রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

চীন কি নতুন মডেলের ঔপনিবেশিক শক্তি হয়ে উঠবে?



চীন বিশ্বায়নের এক নতুন মডেল উপস্থাপন করেছে। চীনা অর্থ এখন আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ হচ্ছে। এই অর্থ সেখানকার অবকাঠামো খাতে বড় পরিবর্তন আনছে। রেল যোগাযোগ, রাস্তাঘাট নির্মাণে চীনা অর্থ ব্যবহৃত হচ্ছে। একটি দৃষ্টান্ত দেই। বর্তমানে আফ্রিকাতে চীনা অর্থে এক হাজার প্রজেক্ট বাস্তবায়িত হচ্ছে। চীন সেখানে নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে ২,২৩৩ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করছে। ৩,৩৫০ কিলোমিটার হাইওয়ে তৈরি করছে। প্রায় ৫৪টি আফ্রিকার দেশকে সড়ক ও রেলপথে সংযুক্ত করছে। বছরে চীন ১৫০ বিলিয়ন ডলার খরচ করছে এসব দেশে। বলা হচ্ছে, প্রায় ১০ লাখ চীনা এখন আফ্রিকাতে বসবাস করেন। এত বিপুলসংখ্যক চীনা নাগরিকের উপস্থিতির কারণে সেখানে এক সঙ্কর জাতির জন্ম হয়েছে। বাবা চীনা, মা আফ্রিকান এ ধরনের সঙ্কর জাতি আফ্রিকান দেশগুলোয় বিকশিত হচ্ছে, যারা মূলত কৃষ্ণাঙ্গ হলেও বাবার চীনা নাম ও পদবি ব্যবহার করছে। চীনের এই ভূমিকাকে অনেকে এক ধরনের ‘চীনা উপনিবেশবাদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। চীনের কাছে রয়েছে প্রচুর অর্থ। বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতি এখন চীনের। এর পরিমাণ ১১,৩৯১ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার (যুক্তরাষ্ট্রের ১৮,৫৬১ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার)। কিন্তু ক্রয় ক্ষমতার ভিত্তিতে চীনের অবস্থান প্রথম, ২১,২৬৯ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার (আইএমএফ)। চীনের রিজার্ভের পরিমাণ ৩,৪০৫ বিলিয়ন ডলার। চীনের কাছে বিপুল অর্থ থাকায় তা এখন সর্বত্র বিনিয়োগ হচ্ছে। অতি সম্প্রতি বেইজিং-এ ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড (ওবিওআর) শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়ে গেল। ২৮টি দেশের সরকারপ্রধানরা এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। এই মহাপরিকল্পনার আওতায় চীনকে একদিকে মধ্য এশিয়া ও আফ্রিকা, অন্যদিকে ইউরোপের সঙ্গে সড়ক, রেলপথ ও সামুদ্রিক পথে সংযুক্ত করা হবে। এর ফলে বৈশ্বিক বাণিজ্যে একটা বড় পরিবর্তন আসবে। এর মধ্য দিয়ে বাণিজ্যে চীনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে, এটা সত্য। কিন্তু ওবিওআর-এর সঙ্গে সংযুক্ত দেশগুলোও উপকৃত হবে। উল্লেখ্য, মোট ৬০ থেকে ৬৫টি দেশ এই ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড কর্মসূচির আওতায় রয়েছে। বিশ্বের অর্থনীতির তিন ভাগের এক ভাগ এর আওতায় আসবে। বিশ্বের জনসংখ্যার অর্ধেক বসবাস করে এই অঞ্চলে। এবং সেইসঙ্গে বিশ্বে যে জ্বালানি সম্পদের রিজার্ভ রয়েছে তার মাঝে শতকরা ৭৫ ভাগ এই এলাকায় রয়েছে। ফলে চীনের নেতৃত্বে ওবিওআর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা ভেঙে যাবে।

বলা ভালো, ওবিওআর একটি মহাপরিকল্পনা। এটা চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং-এর একটি বিশ্বদর্শন। এতে প্রাথমিকভাবে এক ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। গেল ১৪-১৫ মে বেইজিং-এ ওবিওআর-এর যে শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল, তাতে এ খাতে শি জিন পিং এক বিশাল অংকের অর্থ (প্রায় ১৩ হাজার কোটি ডলার) বরাদ্দের কথা ঘোষণা করেছেন। এর মধ্য দিয়ে বিশাল এক এলাকায় চীনা অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। এক নতুন ধরনের অর্থনৈতিক উপনিবেশবাদ আমরা প্রত্যক্ষ করব একুশ শতকে। চীনা পণ্যের এক বিশাল বাজার গড়ে উঠবে ওবিওআরভুক্ত দেশগুলোতে। চীনা বিনিয়োগ বাড়ার কারণে চীনের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়বে এসব দেশের। তখন ওবিওআরভুক্ত দেশগুলো সুযোগ পাবে চীনের সঙ্গে শুল্কমুক্ত এক বাজারব্যবস্থা গড়ে তুলতে। চীনের সঙ্গে বর্তমানে ১২টি দেশের ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট (এফটিএ) রয়েছে। এই দেশগুলো হচ্ছে- সিঙ্গাপুর, পাকিস্তান, চিলি, পেরু, কোস্টারিকা, আইসল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, হংকং ও তাইওয়ান। আরও ৮টি দেশ ও সংস্থার সঙ্গে এফটিএ নিয়ে আলোচনা চলছে। এই দেশগুলো হচ্ছে- জাপান, কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলংকা, নরওয়ে ও কয়েকটি আঞ্চলিক সংস্থা। বাংলাদেশের সরকারপ্রধান ওবিওআর শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেননি। কিন্তু জুনিয়র মন্ত্রিপর্যায়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব হয়েছে। বাংলাদেশ ওবিওআর কর্মসূচিকে সমর্থন করছে। সুতরাং বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনা তৈরি হল আগামীতে চীনের সঙ্গে একটি এফটিএ করার। বলা ভালো, বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্য চীনের অনুকূলে। ফলে এফটিএ স্বাক্ষরিত হলে এ থেকে বাংলাদেশ ফায়দা নিতে পারবে ভবিষ্যতে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, প্রস্তাবিত ওবিওআর-এ মোট ৬টি অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে। প্রতিটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের সঙ্গে চীনের সংযুক্তি রয়েছে। এর মধ্যে দিয়ে ওইসব অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নে চীন এগিয়ে আসবে। যেমন বলা যেতে পারে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের (সিপিইসি) কথা। সিপিইসিতে প্রাথমিকভাবে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৪৬ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭ বিলিয়ন ডলার। এই করিডোর চীনের খাসগরকে (জিয়াং জিয়াং প্রদেশ) পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের গাওদার সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। এই করিডোর পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত ‘আজাদ কাশ্মীরের’ গিলগিট-বালাটিস্তান হয়ে খাইবার পাখতুনখোয়া, পাঞ্জাব ও বেলুচিস্তান প্রদেশের ভেতর দিয়ে গাওদারের সমুদ্রবন্দরে মিলিত হয়েছে। এই অর্থনৈতিক করিডোরে সড়ক ও রেলপথ ছাড়াও গ্যাসের পাইপলাইন থাকবে। চীনের জ্বালানি চাহিদা প্রচুর। মধ্য এশিয়ায় রয়েছে প্রচুর জ্বালানি সম্পদ। চীন এই জ্বালানি সম্পদ নিয়ে যেতে চায় ইউনান প্রদেশে।

এ জন্যই চীন বাংলাদেশে কক্সবাজার উপকূলীয় অঞ্চলে সোনাদিয়ায় একটি গভীর বন্দর নির্মাণ করতে চেয়েছিল। ভারতের আপত্তির কারণে যা সম্ভব হয়নি। এখন সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত না হওয়ায় মিয়ানমারে এটা নির্মিত হবে। অথবা মিয়ানমারের কোনো বন্দর ব্যবহার করে চীন ‘কানেকটেড’ হবে, যাতে করে গাওদার বন্দর ব্যবহার করে ইউনান প্রদেশের (কুনসিংযার রাজধানী) মধ্য নিয়ে যাওয়া যায় এবং একই পথ অনুসরণ করে চীনা পণ্য রফতানি করাও সম্ভব হয়। এতে সময় কম লাগবে এবং চীনা পণ্যের দামও কমে যাবে। বাংলাদেশও এ থেকে উপকৃত হতে পারে। কেননা বাংলাদেশ উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা বিসিআইএমের (বাংলাদেশ-চীন-ইউনান প্রদেশ, ভারত ও মিয়ানমার) সদস্য। বিশ্বের জনগোষ্ঠীর ৪০ ভাগ মানুষ এখানে বাস করে। বিশ্বের ৯ ভাগ এলাকা বিসিআইএমের অন্তর্ভুক্ত। বিশ্ব জিডিপির ৭ দশমিক ৩ ভাগ এই অঞ্চলের। ভারত এবং বাংলাদেশ এই জোট থেকে লাভবান হতে পারে। কুনমিং থেকে কলকাতা পর্যন্ত বিসিআইএমের আওতায় সড়কপথ হবে। কুনমিং থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত সড়ক আছে। বাংলাদেশের কক্সবাজার থেকে মিয়ানমারের সীমান্ত পর্যন্ত সড়ক তৈরি করছে বাংলাদেশ। ভারতের সাতবোন রাজ্যগুলো কীভাবে বিসিআইএম করিডোর থেকে লাভবান হবে, তার একটি দৃষ্টান্ত দেই। সাতবোন রাজ্যের পণ্য কলকাতা সমুদ্রবন্দরে পৌঁছতে লাগে ৭ দিন। সেখান থেকে চীনের গন্তব্যে পৌঁছতে লাগে ৩ থেকে ৪ সপ্তাহ। এখন বিসিআইএম করিডোর ব্যবহার করে ভারত মাত্র ২ দিনে তার পণ্য ইউনান প্রদেশে পৌঁছে দিতে পারবে। এতে শতকরা ৩০ ভাগ খরচ কমে যাবে। ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এ আরও ৫টি অর্থনৈতিক করিডোর রয়েছে। এই অর্থনৈতিক করিডোরগুলো ব্যবহার করে ইউরোপসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলোও উপকৃত হবে। বিসিআইএম ও সিপিইসির বাইরে আরও যে ৪টি অর্থনৈতিক করিডোর রয়েছে, সেগুলো হচ্ছে চীন-মঙ্গোলিয়া-রাশিয়া ইকোনমিক করিডোর, নিউ ইউরো এশিয়ান ব্রিজ, চীন মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া অর্থনৈতিক করিডোর এবং চীন-ইন্দোচায়না পেনিনসুলা। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে সংযুক্ত করা হয়েছে। আর এভাবেই চীন দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ইউরো-এশিয়াসহ সুদূর ইউরোপের সঙ্গে সড়ক ও রেলপথে সংযুক্ত হবে। এটা এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। একদিকে সড়কপথে যখন চীন সংযুক্ত হবে, তখন অন্যদিকেও ইউরোপ থেকে চীনের অন্য অঞ্চল সমুদ্রপথে সংযুক্ত হবে।

প্রথম ক্ষেত্রে (বেল্ট) চীনের জি’আন শহর থেকে সড়কপথে হল্যান্ডের রটারডাম পর্যন্ত সংযুক্ত হবে। অপরদিকে রটারডাম থেকে ইতালির ভেনিস স্থলপথ এবং ভেনিস থেকে সমুদ্রপথে চীনের সমুদ্রবন্দর ফুজউ পর্যন্ত সংযুক্ত হবে। বিশাল এক কর্মযজ্ঞ, যা চিন্তাও করা যায় না। কিন্তু চীনের বর্তমান নেতৃত্ব এই অসাধ্য কাজটি হাতে নিয়েছে। এবং চীন যখন ২০৪৯ সালে তার বিজয়ের ১০০ বছরে পা দেবে, তখন এই ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডের মহাকর্মযজ্ঞ শেষ হবে।

পশ্চিমা গবেষকরা চীনের এই উদ্যোগকে চিহ্নিত করেছেন চীনের মার্শাল প্ল্যান হিসেবে। পাঠকদের স্মরণ থাকার কথা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ পুনর্গঠনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র মার্শাল প্ল্যান নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। অনেকটা সেই মডেলকে সামনে রেখেই চীন একুশ শতকে অবকাঠামো উন্নয়নে যে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, তাকেই অভিহিত করা হয়েছে ‘চীনের মার্শাল প্ল্যান’ হিসেবে। এখন প্রশ্ন অনেকগুলো। বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র চীনের এই মহাপরিকল্পনাকে কীভাবে দেখছে? কেননা আগামী ১০ বছরের মধ্যে চীন বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান হবে তখন দ্বিতীয়। চীনের এই অর্থনৈতিক আধিপত্যকে যুক্তরাষ্ট্র সহজভাবে নেবে বলে মনে হয় না। উঠতি অর্থনীতির দেশ ভারত। ভারত ও চীনের এই উত্থানকে খুব ভালো চোখে দেখবে বলে মনে হয় না। ইউরোপের অবস্থান কী হবে? বেইজিং-এ ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডের শীর্ষ সম্মেলনে চীন প্রায় একশ’টির মতো দেশকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তবে অনেক দেশই আসেনি। এমনকি যে ৬৮টি দেশ এই ওবিওআর-এ সংযুক্ত হবে, সেখান থেকেও সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব হয়নি। অনেক রাষ্ট্র তথা সরকারপ্রধান আসেননি। এর অর্থ পরিষ্কার- এই অঞ্চলের দেশগুলোর মাঝে চীনের ব্যাপারে এক ধরনের শঙ্কা আছে। ভারত সম্মেলনে যোগ দেয়নি। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের ব্যাপারে ভারতের আপত্তি রয়েছে। কেননা এটি বিতর্কিত গিলগিট-বালাটিস্তানের ওপর দিয়ে গেছে, যা পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ভারত মনে করে এটি তাদের। সম্মেলন শেষে যে ইশতেহার প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে ইউরোপের কোনো রাষ্ট্র স্বাক্ষর করেনি। তারা পরিবেশের সমস্যাটা বড় করে দেখছে। ফলে ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডের সাফল্য নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল। ভারত-চীন দ্বন্দ্ব যদি আরও বেড়ে যায়, তাহলে এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে না। এক্ষেত্রে ৬টি অর্থনৈতিক করিডরের একটি বিসিআইএম করিডর বিকশিত হবে না। ভারত মহাসাগরে দেশ দুটি প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হচ্ছে। তবে এটা বলাই যায়, চীনের এই মহাপরিকল্পনা আগামীতে বার বার আলোচিত হতে থাকবেই। তখন যে অসন্তোষের জন্ম হবে, তা নিরসনে চীন কী ভূমিকা নেয়, সে ব্যাপারেও লক্ষ থাকবে অনেকের। চীনের বর্তমান নেতৃত্ব বার বার আমাদের আশ্বস্ত করেছেন যে, ওবিওআরের মাধ্যমে চীন আগামীতে কোনো অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবে না। কিন্তু চীনা অর্থনীতি যেভাবে বিকশিত হচ্ছে এবং চীনা পণ্য যেভাবে সারা বিশ্বের বাজার দখল করে রেখেছে, সেখানে চীনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। আফ্রিকাতে চীনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সেখানকার জনগোষ্ঠীর মাঝে এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। আফ্রিকাতে চীনের এক ধরনের অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ল্যাটিন আমেরিকাতেও চীনা প্রভাব বাড়ছে। সেখানে চীনা বিনিয়োগ বাড়ছে। চীনা বিশেষজ্ঞরা চীনের এই ভূমিকাকে চীনা বিশ্বায়ন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

এই চীনা বিশ্বায়ন কি এক ধরনের চীনা উপনিবেশবাদ তৈরি করবে বিশ্বে, যেমনটি এক সময় স্পেন, ব্রিটেন কিংবা ফ্রান্স করেছিল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। সিরিয়াস পাঠক মাত্রই জানেন, ১৬ শতক থেকে বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইউরোপীয় শক্তিগুলো বিশেষ করে ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন ও পর্তুগাল আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকাতে তাদের উপনিবেশ তৈরি করেছিল। দীর্ঘদিন তারা তাদের দখলদারিত্ব বজায় রেখেছিল। পরে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে কলোনিগুলো এক এক করে স্বাধীন হতে থাকে। বলাই বাহুল্য, উপনিবেশ তৈরি করার পেছনে বড় অর্থনৈতিক স্বার্থ কাজ করেছিল। একদিকে এশিয়া-আফ্রিকার কাঁচামাল তথা প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যাপারে উপনিবেশবাদী শক্তিগুলোর আগ্রহ এবং পরবর্তী সময় ওইসব দেশে তৈরি তথা উৎপাদিত পণ্যের বাজার সৃষ্টি করে উপনিবেশবাদী শক্তিগুলো তাদের আধিপত্য বজায় রেখে আসছিল। উপনিবেশবাদী শক্তিগুলো অতীতে কত টাকা লুণ্ঠন করে নিয়ে গেছে, এর অনেক তথ্য অনেক গবেষকের লেখায় আছে। আজ চীনের ভূমিকা কি তেমনি? ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড বা ওবিওআর মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের পেছনে চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। ওবিওআর ৬টি অর্থনৈতিক করিডোর চীনকে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত করছে। আর মধ্য এশিয়ায় রয়েছে জ্বালানি সম্পদের বিশাল রিজার্ভ। বিশ্ব গ্যাস রিজার্ভের ৩২ দশমিক ৪ ভাগ রিজার্ভ রয়েছে ইউরো-এশিয়া তথা মধ্য এশিয়ায়। আর চীনের জ্বালানি ক্ষুধা রয়েছে, এটা সবাই জানে। একই কথা প্রযোজ্য আফ্রিকার ক্ষেত্রেও। সেখানে তেল রয়েছে (যেমন এঙ্গোলা, নাইজেরিয়া, জাম্বিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা), সেখানে চীনের বিনিয়োগ বাড়ছে। বাড়ছে চীনা নাগরিকদের উপস্থিতিও। যেমন এই মুহূর্তে দক্ষিণ আফ্রিকায় ২ লাখ, এঙ্গোলায় ৩০ হাজার, নাইজেরিয়ায় ৫০ হাজার ও জাম্বিয়ায় ৪০ হাজার চীনা নাগরিক বসবাস করেন। এর মধ্য দিয়ে চীন সেখানে এক নতুন উপনিবেশ তৈরি করছে। অর্থ এখানে একটি ফ্যাক্টর। চীনা তিনটি ব্যাংক এখন এসব দেশে বিশাল বিনিয়োগ করছে। চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ৯০০ প্রজেক্ট (৬০ দেশ)-এ নিয়োগ করেছে ৮৯০ বিলিয়ন ডলার। ব্যাংক অব চায়নার বিনিয়োগের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন (২০১৬-২০১৮) ডলার। আর ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়না ওবিওআর মহাপরিকল্পনায় বিনিয়োগ করেছে ১৫৯ বিলিয়ন ডলার। সুতরাং বোঝাই যায় চীনা অর্থ কী ভূমিকা পালন করছে। তবে চীনা বংশোদ্ভূত ক্যালিফোনিয়ার সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ডেভিড সি কং-এর মতে চীনের এই উত্থান নতুন কিছু নয়। তার মতে, China has been a hegemon and source of civili“ation for at least twenty centuries, its rise is not nwe (National Interest, may 23, 2017). এই মূল্যায়নের সঙ্গে হয়তো অনেকে একমত হবেন না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বিশ্ব ব্যবস্থায় চীনের গুরুত্ব বাড়ছে। চীনের অর্থনৈতিক শক্তি, প্রযুক্তিগত মান চীনকে একুশ শতকে কোথায় নিয়ে যাবে, সেটাই দেখার বিষয়।
Daily Jugantor
29.05.2017

ট্রাম্প কি সুন্নি-শিয়া দ্বন্দ্বকে উসকে দিয়ে গেলেন?



এ সৌদি জোট অনেক প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এলো এখন। সৌদি আরব নিজে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে অন্যতম একটি ‘অ্যাক্টর’ অর্থাৎ অন্যতম নির্ধারক হিসেবে নিজেকে দেখাতে চায়। অতীতের কোনো সৌদি বাদশা এভাবে সৌদি পররাষ্ট্রনীতি ও নিরাপত্তা ইস্যুতে কোনো বড় ভূমিকা পালন করেননি। কিন্তু বর্তমান বাদশা সালমান বিন আবদুল আাজিজের ‘অ্যাপ্রোচ’ একটু ভিন্ন। তিনি সৌদি আরবকে দেখতে চান এ অঞ্চলের রাজনীতির অন্যতম নির্ধারক হিসেবে। তাই তার নেতৃত্বে একটি সামরিক জোটের প্রয়োজন ছিল। সৌদি আরব পারসীয় অঞ্চলে তার প্রভাব বাড়াতে চায়। এর প্রকাশ হিসেবে আমরা দেখেছি ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে সৌদি আরবের হস্তক্ষেপ তথা সৌদি বিমান বাহিনীর ইয়েমেনে অব্যাহত বোমাবর্ষণ। এর আগে লেবাননের গৃহযুদ্ধে সৌদি ট্যাঙ্কবহরকে আমরা লেবাননে প্রবেশ করতে দেখেছিলাম। অতীতে কুয়েতের আমির যখন ইরাকি সেনাদের দ্বারা উৎখাত হন (১৯৯০), তখন সৌদি আরব আমিরকে আশ্রয় দিয়েছিল বটে, কিন্তু আমিরের সমর্থনে কোনো সেনা বা বিমান পাঠায়নি। ২০১১ সালে তিউনিশিয়ায় ‘জেসমিন বিপ্লব’ জাইন আল আবেদিন বেন আলিকে ক্ষমতাচ্যুত ও বেন আলি সৌদি আরবে আশ্রয় নিলেও সৌদি আরব তিউনিশিয়ায় হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু বাদশা সালমান বিন আবদুল আজিজ ক্ষমতাসীন হয়ে সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনেন। আর তারই ফলশ্রুতিতে নতুন এক ‘সৌদি আরব’কে আমরা দেখছি। সৌদি আরবের নীতিনির্ধাকরদের বরাবরই একটা বড় ভয় ইরানকে নিয়ে। পারসীয় অঞ্চলের রাজনীতিতে ইরানের ভূমিকা বাড়ছে এবং ইরানের এ ভূমিকাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন স্বীকারও করে। ইরানের সঙ্গে ছয় জাতি পারমাণবিক চুক্তি, ইরানের ধর্মীয় নেতা খামেনিকে ওবামার গোপন চিঠি লেখা ইত্যাদি প্রমাণ করে, যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে ইরানের ভূমিকাকে স্বীকার করে নিয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্প এখন ইরান সমঝোতাকে অস্বীকার করেছেন।
ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ ছয় জাতি আলোচনায় যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে বিগত জানুয়ারি মাসে (২০১৬) ইরানের ওপর থেকে ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছিল। ফলে ইরান আবার একটি ‘শক্তি’ হিসেবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে! অতীতে ইরানি বিপ্লবের আগে (১৯৭৯) রেজা শাহ পাহলেভির সময় ইরানের ভূমিকাকে ‘পারসীয় অঞ্চলের পুলিশ’ এর ভূমিকার সঙ্গে তুলনা করা হতো। ইরান ওই ভূমিকায় আবার ফিরে যাচ্ছে। সৌদি আরবের ভয়টা এখানেই। ইরানের উত্থান সৌদি আরবসহ এ অঞ্চলের শিয়া সম্প্রদায়কে আরও বেশি উৎসাহিত করবে। বলা ভালো, এ জোটে সিরিয়াকে রাখা হয়নি। এটা সবাই জানেন, সৌদি আরব চাচ্ছে সিরিয়ায় আসাদের উৎখাত। কিন্তু সৌদি পছন্দের তালিকায় আইএসও নেই। ২০১৫ সালে ডিসেম্বরে আসাদবিরোধী দলগুলোর একটি সম্মেলন হয়েছিল রিয়াদে। সেখানে এমন অনেক দল অংশ নিয়েছিল, যাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ ছিল। এক্ষেত্রে সৌদি আরবের ভূমিকা কী হবে এসব দল ও জোটের বিরুদ্ধে? অনেকেই জানেন, ইসলামিক স্টেটের নেতৃত্বে সিরিয়া ও ইরাকের একটা অংশ নিয়ে তথাকথিত একটা জিহাদি রাষ্ট্র ‘সুন্নিস্তানে’র জন্ম হয়েছে, যারা ওয়াহাবি মতাদর্শ ও আদি ইসলামিক রাষ্ট্রের ধ্যানধারণায় পরিচালিত হচ্ছে। সৌদি রাষ্ট্রের ভিত্তিই হচ্ছে এই ওয়াহাবি মতাদর্শ। এক্ষেত্রে আপতদৃষ্টিতে আইএসএ’র সঙ্গে সৌদি নীতিনির্ধারকদের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও আদর্শগতভাবে মিল তো আছেই! সুতরাং সৌদি-আইএস সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। আরও একটা কথা বলা দরকার, ইরান ও সিরিয়ার তেলের কূপগুলোর একটা বড় অংশ ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসএ’র নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। কালোবাজারে আইএস এই তেল বিক্রি করে। দৈনিক তাদের গড় আয় ২ মিলিয়ন ডলার। আর এ কারণেই আইএস পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী জঙ্গিগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। এ তেল তুরস্কের মধ্য দিয়ে অন্যত্র যায়। ইসরাইল এ তেলের অন্যতম ক্রেতা। এ তেল নিয়েই সেখানে একটি ‘স্থলযুদ্ধে’র সম্ভাবনা বাড়ছে। কেননা আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য কমে যাওয়ায় (ব্যারেলপ্রতি বর্তমান মূল্য ৫০ ডলারের নিচে) আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের আয় কমে যাচ্ছে। ফলে একটি ‘যুদ্ধ’ শুরু না হলে এ তেলের মূল্য বাড়ানো যাবে না। তাই ধারণা করছি একটি যুদ্ধ সেখানে আসন্ন। পাঠকদের উপসাগরীয় অঞ্চলের তেলের গুরুত্ব সম্পর্কে একটি ধারণা দিতে চাই। ইরান ও সৌদি আরবের মাঝখানে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ, যা ‘স্ট্রেট অব হরমুজ’ নামে পরিচিত। এ সমুদ্রপথটি তেল সরবরাহের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বে সমুদ্রপথে যে পরিমাণ তেল পরিবহন করা হয় (প্রতিদিন ৫৬ দশমিক ৫ মিলিয়ন ব্যারেল), তার ২০ ভাগ (১৭ মিলিয়ন ব্যারেল) এ পথে পরিবাহিত হয়। ২০০৯ সালে এর পরিমাণ ছিল ১৫ দশমিক ৭ মিলিয়ন ব্যারেল (প্রতিদিন); এখন তা বেড়েছে ১৭ মিলিয়ন ব্যারেলে (২০১৩)। ২০১৬ সালের পরিসংখ্যান নিলে দেখা যাবে, তা প্রায় ২০ মিলিয়ন ব্যারেলে উন্নীত হয়েছিল। প্রায় ৩ দশমিক ২ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘স্ট্রেট অব হরমুজ’ প্রণালি অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করে ইরানি নৌবাহিনী। যে কোনো ‘সংকটে’ ইরান যদি এ জ্বালানি তেল সরবরাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তা বিশ্ব অর্থনীতিকে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দেবে। সৌদি আরবে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্রের বাজার। এ অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়লে এ অঞ্চলে মার্কিনি আন্তঃব্যবসা বৃদ্ধি পাবে, যা মার্কিনি অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে। যারা আন্তর্জাতিক রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে আরও বেশ ক’টি সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে। এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমসে ছাপা হয়েছে।
সুতরাং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন এসেছে। একদিকে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের অবনতি আর অন্যদিকে সৌদি আরবের নেতৃত্বে একটি সামরিক জোট গঠন, যাতে সুন্নি প্রাধান্য থাকছে, এ অঞ্চলের রাজনীতিতে উত্তেজনা বাড়াবে মাত্র। ইরান এখন ভিন্ন সূত্র থেকে (রাশিয়া ও চীন) অস্ত্র সংগ্রহ করবে। এ অঞ্চলে উত্তেজনা জিইয়ে রাখলে লাভ যুক্তরাষ্ট্রেরই। তাই আগামীতে এ অঞ্চলের রাজনীতি নতুন একটি মাত্রা পেল মাত্র।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে সৌদি আরবকে বেছে নিয়েছিলেন। রিয়াদে ২১ মে তিনি আরব ইসলামিক-আমেরিকান (এআইএ) সম্মেলনে ভাষণও দেন। ওই সম্মেলনে মুসলিমপ্রধান ৫৬ দেশের রাষ্ট্র্র তথা সরকারপ্রধানরা অংশ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ওই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সম্মেলনে শেখ হাসিনা বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ দমনে চার দফা প্রস্তাবও পেশ করেছিলেন। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিয়াদ সফর ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ওই সম্মেলনে তিনি ইরানবিরোধী যে বক্তব্য দেন, তা নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের সঙ্গে যে ১১ হাজার কোটি ডলারের একটি অস্ত্র চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, তা এখন এ অঞ্চলের উত্তেজনার মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দেবে। প্রশ্ন হচ্ছেÑ এ অস্ত্র বিক্রিতে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ কী? যুক্তরাষ্ট্র যে অস্ত্র বিক্রি করবে, তা নিঃসন্দেহে সৌদি আরবের নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করবে। কিন্তু সে সঙ্গে সুন্নি-শিয়া দ্বন্দ্ব আবারও বেড়ে যেতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়া সংকটের যখন সমাধান হয়নি কিংবা ইসলামিক স্টেটকে যখন পরিপূর্ণভাবে উৎখাত করা সম্ভব হয়নি, ঠিক তখনই ১১ হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র এ অঞ্চলে নতুন একটি ‘ফ্রন্ট’ ওপেন করবে এবং এ অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়াবে। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, ২০১৫ সালে সৌদি আরবের নেতৃত্বে সন্ত্রাসবাদবিরোধী একটি জোট গঠিত হয়েছিল, যার নাম ছিল ‘ইসলামিক মিলিটারি অ্যালায়েন্স টু ফাইট টেরোরিজম’। বাংলাদেশ ওই জোটে আছে। প্রায় ৩৩ মুসলিমপ্রধান দেশের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে এ জোটে। এ জোটকে অভিহিত করা হয়েছে ‘আরব ন্যাটো’ হিসেবে। সম্প্রতি সৌদি আরবের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। সুন্নি-শিয়া দ্বন্দ্বের রেশ ধরে সৌদি আরব ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। এখন সৌদি আরব একটি সামরিক জোট গঠন করল এবং অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হলো। যদিও প্রথম থেকেই বলা হচ্ছে, ‘জোটটি’ শুধু সন্ত্রাসবিরোধী একটি কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে এবং জোট কার্যত একটি তথ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করবে। কিন্তু বাস্তবে এটি শুধু একটি তথ্যবিনিময় কেন্দ্র হিসেবেই থাকবে, নাকি সত্যিকার অর্থে একটি সামরিক জোট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবেÑ এ প্রশ্ন থাকলই। কেননা আরব ইসলামিক-আমেরিকান সম্মেলনের পর যে রিয়াদ ঘোষণা স্বাক্ষরিত হয়েছে, তাতে বেশ কয়েকটি দেশের অংশগ্রহণে ৩৪ হাজার সেনার অতিরিক্ত বাহিনী গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। ওই ঘোষণায় আরও বলা হয়েছেÑ ইরাক ও সিরিয়ায় সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে অভিযানে সহযোগিতার জন্যই এ সেনাবাহিনী ব্যবহৃত হবে। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। বিশেষ করে সৌদি শিয়া নেতা নিমর আল নিমরের মৃত্যুদ- কার্যকরের পর (জানুয়ারি ২০১৬) এখন একটি সুন্নিপ্রধান সামরিক জোট গঠন এ অঞ্চলে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব ও বিভেদকে উপসাগরের অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে দেবে। এখানে একটা কথা বলা দরকার, পারসীয় উপসাগরভুক্ত অঞ্চলে সুন্নিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ অঞ্চলের জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগ সুন্নি সম্প্রদায়ভুক্ত, আর ৩৬ ভাগ মানুষ হচ্ছেন শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত। এ অঞ্চলের মাঝে ইরাক, লেবানন, ইয়েমেন আর বাহরাইনে শিয়া সম্প্রদায়ের লোক বেশি বাস করে। যেমনÑ বলা যেতে পারে, ইরানে যেখানে ৮৫ শতাংশ লোক শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত, সেখানে সুন্নিদের সংখ্যা শতকরা মাত্র ১৫ ভাগ। ইরাকের ৬৩ ভাগ যেখানে শিয়া, ৩২ ভাগ সেখানে সুন্নি; সিরিয়ায় ১৫ ভাগ শিয়া, আর ৭৩ ভাগ সুন্নি; বাহরাইনে ৭৫ ভাগ শিয়া, ২৫ ভাগ সুন্নি; ইয়েমেনে ৪৪ ভাগ শিয়া, ৫৬ ভাগ সুন্নি। মজার ব্যাপার হলো, বাহরাইনে শিয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের কোনো ভূমিকা নেই। সুন্নি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে খলিফা হামাদ ও তার পরিবার সেখানে দীর্ঘদিন ক্ষমতায়। সিরিয়ার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ আলাউট সম্প্রদায়ের লোক। আলাউট সম্প্রদায় শিয়াদের একটি উপশাখা। একটি গোত্র। এ গোত্র সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। বাশার আল আসাদের বাবা হাফিজ আল আসাদও সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সিরিয়া ও ইরাকে একসময় বাম-মনা বার্থ পার্টি গঠিত হয়েছিল। হাফিজ আল আসাদ সেনাবাহিনীর লোক হয়েও বার্থ পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। পার্টি তার স্বাভাবিক মৃত্যুর পর ২০০০ সালে তার ছেলে বাশার আল আসাদকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। ইরাকে সাদ্দাম-পরবর্তী জমানায় শিয়ারা ক্ষমতা পরিচলনা করলেও সাদ্দামের (সুন্নি) সময় শিয়ারা ছিলেন উপেক্ষিত। এখন ইরাকে শিয়ারা ক্ষমতায়। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজনÑ সৌদি শিয়া নেতা নিমর আল নিমরের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছিল এমন একটি সময়, যখন এ অঞ্চলে সৌদি আরবের নেতৃত্বে ২০১৫ সালেই একটি সামরিক জোট গঠিত হয়েছিল। এ জোট গঠনকে ইরান ভালো চোখে দেখেনি। খুব সংগত কারণেই এ সামরিক জোটটি গঠনের প্রেক্ষাপট আলোচনার দাবি রাখে।
Daily Alokito Bangladesh
28.05.2017

ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক সমঝোতা কি ভেস্তে গেল


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার শাসনামলে ২০১৫ সালের জুলাইয়ে ইরানের সঙ্গে একটি পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ওই সমঝোতা চুক্তিটি ছয় জাতি সমঝোতা চুক্তি হিসেবে পরিচিত। কিন্তু গত জানুয়ারিতে (২০১৭) ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর এই পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তিটি এখন প্রশ্নের মুখে আছে। দায়িত্ব নেওয়ার পর পরই তিনি অভিযোগ করেছিলেন, ইরান চুক্তিটি ঠিকঠাক মানছে না। দায়িত্ব নেওয়ার পর পরই তিনি এটা নিশ্চিত করেছিলেন ওই চুক্তিটি তিনি মানবেন না! এরই ধারাবাহিকতায় তার প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে ২১ মে রিয়াদে তিনি যখন আরব-আমেরিকান শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন, তখনো তিনি তার ওই ইরানবিরোধী মনোভাব আবারও স্পষ্ট করেছেন। রিয়াদে তিনি বলেছিলেন, মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে জাতিগত দ্বন্দ্ব ও সন্ত্রাস ছড়ানোর জন্য ইরান দায়ী! ফলে ইরানের সঙ্গে ছয় জাতির যে পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তা এখন বড় প্রশ্নের মুখে পড়েছে। বলা ভালো, ওই সমঝোতা চুক্তিতে (২০১৫) ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এতে দেখা যায় যে, আগামী ১০ বছরের মধ্যে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে পারবে না। তাদের পরমাণুকেন্দ্রে চলবে নজরদারি। অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকছে এবং তেহরান শর্ত ভাঙলে ৬৫ দিনের মধ্যে ফের কিছু নিষেধাজ্ঞা বহাল হবে। একই সঙ্গে ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে কতটা এগিয়েছে, তা তদন্ত করবে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা বা আইএইএ। ফের আইএইএ ইরান বিরোধ হলে, তা মেটাবে একটি শালিসি বোর্ড। ওই চুক্তির পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ইরানের যে সম্পদ জব্দ করা হয়েছিল, তা ইরানকে ফেরত দেওয়া হবে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার ফলে ইরান তার যাত্রীবাহী বিমান সংস্থার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ আমদানি করতে পারবে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ১০ বছর পর ইরান তার পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আরও গবেষণা ও উন্নয়নকাজ করতে পারবে। কিন্তু এর পরও নিষেধাজ্ঞা ছিল। এতে সমঝোতার কোনো কোনো অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা দেখার বিষয়।
নিঃসন্দেহে এ অঞ্চলের রাজনীতির জন্য ওই চুক্তিটি উত্তেজনা হ্রাস করতে সাহায্য করার কথা। ওবামা প্রশাসনের ওপর ইসরায়েলি প্রশাসনের প্রচ- একটা ‘চাপ’ থাকা সত্ত্বেয় ওবামা প্রশাসন এ ধরনের শর্তে রাজি হয়েছিলেন। ফলে আলোচনায় বাকি বৃহৎ শক্তিগুলোও রাজি হয়েছিল। ওবামার জন্য একটি প্লাস পয়েন্ট ছিল সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট কার্টার এবং প্রায় ১০০ জন সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত কর্তৃক ওবামাকে সমর্থন। কংগ্রেস সদস্যদের বিরোধিতার মুখেও তিনি ওই সমঝোতাকে নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন। যদিও পরবর্তী সময়ে ১১টি ইরানি কোম্পানি ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে ইরানবিরোধী একটা অবস্থান নিয়েছেন। সৌদি আরবের সঙ্গে প্রায় ১৩ হাজার কোটি ডলারের একটি অস্ত্র চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। রিয়াদ ঘোষণায় ৩৪ হাজার সেনাবাহিনীর একটি বাহিনী গঠনের কথাও বলা হয়েছে।
ইরানের ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে গিয়েছিল বটে। কিন্তু নতুন করে নিষেধাজ্ঞা ও মানবাধিকার-সম্পর্কিত অভিযোগ রয়েছে। ইরানের অবস্থা অনেকটা ফাঁদে পড়ার মতো। ইরান পুরোপুরিভাবে ‘মুক্ত’ হচ্ছে না। নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্ক এখন প্রশ্নের মুখে থাকল। বলতে দ্বিধা নেই, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরিভাবে উঠে গেলে ইরান এ অঞ্চলে অন্যতম একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে, যা ইসরায়েল ও সৌদি আরবÑ কারোরই পছন্দ নয়। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে অন্যতম ফ্যাক্টর হচ্ছে ইসরায়েল। পারমাণবিক চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু মন্তব্য করেছিলেন, ‘এটা একটা ঐতিহাসিক ভুল’। ইসরায়েলের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ চুক্তির কোনো কোনো ধারা নিয়ে সমালোচনাও করেছেন। ফলে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার ওই চুক্তির প্রশংসা এবং ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি এ চুক্তির মধ্য দিয়ে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে বলে মন্তব্য করলেও পরবর্তিত পরিস্থিতির কারণে এখন দ্রুত বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরি করছে, এই অভিযোগ তুলে ২০০৬ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি বাতিল করার দাবি-সংবলিত একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। এরপর অন্তত এ-সংক্রান্ত আরও ছয়টি প্রস্তাব পরে গ্রহণ করা হয়েছিল এবং ইরান ওই কর্মসূচি বাতিল না করায় ২০১০ সালে জাতিসংঘ ইরানের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক মালিকানার সম্পদ জব্দসহ দেশটির বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। তবে ২০০৬ সাল থেকেই ইরানের সঙ্গে ছয় জাতি (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও জার্মানি) আলোচনা চলে আসছিল। কিন্তু তাতে কোনো ফলাফল পাওয়া যাচ্ছিল না। ২০১৩ সালে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে উদারপন্থি হিসেবে পরিচিত হাসান রুহানি বিজয়ী হলে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ করা যায়। ফলে এই ছয় জাতি আলোচনা আরও গতি পায়। ২০১৪ সালের নভেম্বরে একটি চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু হয় এবং এপ্রিলে (২০১৫) সুইজারল্যান্ডের লুজানে একটি খসড়া চুক্তিতে ইরান ও ছয় জাতি উপনীত হয়। ওই বছরের ৩০ জুনের মধ্যে ওই খসড়া চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। জুলাই (২০১৫) সালে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে অন্তত একটি জিনিস স্পষ্ট হয়েছিল। আর তা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক বৃদ্ধির একটি সম্ভাবনা। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এই সম্পর্ক আরও উন্নত করার প্রয়োজন রয়েছে। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে, প্রশাসনে,
সেনাবাহিনীতে এখনো ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লবের পর দীর্ঘ ৪৪৪ দিন রেভল্যুশনারি স্টুডেটস কর্তৃক তেহরানের মার্কিন দূতাবাস দখল করে নেওয়ার ঘটনার স্মৃতি একটি ‘ক্ষতচিহ্ন’ হিসেবে রয়ে গেছে। ফলে সম্পর্ক বৃদ্ধির সম্ভাবনাটা অত সহজ ছিল না। এরপর যোগ হয় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি। ওই ঘটনার দীর্ঘ ৩৬ বছর পর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি এই দেশ দুটিকে আরও কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল। এর ফলে এ চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ‘বন্ধু’ ইসরায়েলের আপত্তি সত্ত্বেও। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিস্টরা মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে ইরাক-সিরিয়ায় জঙ্গিবাদী ইসলামিক স্টেটের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে হলে তাদের ইরানের সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে। অনেকের স্মরণ থাকার কথা গেল নভেম্বরের (২০১৪) বারাক ওবামা স্বীকার করেছিরেন, তিনি গোপনে ইরানি সমর্থন চেয়ে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনিকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। প্রত্যুত্তরে খামেনিও তাকে একটি গোপনে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। আইএস (ইসলামিক স্টেট) জঙ্গিদের ঠেকাতে ওবামা খামেনির সমর্থন চেয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে ইয়েমেনে ‘হুথি বিদ্রোহ’ প্রমাণ করেছিল, সেখানেও একটি স্থিতিশীল সরকার গঠনে ইরানের সমর্থন প্রয়োজন রয়েছে। কেননা হুথিরা শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত এবং অভিযোগ আছে হুথি বিদ্রোহীরা ইরান থেকে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য পেয়ে থাকে, যদিও ইরান বারবার তা অস্বীকার করে আসছে। ২০১৫ সালে ‘ইরান চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হওয়ায় সৌদি আরবের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক আরও স্বাভাবিক হবে এবং যুক্তরাষ্ট্র এটাই চেয়েছিল। সৌদি-ইরান জোট প্যারিসীয় অঞ্চলের রাজনীতিতে একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে, এটা মনে করেন অনেক মার্কিন গবেষক। কেননা ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহের কারণে সেখানে সরকারের পতন ঘটে এবং প্রেসিডেন্ট দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরপর মার্চে সৌদি বিমান হুথি বিদ্রোহী ঘাঁটিতে বোমা হামলা চালালেও সেখানে স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। এরই মধ্যে সৌদি আরবে শিয়া নেতা নিমর আল নিমরের মৃত্যুদ- কার্যকর করায় নভেম্বর ২০১৬ সৌদি আরব-ইরান সম্পর্কে অবনতি ঘটিয়েছে। এ দেশ দুটির মধ্যে আস্থাহীনতার সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছে। উপরন্তু সৌদি আরবের নেতৃত্বে একটি সামরিক জোট গঠিত হওয়ায় ইরান এটাকে ভালো চোখে নেয়নি। নতুন করে শিয়া-সুন্নি বিতর্কটি সামনে চলে এসেছে আবার। এরই মধ্যে নতুন করে যোগ হলো সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র বিক্রি এবং সৌদি আরবের নেতৃত্বে ৩৪ হাজার সেনাবাহিনীর (বিভিন্ন মুসলিম দেশের) একটি সামরিক জোটের, যা পরিচিতি পেয়েছে ‘আরব ন্যাটো’ হিসেবে।
এখন নয়া রাজনৈতিক সমীকরণের ফলে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা লক্ষ করার বিষয়। সিরিয়া সংকট সমাধানে ইরানের সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। চলতি বছর সিরিয়ায় একটি সর্বদলীয় সরকার গঠিত হওয়ার কথা এবং আগামী বছর সেখানে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এখন ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের যদি আরও অবনতি ঘটে, তাহলে তা সিরিয়ার ঘটনাবলিতেও প্রভাব ফেলবে। চলতি বছরের কোনো একসময় জেনেভায় সিরিয়া নিয়ে একটি বহুদলীয় আলোচনা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। ওই আলোচনায় ইরান ও সৌদি আরবও অংশ নেবে। এখন নতুন করে সৌদি আরবে অস্ত্র বিক্রি ও সামরিক জোট গঠন করায়, তা সামগ্রিকভাবে আলোচনায় একটা অচলাবস্থা এনে দিতে পারে। এটা সবাই জানে যে, ইরান সিরিয়ায় আসাদ সরকারকে সমর্থন করছে। আর ইরান পাশে পেয়েছে রাশিয়ার মতো বড় একটি শক্তিকে। ফলে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতিতে সিরিয়ায় শান্তি প্রক্রিয়া বিস্মিত হবে। দীর্ঘ প্রায় ৩৬ বছর ইরান আন্তর্জাতিক আসরে একা। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির কারণে ইরান বিশ্বে একা হয়ে গিয়েছিল। ইরানের বৈদেশিক আয়ের বড় উৎস পেট্রোলিয়াম সেক্টরে কোনো বিনিয়োগ আসছিল না। এমনকি ইরান তেল রপ্তানি করতেও পারছিল না। এ জন্যই ইরানিদের প্রয়োজন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন। কট্টর শিয়া ধর্মীয় ভাবধারায় বিশ্বাসী ইরানি ধর্মীয় নেতারা এটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেনÑ এটাই হচ্ছে বাস্তববাদী নীতির মূল কথা। ২০১৬ সালে ইরানের পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই পার্লামেন্ট নির্বাচনে রুহানি সমর্থকরা বিজয়ী হয়েছিলেন। একই সঙ্গে ২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত হয় ইরানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ওই নির্বাচনে রুহানি দ্বিতীয়বারের মতো বিজয়ী হয়েছেন। আর ওই সময়েই ট্রাম্প সৌদি আরব সফর করেছেন। তবে কট্টরপন্থিরা ইরানে এখনো তৎপর।
ইসরায়েলের বিরোধিতার কারণে মার্কিন কংগ্রেসে এই ইরান সমঝোতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ট্রাম্পের পাশাপাশি রিপাবলিকান পার্টির একটা বড় অংশ ইরান পারমাণবিক সমঝোতার বিরোধী। ডেমোক্র্যাটরা এটাকে সমর্থন করলেও, কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাটদের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল। এখন ট্রাম্প যদি চান, তাহলে কংগ্রেসে ওই সমঝোতা বাতিল কিংবা ইরানের বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে একটি বিল উত্থাপিত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলি লবি এটাই চাইছে। এমনকি মে মাসে (২০১৭) ট্রাম্পের ইসরায়েল সফরের সময় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে।
ইরান চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ইরানের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দার্শনিক রামিন জাহানবেগলু (জধসরহ ঔধযধহনবমষড়ড়) একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেনÑ ‘মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির মেরুকরণে এই মুহূর্তে ইরান একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ’। এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। ইরানকে ছাড়া যে উপসাগর তথা মধ্যপ্রাচ্যে একটি স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করা যাবে না, এটা প্রমাণিত হয়েছে। এখন দেখার পালা, মার্কিন নীতিতে এ পরিবর্তনটা কীভাবে প্রতিফলিত হয়। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লবের আগে, অর্থাৎ রেজা শাহ পাহলেভির শাসনামলে মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে যে মার্কিনি নীতি তার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ইরান। ইরানকে সঙ্গে নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থ নিশ্চিত করেছিল। কিন্তু সেই দৃশ্যপট বদলে যায় ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর। তারপর অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। ইরানে রুহানির উত্থান ও দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয় প্রমাণ করেÑ ইরানের নয়া নেতৃত্ব যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আরও উন্নত করতে চায়। কিন্তু ট্রাম্প যেভাবে এগোচ্ছেন, তা পুরো দৃশ্যপটকে বদলে দিতে পারে। এখানে নতুন করে অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও উত্তেজনার সৃষ্টি হতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরব-ইরান দ্বন্দ্ব কিংবা শিয়া-সুন্নি সেই পুরনো বিরোধ যদি আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, তাহলে তা কারো জন্যই কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না।
Daily Amader Somoy
27.05.2017

চীন-ভারত দ্বন্দ্ব ও ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এর ভবিষ্যৎ


গত ১৬ মে পেইচিংয়ে শেষ হয়েছে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ (ওবিওআর) শীর্ষক একটি আন্তর্জাতিক শীর্ষ সম্মেলন। চীন এই শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের ‘ব্রেন চাইল্ড’ হচ্ছে এই ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ মহাপরিকল্পনা। এই মহাপরিকল্পনার আওতায় তিনি সড়ক ও রেলপথে চীনের সঙ্গে দক্ষিণ তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্য এশিয়া তথা রাশিয়া ও ইউরোএশিয়ার সঙ্গে ইউরোপকে সংযুক্ত করতে চান। এটা করতে গিয়ে তিনি স্থলপথে চীনের এক অঞ্চলের সঙ্গে ইউরোপের সংযুক্তি ঘটাবেন, যাকে বলা হচ্ছে ‘বেল্ট’ আর অন্যদিকে সমুদ্রপথে চীনের অন্য একটি অঞ্চলের সঙ্গে ইউরোপের সংযুক্তি ঘটবে, যাকে বলা হচ্ছে ‘রোড’। প্রাচীন যুগে হান সাম্রাজ্যের সময় (২২০ বিসি-২০৬ বিসি) চীনা সম্রাট যে ‘সিল্ক রুট’-এর প্রচলন করেছিলেন (চীনা পণ্য নিয়ে ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে অন্য অঞ্চলে যাওয়া), আধুনিক যুগে এসে শি চিনপিং সেই ‘সিল্ক রুট’-এর নতুন একটি সংস্করণ দিলেন।
২০১৩ সালে মধ্য এশিয়া সফরের সময় শি চিনপিং প্রথমবারের মতো এই ধারণা দিয়েছিলেন। মাত্র চার বছরের মধ্যে তিনি বাস্তবে এর রূপ দিলেন। তিনি পেইচিংয়ে যে শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন, তাতে যোগ দিয়েছিলেন ২৯টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে ছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অনুপস্থিতি শীর্ষ সম্মেলনের সাফল্যকে ম্লান করে দেয়। ভারতের অনুপস্থিতি ছিল উল্লেখ করার মতো। ভারত এ সম্মেলনে যোগ না দেওয়ায় এ কর্মসূচির ভবিষ্যৎ একটা প্রশ্নের মুখে থাকল; যদিও সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, চীন ধীরে ধীরে ভারতের বড় বাণিজ্যিক অংশীদার হয়ে উঠছে। ২০১৪ সালে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ৭১ বিলিয়ন ডলার; যদিও সত্য এটাই, বাণিজ্য ঘাটতিও বাড়ছে। আর এই ঘাটতি ভারতের প্রতিকূলে, যেখানে ২০০১-২০০২ সালে এক বিলিয়ন ডলার ঘাটতি ছিল, তা ২০১৫ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮ বিলিয়ন ডলারে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির (পিপিপি) দেশ চীন। আর দ্রুত বিকাশমান ভারতের অর্থনীতি বিশ্বের তৃতীয় (পিপিপি, সাধারণ সপ্তম) অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। এশিয়ায় এ দুই বড় অর্থনীতির মধ্যে সম্পর্ক কী হবে কিংবা ওবিওআর নিয়ে দ্বন্দ্ব বড় কোনো সংকটের জন্ম দেবে কি না—এসব এখন ভাবনার বিষয়। তবে এটা বলতেই হয়, বেশ কিছু বিষয়ে পার্শ্ববর্তী এ দেশ দুটির মধ্যে দ্বিমত ও বিভাজন আছে। কিন্তু বাণিজ্যিক সম্পর্ক এ বিভাজন আর বিদ্বেষকে ছাড়িয়ে গেছে। সীমান্ত নিয়ে যে সমস্যা ছিল তা পুরোই গেছে—চীন অরুণাচল প্রদেশের একটা অংশকে তাদের নিজেদের এলাকা বলে দাবি করে। এ দাবি চীন পরিত্যাগ করেনি। নরেন্দ্র মোদির পেইচিং উপস্থিতির সময় (মে ২০১৫) চীনা সরকারি টিভিতে ভারতের যে ম্যাপ দেখানো হয়েছিল তাতে কাশ্মীর ও অরুণাচলকে ভারতীয় অংশ হিসেবে দেখানো হয়নি। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের মধ্য দিয়ে চীন সড়ক নির্মাণ শেষ করছে ভারতের আপত্তি সত্ত্ব্বেও। দক্ষিণ চীন সাগরে চীন একটি বিমানঘাঁটি নির্মাণ করছে, যা কিনা জাপানের নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ। এ ধরনের কর্মকাণ্ড ভারতের নিরাপত্তা স্ট্র্যাটেজিস্টদের আতঙ্কিত করেছে। ভারত তার উদ্বেগ প্রকাশ করলেও চীন তাতে সম্মান দেখায়নি। নেপাল ও মিয়ানমারে চীনা প্রভাব বাড়ছে—এটাও ভারতীয়দের উত্কণ্ঠার অন্যতম একটি কারণ। ২০১৫ সালে ভূমিকম্পকবলিত নেপালে ত্রাণ বিতরণ নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যে এক ধরনের ‘ঠাণ্ডা লড়াই’ও আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম। ভারত গেল বছর ভারত মহাসাগরে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রকে সঙ্গে নিয়ে একটি বড় ধরনের নৌ সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছিল। এটা নিঃসন্দেহে চীনাদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। ভারত একটি পারমাণবিক শক্তি। ভারত এখন পরমাণু সরবরাহকারী গোষ্ঠীতে (এনএসজি) অন্তর্ভুক্ত হতে চায়। কিন্তু তাতে আপত্তি রয়েছে চীনের। ওষুধ, তথ্য-প্রযুক্তি, কৃষিপণ্য নিয়ে ভারত চীনা বাজারে ঢুকতে চায়। কিন্তু তাতে রয়েছে চীনাদের আপত্তি।
ভবিষ্যতে চীনাদের একটা বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে ভারতের প্রাচীন ‘কটন রুট’-এর পুনরুত্থান। প্রাচীন যুগে ভারত ভারত মহাসাগরকে কেন্দ্র করে তার সুতি শিল্পের বিকাশ ঘটিয়েছিল। প্রাচীন ভারতে বণিকরা ভারত মহাসাগরের কয়েকটি রুট ব্যবহার করে তাদের পণ্যসামগ্রী, বিশেষ করে ভারতীয় সুতি কাপড় নিয়ে সুদূর আফ্রিকা পর্যন্ত যেত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয় সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল এ পথ ধরেই। অথচ চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ মহাপরিকল্পনার সঙ্গে মোদির প্রস্তাবিত ‘কটন রুট’-এর ধারণা সাংঘর্ষিক। প্রাচীন কটন রুটকে নতুন করে সাজানোর মধ্য দিয়ে ভারত এক মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে; অর্থাৎ ভারত মহাসাগরে তার সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করা। অনেকেই স্মরণ করতে পারবেন, মোদি ২০১৫ সালের মার্চ মাসে মরিশাস, সিসিলি ও শ্রীলঙ্কা সফর করেছেন। মরিশাস সফরের সময় মরিশাসের সঙ্গে সেখানে একটি ভারতীয় নৌঘাঁটি স্থাপনের ব্যাপারে চুক্তি হয়েছে। মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে একটি মৈত্রী জোট গড়ার উদ্যোগ নিয়েছিল ভারত। ওই জোটেও মরিশাস ও সিসিলিকে পর্যবেক্ষক হিসেবে থাকার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এটা যদি কার্যকর হয়, তাহলে অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিম উপকূল থেকে শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ মধ্যাঞ্চলের সিসিলি, মরিশাস কিংবা সুদূর ওমান-মোজাম্বিকও একই প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হবে। এর অর্থ পরিষ্কার, বিশাল ভারত মহাসাগরে ভারত তার নৌবাহিনীর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায় এবং ‘ইন্ডিয়ান ওসেন রিম’ বা ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে অন্যতম একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে চায়। অথচ চীন এরই মধ্যে ‘মুক্তার মালা’ নীতির মাধ্যমে ভারত মহাসাগরে তার উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে। জিবুতিতে একটি নৌঘাঁটি নির্মাণ করতে চায় চীন—এ খবর সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। তবে চীনের জন্য একটি খারাপ খবর হচ্ছে শ্রীলঙ্কায় তার যে প্রভাব ছিল, তা এখন কমতির দিকে। সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষের ‘অতি চীননির্ভর’ নীতির কারণে তাঁকে ক্ষমতা হারাতে হয়েছিল। সেখানে সিরিসেনার নেতৃত্বে একটি ‘ভারতবাজ’ সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে। ফলে আগামী দিনে ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে চীন ও ভারতের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করার প্রতিযোগিতা যে থাকবে, তা বলাই বাহুল্য। এর ফলে বাধাগ্রস্ত হবে ওবিওআরের বিকাশ।
ভারত এরই মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার সর্বত্র তার রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় তার সীমান্তবর্তী যেসব দেশ রয়েছে, প্রতিটি দেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক শুধু ভালোই নয়, বরং সর্বকালের সেরা সম্পর্ক রয়েছে এখন। এ অঞ্চলে ভারতের অর্থনৈতিক, সামরিক ও স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। অতীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সরকার যা করতে পারেনি, তা মোদি সরকার করে দেখিয়েছে। ‘সার্ক যাত্রা’র অংশ হিসেবে ভারত এ অঞ্চলের দেশগুলোকে তার পতাকাতলে আনছে। এটা অনেকটা ‘মনরো ডকট্রিন’-এর ভারতীয় সংস্করণ, অর্থাৎ ভারত চাইবে না এ অঞ্চলে অন্য কোনো শক্তি কর্তৃত্ব করুক অথবা প্রভাব বিস্তার করুক। চীন এ অঞ্চলের নিকট প্রতিবেশী। বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে চীন সীমান্ত খুব বেশি দূরে নয়। এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব সংকুচিত করার উদ্দেশ্য নিয়েই ভারত কাজ করে যাচ্ছে। ভারতের আপত্তির কারণে ভুটানে এখন পর্যন্ত চীন তার দূতাবাস খুলতে পারেনি। তাই চীন-ভারত সম্পর্কটা অনেকের কাছেই আলোচনার অন্যতম একটি বিষয়। এ সম্পর্ককে অনেক পর্যবেক্ষক ‘ভারতের হাতি বনাম চীনের ড্রাগন’ (Indian Elephant vs Chinese Dragon) হিসেবে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ চীনের পরিচিতি যেখানে ড্রাগনকে দিয়ে, ঠিক তেমনি ভারতের পরিচিতি হাতিকে দিয়ে। ‘হাতি বনাম ড্রাগন’ দ্বন্দ্ব নিঃসন্দেহে একুশ শতকের মধ্যভাগে শুধু এ অঞ্চলেই নয়, বরং বিশ্বরাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে।
অনেকেই স্মরণ করতে পারেন ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের কথা, যে যুদ্ধে ভারতের একটা বিশাল এলাকা চীন দখল করে নিয়েছিল। এর আগে মধ্য পঞ্চাশের দশকে ‘হিন্দি-চীনি ভাই ভাই’ স্লোগান তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। তিব্বতকে কেন্দ্র করে ভারত ও চীন যে ‘পঞ্চশীলা নীতি’ গ্রহণ করেছিল, যা ন্যাম বা জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন প্রতিষ্ঠায় একটি ভিত্তি দিয়েছিল। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই পঞ্চশীলা নীতি। যেমন বলা যেতে পারে ইন্দোনেশিয়ার কথা। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রনীতিতে এই পঞ্চশীলার কথা বলা আছে। মধ্য পঞ্চাশের সেই ‘নেহরু-চৌ এন লাই’ ইমেজ আবার ফিরে এসেছিল মোদি-শি চিনপিং বন্ধুত্বের মধ্য দিয়ে। এটি কতটুকু কার্যকর হবে, মোদির এই সফর দুই দেশের সম্পর্ককে কত উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবে, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে। এখানে মূল সমস্যা হচ্ছে মানসিকতার। ভারতের ব্যুরোক্রেসি ভারতকে একটি বিশ্বশক্তি হিসেবে দেখতে চায়। রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষে এ প্রভাব কাটানো কঠিন। মনমোহন সিং পারেননি। এখন দেখার পালা মোদি কতটুকু পারেন। তবে এটা তো সত্য, মোদির নিজস্ব একটা স্টাইল আছে। তিনি রাজনীতিকে পাশে ঠেলে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গুরুত্ব দিচ্ছেন বেশি। তাঁর চাই উন্নয়ন। চাই বিনিয়োগ। চাই ব্যবসা। সে কারণে পুরনো বৈরিতা ভুলে গিয়ে তিনি চীন সফরে বাণিজ্যিক সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়েছিলেন বেশি। তাঁর বৈদেশিক নীতির এটাই বড় বৈশিষ্ট্য। তাঁর জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও সর্বশেষ চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া সফরের উদ্দেশ্য ছিল একটাই, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচিকে সফল করা।
এখন ভারত ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ বা ওবিওআর শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিল না। ভারত যুক্তি দেখিয়েছে, চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর, যা ওবিওআরের একটি অংশ, তা গিলগিট বালটিস্তানের ওপর দিয়ে গেছে। ওই অঞ্চলটি পাকিস্তানের অধিকৃত হলেও, ভারতেরও দাবি রয়েছে। এই অর্থনৈতিক করিডর অবকাঠামো নির্মাণে প্রায় ১০ হাজার চীনা কাজ করছে আর তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিয়োজিত রয়েছে ১২ হাজার পাকিস্তানি সেনা। বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলছে। অভিযোগে আছে, এর পেছনে ইন্ধন রয়েছে ভারতের। ফলে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব ও ভারত-চীন দ্বন্দ্ব প্রস্তাবিত ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচি ভণ্ডুল করে দিতে পারে! অথচ ওবিওআর একটি বড় সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। যে ৬৪টি দেশ ওবিওআর পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত, তা বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। বিশ্বের জ্বালানিসম্পদের ৭৫ শতাংশ রয়েছে এ অঞ্চলে। আর বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক বাস করে এখানে। শীর্ষ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, চীন ওবিওআর প্রকল্পে প্রায় ১৩ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। আগামী ২০৪৯ সালে অর্থাৎ চীনা বিপ্লবের যখন ১০০ বছর পূর্ণ হবে তখন এ পরিকল্পনা সম্পন্ন হবে। নিঃসন্দেহে ভারত যদি শেষ পর্যন্ত এ পরিকল্পনায় না থাকে, তাহলে চীনা লক্ষ্য অর্জিত হবে না। ভারতকে বাদ দিয়ে ওই প্রকল্প কতটুকু সফল হবে, সে প্রশ্নও উঠেছে। জুন মাসে পেইচিংয়ে ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে অংশ নেবেন নরেন্দ্র মোদি। তাতে বরফ কতটুকু গলবে, সেটিও একটি প্রশ্ন। যদি ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচি পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়, তাহলে বদলে যাবে পুরো দৃশ্যপট। কিন্তু প্রশ্ন থাকলই ভারতের মতো বড় অর্থনীতির দেশের অংশগ্রহণ ছাড়া ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচি আদৌ সফল হবে কি না!
Daily Kaler kontho
23.05.2017

উদ্যোগ আছে, শৃঙ্খলা নেই



বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল। দলটিকে নিয়ে আলাপ-আলোচনার যেন শেষ নেই। ২০১৯ সালের প্রথমদিকেই নির্বাচনটি হবে, এটা মোটামুটি নিশ্চিত করেছেন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। ইতিমধ্যে খালেদা জিয়া একটি ভিশন-২০৩০ উপস্থাপন করেছেন। সেটা নিয়েও কম বিতর্ক হচ্ছে না। টকশোগুলোতে দেখেছি সেখানে সমালোচনার ঝড়। আর আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা তো হরহামেশাই ভিশন-২০৩০-এর সমালোচনা করে আসছেন। এসব সমালোচনার মধ্য দিয়ে অন্তত একটা জিনিস আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে, আর তা হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল এই ভিশন-২০৩০-কে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। বিশেষ করে তোফায়েল আহমেদ, সৈয়দ আশরাফ কিংবা ওবায়দুল কাদের যখন ভিশন-২০৩০-এর কঠোর সমালোচনা করেন, তখন বুঝতে হবে আওয়ামী লীগের ভেতরে এক ধরনের ভয় ও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিএনপি তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছে। একটি দল তা করতেই পারে। আওয়ামী লীগও করেছিল রূপকল্প-২০২১। এখন জাতীয় পার্টিও বলছে তারাও একটা রূপকল্প উপস্থাপন করবে। এগুলো ভালো দিক। কেননা একটি দল, যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় আছে বা আগামীতে যেতে চায় তাদের দেশ পরিচালনার ব্যাপারে একটি চিন্তা-ভাবনা বা পরিকল্পনা থাকা উচিত। তবে এ পরিকল্পনা হওয়া উচিত বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থাকে বিবেচনায় নিয়ে।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ব্যাপারে কতগুলো বিষয় থাকা উচিত। যেমন জনসংখ্যা। একটি বিশাল জনগোষ্ঠী রয়েছে আমাদের। এ জনগোষ্ঠীর মাঝে আবার তরুণ প্রজন্মের রয়েছে আধিক্য। পরিকল্পনা হওয়া উচিত এ তরুণ প্রজন্মকে আমরা কীভাবে কাজে লাগাতে পারব। তাদের তথাকথিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি ধরিয়ে দিয়ে তাদের যে শক্তি, তা কি আমরা ব্যবহার করতে পারব? স্বাধীনতার ৫০ বছর আমরা পালন করব ২০২১ সালে। খুব বেশি দিন আমাদের বাকি নেই। প্রবৃদ্ধি সরকারি হিসাবে ৭-এর ওপরে হলেও আন্তর্জাতিকভাবে তা ৬ দশমিক ৫-এর মতো। এটাও বড় অর্জন। এ অর্জন ধরে রাখতে হলে অর্থনীতিতে কী কী পরিবর্তন আনতে হবে? দলগুলোর এ ব্যাপারে স্পষ্ট বক্তব্য থাকা উচিত। দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আগামীতে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি কী হবে? জোটবদ্ধতা (সৌদি সামরিক জোট), ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা (ভারতকেন্দ্রিক নীতি), চীনের অর্থনৈতিক আধিপত্যের শরিক হওয়া (ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড)? বিষয়গুলোর ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা থাকা বাঞ্ছনীয়। একটি রাজনৈতিক দল তাদের দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়গুলো দেখবে। এতে করে পার্থক্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক; কিন্তু খুব নগ্নভাবে যখন সমালোচনা করা হয়, তখন প্রশ্ন ওঠে বৈকি। ভিশন-২০৩০ উপস্থাপিত হয়েছে। এটি বিএনপির একটি পরিকল্পনা, একটি রূপকল্প, যে রূপকল্প বিএনপি যদি ক্ষমতায় যেতে পারে, তাহলে বাস্তবায়ন করবে বলে কথা দিয়েছে। একটি বড় দলের কাছ থেকে এ ধরনের একটি পরিকল্পনা আশা করাই যায়। ভিশন-২০৩০-এর অর্থ হচ্ছে বিএনপি ২০৩০ সালকে টার্গেট করেছে। অর্থাৎ বিএনপি আমার বিবেচনায় ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে টার্গেট করছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নিবাচন সামনে রেখে বিএনপি এই ভিশন দিল। এটা নির্বাচনী ইশতেহার নয়। এটা বিএনপির একটি মহাপরিকল্পনা। বাংলাদেশকে বিএনপি কীভাবে দেখতে চায়, এই ভিশন-২০৩০-এ তা প্রতিফলিত হয়েছে। আওয়ামী লীগও এ ধরনের একটি মহাপরিকল্পনা দিয়েছিল। রূপকল্প-২০২১। সেই রূপকল্পেও আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে ২০২১ সালে কীভাবে দেখতে চায়, তা জাতির সামনে উপস্থাপন করেছিল। এ ধরনের যে কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা যে কোনো বিবেচনায় প্রশংসার দাবি রাখে।

সুতরাং বিএনপি যখন ভিশন-২০৩০ উপস্থাপন করল, আমরা তাকে স্বাগত না জানিয়ে পারি না। বিএনপি বড় দল। ভবিষ্যতে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনার দাবিদার। সুতরাং ভিশন-২০৩০ নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। আমার বিবেচনায় ভিশন-২০৩০-এ অনেক ইতিবাচক দিক আছে। তবে কিছু কিছু নেতিবাচক দিক যে নেই, তা বলা যাবে না। আছে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট একটি সংসদের কথা বিবেচনায় নেয়ার প্রস্তাব করেছে বিএনপি। সরাসরি প্রস্তাব করেননি খালেদা জিয়া। বলেছেন বিষয়টি নিয়ে আরও আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এটি কোনো ভালো সিদ্ধান্ত নয়। এতে করে নানা জটিলতা তৈরি হবে। সংসদীয় এলাকায় কে প্রতিনিধিত্ব করবেন, তা নানা প্রশ্ন তৈরি হবে এবং দু’জন সংসদ সদস্যকে নিয়েও বিতর্ক তৈরি হবে। এটা নিয়ে সুস্পষ্ট আইন তৈরি করলেও ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হতে বাধ্য। অন্য যেসব দেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ রয়েছে, (ভারত, পাকিস্তান, যুক্তরাজ্য, জার্মানি) তার সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহ্যকে মেলানো যাবে না। বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ। হতে পারে জনসংখ্যা বেশি; কিন্তু এই ছোট দেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ কাম্য নয়। খালেদা জিয়া যে যুক্তি দেখিয়েছেন, অর্থাৎ পেশাজীবীদের উচ্চকক্ষে স্থান দেয়া, এটা তত্ত্বগতভাবে ভালো; কিন্তু এককক্ষবিশিষ্ট সংসদীয় রাজনীতিতেও পেশাজীবীদের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। বিএনপি পেশাজীবীদের স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। এতে করে সংসদীয় রাজনীতির মান আরও বাড়বে। বাংলাদেশে কোনো প্রদেশ নেই। জাতিগতভাবেও তেমন কোনো পার্থক্য নেই। ফলে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে উচ্চকক্ষে প্রতিনিধিত্ব করারও কোনো প্রয়োজন নেই। ফলে উচ্চকক্ষ সৃষ্টি করা একটি অপ্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। এতে করে সরকারি খাতের অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছু হবে না। প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনতে চায় বিএনপি। ভিশন-২০৩০-এ আছে সে কথা। কিন্তু এ ভারসাম্য কীভাবে আনা যাবে, তা তিনি স্পষ্ট করেননি। এটা অস্বীকার করা যাবে না, বর্তমান সংবিধান প্রধানমন্ত্রীকে যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়েছে। সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতাবলে প্রধানমন্ত্রীর একক কর্তৃত্ব নিশ্চিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী অতি ক্ষমতাবান ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। এটা কীভাবে কমানো যায়, কীভাবে রাষ্ট্রপতিকে কিছু ক্ষমতা দিয়ে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্য আনা যায়, তা যদি খালেদা জিয়া নিশ্চিত করতেন, তাতে করে সাধারণ মানুষ একটা স্পষ্ট ধারণা পেত। ভিশন-২০৩০-এ বলা হয়েছে, ‘অন্য কোনো রাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি করলে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া হবে। মুসলিম উম্মাহ ও প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তুলবে বিএনপি।’ এ বক্তব্য অনেকটা সাদামাটা। বর্তমান সরকারও অনেকটা একই সুরে তার পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করে। এ ক্ষেত্রে খুব একটা পার্থক্য নেই। খালেদা জিয়া বলেছেন, চীনের প্রস্তাবিত ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ উদ্যোগের সঙ্গে সংযুক্তির ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হবে। প্রশ্ন হচ্ছে এ উদ্যোগ তো ইতিমধ্যে চীন নিয়েছে। এ নিয়ে মে মাসের মাঝামঝি চীনে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। তাতে বাংলাদেশের শিল্পমন্ত্রীসহ একটি প্রতিনিধিদল যোগ দিয়েছিল। চীনের সঙ্গে কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ব্যাপারে ভিশন-২০৩০-এ বিশেষ কিছু বলা নেই। ভিশন-২০৩০-এর এটা একটা দুর্বল দিক। পররাষ্ট্র ও দেশরক্ষা নীতি এখানে বিস্তারিত আলোচিত হয়নি। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার যে ভিত্তি রচিত হয়েছে, সে ব্যাপারেও তেমন কোনো কথা নেই। তবে ভিশন-২০৩০-এ অনেক ভালো ভালো কথা আছে।

খালেদা জিয়া থ্রিজি, অর্থাৎ সুশাসন, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও সুসরকারের কথা বলেছেন। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে থ্রিজির গুরুত্ব অনেক। এখন এই থ্রিজিকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, বাংলাদেশে এ তিনটি সমস্যাই মূল- অর্থাৎ সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা, দুর্নীতিরোধ করা আর সুসরকার প্রতিষ্ঠা করা। এ ক্ষেত্রেও যে প্রশ্নটি করা যায়, তা হচ্ছে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে কীভাবে এটি করবে, তার সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। বিএনপির প্রস্তাবে সংবিধানে গণভোট ব্যবস্থা প্রবর্তন, সংসদে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি ও পাবলিক আন্ডারটেকিংস কমিটির সভাপতি পদ বিরোধী দলকে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশের পার্লামেন্টে এমনটি আছে। ডেপুটি স্পিকার বিরোধী দল থেকে নেয়া হবে এমন কথাও বলা হয়েছে। এমন নজিরও অনত্র আছে। আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো পরিচালনার ভার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে ন্যস্ত করা, ৩৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা, চট্টগ্রাম উপকূলীয় এলাকায় বঙ্গোপসাগরে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা, দেশকে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা, মাথাপিছু আয় ৫ হাজার ডলারে উন্নীত করাসহ জিডিপির প্রবৃদ্ধি ডাবল ডিজিটে উন্নীত করা, খালখনন কর্মসূচি আবারও চালু করা, স্বাস্থ্যবীমা চালুসহ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের বিষয়টি পুনঃপরীক্ষা ইত্যাদিসহ আরও বেশকিছু প্রস্তাব রয়েছে ভিশন-২০৩০-এ। খালেদা জিয়া গ্রিন এনার্জির কথা বলতে পারতেন। তা বলেননি। এমনকি সুন্দরবনের পাশে রামপাল কয়লাচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে যে বিতর্ক, সে ব্যাপারেও খালেদা জিয়া কোনো মন্তব্য করেননি। আসলে ভিশন-২০৩০ নিয়ে মূল বিতর্ক কেন্দ্রীভূত এক জায়গায়- আর তা হচ্ছে এটি এক ধরনের নির্বাচনী ইশতেহার।

আমি ভিশন-২০৩০ পড়ে দেখেছি। আরও অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত ছিল। অনেক ক্ষেত্রেই ভাসা ভাসা মন্তব্য রয়েছে। তথ্য ও উপাত্তের বড় অভাব। অর্থনীতি সেক্টরটা উপেক্ষিত থেকেছে। বিএনপির একটি বড় সমস্যা হচ্ছে দলটির কোনো থিঙ্ক ট্যাংক নেই। যাদের থিঙ্ক ট্যাংকের সঙ্গে জড়িত বলা হয় (যেমন- ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী), তাদের আমি জিজ্ঞেস করে দেখেছি, তারা এটা অস্বীকার করেছেন। অনেকেই বলেছেন কোনো ধরনের রিসার্চ ছাড়াই এটি উপস্থাপন করা হয়েছে। একজন অর্থনীতিবিদ, যাকে থিঙ্ক ট্যাংকের সদস্য বলে ধরা হয়, খালেদা জিয়ার সঙ্গে এক টেবিলে বসেনও, তিনি থাকতে অর্থনীতি সেক্টরটা উপেক্ষিত থাকল কেন? পররাষ্ট্র সচিব আর রাষ্ট্রদূত, সাবেক সচিবদের দিয়ে যদি ভিশন-২০৩০ তৈরি করা হয়, তার পরিণতি এমনই হবে। অনেক বিষয় অনুপস্থিত থেকে যাবে। বিএনপির মতো বড় দলের কাছ থেকে তা কাম্য নয়। তড়িঘড়ি করে উপস্থাপনের প্রয়োজন ছিল না। খালেদা জিয়া বিএনপির কাউন্সিলে একটা ধারণা দিয়েছিলেন। তারপর আদৌ বিশেষজ্ঞ মতামত নেয়া হয়েছিল বলে আমার মনে হয়নি। প্রয়োজন ছিল বিষয়ভিত্তিক গ্রুপ করা। সেখানে থাকা উচিত ছিল বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের। দলীয় কর্মীদের দিয়ে ‘বিশেষজ্ঞ কমিটি’ হলে, তাতে ভালো কিছু আশা করা যায় না।

বিএনপি ১৩ মে একটি জাতীয় সেমিনার করেছে। বিষয় বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা। ধারণা করছি, ভিশন-২০৩০-কে সমৃদ্ধ করার জন্যই এ ধরনের আরও সেমিনারের আয়োজন করবে বিএনপি। এটা ভালো দিক। এতে করে একটা দিকনির্দেশনা পাওয়া যাবে; কিন্তু সেমিনারে উপস্থাপিত বক্তব্য কি একুশ শতক উপযোগী? যারা বক্তব্য দিলেন, লেখা পাঠ করলেন, তারা কি তথ্য-উপাত্ত দিয়ে দেখাতে পেরেছেন ২০৩০ কিংবা তারপর কোন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের দরকার? শিক্ষাব্যবস্থা দেশে সার্টিফিকেটসর্বস্ব জনগোষ্ঠী তৈরি করবে না বরং কর্মক্ষম একটি জনগোষ্ঠী তৈরি করবে, সে ব্যাপারে উপস্থিত শিক্ষাবিদরা কিংবা প্রবন্ধ পাঠকারীরা কি কোনো প্রস্তাব দিয়েছিলেন? কোনো রূপরেখা দিয়েছিলেন? বিএনপির বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে সমস্যা এখানেই। এরা সবাই সব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। বিএনপির এটাই বড় সমস্যা। আর একটা কথা। এ ধরনের সেমিনার হওয়া উচিত শুধু নীতিনির্ধারকদের জন্য। তাদের জন্যই এ সেমিনার। খালেদা জিয়াসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যরা থাকবেন। এর বাইরে সিনিয়র নেতারা থাকতে পারেন। তারা প্রশ্ন করবেন, বিষয় সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে অবহিত হবেন এবং পরবর্তী সময়ে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবেন। প্রয়োজনে ভিশন-২০৩০-এ সংশোধনী আনবেন। শত শত নেতাকর্মীর উপস্থিতিতে কোনো সেমিনার হয় বলে আমার জানা নেই। খালেদা জিয়ার সঙ্গে একই টেবিলে যাদের দেখলাম, তাদের কাউকে কাউকে আমি জেনারেল মঈনের বই-এর প্রকাশনা উৎসবে দেখেছি। ছবিও আছে। এরা সব জায়গাতেই থাকেন। তবুও ভালো। শিক্ষা নিয়ে কিছু বক্তব্য এসেছে। আরও সেমিনার হোক এবং তা যেন হয় বিষয়ভিত্তিক।

বিএনপি সক্রিয় হয়েছে। এটা ভালো দিক। স্থায়ী কমিটির সদস্যরা যদি আরও সক্রিয় হয়, যদি খালেদা জিয়া বিভাগীয় শহরগুলোতে যান, আমার ধারণা বিএনপি ঘুরে দাঁড়াবে।
Daily Jugantor
22.05.2017

চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ মহাপরিকল্পনা ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

সম্প্রতি চীনের উদ্যোগে বেইজিংয়ে নতুন সিল্ক রুটখ্যাত ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচিসংক্রান্ত একটি শীর্ষ সম্মেলন শেষ হয়েছে। এ শীর্ষ সম্মেলনে ৩০ দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা যোগ দিয়েছিলেন। তাদের মাঝে ছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান ও মধ্য এশিয়ার সরকারপ্রধানরা। দক্ষিণ তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারের সরকারপ্রধানরাও এ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শিল্পমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ওই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিল। তবে ভারত এ সম্মেলনে যোগ দেয়নি। আন্তর্জাতিক আসরে চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ (ওবিওআর) মহাপরিকল্পনা একটি বহুল আলোচিত বিষয়। এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে বিশ্বের অর্থনৈতিক দৃশ্যপট পুরোপুরি বদলে যাবে এবং বিশ্বে চীন অন্যতম একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। অনেক কারণের জন্য ওবিওআরের গুরুত্ব রয়েছে অনেক। প্রথমত, এ মহাপরিকল্পনার আওতায় চীনকে একদিকে মধ্য এশিয়া ও আফ্রিকা এবং অন্যদিকে ইউরোপের সঙ্গে সড়ক, রেলপথ ও সামুদ্রিক পথে সংযুক্ত করছে। ফলে বৈশ্বিক বাণিজ্যে একটা বড় পরিবর্তন আসবে। এর মধ্য দিয়ে বাণিজ্যে চীনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে- এটা সত্য। কিন্তু ওবিওআরের সঙ্গে সংযুক্ত দেশগুলোও উপকৃত হবে। দ্বিতীয়ত, ৬০ থেকে ৬৫টি দেশ এ ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচির আওতায় রয়েছে। বিশ্বের অর্থনীতির তিন ভাগের এক ভাগ এর আওতায় আসবে। বিশ্বের জনসংখ্যার অর্ধেক বসবাস করে এ অঞ্চলে এবং একই সঙ্গে বিশ্বে যে জ্বালানি সম্পদের রিজার্ভ রয়েছে, তার মাঝে শতকরা ৭৫ ভাগ এ এলাকায় রয়েছে। ফলে চীনের নেতৃত্বে ওবিওআর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক এককেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা ভেঙে যাবে। তৃতীয়ত, ওবিওআর একটি মহাপরিকল্পনা। এটা চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের একটি বিশ্ব দর্শন। এতে প্রাথমিকভাবে ১ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। ১৪-১৫ মে বেইজিংয়ে ওবিওআরের যে শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল, তাতে এ খাতে শি জিনপিং এক বিশাল অঙ্কের অর্থ বরাদ্দের কথা ঘোষণা করেছেন। এর মধ্য দিয়ে বিশাল এক এলাকায় চীনা অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। এক নতুন ধরনের অর্থনৈতিক উপনিবেশবাদ আমরা প্রত্যক্ষ করব একুশ শতকে। চীনা পণ্যের এক বিশাল বাজার গড়ে উঠবে ওবিওআরভুক্ত দেশগুলোয়। চীনা বিনিয়োগ বাড়ার কারণে চীনের ওপর নির্ভলশীলতা বাড়বে এসব দেশের। চতুর্থত, ওবিওআরভুক্ত দেশগুলো সুযোগ পাবে চীনের সঙ্গে শুল্কমুক্ত এক বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে। চীনের সঙ্গে বর্তমানে ১২টি দেশের ‘ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট’ (এফটিএ) রয়েছে। এ দেশগুলো হচ্ছে সিঙ্গাপুর, পাকিস্তান, চিলি, পেরু, কোস্টারিকা, আইসল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, হংকং ও তাইওয়ান। আরও আটটি দেশের সঙ্গে এফটিএ নিয়ে আলোচনা চলছে। এ দেশগুলো হচ্ছে জাপান, কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা, নরওয়ে ও কয়েকটি আঞ্চলিক সংস্থা। বাংলাদেশের সরকারপ্রধান ওবিওআর শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেননি। কিন্তু সিনিয়র মন্ত্রিপর্যায়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব হয়েছে। বাংলাদেশ ওবিওআর কর্মসূচিকে সমর্থন করছে। সুতরাং বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনা তৈরি হলো আগামীতে চীনের সঙ্গে একটি এফটিএ করার। বলা ভালো, বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্য চীনের অনুকূলে। ফলে এফটিএ স্বাক্ষরিত হলে এ থেকে বাংলাদেশ ফায়দা নিতে পারবে ভবিষ্যতে। পঞ্চমত, প্রস্তাবিত ওবিওআরে মোট ছয়টি অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে। প্রতিটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের সঙ্গে চীনের সংযুক্তি রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ওইসব অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নে চীন এগিয়ে আসবে। যেমন বলা যেতে পারে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের (সিপিইসি) কথা। সিপিইসিতে প্রাথমিকভাবে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৪৬ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭ বিলিয়ন ডলার। এ করিডোর চীনের খাসগরকে (জিয়াং জিয়াং প্রদেশ) পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের গাওদার সমুদ্রবন্দরকে সংযুক্ত করেছে। এ করিডোর পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত ‘আজাদ কাশ্মীরের’ গিলগিট-বালটিস্তান হয়ে খাইবার পাখতুনখোয়া, পাঞ্জাব ও বেলুচিন্তান প্রদেশের ভেতর দিয়ে গাওদারের সমুদ্রবন্দরে মিলিত হয়েছে। এ অর্থনৈতিক করিডোরে সড়ক ও রেলপথ ছাড়াও গ্যাসের পাইপলাইন থাকবে।
চীনের জ্বালানি চাহিদা প্রচুর। মধ্য এশিয়ায় রয়েছে প্রচুর জ্বালানি সম্পদ। চীন এ জ্বালানি সম্পদ নিয়ে যেতে চায় ইউনান প্রদেশে। এজন্যই চীন বাংলাদেশের কক্সবাজার উপকূলীয় অঞ্চলে সোনাদিয়ায় একটি গভীর বন্দর নির্মাণ করতে চেয়েছিল, ভারতের আপত্তির কারণে যা সম্ভব হয়নি। এখন সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত না হওয়ায় মিয়ানমারে এটা নির্মিত হবে। অথবা মিয়ানমারের কোনো বন্দর ব্যবহার করে চীন ‘কানেকটেড’ হবে, যাতে গাওদার বন্দর ব্যবহার করে ইউনান প্রদেশে (কুনমিং যার রাজধানী) পণ্য নিয়ে যাওয়া যায় এবং একই পথ অনুসরণ করে চীনা পণ্য রফতানি করাও সম্ভব হবে। এতে সময় কম লাগবে এবং চীনা পণ্যের দামও কমে যাবে। বাংলাদেশও এ থেকে উপকৃত হতে পারে। কেননা বাংলাদেশ উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা বিসিআইএমের (বাংলাদেশ-চীন, ইউনান প্রদেশ, ভারত ও মিয়ানমার) সদস্য। বিশ্বের জনগোষ্ঠীর শতকরা ৪০ ভাগ মানুষ এখানে বাস করে। বিশ্বের ৯ ভাগ এলাকা বিসিআইএমের অন্তর্ভুক্ত। বিশ্ব জিডিপির ৭ দশমিক ৩ ভাগ এ অঞ্চলের। ভারত এবং বাংলাদেশ এ জোট থেকে লাভবান হতে পারে। কুনমিং থেকে কলকাতা পর্যন্ত বিসিআইএমের আওতায় সড়কপথ হবে। কুনমিং থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত সড়ক আছে। বাংলাদেশের কক্সবাজার থেকে মিয়ানমার সীমান্ত পর্যন্ত সড়ক তৈরি করছে বাংলাদেশ। ভারতের সাতবোন রাজ্যগুলো কীভাবে বিসিআইএম করিডোর থেকে লাভবান হবে, তার একটি দৃষ্টান্ত দিই। সাতবোন রাজ্যের পণ্য কলকাতা সমুদ্রবন্দরে পৌঁছতে লাগে ৭ দিন। সেখান থেকে চীনের গন্তব্যে পৌঁছতে লাগে ৩ থেকে ৪ সপ্তাহ। এখন বিসিআইএম করিডোর ব্যবহার করে ভারত মাত্র ২ দিনে তার পণ্য ইউনান প্রদেশে পৌঁছে দিতে পারবে। এতে শতকরা ৩০ ভাগ খরচ কমে যাবে। ষষ্ঠ, ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ এ আরও পাঁচটি অর্থনৈতিক করিডোর রয়েছে। এ অর্থনৈতিক করিডোরগুলো ব্যবহার করে ইউরোপ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোও উপকৃত হবে। বিসিআইএম ও সিপিইসির বাইরে আরও যে চারটি অর্থনৈতিক করিডোর রয়েছে, সেগুলো হচ্ছে চীন-মঙ্গোলিয়া-রাশিয়া-ইকোনমিক করিডোর, নিউ ইউরো এশিয়ান ব্রিজ, চীন-মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া অর্থনৈতিক করিডোর এবং চীন-ইন্দোচায়না পেনিনসুলা। লক্ষ করলে দেখা যাবে, প্রতিটি ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে তার পার্শ¦বর্তী দেশগুলোকে সংযুক্ত করা হয়েছে। আর এভাবেই চীন দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ইউরো-এশিয়াসহ সুদূর ইউরোপের সঙ্গে সড়ক ও রেলপথে সংযুক্ত হবে। এটা এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। একদিকে সড়কপথে যখন চীন সংযুক্ত হবে, তখন অন্যদিকেও ইউরোপ থেকে চীনের অন্য অঞ্চলে সমুদ্রপথে সংযুক্ত হবে। প্রথম ক্ষেত্রে (বেল্ট) চীনের জি’আন শহর থেকে সড়কপথে নেদারল্যান্ডসের রটারডাম পর্যন্ত সংযুক্ত হবে। অপরদিকে রটারডাম থেকে ইতালির ভেনিস স্থলপথ এবং ভেনিস থেকে সমুদ্রপথে চীনের সমুদ্রবন্দর যুজউ পর্যন্ত সংযুক্ত হবে। বিশাল এক কর্মযজ্ঞ, যা চিন্তাও করা যায় না। কিন্তু চীনের বর্তমান নেতৃত্ব এ অসাধ্য কাজটি হাতে নিয়েছে এবং দেশটি যখন ২০৪৯ সালে তার বিপ্লবের ১০০ বছরে পা দেবে, তখন এ ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ এর মহাকর্মযজ্ঞ শেষ হবে।
পশ্চিমা গবেষকরা চীনের এ উদ্যোগকে চিহ্নিত করেছেন চীনের মার্শাল প্লান হিসেবে। পাঠকদের স্মরণ থাকার কথা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ পুনর্গঠনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ‘মার্শাল প্লান’ নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। অনেকটা সে মডেলকে সামনে রেখেই চীন একুশ শতকে অবকাঠামো উন্নয়নে যে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, তাকেই অভিহিত করা হয়েছে ‘চীনের মার্শাল প্লান’ হিসেবে। এখন প্রশ্ন অনেকÑ এক, বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র চীনের এ মহাপরিকল্পনাকে কীভাবে দেখছে? কেননা আগামী ১০ বছরের মধ্যে চীন বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান হবে তখন দ্বিতীয়। চীনের এ অর্থনৈতিক আধিপত্যকে যুক্তরাষ্ট্র সহজভাবে নেবে বলে মনে হয় না। দুই, উঠতি অর্থনীতির দেশ ভারত। ভারত চীনের এ উত্থানকে খুব ভালো চোখে দেখবে বলে মনে হয় না। তিন, ইউরোপের অবস্থান কী হবে? সম্প্রতি মে মাসে বেইজিংয়ে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ এর শীর্ষ সম্মেলন শেষ হয়েছে। চীন প্রায় ১০০টির মতো দেশকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তবে অনেক দেশই আসেনি। এমনিক যে ৬৮টি দেশ এই ওবিওআরে সংযুক্ত হবে, সেখান থেকেও সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব হয়নি। অনেক রাষ্ট্র তথা সরকারপ্রধান আসেননি। এর অর্থ পরিষ্কারÑ এ অঞ্চলের দেশগুলোর মাঝে চীনের ব্যাপারে এক ধরনের শঙ্কা আছে। ভারত সম্মেলনে যোগ দেয়নি। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের ব্যাপারে ভারতের আপত্তি রয়েছে। কেননা এটি বিতর্কিত গিলগিট-বালটিস্তানের ওপর দিয়ে গেছে, যা পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ভারত মনে করে এটি তাদের। সম্মেলন শেষে যে ইশতেহার প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে ইউরোপের কোনো রাষ্ট্র স্বাক্ষর করেনি। তারা পরিশেষের সমস্যাটা বড় করে দেখছে। ফলে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ এর সাফল্য নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল। ভারত-চীন দ্বন্দ্ব যদি আরও বেড়ে যায়, তাহলে এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে না। এক্ষেত্রে ছয়টি অর্থনৈতিক করিডোরের একটি বিসিআইএম করিডোর বিকশিত হবে না। ভারত মহাসাগরে দেশ দুইটি প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হবে। তবে এটা বলাই যায়, চীনের এ মহাপরিকল্পনা আগামীতে বারবার আলোচিত হতে থাকবেই। এখন যে অসন্তোষের জন্ম হয়েছে, তা নিরসনে চীন কী ভূমিকা নেয়, সে ব্যাপারেও লক্ষ থাকবে অনেকের।
Daily Alokito Bangladesh
21.05.2017

বিএনপির ভিশন ২০৩০ ও কিছু কথা


খালেদা জিয়া সম্প্রতি ভিশন ২০৩০ উপস্থাপন করেছেন। এটি বিএনপির একটি পরিকল্পনা, একটি রূপকল্প, যে রূপকল্প বিএনপি যদি ক্ষমতায় যেতে পারে, তাহলে বাস্তবায়ন করবে। একটি বড় দলের কাছ থেকে এ ধরনের পরিকল্পনা আশা করাই যায়। রূপকল্প বা ভিশন ২০৩০-এর অর্থ হচ্ছে, বিএনপি ২০৩০ সালকে টার্গেট করেছে। অর্থাৎ বিএনপি ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে টার্গেট করছে! একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির এই রূপকল্প ছিল। এটা নির্বাচনী ইশতেহার নয়। এটা বিএনপির একটি মহাপরিকল্পনা। বাংলাদেশকে বিএনপি কীভাবে দেখতে চায়, এই ভিশন ২০৩০-এ তা প্রতিফলিত হয়েছে। আওয়ামী লীগও এ ধরনের একটি মহাপরিকল্পনা দিয়েছিল। রূপকল্প ২০২১। সেই রূপকল্পেও আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে ২০২১ সালে কীভাবে দেখতে চায়, তা জাতির সামনে উপস্থাপন করেছিল। এ ধরনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা যে কোনো বিবেচনায় প্রশংসার দাবি রাখে। তাই বিএনপি যখন ভিশন ২০৩০ উপস্থাপন করল, আমরা তাকে স্বাগত না জানিয়ে পারি না। বিএনপি বড় দল। ভবিষ্যতে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনার দাবিদার। তাই ভিশন ২০৩০ নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। আমার বিবেচনায় ভিশন ২০৩০-এ অনেকগুলো ইতিবাচক দিক আছে। তবে কিছু কিছু নেতিবাচক দিক যে নেই, তা বলা যাবে না। আছে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট একটি সংসদের কথা বিবেচনায় নেওয়ার প্রস্তাব করেছে বিএনপি। সরাসরি প্রস্তাব করেননি খালেদা জিয়া। বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে আরও আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এটি কোনো ভালো সিদ্ধান্ত নয়। এতে করে নানা জটিলতা তৈরি হবে। সংসদীয় এলাকায় কে প্রতিনিধিত্ব করবেন, তা নানা প্রশ্ন তৈরি করবে এবং দু’জন ‘সংসদ সদস্য’কে নিয়ে বিতর্ক তৈরি হবে। এটা নিয়ে সুস্পষ্ট আইন থাকলেও ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হতে বাধ্য। অন্য যেসব দেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ রয়েছে (ভারত, পাকিস্তান, যুক্তরাজ্য, জার্মানি) তার সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহ্য মেলানো যাবে না। বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ। হতে পারে জনসংখ্যা বেশি। কিন্তু এই ছোট দেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ কাম্য নয়। খালেদা জিয়া যে যুক্তি দেখিয়েছেন, অর্থাৎ পেশাজীবীদের উচ্চকক্ষে স্থান দেওয়া, এটা তত্ত্বগতভাবে ভালো। কিন্তু এককক্ষবিশিষ্ট সংসদীয় রাজনীতিতেও পেশাজীবীদের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। বিএনপি পেশাজীবীদের স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। এতে করে সংসদীয় রাজনীতির মান আরও বাড়বে। বাংলাদেশে কোনো প্রদেশ নেই। জনসংখ্যার মাঝে জাতিগতভাবেও তেমন কোনো পার্থক্য নেই। ফলে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে উচ্চকক্ষে প্রতিনিধিত্ব করারও কোনো প্রয়োজন নেই। তাই উচ্চকক্ষ সৃষ্টি করা একটি অপ্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। এতে করে সরকারি খাতের অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছু হবে না। প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনতে চায় বিএনপি। ভিশন ২০৩০-এ আছে সে কথাও। কিন্তু এ ভারসাম্য কীভাবে আনা যাবে, তা তিনি স্পষ্ট করেননি। এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে যথেষ্ট ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতাবলে প্রধানমন্ত্রীর একক কর্তৃত্ব নিশ্চিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী অতি ক্ষমতাবান ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। এটা কীভাবে কমানো যায়, কীভাবে রাষ্ট্রপতিকে ‘বিন্দু’ ক্ষমতা দিয়ে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্য আনা যায়, তা যদি খালেদা জিয়া নিশ্চিত করতেন, তাতে করে সাধারণ মানুষ একটা স্পষ্ট ধারণা পেত। ভিশন ২০৩০-এ বলা হয়েছে, ‘অন্য কোনো রাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি করলে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেশের জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। মুসলিম উম্মাহ ও প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তুলবে বিএনপি।’ এই বক্তব্য অনেকটা সাদামাঠা বক্তব্য। বর্তমান সরকারও অনেকটা একই সুরে তার পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করে। এ ক্ষেত্রে খুব একটা পার্থক্য নেই। খালেদা জিয়া বলেছেন, চীনের প্রস্তাবিত ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ উদ্যোগের সঙ্গে সংযুক্তির ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই উদ্যোগ তো ইতোমধ্যে চীন নিয়েছে। এ নিয়ে মে মাসের মাঝামাঝি চীনে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাতে বাংলাদেশের শিল্পমন্ত্রীসহ একটি প্রতিনিধি দল যোগ দিয়েছে। চীনের সঙ্গে কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ব্যাপারে ভিশন ২০৩০-এ বিশেষ কিছু বলা নেই। সম্ভবত ভিশন ২০৩০-এ এটা একটা দুর্বল দিক। পররাষ্ট্র ও দেশরক্ষা নীতি এখানে বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার যে ভিত্তি রচিত হয়েছে, সে ব্যাপারেও তেমন কোনো কথা নেই। তবে ভিশন ২০৩০-এ অনেক ভালো ভালো কথা আছে। খালেদা জিয়া ‘থ্রি-জি’, অর্থাৎ সুশাসন, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও সুসরকারের কথা বলেছেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে থ্রি-জির গুরুত্ব অনেক। এখন এই থ্রি-জিকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, বাংলাদেশে সুস্থ সরকার পরিচালনায় এই তিনটি সমস্যাই মূলÑ অর্থাৎ সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা, দুর্নীতি রোধ করা আর সুসরকার প্রতিষ্ঠা করা। এ ক্ষেত্রেও যে প্রশ্নটি করা যায়, তা হচ্ছে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে কীভাবে এটি করবে, তার সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। বিএনপির প্রস্তাবে সংবিধানে গণভোট ব্যবস্থা প্রবর্তন, সংসদে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি ও পাবলিক আন্ডারটেকিংস কমিটির সভাপতি পদ বিরোধী দলকে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশের পার্লামেন্টে এমনটি আছে। ডেপুটি স্পিকার বিরোধী দল থেকে নেওয়া হবে, এমন কথাও বলা হয়েছে। এমন নজিরও অন্যত্র আছে। আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো পরিচালনার ভার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে ন্যস্ত করা, ৩৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা, চট্টগ্রাম উপকূলীয় এলাকায় বঙ্গোপসাগরে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা, দেশকে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা, মাথাপিছু আয় ৫ হাজারে উন্নীত করাসহ জিডিপির প্রবৃদ্ধি ডবল ডিজিটে উন্নীত করা, খাল খনন কর্মসূচি পুনরায় চালু করা, স্বাস্থ্যবীমা চালুসহ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিষয়টি পুনঃপরীক্ষা ইত্যাদিসহ আরও বেশ কিছু প্রস্তাব রয়েছে ভিশন ২০৩০-এ। খালেদা জিয়া গ্রিন-এনার্জির কথা বলতে পারতেন। তা বলেননি। এমনকি সুন্দরবনের পাশে কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে যে বিতর্ক, সে ব্যাপারেও খালেদা জিয়া কোনো মন্তব্য করেননি। আসলে ভিশন ২০৩০ নিয়ে মূল বিতর্ক কেন্দ্রীভূত এক জায়গায়Ñ আর তা হচ্ছে এটি এক ধরনের নির্বাচনী ইশতেহার। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি যে ভিশন ২০৩০ ব্যবহার করবে, এ ব্যাপারে দ্বিমত করার সুযোগ নেই।
অনেক কারণের জন্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, ‘সকল দলের অংশগ্রহণে’ একটি নির্বাচন প্রয়োজন। এ জন্য বিএনপিকে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসতে হবে। আমার ধারণা বর্তমান সরকারও চায় আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিক। পরপর দুটি নির্বাচনে বিএনপি যদি অংশ না নেয়, তাতে সরকারের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন হবে না সত্য, কিন্তু বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তি একটা প্রশ্নের মুখে থাকবে। দ্বিতীয়ত, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অনেক মামলা রয়েছে। মামলার রায়ও হবে চলতি বছরে। এতে করে খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার একটা প্রশ্ন আছে। খালেদা জিয়াকে মাইনাস করে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে নাÑ এসব কথা বলা হচ্ছে। বিষয়টি একান্তই আইনগত। তাই আদালতের কাছেই বিষয়টি ছেড়ে দিতে হবে। এ বিষয়ে আমরা যত কম কথা বলব, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। তৃতীয়ত, জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলে, আবার সরকারে রেখে সরকার খুব লাভবান হয়েছে বলে মনে হয় না। সাধারণ মানুষ জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলের আসনে মেনে নেয়নি। বিএনপি সংসদে বিরোধী দলে থাকলে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে।
এ দেশে সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য দুটি বড় দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মানসিকতায় পরিবর্তন দরকার। মানসিকতায় যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে এ দেশে ‘গণতন্ত্রের হাওয়া’ বইবে না। আর বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি বিভেদ-অসন্তোষ থাকে, তাহলে এ থেকে ফায়দা নেবে অসাংবিধানিক শক্তিগুলো, যা গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গল নয়। দীর্ঘ ৪৫ বছর আমরা পার করেছি। আমাদের অনেক অর্জন আছে। অনেক সেক্টরে আমরা বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রাখি। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীতে আমাদের সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ, তৈরি পোশাকশিল্পে আমাদের সক্ষমতা, ওষুধশিল্পের গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদি নানা কারণে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের একটা পরিচিতি আছে। আমরা ‘সফটপাওয়ার’ হিসেবে ইতোমধ্যে পরিচিতি পেয়েছি। ‘নেক্সট ইলেভেন’-এ বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৭-এর ঘরে থাকবে বলে আন্তর্জাতিক মহল থেকে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এখন এই যে ‘অর্জন’, এই অর্জন মুখ থুবড়ে পড়বে যদি রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে দুটি বড় দলের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না হয়। এই ‘আস্থার সম্পর্ক’ শুধু দেশের বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্যই মঙ্গল নয়, বরং দেশের স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন, উপরন্তু জনগণের প্রত্যাশা পূরণের জন্যও প্রয়োজন। জনগণ এমনটি দেখতে চায়। সাধারণ মানুষ চায় দুটি বড় দলের নেতারা পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করে কোনো বক্তব্য রাখবেন না। পরস্পরকে শ্রদ্ধা করবেন। দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকবে। এই প্রতিযোগিতা হতে হবে রাজনৈতিক ও কর্মসূচিভিত্তিক। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা এমনটি দেখতে পাই না। ভিশন ২০৩০ উপস্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে, বলতে গেলে ওইদিন সন্ধ্যাবেলায়ই আমরা আওয়ামী লীগের নেতিবাচক মনোভাব পেয়েছি। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘ভিশন ২০৩০ জাতির সঙ্গে তামাশা ও প্রতারণা। অনেক সিনিয়র মন্ত্রীও একই লাইনে কথা বলেছেন।’ এর প্রয়োজন ছিল না। বিএনপি একটি কর্মসূচি দিয়েছে। এর আগে আওয়ামী লীগও রূপকল্প ২০২১ দিয়েছিল। সব কর্মসূচিই যে ভালো তা বলা যাবে না। আওয়ামী লীগের রূপকল্পে যেমনি সীমাবদ্ধতা আছে, ঠিক তেমনি ভিশন ২০৩০-ও পূর্ণাঙ্গ নয়। তবে ভালো দিক হচ্ছে, দুটি বড় দলই তাদের পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছে। আগামী নির্বাচনে এর একটি প্রতিফলন থাকবে। কোনটি ভাল, কোনটি খারাপÑ এভাবে সমালোচনা না করে বরং নির্দিষ্ট করে বলা উচিত দলগুলোর সীমাবদ্ধতা কোথায়। দুটি বড় দলই এখন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা দিল। নিঃসন্দেহে এর ইতিবাচক দিক আছে।
Daily Amader Somoy
18.05.2017

অথঃ ভিসি কাহিনী


ভিসিদের কাহিনী নিয়ে বেশ কিছুদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিক সিরিজ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। তাতে অনেক ভিসি যে অনেক অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন, তা উল্লেখ করা হয়েছিল। ভিসি হচ্ছেন একটা প্রতিষ্ঠান। তিনি যদি বিতর্কিত হন, দুর্নীতি করেন, তাহলে আস্থার জায়গাটা আর থাকে না
জনগণের ট্যাক্সের টাকায় যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চলে, সে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ভিসি বা উপাচার্যের ‘কাহিনী’ এখন নিয়মিত কাগজে ছাপা হচ্ছে। একজন ভিসি বললেন, তিনি ছাত্রলীগ নেতাকর্মী ছাড়া অন্য কাউকে চাকরি দেবেন না! একজন অস্ত্রবাজ শিক্ষক তার ‘চাকরি’ পেলেন একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভিসি বললেন, বিষয়টি তিনি জানেন না। তার তা না জানারই কথা; কেননা প্রভাষক নিয়োগ বোর্ডে তিনি সভাপতিত্ব করেন না। আর একজন ভিসি, যিনি দক্ষিণাঞ্চলের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল জমি দখলের! বঙ্গবন্ধুর নামে প্রতিষ্ঠিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সংবাদ আরও মারাত্মকÑ তিনি তার সরকারি বাসভবনে একটি বিউটি পারলার বসিয়েছেন! কী সাংঘাতিক কথা! ভিসির বাংলোয় বিউটি পারলার। স্ত্রী অধ্যাপনা করেন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাই ভিসির বাংলোয় সিরিয়াল রক্ষার কাজটি তিনি নিজেই করেন। সংবাদদাতা একটি ছবিও পাঠিয়েছেন সংবাদের সঙ্গে, যাতে দেখা যায় তিনি দাঁড়িয়ে (ভিসি-বাংলোয়) সিরিয়াল দিচ্ছেন সেবা গ্রহণকারীদের। আর পাশে বসা বেশ কয়েকজন সেবা গ্রহণকারী। এর বাইরে আরও অনেক ভিসি কাহিনী ছাপা হয়েছে, যা হয়তো আমার চোখে ধরা পড়েনি। খুঁজলে হয়তো তা পাওয়াও যাবে। কেননা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৪২। ৪২ জন ভিসি তো আছেনই, তাদের নিয়ে সংবাদ ছাপা হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে গেছে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এ কে এম নূর উন নবীর কাহিনী। তিনি এখন সাবেক। কেননা ৫ মে তার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। মাত্র সাড়ে ৫ মাসে তিনি খাবার খেয়েছেন (অফিস তথা আপ্যায়ন) ১০ লাখ টাকার (পরিবর্তন.কম, ৪ মে)। এর সঙ্গে ট্রেজারার হিসেবে অতিরিক্ত খেয়েছেন আরও ২ লাখ ১৯ হাজার। সবমিলিয়ে প্রায় ১২ লাখ টাকা! তাকে নিয়ে ‘কাহিনী’ আরও আছে। ভিসির পদটি সার্বক্ষণিক। কিন্তু তিনি ঢাকায় থাকতেন বেশিরভাগ সময়। আর টিএ/ডিএ’র নামে উত্তোলন করেছেন ৪ লাখ টাকা। ভর্তি পরীক্ষায় ‘তদারকিতে’ তিনি নিয়েছেন ১৬ লাখ টাকা! প্রায় ১২ লাখ টাকার যে আপ্যায়ন ‘বিল’ তিনি তুলেছেন, তা মাত্র ১৬৫ দিনেরÑ যতদিন তিনি ক্যাম্পাসে ছিলেন! সামাজিক মিডিয়ায় কে যেন একটা হিসাব দিয়েছে। তিনি যা খেয়েছেন এবং যার জন্য প্রায় ১২ লাখ টাকা বিল তুলেছেন, তা যদি দিন হিসাবে গণনা করা হয়, তাহলে প্রতিদিন তিনি ‘খেয়েছেন’ (নাশতা) প্রায় ৭ হাজার টাকা! পাঠক, বিভ্রান্ত হবেন না। এ হিসাবটা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের। তারা সেখানে তদন্তে গিয়েছিলেন। তাদের তদন্তে এসব অসংগতি ধরা পড়েছে। সচেতন পাঠকমাত্রই জানেন, এর আগে যিনি ভিসি ছিলেন, ড. জলিল, তিনিও ব্যাপক অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। দুদক সেসব অনিয়মের তদন্ত করছে। গোপালগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি’কেও দুদক চিঠি দিয়েছিল। যদিও সে চিঠি তিনি আদৌ গুরুত্বের সঙ্গে নেননি। একজন ভিসি, যিনি শিক্ষাবিদও বটে, তিনি যখন আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন, তখন এর চেয়ে আর দুঃখজনক কিছু থাকতে পারে না। রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত এসব ভিসি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজকে জাতির কাছে ‘ছোট’ করছেন। দুদকের উচিত এসব অনুসন্ধান করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া। না হলে এ প্রবণতা বাড়তেই থাকবে। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এখন ৪২। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে যাদের ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তাদের অনেকে শুধু অযোগ্যই নন, বরং অনেকেই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন; বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছেন; শিক্ষক সমাজকে জাতির কাছে ‘ছোট’ করেছেন। দলীয় পরিচয়ে কিংবা আঞ্চলিকতা বিবেচনায় নিয়ে যাদের ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়, তারা যে ব্যর্থ এবং ওই বিদ্যালয়ে শিক্ষার মান যে তারা আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেন না, গোপালগঞ্জ কিংবা রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কর্মকা-ে আবারও তা প্রমাণিত হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েই অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়টিকে তিনি পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। নিজের আত্মীয়স্বজন, ভাই, স্ত্রী এদের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেন তাদের যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও। রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি এর বড় প্রমাণ। এ ধরনের ঘটনা আরও অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে শোনা যায়। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন একটি আইন করতে পারে, যেখানে বলা থাকবেÑ বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ ব্যক্তিদের সন্তান বা আত্মীয়স্বজন প্রথমে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি নিয়োগ পাবেন না। তাদের অন্য যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে, পরে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকরা প্রথমে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে পরে যদি চান নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের কর্মজীবন শুরু করেন। এটা করা না হলে অচিরেই প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একেকটি ‘পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে’ পরিণত হবে। আমার নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এ প্রবণতা আমি লক্ষ করছি। এটা ভালো নয়। উচ্চশিক্ষার জন্য তা মঙ্গলও নয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর মঞ্জুরি কমিশনের নজরদারি অনেক কম। চেয়ারম্যান ও সদস্যরা আছেন; কিন্তু তাদের কোনো শক্ত কর্মকা- আমার চোখে ধরা পড়ছে না। এখন ইউজিসির নামের পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। তাতে উচ্চশিক্ষায় কতটুকু পরিবর্তন আসবে, আমি নিশ্চিত নই। অতিসম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর দফতরের এসডিজি-বিষয়ক প্রধান সমন্বয়ক মোঃ আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, আমাদের শিক্ষার মান নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। আজাদ সাবেক আমলা। সিনিয়র সচিব ছিলেন। অবসরে গেছেন। তিনি কথাটা মিথ্যা বলেননি। সাবেক শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খানও একাধিকবার এ ধরনের কথা বলেছেন। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মানের যে অবনতি ঘটেছে, এটা তো হাজারটা দৃষ্টান্ত দিয়ে দেখানো যায়। টিআইবির ১৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর (যেগুলো সব বড় বিশ্ববিদ্যালয়) যে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল, তাতে তথ্য-উপাত্তসহ উল্লেখ করা হয়েছিল ব্যক্তির ইচ্ছায়, দলীয় বিবেচনায়, টাকার বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এদের অনেকেই যোগ্য নন। ফলে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে তারা অবদান রাখতে পারছেন না। আমার ধারণা ছিল, ইউজিসি ওই প্রতিবেদনের পর একটি বড়সড় অনুসন্ধান চালাবে। কিন্তু তারা তা করেনি। শুধু এর প্রতিবাদ করে তারা তাদের দায়িত্ব শেষ করেছেন। দুদকও বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করতে পারে। টাকার বিনিময়ে যদি শিক্ষক নিয়োগ হয়, তাহলে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন হবে কীভাবে? একটা হতাশাজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি। অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। এর প্রয়োজনীয়তা নিশ্চয়ই অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু শিক্ষার মানোন্নয়নে যে কাজটি করা দরকার, তা হচ্ছে না। এক্ষেত্রে যাদের ওপর এ দায়িত্বটি বর্তেছে, তারা এটা না করে ব্যস্ত থাকছেন অন্য কাজে। তাই যোগ্য ও দক্ষ লোকদের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে সরকার একটি কমিশন গঠন করতে পারে। ইউজিসি এ কাজটি করতে পারছে না। রাজনৈতিক বিবেচনায় চেয়ারম্যান ও সদস্যরা নিয়োগ পেয়েছেন। তাদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। উচ্চশিক্ষায় যাদের উচ্চতর ডিগ্রি নেই, গবেষণা নেই, তাদের এখানে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।
ভিসিদের কাহিনী নিয়ে বেশ কিছুদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিক সিরিজ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। তাতে অনেক ভিসি যে অনেক অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন, তা উল্লেখ করা হয়েছিল। ভিসি হচ্ছেন একটা প্রতিষ্ঠান। তিনি যদি বিতর্কিত হন, দুর্নীতি করেন, তাহলে আস্থার জায়গাটা আর থাকে না। শুধু আর্থিক কেলেঙ্কারি নয়, কোনো কোনো ভিসি আবার নিজের অনুপযুক্ত ছেলেকে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক বানিয়ে ‘সুবিধা’ নেয়ার চেষ্টা করেছেন। এ সংক্রান্ত একটি সংবাদ সম্প্রতি ছাপা হয়েছে। যে ‘ছাত্র’ কোনোদিন যোগ্যতাবলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেননি, তিনি এখন কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক! যে ছাত্রটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন, তার তো ‘ভালো ছাত্র হলে’ ওইসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকতা করার কথা! বাবা ভিসি। তাই বলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে তাকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে হবে! তার নিয়োগ প্রক্রিয়া যে সিন্ডিকেটে অনুমোদিত হয়েছিল, ওই সিন্ডিকেট সভায় ভিসি কি উপস্থিত ছিলেন? নিজে উপস্থিত থেকে ছেলের নিয়োগ প্রক্রিয়া তিনি কি অনুমোদন করতে পারেন? আইনগতভাবে এবং নৈতিকভাবে তিনি তা পারেন না। ইউজিসি কি বিষয়টি তলিয়ে দেখেছে? শিক্ষামন্ত্রী ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সম্প্রতি বলেছেন, ‘শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।’ কথাটা শুনতে ভালোই শোনায়। জানতে খুব ইচ্ছে করে, মান বৃদ্ধির জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় কী কী উদ্যোগ নিয়েছে? অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ কি শিক্ষার মানোন্নয়নের কোনো নির্দেশনা দেয়? ব্যক্তির ইচ্ছায় এবং ব্যক্তিকে সামনে রেখে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নতুন নতুন বিভাগ খোলা হচ্ছে, যার আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই এবং দক্ষ জনশক্তি গড়ার ক্ষেত্রেও তা কোনো অবদান রাখবে না। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্র্যাকটিক্যাল কেমিস্ট্রি নামে নতুন একটি বিভাগ খোলা ও সেখানে জনবল নিয়োগে যে অনিয়ম হয়েছে, তার রেশ ধরে ইউজিসির এক কর্মকর্তাকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়েছে। এজন্য ইউজিসির চেয়ারম্যান ধন্যবাদ পেতেই পারেন। কিন্তু অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সন্তানদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ তথা বৃত্তি প্রদান ইত্যাদি বন্ধে ইউজিসি যদি উদ্যোগ নেয়, তাহলে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে তা বড় অবদান রাখবে।
রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অনেক অনিয়ম ও দুর্নীতি মাথায় নিয়ে তার ৪ বছরের টার্ম শেষ করেছেন। পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী, দ্বিতীয় টার্মে থাকার ‘খায়েস’ প্রকাশ করলেও শেষ অবধি তিনি হাল ছেড়ে দিয়েছেন। এ ধরনের দুর্নীতিবাজরা যদি আবার এখানে নিয়োগ পেতেন, তাতে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকট বাড়ত বৈ কমত না! আরও একজন অধ্যাপক (যিনি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি এখন) লবিং করছেনÑ যার কাজ হচ্ছে টিভি টকশোতে বক্তৃতা দেয়া, নির্বাচন মনিটরিংয়ের নামে বিদেশ থেকে টাকা আনা। এসব ‘শিক্ষক’ ভিসি হলে(?) পরিস্থিতির অবনতি ছাড়া উন্নতি হবে না। এসব জুনিয়র শিক্ষকের বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা থেকে যত দূরে রাখা যায়, ততই সবার মঙ্গল। রাজনৈতিক বিবেচনায় ভিসি নিয়োগ বন্ধ হোক। অভিজ্ঞ ও সিনিয়র শিক্ষকদের ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হোক, যাদের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকবে না। যশোর, গোপালগঞ্জ, জগন্নাথ কিংবা রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটেছে, তা থেকে আমরা কী শিক্ষা নেব প্রশ্ন আমাদের সেখানেই।
Daily Alokito Bangladesh
14.05.2017

দুদক তদন্ত করুক, দুর্নীতিবাজরা শাস্তি পাক




ভদ্রলোক প্রতিদিন নাশতা খেয়েছেন সাত হাজার ২৩৩ টাকার। তিনি একজন ভিসি, অর্থাৎ উপাচার্য, এখন সাবেক। ২০১৪-১৫ এবং ২০১৫-১৬ এই দুই অর্থবছরে মাত্র ১৬৫ দিন ক্যাম্পাসে অবস্থান করে মোট ১১ লাখ ৯৩ হাজার ৫২৮ টাকার 'নাশতা' খেয়েছেন। যার অর্থ প্রতিদিন ৭ হাজার ২৩৩ টাকা। নাশতা তিনি খেতেই পারেন। তিনি যখন মিটিংয়ে থাকেন, তখন নাশতা খেতে পারেন। তবু তার জন্য প্রতিদিন সাত হাজার ২৩৩ টাকা বরাদ্দ। কী খেয়েছিলেন তিনি?
সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, মন্ত্রীরা কিংবা সচিবরাও কী তাহলে এ ধরনের ঋণ করেন? এই ভদ্রলোকের নাম অধ্যাপক নুর উন নবী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক। কোথায় যেন শুনেছিলাম তিনি একসময় জাসদ ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সত্য-মিথ্যা জানি না। তবে তিনি যে আওয়ামী লীগের সম্মানিত শিক্ষক রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। জাসদ এখন সরকারের অংশীদার। হতে পারে 'জাসদ কোটায়' তিনি ভিসি হয়েছিলেন। একজন শিক্ষক যখন দুর্নীতিবাজ হন, আমরা তখন কার কাছে আস্থাটা রাখি? তার দুর্নীতির যে খবর পত্র-পত্রিকায় ও অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে (যায়যায়দিন ও পরিবর্তন.কম) তা নিছক কোনো একটি সাধারণ রিপোর্ট নয়। ওটা ছিল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তদন্ত রিপোর্ট সুতরাং এর পেছনে সত্যতা আছে। ভদ্রলোকের দুর্নীতির আরও কাহিনী আছে। তিনি নিজে একা তিনটি গাড়ি ব্যবহার করতেন। এর মাঝে একটি আবার সার্বক্ষণিকভাবে ঢাকায় তার স্ত্রী ব্যবহার করতেন। স্ত্রী কেন সরকারি গাড়ি ব্যবহার করবেন? বিশ্ববিদ্যালয় কেন ওই গাড়ির ড্রাইভারের বেতন ও জ্বালানি বিল পরিশোধ করবে? জ্বালানি বাবদ তিনি কত ব্যবহার করেছিলেন, তারও হিসাব নেয়া প্রয়োজন। আরও 'কাহিনী' আছে। তিন বছরে ভর্তি পরীক্ষার 'সম্মানী' বাবদ ১৬ লাখ টাকা তিনি নিয়েছেন। এটা তো তিনি পারেন না? মঞ্জুরি কমিশনের আইনে তা অনুমোদন করে না। এসব দুর্নীতিবাজ শিক্ষকদের কারণে শিক্ষক সম্পর্কে আজ সবাই অন্য চোখে দেখে। প্রশ্ন হচ্ছে_ শিক্ষক হিসেবে তিনি কী মাফ পেতে পারেন? আইন কী তাকে অন্য চোখে দেখবে? দুদক অতি সম্প্রতি অনেক ভালো কাজ করেছে। সর্বশেষ ঘটনায় দুদক সিলেটেরে হাওর অঞ্চলের বাঁধ ভেঙে যাওয়ার ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের শীর্ষ স্থানীয় কর্মকর্তাদের ডেকেছে। তাদের দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত করছে। জনগণের ট্যাক্সের টাকা নিয়ে যারা 'নয়-ছয়' করেন, তা দেখার দায়িত্ব দুদকের। এখন যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তদন্ত শেষে এসব আর্থিক কেলেঙ্কারী ধরা পড়েছে। সুতরাং দুদক তদন্ত করতেই পারে। করা উচিত। কেউই আইনের ঊধর্ে্ব নন। একজন শিক্ষক কিংবা একজন উপার্চায হিসেবে কেউই মাফ পেতে পারেন না। তিনি যদি আর্থিক কেলেঙ্কারীর সঙ্গে জড়িয়ে যান, তার বিচার প্রচলিত আইনেই হওয়া উচিত। দুদক যদি তার আর্থিক অনিয়মের বিচার করে, তাহলে এটা একটা মেসেজ পেঁৗছে যাবে সব ভিসির কাছে_ কেউই তখন আর দুর্নীতির সঙ্গে নিজেকে জড়িত করবেন না।
সাম্প্রতিক সময়ে উপাচার্যদের নানা কাহিনী পত্র পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে, যা পড়ে মাথা হেট হেয়ে যায়। আরেক উপাচার্যের কাহিনী ছাপা হয়েছিল ক'দিন আগে। তাতে দেখা গেছে তিনি তার সরকারি বাসায় একটি বিউটি পার্লার স্থাপন করেছেন। ছবিও আছে একটি। ছবিতে দেখা যাচ্ছে ভিসি তার বাসভবনে প্রতিষ্ঠিত বিউটি পার্লারের সিরিয়াল নিজেই নিয়ন্ত্রণ করছেন। একজন ভিসি, অর্থাৎ উপাচার্য, তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিউটি পার্লার কেন, আলু-পটোলের ব্যবসা করতেই পারেন। এটা তার অধিকার। কিন্তু তিনি তো এর জন্য উপাচার্য ভবন ব্যবহার করতে পারেন না? খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ওই বিউটি পার্লারের জন্য যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছে, তাও নেয়া হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়, তা থেকে। আমাদের দুঃখ লাগে আমরা এ ধরনের 'লোককেও' ভিসি বানিয়েছি। তিনি তো শিক্ষক সমাজের কলঙ্ক। তিনি গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। নাম তিনি গোপালগঞ্জের মানুষ হতে পারেন। কিন্তু গোপালগঞ্জের প্রতিষ্ঠিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ওই এলাকার একজন শিক্ষকেই নিয়োগ দিতে হবে কেন। এ প্রবণতা তো আঞ্চলিকতার জন্ম দেবে। দিয়েছেও। একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিনিধির কাছে তিনি প্রধানমন্ত্রীর নাম ব্যবহার করেছেন। এটা তিনি করতে পারেন না। দুদকে তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও আর্থিক কেলেঙ্কারীর অভিযোগ রয়েছে। তাকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন দুদকের চিঠির কোনো জবাব দিতে হবে না। কেননা তিনি ম্যানেজ করে ফেলেছেন। কী সাংঘাতিক কথা। সরাসরি তিনি বললেন 'ম্যানেজ' করার কথা। দুদক তো কাউকেই ছাড় দিচ্ছে না ইদানীং। ভদ্রলোক গোপালগঞ্জের মানুষ এবং ভিসি হতে পারেন। তাই বলে কী ছাড় পেতে পারেন? নিশ্চয়ই তিনি এটা পারেন না। তার বিরুদ্ধেও তহবিল তসরূফ ও দুর্নীতির অভিযোগ আছে। এখন ভবিষ্যতই বলতে পারবে দুদক বিষয়গুলোকে কিভাবে দেখছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে অনেক ভিসির 'কাহিনী' কোনোদিই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়নি। হয়তো হবেও না। তবে তাদের সম্পদের হিসাব যদি নেয়া যায়, তাহলে 'থলের বিড়াল' বেরিয়ে এলেও আসতে পারে। মনে আছে বিএনপি জমানায় এক ভিসি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ক্রয়কৃত ইট-সিমেন্ট দিয়ে ঢাকায় নিজের বাড়ি নির্মাণের কাজে ব্যবহার করেছিলেন। আরেক ভিসি তার জন্য নির্ধারিত বাসভবনে না থেকে নিজ বাড়িতে থেকে বাসা ভাড়া গ্রহণ করেছিলেন (সে টাকা ফেরত দিতে আমি বাধ্য করেছিলাম আমার তদন্ত শেষে)। আরেক ভিসি নিজের বোনকে বিয়ের বিনিময়ে একজনকে চাকরি দিয়েছিলেন। তদন্তে তা প্রমাণিত হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তার দুর্নীতি সংক্রান্ত ফাইল হারিয়ে গিয়েছিল। কোনো বিচার হয়নি। আজ তাই গোপালগঞ্জের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির 'বিউটি পার্লার' দেয়ার কাহিনী শুধু সংবাদপত্রেই থেকে যাবে বলে আমার আশঙ্কা। আর শিক্ষামন্ত্রীও আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে যাবেন এবং উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের আহ্বান জানাবেন। সংবাদপত্রে সে খবর ছাপা হবে। আমরা উৎসাহিত হব। উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন হবে, আমরা তা আশা করতেই থাকব। এ 'কাহিনীর' যেন শেষ নেই। সরকার একটু ভাবুন কাদের ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে? কী তাদের যোগ্যতা? 'বিউটি পার্লার' দেয়ার যার মানসিকতা তিনি কী ভিসি হতে পারেন? যোগ্য লোককে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদগুলোতে নিয়োগ না দিলে যা হয় তাই হয়েছে গোপালগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির ক্ষেত্রে। এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিক তাকে ওই পদে রাখা কতটুকু যৌক্তিক হবে? আমরা শুধু আশা করতেই পারি বিশ্ববিদ্যালয়টি ঠিকমতো চলুক। দক্ষ জনবল সৃষ্টিতে বিশ্ববিদ্যালয়টি অবদান রাখুক। প্রধানমন্ত্রীর নিজের বাড়ি গোপালগঞ্জ। প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীদের কথা বিবেচনা করে তিনি গোপালগঞ্জ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু একজন ব্যক্তির জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়টি শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়বে, আমরা তা চাই না। বিষয়টি তদন্ত হোক এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আইনের মুখোমুখি দাঁড় করানো হোক। সেই সঙ্গে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েও কথা বলা দরকার। প্রধানমন্ত্রীর শ্বশুরবাড়ি রংপুর। উপরন্তু একজন মহীয়সী নারীর নামে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অধ্যাপক নবী মাত্র তৃতীয় ভিসি। অধ্যাপক নূর উন নবী তার টার্ম শেষ করেছেন ৫ মে। তিনি অনেক তদবির করেছেন দ্বিতীয় টার্মের জন্য। তার অতীত রেকর্ড ও দুর্নীতির অভিযোগের কারণে সরকার আর দ্বিতীয় টার্মের জন্য তাকে নিয়োগ দেয়নি। দ্বিতীয় টার্ম যে কখনো ভালো হয় না তার বড় প্রমাণ অধ্যাপক মীজানুর রহমান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। তার একটি মন্তব্যের জন্য তিনি বিতর্কিত হয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, 'ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের চাকরি দিতে তিনি বাধ্য।' হয়ত কথাটা তিনি এভাবে বলতে চাননি। কিন্তু প্রথম আলোর মতো পত্রিকা তার বক্তব্য এভাবেই ছেপেছিল। তিনি নাকি বলতে চেয়েছিলেন তার আমলে কোনো জামায়াত-শিবির কর্মী জগন্নাথে চাকরি পাবে না। তিনি ভিসি। সিদ্ধান্ত তিনি নিতেই পারেন। কে শিবির, কে ছাত্রদল, কে জাসদ_ কাউকে তো এভাবে চিহ্নিত করা যায় না। তিনি স্পষ্টভাষী। সবসময় স্পষ্ট করে কথা বলেন। টিভি টকশোতেও বলেন। বিরোধী পক্ষকে ছাড় দেন না। তার রাজনৈতিক দর্শনের কারণে তিনি এমনটি করতেই পারেন। আমার ধারণা তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সরাসরি অংশ নিলে ভালো করবেন। ভবিষ্যতে দেশ ভালো নেতৃত্ব পাবে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজনীতি আর শিক্ষকতা এক সঙ্গে তিনি মেলাতে পারছেন না। রাজনীতি প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি। নিশ্চয়ই তিনি এটা উপলব্ধি করতে পারবেন। একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে আমার অনুরোধ থাকবে তিনি রাজনীতিতে আসুন। আমরা দেশে ভালো নেতৃত্ব পাব।
ভিসিদের নিয়ে নানা কাহিনী আমাকে বিব্রত করে। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু, যিনি সরকারের শীর্ষ আমলা হয়েছিলেন। তিনি আমাকে দেখাতে চেয়েছিলেন কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে (এমনকি জাহাঙ্গীরনগরের ক্ষেত্রেও)। আমার ওই বন্ধু বর্তমান সরকারের খুব কাছের লোক। ধারণা করছি ভবিষ্যতে কোনো 'বড় পদ' পাবেন তিনি। বন্ধু হিসেবে নিশ্চয়ই খুশি হব আমি তাতে; কিন্তু আমি তাকে বলেছিলাম শিক্ষক হিসেবেই আমি ব্যর্থ। উপাচার্য হই কিভাবে? বর্তমান সময়ে উপাচার্য হলে অনেক 'গ্রুপ'কে সন্তুষ্ট করতে হয়। আমি তা পারব না। আমার অনেক দুঃখবোধ আছে। শিক্ষক হিসেবে ভালো ছাত্রটিকে আমি শিক্ষক হিসেবে পাইনি। কেননা তার কোনো রাজনৈতিক দর্শন ছিল না। অর্থাৎ কোনো বড় ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না। শুধু পড়াশোনা করে গেছে সারাটা সময়। অনার্স ও মাস্টার্সে তার অবস্থান দুটোতেই প্রথম শ্রেণিতে প্রথম ছিল। কিন্তু শিক্ষক হবার 'যোগ্যতা' সে অর্জন করতে পারেনি। টিআইবি আমাদের জানিয়েছিল টাকার বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয়। কাকে শিক্ষক বানানো হবে, প্রথম থেকেই অর্থাৎ প্রথম বর্ষ থেকেই 'টার্গেট' নিয়ে এগিয়ে যায় একটি 'চক্র'। বারে বারে পরীক্ষা কমিটিতে থাকা, বিশেষ বিশেষ শিক্ষকের সঙ্গে সখ্যতা_ যা টিআইবির রিপোর্টে ছিল, তাতে কোনো মিথ্যা কিছু ছিল না। কিন্তু ওই রিপোর্টের পরও কী শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোনো পরিবর্তন এসেছে? না, পরিবর্তন আসেনি। আজও দেখি আমার নিজের বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে কোনো বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই। কিংবা অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদন ছাড়াই। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কর্তাব্যক্তিরা 'চুপ'। কেননা তাদের স্বার্থ আছে। তাদের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সন্তানরা শিক্ষক হিসেবে এখন যোগ দিচ্ছেন জাহাঙ্গীরনগরে। তাই আমার বন্ধুকে বলি আমি একজন ব্যর্থ মানুষ। অবসরে যাব এই ব্যর্থতা নিয়েই। কোনো দায়িত্ব আমি আগামীতেও নেবো না।
লেখাটা শুরু করেছিলাম দুদককে উদ্দেশ্য করে।
রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য বিদায়ী ভিসি অধ্যাপক নূর উন নবী 'দুর্নীতির ডাকাত' হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। প্রতিদিন 'নাশতার' বা আপ্যায়নের জন্য যিনি বিল তোলেন প্রায় সাত হাজার ২৩৩ টাকা (মঞ্জুরি কমিশনের তদন্ত অনুযায়ী), ভর্তি পরীক্ষায় ডিউটি না করেও যিনি তিন বছরে বিল নেন ১৬ লাখ টাকা (তদন্ত রিপোর্ট), তাকে 'দুর্নীতির ডাকাত' বলাই তো যুক্তিসঙ্গত। এখন দুদক তদন্ত করুক। অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হোক। একটা দৃষ্টান্ত স্থাপিত হোক।
আর ভিসি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বাছ-বিচার করা হোক। সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের নিরুৎসাহিত করে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের এবং সিনিয়র প্রফেসরদের ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হোক। যারা এখন ভিসির জন্য তদবির করছেন, টিভি টকশোতে সরকারের গুণগান গাচ্ছেন বেশি করে, বুঝতে হবে তাদের উদ্দেশ্য সৎ নয়। আমরা একুশ শতক উপযোগী করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তৈরি করতে চাই। কিন্তু 'নবী মার্কা ভিসি' কিংবা 'মীজান মার্কা মডেল' (প্রথম আলো), আর যাই হোক, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একুশ শতক উপযোগী করে গড়ে তুলতে কোনো সাহায্য করবে না। আমাদের নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে এই উপলব্ধি বোধটুকু আসুক, এটাই প্রত্যাশা করি।
Daily Jai Jai Din13.05.2017

বিএনপি কি নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে দিল?



বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গত বুধবার ঢাকায় একটি হোটেলে ‘ভিশন-২০৩০’ উপস্থাপন করেছেন। এর মধ্য দিয়ে বিএনপি ২০৩০ সালের বাংলাদেশকে কীভাবে দেখতে চায়, তা উপস্থাপন করেছে। যদিও এর আগে বিএনপির মহাসচিব জানিয়ে দিয়েছিলেন, ভিশন-২০৩০-এর সঙ্গে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। বিএনপি এখনও নির্বাচনকালীন সরকারের প্রশ্নে তাদের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন আনেনি। অর্থাৎ বিএনপি বারবার বলে আসছে, শেখ হাসিনা দলীয়প্রধান, তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেখে নির্বাচনের আয়োজন করলে সেই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। একসময় বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করত। এখন আর তারা সেই দাবি করে না। তারা চাচ্ছে একটি নির্বাচনকালীন সরকার, যেখানে বড় দল হিসেবে বিএনপিকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি সরকার গঠিত হবে, যে সরকার নির্বাচন পরিচালনা করবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সংবিধানে এ ধরনের কোনো সরকারের কথা উল্লেখ নেই। এটাই বিবেচনায় নিচ্ছে সরকারি দল। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জানিয়ে দিয়েছেন, পৃথিবীর কোনো দেশে এ ধরনের নির্বাচনকালীন সরকার নেই। অর্থাৎ বিএনপির প্রস্তাবে আওয়ামী লীগ রাজি নয়। ফলে একটা জটিলতা থেকেই গেল।

সংবিধানের কোথাও স্পষ্ট করে বলা নেই একটি ‘নির্বাচনকালীন সরকারের’ কথা। তবে ৫৭(৩)-এ বলা আছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকিতে এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই অযোগ্য করিবে না।’ এর অর্থ পরিষ্কার- যিনি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তিনি নতুন একজন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্বপদে বহাল থাকবেন। অর্থাৎ শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল রেখেই নির্বাচন কমিশন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করবে। বিএনপির আপত্তিটা এখানেই। বিএনপি মনে করে, যেহেতু শেখ হাসিনা একটি দলের প্রধান, সুতরাং তাকে ক্ষমতায় রেখে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এ যুক্তি একেবারে ফেলে দেয়ার মতো নয়। অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি, সংবিধানের ১১৮(৪) অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন থাকবে বলা হলেও এ কমিশন কখনই স্বাধীন ছিল না। কমিশনকে নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রশাসনের ওপর নির্ভর করতে হয়। স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা, ডিসি ও টিএনওদের ওপর নির্ভর করতে হয়। আর এদের নিয়ন্ত্রণ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যদিও সংবিধানের ১২৬নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে’, বাস্তবে এটা শুধু কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ। ‘নির্বাহী কর্তৃপক্ষ’ নির্বাচন কমিশনের কথায় চলে না। এবং নির্বাচন কমিশনও এদেরকে ‘কর্তব্য পালনে’ বাধ্য করতে পারে না। ফলে সরকার যা চায় তা-ই হয়। নির্বাচন কমিশন এখানে ঠুঁটো জগন্নাথ। কাজেই একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রশ্নে সরকারের আন্তরিকতাটাই আসল।

এখন বিএনপি বলছে একটি ‘নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখার’ কথা। এই ‘রূপরেখা’ তো সরকার দেবে না। দিতে হবে বিএনপিকে। গত ৯ মার্চ এক আলোচনা সভায় বিএনপির সিনিয়র নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন জানিয়েছিলেন, শিগগিরই খালেদা জিয়া নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা দেবেন। আমরা জানি না সেই রূপরেখা কী হবে। ইতিমধ্যে দু’মাস কেটে গেছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে (২০১৪) প্রধানমন্ত্রী একটি ছোট আকারের মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন। ওই মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল বিএনপিকে, যা বিএনপি গ্রহণ করেনি। এখন কি প্রধানমন্ত্রী সেরকম একটি আমন্ত্রণ জানাবেন? তবে ২০১৪-পূর্ববর্তী পরিস্থিতি ও আজকের পরিস্থিতির মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। নবম সংসদে বিএনপি ছিল এবং সংসদ সদস্যদের সমন্বয়েই ওই সময় একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হয়েছিল। এখন তো বিএনপি সংসদে নেই। তাহলে বিএনপি ‘নির্বাচনকালীন সরকারে’ থাকবে কী করে? এখানেই এসে যায় সরকারের আন্তরিকতার প্রশ্ন। বিএনপি সংসদের বাইরে বড় দল। দেশে ও বিদেশে দলটির ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা আছে। দাতাগোষ্ঠী বারবার ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ যে নির্বাচনের কথা বলছে, তার মাধ্যমে তারা পরোক্ষভাবে বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসার কথাই বোঝাচ্ছে। এখন সেটি সম্ভব হবে কীভাবে? শেখ হাসিনাই নির্বাচনকালীন প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। এটাই সংবিধানের কথা। সংবিধানের বাইরে যাওয়া যাবে না। এখন বিএনপিকে আস্থায় নিতে হলে দলটিকে একটি ‘অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভায়’ অন্তর্ভুক্ত করা যায় শুধু নির্বাচন প্রস্তুতিকালীন তিন মাস সময়ের জন্য। সরকার নীতিগতভাবে এক্ষেত্রে কতগুলো সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যা অনেকটা এরকম : ১. শুধু সংসদ সদস্যদের সমন্বয়ে নির্বাচনকালীন একটি সরকার গঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি ১০ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভা থাকবে; ২. তিনটি দল- আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি এই মন্ত্রিসভায় থাকবে (মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্তির জন্য তিনটি উপনির্বাচনে তিনজন বিএনপি প্রার্থীকে ‘বিজয়ী’ করে সংসদে আনা যায়); ৩. প্রধানমন্ত্রী ব্যতিরেকে যারা মন্ত্রিসভায় থাকবেন, তারা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না; ৪. জনপ্রশাসন অথবা স্বরাষ্ট্র যে কোনো একটি মন্ত্রণালয় বিএনপিকে দেয়া যেতে পারে; ৫. ওই সরকার নীতিগত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না; ৬. নির্বাচনের সময় ডিসি, টিএনও ও ওসিদের বদলি করা হবে। প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় নতুন লোক দিতে হবে। বিকল্প হিসেবে স্পিকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হতে পারেন, অথবা আওয়ামী লীগের যে কোনো বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা এই দায়িত্বটি নিতে পারেন। তবে নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে তারা কেউই (অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সদস্যরা) একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না। তিনটি দলের প্রতিনিধিত্ব থাকবে এ কারণে যে, বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে এই তিনটি দলের বরাবরই প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। এর বাইরে যেসব দল দশম কিংবা নবম জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছে, তারা দুটো বড় দলের ব্যানারে এবং ওই দলের প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন (যেমন জাসদের দলীয় প্রতীক মশাল, বিজয়ী হয়েছেন নৌকা প্রতীক নিয়ে)। সুতরাং অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভায় ওইসব দলের প্রতিনিধিত্বের প্রয়োজন নেই।

বেশকিছু কারণে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন প্রয়োজন। এজন্য বিএনপিকে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসতে হবে। আমার ধারণা বর্তমান সরকারও চায় আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিক। পরপর দুটো নির্বাচনে বিএনপি যদি অংশ না নেয়, তাতে সরকারের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন হবে না সত্য, কিন্তু বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তি একটা প্রশ্নের মুখে থাকবে। দ্বিতীয়ত, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অনেক মামলা রয়েছে। মামলার রায়ও হবে চলতি বছরে। এতে করে খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেয়ার একটা প্রশ্ন আছে। খালেদা জিয়াকে মাইনাস করে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না- এসব কথা বলা হচ্ছে। বিষয়টি একান্তই আইনগত। সুতরাং আদালতের ওপরই বিষয়টি ছেড়ে দিতে হবে। এ বিষয়ে আমরা যত কম কথা বলব, ততই মঙ্গল। তৃতীয়ত, জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলে এবং একইসঙ্গে সরকারে রেখে সরকার খুব লাভবান হয়েছে বলে মনে হয় না। সাধারণ মানুষ জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলের আসনে মেনে নেয়নি। বিএনপি সংসদে বিরোধী দলে থাকলে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ত।

এদেশে সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য দুই বড় দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মানসিকতায় পরিবর্তন দরকার। মানসিকতায় যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে দেশে ‘গণতন্ত্রের হাওয়া’ বইবে না। আর বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি বিভেদ-অসন্তোষ থাকে, তাহলে এ থেকে ফায়দা নেবে অসাংবিধানিক শক্তিগুলো, যা গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গলজনক নয়। স্বাধীনতা লাভের পর আমাদের অনেক অর্জন আছে। অনেক সেক্টরে আমরা বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা রাখি। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীতে আমাদের সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ, তৈরি পোশাক শিল্পে আমাদের সক্ষমতা, ওষুধ শিল্পের গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদি নানা কারণে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের একটা পরিচিতি আছে। আমরা ‘সফ্ট পাওয়ার’ হিসেবে ইতিমধ্যে পরিচিতি পেয়েছি। ‘নেক্সট ইলেভেনে’ বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৭-এর ঘরে থাকবে বলে আন্তর্জাতিক মহল থেকে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এই ‘অর্জন’ মুখ থুবড়ে পড়বে যদি রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে দুই বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না হয়। এ ‘আস্থার সম্পর্ক’ শুধু দেশের বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্যই নয়, বরং স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন, উপরন্তু জনগণের প্রত্যাশা পূরণের জন্যও প্রয়োজন। কারণ সাধারণ মানুষ চায় দুই বড় দলের নেতারা পরস্পরকে শ্রদ্ধা করবেন। তারা একে অন্যকে আক্রমণ করে কোনো বক্তব্য রাখবেন না। দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকবে। এই প্রতিযোগিতা হতে হবে রাজনৈতিক ও কর্মসূচিভিত্তিক।

প্রধানমন্ত্রী পরোক্ষভাবে ‘নির্বাচনী প্রচারণা’ একরকম শুরু করে দিয়েছেন। গত দুই মাসে তিনি একাধিক জনসভা করেছেন। প্রতিটিতেই তিনি উন্নয়নের কথা বলেছেন। বগুড়া বিএনপির ঘাঁটি বলেই বিবেচিত। সেখানে তিনি বলেছেন, উন্নয়নে কোনো বিশেষ এলাকা বিবেচ্য নয়। এর অর্থ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে তিনি নির্বাচনী প্রচারণায় নিয়ে আসবেন। সামনে আছে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের বিষয়টি, যা ২০১৮ সালে চালু হওয়ার কথা। হয়তো পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেই তিনি নির্বাচনের তারিখ দেবেন। এ ক্ষেত্রে বিএনপি কী করবে? দলটি নির্বাচনে যাবে। তারা নিশ্চিত হতে চায় নির্বাচনে কারচুপি হবে না এবং নির্বাচনটি সুষ্ঠু হবে। ইসির ব্যাপারে বিএনপির রিজার্ভেশন আছে। সিইসিকে বিএনপি প্রত্যাখ্যান করেছে। তারপরও কথা থেকে যায়। একটি গ্রহণযোগ্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার- যা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বেও গঠন করা সম্ভব- বিএনপির আস্থা অর্জন করতে পারে এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারে। স্পষ্টতই ‘রাজনীতির বলটি’ এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে। বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রেখে কিংবা নিবন্ধন বাতিল করার কথা বলে আর যাই হোক একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আমরা উপহার দিতে পারব না। সুতরাং নির্বাচনে অংশ নিতে বিএনপি যখন আগ্রহ দেখিয়েছে, তখন বিএনপির এই ‘আগ্রহ’কে কাজে লাগিয়েই নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।

এদিকে গত ৮ মে ঢাকাস্থ ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদোন বলেছেন, ২০১৪ সালের নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ কাম্য (যুগান্তর, ৯ মে)। এ ধরনের কথা ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে এর আগেও উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু এই ‘শিক্ষা’ কি বড় দলগুলো নিয়েছে? আমার মনে হয় না। আমরা বারবার বলে আসছি, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে একটা আস্থার সম্পর্ক থাকা দরকার। ২০১৪ সালের পর আজ অব্দি সেই আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। ফলে দিন যতই গড়াচ্ছে, ততই শঙ্কা বাড়ছে- যদি আস্থার সম্পর্ক তৈরি না হয়, তাহলে বিএনপি নির্বাচনে যাবে কিনা? ২০১৪ সালের জানুয়ারির আর ২০১৮ সালের শেষের কিংবা ২০১৯ সালের জানুয়ারির পরিস্থিতি নিশ্চয়ই এক নয়। এক হবেও না। বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নিয়ে সরকারের পতন ঘটাতে চেয়েছিল। তারা তা পারেনি। এই ভুল এবার আর বিএনপি করবে না। তবে সেই সঙ্গে এটাও সত্য, বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসতে হলে সরকারকে একটি বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের আন্তরিকতাটাই হল আসল।
Daily  Jugantor
13.05.2017