রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

যে ছবি কথা বলে

গেল ৭ জুলাই বৃহস্পতিবারের সংবাদপত্রগুলোতে যেসব ছবি ছাপা হয়েছে, তা দেখে আমার কাছে একটি প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। তা হচ্ছে, একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির নিরাপত্তা যদি না থাকে, তাহলে আমাদের মতো আমজনতার নিরাপত্তা কোথায়? বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের আহত হওয়ার একাধিক ছবি ছাপা হয়েছে প্রথম পাতায়। কোনোটিতে তাঁর শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। কোনোটিতে শরীর থেকে তাঁর টি-শার্ট খুলে নেওয়া হচ্ছে। কোনোটিতে তিনি অচেতন হয়ে পড়ে আছেন রাস্তায়। ফারুক সাহেব এমপি, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। তিনি একটি সাংবিধানিক পদে আসীন। তাঁকে পুলিশ চিনবে না_এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তিনি মিডিয়ায় যেমনি পরিচিত ব্যক্তি, ঠিক তেমনি পরিচিত পুলিশের কাছেও। জেনেশুনেই পুলিশ তাঁকে পিটিয়েছে। এটা কি পুলিশ পারে? যিনি একটি সাংবিধানিক পদে আছেন, তাঁকে কি পুলিশ পেটাতে পারে! তিনি যদি 'অন্যায়' করে থাকেন, তাহলে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পারত। কিন্তু ছবি মিথ্যা বলে না। ছবিতে স্পষ্ট দেখা গেছে, তাঁর শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। খালি গায়ে তিনি ন্যাম ভবনে আশ্রয় নিলেও পুলিশ সেখানে গিয়েও তাঁকে পেটায়। তাঁর মাথায় ১১টি সেলাই দেওয়া হয়েছে। তিনি এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

জয়নুল আবদিন ফারুক একজন রাজনীতিবিদ। একজন রাজনীতিবিদকে যদি এই পরিণতি বরণ করতে হয়, তাহলে পুলিশের ওপর আস্থার জায়গাটা আমরা রাখতে পারি না। পত্রপত্রিকায় দুজন পুলিশ অফিসারের নাম এসেছে। কালের কণ্ঠ তাদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ওই দুই পুলিশ অফিসারের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা তুলে ধরেছে। এখানে অনেক প্রশ্ন। এক. এডিসি হারুন (তেজগাঁও জোনের দায়িত্বপ্রাপ্ত) কি এককভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, নাকি ঊর্ধ্বতন কোনো পুলিশ অফিসারের নির্দেশে এই কাজটি তিনি করেছেন? এসব ক্ষেত্রে একজন পুলিশ অফিসার একা কোনো সিদ্ধান্ত নেন না। নিতে পারেন না। তাঁকে উপরের নির্দেশ পালন করতে হয়। উপরের নির্দেশ ছাড়া তিনি একা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে জানা দরকার, নির্দেশদাতা কে? এ অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডিসি, নাকি পুলিশের হাইকমান্ড? দুই. সংসদ চলাকালীন সময়ে ওই এলাকায় মিটিং-মিছিল নিষিদ্ধ। এর মধ্যে কোনো অসত্য নেই। সংসদ সদস্য জয়নুল আবদিন ফারুক যদি মিছিল করেও থাকেন (?), তাহলে তাঁকে বাধা দিয়ে আটকে দেওয়া যেত। পুলিশ তো বিএনপি ভবন আটকে দিয়েছিল। প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, কাঁটার বেড়া দিয়ে সংসদ এলাকায় সব ধরনের মিছিল নিষিদ্ধ করা যেত। তা না করে সংসদ সদস্য ফারুকসহ তাঁর সহকর্মীদের জমায়েতের সুযোগ দিয়ে তাঁদের পেটানোর কোনো ব্যাখ্যাই গ্রহণযোগ্য নয়। পুলিশ অপরাধ করেছে। পুলিশ যদি দুঃখ প্রকাশ করত, তা হলে পুলিশ ভালো করত। তিন. সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে পুলিশের এডিসি হারুন ও এসি বিপ্লব সরকার একসময় ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন। আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায়, তখন ছাত্রলীগের এসব সাবেক নেতাকে সংসদ এলাকায় দায়িত্বে নিয়োজিত রাখা ঠিক হয়নি। পুলিশ প্রশাসনের এই উদ্দেশ্য নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে এখন। চার. অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এডিসি হারুনের গ্রিন কার্ড রয়েছে অথবা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব রয়েছে। পুলিশের মতো একটি জননিরাপত্তা সংস্থায় বিদেশি নাগরিকত্ব নেওয়া কোনো ব্যক্তি শীর্ষ পর্যায়ে কাজ করতে পারেন কি? পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এটা কি জানত? যদি না জানা থাকে, তাহলে হারুন সাহেব তথ্য গোপন করেছে। সরকারি চাকরিতে তথ্য গোপন করা একটা অপরাধ। এ ব্যাপারে তাঁর কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া যেতে পারে। এখানে বলা ভালো, আমেরিকায় বাংলাদেশি যাঁরা বসবাস করেন, তাঁদের যৌথ নাগরিকত্বের কোনো সুযোগ নেই।

একজন বাংলাদেশিকে তাঁর বাংলাদেশি পাসপোর্ট সারেন্ডার করেই তাঁকে আমেরিকান নাগরিকত্ব অথবা গ্রিন কার্ড নিতে হয়। পাঁচ. অভিযোগ উঠেছে এসি বিপ্লব সরকার দীর্ঘ আট বছর চাকরিতে 'ফেরারি' থেকে বর্তমান সরকারের আমলে আবার চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁকে চাকরিতে যোগ দেওয়ার অনুমতি দেওয়ায় ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা কি কোনো আইন ভঙ্গ করেছেন? ছয়. সংসদ সদস্য ফারুককে বেধড়ক পেটানোর পরও তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অন্যদিকে অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে তা শেরে বাংলা থানা গ্রহণ করেনি। এর মধ্যে দিয়ে কি পুলিশের এক ধরনের নিরপেক্ষতা বিঘি্নত হলো না? পুলিশ সংসদ সদস্যকে পিটিয়ে অন্যায় করেছে, কি করেনি, তা তদন্তের ব্যাপার। একজন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি কারো বিরুদ্ধে মামলা করতেই পারেন। এ ক্ষেত্রে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা যখন মামলা করতে গেলেন, তখন থানা মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানাল। এর মধ্য দিয়ে কি জাতীয় সংসদকে অবমাননা করা হলো না? সাত. স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, তদন্ত কমিটির যিনি প্রধান তিনি একজন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। একজন পুলিশ অফিসার দিয়ে একজন পুলিশ অফিসারের তদন্ত করা কি 'আইওয়াশ' নয়? এতে করে কি সত্য বেরিয়ে আসবে? অতীতে দেখা গেছে, যখনই পুলিশ অপর একজন পুলিশের তদন্ত করেছে, সেখানে সত্য চাপা পড়ে গেছে। পুলিশ পুলিশের বিরুদ্ধে যায় না। এ ক্ষেত্রে গোষ্ঠীস্বার্থ কাজ করে। সরকারের ভুলটা এখানেই। সরকার বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে একজন বিচারপতির নেতৃত্বে যদি একটি কমিটি গঠন করত, তা হলে সরকারের সৎ উদ্দেশ্য প্রমাণিত হতো। আট. সংসদ এলাকায় সংঘটিত কোনো ঘটনায় স্পিকারের কি কোনো ভূমিকা আছে? তাঁর ভূমিকা কি শুধু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা? নয়. পুলিশের হাতে তো লাঠি থাকার কথা নয়। তাহলে কি পেটানোর উদ্দেশ্যেই পুলিশ লাঠি হাতে 'ডিউটি'তে নিয়োজিত ছিল? দশ. খবরের কাগজে সংবাদ বেরিয়েছে, যে কয়েকজন কনস্টেবল সংসদ সদস্যকে লাথি মারতে থাকে। কোনো কোনো কাগজে ওইসব কনস্টেবলের পেটানোর দৃশ্যও (সকালের খবর) ছাপা হয়েছে। এখন ওই কনস্টেবলেরও বিচার হবে?

আমি আরো মর্মাহত হয়েছি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও আইজির মন্তব্যে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, 'পুলিশের ওপর এমন হামলা অতীতে কখনো হয়নি।' স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বললেন, 'হামলায় বিএনপি নেতাদের উস্কানি ছিল। পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালন করেছে।' আর আইজিও এঁদের কথার প্রতিধ্বনিত করেছেন মাত্র। আমি এঁদের সবার কাছ থেকে আরো অনেক 'ম্যাচিওরড' বক্তব্য আশা করেছিলাম। একটি ঘটনা ঘটে গেছে। এটা নিয়ে পরস্পরকে দোষারোপ করার যে সংস্কৃতি, তা থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারলাম না। কোনো গণতান্ত্রিক দেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদত্যাগ করতেন। সব দায়দায়িত্ব তো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর। আমি ইউরোপের হাজারটা দৃষ্টান্ত দিতে পারব। আমাদের রাজনীতিবিদরা 'রাজনীতির' ঊধর্ে্ব উঠে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারতেন। তা তাঁরা পারলেন না। আমি সংসদের অভিভাবক স্পিকার মহোদয়কে অনুরোধ করব 'ইউ টিউব'-এ পোস্ট করা প্রতিবেদনটি দেখতে। কেউ একজন ওই ঘটনার ক্লিপিংস ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়েছেন। তাতে স্পষ্ট এসি বিপ্লব সরকারের বক্তব্য আছে। সেখানে তিনি জয়নুল আবদিন ফারুককে উদ্দেশ করে বলছেন, 'থাপড়ায়ে তোমার দাঁত ফালায়ে দেব। কী মনে করিস তুই।' এই বক্তব্য রেকর্ড হয়ে আছে। আপনি সংগ্রহ করে তা দেখতে পারেন। একজন জুনিয়র পুলিশ অফিসার একজন রাজনীতিককে 'তুই তাকারি' বলেবেন, 'দাঁত ভেঙে ফেলার' হুমকি দেবেন, এটা কি একজন পুলিশ অফিসার পারেন? মাননীয় স্পিকার, আপনি কি এতে অপমানিত বোধ করেন না? এটা কি সংসদের ৩৪৫ জন সংসদ সদস্যের জন্য অপমানকর নয়?

মাননীয় স্পিকার, আমি 'ইউ টিউব'-এ ওই ক্লিপিংস দেখেছি এবং কষ্ট পেয়েছি। কেননা আমার ছাত্র এখন পুলিশের এসি। একজন ঢাকার এক অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত ডিসিও। ঢাকার কমিশনার বেনজির আহমদকে এক সপ্তাহ আগে গর্ব করে আমার ছাত্রদের কথা আমি বলেছিলাম। বিপ্লব জগন্নাথে পড়েছেন। জাহাঙ্গীরনগরে পড়লে আমার ছাত্র হতেন। যেখানে তাঁকে নিয়ে আমার গর্ব করার কথা, সেখানে তাঁর আচরণ আমাকে কষ্ট দিয়েছে। সারদায় প্রশিক্ষণ চলাকালে তো শেখানো হয় সংকটের সময় ধৈর্য ধরতে। উত্তেজিত না হতে। মানুষের সঙ্গে ভালো আচরণ করতে। কিন্তু কী আচরণ করলেন বিপ্লব? কী শিখলেন তিনি সারদা থেকে। পুলিশের কর্মকর্তারা কি জানেন 'ইউ টিউব'-এর ওই ক্লিপিংস বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন যদি দাবি ওঠে শান্তি মিশনে বাংলাদেশি পুলিশ বাহিনীকে না পাঠাতে, তাতে কি পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে? আমি চাই না, এমনটি হোক। আমি পুলিশের ওপর আস্থাই রাখতে চাই। কিন্তু একজন এডিসি হারুন, একজন এসি বিপ্লব যত দিন পুলিশে থাকবেন, তত দিন পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে না। একজন সংসদ সদস্যের ওপর পুলিশের হামলা, তাঁকে আহত করার ঘটনা আমি ভুলে যেতে চাই। বিচারে দোষীরা শাস্তি পাক। একটা আস্থার পরিবেশ তৈরি হোক। এমনিতে রাজনীতিতে অস্থিরতা বাড়ছে। হরতালের পর হরতাল হচ্ছে। বিরোধী দলের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব বাড়ছে। এমনি এক পরিস্থিতিতে একজন বিরোধী দলের সংসদ সদস্য যখন পুলিশের পিটুনিতে আহত হন, তখন রাজনৈতিক পরিস্থিতির যে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেবে, তা বলাই বাহুল্য।
ঢাকা, সোমবার, ১১ জুলাই ২০১১, দৈনিক কালের কন্ঠ 
 ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
www.tsrahmanbd.blogspot.com

0 comments:

Post a Comment