রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

রাজনীতি, নির্বাচন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা


রাজনীতির মাঠে চলছে এখন নানা গুজব। গেল সোমবার বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম জিয়াকে কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। বেগম জিয়া অসুস্থ। কারও সাহায্য ছাড়া হাঁটতে পারেন না। বাজারে গুজব বেগম জিয়া প্যারোলে মুক্তি পাচ্ছেন! যদি তাই হয়, তাহলে জিয়া পরিবারের বাইরে বিএনপির ভবিষ্যৎ কী? বিএনপিকে নিয়ে মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য নানা কথা বলছেন। বিএনপি বিলীন হয়ে যাবে এমন কথাও উচ্চারিত হচ্ছে মন্ত্রীদের মুখ থেকে। এদিকে সুলতান মনসুরের পর ঐক্যজোটের অপর সংসদ সদস্য মোকাব্বির খানও সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন। তার এই যোগদান কি বিএনপির বাকি ৬ জন সংসদ সদস্যকে সংসদে যোগ দিতে উৎসাহিত করবে? এ নিয়েও রয়েছে নানা গুজব। এদিকে চতুর্থ ধাপে উপজেলা নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। চার ধাপে মোট ৪৪৫টি উপজেলার নির্বাচন সম্পন্ন হলো। ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের পর এই উপজেলা নির্বাচন কি আমাদের আশাবাদী করে? না, আমাদের আশাবাদী করে না।
বলাবাহুল্য, গেল ১০ মার্চ ৭৮টি উপজেলার ভোট প্রথম পর্যায়ে শেষ হয়েছিল। কেমন হলো চার ধাপের এই উপজেলা নির্বাচন? সংবাদপত্রের ভাষ্য থেকেই বোঝা যায়, এই নির্বাচনটিও ভালো হয়নি। জাতীয় নির্বাচনে সব দল অংশ নিলেও এই নির্বাচনে সব দল অংশ নেয়নি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। নির্বাচনের ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ তৈরি হয়নি। সংবাদপত্রের ভাষায় ‘পর্যাপ্ত আয়োজন, ছিল না তেমন ভোটার’ (প্রথম আলো)। জাতীয় সংসদের মতো উপজেলা নির্বাচনও ছিল সরকারি দলের জয়জয়কার। ঘোষিত ফলাফলে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছে ২৮৪টিতে। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীরা ১৩৫টিতে, জাতীয় পার্টি সমর্থক প্রার্থীরা ৩টি বিজয়ী হয়েছেন (যুগান্তর)। কিন্তু এই নির্বাচন কি সুষ্ঠু হয়েছে? সংবাদপত্রের ভাষা অবশ্য সে কথা বলে না! কোথাও কোথাও অতিরিক্ত ভোট পড়েছে (শাহজাদপুর)। রাতে ব্যালটে সিল মারা হয়েছে (সিরাজগঞ্জ)। প্রিসাইডিং অফিসার ও সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারকে গ্রেপ্তার করে জেল দেওয়া হয়েছে। ব্যালট ছিনতাই হওয়ার (৯২ আসনে) খবরও আছে। এর অর্থ এই নির্বাচনটিও ভালো হয়নি। নির্বাচনের অপর নাম প্রতিদ্বন্দ্বিতা। একজন অপরজনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, শঙ্কামুক্তভাবে নির্বাচন হবে। কিন্তু তা হয়নি। এই প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হয়েছে। সরকারি দলের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বেশি থাকলেও, নির্বাচনে রাতের বেলা সিল মারা, ব্যালট ছিনতাই, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা কোনো আশার কথা বলে না। এমনকি সোশ্যাল মিডিয়ায় যে ছবি প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা গেছে কোথাও কোথাও ভোটকেন্দ্রে কোনো ভোটার নেই, কোথাও ভোটকেন্দ্রে নিয়োজিত শক্তিরা সুবিধা নিচ্ছেন, কোথাও বা ভোটকেন্দ্রের বাইরে রোদ পোহাচ্ছেন এ সবই ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’, সব কেন্দ্রে হয়তো এমনটি ঘটেনি। কিন্তু ‘উৎসাহ ও উদ্দীপনার’ মধ্য দিয়ে যে নির্বাচনের কথা বলা হয়, উপজেলা নির্বাচনে তেমনটি ছিল না এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। তাহলে ভোটের ওপর কি মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলছে? এসব প্রশ্ন এখন উচ্চারিত হচ্ছে। একজন নির্বাচন কমিশনারও সেদিকে ইঙ্গিত করেছেন।
আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা বলে নির্বাচন মানেই একটা জমজমাট আসর। প্রচুর লোকজন ভোট কেন্দ্রের আশপাশে থাকে। ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয় উভয়পক্ষ থেকে। কিন্তু এবার তেমনটি ছিল না। বিএনপি ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু এই নির্বাচনটি ভালো হয়নি। একতরফাভাবে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ফলে এর একটা প্রভাব যে উপজেলায় থাকবেÑ এটা সবাই অনুমান করেছিলেন। বাস্তব ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী ভোট হয়েছে। কিন্তু কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না। আবার এরই মাঝে যখন রাতের বেলায় সিল মারার ঘটনা ঘটে কিংবা ব্যালট পেপার ছিনতাই হয়, এই ঘটনাকে আমরা যতই ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলি না কেন, বাস্তব ক্ষেত্রে আমাদের নির্বাচনী সংস্কৃতির জন্য এটা খারাপ খবর। নির্বাচনী রাজনীতির জন্য আরেকটি খাবাপ খবর হচ্ছে সুলতান মনসুরের পর মোকাব্বির খানও জাতীয় সংসদ অধিবেশনে যোগদানের ঘটনাটি। সুলতান মনসুর গণফোরামের সদস্য ও ধানের শীষের প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু গণফোরাম সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা সংসদে যাবে না। কিন্তু সুলতান মনসুর যোগ দিয়েছেন এরই মধ্যে। এর পেছনে যুক্তি যাই থাকুক না কেন, দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করার এই সিদ্ধান্ত আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য কোনো ভালো খবর নয়। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে এ ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দেওয়া আছে। যদিও ৭০ অনুচ্ছেদ অতীতেও কার্যকর হতে দেখা যায়নি। তবে সুলতান মনসুরের সংসদে যোগদান এ বিতর্ককে বাড়িয়েছে মাত্র।
তবে সুলতান মনসুর সংসদে যোগ দিতে পারবেন কি পারবেন না, এই বিতর্কের আরও একটি দিক আছে। তিনি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। তার এলাকার জনগণ তাকে ভোট দিয়েছে। এখন কি তিনি তার এলাকার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন না? এটা একটা মৌলিক প্রশ্ন। এই প্রশ্নটিই তুলেছিলেন সুলতান মনসুর। তিনি সংসদে তার এলাকার জনগণের কথা বলতে চান। জনগণ তাকে ভোট দিয়ে সংসদে পাঠিয়েছে। এখন দলীয় শৃঙ্খলার কারণে সেই প্রতিনিধিত্বে বড় অন্তরায় সৃষ্টি হয়েছে। ৭০ অনুচ্ছেদের এটাই বড় সমস্যা। অনেকেই ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের কথা বলেছেন। কিন্তু এই অনুচ্ছেদ যদি বাতিল হয়ে যায়, তাহলে তো সংসদ ‘কেনা-বেচার’ হাটে পরিণত হবে! টাকার বিনিময়ে সংসদ সদস্যরা ‘বিক্রি’ হয়ে যেতে পারেন। দল ভাঙা ও নতুন দল গড়া একটি স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হবে। যাদের হাতে টাকা আছে, তারা সাংসদদের ‘ক্রয়’ করে সরকার গঠনে উদ্যোগী হবেন! এর মধ্য দিয়ে অস্থিতিশীল সরকার গঠিত হতে পারে। গণতন্ত্রের জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। সুতরাং ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন না করাই শ্রেয়। তবে ৭০ অনুচ্ছেদকে আরও যুগোপযোগী করা যায়। যেমন ৭০ অনুচ্ছেদে ‘দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে’ কথাটা অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। না হলে ৭০ অনুচ্ছেদ দিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ থাকল।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৪৮ বছরে পা দিয়েছে এই মার্চ মাসে। একটি দেশের জন্য ৪৮ বছর একেবারে কম সময় নয়। এই ৪৮ বছরে অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। সামাজিক ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও আমরা ভারতের থেকেও এগিয়ে আছি। কিন্তু আমাদের একটা বড় অন্তরায় হচ্ছে রাজনীতির সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। রাজনীতিতে যে আস্থার সম্পর্ক প্রয়োজন, সে ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি অনেক। এই আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না হলে গণতন্ত্রকে আমরা উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব না। একটি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে বটে। কিন্তু নির্বাচনটি ভালো হয়নি। সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনটি হলেও, নির্বাচনটি ছিল ত্রুটিযুক্ত। নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ৮টি আসন পাওয়া অনেককেই অবাক করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ফ্রন্ট সংসদে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এখন দল তথা ফ্রন্টের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করেই সুলতান মনসুর সংসদে যোগ দিলেন। আর এখন যোগ দিলেন মোকাব্বির খান। মোকাব্বির কিংবা সুলতান মনসুরের ভাগ্য এখন কীভাবে লিখিত হবে? তারা কি সংসদ সদস্য হিসেবে সংসদে আগামী ৫ বছর থাকতে পারবেন? নানা প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা এখন জনমনে। নবম জাতীয় সংসদের শেষের দিকে জাতীয় পার্টি থেকে সাতক্ষীরা-৪ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম রেজাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংসদে তার সদস্যপদ স্বতন্ত্র হিসেবে বজায় ছিল। অষ্টম সংসদের শেষের দিকে তৎকালীন বিএনপি থেকে রাজশাহী-৪ আসনের এমপি আবু হেনাকে বহিষ্কার করা হয়। আবু হেনার ক্ষেত্রেও তার সংসদ সদস্যপদ বহাল ছিল। সুলতান মনসুর, মোকাব্বির খান এসব জানেন। আর জেনেশুনেই তারা সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন ও দেবেন। যতদূর জানি সুলতান মনসুর নিজে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেননি। তিনি সংস্কারবাদী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সংস্কারবাদী অনেক নেতাকেই আওয়ামী লীগ ফিরিয়ে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সুলতান মনসুরকে যদি ফিরিয়ে নেয় আমি অবাক হব না।
সুলতান মনসুর নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন, এটা সত্য। কিন্তু সংসদে যোগ দিয়ে নৈতিকভাবে তিনি ‘পরাজিত’ হয়েছেন। আওয়ামী লীগের ‘রাজনৈতিক শত্রু’ বিএনপির ধানের শীষ মার্কা নিয়ে বিজয়ী হয়ে তিনি যদি এখন আবার তার নিজ দলে ফিরে যান, তাহলে রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য সেটা হবে দুঃখজনক ঘটনা। রাজনীতিবিদদের প্রতি মানুষের যে আস্থা হারাচ্ছে, এটা হবে তার একটা বড় দৃষ্টান্ত। মানুষ চায় রাজনীতিবিদরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। দলবদল, সীমিত সুযোগের জন্য দল ত্যাগ কিংবা আবারও দলে ফিরে আসা কোনো ভালো খবর নয়।
নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। বিএনপির ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন নানা মহল থেকে কথা উচ্চারিত হচ্ছে, তখন উপজেলা নির্বাচন চলার সময়ে তিনি বলেছেন ‘ভোটে জনগণের যে অনীহা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাতে জাতি এক গভীর খাদের কিনারার দিকে অগ্রসরমান। আমরা গণতন্ত্রের শোকযাত্রায় শামিল হতে চাই না। রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিকদের ভেবে দেখা দরকার’ (যুগান্তর)। নির্বাচন কমিশনে থেকে একজন নির্বাচন কমিশনার যখন এ ধরনের কথাবার্তা বলেন, তখন তা আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘মেসেজ’ দেয়। আমরা নির্বাচন ব্যবস্থাকে পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিয়েছি! পাঠক, কম্বোডিয়ার পরিস্থিতির দিকে লক্ষ রাখতে পারেন। নির্বাচন ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা ফিরিয়ে আনতে হলে সরকারি দলের ওপর নির্বাচন কমিশনের কর্তৃত্ব বাড়ানো ও বড় দলগুলোর মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা দরকার। না হলে সরকার ক্ষমতায় থাকবে বটে; কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কৃতির কোনো উন্নতি হবে না। গণতন্ত্রের জন্য তা হবে দুঃখজনক ঘটনা।
Daily Desh Rupantor
07.04.2019

0 comments:

Post a Comment