রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

কোন পথে আফগানিস্তান?

এই দৃশ্য শুধু আফগানিস্তান নয় পুরো বিশ্বকেই চোখ রাঙায়
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণার পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে কোন পথে এখন আফগানিস্তান? এই সৈন্য প্রত্যাহার কি আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে আদৌ কোনো সাহায্য করবে? প্রেসিডেন্ট ওবামার এই সিদ্ধান্ত খোদ যুক্তরাষ্ট্রে বিশেষ করে তার সামরিক উপদেষ্টাদের অনেককে অবাক করেছে এবং তারা এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। ওবামার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ বছর ১০ হাজার মার্কিন সৈন্য দেশে ফিরে আসবে। আর বাকি ২৩ হাজার সেনা ফিরে আসবে আগামী সেপ্টেম্বরের (২০১২) আগে। এরপরও সেখানে মার্কিন সৈন্য থাকবে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন সৈন্য আফগানিস্তানে নিয়োজিত রয়েছে। ২০০৯ সালে সেখানে যে বাড়তি ৩৩ হাজার সৈন্য পাঠানো হয়েছিল, সেই বাড়তি সেনাই প্রত্যাহার করে নিলেন ওবামা। এর মধ্য দিয়ে আফগানিস্তান অভিযান সমাপ্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে তিনি ঘোষণা করেছেন এবং তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, ২০১৫ সালের আগেই আফগান বাহিনীর হাতে দেশটির নিরাপত্তার দায়িত্ব তুলে দেওয়া হবে এবং ওঝঅঋ (ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঝবপঁৎরঃু অংংরংঃধহপব ঋড়ৎপব) এর আওতাধীন আফগানিস্তানে অবস্থানরত সব বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। বলা ভালো, আফগানিস্তানে ক্ষমতাসীন তালেবানরা ৯/১১ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দিয়েছে, এই অভিযোগ তুলে ২০০১ সালের অক্টোবরে আফগানিস্তানে বিমান হামলা চালিয়ে দেশটি দখল করে নিয়েছিল এবং ডিসেম্বর (২০০১) হামিদ কারজাইয়ের নেতৃত্বে একটি \'পুতুল সরকারকে\' সেখানে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। কিন্তু গত দশ বছরে আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হয়নি। অনেকেই এখন বারাক ওবামার ঘোষণার সঙ্গে সাবেক সোভিয়েত নেতা মিখাইল গরবাচেভের একটি ঘোষণার (১৯৮৮) মিল খুঁজতে পারেন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান দখল করে নিয়েছিল ১৯৭৯ সালে। আর ১৯৮৮ সালে গরবাচেভ আফগানিস্তান থেকে সব সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহারের (যা কার্যকর হয়েছিল ১৯৮৯ সালে) ঘোষণা দিয়েছিলেন। গত ৩৩ বছর ধরে সেখানে যুদ্ধ চলছে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনাবাহিনী আফগানিস্তান ছেড়ে গেলেও যুদ্ধ থামেনি। আজ ২০১২ বা ২০১৫ সালে সব বিদেশি সৈন্য আফগানিস্তান ছেড়ে গেলেও সেখানে যুদ্ধ থামবে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
বিশ্বমানচিত্রে আফগানিস্তান

দুটি কারণে ওবামা মূলত এই সিদ্ধান্তটি নিয়েছেন। এক. ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং ওবামা দ্বিতীয় টার্মের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত সেখানে তার ইমেজ বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। দুই. আফগান যুদ্ধের বিপুল খরচ বহন করা নিয়ে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই এখন কথাবার্তা হচ্ছে, যা নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে। যদি খরচের হিসাব দেওয়া যায়, তা খুব আশার কথা বলে না। যেখানে ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য চাকরির সংস্থান করতে পারছেন না, সেখানে ইরাক ও আফগান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতির পরিমাণ ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার। চলতি বছর আফগান যুদ্ধের জন্য বাজেট বরাদ্দ হচ্ছে ১২০ মিলিয়ন ডলার। ঝঞজঅঞ ঋঙজ নামে একটি গবেষণা সংস্থা তাদের এক প্রতিবেদনে (২৩ জুন, ১১) জানিয়েছে, আফগানিস্তানে অবস্থানরত একজন মার্কিন সৈন্যের জন্য বছরে খরচ হয় ১ মিলয়ন ডলার। এক গ্যালন তেল যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর কাছে সরবরাহে (পরিবহন, নিরাপত্তা ইত্যাদি) খরচ হয় প্রায় ৪০০ ডলার। অপর একজন গবেষক দেখিয়েছেন, আফগানিস্তানে ২০১১-১২ অর্থবছরে যে অর্থ ব্যয় হবে তা দিয়ে নিম্নোক্ত কাজগুলো করা সম্ভব : ১. নিম্নআয়ের পরিবারে জন্মগ্রহণকারী ৫৭ দশমিক ৯ মিলিয়ন শিশুর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, ২. ২০২ মিলিয়ন ছাত্রকে তাদের উচ্চশিক্ষাসম্পন্ন করতে সাড়ে ৫ হাজার ডলার করে সাহায্য দেওয়া, ৩. ১৪ দশমিক ৩৫ মিলিয়ন বয়স্ক মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া, ৪. প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর জন্য আরও ১ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন শিক্ষক নিয়োগ করা, ৫. ১ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন পুলিশ অফিসার নিয়োগ করা এবং ৬. ৬৭ দশমিক ৮ মিলিয়ন বাড়িঘরে সস্তায় \'সবুজ জ্বালানি\' (সৌরবিদ্যুৎ) সরবরাহ করা। আফগান যুদ্ধের খরচ অবশ্যই একটি ফ্যাক্টর।
কিন্তু এরপর কী? যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফ্রান্সও জানিয়ে দিয়েছে, তারাও সৈন্য প্রত্যাহার করবে। আর ব্রিটেন তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে ২০১৪ সালে। আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই ওবামার এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন। কিন্তু কারজাই এই সিদ্ধান্তে যতই সন্তুষ্ট হন না কেন, আফগান সেনাবাহিনী তালেবানদের মোকাবেলা করার জন্য যথেষ্ট নয়। কারজাইয়ের পরিণতি হতে পারে অনেকটা ডা. নজিবুল্লাহর মতো, যিনি আফগানিস্তানে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণে ১৯৮৬ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। তালেবানরা ১৯৯২ সালের ১৫ এপ্রিল তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। পরে তাকে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয়।
যুক্তরাষ্ট্র সরকার অনেক দিন ধরেই চেষ্টা করছে, তালেবানদের সঙ্গে একটি সমঝোতায় যেতে। প্রাথমিকভাবে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হলেও কোনো সমঝোতা হয়নি। সমস্যা হচ্ছে_ আফগানিস্তানে একাধিক তালেবান গ্রুপ সক্রিয়। এরা আবার গোষ্ঠীকেন্দ্রিকভাবে বিভক্ত। মোল্লা ওমরের নেতৃত্বাধীন অংশ দক্ষিণ আফগানিস্তানে সক্রিয়। গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের নেতৃত্বাধীন হেজবে ইসলামী গ্রুপ সক্রিয় কুবার ও কান্দাহার প্রদেশে। উত্তর ওয়াজিরিস্তানে সক্রিয় হাক্কানি নেটওয়ার্ক, যার নেতৃত্বে রয়েছে বাবা-ছেলে জালালুদ্দিন হাক্কানী ও সিরাজুদ্দিন হাক্কানি। পাকিস্তানপন্থি তালেবানদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ রয়েছে এবং পাকিস্তানের ঋঅঞঅ অঞ্চলে এরা আশ্রয় পায়। বিশেষ করে সোয়াত ও বাজুর এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে \'তেহরিক-ই-নিফাজ-ই সারিয়াত-ই মোহাম্মদি\'। নেতৃত্বে রয়েছেন সুফি মোহাম্মদ। দুটি বিচ্ছিন্ন গ্রুপও এ অঞ্চলে তৎপর, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন ফজলুল্লাহ (ধারণা করা হয় নিহত) ও মৌলভী ফকির মোহাম্মদ। কাশ্মীরে তৎপর লস্কর-ই-তৈয়বার সঙ্গেও এদের যোগাযোগ রয়েছে। সেই সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে \'তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান\'-এর মতো সংগঠনগুলোর সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্র এখন কোন গ্রুপের সঙ্গে সমঝোতায় যাবে? মূলধারার (মোল্লা ওমর) শীর্ষ পর্যায়ের দু\'একজন নেতার সঙ্গে পরোক্ষ আলোচনা হলেও তা কোনো ফল দেয়নি। তাই একটা বড় প্রশ্ন রয়েই গেল। যুক্তরাষ্ট্র সাধারণ আফগানদের জন্য কিছু কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করলেও (স্বাস্থ্যসেবা, স্কুল নির্মাণ, রাস্তাঘাট তৈরি, চাকরি) তা ব্যাপক জনসমর্থন পায়নি। সেখানে অর্থের অপচয় হয়েছে মাত্র। এখন ওবামার সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত মার্কিন রাজনীতিতে তার অবস্থানকে শক্তিশালী করবে হয়তো, কিন্তু আফগান সমস্যার কোনো সমাধান ডেকে আনবে না। আগামী ২০১২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে জনসমর্থন বাড়াতে ওবামা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আফগান যুদ্ধে এ যাবৎ এক হাজার ৬০০-এর বেশি মার্কিন সেনা নিহত হয়েছেন। ১২ হাজার সেনা আহত হয়েছেন। এর একটি প্রতিক্রিয়া আছে। ভুলে গেলে চলবে না, আফগানিস্তানে যথেষ্ট মার্কিনি স্বার্থ রয়েছে। মধ্য এশিয়ায় রয়েছে বিপুল জ্বালানি (তেল ও গ্যাস) সম্পদ। এই জ্বালানি সম্পদের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রয়েছে। হেরাত ও হেলমান্দ প্রদেশে তারা নতুন দুটি বিমানবন্দর নির্মাণ করেছে। কিরঘিজস্তানের মানাস বিমানবন্দর তারা ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরিভাবে আফগানিস্তান পরিত্যাগ করবে, এটা আমি মনে করি না। ২০১২ সালের নির্বাচনের পর নতুন করে যদি আফগান স্ট্র্যাটেজি রচিত হয়, আমি অবাক হবো না। মনে রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী এখনও আফগান থেকে সেনা প্রত্যাহারের বিরোধী।
সুত্রঃ দৈনিক সমকাল ,৩রা জুলাই ২০১১।
প্রফেসর ড. তারেক শামসুর রেহমান 
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
www.tsrahmanbd.blogspot.com

0 comments:

Post a Comment