বাংলাদেশ আবার হরতালের রাজনীতিতে প্রবেশ করেছে। গত ৬ ও ৭ জুলাই চারদলীয় জোটের হরতাল পালন করার পর, ১০ ও ১১ জুলাই হরতাল পালিত হলো কয়েকটি ইসলামিক দলের আহ্বানে। বিএনপি এই হরতাল সমর্থন করেছিল। সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর থেকে পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস বাদ ইত্যাদি নানা কারণে চারদলীয় জোট তথা ইসলামিক দলগুলো এ হরতাল আহ্বান করেছিল। গত ৬ জুলাই হরতাল চলাকালে একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক প্রহৃত হয়েছেন পুলিশ বাহিনী দ্বারা। টিভি পর্দায় এ দৃশ্য যারা দেখেছেন, তারা মর্মাহত না হয়ে পারবেন না। একজন জনপ্রতিনিধিকে একজন পুলিশ অফিসার এভাবে 'শার্টের কলার ধরে টানবেন' 'শুয়োরের বাচ্চা' বলে গালি দেবেন, তা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য ও সমর্থনযোগ্য নয়। 'ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সি' অনুযায়ী একজন সংসদ সদস্যের অবস্থান অনেক ঊধর্ে্ব। তিনি ভিআইপি। রাষ্ট্র তাকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। তিনি বিরোধী দলে থাকতে পারেন, কিন্তু তাই বলে তার প্রায় সন্তানতুল্য একজন এসি তাকে গালাগাল করবেন, এটা শোভন নয়, বরং সব সংসদ সদস্যের জন্য এ ঘটনা অপমানজনক। একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। তদন্ত কমিটি কী রিপোর্ট দেবে, আমরা তা জানি না। কিন্তু টিভি প্রতিবেদনগুলো সাক্ষী সেদিন অভিযুক্ত দুই পুলিশ অফিসার সংসদ এলাকায় কী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তদন্তের স্বার্থেই এদের দুজনকে চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা উচিত। নচেৎ এরা তদন্তে প্রভাব খাটাতে পারেন।
স্পষ্টতই বাংলাদেশের রাজনীতি ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠছে। সংবিধান সংশোধন নিয়ে যে সমঝোতার প্রয়োজন ছিল, তা হয়নি। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অবস্থান এখন মুখোমুখি। প্রধানমন্ত্রী বিএনপিকে সংসদে এসে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু সেই সুযোগ এখন আর নেই। সংসদে এসে সংবিধান নিয়ে আলোচনা করার এখন কোনো অর্থ নেই। সংবিধান ইতিমধ্যে সংশোধিত হয়ে গেছে। এখন সংসদে আলোচনা করেও সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করা যাবে না। তবে সংবিধান নয়, বরং আগামী নির্বাচন নিয়ে একটি সমঝোতায় আসা সম্ভব। অতীত থেকে আমরা এতটুকুও শিক্ষা নেইনি। দেয়ালের লিখন থেকেও আমরা এতটুকু শিখিনি। যারা সরকারে থাকে, তাদের কিছুটা সহনশীল হতে হয়। বিরোধী দলকে আস্থায় নেয়ার মানসিকতা থাকতে হয়। গণতন্ত্রের এই স্পিরিট আমাদের দেশে কার্যকর হচ্ছে না। তাই অবশ্যম্ভাবীভাবে ফিরে আসছে ২০০৬ সালের অক্টোবরের সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি (২)। আজ আমাদের রাজনীতিবিদরা যদি দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে না পারেন, তাহলে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে আমাদের। তাই একটা সমঝোতা জরুরি।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীকে সামনে রেখেও এই সমঝোতা সম্ভব। সরকার সিদ্ধান্ত নিতে পারে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দলীয়ভাবে হবে না। নির্বাচন পরিচালনা করবে একটি নিরপেক্ষ কাউন্সিল। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে এই নিরপেক্ষ কাউন্সিল গঠিত হতে পারে। বিকল্প হিসেবে সাবেক একজন প্রধান বিচারপতির (সর্বশেষ প্রধান বিচারপতি নন) নেতৃত্বে একটি 'এলডার্স কাউন্সিল' গঠিত হতে পারে, যারা নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনা করবেন। এই 'এলডার্স কাউন্সিল' তিন অথবা পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট হতে পারে। দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিরাই এ কাউন্সিলে অন্তর্ভুক্ত হবেন। এ-সংক্রান্ত একটি বিল সংসদে উপস্থাপিত হতে পারে। শরিক দলের কোনো সদস্য এ বিল উপস্থাপন করতে পারেন। সরকার ওই প্রস্তাবে সমর্থন জানাতে পারে। এতে করে সরকারের সৎ উদ্দেশ্য প্রমাণিত হবে। কিংবা বিরোধী দল হিসেবে সংসদে উপস্থিত এলডিপি সদস্য কর্নেল অলি আহমদও এ ধরনের একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করতে পারেন। অথবা স্পিকার নিজ উদ্যোগে দুই পক্ষের সঙ্গে আলোচনার একটি উদ্যোগ নিতে পারেন। তিনি সরাসরি বিএনপির সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে পারেন। এতে বরফ গলতে পারে। বিকল্প হিসেবে প্রেসিডেন্ট নিজেও একটি উদ্যোগ নিতে পারেন। সাংবিধানিকভাবে তার কোনো ক্ষমতা নেই। কিন্তু তিনি তো জাতির অভিভাবক। সংকট মুহূর্তে তার একটি নিরপেক্ষ ভূমিকা জাতি আশা করতেই পারে। আমার বিশ্বাস এর যে কোনো একটি সমঝোতার দুয়ার খুলে দিতে পারে।
আমি সরকারের ভূমিকাকে বেশি গুরুত্ব দিতে চাই। সরকারকে অবশ্যই নমনীয় হতে হবে। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সবকিছু সম্পন্ন করা ঠিক নয়। অতীত অভিজ্ঞতা বলে কেউ কখনো জোর করে ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। বাংলাদেশের ৪০ বছরের ইতিহাস অনেক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে। এরশাদ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিলেন বটে, কিন্তু গণঅসন্তোষ তাকে ক্ষমতায় থাকতে দেয়নি। বেগম জিয়া ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। অথচ প্রথমদিকে তিনি রাজি ছিলেন না। পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করেছিল। সেদিন শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের ব্যাপারে ছিলেন সোচ্চার। অদৃষ্টের কী নির্মম পরিহাস। যিনি একদিন নিজেকে দাবি করতেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তক হিসেবে, তিনি নিজে এখন এ ব্যবস্থার বিরোধী। শেখ হাসিনা যদি আজ বিরোধী দলে থাকতেন, তিনি কী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অবসান চাইতেন? এটা একটা মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন।
সংসদে সরকারের 'ব্রুট মেজরিটি' রয়েছে। এই ব্রুট মেজরিটি অনেক সময় দলের জন্য মঙ্গলের পরিবর্তে অমঙ্গল ডেকে আনতে পারে। ব্রুট মেজরিটির কারণে সরকার যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করে না। পঞ্চদশ সংশোধনীর ক্ষেত্রে এমনটি হয়েছে বলেই আমার ধারণা। সরকারের যদি ব্রুট মেজরিটি না থাকতো, তাহলে সরকার সিদ্ধান্ত নিতে দু'বার চিন্তা করতো। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী এখন একটা বাস্তবতা। ভালো হয়েছে কী মন্দ হয়েছে, এই বিতর্কে না গিয়ে জটিলতা না বাড়িয়ে বিরোধী দলের সহযোগিতা কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, এটাই বড় প্রশ্ন এখন। হার্ড লাইনে গিয়ে সমস্যার যেমনি কোনো সমাধান করা যায় না, ঠিক তেমনি গণতন্ত্রও বিনির্মাণ করা যায় না। পরপর হরতাল পালন করার মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে সরকারের যদি উপলব্ধি হয়, তাতেই জনগণের মঙ্গল নিহিত। সবচেয়ে বড় কথা, এ মুহূর্তে বিরোধী দলকে আস্থায় নিতে হবে। বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে পেটানোর ঘটনায় অভিযুক্ত দুই পুলিশ অফিসারের যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হয়, তাহলে বিরোধী দলকে আস্থায় নেয়া যাবে না। আমি দিব্যি দিয়ে বলতে পারি, এডিসি হারুন ও এসি বিপ্লব একজন এমপিকে যেভাবে পেটালেন, যেভাবে অপমান করলেন, পিটিয়ে অচেতন করে রাস্তায় শুইয়ে রাখলেন, এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো নির্দেশ ছিল না। এই দুই অফিসার নিজ উদ্যোগে এ কাজটি করেছেন। এটাকে ধামাচাপা দেয়া ঠিক হবে না। শুভবুদ্ধির কোনো মানুষ এ বর্বরোচিত হামলাকে সমর্থন করবে না। এ ঘটনা আবারো প্রমাণ করলো পুলিশ বাহিনীতে রাজনৈতিক ক্যাডাররা রয়ে গেছেন, যারা 'পুলিশের পোশাক'কে ব্যবহার করছেন রাজনৈতিক স্বার্থে। একজন অফিসার, তিনি পুলিশে থাকুন কিংবা প্রশাসনে থাকুন, অতীতে তারা ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন। সেটা কোনো অপরাধ নয়। অপরাধ তিনি যদি তার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ভুলে গিয়ে না থাকেন। সুবিধা নেয়ার জন্য তারা এ কাজটি করেন। সরকারি চাকরিতে থেকেও তারা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন। এটা সুষ্ঠু পুলিশ প্রশাসনের জন্য ভালো নয়। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিশ্চয়ই এটা উপলব্ধি করতে পারবেন। যে ঘটনা ঘটলো, জাতি হিসেবে এটা আমাদের জন্য কলঙ্ক। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তিও এতে নষ্ট হয়েছে। একমাত্র দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদানের মধ্যে দিয়ে একটা আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব।
বাংলাদেশে যে হরতালের রাজনীতি শুরু হয়েছে, তা দেশটির প্রবৃদ্ধিকে আরে শ্লথ করে দেবে। বারবার হরতালের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তৈরি পোশাক শিল্পে এক ধরনের হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে রফতানিতে যে গতি আসবে না, তা বলাই বাহুল্য। এমনিতেই সরকারের গত আড়াই বছরের 'পারফরম্যান্স' ভালো নয়। সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য কমাতে পারেনি। ওএমএসের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। বেকার ও ছদ্মবেকারের সংখ্যা বাড়ছে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে যারা জড়িত, তাদের বিচার করা যায়নি। প্রায় ৩৩ লাখ খুদে বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন। কিন্তু যারা কোটি কোটি টাকা অবৈধ উপায়ে বাজার থেকে তুলে নিলেন তারা দিব্যি চুটিয়ে ব্যবসা করছেন। সরকার এদিকে যদি দৃষ্টি না দেয়, তাহলে তা ভবিষ্যতে সরকারের জন্য কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। বারেবারে হরতাল পালনের মধ্য দিয়ে একটা প্রশ্নই সামনে চলে এলো, তা হচ্ছে_ একটা সমঝোতা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। আর সমঝোতার উদ্যোগটি নিতে হবে সরকারকেই।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment