রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও সুবিধাবাদিতা

‘সুলতান মনসুর ও মোকাব্বিরের শাস্তি প্রত্যাহার করা হবে’সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতিতে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে এক এক করে সুলতান মনসুর, মোকাব্বির খান ও জাহিদুর রহমান সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন। আবার মোকাব্বির খানকে গণফোরাম বহিষ্কারের কথা ঘোষণা করলেও তাকে দেখা গেল কামাল হোসেনের পাশে বসতে গণফোরামের বিশেষ অধিবেশনে। এদের সংসদে অধিবেশনে যোগদান রাজনীতিতে বিতর্ক বাড়িয়েছে। একটা যুক্তি আছে। এরা নির্বাচিত। জনগণ তাদের ভোট দিয়েছে। এখন কি এরা তাদের এলাকার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন না? এটা একটা মৌলিক প্রশ্ন। এই প্রশ্নটিই প্রথমে তুলেছিলেন সুলতান মনসুর। তিনি সংসদে তার এলাকার জনগণের কথা বলতে চান। জনগণ তাকে ভোট দিয়ে সংসদে পাঠিয়েছে। দলীয় শৃঙ্খলার কারণে সেই প্রতিনিধিত্বে তখন বড় অন্তরায় সৃষ্টি হয়েছিল। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের এটাই বড় সমস্যা। অনেকেই ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের কথা বলেছেন। কিন্তু এই অনুচ্ছেদ যদি বাতিল হয়ে যায়, তাহলে তো সংসদ ‘কেনা-বেচার’ হাটে পরিণত হবে! টাকার বিনিময়ে সংসদ সদস্যরা ‘বিক্রি’ হয়ে যেতে পারেন। দল ভাঙা ও নতুন দল গড়া একটি স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হবে। যাদের হাতে টাকা আছে, তারা সাংসদদের ক্রয় করে সরকার গঠনে উদ্যোগী হবেন! এর মধ্য দিয়ে অস্থিতিশীল সরকার গঠিত হতে পারে। গণতন্ত্রের জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। সুতরাং ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন না করাই শ্রেয়। তবে ৭০ অনুচ্ছেদকে আরও যুগোপযোগী করা যায়। যেমন ৭০ অনুচ্ছেদে ‘দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে’ কথাটা অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। না হলে ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ থাকল।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৪৮ বছরে পা দিয়েছে চলতি মার্চ মাসে। একটি দেশের জন্য ৪৮ বছর একেবারে কম সময় নয়। এই ৪৮ বছরে অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। সামাজিক ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও আমরা ভারতের কাছ থেকেও এগিয়ে আছি। কিন্তু আমাদের একটা বড় অন্তরায় হচ্ছে রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। রাজনীতিতে যে আস্থার সম্পর্ক প্রয়োজন, সে ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি অনেক। এই আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না হলে গণতন্ত্রকে আমরা উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব না। একটি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে বটে। কিন্তু নির্বাচনটি ভালো হয়নি। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনটি হলেও, নির্বাচনটি ছিল ত্রুটিযুক্ত। নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আটটি আসন পাওয়া অনেককেই অবাক করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ফ্রন্ট সংসদে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এখন দল তথা ফ্রন্টের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করেই সুলতান মনসুররা সংসদে যোগ দিলেন। আর মোকাব্বির খান, জাহিদরা তাকে অনুসরণ করলেন। এখন একটা মৌলিক প্রশ্ন এখনÑ জাহিদ, মোকাব্বির কিংবা সুলতান মনসুরের ভাগ্য এখন কীভাবে লিখিত হবে? তারা কি সংসদ সদস্য হিসেবে সংসদে আগামী পাঁচ বছর থাকতে পারবেন? নানা প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা এখন জনমনে। নবম জাতীয় সংসদের শেষের দিকে জাতীয় পার্টি থেকে সাতক্ষীরা-৪ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম রেজাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংসদে তার সংসদ্যপদ স্বতন্ত্র হিসেবে বজায় ছিল। অষ্টম সংসদের শেষের দিকে তৎকালীন বিএনপি থেকে রাজশাহী-৪ আসনের এমপি আবু হেনাকে বহিষ্কার করা হয়। আবু হেনার ক্ষেত্রেও তর সংসদ সদস্যপদ বহাল ছিল। সুলতান মনসুর, মোকাব্বির খান ও জাহিদরা এসব জানেন। আর জেনেশুনেই তারা সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন। যতদূর জানি সুলতান মনসুর নিজে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেননি। তিনি সংস্কারবাদী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সংস্কারবাদী অনেক নেতাকেই আওয়ামী লীগ ফিরিয়ে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সুলতান মনসুরকে যদি ফিরিয়ে নেয়, আমি অবাক হব না।
সুলতান মনসুর মোকাব্বির কিংবা জাহিদরা নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন, এটা সত্য। কিন্তু সংসদে যোগ দিয়ে নৈতিকভাবে এরা ‘পরাজিত’ হয়েছেন। আওয়ামী লীগের ‘রাজনৈতিক শত্রু’ বিএনপির ধানের শীষ মার্কা নিয়ে বিজয়ী হয়ে মনসুর সাহেবরা যদি এখন আবার তার নিজ দলে ফিরে যান, তাহলে রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য সেটা ভালো দৃষ্টান্ত হবে না। রাজনীতিকদের প্রতি মানুষের যে আস্থা হারাচ্ছে, এটা হবে তার একটা বড় দৃষ্টান্ত। মানুষ চায় রাজনীতিবিদরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। দলবদল, সীমিত সুযোগের জন্য দলত্যাগ কিংবা আবার দলে ফিরে আসা কোনো ভালো খবর নয়।
নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন অতিসম্প্রতি। বিএনপির ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন নানা মহল থেকে নানা কথা উচ্চারিত হচ্ছে, তখন উপজেলা নির্বাচন চলাকালীন তিনি বলেছিলেন, ‘ভোটের প্রতি জনগণের যে অনীহা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাতে জাতি এক গভীর খাদের কিনারার দিকে অগ্রসরমান। আমরা গণতন্ত্রের শোকযাত্রায় শামিল হতে চাই না। রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিকদের এটা ভেবে দেখা দরকার।’ (যুগান্তর) নির্বাচন কমিশন থেকে একজন নির্বাচন কমিশনার যখন এ ধরনের কথাবার্তা বলেন, তখন আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘মেসেজ’ দেয়। আমরা নির্বাচন ব্যবস্থাকে পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিয়েছি। পাঠক, কম্বোডিয়ার পরিস্থিতির দিকে লক্ষ রাখতে পারেন। নির্বাচন ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা ফিরিয়ে আনতে হলে সরকারি দলের ওপর নির্বাচন কমিশনের কর্তৃত্ব বাড়ানো ও বড় দলগুলোর মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা দরকার। না হলে সরকার ক্ষমতায় থাকবে বটে, কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কৃতির কোনো উন্নতি হবে না। গণতন্ত্রের জন্য তা হবে দুঃখজনক ঘটনা।
আমরা বারবার রাজনীতিবিদের কাছে ফিরে যাই। রাজনীতিবিদরাই আমাদের পথ দেখাবেন। তাদের ওপর আস্থাটা রাখতে চাই। কিন্তু সুলতান মনসুর, মোকাব্বির খান আর জাহিদুর রহমানরা সেই আস্থাটা কতটুকু ধরে রাখতে পারলেন এখন? ড. কামাল হোসেন নিঃসন্দেহে বাংলাদেশে একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি ‘সফল’ না হলেও, তার ব্যক্তিত্ব, দুর্নীতিমুক্ত থাকা, একজন সিনিয়র সিটিজেন, উপরন্তু সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় তার ভূমিকা তাকে সমাজে একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিতে পরিণত করেছে। কিন্তু একি করলেন তিনি? যে মোকাব্বির খানকে তার বাসা ও অফিসে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন, সেই মোকাব্বির খানকে পাশে বসিয়ে গণফোরামের বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশনে বক্তব্য দেন কীভাবে? তাহলে কি ধরে নেব মোকাব্বির খানের সংসদ অধিবেশনে যোগদানের ব্যাপারে তার নীরব সম্মতি ছিল? মোকাব্বির খান তো তেমনটাই ইঙ্গিত করেছিলেন। এটা কি তাহলে তার দ্বিমুখী নীতি হয়ে গেল না? বাংলাদেশের রাজনৈতিক মঞ্চে ড. কামাল হোসেন কখনোই আওয়ামী লীগের বিকল্প না, কখনো ছিলেন না, এখনো তিনি নন। একটা সীমিত সময়ের জন্য তার প্রয়োজন ছিল। সেই প্রয়োজন এখন ফুরিয়ে গেছে বলে আমার ধারণা।
একজন রাজনীতিবিদ সৎ থাকবেন। কমিটেড থাকবেন। লোভ তাকে স্পর্শ করতে পারবে না এটাই আমাদের প্রত্যাশা। আমাদের কাছে দৃষ্টান্ত যে নেই, তেমনটি নয়। দৃষ্টান্ত আছে। তাদের নাম আজ না হয় নাই বা উল্লেখ করলাম। কিন্তু আজ যখন দেখি শুধু রাজনীতি করে অনেকে অঢেল সম্পদের ‘মালিক’ হয়েছেন, তখন কষ্ট লাগে। আস্থায় ঘাটতি সৃষ্টি হয়। শুধু বাড়ি-গাড়ি নয়, অনেকে আবার ‘ব্যবসায়ী’ হয়ে গেছেন। অনেকে আবার কর দেন না অথবা করখেলাপি। সাধারণ একজন মানুষ থেকে হঠাৎ করে ‘আলাদিনের চেরাগ’ পেয়ে বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে গেছেন! দুদক যখন এদের কাউকে কাউকে ‘নোটিস’ করে, তখন আমাদের আস্থার জায়গাটা আর থাকে না।
একটা দল ভুল করতেই পারে। বিএনপিও ভুল করেছে। এখন জাহিদুর রহমানরা সংসদে গিয়ে কি আরেকটি ভুল করতে যাচ্ছেন? এটা ‘ওয়ান মিলিয়ন’ ডলারের প্রশ্ন। যদিও বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, সরকারের ‘চাপ’ ছিল। অথচ প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন কোনো ‘চাপ ছিল না’। অনেকে বলার চেষ্টা করেন, সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সংসদ সদস্যের পদটি একটি ‘লোভনীয় পদে’ পরিণত হয়েছে! সংসদ সদস্যরা ট্যাক্স ফ্রি গাড়ি পান (অনেকে আবার সেই গাড়ি অনেক টাকায় বিক্রি করে দেন)। ফ্ল্যাট কিংবা প্লট পান। মাসিক বেতন ও মাসোহারা পান। এককালীন থোক বরাদ্দ পান। নামে-বেনামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলতে পারেন। এটা যে শুধু যারা ক্ষমতায় থাকেন, তাদের জন্যই প্রজোয্য নয়। বরং যারা বিরোধী দলে থাকেন, তারাও এই ‘সুযোগ’টি গ্রহণ করেন। একসময় যারা বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তারাও এক-একজন ধনাঢ্য ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন এমন অভিযোগ তো আছে। নিজের স্ত্রী, ভাই কিংবা বোনকে সংসদ সদস্য হিসেবে সংসদে নিয়ে এসেছেন এমন দৃষ্টান্ত তো এ সংসদেই আছে। একজন মওলানা ভাসানী চিরদিন ‘কুঁড়ের ঘরে’ জীবন কাটিয়ে গেছেন। তিনি কখনো প্লট বা ফ্ল্যাটের জন্য আবেদন করেননি। ঢাকা শহরে তার বাড়িও নেই। এসব তার প্রয়োজন ছিল না। তার অনুসারীরা তাকে কলা-মুড়ি, চিঁড়া এনে দিয়ে যেতÑ এসব তিনি নিজে যেমন খেতেন, তেমনি আমাদের মতো অতিথি গেলে, তাদেরও খেতে দিতেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, ‘দ্বিতীয়’ আরেকজন মওলানা ভাসানী আমরা পেলাম না!
এখন সুলতান মনসুর, মোকাব্বির খান কিংবা জাহিদুর রহমানরা কতটুকু ‘নিজের স্বার্থের’ জন্য সংসদে গেলেন, কিংবা কতটুকু ‘রাজনীতি’র জন্য সংসদে গেলেন, তার মূল্যায়ন হয়তো আগামী দিনে হবে। কিন্তু এ ‘ঘটনা’ একটা বাজে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকল। এ ‘ঘটনা’ আগামী দিনের রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে। এর ফলে ‘রাজনীতি’ আর থাকল না। সুবিধাবাদিতা এখন এসে ভিড় করবে রাজনীতির ময়দানে।
Daily Desh Rupantor
30.04.2019

ইসলামিক স্টেটের 'দ্বিতীয়' উত্থান


শেষ অবধি ইসলামিক স্টেট বা আইএস স্বীকার করল, তারা শ্রীলংকায় গত ২০ এপ্রিল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। রাজধানী কলম্বো ও শহরতলির তিনটি গির্জা ও কয়েকটি ফাইভ স্টার হোটেলে যে সন্ত্রাসবাদী আত্মঘাতী বোমা হামলা চালানো হয়েছিল, তাতে এখন পর্যন্ত ৩৫৯ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। বরাবরের মতো ওয়াশিংটনভিত্তিক সন্ত্রাস পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা  Site intelligence কয়েকজন যুবকের ছবি প্রকাশ করে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিল, এরাই আত্মঘাতী বোমারু। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আইএস যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছিল  Site intelligence 
কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তাদের ওয়েবসাইটে তা প্রকাশ করেছিল। এটি পরিচালনা করেন রিটা কাট্‌জ নামে একজন নারী। যিনি এক সময় ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থায় কাজ করতেন।

শ্রীলংকায় আত্মঘাতী বোমা হামলার পরপরই আমি গণমাধ্যমকে বলেছিলাম, এটা আইএসের কাজ। তারা মার্চে ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে যে ৭১ জন মুসল্লিকে হত্যা করা হয়েছিল, আইএস প্রতিশোধ নিল এর মধ্য দিয়ে। আইএস আগেই এর প্রতিশোধ নেওয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু মাত্র এক মাসের ব্যবধানে তারা যে প্রতিশোধটি নেবে এবং শ্রীলংকার মতো একটি দেশকে বেছে নেবে, এটা ছিল আমার কাছে অকল্পনীয়। আইএস কেন শ্রীলংকাকে বেছে নিল, এটা নিয়েও নানা প্রশ্ন আছে।

এখন শ্রীলংকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সংঘটিত করে আইএস তার 'দ্বিতীয় উত্থান'কে জানান দিল। ২০১৪ সালে সিরিয়া-ইরাকে আইএসের জন্ম ছিল অবাক করার মতো একটি ঘটনা। সারাবিশ্ব সেদিন প্রত্যক্ষ করেছিল একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের জন্মের পর ইসলাম ধর্মের নামে তারা উদ্যোগ নিয়েছিল তথাকথিত একটি খেলাফত প্রতিষ্ঠা করার। সেই 'খেলাফত' প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কিন্তু মুসলমানপ্রধান দেশগুলো থেকে শত শত তরুণ সিরিয়ায় গিয়েছিল এদের পক্ষ হয়ে সিরিয়ায় যুদ্ধ করতে। সরাসরি যুদ্ধেও তারা অংশ নিয়েছিল। কিন্তু মাত্র চার বছরের ব্যবধানে ভেঙে পড়ে ইসলামিক স্টেটের সেই খেলাফতের ধারণা। সিরিয়া-ইরাক থেকে এরা পালিয়ে যায়, আশ্রয় নেয় ফিলিপাইনসহ মুসলমানপ্রধান কিছু কিছু দেশে। আইএসের মূল কাঠামো ভেঙে গিয়েছিল সত্য; কিন্তু আদর্শের মৃত্যু হয়নি। তাই মুসলমানপ্রধান দেশগুলোতে স্থানীয় কিছু সংগঠনকে উৎসাহিত করে এদের ব্যানারে আইএসের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে এখন আমরা দেখি। যেমন বলা যেতে পারে- আল শামান (সোমালিয়া), ইসলামিক স্টেট-খোরাসান (আফগানিস্তান), হাক্কানী নেটওয়ার্ক (আফগানিস্তান), দোজো মিলিশিয়া (মালি), জইশ-ই-মোহাম্মদ (কাশ্মীর), তেহরিক-ই তালেবান (পাকিস্তান), বোকো হারাম (নাইজেরিয়া), আল কায়দা ইন ইসলামিক পেনিনসুলা (ইয়েমেন), ইউনাইটেড জিহাদি কাউন্সিলের (পাকিস্তান) নাম। তবে সবচেয়ে বেশি সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে এখনও জড়িত আইএস ও তালেবান। এরা সবাই ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করছে তাদের সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডে। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হলো শ্রীলংকার ন্যাশনাল তওহিদ জামাতের (এনটিজে) নাম। অতীতে শ্রীলংকায় সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত ছিল তামিল টাইগাররা। এখন সেটা অতীত। এখন যুক্ত হলো ইসলামিক সন্ত্রাসবাদীরা। এটা শ্রীলংকার গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য কোনো ভালো খবর নয়। লক্ষণীয়, শ্রীলংকার এই জাতীয় সংকটে সরকারি দল, বিরোধী দল, জাতীয় গণমাধ্যম ও নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনী, সবাই নূ্যনতম ইস্যুতে একত্রিত হয়নি। শ্রীলংকার স্থিতিশীলতার জন্য এটা ভালো খবর নয়। তবে এটা ভুলে গেলে চলবে না, জঙ্গিবাদ এখনও একটি বৈশ্বিক সমস্যা। ইসলামিক স্টেটের উত্থান (২০১৪) ও পতনের মধ্য দিয়ে ইসলামিক জঙ্গিবাদের অবসান হয়েছে- এটা আমার মনে হয় না। বরং খোঁজ নিলে দেখা যাবে, আইএসের সঙ্গে যেসব জঙ্গি সেখানে যুদ্ধ করেছিল এবং যারা বেঁচে গিয়েছিল, তারা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে এবং সেখানে স্থানীয় জঙ্গিদের সঙ্গে মিলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখছে। ফিলিপাইনের মিন্দানাও প্রদেশে ইসলামিক জঙ্গিরা আশ্রয় নিয়েছে। ২০১৭ সালে আইএস জঙ্গিরা মারাভি নামে একটি শহর দখল করে নিয়েছিল। দীর্ঘ ৫ মাস মারাভি দখল করে সেখানে তারা ইসলামী শাসন চালু করেছিল। পরে অবশ্য মারাভি জঙ্গিমুক্ত হয়েছে। সাধারণত আইএস স্থানীয় জঙ্গিদের সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে তোলে। ফিলিপাইনের মিন্দানাও ও আবু সালাফ গ্রুপ, আনসার খলিফা ফিলিপাইনস, মাউটে গ্রুপ- এদের সঙ্গে আইএস রাজনৈতিক সখ্য গড়ে তুলেছে। আর এরাই সেখানে জঙ্গিবাদী কার্যক্রম চালাচ্ছে। থাইল্যান্ডের দক্ষিণে তিনটি প্রদেশ- ইয়ালা, নারালিওয়াট ও পাটানিতে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড চলছে এবং এর পেছনে আইএসের ইন্ধন আছে। দুটি সংগঠনের কথা জানা যায়- Barisan Ruslun National Malaya Patani'র সশস্ত্র শাখা Runda Kumpulan kecil I Gerakan mujahideen Islam Patani. এরা আইএসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ইন্দোনেশিয়াতেও আইএসের সমর্থিত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো (লস্কর জিহাদ, জামিয়া ইসলামিয়া, ইসলামিক ডিফেনডার্স ফ্রন্ট) তৎপর। সেখানে হামা আনসারাট দাওলাকে প্রো-আইএস বলে ধরে নেওয়া হয়। তুলনামূলক বিচারে মালয়েশিয়াতে ইসলামিক জঙ্গিদের তৎপরতা কম।

শ্রীলংকার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আইএস জানান দিল তাদের অস্তিত্বের কথা। আমি এটাকে বলছি আইএসের দ্বিতীয় উত্থান। আইএসের জন্মদাতা আবু বকর আল বুগদাদি আদৌ বেঁচে আছেন কিনা কিংবা বেঁচে থাকলে কোথায় আছেন, সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া না গেলেও আইএস সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে যেসব স্ট্র্যাটেজি অনুসরণ করে, শ্রীলংকার ক্ষেত্রে সেই একই স্ট্র্যাটেজি অনুসরণ করতে আমরা দেখেছি। যেমন স্থানীয় কোনো সংগঠনকে ব্যবহার করা (এ ক্ষেত্রে ন্যাশনাল তওহিদ জামিয়াত), আত্মঘাতী হামলাকারীদের ব্যবহার (৭ জনের একটি গ্রুপ ছবি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে), অপারেশনে যাওয়ার আগে আইএস ও বুগদাদির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ, 'সাইট ইনটেলিজেন্স' নামে ওয়াশিংটনভিত্তিক একটি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণকারী সংস্থার ওয়েবসাইটে তা প্রকাশ, ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, শক্তিশালী বিস্ম্ফোরক ব্যবহার ইত্যাদি। আইএসের স্ট্র্যাটেজি অনেকটা Spider web  স্ট্র্যাটেজির মতো। ছোট ছোট সেলে বিভক্ত হয়ে আইএস এখন তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। মাকড়সার জালের মতো সংগঠিত হচ্ছে আবার ধ্বংসও হচ্ছে। মাকড়সা যেমন ঘরের এক কোণে জাল বোনে, সেই জাল নষ্ট করে দিলে অন্যত্র, অন্য কোথাও গিয়ে জাল বোনে- আইএসের বর্তমান স্ট্র্যাটেজি অনেকটা সেরকম। আগের মতো তারা সুসংগঠিত হয়ে একটি বিশাল এলাকা নিয়ে (সিরিয়ার রাকাকে কেন্দ্র করে) যে 'বিশাল সাম্রাজ্য' তারা গড়ে তুলেছিল, এখন তাতে তারা পরিবর্তন আনছে বলেই মনে হয়। এটাই হচ্ছে Spider web-এর তত্ত্ব। এক জায়গায় ধ্বংস হবে, এরপর অন্য জায়গায় গিয়ে তারা আবার সংগঠিত হবে। আবু মুসাব আল সুরি (The Global Islmic Resistance) হচ্ছেন এই তত্ত্বের প্রবক্তা। এখন শ্রীলংকার সন্ত্রাস যে শেষ সন্ত্রাস, তা বোধকরি অনেকেই স্বীকার করবেন না। হয়তো দেখা যাবে, আইএস অন্য কোনো দেশে আবারও সংগঠিত হয়ে স্থানীয় কোনো সংগঠনকে ব্যবহার করে এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাবে। দক্ষিণ এশিয়া তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হচ্ছে এদের জন্য এক ধরনের উর্বর ভূমি। এ অঞ্চলে দরিদ্রতা আছে, মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বসবাস, যারা বঞ্চনার শিকার ও তাদের মাঝে হতাশা আছে- আইএসের পক্ষে এদের রিক্রুট করা সহজ।

বিশ্বব্যাপী জঙ্গি তৎপরতা বাড়ছে। ৯/১১-এর ঘটনাবলির পর যুক্তরাষ্ট্র 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' শুরু করেছিল। ১৭ বছর পরও সেই যুদ্ধের শেষ হয়নি। পাঠকদের কিছু তথ্য দিই, যাতে বোঝা যাবে ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে এ যাবৎ কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। যুদ্ধের পেছনে এ যাবৎ খরচ হয়েছে ৪ দশমিক ৭৭ ট্রিলিয়ন ডলার। ওই যুদ্ধে ১৪,৫৫,৫৯০ জন ইরাকি মারা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মারা গেছে ৪৮০১ জন সেনা আর আন্তর্জাতিক ফোর্সের মৃত্যুর সংখ্যা ৩৪৩০ জন (Infromation clearing House, April 20, 2019)। চিন্তা করা যায়, যুদ্ধের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ঘণ্টায় খরচ হয় এক মিলিয়ন ডলার। 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ'-এর কারণেই পৃথিবীর মুসলমানপ্রধান অঞ্চলগুলোতে জন্ম হয়েছে জঙ্গি সংগঠনগুলোর। আর আইএস এদের উৎসাহিত করছে জঙ্গিবাদ অব্যাহত রাখতে। সারা ফিনিয়ান কানিংহাম, নোয়াম চমস্কি কিংবা অধ্যাপক মিসেল চসুডোভস্কির লেখার সঙ্গে পরিচিত, তারা জানেন, ওইসব গবেষক তথ্য-উপাত্ত দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে, 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ'-এর পেছনে একটা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য কাজ করছে। আল কায়দা কিংবা আইএসের উত্থানের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধন ছিল ও এখনও আছে- এমন কথাও কোনো কোনো মহল থেকে বলা হয়। একটি বিশেষ মহল আইএসকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে আসছে। অর্থ একটি ফ্যাক্টর। অর্থ ছাড়া এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যায় না। ফিনিয়ান কানিংহাম তার প্রবন্ধ '9/11 Pavid the way for Americas Permanent war or Aggression'-এ মার্কিন ব্যবসায়িক শ্রেণির স্বার্থের কথা উল্লেখ করেছেন (পাঠক, ইরাক পুনর্গঠনের কথা স্মরণ করুন। যুদ্ধ-পরবর্তী ইরাকে পুনর্গঠনের কাজ পেয়েছিল মার্কিন কোম্পানিগুলো)। মিসেল চসুডোভস্কি তো স্পষ্ট করেই বলেছেন,alleged jihadi plotters were the Product of US state terrorism. ৯/১১ নিয়ে চসুডোভস্কি এই মন্তব্য করেছিলেন (পাঠক পড়ূন চসুডোভস্কির বহুল আলোচিত গ্রন্থ The Globalization of War)। চমস্কির বই ৯/১১: 9/11: war there an Alternativeও পড়ে দেখতে পারেন।

শ্রীলংকায় আইএসের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ে যত প্রশ্নই থাকুক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে, আইএস তাদের স্ট্র্যাটেজিতে পরিবর্তন এনে তাদের অস্তিত্ব জানান দিল। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশের জন্য এটা একটা 'ওয়েকআপ' কল। আইএস আছে। তাদের স্ট্র্যাটেজিতে পরিবর্তন আনছে মাত্র। একসময় তারা সিরিয়াতে বিশাল এক 'জিহাদি বাহিনী' গঠন করে একটি 'জিহাদি রাষ্ট্র' প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেছিল। সে চেষ্টা সফল হয়নি। এখন 'ইসলামের নামে' এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আইএস তাদের অস্তিত্ব আবারও জানান দিয়ে গেল মাত্র।
Daily Lakerkontho
26.04.2019

রক্তাক্ত কলম্বো ও দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা






শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বো ও শহরতলির তিনটি গির্জা ও কয়েকটি ফাইভ স্টার হোটেলে সন্ত্রাসী হামলার পর খুব সঙ্গত কারণেই একটি প্রশ্ন এখন ব্যাপকভাবে আলোচিত আর তা হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো আসলে কতটুকু নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকির মাঝে আছে? দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো এর আগে একাধিকবার সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের শিকার হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভুটান ও নেপাল থেকে তেমন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের খবর না আসলেও, বাংলাদেশ ও ভারতের রাজধানীতে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে সংঘটিত হয়েছে। আর পাকিস্তান ও আফগানিস্তান তো বরাবরই সন্ত্রাস কবলিত দুটি দেশ। আগফানিস্তান কার্যত এখন তালেবান আর ইসলামিক স্টেটের নিয়ন্ত্রণাধীনে। সেখানে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। খোদ রাজধানী কাবুল এখন অরক্ষিত। কাবুলে আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনা এখন যেন সেখানে সাধারণ একটি ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তালেবানদের সঙ্গে একদিকে আলোচনা শুরু করলেও, আত্মঘাতী বোমাবাজি সেখানকার রাজনৈতিক সংস্কৃতির অন্যতম অংশে পরিণত হয়েছে। পাকিস্তানে পাখিতুন খাওয়া প্রদেশে সরকারের কর্তৃত্ব এক রকম নেই বললেই চলে। পাকিস্তানে জঙ্গিগোষ্ঠী তেহরিক-ই-তালিবান অত্যন্ত সক্রিয়। একসময় ধারণা করা হয়েছিল ইমরান খান রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিলে সেখানে আত্মঘাতী বোমাবাজি সংস্কৃতি বন্ধ হবে। কিন্তু তা হয়নি। বরং বেলুচিস্তান নতুন করে সন্ত্রাস কবলিত এলাকা হিসেবে যোগ হয়েছে। ভারতের অবস্থাও লক্ষ করার মতো। সম্প্রতি সেখানে একাধিক সন্ত্রাসবাদী ঘটনা ঘটেছে। খোদ ভারতের পার্লামেন্টেও সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়েছিল। চলতি বছরের ১৪ ফেব্রæয়ারি জম্মু ও কাশ্মিরের পুলওয়ামায় সন্ত্রাসী হামলায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ৪০ জন আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য। এর জন্য দায়ী করা হয়েছিল পাকিস্তানভিত্তিক সংগঠন জইশ-ই-মোহাম্মদকে। বাংলাদেশও সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ডে আক্রান্ত হয়েছিল। বাকি ছিল শ্রীলঙ্কা। এখন শ্রীলঙ্কাও আক্রান্ত হলো। দক্ষিণ এশিয়ায় সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ডের সঙ্গে ইসলামিক স্টেট প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে গেছে। শ্রীলঙ্কার গণহত্যার সঙ্গে আইএস জড়িত। তারা গেল মার্চ মাসে ক্রাইস্টচার্চের ৫০ জন মুসলমানের হত্যার প্রতিশোধ নিল। ২০ এপ্রিলের ঘটনা সেখানে একটি ব্যাতিক্রমধর্মী ঘটনা হলেও (৩২১ জন মানুষের মৃত্যু) সেখানে মুসলমানদের সঙ্গে উগ্র বৌদ্ধদের সংঘর্ষের খবর সম্প্রতি একাধিকবার সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় মুসলমান জনগোষ্ঠীর সংখ্যা মাত্র ১০ শতাংশ। সংখ্যাগরিষ্ঠ ৭১ শতাংশ মানুষ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তবে বৌদ্ধদের মাঝে উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। একটি উগ্রপন্থি বৌদ্ধ সংগঠনের (বদু বালা সেবা) নাম পাওয়া যায়, যারা মুসলমানদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে আসছে। এরা কলম্বোতে বাংলাদেশ দূতাবাসেও একবার হামলা চালিয়েছিল। আইএস তাদের সহযোগী সংগঠনকে তাই শ্রীলঙ্কাকেই বেছে নিয়েছে তাদের পরবর্তী টার্গেট হিসেবে। আইএস ন্যাশনাল তওহিদ জমিয়াতকে কলম্বোতে ব্যবহার করেছিল। আইএস-এর খেলাফতের পতন হয়েছে। সিরিয়ার রাকাতে ছিল তাদের অলিখিত রাজধানী। এতদিন তারা ইউরোপের বিভিন্ন শহরে, বিশেষ করে প্যারিস, লন্ডন ও ব্রাসেলসের মতো শহরে ‘লোন উলফ’ বা একক সন্ত্রাসী হামলার মধ্য দিয়ে তাদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে আসছিল। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও তারা লোন উলফ-এর মাধ্যমে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনা করেছে। লক্ষ করলে দেখা যাবে মুসলমান প্রধান দলগুলোতে আইএসের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড হয়েছে কম।

যেখানে মুসলমানরা সংখ্যালঘু, সেখানে আইএস তাদের কর্মকান্ড সম্প্রসারিত করেছে। শ্রীলঙ্কায় সন্ত্রাসী কর্মকান্ড এ আলোকেই রচিত। তবে শ্রীলঙ্কায় এই সন্ত্রাসী কর্মকান্ড এখন অনেক প্রশ্নের জন্ম দেবে। এএফপি আমাদের জানাচ্ছে ২০ এপ্রিলের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের অন্তত ১০ দিন আগে শ্রীলঙ্কার পুলিশ প্রধান প্রযুথ জয়াসুন্দরা শ্রীলঙ্কায় সম্ভাব্য একটি সন্ত্রাসী হামলার কথা জানিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছিলেন। ১১ এপ্রিল ওই চিঠিটি পাঠানো হয়েছিল বলে একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা প্রিয়লাল দেশনায়েকে সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন (ডেইলি মিরর, ২২ এপ্রিল)।
সংবাদপত্রে এমন খবরও প্রকাশিত হয়েছে যে, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা শ্রীলঙ্কার গোয়েন্দা সংস্থাকে সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলার তথ্য সরবরাহ করেছিল। অন্তত ৩০ মিনিট আগেই শ্রীলঙ্কার গোয়েন্দারা জানত একটি সন্ত্রাসী হামলা হতে যাচ্ছে। সঙ্গত কারণেই তাই প্রশ্ন এসে যায়, শ্রীলঙ্কার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ ব্যাপারে বিশেষ পদক্ষেপ নিল না কেন? এটা কি শুধুই শৈথিল্য? সন্ত্রাসী হামলাকে সিরিয়াসলি না নেওয়া? নাকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাঝে জঙ্গিদের পেনিট্রেশন ঘটেছে? বিবিসিকে একজন শ্রীলঙ্কার মন্ত্রী স্বীকার করেছেন যে, চিঠি পাওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী অবহিত ছিলেন না। তবে চিঠি পাওয়ার বিষয়টি তিনি স্বীকার করেছেন। সারা বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদ যখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, যখন আইএস ক্রাইস্টচার্চের গণহত্যার বদলা নেওয়ার কথা বলছিল, তখন শ্রীলঙ্কার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সতর্ক হবার প্রয়োজন ছিল। তারা দায়িত্বে অবহেলা করেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে শ্রীলঙ্কার পুলিশ প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে। কাউন্টার টেররিজম ফোর্স গঠন করতে হবে।
বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা শ্রীলঙ্কা কাজে লাগাতে পারে। দ্বিতীয়ত, শ্রীলঙ্কায় ন্যাশনাল তওহিদ জমিয়াত বা এনটিজে নামে উগ্র ইসলামিক সংগঠনের খবর পাওয়া যায়, তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে। এনটিজের সঙ্গে আইএসের যোগাযোগ আছে। এনটিজেকে বলা হয় আইএসের পূর্বসূরী। এদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের রেকর্ড আছে। গেল বছর এরা বেশকিছু বৌদ্ধমন্দির ভেঙে আলোচনায় এসেছিল। এই হামলার সঙ্গে অন্য কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের কতটুকু যোগসূত্র আছে, তা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব এখন শ্রীলঙ্কার নিরাপত্তা বাহিনীর। ইতোমধ্যে শ্রীলঙ্কার পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, এই সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সঙ্গে স্থানীয় সংগঠন জড়িত।

যদিও সুনির্দিষ্ট কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের নাম প্রথমে বলা হয়নি। শ্রীলঙ্কার সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা গুনাসেকারা এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন। স্থানীয় সংগঠনই এই সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালিয়েছে। জাহরান হাশিম নামে একজন উগ্রবাদী সন্ত্রাসীর ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। বিদেশ থেকে তার ছবি ‘আপলোড’ করা হয়েছে। সুতরাং এই সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জাহরান হাশিমের সংশ্লিষ্টতা কী, তার উদ্দেশ্য কী ছিল কিংবা সে কাদের সঙ্গে জড়িত ছিল, এসব এখন খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

মুসলমানদের বলা হয় শ্রীলঙ্কার ‘ভ‚মিপুত্র’ অর্থাৎ আদি বসতি। অতীতে শ্রীলঙ্কায় মুসলমানদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের তেমন কোনো খবর পাওয়া যায় না। কিন্তু ২০১৪ সালে সিরিয়া ইরানে আইএসের উত্থানের পরপরই সারা বিশ্বেই সন্ত্রাসবাদের ধারণা পাল্টে গেছে। বিশ্বে ইসলামিক খেলাফত প্রতিষ্ঠার মতবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে তরুণ প্রজন্ম, যারা মুসলমান, তারা সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ডে নিজেদের জড়িত করেছেন।
মুসলমান প্রধান দেশগুলোতে এর প্রেক্ষাপটেই জন্ম হয়েছে স্থানীয় কিছু সন্ত্রাসী সংগঠন, যারা সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ডের মধ্য দিয়েই ইসলামিক আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। শ্রীলঙ্কায় এনটিজের উত্থান এভাবেই এখন তদন্তে বেড়িয়ে আসবে এদের সঙ্গে অন্য কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের যোগাযোগ আছে কি না, কিংবা থাকলে কতটুকু আছে। প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা ও প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের মাঝে এক ধরনের ক্ষমতার দ্ব›দ্ব আছে। এই দ্ব›দ্ব সন্ত্রাসীদের উসকে দিল কি না, কিংবা তারা সুযোগ নিল কি না, তাও খতিয়ে দেখা দরকার। ন্যাশনাল তওহিদ জমিয়াত-এর আর্থিক ভিত্তি কী, তা খুঁজে দেখা দরকার। কেননা এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা চালাতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের পর শ্রীলঙ্কায় যখন স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছিল, ঠিক তখনই এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড শ্রীলঙ্কার জন্য কোনো ভালো খবর নয়। গৃহযুদ্ধের পর শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে সুবাতাস বইছে। ৪২ মিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৭ মিলিয়নে।
শ্রীলঙ্কায় ভ্রমণকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে (প্রতি মাসে) ৫ গুণ। ২০০৯ সালে যে সংখ্যা ছিল ৫০ হাজার, ২০১৮ সালে তা বেড়েছে ২ লাখ ৫০ হাজারে। দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কাতেই মাথাপিছু আয় সবচেয়ে বেশি। এই ঘটনায় শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিদেশি পর্যটকদের শ্রীলঙ্কায় আসা বন্ধ হয়ে যাবে। এতে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদিও দুটি ইসলামিক সংগঠন (শ্রীলঙ্কার) ‘দ্য মুসলিম কাউন্সিল অব শ্রীলঙ্কা’ ও ‘অল সিলোন জমিয়াতুল উলেমা’ এই সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ডের নিন্দা করেছে। যন্ডদিও শ্রীলঙ্কার শীর্ষ স্থানীয় ক্রিশ্চিয়ান ধর্মীয় নেতা ‘শান্তি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি বজায় রাখার আহŸান জানিয়েছেন। কিন্তু সেখানে উগ্র বৌদ্ধ সংগঠন রয়েছে। তারা এটাকে ইস্যু করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি কষ্ট করতে পারে। এ দিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।

শ্রীলঙ্কার সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ড শুধু শ্রীলঙ্কা তথা দক্ষিণ পূর্ব-এশিয়ার দেশগুলোর জন্য একটি ‘ওপেক আপ’ বলই নয়, বাংলাদেশের জন্যও একটি সতর্ক বার্তা। অতীতে বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ড সংঘটিত হয়েছে। তবে আমাদের ‘কাউন্টার টেররিজম ইউনিট’কে ধন্যবাদ দিতেই হয়। এই সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ড পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে, এটা বলা যাবে না, তবে অনেক ক্ষেত্রেই নির্মূল হয়েছে। ইসলামের নামে ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে কোনো কোনো ওয়াজ মাহফিলে, এমন অভিযোগ শোনা যায়। এ ক্ষেত্রে মনিটরিং বাড়ানো দরকার। তরুণ প্রজন্ম যাতে বিভ্রান্ত না হয়, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন সোস্যাল মিডিয়ায় যাতে শ্রীলঙ্কার ঘটনাবলি ব্যবহার করে বিভ্রান্তি না ছড়ানো হয়, সে ব্যাপারে তৎপর হওয়া জরুরি। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদের মাত্রা কমেছে, এটা বলা যাবে না। গবেষকদের তথ্য মতে, গত চার মাসে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ২৬৪টি সন্ত্রাসবাদী ঘটনা ঘটেছে। এসব সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ডের সঙ্গে স্থানীয় সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলো জড়িত থাকলেও পর্দার অন্তরালে আইএস এদের পরিচালনা করছে। এমনকি আগের মতো ঝওঞঊ ওহঃবষষরমবহপব-কেও আমরা তৎপর হতে দেখলাম। বাংলাদেশসহ যেখানেই আইএস তাদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালিয়েছে। ঝওঞঊ (ওয়াশিংটনভিত্তিক ইসরাইলি সাবেক গোয়েন্দা রিটা কাটজ কর্তৃক পরিচালিত) সেই খবরগুলো অত্যন্ত দ্রæততার সঙ্গে তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রেও তিনজন আত্মঘাতী বোমারুর ছবি তারা প্রকাশ করেছে, যারা শ্রীলঙ্কায় আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়েছিল। শ্রীলঙ্কা সরকার তাদের দেশে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশকে শ্রীলঙ্কার ঘটনাবলি থেকে শিক্ষা নেওয়া ও সন্ত্রাস দমনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো নিজেদের মধ্যে তথ্য বিনিময়ও করতে পারে। শ্রীলঙ্কার ঘটানাবলিকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
Daily Somoyer Alo
25.04.2019

শ্রীলঙ্কায় সন্ত্রাসবাদী হামলা কী বার্তা দেয়


Image result for Terror in Colomboশ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বো ও শহরতলির তিনটি গির্জা ও দেশের বড় বড় তিনটি হোটেলে আত্মঘাতী বোমা হামলার পর যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে এই হামলা কী বার্তা দিয়ে গেল? শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে এত বড় সন্ত্রাসী কর্মকান্ড অতীতে কখনো হয়নি। এটা ঠিক শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে একটা ‘কালো অধ্যায়’ আছে। শ্রীলঙ্কার তামিল টাইগারদের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের কারণে ইতিহাস শ্রীলঙ্কার ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট করেছিল। ১৯৮৪-৮৫ সালে শ্রীলঙ্কার তামিলরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছিল। ২০০৯ সালে তামিল টাইগার নেতা প্রভাকরনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তামিলদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের অবসান ঘটে। দীর্ঘ ২৫ বছরের সশস্ত্র সংগঠনে তামিল টাইগাররা একাধিকবার আত্মঘাতী হামলা পরিচালনা করেছে। তামিলদের আত্মঘাতী বোমা হামলায় ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী পর্যন্ত মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু ২০০৯ সালের পর থেকে আর আত্ম্ঘাতী বোমা হামলার তেমন কোনো খবর পাওয়া যায় না। সুতরাং হঠাৎ করেই আবার যখন শ্রীলঙ্কায় আত্মঘাতী বোমা হামলা হলো, তখন প্রশ্ন উঠেছে এই সন্ত্রাসী হামলার পেছনে কারা রয়েছে এবং তাদের উদ্দেশ্য কী? অনেকের দৃষ্টি এখন ইসলামিক স্টেটের দিকে, যারা ঘোষণা দিয়েছিল ক্রাইস্টচার্চের ৫০ জন মুসলমানের হত্যায় তারা বদলা নেবে। শ্রীলঙ্কায় ২৯০ জন মানুষকে হত্যার মধ্যদিয়ে কিংবা ৩টি চার্চে হামলার মধ্যদিয়ে আইএস কি সেই প্রতিশোধই নিল? ইতিমধ্যে ‘ন্যাশনাল তওহিদ জমিয়াত’ নামে একটি মুসলমান প্রধান সংগঠনের নাম পাওয়া যায়, যারা এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত বলে বিশ্বাস করা হচ্ছে। ‘ন্যাশনাল তওহিদ জমিয়াত’ বা এনটিজে আইএস-এর আদর্শ ধারণ করে। আইএস-এর পূর্বসূরি হচ্ছে এনটিজে।
মুসলমানদের বলা হয় শ্রীলঙ্কার ‘ভূমিপুত্র’ অর্থাৎ আদি বাসিন্দা। অতীতে শ্রীলঙ্কায় মুসলমানদের সন্ত্রাসী কর্মকা-ের তেমন কোনো খবর পাওয়া যায় না। কিন্তু ২০১৪ সালে সিরিয়া-ইরাকে আইএস-এর উত্থানের পর পরই সারা বিশে^ই সন্ত্রাসবাদের ধারণা পাল্টে গেছে। বিশ্বে ‘ইসলামিক খেলাফত’ প্রতিষ্ঠার মতবাদে উদ্ভূত হয়ে তরুণ প্রজন্ম, যারা মুসলমান, তারা সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ডে নিজেদের জড়িত করেছেন। মুসলমান প্রধান দেশগুলোতে এর প্রেক্ষাপটেই জন্ম হয়েছে স্থানীয় কিছু সন্ত্রাসী সংগঠন, যারা সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ডের মধ্য দিয়েই ‘ইসলামিক আদর্শ’ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। শ্রীলঙ্কায় এনটিজের উত্থান এভাবেই। এখন তদন্তেই বেরিয়ে আসবে এইসব হামলার সঙ্গে আইএস জড়িত ছিল কি না। তবে এদের সঙ্গে আইএস-এর কোনো যোগসূত্র নেই কিংবা আইএস এদের উৎসাহিত করেনি এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা- করতে, তা বলা যাবে না। আগামীতে যদি আইএস-এর পক্ষ থেকে এই সন্ত্রসাী কর্মকান্ডে তাদের জড়িত থাকার কথা ঘোষণা করা হয় আমি অবাক হব না।
দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের পর শ্রীলঙ্কায় যখন স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছিল, ঠিক তখনই এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা- শ্রীলঙ্কার জন্য কোনো ভালো খবর নয়। গৃহযুদ্ধের পর শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে সুবাতাস বইছে ৪২ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি, বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৭ বিলিয়নে। শ্রীলঙ্কায় ভ্রমণকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে (প্রতি মাসে) ৫ গুণ। ২০০৯ সালে যে সংখ্যা ছিল ৫০ হাজারে, ২০১৮ সালে তা বেড়েছে ২ লাখ ৫০ হাজারে। দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কাতেই মাথাপিছু আয় সবচেয়ে বেশি। এই ঘটনায় শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিদেশি পর্যটকদের শ্রীলঙ্কায় আসা বন্ধ হয়ে যাবে, যাতে করে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদিও দুটি ইসলামিক সংগঠন (শ্রীলঙ্কার) ‘দি মুসলিম কাউন্সিল অব শ্রীলঙ্কা’ ও ‘আল সিলোন জমিয়াতুল উলেমা’ এই সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ডের নিন্দা করেছে। যদিও শ্রীলঙ্কার শীর্ষস্থানীয় ক্রিশ্চিয়ান ধর্মীয় নেতা ‘শান্তি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি’ বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু সেখানে উগ্র বৌদ্ধ সংগঠন রয়েছে। তারা এটাকে ইস্যু করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে পারে। এ দিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
শ্রীলঙ্কার সন্ত্রাসবাদী কর্মকা- শুধুমাত্র শ্রীলঙ্কা তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জন্য একটি ‘ওয়েক আপ’ ফলই নয়, বাংলাদেশের জন্যও একটি সতর্কবার্তা। অতীতে বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ড সংঘটিত হয়েছে। তবে আমাদের ‘কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট’কে ধন্যবাদ দিতেই হয়। এই সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ড পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে, এটা বলা যাবে না, তবে অনেক ক্ষেত্রেই নির্মূল হয়েছে। ইসলামের নামে ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে কোনো কোনো ওয়াজ মাহফিল, এমন অভিযোগও শোনা যায়। এ ক্ষেত্রে মনিটরিং বাড়ানো দরকার। তরুণ প্রজন্ম যাতে বিভ্রান্ত না হয়, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। সোশ্যাল মিডিয়ায় যাতে শ্রীলঙ্কার ঘটনাবলিকে ব্যবহার করে বিভ্রান্তি না ছড়ানো হয়, সে ব্যাপারে তৎপর হওয়া জরুরি।
বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদের মাত্রা কমেছে, এটা বলা যাবে না। গবেষকদের তথ্যমতে গত ৪ মাসে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ২৬৪টি সন্ত্রাসবাদী ঘটনা ঘটেছে। এইসব সন্ত্রাসবাদী কর্মকাকান্ডে সঙ্গে আল সামাজ (সোমালিয়া), তালিবান (আফগানিস্তান), ইসলামিক স্টেট (আফগানিস্তান), দোজো মিলিশিয়া (মালি), জইশ-ই-মোহাম্মদ (কাশ্মীর), তেহরিক-ই-তালিবান (পাকিস্তান), বোকো হারাম (নাইজেরিয়া), আল-কায়েদা (ইয়েমেন), বেলুচ রিপাবলিকান আর্মি বেলুচিস্তান) জড়িত। তবে সবচেয়ে বেশি  সন্ত্রাসবাদী কর্মকাকান্ডের সঙ্গে জড়িত আইএস ও তালিবান। এরা সবাই ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করছে তাদের সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ডে। এসব এর সঙ্গে যুক্ত হােল শ্রীলঙ্কার নাম। অতীতে শ্রীলঙ্কায় সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত ছিল তামিল টাইগাররা। এখন সেটা অতীত। এখন যুক্ত হলো ইসলামিক সন্ত্রাসবাদীরা। এটা শ্রীলঙ্কার সংস্কৃতির জন্য কোনো ভালো খবর নয়। তবে লক্ষণীয় শ্রীলঙ্কার এই জাতীয় সংকটে সরকারি দল, বিরোধী দল, জাতীয় গণমাধ্যম ও নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনী সবাই ন্যূনতম ইসু্যুতে একত্রিত হয়েছে। শ্রীলঙ্কার স্থিতিশীলতার জন্য এটা ভালো খবর। তবে এটা ভুলে গেলে চলবে না জঙ্গিবাদ এখনো একটি বৈশ্বিক সমস্যা। ইসলামিক স্টেটের উত্থান (২০১৪) ও পতনের মধ্য দিয়ে ইসলামিক জঙ্গিবাদের অবসান হয়েছে, এটা আমার মনে হয় না। বরং খোঁজ নিলে দেখা যাবে আইএস-এর সঙ্গে যেসব জঙ্গি সেখানে যুদ্ধ করেছিল এবং যারা বেঁচে গিয়েছিল, তারা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে এবং সেখানে স্থানীয় জঙ্গিদের সঙ্গে মিলে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড অব্যাহত রাখছে। ফিলিপাইনের মিন্দানাও প্রদেশে ইসলামিক জঙ্গিরা আশ্রয় নিয়েছে। ২০১৭ সালে আইএস জঙ্গিরা মারাভি নামে একটি শহর দখল করে নিয়েছিল। দীর্ঘ ৫ মাস মারাভি দখল করে সেখানে তারা ইসলামিক শাসন চালু করেছিল। পরে  অবশ্য মারাভি জঙ্গিমুক্ত হয়েছে। সাধারণত আইএস স্থানীয় জঙ্গিদের সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে তোলে। ফিলিপাইনের মিন্দানাওয়ে আবু  সায়াফ গ্রুপ, আনসার খলিফা ফিলিপাইনস, মাউটে গ্রুপÑ এদের সঙ্গে আইএস রাজনৈতিক সখ্য গড়ে তুলেছে। আর এরাই সেখানে জঙ্গিবাদী কার্যক্রম চালাচ্ছে। থাইল্যান্ডের দক্ষিণে তিনটি প্রদেশ ইয়ালা, নারাথিওয়াট ও পাটানিতে সন্ত্রাসবাদী কর্মকা- চলছে এবং এর পেছনে আইএস-এর ইন্ধন আছে। দুটি সংগঠনের কথা জানা যায় Barisan Revolusi Nasional Malayu Patani র সশস্ত্র শাখা Runda Kumpulan Kecil, Gerakan Mujahideen IslamPatani।  এরা আইএস-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। ইন্দোনেশিয়াতেও আইএস-এর সমর্থিত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো (লস্কর জিহাদ, জামিয়া ইসলামিয়া, ইসলামিক ডিফেনডার্স ফ্রন্ট) তৎপর। জা’মা আনসারুট দাওলাকে প্রো-আইএস বলে ধরে নেওয়া হয়। তুলনামূলক বিচারে মালয়েশিয়াতে ইসলামিক জঙ্গিদের তৎপরতা কম।
বিশ্বব্যাপী জঙ্গি তৎপরতা বাড়ছে। ৯/১১-এর ঘটনাবলির পর যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরু করেছিল। ১৭ বছর পর সেই যুদ্ধের শেষ হয়নি। পাঠকদের কিছু তথ্য দিই, যাতে বোঝা যাবে ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে এ যাবৎ কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। যুদ্ধের পেছনে এ যাবৎ খরচ হয়েছে ৪ দশমিক ৭৭ ট্রিলিয়ন ডলার। এই যুদ্ধে ১৪৫৫৫৯০ জন ইরাকি মারা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের মারা গেছে ৪৮০১ জন সেনা আর আন্তর্জাতিক ফোর্সের মৃত্যুর সংখ্যা ৩৪৩০ জন (Information Clearing House, April 20, 2019)। চিন্তা করা যায় যুদ্ধের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ঘণ্টায় খরচ হয় ১ মিলিয়ন ডলার। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-এর কারণেই পৃথিবীর মুসলমান প্রধান অঞ্চলগুলোতে জন্ম হয়েছে জঙ্গি সংগঠনগুলোর। আর আইএস এদের উৎসাহিত করছে জঙ্গিবাদ অব্যাহত রাখতে।
শ্রীলঙ্কার সন্ত্রাসী ঘটনা আমাদের চোখ খুলে দিল। শেষ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কা সরকার স্বীকার করেছে (National Towheeth Jam'ath_ NTJ )  এই সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালিয়েছে। তবে এর পেছনে রয়েছে আইএস। আমাদের দেশের জন্যও এটা একটা সতর্ক সংকেত। বাংলাদেশে ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠী আছে। তবে এদের তৎপরতা এখন নেই। অনেকটাই ধ্বংস হয়ে গেছে নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকান্ডের কারণে। তবে আমাদের আরও সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো দরকার। জঙ্গিরা ভিন্ন ভিন্ন সংগঠনের নামে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। সেদিকেও দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। সন্ত্রাসী দমনে আমাদের অভিজ্ঞতা ভালো। শ্রীলঙ্কা আমাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারে।
Daily Desh Rupantor
23.04.2019

সন্ত্রাসবাদ : ক্রাইস্টচার্চ থেকে কলম্বো

Image result for Terror in Colomboগত মার্চ গত মার্চমাসের মাঝামাঝি নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের রেশ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই গত রবিবার শ্রীলঙ্কায় সন্ত্রাসবাদী হামলায় মারা গেলেন ২৯০ জন, যাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বিদেশিও রয়েছেন। ক্রাইস্টচার্চে সন্ত্রাসবাদী হামলায় জড়িত ছিল একজন—ব্রেন্টন টারান্ট, যে উগ্র শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য ও প্রচণ্ড মুসলমান বিদ্বেষী মানসিকতায় বিশ্বাসী ছিল। ওই হামলায় মসজিদে নামাজ আদায়রত ৪৯ জন মুসলমান সাধারণ মানুষকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছিল ব্রেন্টন টারান্ট। এখন অবধি এটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি ক্রাইস্টচার্চের হামলার সঙ্গে আদৌ কোনো সংগঠন জড়িত ছিল কি না? কিন্তু কলম্বোসহ তিন স্থানে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডে নিহতদের সংখ্যা অনেক বেশি। এটা একক কোনো সন্ত্রাসীর কাজ নয়। একাধিক স্থানে প্রায় একই সময় সন্ত্রাসী হামলা প্রমাণ করে এটা অনেকটা পরিকল্পিত। এবং আইএসের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো শ্রীলঙ্কান সংগঠন এর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে, যদিও কোনো সংগঠনই এর দায়ভার এখন অবধি স্বীকার করেনি।
পাঠকদের স্মরণ থাকার কথা, ক্রাইস্টচার্চের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পর আইএস বা ইসলামিক স্টেট হুমকি দিয়েছিল ৪৯ জন মুসলমান নাগরিককে হত্যার তারা প্রতিশোধ নেবে। এখন কলম্বোর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পর এর সত্যতা খুঁজে পাওয়া গেল। সিরিয়া থেকে আইএসের উৎখাতের পর ধারণা করা হয়েছিল আইএস তার অস্তিত্ব হারিয়েছে। কিন্তু কলম্বোর ঘটনাবলিতে প্রমাণিত হলো সন্ত্রাসীরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারিত করেছে। সিরিয়া-ইরাক থেকে উৎখাতের পর আইএস যোদ্ধাদের একটা অংশ ফিলিপাইনের মিন্দানাওয়ে আশ্রয় নিয়েছে। আরেকটি অংশ চলে গেছে আফ্রিকায়, বিশেষ করে মালিতে। এখন দেখা যাচ্ছে শ্রীলঙ্কার মতো রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল একটি দেশকেও সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো বেছে নিয়েছে। এর পেছনে আইএসের সঙ্গে সম্পৃক্ত সংগঠনের জড়িত থাকার সম্ভাবনা বেশি। শ্রীলঙ্কায় গত প্রায় ১০ বছর তেমন কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নেই। একসময় তামিল টাইগাররা এসব আত্মঘাতী বোমা হামলা চালাত। তামিল টাইগাররা একসময় পৃথিবীর অন্যতম জঙ্গি সংগঠনে পরিণত হয়েছিল। যদিও তারা ধর্মকে কখনোই ব্যবহার করেনি। বরং স্বাধীন একটি তামিল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘ ২৬ বছর তারা ‘যুদ্ধ’ করেছে। কিন্তু ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কা সেনাবাহিনীর হাতে টাইগারদের শীর্ষ নেতা ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের মৃত্যুর পর টাইগারদের আন্দোলনেও ভাটা পড়ে। গত ১০ বছর তামিল টাইগারদের কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের খবর পাওয়া যায়নি। তবে সেখানে মুসলমানদের সঙ্গে উগ্র বৌদ্ধদের সংঘর্ষের খবর সাম্প্রতিককালে একাধিকবার সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় মুসলমান জনগোষ্ঠীর সংখ্যা মাত্র ১০ শতাংশ। সংখ্যাগরিষ্ঠ ৭১ শতাংশ মানুষ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তবে বৌদ্ধদের মধ্যে উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। একটি উগ্রপন্থী বৌদ্ধ সংগঠনের (বদু বালা সেনা) নাম পাওয়া যায়, যারা মুসলমানদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে আসছে। এরা কলম্বোতে বাংলাদেশ দূতাবাসেও একবার হামলা চালিয়েছিল। আইএস তাদের সহযোগী সংগঠনের মাধ্যমে এই শ্রীলঙ্কাকেই তাই বেছে নিয়েছে তাদের পরবর্তী টার্গেট হিসেবে।
আইএসের খেলাফতের পতন হয়েছে। সিরিয়ার রাকা ছিল তাদের অলিখিত রাজধানী। এত দিন তারা ইউরোপের বিভিন্ন শহরে, বিশেষ করে প্যারিস, লন্ডন ও ব্রাসেলসের মতো শহরে ‘লোন উলফ’ বা ‘একক সন্ত্রাসী হামলার’ মধ্য দিয়ে তাদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে আসছিল। খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও তারা ‘লোন উলফ’-এর মাধ্যমে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে। লক্ষ করলে দেখা যাবে মুসলমানপ্রধান দেশগুলোতে আইএসের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হয়েছে কম। যেখানে মুসলমানরা সংখ্যালঘু, সেখানে আইএস তাদের কর্মকাণ্ড সম্প্রসারিত করেছে। শ্রীলঙ্কায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এ আলোকেই রচিত। তবে শ্রীলঙ্কায় এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এখন অনেক প্রশ্নের জন্ম দেবে। এএফপি আমাদের জানাচ্ছে, ২০ এপ্রিলের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অন্তত ১০ দিন আগে শ্রীলঙ্কার পুলিশপ্রধান পুযুথ জয়াসুন্দরা শ্রীলঙ্কায় সম্ভাব্য একটি সন্ত্রাসী হামলার কথা জানিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছিলেন। ১১ এপ্রিল ওই চিঠিটি পাঠানো হয়েছিল বলে একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা প্রিয়লাল দেশনায়েকে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন (ডেইলি মিরর, ২২ এপ্রিল)।
সংবাদপত্রে এমন খবরও প্রকাশিত হয়েছে যে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা শ্রীলঙ্কার গোয়েন্দা সংস্থাকে সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলার তথ্য সরবরাহ করেছিল। অন্তত ৩০ মিনিট আগেই শ্রীলঙ্কার গোয়েন্দারা জানত, একটি সন্ত্রাসী হামলা হতে যাচ্ছে! সংগত কারণেই প্রশ্ন এসে যায় শ্রীলঙ্কার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ ব্যাপারে বিশেষ পদক্ষেপ নিল না কেন? এটা কি শুধুই শৈথিল্য? সন্ত্রাসী হামলাকে সিরিয়াসলি না নেওয়া? নাকি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে জঙ্গিদের ‘পেনেট্রেশন’ ঘটেছে? বিবিসিকে একজন শ্রীলঙ্কার মন্ত্রী এটা স্বীকার করেছেন যে চিঠি পাওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী অবহিত ছিলেন না। তবে চিঠি পাওয়ার বিষয়টি তিনি স্বীকার করেছেন। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদ যখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, যখন আইএস ক্রাইস্টচার্চের গণহত্যার বদলা নেওয়ার কথা বলছিল, তখন শ্রীলঙ্কার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন ছিল। তারা দায়িত্বে অবহেলা করেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে শ্রীলঙ্কার পুলিশ প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে। কাউন্টার টেররিজম ফোর্স গঠন করতে হবে। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা শ্রীলঙ্কা কাজে লাগাতে পারে। দ্বিতীয়ত, শ্রীলঙ্কায় ‘ন্যাশনাল তওহিদ জমিয়াত’ বা এনটিজে নামে একটি উগ্র ইসলামিক সংগঠনের খবর পাওয়া যায়। ধারণা করা হচ্ছে, এনটিজের সঙ্গে আইএসের যোগাযোগ আছে। এনটিজেকে বলা হয় আইএসের পূর্বসূরি। এদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের রেকর্ড আছে। গেল বছর এরা বেশ কিছু স্ট্যাচু ভেঙে আলোচনায় এসেছিল। এই হামলার সঙ্গে এনটিজের কতটুকু যোগসূত্র আছে, তা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব এখন শ্রীলঙ্কার নিরাপত্তা বাহিনীর। এরই মধ্যে শ্রীলঙ্কার পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ‘স্থানীয় সংগঠন’ জড়িত। যদিও সুনির্দিষ্ট কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের নাম বলা হয়নি। শ্রীলঙ্কার সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা গুনাসেকারা এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, স্থানীয় সংগঠনই এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। জাহরান হাশিম নামে একজন উগ্রবাদী সন্ত্রাসীর ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। বিদেশ থেকে তার ছবি ‘আপলোড’ করা হয়েছে। সুতরাং এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জাহরান হাশিমের সংশ্লিষ্টতা কী, তাঁর উদ্দেশ্য কী ছিল কিংবা তিনি কাদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন—এসব এখন খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
মুসলমানদের বলা হয় শ্রীলঙ্কার ‘ভূমিপুত্র’ অর্থাৎ আদি বাসিন্দা। অতীতে শ্রীলঙ্কায় মুসলমানদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের তেমন কোনো খবর পাওয়া যায়নি। কিন্তু ২০১৪ সালে সিরিয়া-ইরাকে আইএসের উত্থানের পরপরই সারা বিশ্বেই সন্ত্রাসবাদের ধারণা পাল্টে গেছে। বিশ্বে ‘ইসলামিক খেলাফত’ প্রতিষ্ঠার মতবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে তরুণ প্রজন্ম, যারা মুসলমান, তারা সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডে নিজেদের জড়িত করেছে। মুসলমানপ্রধান দেশগুলোতে এর প্রেক্ষাপটেই জন্ম হয়েছে স্থানীয় কিছু সন্ত্রাসী সংগঠন, যারা সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়েই ‘ইসলামিক আদর্শ’ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। শ্রীলঙ্কায় এনটিজের উত্থান এভাবেই। এখন তদন্তেই বেরিয়ে আসবে এরা কতটুকু জড়িত ছিল। তবে ওদের সঙ্গে আইএসের কোনো যোগসূত্র নেই, কিংবা আইএস এদের উৎসাহিত করেনি এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করতে, তা বলা যাবে না। আগামী দিনে যদি আইএসের পক্ষ থেকে এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে তাদের জড়িত থাকার কথা ঘোষণা করা হয়, আমি অবাক হব না।
দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের পর শ্রীলঙ্কায় যখন স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছিল, ঠিক তখনই এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শ্রীলঙ্কার জন্য কোনো ভালো খবর নয়। গৃহযুদ্ধের পর শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে সুবাতাস বইছে—৪২ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৭ বিলিয়নে। শ্রীলঙ্কায় ভ্রমণকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে পাঁচ গুণ। ২০০৯ সালে যে সংখ্যা ৫০ হাজারে, ২০১৮ সালে তা বেড়েছে দুই লাখ ৫০ হাজারে। দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কায়ই মাথাপিছু আয় সবচেয়ে বেশি। এ ঘটনায় শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিদেশি পর্যটকদের শ্রীলঙ্কায় আসা বন্ধ হয়ে যাবে, যাতে করে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদিও দুটি ইসলামিক সংগঠন (শ্রীলঙ্কার)—‘দি মুসলিম কাউন্সিল অব শ্রীলঙ্কা’ ও ‘আয় সিলোন জমিয়াতুল উলেমা’—এই সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের নিন্দা করেছে। যদিও শ্রীলঙ্কার শীর্ষস্থানীয় ক্রিশ্চিয়ান ধর্মীয় নেতা ‘শান্তি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি’ বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু সেখানে উগ্র বৌদ্ধ সংগঠন রয়েছে। তারা এটাকে ইস্যু করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি নষ্ট করতে পারে। এদিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
শ্রীলঙ্কার সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড শুধু শ্রীলঙ্কা তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জন্য একটি ‘ওয়েক আপ’ কলই নয়, বাংলাদেশের জন্যও একটি সতর্কবার্তা। অতীতে বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। তবে আমাদের ‘কাউন্টার টেররিজম ইউনিট’কে ধন্যবাদ দিতেই হয়। এই সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে—এটা বলা যাবে না, তবে অনেক ক্ষেত্রেই নির্মূল হয়েছে। ইসলামের নামে ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে কোনো কোনো ওয়াজ মাহফিলে, এমন অভিযোগ শোনা যায়। এ ক্ষেত্রে মনিটরিং বাড়ানো দরকার। তরুণ প্রজন্ম যাতে বিভ্রান্ত না হয়, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। সোশ্যাল মিডিয়ায় যাতে শ্রীলঙ্কার ঘটনাবলিকে ব্যবহার করে বিভ্রান্তি না ছড়ানো হয়, সে ব্যাপারে তৎপর হওয়া জরুরি।
বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদের মাত্রা কমেছে, এটা বলা যাবে না। গবেষকদের তথ্য মতে, গত চার মাসে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ২৬৪টি সন্ত্রাসবাদী ঘটনা ঘটেছে। এসব সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আল শাবাব (সোমালিয়া), তালেবান (আফগানিস্তান), ইসলামিক স্টেট (আফগানিস্তান), দোজো মিলিশিয়া (মালি), জইশ-ই-মোহাম্মদ (কাশ্মীর), তাহরিক-ই-তালেবান (পাকিস্তান), বোকো হারাম (নাইজেরিয়া), আল-কায়েদা (ইয়েমেন), বেলুচ রিপাবলিকান আর্মি (বেলুচিস্তান) জড়িত। তবে সবচেয়ে বেশি সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত আইএস ও তালেবান। এরা সবাই ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করছে তাদের সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডে। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হলো শ্রীলঙ্কার নাম। অতীতে শ্রীলঙ্কায় সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত ছিল তামিল টাইগাররা। এখন সেটা অতীত। এখন যুক্ত হলো ‘ইসলামিক’ সন্ত্রাসবাদীরা। এটা শ্রীলঙ্কার গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য কোনো ভালো খবর নয়
Daily Kalerkontho
23.04.2019

খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি ও বিএনপির ভবিষ্যৎ

Image result for Begum Zia cartoon



রাজনীতিতে এই মুহূর্তে অন্যতম আলোচিত বিষয় হচ্ছে খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির সম্ভাবনা। তবে খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তি নেবেন কি না সে বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয়। প্যারোলে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি সামনে আসে যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এক অনুষ্ঠানে ৬ এপ্রিল বললেন, প্যারোলের আবেদন হলে চিন্তা করবে সরকার। তবে তিনি এও জানিয়েছেন প্যারোলে মুক্তির জন্য সুনির্দিষ্ট কারণ থাকতে হবে। অনেকটা একই সুরে কথা বলেছেন তথ্যমন্ত্রী। পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন আয়োজিত যুব সম্মেলন ২০১৯-এ প্রধান অতিথির বক্তব্যে (৭ এপ্রিল) তিনি বললেন, আবেদন না করলে খালেদা জিয়ার প্যারোলের বিবেচনা হবে। এর অর্থ পরিষ্কার খালেদা জিয়া যদি প্যারোলে মুক্তি পেতে চান, তাহলে তাকে আবেদন করতে হবে। কিন্তু তিনি কি তা করবেন? জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার শাস্তি হয়েছে। একই সঙ্গে ধর্মীয় উসকানি ও মানহানির দুটি মামলা চলমান। আইনি প্রক্রিয়ায় তিনি মুক্তি পাবেন, সে সম্ভাবনা কম। খালেদা জিয়া অসুস্থ। অন্যের সাহায্য নিয়েই তাকে চলাফেরা করতে হয়। তিনি এখন বিএসএমএমইউতে চিকিৎসাধীন আছেন। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসার জন্য যদি তিনি আদেশ পেতে চান, তাহলে আইনের বিধান মতে তাকে আবেদন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আবেদন করলেই তিনি প্যারোলে মুক্তি পাবেন, তেমনটি নয়। এর সঙ্গেও একটি রাজনীতি আছে। অর্থাৎ তার মুক্তির বিষয়টির সঙ্গে রাজনীতির বিষয়টি জড়িত। তাহলে সেই রাজনীতিটি কী? বাজারে গুজব বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে যে ছয়জন নির্বাচিত হয়েছেন, তারা যদি সংসদে যোগ দেন। তাহলে খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি বিবেচনা করবে সরকার। সবকিছু মিলিয়ে তাই নানা প্রশ্ন জনমানসে। যদিও বিএনপির নেতারা মনে করছেন প্যারোলে নয়। জামিন তার প্রাপ্য। ৭ এপ্রিল বিএনপির নেতাকর্মীরা খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে গণঅনশন করেছেন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের শরিকরাও গণঅনশনে অংশ নিয়েছেন। গণঅনশনে ঐক্যফ্রন্টের নেতারা বলেছেন, খালেদা জিয়াকে তারা আন্দোলনের মাধ্যমে মুক্ত করে ছাড়বেন।
অনেকগুলো প্রশ্ন এখানে আছে। খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তি পাবেন কি না, তা নির্ভর করছে একান্তভাবেই তার ওপর। জিয়া পরিবার প্যারোলে মুক্তি চাচ্ছে, এখন কথাও হয়েছে। খালেদা জিয়ার বয়স হয়েছে। স্বাস্থ্য আর আগের মতো নেই। ছোট ছেলের মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা ও পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা এবং রাজনীতি, বিশেষ করে বিএনপির আন্দোলনে ব্যর্থতা খালেদা জিয়াকে আরও বেশি হতাশাগ্রস্ত করে ফেলেছে এটা অস্বীকার করা যাবে না। এটা বোধ করি, খালেদা জিয়া নিজেও উপলব্ধি করেন আইনি প্রক্রিয়ায় তিনি হয়তো আর জামিন পাবেন না। এ ক্ষেত্রে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বিদেশে চিকিৎসা নেওয়া তার জন্য মঙ্গল এই উপলব্ধিবোধ তার মাঝে আসতে পারে। তিনি বিদেশে বসে দলের নেতৃত্ব দেওয়া ও আন্দোলন সংগঠিত করাÑ এটাও তিনি চিন্তা করতে পারেন। আগে সুস্থতা নিশ্চিত করা, পরে রাজনীতি। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব আর আজকের খালেদা জিয়াÑ এর মাঝে রয়েছে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। তখন বয়স কম ছিল। দুটি বড় দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ যৌথ আন্দোলন করেছিল। আর আজ খালেদা জিয়া একা, সঙ্গে কোনো বড় দল নেই। উপরন্তু মাঝখানে চলে গেছে ২৯ বছর। বয়স বেড়েছে। হতাশা বেড়েছে। ব্যক্তি জীবনে বিপর্ষয় এসেছে বারবার। এটা ঠিক খালেদা জিয়া এখনও অবিসংবাদিত নেত্রী। এই মুহূর্তে শেখ হাসিনার বিকল্প খালেদা জিয়াই। কামাল হোসেন নন। বিএনপির একটি অংশ এবং ঐক্যফ্রন্টও চাইবে খালেদা জিয়া জেলে থাকুক। তাতে করে আন্দোলন করা সহজ। খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তিতে আন্দোলনে আর কোনো ‘ইস্যু’ থাকে না। তাই তো গণঅনশনে আমরা ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের বক্তব্য দেখেছি তারা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে চান। এটা যে শুধু একটি সেøাগান, তা আর কাউকে বলে দিতে হয় না। খালেদা জিয়া এক বছরের ওপরে জেলে আছেন। বিএনপি কিংবা ঐক্যফ্রন্ট আন্দোলন সংগঠিত করতে পারেনি। কর্মীরা আন্দোলনের পক্ষে থাকলেও, বিএনপির নেতাদের আন্দোলনে দেখা যায় না। তারা বয়োবৃদ্ধ, বয়সের ভারে ন্যুব্জ, আন্দোলনে তারা ব্যর্থ। তাই আন্দোলন নয়, বরং আইনি প্রক্রিয়াতেই খালেদা জিয়ার মুক্তির উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। তাতেও তারা সফল হযনি। এই যখন পরিস্থিতি তখন বিএনপির নির্বাচিত ছয়জন সংসদ সদস্য এখন কী করবেন? সুলতান মনসুর ও মোকাব্বির খান ইতোমধ্যে সংসদে যোগ দিয়েছেন। এখন বিএনপির নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা যদি সংসদে যোগ না দেন, তাহলে সংসদে সদস্যপদ হারানোর ঝুঁকিতে তারা থাকবেন। ৩০ এপ্রিলের মধ্যে তাদের সাংসদে যোগ দিতে হবেÑ না হলে তাদের সংসদ সদস্যপদ থাকবে না। তারা যদি যোগ না দেন (?), তাতে করেও আন্দোলনে কোনো গতি পাবে না। বরং সেখানে উপ-নির্বাচন হবে। সুলতান মনসুর সংসদে যোগ দেওয়ার পেছনে যে যুক্তি তুলে ধরেছিলেন, তাও বিবেচনায় নেওয়া যায়।
সুলতান মনসুর সংসদে যোগ দিতে পারবেন, কী পারবেন না, এই বিতর্কের আরও একটি দিক আছে। তিনি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। তার এলাকার জনগণ তাকে ভোট দিয়েছে। এখন কি তিনি তার এলাকার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন না? এটা একটা মৌলিক প্রশ্ন। এই প্রশ্নটিই তুলে দিলেন সুলতান মনসুর। তিনি সংসদ তার এলাকার জনগণের কথা বলতে চান। জনগণ তাকে ভোট দিয়ে সংসদে পাঠিয়েছেন। দলীয় শৃঙ্খলার কারণে সেই প্রতিনিধিত্বে বড় অন্তরায় সৃষ্টি হয়েছিল। ৭০ অনুচ্ছেদের এটাই বড় সমস্যা। অনেকেই ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের কথা বলেছেন। কিন্তু এই অনুচ্ছেদ যদি বাতিল হয়ে যায়, তাহলে তো সংসদ কেনা বেচার হাটে পরিণত হবে। টাকার বিনিময়ে সংসদ সদস্যরা বিক্রি হয়ে যেতে পারেন। দল ভাঙা ও নতুন দল গড়া একটি স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হবে। যাদের হাতে টাকা আছে, তারা সাংসদদের ক্রয় করে সরকার গঠনে উদ্যোগী হবেন। এর মধ্য দিয়ে অস্থিতিশীল সরকার গঠিত হতে পারে। গণতন্ত্রের জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। সুতরাং ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন না করাই শ্রেয়। তবে ৭০ অনুচ্ছেদকে আরও যুগোপযোগী করা যায়। যেমন ৭০ অনুচ্ছেদে দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথাটা অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। না হলে ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ থাকল।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৪৮ বছরে পা দিয়েছে চলতি মার্চ মাসে। একটি দেশের জন্য ৪৮ বছর একেবারে কম সময় নয়। এই ৪৮ বছরে অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। সামাজিক ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও আমরা ভারতের কাছ থেকেও এগিয়ে আছি। কিন্তু আমাদের একটা বড় বাস্তবায়ন হচ্ছেÑ রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। রাজনীতিতে যে আস্থার সম্পর্ক প্রয়োজন, সে ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি অনেক। এই আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না হলে গণতন্ত্রকে আমরা উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব না। একটি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে বটে। কিন্তু নির্বাচনটি ভালো হয়নি। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনটি হলেও, নির্বাচনটি ছিল ত্রæটিযুক্ত। নির্বাচন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ৮টি আসন পাওয়া অনেককেই অবাক করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ফ্রন্ট সংসদে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এখন দল তথা ফ্রন্টের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করেই সুলতান মনসুর সংসদে যোগ দিলেন। আর মোকাব্বির খানও তাকে অনুসরণ করলেন। মোকাব্বির কিংবা সুলতান মনসুরের ভাগ্য এখন কীভাবে লিখিত হবে? তারা কী সংসদ সদস্য হিসেবে সংসদে আগামী পাঁচ বছর থাকতে পারবেন? নানা প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা এখন জনমনে। জাতীয় সংসদের শেষের দিকে জাতীয় পার্টি থেকে সাতক্ষীরা-৪ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম রেজাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংসদে তার সদস্যপদ স্বতন্ত্র হিসেবে বজায় ছিল। অষ্টম সংসদের শেষের দিকে তৎকালীন বিএনপি থেকে রাজশাহী-৪ আসনের এমপি আবু হেনাকে বহিষ্কার করা হয়। আবু হেনার ক্ষেত্রেও তার সংসদ সদস্য পদ বহাল ছিল। সুলতান মনসুর ও মোকাব্বর খান এখন জানেন। আর জেনে শুনেই তারা সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন যতদূর জানি, সুলতান মনসুর নিজে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেননি। তিনি সংস্কারবাদী হিসেবে নির্বাচিত ছিলেন। সংস্কারবাদী অনেক নেতাকেই আওয়ামী লীগ ফিরিয়ে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সুলতান মনসুরকে যদি ফিরিয়ে নেয় আমি অবাক হব না।
সুলতান মনসুর নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন, এটা সত্য। কিন্তু সংসদে যোগ দিয়ে নৈতিকভাবে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চক্র বিএনপির ধানের শীষ মার্কা নিয়ে বিজয়ী হয়ে তিনি যদি এখন আবার তার নিজ দলে ফিরে যান, তাহলে রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য সেটা হবে দুঃখজনক ঘটনা। রাজনীতিবিদদের প্রতি মানুষের যে আস্থা থাকছে, এটা হবে তার একটা বড় দৃষ্টান্ত। মানুষ চায় রাজনীতিবিদরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। দল বদল, সীমিত সুযোগের জন্য দল ত্যাগ কিংবা আবারও দলে ফিরে আসা কোনো ভালো খবর নয়।
রাজনীতি এই মুহূর্তে কেন্দ্রীভ‚ত খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি নিয়ে। খালেদা জিয়া কী সিদ্ধান্ত নেবেন, আমরা তা জানি না। এর সঙ্গে কোনো শর্ত থাকুক, আমরা তা চাই না। খালেদা জিয়ার সুস্থতা আমাদের কাম্য। তিন তিনবার তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি জাতীয় নেতা। তার সুস্থতা একদিকে, রাজনীতি অন্যদিকে। রাজনীতি তো মানুষের জন্যই। একজন গৃহবধূ থেকে তিনি রাজনীতিতে অন্যতম শক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। বিএনপির তিনিই একমাত্র ভরসা। তার সুস্থতার জন্য যদি তাকে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বিদেশে যেতে (?) হয়। সেটাও তার নিজের জন্য ও দলের জন্যও মঙ্গল।
Daily Somoyer Alo
16.04.2019

মোদি ম্যাজিক কাজ করবে কি



তৃতীয় শক্তির উত্থান কতটা সম্ভব


ভারতের লোকসভা নির্বাচন সামনে রেখে যে প্রশ্নটি কোনো কোনো মহল থেকে এখন উচ্চারিত তা হচ্ছে, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কেন্দ্রে একটি তৃতীয় শক্তির সরকার গঠনের সম্ভাবনা কতটুকু? ভারতের রাজনীতি মূলত এখন দু'ধারায় বিভক্ত- কেন্দ্রে সরকার গঠিত হয়েছে এনডিএর নেতৃত্বাধীন একটি জোটের, যে জোটের মূল শক্তি হচ্ছে বিজেপি। অন্যদিকে ইউপিএ জোটের নেতৃত্বে রয়েছে অপর একটি জোট, যারা প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে কেন্দ্রে রয়েছে। ইউপিএ জোটের প্রধান শক্তি হচ্ছে কংগ্রেস। কিন্তু লোকসভায় আঞ্চলিক শক্তিগুলোর প্রতিনিধিত্ব অনেক বেশি। সমস্যা হচ্ছে, আঞ্চলিক দলগুলো তৃতীয় শক্তি জোট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারেনি। ২০১৪ সালের সর্বশেষ নির্বাচনে এনডিএ জোট পেয়েছিল ৩৩৬ আসন (মোট আসন ৫৪৩) আর ইউপিএ জোট পেয়েছিল মাত্র ৬০ আসন। এর বাইরে আঞ্চলিক দলগুলো পেয়েছিল ১৪৭ আসন। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন।

দুটি বিষয় এখানে উল্লেখ করার মতো- এক. বহুজন সমাজ পার্টির নেত্রী ও উত্তর প্রদেশের চার চারবারের মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী নিজে প্রধানমন্ত্রী হতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। যদিও মায়াবতী লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন না; দুই. তৃণমূল নেত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, কেন্দ্রে সরকার গঠন করতে হলে তৃণমূলের সমর্থনের প্রয়োজন হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মায়াবতী, অখিলেশ যাদব, কেজরিওয়াল, চন্দ্রবাবু নাইডুর মতো নেতৃত্ব জাতীয় পর্যায়ে আসতে না পারলেও স্থানীয় তথা আঞ্চলিক রাজনীতিতে তাদের দলের প্রভাব অনেক বেশি। কোনো কোনো দলের আবার জাতীয় দলের স্বীকৃতিও নেই। ফলে সুযোগটি নিচ্ছে বিজেপি ও কংগ্রেসের মতো দল।

সর্বভারতীয় রাজনীতিতে আঞ্চলিক দলগুলো যে কত শক্তিশালী, তা একটা পরিসংখ্যান দিলেই বোঝা যাবে। যেমন পশ্চিমবঙ্গ থেকে লোকসভায় তৃণমূলের আসন ৩৪ (মোট আসন ৪২), উড়িষ্যাতে ২১ আসনের ২০টিতে আছে বিজেডি, তামিলনাড়ূর ৩৯ আসনের মধ্যে ৩৭ আসন এডিএমকের, তেলেঙ্গানার ১৭ আসনের ১১ আসন স্থানীয় দল টিআরএসের।

এসব রাজ্যে কোথাও কোথাও বিজেপি স্থানীয় আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে ঐক্য করে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে চমক দেখিয়েছিল বিজেপি। কিন্তু এবার কি সেই চমক দেখাতে পারবে বিজেপি? উত্তরপ্রদেশে বিজেপির ভোট কাটতে মায়াবতী (বহুজন সমাজবাদী পার্টি), অখিলেশ যাদব (সমাজবাদী পার্টি), অজিত সিং (রাষ্ট্রীয় লোকদল) জোটবদ্ধ হয়েছে। এতে করে ভোটের প্যাটার্ন বদলে যেতে পারে। উত্তরপ্রদেশে এই জোট বেশি আসন পেতে পারে। সেই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল, বিহারে রাষ্ট্রীয় জনতা দল, কেরলে বামফ্রন্ট, উড়িষ্যায় বিজেডি, তামিলনাড়ূতে এডিএমকে এবং তেলেঙ্গানায় টিআরএস বড় আসনের ব্যবধানে বিজয়ী হতে পারে।

মজার ব্যাপার, মোট ৩৬টি রাজ্য তথা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে কংগ্রেসের উল্লেখযোগ্য আসন রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে ৪, আসামে ৩, কর্ণাটকে ৯, কেরলে ৮ এবং পাঞ্জাবে ৩। এই সীমিত সংখ্যক আসন নিয়ে কেন্দ্রে সরকার গঠন করা অকল্পনীয় ব্যাপার। আঞ্চলিক বড় দলগুলোর সঙ্গে কোনো ঐক্য করতে পারেনি কংগ্রেস। মায়াবতী ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বরাবরই কংগ্রেসের সমালোচনা করে আসছেন।

মোদিকে 'ঠেকাতে' কৌশলগত কারণে কংগ্রেস যদি মায়াবতী কিংবা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সমর্থন করে, তাহলে কেন্দ্রে একটি বিজেপিবিরোধী সরকার গঠন সম্ভব। কিন্তু এই সম্ভাবনা শুধু কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি নেই। নির্বাচনী প্রচারে রাহুল গান্ধী, মায়াবতী, অখিলেশ যাদব কিংবা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্যে এ ধরনের কোনো সম্ভাবনার কথা শোনা যায়নি। আর এতেই সুযোগ তৈরি হয়েছে নরেন্দ্র মোদির জন্য। বিরোধী দলগুলোর এক প্ল্যাটফর্মে না আসার ব্যর্থতায় নরেন্দ্র মোদির জন্য একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে দ্বিতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হওয়ার।

২০১৪ সালে 'মোদি ম্যাজিক' সর্বভারতব্যাপী একটি ক্রেজ তৈরি করেছিল। মোদির বক্তব্য, এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঝটিকা সফর, মাঠে মাঠে বক্তৃতা দেওয়া কিংবা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি তাকে অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত করেছিল। মোদি নিজেকে জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী, অটল বিহারি বাজপেয়ির মতো সর্বজনগ্রহণযোগ্য নেতৃত্বের পাশে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। এটা তার সাফল্য। নেহরু পরিবারের বাইরে তিনি নিজেকে অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত করেছেন। বাঘা বাঘা বিজেপি নেতাকে কৌশলে হটিয়ে তিনি দলে তার অবস্থান শক্তিশালী করেছেন। এমনকি তার কূটকৌশলের কারণে আদভানির মতো বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাও আজ রাজনীতি থেকে অনেকটা 'বিদায়' নিয়েছেন। আদভানি এবার লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেননি। চিন্তা করা যায়- লোকসভা নির্বাচনে ১৯৮৪ সালে বিজেপি যেখানে পেয়েছিল মাত্র দুটি আসন, ২০১৪ সালে এই আসন সংখ্যা ২৮২ (এনডিএ জোটের ৩৩৬)! এবার হয়তো আসন কিছুটা কমবে; কিন্তু এনডিএ জোটই সরকার গঠন করবে। জনমত জরিপ তাই বলছে।

একসময় কংগ্রেস ছিল সর্বভারতব্যাপী একক একটি শক্তি। দীর্ঘ ৪৪ বছর কংগ্রেস ভারত শাসন করেছে। সেই কংগ্রেস ২০১৪ সালে পেয়েছিল মাত্র ৪৪ আসন (মোট আসন ৫৪৩)। মূলত রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পরপরই কংগ্রেসে ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের অভাব পরিলক্ষিত হয়। দীর্ঘদিন সোনিয়া গান্ধী কংগ্রেসের নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। কিন্তু তিনি জন্মগতভাবে ভারতীয় ছিলেন না। ফলে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য তার পথ অতটা মসৃণ ছিল না। দীর্ঘদিন পর রাহুল গান্ধী কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব নিলেও তিনি 'আরেকজন রাজীব গান্ধী' হতে পারেননি। উপরন্তু ততদিনে ভারতীয় রাজনীতিও অনেক বদলে গেছে। কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে বিজেপি। বিজেপি তার হিন্দু জাতীয়তাবাদী আদর্শ সামনে রেখে সাধারণ ভারতীয়দের মধ্যে তার অবস্থান শক্তিশালী করতে পেরেছিল। ভারতের অনেক রাজ্যেই এখন বিজেপি ক্ষমতায় অথবা ক্ষমতার অংশীদার।

পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন রাজ্যে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন শেষে ২৩ মে ভোট গণনা শুরু হবে এবং ধারণা করছি, জুন মাসেই ভারত একটি নয়া সরকার পাবে। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি যে ইমেজ নিয়ে রাজনীতিতে এসেছিলেন, ৫ বছর ক্ষমতায় থাকার ফলে তার সেই ইমেজ এখন আর আগের মতো নেই। কর্মসংস্থানের যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন, তা তিনি পূরণ করতে পারেননি। বেকার সমস্যা সেখানে প্রবল। কর্মজীবী মানুষের মাঝে ৫০ শতাংশেরই কোনো সুনির্দিষ্ট কাজ নেই। মোদি নিজেকে জনগণের সেবক বা চৌকিদার হিসেবে পরিচয় দেন; কিন্তু রাফায়েল নির্মাণ ক্রয় দুর্নীতিতে তিনি জড়িয়ে গেছেন। সামান্য চা বিক্রেতা থেকে তার রাজনীতিতে আগমন ঘটেছিল। কিন্তু সেই চা বিক্রেতার গায়েই উঠেছিল ১০ লাখ রুপির সুট, যখন তিনি ওবামাকে নয়াদিল্লিতে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন। পুলওয়ামা হত্যাকাণ্ডের জন্যও তিনি অভিযুক্ত হয়েছেন। রামমন্দির ইস্যুকে পুনরায় সামনে এনে তিনি সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে উসকে দিয়েছেন। কৃষকদের আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব দিয়েও তা তিনি রক্ষা করতে পারেননি। অন্যদিকে রাহুল গান্ধীর 'ন্যায় প্রকল্প'ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় তিনি অতি গরিব পরিবারকে মাসে ছয় হাজার টাকা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যা নিয়ে বিজেপি প্রশ্ন তুলেছে। সব মিলিয়ে ব্যক্তিগত আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের মধ্য দিয়ে নির্বাচনী প্রচার চলছে। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ভারত একটি নয়া সরকার পাবে বটে; কিন্তু রাজনীতিতে খুব একটা পরিবর্তন আসবে বলে হয় না।
Daily Samakal
11.04.2019