সোনিয়া গান্ধীর বাংলাদেশ সফরের মধ্যে দিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নতুন একটি মাত্রা পেয়েছে। সোনিয়া গান্ধী ভারত সরকারের কোনো পদে নেই। তিনি কংগ্রেসের সভাপতি। তার বাংলাদেশ সফরও কোনো রাষ্ট্রীয় সফর ছিল না। অটিজম সম্মেলনে যোগ দিতে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি চলেও গেছেন গত ২৫ জুলাই। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তার এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা তিনি কংগ্রেসের সভাপতি হলেও, তার পরিচয় তিনি ভারতের ঐতিহ্যবাহী নেহেরু পরিবারের সদস্য, সবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পুত্রবধূ, রাজীব গান্ধীর স্ত্রী ও 'ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী' রাহুল গান্ধীর মা। মূলত তার এসব পরিচয়ই তাকে শুধু ভারতেই নয়, বরং বিশ্বে আরো বেশি করে পরিচিত করেছে। ঢাকায় অবস্থানকালে তিনি ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষ থেকে 'বাংলাদেশ স্বাধীনতা সম্মাননা' পদক গ্রহণ করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে অবিস্বরণীয় অবদানের স্বীকৃতিসরূপ ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে প্রায় দু'শ ভরি ওজনের স্বর্ণের তৈরি পদকটি দেয়া হয়। অনেক দেরীতে হলেও বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধীর অবদানকে স্মরণ করলো। বাংলাদেশের এই ভূমিকা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে আরো অনেক উচ্চতায় নিয়ে যাবে।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নানা জটিলতায় আটকে আছে। সোনিয়া গান্ধীর এই সফরের মধ্যে দিয়ে এ জটিলতা কতটুকু দূর হবে, তা ভবিষ্যৎই বলবে। কিন্তু এটা সত্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত (জানুয়ারি ২০১০) সফরের পর এই দুটি দেশের মাঝে সম্পর্ক নতুন একটি দিকে টার্ন নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নয়াদিলি্লতে ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। ইতিমধ্যে ট্রানজিট চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যদিও এটা নির্ধারিত হয়নি 'ট্রানজিট ফি' আমরা কতটুকু নির্ধারণ করবো। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর ঢাকায় এসেছিলেন ভারত সরকারের অত্যন্ত ক্ষমতাধর ব্যক্তি প্রণব মুখার্জি। ভারত যে ১০০ কোটি ডলারের সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছিল, সে ব্যাপারে একটি চুক্তি করতেই ঢাকায় এসেছিলেন প্রণব মুখার্জি। এরপর গত ৮ জুলাই ঢাকা সফর করে গেলেন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণা। ২৯ জুলাই আসছেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিদাম্বরম। সেপ্টেম্বর মাসে আসছেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। মাঝখানে ভারতীয় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীরও ঢাকা সফর করার কথা। বলা হচ্ছে পি. চিদাম্বরমের ঢাকা সফরের সময় একটি 'বর্ডার ম্যানেজমেন্ট প্লান' সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। অতীতে কখনই এত স্বল্প সময়ের ব্যবধানে এত বিপুল সংখ্যক ভারতীয় ভিআইপি বাংলাদেশ সফর করেননি। কৃষ্ণার সফরের প্রাক্কালেও বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশিদের হত্যা অব্যাহত ছিল। ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত বিএসএফের হাতে ১৭ জন বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন। আর চলতি মাসের প্রথম ৬ দিনে প্রাণ হারিয়েছেন আরো ২ জন বাংলাদেশি। আর আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তো সংসদে স্বীকার করেছেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২৬ মাসে সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে ১৩৬ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন আরো ১৭০ জন (আমার দেশ, ৭ জুলাই)। কিশোরী ফেলানিকে পাখির মতো গুলি করে তার মৃতদেহ কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বিশ্বের মানুষ এ ঘটনায় বিস্ময় ও হতবাক হলেও, ঢাকার সেগুনবাগিচায় কর্মরত কর্তাব্যক্তিদের টনক তাতে নড়েনি। তাৎক্ষণিকভাবে ভারতীয় হাইকমিশনারকে ডেকে আমাদের পররাষ্ট্র-সচিব 'সাহস' পেলেন না প্রতিবাদ জানাতে। যদিও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ মানববন্ধন করে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। আজ আমাদের দীপু মনির সঙ্গে বসে কৃষ্ণা বাবু যখন বললেন, 'সীমান্ত হত্যা বন্ধে দুই দেশকে দায়িত্ব নিতে হবে, তখন আমাদের দীপু মনি 'সাহস' করে বলতে পারলেন না একজন ভারতীয় নাগরিককে কখনো হত্যা করেনি বাংলাদেশের বর্ডার গার্ড। আমাদের দুঃখটা এখনেই_ আমাদের নেতা-নেত্রীরা সাহস করে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা বলতে পারেন না।
কৃষ্ণার সফরকালে দুটি চুক্তি হয়েছে। একটি যৌথ বিনিয়োগ সংক্রান্ত আর দ্বিতীয়টি ভুটানের যানবাহন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ সংক্রান্ত। এই দুটি চুক্তি থেকে আমাদের লাভ কতটুকু তা আগামী দিনই বলতে পারবো। তবে ভারতের ভূমি সংক্রান্ত চুক্তি আগেও হয়েছিল, কাজ হয়নি। আমাদের বলা হলো ভারতীয় ১০০ কোটি ঋণ সংক্রান্ত প্রকল্প চূড়ান্ত হবে মনমোহন সিংয়ের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সফরের সময়। বলা হলো তিস্তার পানি বণ্টন নিয়েও একটি চুক্তি হবে ওই সময়। ভারতীয় ঋণ চুক্তি নিয়ে যে জটিলতা, সিরিয়াস পাঠকরা এ সম্পর্কে মোটামুটি জানেন। তাই এ বিষয় আলোকপাত করলাম না। কিন্তু আমার শঙ্কা তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে। একটি চুক্তি হবে_ এটা আমার কথা। কিন্তু তাতে আমাদের স্বার্থ রক্ষিত হবে কী? ইতিমধ্যে দুদেশের পানিসম্পদ সচিবরা একটি খসড়া চুক্তিতে উপনীত হয়েছেন বলে আমরা জানতে পেরেছি। কিন্তু এর খুঁটিনাটি আমরা জানি না। এর জন্য আলোচনার পথও সরকার তৈরি করে দেয়নি। সংসদেও আলোচনার কোনো সুযোগ তৈরি হয়নি। আশঙ্কা করছি ফারাক্কা চুক্তির মতোই তিস্তা চুক্তি আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হবে। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে প্রথম যখন সরকার গঠন করে, তখন তড়িঘড়ি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নয়াদিলি্লতে গিয়ে একটি চুক্তি করেছিলেন (১৯৯৬, ডিসেম্বর)। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী পানি আমরা কোনো দিনই পাইনি। ওই চুক্তির আগে ১৯৯৬ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে পদ্মায় পানির সর্বনিম্ন প্রবাহ যেখানে ছিল ৯.৪৫ মিটার, সেখানে ২০১১ সালের মে মাসে রাজশাহীর রামপুর-বোয়ালিয়া পয়েন্টে পানির প্রবাহ মাত্র ৮.৯২ মিটার (আমার দেশ, ১৬ মে, ১১)। ভারতের পানি প্রত্যাহারের ফলে একটা পর্যায়ে এসে পানি আরো কমে যাবে। ওই চুক্তি করে লাভবান হলো ভারত, আর আমরা আমাদের পানির হিস্যা হারালাম। এখন ভয় হচ্ছে তিস্তা নিয়েও এমন একটি চুক্তি হয় কী না। চুক্তি করলেই স্বার্থ রক্ষিত হয় না। ফারাক্কা চুক্তি এর বড় প্রমাণ।
শুধু তিস্তার চুক্তির কথা কেন বলি, ভারতের সঙ্গে আমাদের সমস্যা একাধিক। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী কৃষ্ণার সফরের সময় এর কোনোটি নিয়েও কোনো আলোচনা হয়নি। ট্রানজিট চুক্তির বিনিময়ে ইতিমধ্যে আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে ত্রিপুরায় ওভার ডাইমেনশনাল (ওডিসি), পরিবহন চলাচল শুরু হয়েছে। কিন্তু ট্রানজিট ফি কত হবে, তা আজো নির্ধারিত হয়নি। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ৬.৫ কিলোমিটার সীমানা আজো চিহ্নিত হয়নি। ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল রয়েছে, যার জমির পরিমাণ ৭ হাজার ১১০ একর। ওইসব ছিটমহল আজো বাংলাদেশের মূল ভূখ-ের সঙ্গে সংযুক্ত হয়নি। তিনবিঘা করিডরের ওপর একটি ফ্লাইওভার নির্মাণের সিদ্ধান্ত হলেও তা এখনো কার্যকরী হয়নি। বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য ভারতের অনুকূলে। বাণিজ্য ভারসাম্য কমিয়ে আনতে ভারতের কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা থাকলেও নানা ধরনের ট্রারিফ ও প্যারাট্যারিফের কারণে সেই পণ্য ভারতের বাজারে প্রবেশ করতে পারছে না। কৃষ্ণার বাংলাদেশ সফরের সময় এসব বিষয় নিয়ে আদৌ আলোচনা হয়নি। বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও প্রশ্নগুলো উত্থাপন করা হয়নি। এখন মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় আমরা কী পাব, সে ব্যাপারেও নিশ্চিত হতে পারছি না। কেননা কৃষ্ণার সফরের সময়ই মনমোহন সিংয়ের সফরের খুঁটিনাটি চূড়ান্ত হয়েছে। মনমোহন আসবেন শুধু চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য।
আমরা বারবার বলে আসছি, আমরা ভারতের বন্ধুত্ব চাই। কিন্তু সেই বন্ধুত্ব হতে হবে সমমর্যাদার ভিত্তিতে। বাংলাদেশ ছোট দেশ হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের একজন ড. ইউনূস আছেন, যিনি বাংলাদেশকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছেন। আমাদের সেনাবাহিনী বিশ্বে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে। পোশাক শিল্পে আমাদের দক্ষতা আমরা প্রমাণ করেছি। তাই বাংলাদেশকে ছোট করে দেখা যাবে না। ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় আমাদের দক্ষতা প্রমাণ করতে হবে। এখন একটি সেমিনারে অংশ নিতে ঢাকা সফর করে গেলেন সোনিয়া গান্ধী। আমরা তাকে স্বাগত জানাই। বেশ কিছুদিন আগে রাহুল গান্ধীও ঢাকা ঘুরে গিয়েছিলেন। সেদিন তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। বাংলাদেশ যে পারে, আমরা তো তা প্রমাণ করেছি। এখন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রমাণ দেখানোর পালা। সেপ্টেম্বর হতে আর খুব বাকি নেই। আমরা প্রত্যাশা করবো মনমোহন সিং ঢাকায় এসে আমাদের আশার কথা শোনাবেন। যে বক্তব্য রেখে তিনি বাংলাদেশকে 'ছোট' করেছিলেন, এখন তাকেই উদ্যোগ নিতে হবে বাংলাদেশের মানুষের আস্থা অর্জন করতে। সোনিয়া গান্ধী নিজেও দেখে গেলেন বাংলাদেশের জনগণের ভালোবাসা। আমরা অকৃতজ্ঞ জাতি নই। আমরা ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকাকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেছি। সোনিয়া গান্ধী পারেন একটি বড় ভূমিকা নিতে। তিনি সরকারে না থাকলেও, তিনিই মূল ব্যক্তি। তার সিদ্ধান্তের বাইরে মনমোহন সিং কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। এখন সোনিয়া গান্ধীর সফরের পর বিরাজমান সমস্যার সমাধানে ভারত সরকারের একটি বড় উদ্যোগ আমরা দেখতে চাই। আমরা আশা করি, মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরও সফল হবে এবং আমরা ভারতের ওপর আস্থা রাখতে পারবো।
ড. তারেক শামসুর রেহমান,
অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নানা জটিলতায় আটকে আছে। সোনিয়া গান্ধীর এই সফরের মধ্যে দিয়ে এ জটিলতা কতটুকু দূর হবে, তা ভবিষ্যৎই বলবে। কিন্তু এটা সত্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত (জানুয়ারি ২০১০) সফরের পর এই দুটি দেশের মাঝে সম্পর্ক নতুন একটি দিকে টার্ন নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নয়াদিলি্লতে ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। ইতিমধ্যে ট্রানজিট চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যদিও এটা নির্ধারিত হয়নি 'ট্রানজিট ফি' আমরা কতটুকু নির্ধারণ করবো। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর ঢাকায় এসেছিলেন ভারত সরকারের অত্যন্ত ক্ষমতাধর ব্যক্তি প্রণব মুখার্জি। ভারত যে ১০০ কোটি ডলারের সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছিল, সে ব্যাপারে একটি চুক্তি করতেই ঢাকায় এসেছিলেন প্রণব মুখার্জি। এরপর গত ৮ জুলাই ঢাকা সফর করে গেলেন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণা। ২৯ জুলাই আসছেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিদাম্বরম। সেপ্টেম্বর মাসে আসছেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। মাঝখানে ভারতীয় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীরও ঢাকা সফর করার কথা। বলা হচ্ছে পি. চিদাম্বরমের ঢাকা সফরের সময় একটি 'বর্ডার ম্যানেজমেন্ট প্লান' সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। অতীতে কখনই এত স্বল্প সময়ের ব্যবধানে এত বিপুল সংখ্যক ভারতীয় ভিআইপি বাংলাদেশ সফর করেননি। কৃষ্ণার সফরের প্রাক্কালেও বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশিদের হত্যা অব্যাহত ছিল। ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত বিএসএফের হাতে ১৭ জন বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন। আর চলতি মাসের প্রথম ৬ দিনে প্রাণ হারিয়েছেন আরো ২ জন বাংলাদেশি। আর আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তো সংসদে স্বীকার করেছেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২৬ মাসে সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে ১৩৬ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন আরো ১৭০ জন (আমার দেশ, ৭ জুলাই)। কিশোরী ফেলানিকে পাখির মতো গুলি করে তার মৃতদেহ কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বিশ্বের মানুষ এ ঘটনায় বিস্ময় ও হতবাক হলেও, ঢাকার সেগুনবাগিচায় কর্মরত কর্তাব্যক্তিদের টনক তাতে নড়েনি। তাৎক্ষণিকভাবে ভারতীয় হাইকমিশনারকে ডেকে আমাদের পররাষ্ট্র-সচিব 'সাহস' পেলেন না প্রতিবাদ জানাতে। যদিও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ মানববন্ধন করে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। আজ আমাদের দীপু মনির সঙ্গে বসে কৃষ্ণা বাবু যখন বললেন, 'সীমান্ত হত্যা বন্ধে দুই দেশকে দায়িত্ব নিতে হবে, তখন আমাদের দীপু মনি 'সাহস' করে বলতে পারলেন না একজন ভারতীয় নাগরিককে কখনো হত্যা করেনি বাংলাদেশের বর্ডার গার্ড। আমাদের দুঃখটা এখনেই_ আমাদের নেতা-নেত্রীরা সাহস করে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা বলতে পারেন না।
কৃষ্ণার সফরকালে দুটি চুক্তি হয়েছে। একটি যৌথ বিনিয়োগ সংক্রান্ত আর দ্বিতীয়টি ভুটানের যানবাহন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ সংক্রান্ত। এই দুটি চুক্তি থেকে আমাদের লাভ কতটুকু তা আগামী দিনই বলতে পারবো। তবে ভারতের ভূমি সংক্রান্ত চুক্তি আগেও হয়েছিল, কাজ হয়নি। আমাদের বলা হলো ভারতীয় ১০০ কোটি ঋণ সংক্রান্ত প্রকল্প চূড়ান্ত হবে মনমোহন সিংয়ের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সফরের সময়। বলা হলো তিস্তার পানি বণ্টন নিয়েও একটি চুক্তি হবে ওই সময়। ভারতীয় ঋণ চুক্তি নিয়ে যে জটিলতা, সিরিয়াস পাঠকরা এ সম্পর্কে মোটামুটি জানেন। তাই এ বিষয় আলোকপাত করলাম না। কিন্তু আমার শঙ্কা তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে। একটি চুক্তি হবে_ এটা আমার কথা। কিন্তু তাতে আমাদের স্বার্থ রক্ষিত হবে কী? ইতিমধ্যে দুদেশের পানিসম্পদ সচিবরা একটি খসড়া চুক্তিতে উপনীত হয়েছেন বলে আমরা জানতে পেরেছি। কিন্তু এর খুঁটিনাটি আমরা জানি না। এর জন্য আলোচনার পথও সরকার তৈরি করে দেয়নি। সংসদেও আলোচনার কোনো সুযোগ তৈরি হয়নি। আশঙ্কা করছি ফারাক্কা চুক্তির মতোই তিস্তা চুক্তি আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হবে। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে প্রথম যখন সরকার গঠন করে, তখন তড়িঘড়ি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নয়াদিলি্লতে গিয়ে একটি চুক্তি করেছিলেন (১৯৯৬, ডিসেম্বর)। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী পানি আমরা কোনো দিনই পাইনি। ওই চুক্তির আগে ১৯৯৬ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে পদ্মায় পানির সর্বনিম্ন প্রবাহ যেখানে ছিল ৯.৪৫ মিটার, সেখানে ২০১১ সালের মে মাসে রাজশাহীর রামপুর-বোয়ালিয়া পয়েন্টে পানির প্রবাহ মাত্র ৮.৯২ মিটার (আমার দেশ, ১৬ মে, ১১)। ভারতের পানি প্রত্যাহারের ফলে একটা পর্যায়ে এসে পানি আরো কমে যাবে। ওই চুক্তি করে লাভবান হলো ভারত, আর আমরা আমাদের পানির হিস্যা হারালাম। এখন ভয় হচ্ছে তিস্তা নিয়েও এমন একটি চুক্তি হয় কী না। চুক্তি করলেই স্বার্থ রক্ষিত হয় না। ফারাক্কা চুক্তি এর বড় প্রমাণ।
শুধু তিস্তার চুক্তির কথা কেন বলি, ভারতের সঙ্গে আমাদের সমস্যা একাধিক। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী কৃষ্ণার সফরের সময় এর কোনোটি নিয়েও কোনো আলোচনা হয়নি। ট্রানজিট চুক্তির বিনিময়ে ইতিমধ্যে আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে ত্রিপুরায় ওভার ডাইমেনশনাল (ওডিসি), পরিবহন চলাচল শুরু হয়েছে। কিন্তু ট্রানজিট ফি কত হবে, তা আজো নির্ধারিত হয়নি। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ৬.৫ কিলোমিটার সীমানা আজো চিহ্নিত হয়নি। ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল রয়েছে, যার জমির পরিমাণ ৭ হাজার ১১০ একর। ওইসব ছিটমহল আজো বাংলাদেশের মূল ভূখ-ের সঙ্গে সংযুক্ত হয়নি। তিনবিঘা করিডরের ওপর একটি ফ্লাইওভার নির্মাণের সিদ্ধান্ত হলেও তা এখনো কার্যকরী হয়নি। বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য ভারতের অনুকূলে। বাণিজ্য ভারসাম্য কমিয়ে আনতে ভারতের কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা থাকলেও নানা ধরনের ট্রারিফ ও প্যারাট্যারিফের কারণে সেই পণ্য ভারতের বাজারে প্রবেশ করতে পারছে না। কৃষ্ণার বাংলাদেশ সফরের সময় এসব বিষয় নিয়ে আদৌ আলোচনা হয়নি। বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও প্রশ্নগুলো উত্থাপন করা হয়নি। এখন মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় আমরা কী পাব, সে ব্যাপারেও নিশ্চিত হতে পারছি না। কেননা কৃষ্ণার সফরের সময়ই মনমোহন সিংয়ের সফরের খুঁটিনাটি চূড়ান্ত হয়েছে। মনমোহন আসবেন শুধু চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য।
আমরা বারবার বলে আসছি, আমরা ভারতের বন্ধুত্ব চাই। কিন্তু সেই বন্ধুত্ব হতে হবে সমমর্যাদার ভিত্তিতে। বাংলাদেশ ছোট দেশ হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের একজন ড. ইউনূস আছেন, যিনি বাংলাদেশকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছেন। আমাদের সেনাবাহিনী বিশ্বে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে। পোশাক শিল্পে আমাদের দক্ষতা আমরা প্রমাণ করেছি। তাই বাংলাদেশকে ছোট করে দেখা যাবে না। ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় আমাদের দক্ষতা প্রমাণ করতে হবে। এখন একটি সেমিনারে অংশ নিতে ঢাকা সফর করে গেলেন সোনিয়া গান্ধী। আমরা তাকে স্বাগত জানাই। বেশ কিছুদিন আগে রাহুল গান্ধীও ঢাকা ঘুরে গিয়েছিলেন। সেদিন তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। বাংলাদেশ যে পারে, আমরা তো তা প্রমাণ করেছি। এখন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রমাণ দেখানোর পালা। সেপ্টেম্বর হতে আর খুব বাকি নেই। আমরা প্রত্যাশা করবো মনমোহন সিং ঢাকায় এসে আমাদের আশার কথা শোনাবেন। যে বক্তব্য রেখে তিনি বাংলাদেশকে 'ছোট' করেছিলেন, এখন তাকেই উদ্যোগ নিতে হবে বাংলাদেশের মানুষের আস্থা অর্জন করতে। সোনিয়া গান্ধী নিজেও দেখে গেলেন বাংলাদেশের জনগণের ভালোবাসা। আমরা অকৃতজ্ঞ জাতি নই। আমরা ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকাকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেছি। সোনিয়া গান্ধী পারেন একটি বড় ভূমিকা নিতে। তিনি সরকারে না থাকলেও, তিনিই মূল ব্যক্তি। তার সিদ্ধান্তের বাইরে মনমোহন সিং কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। এখন সোনিয়া গান্ধীর সফরের পর বিরাজমান সমস্যার সমাধানে ভারত সরকারের একটি বড় উদ্যোগ আমরা দেখতে চাই। আমরা আশা করি, মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরও সফল হবে এবং আমরা ভারতের ওপর আস্থা রাখতে পারবো।
ড. তারেক শামসুর রেহমান,
অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
0 comments:
Post a Comment