রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফরে কী পেল বাংলাদেশ

ঢাকায় সুষমা স্বরাজ তার বক্তব্যে বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়াটাই দীর্ঘমেয়াদি সমাধান, যা বাংলাদেশের অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।’ তবে তিনি বলেছেন, ‘রোহিঙ্গারা ফেরত যাবে!’ ঢাকায় সুষমা স্বরাজ ভারতীয় হাইকমিশনের নতুন চ্যান্সেরি কমপ্লেক্সের উদ্বোধনকালে আরও একটি গরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘পড়শি পহলে, লেকিন বাংলাদেশ সবসে পহলে।’

সুষমা স্বরাজ ঢাকা এসেছিলেন। চলেও গেছেন। ২২ অক্টোবর তিনি যখন দুই দিনের সফরে ঢাকা আসেন, তখন তার ঢাকা সফর নিয়ে প্রত্যাশা কম ছিল না; কিন্তু সব প্রত্যাশা কি পূরণ হয়েছে? বাংলাদেশ যা চেয়েছিল, তা কি সুষমা স্বরাজের ওই সফরের মধ্য দিয়ে পূরণ হয়েছে? তার সফরের পর একটা হিসাব নেয়া যেতে পারে। আমার বিবেচনায় তার সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের দুইটি প্রত্যাশা ছিলÑ এক. বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসার ব্যাপারে তিনি আদৌ কোনো উদ্যোগ নেবেন কিনা; দুই. রোহিঙ্গাদের প্রশ্নে ভারত তার অবস্থান পরিবর্তন করবে কিনা। উভয় ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে, এটা আমি বলব না। তিনি খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেছেন এবং তাকে ১৫ মিনিটের বেশি সময় দিয়েছেন। এ খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ একটি নির্বাচনের কথা তিনি বলে গেছেন। এটা কূটনৈতিক ভাষা। ভারত কেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইইউও চায় আগামী নির্বাচনে সব দল অংশ নিক। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্র কি তা বলে? বিএনপি কি নির্বাচনে অংশ নেবে? বিএনপি একটি নির্বাচনকালীন সরকারের কথা বলে আসছে; কিন্তু সে ব্যাপারে কি আদৌ কোনো অগ্রগতি হয়েছে? এটা সত্য, সংবিধানে যে ধারণা দেয়া হয়েছে, তাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রেখেই নির্বাচন হওয়ার কথা। এক্ষেত্রে বিএনপিকে সে প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসা যাবে কীভাবে? উভয়পক্ষ যদি কিছু ছাড় না দেয়, তাহলে এ ‘জটিলতার’ অবসান হবে না।
রোহিঙ্গা সমস্যা ও এর সমাধান এ মুহূর্তে বাংলাদেশের এক নম্বর অগ্রাধিকার। রোহিঙ্গা প্রশ্নে ভারতের অবস্থান বাংলাদেশের পক্ষে নয়; বরং রোহিঙ্গা প্রশ্নে ভারতের অবস্থান মিয়ানমারের পক্ষে। এর কারণ কীÑ এটা নিয়ে এর আগে আমরা আলোচনা করেছি। এক্ষেত্রে সুষমা স্বরাজের বক্তব্য আমি উল্লেখ করতে চাই। ঢাকায় সুষমা স্বরাজ তার বক্তব্যে বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়াটাই দীর্ঘমেয়াদি সমাধান, যা বাংলাদেশের অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।’ তবে তিনি বলেছেন, ‘রোহিঙ্গারা ফেরত যাবে!’ ঢাকায় সুষমা স্বরাজ ভারতীয় হাইকমিশনের নতুন চ্যান্সেরি কমপ্লেক্সের উদ্বোধনকালে আরও একটি গরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘পড়শি পহলে, লেকিন বাংলাদেশ সবসে পহলে।’ (আনন্দবাজার, ২৩ অক্টোবর)। অর্থাৎ ‘পড়শি আগে, কিন্তু বাংলাদেশ সর্বাগ্রে’। মোদি যখন ঢাকায় এসেছিলেন, তখনও তার মুখ থেকে আমরা এ ধরনের কথা শুনেছিলাম। ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশ এ মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। মোদির ঢাকা সফরের সময় উপাঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা বিবিআইএন স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ফলে আজ যখন সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশে এসে বাংলাদেশের কথা প্রথমে গুরুত্ব দেয়ার কথা বলেন, আমি তাতে অবাক হই না। কিন্তু আমরা দেখতে চাই, ভারত এগুরুত্বের কথাটি বাস্তবে প্রমাণ করুক। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ভারত একটি ভূমিকা পালন করতে পারে। ভারত মিয়ানমার সরকারের ওপর ‘চাপ’ প্রয়োগ করতে পারে। মিয়ানমারে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করতে পারে। ভারত বড় আঞ্চলিক শক্তি। মিয়ানমার তাকে অবজ্ঞা করতে পারে না। ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশের স্বার্থ যেখানে সর্বাগ্রে (অন্তত সুষমা স্বরাজের কথা অনুযায়ী), সেখানে ভারত বাংলাদেশের স্বার্থে কতটুকু এগিয়ে আসবেÑ সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ২৩ অক্টোবর মিয়ানমার সফরে যান। এ সফরকে কি মিয়ানমার গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে যখন মিয়ানমারের উপস্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল অং সয়ি অভ্যর্থনা জানান, তখনই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়, মিয়ানমার এ সফরকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। গুরুত্বের সঙ্গে নিলে স্বয়ং সে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকতেন। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন মিয়ানমারে, তখন রাখাইনের সিটওয়ে শহরে কট্টরপন্থী বৌদ্ধরা বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত না নেয়ার জন্য বিক্ষোভ করেছে। মিয়ানমার টাইমস বিক্ষোভের ছবিও ছেপেছে। এর অর্থ আমার কাছে পরিষ্কার। মিয়ানমারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা সময়ক্ষেপণ ছাড়া আর কিছুই নয়। মিয়ানমার আদৌ রোহিঙ্গাদের নেবে বলে আমার মনে হয় না। সবচেয়ে বড় কথা, সেখানে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে কীভাবে? যে হারে বৌদ্ধভিক্ষুরা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে এবং তাদের ফেলে যাওয়া বাড়িঘর দখল করছে, সেখানে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা একটা প্রশ্নের মুখে থাকবে। কিছুদিন আগে মিয়ানমারের এক মন্ত্রী কিয়ন্ট মিন্ট শোয়ে এসেছিলেন। তার সফরে একটি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। মিয়ানমারের মন্ত্রী হাসিমুখে জানিয়েছিলেন, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়া হবে! এ আশ্বাস কি মিয়ানমারের গণহত্যাকারীদের আড়াল করা হলো? সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক উত্থাপিত ৫ দফা আলোচিত হয়নি। পররাষ্ট্র সচিব জানিয়েছিলেন, এ আলোচনা পাঁচ দফা সম্পর্কিত নয়। আমরা একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। প্রক্রিয়াটি শুরু হলো। পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন এ ধরনের কথা বলেন, তখন আমি তাতে অবাক না হয়ে পারি না। কেননা প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে উত্থাপিত তার পাঁচ দফায় বাংলাদেশের নীতিগত অবস্থান তুলে ধরেছেন। দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় এ পাঁচ দফা কেন উত্থাপিত হলো না, আমি বুঝতে অক্ষম। নিঃসন্দেহে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন মূল ইস্যু। কিন্তু ৫ দফার মাঝে সুস্পষ্ট রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান আছে। এ তথাকথিত ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনও সমস্যা সমাধান করতে পারবে না। আমরা মোটামুটিভাবে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ফল জানি। অতীতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা হয়েছে; কিন্তু ফল শূন্য। প্রায় ৪ থেকে ৫ লাখ রোহিঙ্গা আগে থেকেই কক্সবাজার এলাকায় শরণার্থী ক্যাম্পে ও এর আশপাশের এলাকায় বসবাস করে আসছিল। এখন এদের সঙ্গে যুক্ত হলো আরও ৫ লাখের উপরে। অর্থাৎ প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা এখন অবৈধভাবে বাংলাদেশে বসবাস করছে। আন্তর্জাতিক চাপের কারণে মিয়ানমারের মন্ত্রী এসে বলে গেলেন, তাদের নাগরিকদের তারা ফিরিয়ে নেবেন! এটা যে স্রেফ ভাঁওতাবাজি ও সময়ক্ষেপণ, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের নামে মিয়ানমার আমাদের স্রেফ ‘ব্লাফ’ দিল মাত্র! আমরা তাদের আশ্বাসকে যদি বিশ্বাস করি, ভুল করব। আমি দিব্যি দিয়ে বলতে পারি, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে না। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা মিয়ানমারের ওপর ‘চাপ’ সৃষ্টি করতে পারলাম না। ‘চাপ’ সৃষ্টি করার একটা কৌশল হচ্ছে মিয়ানমারে গণহত্যার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচার দাবি করা। এ গণহত্যার খবর আন্তর্জাতিক মিডিয়া বলছে; জাতিসংঘের শরণার্থীসংক্রান্ত কমিশনের প্রধান বলেছেন। সুতরাং বাংলাদেশ এ প্রশ্ন তুলতেই পারে এবং এর মাধ্যমে মিয়ানমারকে ‘চাপ’ এ রাখা সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশ এ পথটি এড়িয়ে গেল। এতে কি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে মিয়ানমার? আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দুইটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ অতিসম্প্রতি ছাপা হয়েছে, যা গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। প্রথম খবরটি এসেছে মালয়েশিয়া থেকে। মিয়ানমারে গণহত্যার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচারের জন্য সেখানে একটি গণআদালত গঠিত হয়েছিল। ২২ সেপ্টেম্বর পার্লামেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনাল (পিপিটি) নামে এ আন্তর্জাতিক গণআদালত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অং সান সু চি ও দেশটির সেনাপ্রধানকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। রোহিঙ্গা ও কাচিনদের ওপর চালানো গণহত্যা এবং নিষ্ঠুর নিপীড়নের তদন্তে যুক্ত বিশিষ্টজন ও খ্যাতনামা আইনজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত সদস্যদের বিচারক প্যানেল এ রায় দেন। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ মাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোসাইড স্টাডিজ অ্যান্ড প্রিভেনশনের গবেষক অধ্যাপক গ্রেগরি স্ট্যানটনও জবানবন্দি দেন। আদালত ওই রায়ের আলোকে ১৭টি সুপারিশ করেন, যা জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে পাঠানো হবে। দ্বিতীয় খবরটি এসেছে জাতিসংঘ থেকে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সর্বসম্মতিক্রমে ইরাকে একটি তথ্যানুসন্ধান টিম পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ টিমের উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলামিক এস্টেটের (আইএস) জঙ্গিরা সেখানে কী ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, সে ব্যাপারে তথ্য অনুসন্ধান করা ও ইরাক সরকারকে সাহায্য করা। ব্রিটেন এ প্রস্তাবটি উত্থাপন করে এবং ১০ লাখ পাউন্ড (১৩ লাখ ৩৫ হজার ডলার) প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়। যারা আইএস কর্তৃক নির্যাতিত হয়েছে, তাদের কিছুটা ‘শান্তি’ দেয়ার জন্যই এ অর্থ দেয়া হবে। এখানে বলে রাখা ভালো, ২০১৪ সালে আইএসের জঙ্গিরা ইরাকের উত্তরাঞ্চলে সিনজির পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের ওপর বড় ধরনের জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে। যাকে পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘ ‘গণহত্যা’ হিসেবে অভিহিত করেছিল। ওই সময় শত শত তরুণী ইয়াজিদি মেয়েকে ধরে এনে তাদের যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তাদের করুণ কাহিনী ওই সময় সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। এখন নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের ওপর যে নির্যাতন ও গণহত্যা হয়েছে, তা তদন্তে একটি তথ্যানুসন্ধান টিম গঠন করা হবে।
উপরে উল্লিখিত দুইটি সংবাদ বিচ্ছিন্ন হলেও একটা মিল আছে। আর তা হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধের বিচার ও দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা। এটা সত্য, মালয়েশিয়ার পিপিটির কোনো আইনগত বৈধতা নেই। এটা সিম্বলিক অর্থাৎ প্রতীকী আদালত; কিন্তু এর একটি প্রতিক্রিয়া আছে। এ ধরনের ঘটনায় একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠনে সহায়তা করে থাকে। রোম স্ট্যাটিটিউটে (১৯৯৮, কার্যকর ২০০২) এ ধরনের আদালত গঠন করার কথা বলা হয়েছে। ইরাকে এ ধরনের আদালত আগামীতে গঠিত হবে এবং আমার ধারণা, আমরা যদি মিয়ানমারের গণহত্যার ঘটনা সত্যিকারভাবে আন্তর্জাতিক আসরে তুলে ধরতে পারি, তাহলে মিয়ানমারের ব্যাপারে একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠন করা সম্ভব।
জসুয়া কুরলানটসিক (Joshua Kurlantyick) ১ অক্টোবর  the National-এ একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। প্রবন্ধটির শিরোনাম Aung san suu ïi is the bad Gyuing the Rohingga crisis, But what about the man directly responsible for massacres? শিরোনাম থেকেই বোঝা যায়, কী বলতে চাচ্ছেন তিনি। যে কথাটা আমরা বারবার বলে আসছি, সে কথাটাই বলেছেন তিনি; অর্থাৎ গণহত্যা ও উচ্ছেদ অভিযানের দায় সু চি এড়াতে পারেন না। তবে তিনি বেশি দায়ী করেছেন সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল অং হ্লাইংকে। তার মন্তব্য অনেকটা এরকম It needs to give the ¸anmar generals a serious warning. Doing so might lead the military to holt its attraction, but more importantly, it would suggest that army leaders can not continue a scorched earth policy and let Ms Suu Kyi take all the public criticism. পশ্চিমাদের উচিত জেনারেল অং হ্লাইংকে একটা কড়া মেসেজ দেয়া। ব্যবসায়িক ও করপোরেট স্বার্থ এখানে এত বেশি যে, পশ্চিমা বিশ্ব এ জেনারেলকে এখনও সমীহ করে চলছেন। জেনারেল হ্লাইং ভারত সফরেও এসেছিলেন। তখন তিনি মোদির পাশাপাশি ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাপ্রধান অজিত দোভালের সঙ্গেও দেখা করেছিলেন। সুতরাং জেনারেল হ্লাইংয়ের ওপর যদি ‘চাপ’ প্রয়োগ করা না যায়, তাহলে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান আদৌ হবে না। এখন ভারতের জাতীয় স্বার্থের আলোকে ভারত কি আদৌ জেনারেল হ্লাইংয়ের ওপর কোনো চাপ প্রয়োগ করবে? সু চি এখানে গৌণ। জেনারেল হ্লাইংয়ের ওপর এখন সবকিছু নির্ভর করছে। সুষমা স্বরাজ এসে গেছেন। বলেছেন, বাংলাদেশের স্বার্থ তিনি আগে দেখবেন। এসব কথার কথা। বাংলাদেশের স্বার্থ যদি তিনি আগে দেখেন (?), তাহলে তিনি এখন মিয়ানমার যাবেন। কিন্তু তার আগামী সফরসূচিতে মিয়ানমার নেই। তাই মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান বাংলাদেশকেই করতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার আন্তর্জাতিকীকরণ করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

ইউরোপীয় ঐক্যের জন্য আরও দুঃসংবাদ

ইউরোপ থেকে সর্বশেষ যে খবরটি এসেছে, তা ইউরোপীয় ঐক্যের জন্য সত্যিই একটি দুঃসংবাদ। দক্ষিণপন্থী যে উত্থান সারা ইউরোপে ঘটছে, তাতে সর্বশেষ যোগ হল চেক রিপাবলিকের নাম। ২০ ও ২১ অক্টোবর সেখানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আর তাতে বিজয়ী হয়েছে দক্ষিণপন্থী এএনও পার্টি। এর নেতা আন্দ্রেই বাবিস, যাকে বলা হয় চেক রিপাবলিকের ডোনাল্ড ট্রাম্প, তিনি হতে যাচ্ছেন দেশটির পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। বাবিস চেক রিপাবলিকের একজন ধনী ব্যক্তি। প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের সম্পদের তিনি মালিক। অতীতে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও তিনিই এখন হতে যাচ্ছেন দেশটির পরবর্তী সরকারপ্রধান। নির্বাচনে তার দল পেয়েছে শতকরা ২৯ দশমিক ৬ ভাগ ভোট। ২০০ আসনবিশিষ্ট পার্লামেন্টে তার দলের আসন এখন ৭৮। দ্বিতীয় অবস্থান সিভিক ডেমোক্রেটিক পার্টির (১১ দশমিক ৩ ভাগ ভোট, ২৫ আসন)। আর তৃতীয় অবস্থানে আছে চেক পিরেট পার্টি (১০ দশমিক ৮ ভাগ ভোট)। বাবিসকে এখন এদের সঙ্গে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হবে। তবে শঙ্কার কারণটা হচ্ছে, এই তিনটি দলই অভিবাসন ও ইসলামবিরোধী। একইসঙ্গে বাবিস ইউরো জোন থেকে বেরিয়ে যাওয়ারও হুমকি দিয়েছেন। বাবিস তার ভাষায় দুর্নীতিগ্রস্ত ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ারও হুমকি দিয়েছেন। দক্ষিণপন্থী এই দলগুলো চেক রিপাবলিকে ইসলাম ধর্ম নিষিদ্ধ করার, কাবাবের দোকান বন্ধ করার, এমনকি মসজিদগুলোর সামনে শূকর চড়ানোর হুমকিও দিয়েছে!

চেক রিপাবলিকের এই নির্বাচনী ফলাফল অনেক শঙ্কার জন্ম দিয়েছে। এক. এর ফলে ইউরোপে দক্ষিণপন্থী শক্তি আরও শক্তিশালী হল- ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও সর্বশেষ চেক রিপাবলিক। এ দলগুলোর কেউ ক্ষমতায়, কেউ শক্তিশালী বিরোধী দলে। এরা সবাই মিলে ইউরোপে অভিবাসনবিরোধী তথা ইসলামবিরোধী একটি অবস্থান নিতে পারে।
দুই. বাবিসের রাজনৈতিক অবস্থানের সঙ্গে পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরির নেতাদের রাজনৈতিক অবস্থানের মিল আছে। এরা আগামীতে ইইউবিরোধী একটা অবস্থান নিতে পারে। পূর্ব ইউরোপ যদি আবারও আগের অবস্থানে যায়, আমি অবাক হব না। আমি গত প্রায় তিন সপ্তাহ ইউরোপে থেকে দেখেছি কীভাবে বদলে যাচ্ছে ইউরোপ। স্পেনের কাতালোনিয়ার ঘটনা যেমন ইউরোপের অন্যত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে উসকে দিতে পারে, ঠিক তেমনি লি পেন (ফ্রান্স), কুর্জ (অস্ট্রিয়া) ও বাবিসের (চেক) মতো চরম দক্ষিণপন্থী নেতাদের উত্থান ইউরোপে চরম জাতিগত বিদ্বেষ জন্ম দিতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনাও আমি অস্বীকার করতে পারি না। এদিকে কাতালোনিয়া নিয়ে পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী হুমকি দিয়েছেন তিনি কাতালোনিয়ার স্বায়ত্তশাসন বাতিল করে সেখানে কেন্দ্রীয় শাসন চালু করবেন। কিন্তু স্বাধীনতাকামীরা অনড় অবস্থানে আছে। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, অন্যত্র এই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়তে পারে। এতে করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের জন্ম হবে, যা ইউরোপের ঐক্যকে দুর্বল করবে। এমনিতেই এখন একটি উগ্র দক্ষিণপন্থী রাজনীতির স্রোত ইউরোপের সর্বত্র বইছে ব্যাপক অভিবাসী আগমনকে কেন্দ্র করে। আমি সপ্তাহখানেক আগে ফ্রান্সে ছিলাম। সেখানে দেখেছি, উগ্র দক্ষিণপন্থী দল ন্যাশনাল ফ্রন্টের প্রভাব বাড়ছে। একই ঘটনা জার্মানিতেও, সেখানে প্রথমবারের মতো পার্লামেন্টে গেছে উগ্র দক্ষিণপন্থী দল অলটারনেট ফর জার্মানি (এএফডি) পার্টি। সম্প্রতি অস্ট্রিয়ার নির্বাচনে ভোটাররা উগ্র দক্ষিণপন্থীদের বিজয়ী করেছে। এর বাইরে হল্যান্ড, হাঙ্গেরি, চেক রিপাবলিক, স্লোভাকিয়াসহ প্রায় প্রতিটি দেশে উগ্র দক্ষিণপন্থীদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বাড়ছে। কোথাও কোথাও এরা ক্ষমতায়, কোথাওবা দ্বিতীয় অবস্থানে।

এ পরিস্থিতিতে কাতালোনিয়ার গণভোট পুরো দৃশ্যপটকে বদলে দিয়েছিল। এ মুহূর্তে এটা স্পষ্ট নয়, কাতালোনিয়ার সংকটের সমাধান হবে কীভাবে। একটা মীমাংসা না হলে তা ইউরোপের সর্বত্র ছড়িয়ে যাবে। মীমাংসাটা হতে হবে স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার আর কাতালোনিয়ার স্বাধীনতাকামীদের মধ্যে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ইইউ এ ব্যাপারে কোনো মধ্যস্থতা করবে না। তাই সারা ইউরোপের দৃষ্টি এখন কাতালোনিয়ার দিকে। এখানে বলা ভালো, ইউরোপে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের খবর নতুন নয়। অনেক ইউরোপীয় দেশে এ ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের খবর আমরা জানি। জার্মানির কথা যদি বলি, তাহলে বেভেরিয়া রাজ্যের কথা আমাকে বলতেই হবে। বেভেরিয়া জার্মানির অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে কিছুটা আলাদা। অর্থনৈতিকভাবে অনেক সমৃদ্ধ এ রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তাধারা আছে। এখানকার মূল দল সিএসইউ হচ্ছে ক্ষমতাসীন সিডিইউ
র স্থানীয় সংগঠন। সিডিইউ এখানে আলাদাভাবে কোনো প্রার্থী দেয় না। সিডিইউর হয়ে কাজ করে সিএসইউ। সম্প্রতি দলটি চ্যান্সেলর মার্কেলকে বাধ্য করেছে অভিবাসীদের কোটা সীমিত করে দিতে। জার্মান রাজনীতিতে বেভেরিয়ার ভূমিকা অনেকটা যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে স্কটল্যান্ডের ভূমিকার মতো। ২০১৪ সালে স্কটল্যান্ডে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে থাকা, না থাকা নিয়ে একটি গণভোট হয়েছিল। তাতে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে থাকার পক্ষেই রায় পড়েছিল। এখন স্কটিকা ন্যাশনাল পার্টিপ্রধান নিকোলা স্টুরজিওন চাচ্ছেন আরেকটি গণভোট, যার মাধ্যমে স্কটল্যান্ডের মানুষ আরেকবার ভোট দিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন তারা স্বাধীন হবেন, নাকি ব্রিটেনের সঙ্গেই থেকে যাবেন। এটা তো স্পষ্ট- স্কটল্যান্ড ইইউতে ব্রিটেনের জায়গাটি নিতে চায়। আর এজন্যই দরকার স্বাধীনতা।
বেলজিয়াম মূলত জাতিগতভাবে দুভাগে বিভক্ত হয়ে আছে- ওয়ালুন্স (Walloons) ও ফ্লেমিস (Flemish)। ওয়ালুন্সরা ফরাসি ভাষাভাষী। আর ফ্লেমিসদের নিজস্ব ভাষা আছে। তাদের মাঝে স্বাধীনতার চেতনাও আছে। কাতালোনিয়া যদি স্বাধীন হয়ে যায়, তাহলে ফ্লেমিসদের স্বাধীনতা আন্দোলন আরও শক্তিশালী হবে। ডেনমার্ক থেকে ৮০০ মাইল দূরে অবস্থিত ফারো (Faroe) দ্বীপপুঞ্জেও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন আছে। দ্বীপটি ডেনমার্কের অধীনে হলেও অতি সম্প্রতি তারা স্বশাসনের কথা ঘোষণা করেছে। ইতালির দুটো অঞ্চল লমবারদি ও ভেনেতোতে চলতি মাসের শেষে বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে গণভোট হবে। ২০১৪ সালের মার্চের এক গণভোটে ৮৯ ভাগ ভেনেতোর মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে রায় দিয়েছিল। সেখানে অনেকটা কাতালোনিয়ার মতো পরিস্থিতি বিরাজ করছে। স্বাধীনতার পক্ষে জনমত সেখানে শক্তিশালী। বাস্ক (Basque) অঞ্চলের খবর নিশ্চয় অনেকেই জানেন। স্পেনের অন্তর্ভুক্ত বাস্ক মূলত স্বায়ত্তশাসিত একটি অঞ্চল। এর কিছু অংশ আবার ফ্রান্সের অন্তর্ভুক্ত। স্বাধীনতাকামী ইটিএ দীর্ঘদিন ধরে বাস্ক অঞ্চলের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করে আসছে। সাম্প্রতিক সময় স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার বাস্ক অঞ্চলের জন্য যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। তারপরও স্বাধীনতাকামীরা সক্রিয়। তারা মাঝেমধ্যেই বোমা হামলা চালিয়ে তাদের অস্তিত্ব জানান দেয়।

ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শক্তিশালী হয়েছে নানা কারণে। কেন্দ্রীয় সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণ, অনুন্নয়ন, নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা ইত্যাদি কারণে বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তাধারা শক্তিশালী হয়েছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে, উগ্র দক্ষিণপন্থী কিছু দল এই বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তাধারাকে উসকে দিয়েছে। যেমন বলা যেতে পারে অলটারনেটিভ ফর ডয়েট্সল্যান্ড (জার্মানি), জবিক বা মুভমেন্ট ফর বেটার হাঙ্গেরি, ফ্রন্ট ন্যাশনাল (ফ্রান্স), গোল্ডেন ডন (গ্রিস), ফ্রাইহাইটলিসে পার্টাই ওস্টারির্স (অস্ট্রিয়া), দি ফিন্স (ফিনল্যান্ড), সুইডেন ডেমোক্রেটস (সুইডেন), ডেনিস পিপলস পার্টি (ডেনমার্ক), পার্টাই ভুর দি ভ্রিজহেইড (হল্যান্ড), লিগানর্ড (ইতালি) ইত্যাদি রাজনৈতিক দলের কথা। এসব রাজনৈতিক দল উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে প্রমোট করছে। কোথাও কোথাও তারা পার্লামেন্টেও আছে। একটা পরিসংখ্যান দিই। সম্প্রতি জার্মানিতে যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাতে এএফডি পেয়েছে শতকরা ১২ ভাগ ভোট। দলটি এখন জার্মানির তৃতীয় শক্তি। সাবেক পূর্ব জার্মানিতে এ দলটি শক্ত অবস্থানে রয়েছে। প্রচণ্ড ইসলাম তথা অভিবাসনবিরোধী দলটি যদি ভবিষ্যতে পূর্ব জার্মানিতে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু করে, আমি অবাক হব না। হাঙ্গেরিতেও ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে জবিক তৃতীয় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। ফ্রান্সে উগ্র দক্ষিণপন্থী ন্যাশনাল ফ্রন্টের নেতা মারিয়ান লি পেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রথম রাউন্ডে শতকরা ২৬ ভাগ ভোট পেয়েছিলেন। দ্বিতীয় রাউন্ডে তিনি ম্যাক্রোর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান। ফ্রান্সের ১৩টি অঞ্চলের মাঝে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে (২০১৫) ন্যাশনাল ফ্রন্ট অন্তত ৬টি অঞ্চলে প্রথম অবস্থানে আছে। গ্রিসে ২০১৫ সালের নির্বাচনে গোল্ডেন ডন পার্টি শতকরা ৭ ভাগ ভোট পেয়েছিল। অস্ট্রিয়ার গত সপ্তাহের সংসদ নির্বাচনে দুটি উগ্রপন্থী দলের প্রাপ্ত ভোটের হার যথাক্রমে শতকরা ২৪ ভাগ (পিপলস পার্টি) ও শতকরা ২০.৫ ভাগ (ফ্রিডম পার্টি)। ফিনল্যান্ডে দি ফিনস পার্টির অবস্থান দ্বিতীয়। ২০১৫ সালে তারা সরকারে যোগ দেয়। ২০১১ সালে তারা সংসদ নির্বাচনে ৩৯ ভাগ ভোট পেয়ে সবাইকে অবাক করেছিল। সুইডেনে সুইডেন ডেমোক্রেট পার্টি ১২ দশমিক ৯ ভাগ ভোট পেয়ে দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম পার্টি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সর্বশেষ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন সোশ্যাল ডেমোক্রেট পার্টি পেয়েছিল ২১ দশমিক ৫ ভাগ ভোট। ডেনমার্কে ডেনিস পিপলস পার্টি শতকরা ২১ ভাগ ভোট পেয়ে (২০১১ সালে ১২ ভাগ ভোট) দেশটির দ্বিতীয় বড় দল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। হল্যান্ডে পার্টাই ভুর দি ভ্রিজহেইড এখন ক্ষমতার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী। দলটির নেতা গার্ট উইলডার্স নানা কারণে বিতর্কিত। বলা হয়, তিনিই মূলত
ট্রাম্পইজমের জনক। প্রচণ্ড ইসলামবিরোধী বক্তব্যের জন্য তিনি বারবার সমালোচিত হয়েছেন। ইতালির নব্য নাৎসি হিসেবে পরিচিত লিগানর্ড (Liganord) পার্টি প্রায় ১৩ ভাগ ভোটারের প্রতিনিধিত্ব করে এবং আগামীতে ক্ষমতার অন্যতম অংশীদার হবে বলে অনেকে মনে করে। এ ধরনের পরিসংখ্যান আরও দেয়া যায়, যাতে দেখা যাবে উগপ্রন্থীদের উত্থান ঘটেছে ইউরোপে। আগামীতে এই উগ্রপন্থীরা কোনো কোনো অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সূচনা করতে পারে।

এই যখন পরিস্থিতি, তখন এ তালিকায় যোগ হল চেক রিপাবলিকের নাম। চেক নেতা আন্দ্রেই বাবিস নতুন এক রাজনীতির সূচনা করতে পারেন, যেখানে পূর্ব ইউরোপের ইইউভুক্ত দেশগুলো একত্রিত হতে পারে। অন্তত ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে তারা একটি আলাদা অবস্থান নিতে পারে, যা কিনা ইইউর ভাঙনকে ত্বরান্বিত করবে মাত্র।

জঙ্গি তৎপরতা কি দক্ষিণ এশিয়ায় সম্প্রসারিত হচ্ছে

সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী যে নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়েছে তার একটি হচ্ছে এ অঞ্চলকে ঘিরে জঙ্গি নেটওয়ার্ক বিস্তার। সিরিয়া-ইরাকে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) কার্যক্রম সীমিত হয়ে আসছে। আইএস নিয়ন্ত্রিত অনেক শহর এখন সিরিয়া তথা ইরাকের বাহিনীর দখলে। বলা হচ্ছে, ওই সব এলাকায় যেসব জিহাদি ছিল, তারা এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, বিশেষ করে ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া কিংবা মালয়েশিয়ায় পালিয়ে গেছে। এর একটা অংশ রাখাইনে আসতে পারে বলেও আশঙ্কা করেছে অনেকে। অস্ট্রেলিয়ার Lowy Institute-এর দুজন গবেষক খালিদ কোসার ও লাইলা সুমিকি-লোগানের একটি গবেষণা প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে গত ৫ অক্টোবর (Defusing the ticking time-bomb in Coxs Bazar)। রোহিঙ্গা পরিস্থিতিকে টাইম বোম্ব-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন তাঁরা। এখানে উগ্রবাদ বিস্তার করতে পারে এমন আশঙ্কাও দেখছেন তাঁরা। যাঁরা বিশ্বব্যাপী জঙ্গি কার্যক্রম নিয়ে কাজ করেন তাঁরা লক্ষ করেছেন যে সিরিয়া-ইরাকে আইএসের কার্যক্রম সীমিত হয়ে আসছে। আইএস রাকায় পরাজিত হয়েছে এরই মধ্যে। তবে এখানে যেসব জঙ্গি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, তারা এখন সেখান থেকে সটকে পড়েছে। ভবিষ্যতে জঙ্গি কার্যক্রম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিস্তৃত হবে বলে অনেকে মন্তব্য করেছে। এ ক্ষেত্রে দুটি দেশের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছে অনেকে। একটি ফিলিপাইনে, অন্যটি মিয়ানমার-বাংলাদেশে রোহিঙ্গা নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে। দ্য ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিনে অক্টোবর (২০১৭) সংখ্যায় অধ্যাপক জাকারি আবুজার (Zachary Abuza) একটি প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে ফিলিপাইনে জঙ্গিবাদের প্রসার নিয়ে। অধ্যাপক আবুজা যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত National war college-এর একজন অধ্যাপক। তাঁর প্রবন্ধের নাম Mayhem in Marawi। ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চলের একটি শহর মারাভি (Marawi)। 

সেখানে গত মে (২০১৭) থেকে ফিলিপাইনের সেনাবাহিনী আইএস সংশ্লিষ্ট আবু সায়াফ গ্রুপের সঙ্গে যে যুদ্ধে লিপ্ত, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি। গত চার মাসে সেখানে জঙ্গিদের সঙ্গে যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে ১৪৭ জন সেনাবাহিনীর সদস্য এবং ৪৭ জন সিভিলিয়ান। জঙ্গিদের সঙ্গে যুদ্ধে ওই শহরটি পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। এই যুদ্ধের সঙ্গে সিরিয়া-ইরাকে আইএসের বিরুদ্ধে সিরিয়া ও ইরাকি বাহিনী যে যুদ্ধ পরিচালনা করছে তার কথা মনে করিয়ে দেয়। সেনাবাহিনী এখন মারাভি শহরের নিয়ন্ত্রণভার নিতে পেরেছে। শহরটি এখন পরিপূর্ণভাবে পরিত্যক্ত। শহরের ১০০ শতাংশ বসতবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এখন সম্প্রসারিত হয়েছে ফিলিপাইনে। সিএনএন গত ২৯ মে (২০১৭) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে Phillipines : the next ISIS strong hold? অর্থাৎ ফিলিপাইন কি হতে যাচ্ছে আইএসের পরবর্তী শক্তিশালী ঘাঁটি? ওই প্রতিবেদনে একটি মসজিদে আইএস কর্তৃক তাদের পতাকা উত্তোলন করার দৃশ্য আমরা দেখেছিলাম।

এ অঞ্চলের তিনটি দেশেফিলিপাইন, মালয়েশিয়া আর ইন্দোনেশিয়ায় গত দুই বছরে যেসব জঙ্গি কর্মকাণ্ড হয়েছে এবং যার সঙ্গে আইএস জড়িত তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে সিএনএনের প্রতিবেদনে। পাঠকদের উদ্দেশে সেখান থেকে কিছু তুলে দিচ্ছি। ২৮ জুন ২০১৬কুয়লালামপুরের একটি নাইট ক্লাবে জঙ্গি হামলায় আটজনের মৃত্যু। ১৪ জানুয়ারি ২০১৬জাকার্তায় সন্ত্রাসী হামলায় চারজনের মৃত্যু। জাকার্তায় ২৪ মে ২০১৭সন্ত্রাসী হামলায় তিনজনের মৃত্যু। ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ফিলিপাইনের দাভাও শহরসন্ত্রাসীর বোমা বিস্ফোরণে মৃত্যু ১৪ জন। আর মারাভির ঘটনা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। প্রতিটি ঘটনায় আইএস তার দায় স্বীকার করেছে। সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বেশ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন তৎপর, যাদের সঙ্গে আইএসের যোগাযোগ রয়েছে। যেমন বলা যেতে পারে, মরো লিবারেশন ফ্রন্ট (এমআইএলএফ)। এরা তৎপর সুলু দ্বীপপুঞ্জ এলাকায়। সুলু দ্বীপপুঞ্জ এলাকায়ও Bangsamoro Islamic freedom fighters (BIFF) তৎপর। জাকার্তায় তৎপর জামেইয়া ইসলামিয়া। আবু সায়াফ গ্রুপ ও মাউটে গ্রুপও তৎপর দক্ষিণাঞ্চলে। আবার ব্রুনেইতে আবু সায়াফ গ্রুপ তাদের তৎপরতা সম্প্রসারিত করেছে। সিঙ্গাপুরভিত্তিক Center for Political Violence and Terrorism Research (ICPVTR) তাদের এক গবেষণায় উল্লেখ করেছে, আইএস সম্প্রতি সিরিয়াফেরত জঙ্গিদের নিয়ে এ অঞ্চলে নতুন একটি ব্রিগেড তৈরি করেছে, যার নাম Katibah Al Muhajir। পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ওই ব্রিগেডের তৎপরতা রয়েছে। এই ব্রিগেডের নেতৃত্ব দিচ্ছেন হাপিলন নামের এক জঙ্গি। হাপিলন এসেছেন সুলু অঞ্চল থেকে। ২০১৬ সালে আইএস তাঁকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আমির হিসেবে ঘোষণা করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মার্কিন গোয়েন্দাদের মতে, হাপিলন ইংরেজি বা আরবি ভাষা কিছুই বোঝেন না এবং ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানও সীমিত। যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে ধরার জন্য পাঁচ মিলিয়ন ডলার পুরস্কারের কথা ঘোষণা করেছে। কয়েক হাজার জঙ্গি বর্তমানে এ অঞ্চলে জঙ্গি তৎপরতায় লিপ্ত। ফলে আগামী দিনগুলোতে এ অঞ্চলে যে অস্থিরতা বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য। এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ওই জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হলো রোহিঙ্গাদের নাম। ফিলিপাইনে জঙ্গি উত্থানের পাশাপাশি এখন রোহিঙ্গা নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে জঙ্গি তৎপরতা বেড়ে যেতে পারে বলে অনেক গবেষক আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সিএনবিসি (যুক্তরাষ্ট্র) টিভি চ্যানেল তাদের এক প্রতিবেদনে (১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭) বলেছে, রোহিঙ্গা সংকটকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো সুযোগ নিতে পারে। 

একটি আশঙ্কার কথা বলছে অনেকে যে রাখাইন অঞ্চল সমুদ্রবেষ্টিত হওয়ায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, বিশেষ করে সুলু অঞ্চলে (মিন্দানাও) অবস্থানরত জিহাদিরা সমুদ্রপথে রাখাইনে যেতে পারে এবং সেখানে সন্ত্রাসী তৎপরতায় লিপ্ত হতে পারে। সুলু অঞ্চল (ফিলিপাইন) আর রাখাইন অঞ্চলের অনেক মিল আছে। অস্ত্র আনা-নেওয়া কিংবা সন্ত্রাসীদের মুভমেন্টের জন্য সমুদ্রপথ খুবই উপযোগী। ফলে ফিলিপাইনের জিহাদিরা যদি ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চলের শহর মারাভি থেকে উত্খাত হয়ে আরাকানে আশ্রয় নেয়, আমি অবাক হব না। এখন পর্যন্ত আরাকানে আরাকান স্যালভেশন আর্মির খবর আমরা জানি, যারা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের কয়েকটি পুলিশ ফাঁড়িতে আক্রমণের ফলে বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এর বাইরেও আরো কয়েকটি গ্রুপের অস্তিত্ব রয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, স্যালভেশন আর্মি খুব বড় সশস্ত্র সংগঠন নয়। কোচিন লিবারেশন ফোর্স মিয়ানমারের বড় বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ। এরা কোচিন প্রদেশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। কিন্তু মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সেখানে জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেনি। কোচিনরা ধর্মীয়ভাবে খ্রিস্ট ধর্মে বিশ্বাসী। বোঝাই যায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মুসলমানদের টার্গেট করেছে। এখন স্যালভেশন আর্মি কতটুকু রোহিঙ্গাদের স্বার্থ দেখে, সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। রোহিঙ্গাদের অনেকেই বলেছে, তারা এ সংগঠনের ব্যাপারে তেমন কিছু জানে না। এরই মধ্যে এ সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাদের সঙ্গে আইএসের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে এ অঞ্চলের ব্যাপারে আইএসের আগ্রহ আছে, এটা বোগদাদির একটি বক্তব্যে আমরা জেনেছিলাম সেই ২০১৪ সালেই। এখন নতুন করে সাত লাখ রোহিঙ্গা (পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর স্ট্যাটাস অনুযায়ী) বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে! এদের যে জঙ্গিরা টার্গেট করবে, এটা বলাই বাহুল্য। জঙ্গিরা সুযোগটি নেবে। রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে জঙ্গি কার্যক্রম বৃদ্ধি পেতে পারে, যা কিনা বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে একটি সংকটের মুখে ঠেলে দিতে পারে।

সবচেয়ে বড় ভয়ের কারণটি হচ্ছে, রাকা থেকে আইএস জঙ্গিরা উত্খাত হওয়ার পর এরা হারিয়ে যাবে না। এমনকি ফিলিপাইনের মারাভি শহর থেকেও আইএসকে উত্খাত করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট দুতার্তে। তাহলে আইএস জঙ্গিরা কোথায় এখন আশ্রয় নেবে? ওয়াশিংটনের ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসিতে কর্মরত গবেষক আরন ওয়াই জেলিন মনে করেন, আইএস শেষ হয়ে যায়নি। তারা কিছুদিন চুপ করে থেকে আবার শক্তি সঞ্চয় করবে এবং তাদের অনুসারীদের উৎসাহ জোগাবে। তারা গেরিলা কায়দায় তাদের কর্মতৎপরতা অব্যাহত রাখবে (with loss of it caliphate, ISIS May Return to Guerrilla Roots, NP Times, Oct. 18, 2017)। আর ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা MI5-এর পরিচালক এন্ডু পারকার মনে করেন, That threat is Multidimantional, evolving repidly and operating at a scale and pace weve not seen before। বক্তব্য পরিষ্কার। নতুন উদ্যোগে আইএস আবির্ভূত হতে পারে। সিরিয়াস পাঠকরা লক্ষ করে থাকবেন অতি সম্প্রতি আফগানিস্তানে তালেবানদের সঙ্গে আইএসের একটি সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। এর অর্থ আইএস তৎপরতা আফগানিস্তানে বাড়বে। একই সঙ্গে সোমালিয়ায় গেল সপ্তাহে যে আত্মঘাতী বোমা হামলা হয়েছে, যাতে প্রায় ৫০০ মানুষ মারা গেছে, সেখানে আইএসের সঙ্গে সম্পৃক্ত আল-শাবাব গ্রুপ তাদের শক্তি বৃদ্ধি করেছে। এ ধরনের আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়ে আইএস সংশ্লিষ্ট জঙ্গি সংগঠনগুলো জানান দিল তারা শেষ হয়ে যায়নি। একই সঙ্গে আল-কায়েদা নিয়েও প্রশ্ন আছে। ওসামা বিন লাদেনের ছেলে ২৭ বছরের হামজা বিন লাদেন এখন আল-কায়েদার নতুন নেতা। Foundation for the Defence of Democracies-এর সিনিয়র গবেষক বিল রোজ্জিও (Bill Roggio) মনে করেন, আইএস যে খিলাফত প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিল, তা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। কিন্তু আল-কায়েদা রয়ে গেছে। ফলে রাকায় আইএসের পতনে আমরা যেন উৎসাহিত না হই। এদের কর্মতৎপরতা বন্ধ হবে না, বরং সম্প্রসারিত হবে অন্যত্র। ইউরোপে সন্ত্রাসী হামলা বাড়তে পারে। লন্ডন, প্যারিসের মতো বড় শহরগুলো এখন টার্গেট। সেই সঙ্গে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের উত্খাতের পর সেখানে যে সংকটের জন্ম হয়েছে তার সুবিধা নিতে পারে আইএস। বিষয়টি আমাদের নীতিনির্ধারকরা যেন ভুলে না যান। তাই বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে ভুল করেনি বটে; কিন্তু আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা এলাকায় আমাদের সামরিক ও বেসামরিক গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো দরকার। সীমান্তে সেনা টহলও বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, যেকোনো জঙ্গি তৎপরতা আমাদের নিরাপত্তা বিপন্ন করে তুলতে পারে।

ইউরোপের পথে পথে

ইউরোপের সঙ্গে আমার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। এখানে উচ্চশিক্ষা নিয়েছি। অনেকগুলো শহরে ছিলাম। প্রতিবছরই যখন দেশ থেকে বের হই, তখন পারলে একবার ইউরোপ ঘুরে যাই। মূলত আমি আসি যুক্তরাষ্ট্রে। গত বছর ছিলাম পাঁচ মাস। আটলান্টিকের ওপারে ইউরোপ। নিউইয়র্ক থেকে আটলান্টিক ক্রস করতে লাগে প্রায় ৮ ঘণ্টা। আর যদি ওখান থেকে ডালাসে আসি লাগে প্রায় ১০ ঘণ্টা। গত বছরও ডালাস থেকে ইউরোপে এসেছিলাম, এবারও এসেছি নিউইয়র্ক হয়ে। কিন্তু এবারের ইউরোপে আসার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ইউরোপ বদলে যাচ্ছেÑ আর এটা কাছ থেকে দেখা। অক্টোবরের এক সকালে যখন প্যারিসের চার্লস দ্য গল বিমানবন্দরে নামলাম, তখন আমাকে অবাক হতে হলো নানা কারণে। প্যারিস অনেক বদলে গেছে। প্যারিসে কদিন থাকার পর লক্ষ করলাম, প্যারিসকে আমি দেখেছিলাম কয়েক দশক আগে, সেই প্যারিস এখন আর তেমন নেই। অনেক বদলে গেছে। বদলে গেছে এ দেশের রাজনীতিও। সনাতন রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করে ম্যাক্রোঁ প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। দুই বছর আগে মাত্র তিনি একটি দল গঠন করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সবাইকে অবাক করেছিলেন। পার্লামেন্ট নির্বাচনেও তার দল ভালো করেছিল। কিন্তু মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে তার জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করেছে। যেখানেই ঘুরতে গেছি, সেখানেই সুযোগ পেলে ফরাসি নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলেছি। কেন ম্যাক্রোঁ জনপ্রিয়তা হারাচ্ছেন? অনেকগুলো কারণ আমি খুঁজে পেয়েছি। এক. যদিও তিনি একজন অর্থনীতিবিদ। কিন্তু অর্থনীতিতে তিনি গতি আনতে পারছেন না। এখন প্রচুর কর দিতে হয় ফরাসি নাগরিকদের, যা তার জনপ্রিয়তা হ্রাসের কারণ। বিশাল করের বোঝা মাথায় নিয়ে একজন ফরাসি কর্মজীবী প্রতিদিন পার করেন। এখানে অসন্তোষ আছে। দুই. প্রচুর বিদেশি, বৈধ ও অবৈধ এখন প্যারিসের মতো শহরে বসবাস করে। তারা নানা সমস্যা ইতোমধ্যেই তৈরি করেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুশাসনের অভাবও আমি লক্ষ করেছি। অবৈধ অভিবাসীরা একটা বড় সংকট তৈরি করছে। এরা নানাবিধ কুকাজে নিজেদের জড়িত করছে। এটা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এসব অভিবাসীর কারণে একটি সংকর জাতির জন্ম হচ্ছে ফ্রান্সে।
এটা আমি জার্মানিতেও দেখেছি। আদি ফরাসি কিংবা আদি জার্মান নাগরিক আগামী ১০ বছর পর আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে থাকতাম Villers-le-Bel নামে একটি এলাকায়। প্যারিস থেকে কিছুটা দূর, বলা যেতে পারে উপশহর। এখানে ফরাসিদের পাশাপাশি মুসলমানপ্রধান দেশগুলো (মরক্কো, আলজেরিয়া, লেবানন ইত্যাদি) থেকে আসা অভিবাসীদের প্রাধান্য বেশি। দেখলে বোঝার উপায় নেই কে ফরাসি, কে আরব দেশ থেকে আসা। এই মিশ্র জাতি নতুন এক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে এখানে। আমার এক আত্মীয়, যার দুই সন্তান, এক ছেলে ও এক মেয়ে। ওদের সঙ্গে আমি বাংলায় কথা বলতে পারিনি। ইংরেজি বোঝে কম। স্কুলে যায়। মায়ের সঙ্গেও কথা বলে ফ্রান্স ভাষায়। মাও এখানে স্কুলে গেছে। স্কুল পাস করেছে। মাও সন্তানদের সঙ্গে কথা বলেন ফ্রান্স ভাষায়। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি। বাংলাদেশের সঙ্গে যে সন্তানের (ইসরাত ওর নাম) রক্তের সম্পর্ক, সে কিনা বড় হচ্ছে ফরাসি সংস্কৃতি ধারণ করে! ইশরাতদের মতো শিশুরা ফরাসি নাগরিক। বাংলা আর ফরাসি এক হয়ে নতুন এক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। ঠিক তেমনি আরবি আর ফরাসি সংস্কৃতি মিলনের ফলে জন্ম হচ্ছে নতুন সংস্কৃতির। চোখে পড়ে যখন আফ্রিকা থেকে আসা এক তরুণ প্রবাসী কোনো তরুণীকে বিয়ে করে অথবা একসঙ্গে থাকে। তাদের ঘরে যে সন্তান আসে, তা পূর্ণ শ্বেতাঙ্গও নয়, আবার পূর্ণ কৃষ্ণাঙ্গও নয়। এ সংখ্যা লাখ লাখ। রাস্তাঘাটে চলাচল করলে এদের দেখা যায়। এদের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে মূল ফরাসিরা। তিন. মাগরেবভুক্ত দেশগুলো (আলজেরিয়া, মরক্কো, তিউনিশিয়া ইত্যাদি) থেকে যারাই এসেছে, তারা শতকরা ১০০ ভাগ মুসলমান। এদের দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় জেনারেশন উগ্র ইসলামিক চিন্তা-চেতনায় আকৃষ্ট হচ্ছে। এরা জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে ইসলামি জঙ্গিবাদ আদর্শকে গ্রহণ করছে। বেকার। উচ্চতর কোনো ডিগ্রি নেই। ভালো চাকরি নেই। হতাশাগ্রস্ত ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাদকাগ্রস্তÑ এসব তরুণকে রিক্রুট করে একদল লোক। তার পর এদের ব্রেন ওয়াশ করা হয়। হাতে অস্ত্র দেওয়া হয়। ওই অস্ত্রই এসব আরবীয় তরুণকে জঙ্গি করে তোলে। এমন নয় যে, এরা নিয়মিত মসজিদে যায়। ধর্মকর্ম করে। ধর্ম সম্পর্কে এদের ধারণাও কম। অথচ এরাই জঙ্গি হয়ে ওঠে। সাম্প্রতিককালে ফ্রান্সে যতগুলো সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে, তার প্রত্যেকটির সঙ্গে এসব তরুণ (যারা মাগরেবভুক্ত দেশগুলো থেকে এসেছে) জড়িত। ফলে ফ্রান্সের সমাজে এই জঙ্গিবিরোধী তথা ইসলামবিরোধী একটা জনমত আছে। এই জনমতকে পুঁজি করেই ফ্রান্সে ন্যাশনাল ফ্রন্টের মতো উগ্রপন্থি দল সামনে চলে এসেছে। মারিয়ান লি পেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ের কাছাকাছি পর্যায়ে চলে গিয়েছিলেন। এরা ইসলামবিরোধী তথা শরণার্থীবিরোধী। জার্মানিতেও এই উগ্রপন্থিরা বিজয়ী হয়েছে। প্রথমবারের মতো এএফডির মতো দল পার্লামেন্টে এসেছে। এএফডি ও ন্যাশনাল ফ্রন্টের রাজনীতির মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। এই উগ্রপন্থি মনোভাব ছড়িয়ে পড়ছে ইউরোপের সর্বত্র, এক দেশ থেকে অন্য দেশে। এর প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। উগ্রপন্থিরা শক্তিশালী হচ্ছে। শরণার্থীদের ইউরোপে প্রবেশ করতে দেওয়া এবং এদের নিয়ে পরবর্তী সময়ে রাজনীতি করা কিংবা শরণার্থীদের তাদের স্বার্থে ব্যবহার করাÑ বর্তমান ইউরোপের রাজনীতির এটাই হচ্ছে চিত্র।
শরণার্থীদের ব্যাপক হারে ইউরোপে প্রবেশ শুধু জার্মানি, ফ্রান্স আর ইতালির রাজনীতিকেই বদলে দেয়নি, বরং পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, চেক রিপাবলিক আর সেøাভাকিয়ার রাজনীতিকেও বদলে দিয়েছে। শরণার্থীরা যখন ইউরোপে ব্যাপক হারে প্রবেশ করতে শুরু করে, তখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক ধরনের কোটা সিস্টেম আরোপ করেছিল। ওই কোটা সিস্টেমে প্রতিটি দেশকে শরণার্থী গ্রহণে নির্দিষ্ট কোটা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, চেক ও সেøাভাকিয়া তা মানতে অস্বীকৃতি জানায়। প্রতিটি দেশকে ১১ হাজার করে শরণার্থী নিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু এই দেশগুলো তা মানেনি। এমনকি হাঙ্গেরি ও সেøাভাকিয়া ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিসে আবেদন করলে তা বাতিল হয়। এসব দেশে শরণার্থীদের ব্যাপক অভিবাসনকে কেন্দ্র করে যেমনি একদিকে দক্ষিণপন্থি উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির উত্থান ঘটেছে, অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নবিরোধী মনোভাবও শক্তিশালী হচ্ছে।
বদলে যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজনীতি। নতুন নতুন রাজনীতিবিদের উত্থান ঘটছে ইউরোপে, যারা তথাকথিত পপুলিজম-এর কারণে জনপ্রিয় হচ্ছেন। সস্তা সেøাগান, জাতীয়তাবোধের ধারণা তাদের জনপ্রিয় করছে। এক সময়ের ট্রেডিশনাল রাজনৈতিক দলগুলো চলে গেছে পেছনের সারিতে। লি পেন, উইলডার্স, গ্রিল্লও, ভিক্টর উরবানÑ এ নামগুলো এখন ইউরোপের রাজনীতিতে বারবার আলোচিত হচ্ছে। হল্যান্ডে গ্রিয়াট উইলডার্সের দল নির্বাচনে সনাতন রাজনৈতিক দলগুলোকে পেছনে ঠেলে দ্বিতীয় হয়েছিল, অনেকটা মারিয়ান লি পেনের মতো ফ্রান্সে। লি পেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে (ফ্রান্সে) দ্বিতীয় হয়েছিলেন। এদের সবার মাঝে একটা মিল আছে। এরা সবাই মুসলমান তথা শরণার্থীবিরোধী। এরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের ধারণারও বিরোধী। উগ্র জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ দ্বারা সবাই চালিত। তাই সঙ্গত কারণেই যে প্রশ্নটি ওঠে, তা হচ্ছে এই উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনা ইউরোপকে কোথায় নিয়ে যাবে? ২৮টি দেশ নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠিত। লোকসংখ্যা প্রায় ৫১০ মিলিয়ন। ১৯৯৯ সালে একক মুদ্রার (ইউরো) সিদ্ধান্ত নিলেও তা কার্যকর হয় ২০০২ সালে। যদিও মাত্র ১৯টি দেশ ইউরো চালু করেছে নিজ দেশের মুদ্রাকে অবলুপ্ত করে। ১৯৫১ সালে প্যারিস চুক্তির মধ্য দিয়ে ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিউনিটি তার যাত্রা শুরু করলেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ১৯৯৩ সালে। ১৬ দশমিক ৪৭৭ ট্রিলিয়ন ডলারের ইইউর যে অর্থনীতি, তা বিশ্বের জিডিপির প্রায় ২৩ শতাংশ। বড় অর্থনীতির এ সংস্থাটি বিশ্ব আসরে এতদিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিল। এখন এতে বিভক্তি আসছে। তৈরি হচ্ছে নানা জটিলতা। এই জটিলতা, বিভক্তি, দ্বন্দ্ব ইউরোপীয় ইউনিয়নকে কোথায় নিয়ে যাবে, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন।

ফ্রান্সে ন্যাশনাল ফ্রন্টের উত্থান, জার্মানিতে এএফডির পার্লামেন্টে তৃতীয় শক্তি হিসেবে আবির্ভাব নিয়ে ইউরোপের সুশীল সমাজ যখন উৎকণ্ঠিত, ঠিক তখনই অস্ট্রিয়া থেকে এলো আরেকটি দুঃসংবাদ। সেখানকার পার্লামেন্ট নির্বাচনে (১৫ অক্টোবর) বিজয়ী হয়েছে উগ্র দক্ষিণপন্থি দল পিপলস পার্টি। মোট ১৮৩ আসনের মধ্যে তার দল পেয়েছে ৬২ সিট। আরেকটি দক্ষিণপন্থি দল ফ্রিডম পার্টি পেয়েছে ৫১ আসন। আর সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি পেয়েছে ৫২ আসন। পিপলস পার্টি আর ফ্রিডম পার্টি এখন সরকার গঠন করবে। সেবাসটিয়ান ক্রজ যার বয়স মাত্র ৩১ বছর। তিনি এখন হতে যাচ্ছেন অস্ট্রিয়ার পরবর্তী চ্যান্সেলর অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী। ১৭ বছর ধরে (২০০০ সাল থেকে) দক্ষিণপন্থি দুটি দল পিপলস পার্টি আর ফ্রিডম পার্টি সেখানে ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে। ইসলাম তথা শরণার্থীবিরোধী রাজনীতিকে পুঁজি করে তারা আবারও ক্ষমতায় এলো। তাদের এই উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতি যে অন্যান্য দেশকে প্রভাবিত করবে, এটাই স্বাভাবিক। ইউরোপের যেখানে আমি গেছি, সেখানেই এই আতঙ্কের খবর আমি পেয়েছি। ইউরোপের উগ্র ডানপন্থিরা যদি শক্তিশালী হয়, তা হলে জাতিগত দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ অনিবার্য। মুসলমানরা বারবার আক্রান্ত হবেন। জার্মানিতে নাজি জমানায় ইহুদিদের যেভাবে চিহ্নিত করে হত্যা করা হয়েছিল, সেভাবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন আগামীতে। ফ্রান্স বিপ্লব Liberty, Equality, Fraternity , অর্থাৎ স্বাধীনতা, সমতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের কথা আমাদের শিখিয়েছিল। ফরাসি বিপ্লবের সময়কাল ছিল ১৭৮৯ থেকে ১৭৯৯ সাল পর্যন্ত। এই বিপ্লব সেখানে গণতন্ত্রের বীজ রোপণ করেছিল। অতীতে কখনো ফরাসি গণতন্ত্র ঝুঁকির মুখে পড়েনি, এখন পড়েছে। বদলে যাচ্ছে ইউরোপ। বদলে যাচ্ছে ফ্রান্সও।
দৈনিক আমাদের সময় ২৩ অক্টোবর ২০১৭

কাতালোনিয়ার গণভোট এবং ইউরোপের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন

বদলে যাচ্ছে ইউরোপের রাজনীতি। ব্রিটেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গেছে। উগ্র ডানপন্থী উত্থান ঘটেছে ইউরোপে, যারা নতুন করে ইউরোপের ইতিহাস লিখতে চায়। ফ্রান্সে উগ্র ডানপন্থী উত্থানের পাশাপাশি এখন জার্মানিতে উগ্র ডানপন্থী তথা নব্য নাজির উত্থান ইউরোপের রাজনীতি বদলে দিতে পারে
 স্পেনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল কাতালোনিয়া নিয়ে যে সংকটের শুরু, তার এখনও কোনো সমাধান হয়নি। সংকটের গভীরতা বাড়ছে। গেল ১ অক্টোবর সেখানে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। গণভোটে স্বাধীনতার পক্ষে রায় পড়েছিল। শতকরা ৯০ শতাংশ কাতালোনিয়ার নাগরিক স্বাধীনতার পক্ষে রায় দিয়েছিল। এর প্রতিক্রিয়ায় কাতালোনিয়ার প্রেসিডেন্ট এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা পুইজমন্ট বলেছিলেন, তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। কিন্তু স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার এর সমালোচনা করেছিল। কাতালোনিয়ার গণভোটে স্বাধীনতার পক্ষে রায় পড়ায় চরম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে অনেক দেশ ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। স্পেন সরকার এর সমালোচনা করেছে এবং স্পেনের একটি সাংবিধানিক আদালত বলেছেন, ১৯৭৮ সালের সংবিধানের ডিক্রি অনুসারে দেশকে বিভক্ত করা যাবে না; শুধু জাতীয় সরকারই গণভোটের আয়োজন করতে পারে। কিন্তু কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতারা স্বাধীনতার প্রশ্নে অনড়। এক্ষেত্রে কাতালোনিয়া যদি স্বাধীনতা ঘোষণা করে, তাহলে স্পেন সরকার সংবিধানের ১৫৫ ধারা প্রয়োগ করতে পারে। স্পেনের পার্লামেন্ট কাতালোনিয়ার জন্য যে স্বায়ত্তশাসন রয়েছে, তা বাতিল করতে পারে। পার্লামেন্ট একটা রাজনৈতিক সমাধানের দিকে যেতে পারে। কিন্তু স্বাধীনতাকামীরা তা মানবে কিনা, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। বলা ভালো, কাতালোনিয়ার জনসংখ্যা মাত্র ৭৫ লাখ ২২ হাজার। স্পেনের মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ মানুষ কাতালোনিয়ায় বসবাস করে। এ প্রদেশটির রাজধানী বার্সেলোনা। বার্সেলোনার ফুটবল টিম জগদ্বিখ্যাত। স্পেনের জাতীয় আয়ের শতকরা ২০ ভাগ আসে (২৫৫.২০৪ বিলিয়ন) ওই প্রদেশে থেকে। ইউরো জোনের চতুর্থ বড় অর্থনৈতিক শক্তি হচ্ছে স্পেন। এখন কাতালোনিয়ায় বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন যদি শক্তিশালী হয়, যদি সত্যি সত্যিই কাতালোনিয়া ইউরোপে নতুন একটি রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তাহলে তা ইউরোপের অন্যত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আরও উৎসাহ জোগাবে।
বদলে যাচ্ছে ইউরোপের রাজনীতি। ব্রিটেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গেছে। উগ্র ডানপন্থী উত্থান ঘটেছে ইউরোপে, যারা নতুন করে ইউরোপের ইতিহাস লিখতে চায়। ফ্রান্সে উগ্র ডানপন্থী উত্থানের পাশাপাশি এখন জার্মানিতে উগ্র ডানপন্থী তথা নব্য নাজির উত্থান ইউরোপের রাজনীতি বদলে দিতে পারে।
এ যখন পরিস্থিতি, তখন যোগ হলো কাতালোনিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। গেল প্রায় দুই সপ্তাহ আমি ইউরোপে। ফ্রান্স ও জার্মানিতে থেকে আমি দেখেছি, টিভিতে এটা নিয়ে প্রচুর আলোচনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন যদি সফল হয়, তাহলে ইউরোপের সর্বত্র এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়বে। এতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের জন্ম হবে, যা ইউরোপের ঐক্যকে দুর্বল করবে। এমনিতেই এখন একটি উগ্র দক্ষিণপন্থী রাজনীতির স্রোত ইউরোপের সর্বত্র বইছে। ব্যাপক অভিবাসী আগমনকে কেন্দ্র করে এ উগ্র দক্ষিণপন্থী রাজনীতির প্রভাব বাড়ছে। আমি সপ্তাহখানেক আগে ফ্রান্সে ছিলাম। সেখানে দেখেছি, উগ্র দক্ষিণপন্থী দল ন্যাশনাল ফ্রন্টের প্রভাব বাড়ছে। প্রভাব বাড়ছে জার্মানিতে। সেখানে প্রথমবারের মতো পার্লামেন্টে গেছে উগ্র দক্ষিণপন্থী দল অলটারনেট ফর জার্মানি (এএফডি) পার্টি। আস্ট্রিয়ার নির্বাচনে গেল সপ্তাহে ভোটাররা উগ্র দক্ষিণপন্থীদের বিজয়ী করেছে। এর বাইরে হল্যান্ড, হাঙ্গেরি, চেক রিপাবলিক, সেøাভাকিয়াসহ প্রায় প্রতিটি দেশে উগ্র দক্ষিণপন্থীদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বাড়ছে। কোথাও কোথাও এরা ক্ষমতায়, কোথাও দ্বিতীয় অবস্থানে। এ যখন পরিস্থিতি, তখন কাতালোনিয়ার গণভোট পুরো দৃশ্যপটকে বদলে দিল। এ মুহূর্তে এটা স্পষ্ট নয়, কাতালোনিয়ার সংকটের সমাধান হবে কীভাবে? একটা সমাধান না হলে তা ইউরোপের সর্বত্র ছড়িয়ে যাবে। সমাধানটা হতে হবে স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার আর কাতালোনিয়ার স্বাধীনতাকামীদের সঙ্গে। ইইউর প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ইইউ এ ব্যাপারে কোনো মধ্যস্থতা করবে না। তাই সারা ইউরোপের দৃষ্টি এখন কাতালোনিয়ার দিকে। এখানে বলা ভালো, ইউরোপে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের খবর নতুন নয়। অনেক ইউরোপীয় দেশে এ ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদীর খবর আমরা জানি। জার্মানির কথা যদি বলি, তাহলে বেভেরিয়া রাজ্যের কথা আমাকে বলতেই হবে। বেভেরিয়া জার্মানির অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে কিছুটা আলাদা। অর্থনৈতিকভাবে অনেক সমৃদ্ধ এ রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তাধারা আছে। এখানকার মূল দল সিএসইউ হচ্ছে ক্ষমতাসীন সিডিইউর স্থানীয় সংগঠন। সিডিইউ এখানে আলাদাভাবে কোনো প্রার্থী দেয় না। সিডিইউর হয়ে কাজ করে সিএসইউ। সম্প্রতি দলটি চ্যান্সেলর মরকেলকে বাধ্য করেছে অভিবাসীদের কোটা সীমিত করে দিতে। জার্মান রাজনীতিতে বেভেরিয়ার ভূমিকা অনেকটা যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে স্কটল্যান্ডের ভূমিকার মতো। ২০১৪ সালে স্কটল্যান্ডে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে থাকা-না থাকা নিয়ে একটি গণভোট হয়েছিল। তাতে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে থাকার পক্ষেই রায় পড়েছিল। এখন স্কটিকা ন্যাশনাল পার্টি প্রধান নিকোলা স্টুরজিওন চাচ্ছেন আরেকটি গণভোট, যাতে স্কটল্যান্ডের মানুষ আরেকবার ভোট দিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন তারা স্বাধীন হবেন, নাকি ব্রিটেনের সঙ্গেই থেকে যাবেন। এটা তো স্পষ্ট, স্কটল্যান্ড ইইউতে ব্রিটেনের জায়গাটি নিতে চায়। আর এজন্যই দরকার স্বাধীনতা। বেলজিয়াম মূলত দুই ভাগে জাতিগতভাবে বিভক্ত হয়ে আছেÑ ওয়ালুনস (ধিষষড়ড়হং) এবং ফ্লেমিশ (ভষবসরংয)। ওয়ালুনসরা ফরাসি ভাষাভাষী। ফ্লেমিশদের নিজস্ব ভাষা আছে। তাদের মাঝে স্বাধীনতার চেতনাও আছে। কাতালোনা যদি স্বাধীন হয়ে যায়, তাহলে ফ্লেমিশ স্বাধীনতা আন্দোলন আরও শক্তিশালী হবে। ডেনমার্ক থেকে ৮০০ মাইল দূরে অবস্থিত ফারোও (ঋধৎড়ব) দ্বীপপুঞ্জেও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন আছে। দ্বীপটি ডেনমার্কের অধীনে হলেও অতিসম্প্রতি তারা স্বশাসনের কথা ঘোষণা করেছে। ইতালির দুইটি অঞ্চল লমবারডি এবং ভেনেতোতে চলতি মাসের শেষে বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে গণভোট হবে। ২০১৪ সালের মার্চের এক গণভোটে ৮৯ শতাংশ ভেনেতোর মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে রায় দিয়েছিল। সেখানে অনেকটা কাতালোনিয়ার মতো পরিস্থিতি বিরাজ করছে। স্বাধীনতার পক্ষে জনমত সেখানে শক্তিশালী। বাস্্ক (ইধংয়ঁব) অঞ্চলের খবর নিশ্চয়ই অনেকে জানেন। স্পেনের অন্তর্ভুক্ত বাস্্ক মূলত স্বায়ত্তশাসিত একটি অঞ্চল। এর কিছু অংশ আবার ফ্রান্সের অন্তর্ভুক্ত। স্বাধীনতাকামী ইটিএ দীর্ঘদিন ধরে বাস্ক অঞ্চলের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করে আসছে। সাম্প্রতিক সময় স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার বাস্ক অঞ্চলের জন্য যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। তারপরও স্বাধীনতাকামীরা সক্রিয়। তারা মাঝেমধ্যেই বোমা হামলা চালিয়ে তাদের অস্তিত্ব জানান দেয়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শক্তিশালী হয়েছে নানা কারণে। কেন্দ্রীয় সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণ, অনুুন্নয়ন, নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা ইত্যাদি কারণে এ বিচিছন্নতাবাদী চিন্তাধারা শক্তিশালী হয়েছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে, উগ্র দক্ষিণপন্থী কিছু দল এ বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তাধারাকে উসকে দিয়েছে। যেমন বলা যেতে পারে ‘অলটারনেটিভ ফর ডয়েটসল্যান্ড’ (জার্মানি), জবিক (ঔড়ননরশ) বা ‘মুভমেন্ট ফর বেটার হাঙ্গেরি’, ‘ফ্রন্ট ন্যাশনাল’ (ফ্রান্স), ‘গোল্ডেন ডন’ (এষফবহ উধহি) (গ্রিস), ‘ফ্রাইহাইটলিসে পার্টাই ওস্টারিস’ (অস্ট্রিয়া), দ্য ফিনস (ফিনল্যান্ড), ‘সুইডেন ডেমোক্র্যাটস’ (সুইডেন), ‘ড্যানিশ পিপলস পার্টি’ (ডেনমার্ক), ‘পার্টাই ভর দি ভ্রিজহেইড’ (চধৎঃরু াড়ড়ৎ ফব াৎরলযবরফ) (হল্যান্ড), ‘লিগা নর্ড’ (ইতালি) প্রভৃতি রাজনৈতিক দলের কথা। এসব রাজনৈতিক দল উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতি প্রমোট করছে। কোথাও কোথাও তারা সংসদেও আছে। একটা পরিসংখ্যান দিই। সম্প্রতি জার্মানিতে যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাতে এএফডির তৃতীয় শক্তি হিসেবে উত্থান ঘটেছে। সাবেক পূর্ব জার্মানিতে এ দলটি শক্ত অবস্থানে রয়েছে। প্রচ- ইসলাম তথা অভিবাসনবিরোধী দলটি যদি ভবিষ্যতে পূর্ব জার্মানিতে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু করে (?) আমি অবাক হব না। হাঙ্গেরিতেও ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে ঔড়ননরশ তৃতীয় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। ফ্রান্সে উগ্র দক্ষিণপন্থী ন্যাশনাল ফ্রন্টের নেতা মারিয়ান লি পেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রথম রাউন্ডে শতকরা ২৬ ভাগ ভোট পেয়েছিলেন। দ্বিতীয় রাউন্ডে তিনি ম্যাক্রোনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান। ফ্রান্সের ১৩টি অঞ্চলের স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে (২০১৫) ন্যাশনাল ফ্রন্ট অন্তত ছয়টি অঞ্চলে প্রথম অবস্থানে আছে। গ্রিসে ২০১৫ সালের নির্বাচনে ‘গোন্ডেন ডন’ পার্টি শতকরা ৭ ভাগ ভোট পেয়েছিল। অস্ট্রিয়ার গত সপ্তাহের সংসদ নির্বাচনে দুইটি উগ্রপন্থী দলের অবস্থান যথাক্রমে শতকরা ২৪.০ ভাগ (পিপলস পার্টি) ও শতকরা ২০.৫ ভাগ (ফ্রিডম পার্টি)। ফিনল্যান্ডে ‘দি ফিনস’ পার্টির অবস্থান দ্বিতীয়। ২০১৫ সালে তারা সরকারে যোগ দেয়। ২০১১ সালে তারা সংসদ নির্বাচনে ৩৯ শতাংশ ভোট পেয়ে সবাইকে অবাক করেছিল। সুইডেনে ‘সুইডেন ডেমোক্র্যাট’ পার্টি শতকরা ১২ দশমিক ৯ ভাগ ভোট পেয়ে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পার্টি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সর্বশেষ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট পার্টি পেয়েছিল ২১ দশমিক ৫ ভাগ ভোট। ডেনমার্কে ‘ড্যানিশ পিপলস পার্টি’ শতকরা ২১ ভাগ ভোট পেয়ে (২০১১ সালে ১২ ভাগ ভোট) দেশের দ্বিতীয় বড় দল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। হল্যান্ডে ‘পার্টাই ভর দি ভ্রিজহেইড’ এখন ক্ষমতার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী। দলটির নেতা গার্ট উইলডার্স বহুবিধ কারণে বিতর্কিত। বলা হয়, তিনিই মূলত ‘ট্রাপইজম’ এর জনক। প্রচ- ইসলামবিরোধী বক্তব্যের জন্য তিনি বারবার সমালোচিত হয়েছেন। ইতালির নব্য নাজি হিসেবে পরিচিত লিগা নর্ড (খরমধ ঘড়ৎফ) পার্টি প্রায় ১৩ ভাগ ভোটারের প্রতিনিধিত্ব করে এবং আগামীতে ক্ষমতার অন্যতম অংশীদার হবে বলে অনেকে মনে করে। এ ধরনের পরিসংখ্যান আরও দেয়া যায়Ñ যাতে দেখা যাবে উগ্রপন্থীদের উত্থান ঘটেছে ইউরোপে। আগামীতে এ উগ্রপন্থীরা কোনো কোনো অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সূচনা করতে পারে। বদলে যাচ্ছে ইউরোপ। একসময় যে ইউরোপ স্থিতিশীলতা ও ঐক্যের প্রতীক ছিল, সেখানে আসতে পারে অনিশ্চয়তা। ভেঙে যেতে পারে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ধারণা।
দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ ২২ অক্টোবর ২০১৭

স্নিগ্ধ ইউরোপ মলিন হচ্ছে?

ইউরোপের রাজনীতি এখন কোন পথে? আমি এখন ইউরোপে। প্যারিস থেকে ফ্রাংকফুর্টে। আগামী সপ্তাহে চলে যাব আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে। খুব কাছ থেকে দেখছি ইউরোপের রাজনীতি। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের লোক হিসেবে যেখানেই যাই দেখার চেষ্টা করি কীভাবে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বদলে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। যেসব বাংলাদেশি থাকেন, তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। বুঝতে চেষ্টা করছি রাজনীতিটা যাচ্ছে কোন দিকে। জার্মানির সাধারণ নির্বাচনের পর আরও দুটি প্রাদেশিক নির্বাচন হয়ে গেল। সেখানেও উগ্র ডানপন্থীরা ভালো করেছে। অস্ট্রিয়াতেও সাধারণ নির্বাচন হয়ে গেছে। সেখানেও উগ্র ডানপন্থীরা ক্ষমতায় এসেছে। এর অর্থ কী? ইউরোপ কি একটি উগ্র ডানপন্থী উত্থান প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছে আগামী দশকে? ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অনেক দেশেই এখন উগ্র ডানপন্থীরা তাদের অবস্থান শক্তিশালী করছে। এ উগ্র ডানপন্থীরা দুটো কাজ করতে পারে- এক. তারা ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যেতে পারে, যেমনটি গেছে ব্রিটেন; দুই. এক ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের জন্ম দিতে পারে, যেমনটি দিয়েছে স্পেনের কাতালোনিয়া।
প্যারিসে Pantheon দেখতে গিয়ে ফ্রান্সের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের সঙ্গে হঠাৎ করেই পরিচয়। পাশের উন্মুক্ত রেস্তোরাঁয় কফি খেতে খেতে ফ্রান্সের রাজনীতি নিয়ে আলাপ হচ্ছিল। Pantheon হচ্ছে একটি মিউজিয়াম। ফরাসি বিপ্লবের পর এ ভবনটিকে মিউজিয়ামে পরিণত করা হয়। অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির কবর আছে এখানে : ভলতেয়ার, ভিক্টর হুগো এবং ম্যারি কুরি। আমার মিউজিয়াম দেখার উদ্দেশ্যও ছিল তা-ই। সেখানেই পরিচয় অধ্যাপক ফাঁসোয়ার সঙ্গে। তারপর আলাপ। তিনি নৃবিজ্ঞান পড়ান। সঙ্গে ভিয়েতনামী স্ত্রী। খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মতো দেশগুলোর ব্যাপারে আগ্রহ রয়েছে ভদ্রলোকের। তিনি স্পষ্ট করেই বললেন, ইউরোপ বদলে যাচ্ছে। আরও দশ বছরে আরও দশটি কাতালোনিয়ার জন্ম হবে! অর্থাৎ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন আরও শক্তিশালী হবে। এ মুহূর্তে কাতালোনিয়া নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে। কাতালোনিয়ার গণভোটে স্বাধীনতার পক্ষে রায় পড়ার পর স্পেন বেশ শক্ত অবস্থানে গেছে। কাতালোনিয়ার নেতারা শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার ঘোষণা স্থগিত রেখেছেন বটে; কিন্তু কতদিন? স্পেন সরকারের সঙ্গে তাদের আলোচনা একরকম ব্যর্থ হয়েছে। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, কাতালোনিয়ার প্রেসিডেন্ট ও স্বাধীনতাকামীদের নেতা চার্লস পুইজমন্ট যদি স্বাধীনতা পরিত্যাগের সুস্পষ্ট ঘোষণা না দেন, তাহলে কাতালোনিয়া যে স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে, স্পেন সরকার তা বাতিল করবে।
কাতালোনিয়া স্পেনের একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ। মাত্র ১২ হাজার ৩৯৭ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে প্রদেশটি গঠিত, লোকসংখ্যা ৭৫ লাখ ২২ হাজার। এই কাতালোনিয়া এখন স্বাধীনতা চায়। গত ১ অক্টোবর সেখানে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে শতকরা ৯০ শতাংশ ভোট পড়েছে স্বাধীনতার পক্ষে। এ নিয়ে একটি বড় ধরনের সংকটে পড়েছে স্পেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এর সমালোচনা করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচ্চ আদালত বলছে, কাতালোনিয়া এ গণভোট আয়োজন করতে পারে না। কিন্তু কাতালোনিয়া স্বাধীনতার প্রশ্নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা চার্লস পুইজমন্ট বলেছেন, স্বাধীনতার ঘোষণা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এভাবেই বদলে যাচ্ছে ইউরোপের রাজনীতি। একদিকে উগ্র দক্ষিণপন্থীদের উত্থান ঘটছে, অনদিকে বাড়ছে বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তাধারা। এ পরিস্থিতি কোথায় নিয়ে যাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে? ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঐক্য কি ধরে রাখা সম্ভব হবে? এসব প্রশ্ন এখন উঠছে বিভিন্ন মহলে। সবচেয়ে বড় শঙ্কার কারণ হচ্ছে উগ্র ডানপন্থী সংগঠনের আত্মপ্রকাশ এবং সাধারণ ইউরোপীয়দের মাঝে এদের প্রভাব বৃদ্ধি। পার্লামেন্ট কিংবা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও এরা বিপুলসংখ্যক আসনে বিজয়ী হয়ে ইউরোপের সনাতন রাজনীতির ট্রেন্ডকে ভেঙে দিয়েছে। জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, হল্যান্ড, চেক রিপাবলিক- সর্বত্রই এই উগ্র ডানপন্থীদের প্রভাব বাড়ছে। ভয়টা সেখানেই। সবচেয়ে অবাক করার ঘটনা ঘটেছে জার্মানির পার্লামেন্ট নির্বাচনে। গত ২৪ সেপ্টেম্বর সেখানে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে উগ্রবাদী দল হিসেবে পরিচিত অলটারনেটিভ ফর জার্মানি (এএফডি) তৃতীয় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে জার্মানির রাজনীতি পরিচালনা করে আসছে দুটি বড় দল- সিডিইউ আর এসপিডি। এখন জার্মান পার্লামেন্টে তৃতীয় শক্তি হচ্ছে এএফডি। ভয়ের কারণ হচ্ছে, এএফডির উত্থান অন্য দেশগুলোতেও প্রভাব ফেলতে পারে। অস্ট্রিয়া এর বড় প্রমাণ। সেখানে গত রোববারের নির্বাচনে উগ্রপন্থী পিপলস পার্টি বিজয়ী হয়েছে এবং ৩১ বছর বয়স্ক সেবাসটিয়ান কুর্জ সেদেশের চ্যান্সেলর হতে যাচ্ছেন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ম্যাত্রেঁদ্ধার বিজয় একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু ফ্রান্সে এসে দেখলাম তার জনপ্রিয়তা আগের মতো নেই। মে মাসে তার জনপ্রিয়তা ছিল শতকরা ৬২ ভাগ, আর আগস্টে (২০১৭) তা কমে দাঁড়ায় ৪০ ভাগে (টাইম, ৯ অক্টোবর ২০১৭)। তার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ রাস্তায়ও নেমেছে। কাজেই দেখা যাচ্ছে, ম্যাক্রোঁর প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমছে। ফ্রান্সের রাজনীতি দীর্ঘদিন নিয়ন্ত্রণ করেছে একদিকে মধ্য-দক্ষিণপন্থীরা, অন্যদিকে মধ্য-বামপন্থীরা। এ দুটি ভাবধারার বড় রাজনৈতিক দলের আদর্শ মানুষকে টানতে পারেনি। তাই নির্বাচনে (প্রেসিডেন্ট) তারা ম্যাক্রোঁকে বেছে নিয়েছিলেন। ম্যাত্রেঁদ্ধা মাত্র দুবছর আগে এটি দল গঠন করে সাধারণ মানুষের কাছে গিয়েছিলেন। তার তারুণ্য, স্পষ্ট বক্তব্য মানুষ গ্রহণ করেছিল। এখন ম্যাক্রোঁ যদি ব্যর্থ হন, তাহলে উগ্র লি পেনের উত্থান ঠেকানো যাবে না।
সমস্যা আছে ইতালিতেও। একটি ভঙ্গুর সরকার সেখানে রয়েছে; কিন্তু যে কোনো সময় এ সরকারের পতন ঘটতে পারে। কমেডিয়ান বেপ্পে গ্রিল্লও ও তার নবগঠিত দল
ফাইভ স্টার মুভমেন্টের উত্থান ইতালির সনাতন রাজনীতির জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। এ দলটি শরণার্থীবিরোধী এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নবিরোধী। ইতিমধ্যে ইতালি ৮০ হাজারের ওপর শরণার্থী গ্রহণ করেছে। এ শরণার্থী আগমন ইতালির রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে। জন্ম হচ্ছে নব্য নাৎসি পার্টির।
শরণার্থীদের ব্যাপক হারে ইউরোপে প্রবেশ শুধু জার্মানি, ফ্রান্স আর ইতালির রাজনীতিকেই বদলে দেয়নি, বদলে দিয়েছে পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, চেক রিপাবলিক আর স্লোভাকিয়ার রাজনীতিকেও। শরণার্থীরা যখন ইউরোপে ব্যাপক হারে প্রবেশ করতে শুরু করে, তখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক ধরনের কোটা সিস্টেম আরোপ করেছিল। এ সিস্টেমে প্রতিটি দেশকে ১১ হাজার করে শরণার্থী গ্রহণে নির্দিষ্ট কোটা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, চেক রিপাবলিক ও স্লোভাকিয়া তা মানতে অস্বীকৃতি জানায়। এমনকি হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়া ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিসে আবেদন করলে তা বাতিল হয়। এসব দেশে শরণার্থীদের ব্যাপক অভিবাসনকে কেন্দ্র করে যেমন একদিকে দক্ষিণপন্থী উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির উত্থান ঘটছে, অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নবিরোধী মনোভাবও শক্তিশালী হচ্ছে।
বদলে যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজনীতিও। নতুন নতুন রাজনীতিকদের উত্থান ঘটছে ইউরোপে, যারা তথাকথিত পপুলিজমের কারণে জনপ্রিয় হচ্ছেন। সস্তা স্লোগান, জাতীয়তাবোধের ধারণা তাদের জনপ্রিয় করছে। এক সময়ের ট্রেডিশনাল রাজনৈতিক দলগুলো চলে গেছে পেছনের সারিতে। লি পেন, উইলডার্স, গ্রিল্লও, ভিক্টর উরবান- এ নামগুলো এখন ইউরোপের রাজনীতিতে বারবার আলোচিত হচ্ছে। হল্যান্ডে গ্রিয়ার্ট উইলডার্সের দল নির্বাচনে সনাতন রাজনৈতিক দলগুলোকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় হয়েছিল, অনেকটা ফ্রান্সের লি পেনের মতো। লি পেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে (ফ্রান্সে) দ্বিতীয় হয়েছিলেন। তাদের সবার মধ্যে একটা মিল আছে। এরা সবাই শরণার্থীবিরোধী তথা মুসলমানবিরোধী। এরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের ধারণারও বিরোধী। উগ্র জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ দ্বারা সবাই চালিত। তাই সঙ্গত কারণেই যে প্রশ্নটি ওঠে তা হচ্ছে, এই উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনা ইউরোপকে কোথায় নিয়ে যাবে? ২৮টি দেশ নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠিত। লোকসংখ্যা প্রায় ৫১০ মিলিয়ন। ১৯৯৯ সালে একক মুদ্রার (ইউরো) সিদ্ধান্ত নিলেও তা কার্যকর হয় ২০০২ সালে, যদিও মাত্র ১৯টি দেশ ইউরো চালু করেছে নিজ দেশের মুদ্রাকে অবলুপ্ত করে। ১৯৫১ সালে প্যারিস চুক্তির মধ্য দিয়ে ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিউনিটি তার যাত্রা শুরু করলেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ১৯৯৩ সালে। ১৬ দশমিক ৪৭৭ ট্রিলিয়ন ডলারের ইইউর যে অর্থনীতি, তা বিশ্বের জিডিপির প্রায় ২৩ ভাগ। বড় অর্থনীতির এ সংস্থাটি বিশ্ব আসরে এতদিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিল। এখন এতে বিভক্তি আসছে। তৈরি হচ্ছে নানা জটিলতা। এ জটিলতা, বিভক্তি, দ্বন্দ্ব ইউরোপীয় ইউনিয়নকে কোথায় নিয়ে যাবে, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন।
সিরিয়া ও ইরাকের সংকট লাখ লাখ মানুষকে দেশান্তরিত করেছে। ১০ লাখ মানুষকে আশ্রয় দিয়ে জার্মানির অ্যাঙ্গেলা মার্কেল মানবতার যে পরিচয় দিয়েছিলেন ২০১৫-১৬ সালে, তা ইতিহাসে নজিরবিহীন। তার ওই সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হলেও রাজনীতির দিক থেকে তিনি একটা ঝুঁকি নিয়েছিলেন। তিনি রাজনীতির জুয়া খেলেছিলেন। এতে তিনি বিজয়ী হতে পারেননি। এ শরণার্থী সংকট ইউরোপের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে জটিল করেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শরণার্থীবিরোধী অবস্থান। বলার অপেক্ষা রাখে না, ট্রাম্পের মনোভাব ও নীতির কারণে ইউরোপের উগ্র দক্ষিণপন্থী সংগঠনগুলো উৎসাহিত হয়েছে। প্রশ্নটা তাই সে কারণেই- কেমন ইউরোপ আমরা দেখব আগামী দিনে?
অনেক কিছুই ঘটতে পারে। উগ্র নব্য-নাৎসি সংগঠনগুলো এখন ইউরোপের প্রতিটি দেশে শক্ত অবস্থান নিয়ে গোটা ইউরোপে একটি
ফ্যাসিস্ট অ্যালায়েন্স গড়ে তুলবে এবং ইউরোপের সমাজে যে বহুত্ববাদ, অর্থাৎ বহু সংস্কৃতির মিলন, তা ভেঙে যাবে। কাতালোনিয়ার মতো অনেক বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রদেশ নিজ নিজ দেশ থেকে আলাদা হতে চাইবে। ব্রিটেনের মতো কিছু দেশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যেতে চাইবে। একইসঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাঝে দুটি ব্লকের আত্মপ্রকাশ ঘটবে : জার্মানি ও ফ্রান্সের নেতৃত্বে একটি ব্লক। এ ব্লক ধনী এবং এরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবে। আর গ্রিসের নেতৃত্বে গরিব দেশগুলোর একটি ব্লক, যারা পরিপূর্ণভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল থাকবে। তাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর দিকে এখন লক্ষ থাকবে অনেকের।
গত দুই সপ্তাহ ধরে ইউরোপে ঘুরেছি। ফ্রান্স থেকে জার্মানি ও চেক রিপাবলিক। দেখছি নতুন এক
রাজনীতির দিকে যাচ্ছে ইউরোপ। এই ইউরোপ কেমন হবে, তার রাজনীতি কেমন হবে এসব দেখার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে মাত্র।


মিয়ানমারের ব্লাফ গেম!

ঢাকা সফর করে গেলেন মিয়ানমারের মন্ত্রী কিয়াও টিন্ট সোয়ে। ওই সফরে একটি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। মিয়ানমারের মন্ত্রী হাসিমুখে জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়া হবে। এই আশ্বাসের মাধ্যমে কি মিয়ানমারের গণহত্যাকারীদের আড়াল করা হল? সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উত্থাপিত ৫ দফা নিয়ে আলোচনা হয়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, এ আলোচনা পাঁচ দফা সম্পর্কিত নয়। আমরা একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। প্রক্রিয়াটি শুরু হল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন এ ধরনের কথা বলেন, তখন আমি অবাক না হয়ে পারি না। কারণ প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে উত্থাপিত তার ৫ দফায় বাংলাদেশের নীতিগত অবস্থান তুলে ধরেছেন। দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় এ ৫ দফা কেন উত্থাপিত হল না, আমি বুঝতে অক্ষম। নিঃসন্দেহে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন মূল ইস্যু। কিন্তু ৫ দফার সঙ্গে সুস্পষ্ট রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান আছে। এই তথাকথিত ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন এ সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। আমরা মোটামুটিভাবে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ফলাফল জানি। অতীতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা হয়েছে; কিন্তু ফলাফল শূন্য।


৪-৫ লাখ রোহিঙ্গা আগে থেকেই কক্সবাজার এলাকায় শরণার্থী ক্যাম্পে ও এর আশপাশের এলাকায় বসবাস করে আসছিল। এখন এদের সঙ্গে যুক্ত হল আরও ৫ লাখের ওপর। অর্থাৎ প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা এখন অবৈধভাবে বাংলাদেশে বসবাস করছে। আন্তর্জাতিক চাপের কারণে মিয়ানমারের মন্ত্রী এসে বলে গেলেন তাদের নাগরিকদের তারা ফিরিয়ে নেবেন। এটা যে স্রেফ ভাঁওতাবাজি ও সময়ক্ষেপণ করা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের নামে মিয়ানমার আমাদের স্রেফ ব্লাফ দিল! আমরা তাদের আশ্বাসকে যদি বিশ্বাস করি তাহলে ভুল করব। দিব্যি দিয়ে বলতে পারি, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে না। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারলাম না। চাপ সৃষ্টি করার একটা কৌশল হচ্ছে মিয়ানমারে গণহত্যার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচার দাবি করা। এই গণহত্যার কথা আন্তর্জাতিক মিডিয়া বলেছে, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের প্রধান বলেছেন। সুতরাং বাংলাদেশ এ প্রশ্ন তুলতেই পারে এবং এর মাধ্যমে মিয়ানমারকে চাপে রাখা সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশ এ পথটি এড়িয়ে গেল! এতে করে কি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে মিয়ানমার?

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ অতি সম্প্রতি ছাপা হয়েছে, যা গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। প্রথম খবরটি এসেছে মালয়েশিয়া থেকে। মিয়ানমারে গণহত্যার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচারের জন্য সেখানে একটি গণআদালত গঠিত হয়েছিল। গত ২২ সেপ্টেম্বর পার্লামেন্ট পিপল্স ট্রাইব্যুনাল (পিপিটি) নামে এ আন্তর্জাতিক গণআদালত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অং সান সু চি ও দেশটির সেনাপ্রধানকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। রোহিঙ্গা ও কাচিনদের ওপর চালানো গণহত্যা ও নিষ্ঠুর নিপীড়নের তদন্তে যুক্ত বিশিষ্টজন ও খ্যাতনামা আইনজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত সদস্যদের বিচারক প্যানেল এ রায় দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ম্যাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোসাইড স্টাডিজ অ্যান্ড প্রিভেনশনের গবেষক অধ্যাপক গ্রেগরি স্ট্যানটনও জবানবন্দি দেন। আদালত ওই রায়ের আলোকে ১৭টি সুপারিশ করেছে, যা জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে পাঠানো হবে।

দ্বিতীয় খবরটি এসেছে জাতিসংঘ থেকে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সর্বসম্মতিক্রমে ইরাকে একটি তথ্যানুসন্ধান টিম পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ টিমের উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) জঙ্গিরা সেখানে কী ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, সে ব্যাপারে তথ্য অনুসন্ধান করা এবং ইরাক সরকারকে সাহায্য করা। ব্রিটেন এ প্রস্তাবটি উত্থাপন করে এবং ১০ লাখ পাউন্ড (১৩ লাখ ৩৫ হাজার মার্কিন ডলার) দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। যারা আইএস কর্তৃক নির্যাতিত হয়েছে, তাদের কিছুটা
সুবিধা দেয়ার জন্যই এই অর্থ দেয়া হবে। এখানে বলে রাখা ভালো, ২০১৪ সালে আইএসের জঙ্গিরা ইরাকের উত্তরাঞ্চলে সিনজির পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত ইয়াজেদি সম্প্রদায়ের ওপর বড় ধরনের জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেছিল, যাকে পরবর্তীকালে জাতিসংঘ গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করেছে। ওই সময় শত শত ইয়াজেদি তরুণীকে ধরে এনে তাদের যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তাদের করুণ কাহিনী ওই সময় সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। এখন নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইয়াজেদি সম্প্রদায়ের ওপর যে নির্যাতন ও গণহত্যা হয়েছে, তা তদন্তে একটি তথ্যানুসন্ধান টিম গঠন করা হবে।

উপরে উল্লিখিত দুটো সংবাদ বিচ্ছিন্ন হলেও একটা মিল আছে- যুদ্ধাপরাধের বিচার ও দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা। এটা সত্য, মালয়েশিয়ার পিপিটির কোনো আইনগত বৈধতা নেই। এটা সিম্বলিক অর্থাৎ প্রতীকী আদালত। কিন্তু এর একটি প্রতিক্রিয়া আছে। এ ধরনের ঘটনা একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠনে সহায়তা করে থাকে। রোম স্ট্যাটিটিউটে (১৯৯৮, কার্যকর ২০০২) এ ধরনের আদালত গঠন করার কথা বলা হয়েছে। আগামীতে ইরাকে এ ধরনের আদালত গঠিত হবে এবং আমাদের ধারণা আমরা যদি মিয়ানমারের গণহত্যার ঘটনা সত্যিকারভাবে আন্তর্জাতিক আসরে তুলে ধরতে পারি, তাহলে মিয়ানমারের ব্যাপারে একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠন করা সম্ভব হবে।

জশুয়া কুরলান্টসিক (Joshua Kurlantyick) গত ১ অক্টোবর The National-এ একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। প্রবন্ধটির শিরোনাম Aung San Suu Kyi is the bad gyu in the Rohingya crisis, but what about the man directly responsible for massacres? শিরোনাম থেকেই বোঝা যায় কী বলতে চেয়েছেন তিনি। যে কথাটা আমরা বারবার বলে আসছি, সে কথাটাই বলেছেন তিনি- অর্থাৎ গণহত্যা ও উচ্ছেদ অভিযানের দায় সু চি এড়াতে পারেন না। তবে তিনি বেশি দায়ী করেছেন সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিং অং হ্লাইংকে। তার মন্তব্য অনেকটা এরকম :
It needs to give the Mayanmar generals a serious warning. Doing so might lead the military to halt its atrocities, but more importantly, it would suggest that army leaders cannot continue a scorched earth policy and let Ms. Suu Kyi take all the public criticism. পশ্চিমাদের উচিত জেনারেল অং হ্লাইংকে একটা কড়া মেসেজ দেয়া।

ব্যবসায়িক ও কর্পোরেট স্বার্থ এখানে এত বেশি যে, পশ্চিমা বিশ্ব এই জেনারেলকে এখনও সমীহ করে চলছে। খোঁজ নিয়ে দেখেছি, ব্যক্তিগত পর্যায়ে জেনারেল হ্লাইং পশ্চিমা বিশ্বের অনেক সরকারপ্রধানের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে আসছেন। লক্ষ্য করে দেখবেন পশ্চিমা নেতারা কিন্তু সরাসরি জেনারেল হ্লাইংকে আক্রমণ করে কোনো বক্তব্য রাখেননি। গত এক বছরে জেনারেল হ্লাইং জার্মানি, ইতালি, জাপান, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম সফর করেছেন এবং প্রতিটি দেশে তাকে লাল কার্পেট সংবর্ধনা দেয়া হয়েছে। বেলজিয়ামে তিনি (নভেম্বর ২০১৬) ইউরোপীয় ইউনিয়নের মিলিটারি কমিটির কাছে বক্তব্য রেখেছেন। ইতালিতে তিনি অস্ত্র ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। জার্মানিতে গিয়েছিলেন ২০১৭ সালের এপ্রিলে। জাপানেও তিনি গিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য প্রধানত দুটো : এক. এসব দেশ থেকে অস্ত্র ক্রয় করা; দুই. নিজেকে মিয়ানমারের মূল নেতা হিসেবে উপস্থাপন করা। এতদিন চীনের অস্ত্রশস্ত্রের ওপর নির্ভরশীল ছিল মিয়ানমার। এখন জেনারেলরা এ নীতিতে পরিবর্তন এনেছেন। ভারত থেকেও টর্পেডো (যা সাবমেরিন ধ্বংসের কাজে ব্যবহৃত হয়) কিনেছেন জেনারেলরা। জেনারেল হ্লাইং ভারতেও গিয়েছিলেন। ভারত সফরে (জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান শুরুর আগে) তিনি মোদি ও অজিত দোভালের সঙ্গে দেখাও করেছেন। অজিত দোভাল ভারতের শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা। ২৬ আগস্ট রাখাইন রাজ্যে গণহত্যা শুরুর আগে দোভালের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ অনেক প্রশ্নের জন্ম দিতে বাধ্য। বলা ভালো, রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশ ভারতের সমর্থন পায়নি। ভারত মূলত সমর্থন করেছে মিয়ানমারকে। এমনকি মিয়ানমারে যে মুসলিম গণহত্যা হয়েছে, তারও নিন্দা করেনি ভারত। এতে জেনারেল হ্লাইং ও স্থানীয় সেনা কমান্ডাররা উৎসাহিত হয়েছেন গণহত্যায়। অতীতে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান এভাবে কখনও বিদেশ সফর করেননি। জেনারেল হ্লাইং নিজেকে তৈরি করছেন পরবর্তী প্রেসিডেন্টের জন্য। বর্তমান প্রেসিডেন্ট হটিন কিঅ (Htin Kyaw) দায়িত্ব নিয়েছেন ২০১৬ সালের ৩০ মার্চ। ১৯৬২ সালের পর তিনিই প্রথম সিভিলিয়ান প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। আমাদের ধারণা, বর্তমান প্রেসিডেন্টের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর জেনারেল হ্লাইং হবেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট, যে কারণে বহির্বিশ্বে তিনি অস্ত্র ক্রয়ের নামে জনসংযোগ তৈরি করছেন। মিয়ানমারের জিডিপির পরিমাণ ৭২ দশমিক ৩৬৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ দেশে রয়েছে তেল, গ্যাসসহ প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ। সুতরাং পশ্চিমা বিশ্বের যে আগ্রহ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। আর এ আগ্রহটাকে ব্যবহার করেই জেনারেল হ্লাইং তার ভবিষ্যৎ পথ পরিষ্কার করছেন। কিন্তু গণহত্যার মূল হোতা তিনি।

এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও বাংলাদেশ যদি মিয়ানমারের মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা বিচারের ব্যাপারে সোচ্চার না হয়, তাহলে পৃথিবীর অন্যত্র যেসব গণহত্যা হয়েছে, তার বিচার নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। অতি সম্প্রতি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমার নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু প্রধানত দুটি বড় শক্তি চীন ও রাশিয়ার কারণে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয়নি। পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দেই- গেল বছর মিয়ানমারের সেনাপ্রধান রাশিয়া সফর করেছিলেন। ওই সফরে তিনি সামরিক অস্ত্র ক্রয়ের ব্যাপারে কয়েক মিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি করেছিলেন। চীনের যে মিয়ানমারে অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে, তা আমরা আগেই আলোচনা করেছি। যুক্তরাষ্ট্রেরও অর্থনৈতিক ও স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে বলে মনে হয়। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকে জাতিসংঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার একটি প্রস্তাব দিয়েছেন। এর পাশাপাশি বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। দীর্ঘদিন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বলবৎ ছিল। ওবামা প্রশাসনের আমলে তা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। কিন্তু এখন প্রমাণিত হয়েছে, তথাকথিত গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে সেনাবাহিনীই মূলত দেশটি চালাচ্ছে। আর তাতে সমর্থন রয়েছে সু চির।

সু চির মন্ত্রীর সফরে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আমরা পেলাম না। কবে প্রত্যাবাসন শুরু হবে, মিয়ানমারে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে কীভাবে, কিংবা সেখানে শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা হবে কিনা, এ ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। সুতরাং এটা বোঝাই যায়, কিয়াও টিন্ট সোয়ের এটি লোক দেখানো সফর। এর মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হবে না। বাংলাদেশকে এখন দু
ভাবে এগিয়ে যেতে হবে। এক. নিবারক কূটনীতি, অর্থাৎ যুদ্ধ নয়, কিন্তু আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খোঁজা। দুই. আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে মিয়ানমারের গণহত্যাকারীদের বিচারের দাবি তোলা এবং এ দাবির সপক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের কূটনীতি আরও সক্রিয় হতে হবে। বাংলাদেশ যদি দুর্বলভাবে তার পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করে, বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রশ্নে, তাহলে বিশ্ব আসরে বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল হবে মাত্র।

কাতালোনিয়ার গণভোট ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ

গত ১ অক্টোবর স্পেনের প্রদেশ কাতালোনিয়ায় অনুষ্ঠিত গণভোটে স্বাধীনতার পক্ষে রায় পড়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজনীতি এখন নতুন একটি মোড় নিল। গেল সপ্তাহে জার্মানিতে সাধারণ নির্বাচনে নব্য নাজি পার্টি হিসেবে খ্যাত অলটারনেটিভ ফর জার্মানি পার্টির বিজয়ে এবং পার্লামেন্টে তৃতীয় বৃহত্তম পার্টি হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর সারা ইউরোপ যখন উৎকণ্ঠিত, ঠিক তখনই এলো কাতালোনিয়ার গণভোটের খবর। গণভোটে ৯০ শতাংশ মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দিয়েছে। আর তাই কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা কার্লস পুইগদেমন্ত বলেছেন, ১২ হাজার ৩৯৭ বর্গমাইল আয়তনের কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই স্বাধীনতা কি স্পেন মেনে নেবে? কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবস্থানই বা কী হবে? গণভোটে স্বাধীনতার পক্ষে রায় পড়ায় চরম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে স্পেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। স্পেন সরকার এর সমালোচনা করেছে এবং স্পেনের একটি সাংবিধানিক আদালত বলেছেন, ১৯৭৮ সালের সংবিধানের ডিক্রি অনুসারে দেশকে বিভক্ত করা যাবে না। শুধু জাতীয় সরকারই গণভোটের আয়োজন করতে পারে। কিন্তু কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতারা স্বাধীনতার প্রশ্নে অনড়। এ ক্ষেত্রে কাতালোনিয়া যদি স্বাধীনতা ঘোষণা করে, তাহলে স্পেন সরকার সংবিধানের ১৫৫ ধারা প্রয়োগ করতে পারে। স্পেনের পার্লামেন্ট কাতালোনিয়ার জন্য যে স্বায়ত্তশাসন রয়েছে, তা বাতিল করতে পারে। পার্লামেন্ট হয়তো একটা রাজনৈতিক সমাধানের দিকে যেতে পারে। কিন্তু স্বাধীনতাকামীরা তা মানবে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। বলা ভালো, কাতালোনিয়ার জনসংখ্যা মাত্র ৭৫ লাখ ২২ হাজার। স্পেনের মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ মানুষ কাতালোনিয়ায় বসবাস করে। এই প্রদেশটির রাজধানী বার্সেলোনা। বার্সেলোনার ফুটবল টিম জগদ্বিখ্যাত। স্পেনের জাতীয় আয়ের ২০ শতাংশ আসে (২৫৫.২০৪ মিলিয়ন) এই প্রদেশ থেকে। ইউরো জোনের চতুর্থ বড় অর্থনৈতিক শক্তি হচ্ছে স্পেন। এখন কাতালোনিয়ায় বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন যদি শক্তিশালী হয়, যদি সত্যি সত্যিই কাতালোনিয়া ইউরোপে নতুন একটি রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তাহলে তা ইউরোপের অন্যত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আরো উৎসাহ জোগাবে।
বদলে যাচ্ছে ইউরোপের রাজনীতি। ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গেছে। উগ্র ডানপন্থী উত্থান ঘটেছে ইউরোপে, যারা নতুন করে ইউরোপের ইতিহাস লিখতে চায়। ফ্রান্সে উগ্র ডানপন্থী উত্থানের পাশাপাশি এখন জার্মানিতে উগ্র ডানপন্থী তথা নব্য নাজি উত্থান ইউরোপের রাজনীতি বদলে দিতে পারে। ভয়টা হচ্ছে জার্মানিতে এএফডির উত্থান নিয়ে। এরা পার্লামেন্টে থাকায় উগ্রবাদ বিস্তার ঘটবে। এটা বড় ধরনের ঘটনা নিঃসন্দেহে। নির্বাচনে নব্য নাজি পার্টি হিসেবে পরিচিত অলটারনেটিভ ফর জার্মানি (AFD) পার্টি প্রথমবারের মতো পার্লামেন্টে যাওয়ায় তা শুধু একটি বড় ধরনের ঘটনারই জন্ম দেয়নি, বরং ইউরোপের সনাতনপন্থী রাজনীতিবিদদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। চিন্তাটা হচ্ছে উগ্র ডানপন্থীদের উত্থান। এই ডানপন্থী উত্থান এরই মধ্যে ইউরোপে অনেক দেশে বিস্তৃত হয়েছে। জার্মানি বড় দেশ। বড় অর্থনীতি। বলা যেতে পারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার পর জার্মানিই হচ্ছে ইউরোপের নেতা। এখন সেই জার্মানিতেই যদি নব্য নাজিবাদের উত্থান ঘটে, তা যে একটা খারাপ সংবাদ বয়ে আনল, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। এএফডির জন্ম মাত্র চার বছর আগে, ২০১৩ সালে। মূলত মুসলমান বিদ্বেষ আর ব্যাপকহারে জার্মানিতে শরণার্থী আগমনকে কেন্দ্র করে (২০১৫ সালে ১৩ লাখ সিরীয়-ইরাকি শরণার্থীর জার্মানি প্রবেশ) এই দলটির জন্ম হয়। এরই মধ্যে তারা জার্মানির ১৬টি প্রদেশের মধ্যে ১৩টি প্রদেশ পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করছে। আরো মজার বিষয় হচ্ছে, সাবেক পূর্ব জার্মানি, যেখানে একসময় সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা চালু ছিল, সেখানে এই দলটির (এএফডির) প্রতিপত্তি এখন বেশি। চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল নিজেও পূর্ব জার্মানি থেকে এসেছেন।
নির্বাচনে এএফডি ১২ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট পেয়ে পার্লামেন্টে ৯৪টি আসন (মোট আসন ৭০৯) নিশ্চিত করেছে। সংখ্যার দিক থেকে ৯৪টি আসন খুব বেশি নয়। কিন্তু ভয়টা হলো, ইউরোপের প্রতিটি দেশে উগ্র ডানপন্থীরা একটি শক্ত অবস্থান নিয়েছে। যেমনঅস্ট্রিয়ায় ফ্রিডম পার্টি ভোট পেয়েছে ৩৫.১ (২০১৬), বেলজিয়ামে নিউ  ফ্লেমিস অ্যালায়েন্স ২০.৩ শতাংশ (২০১৪), ব্রিটেনে ইউকেআইপি ১২.৭ শতাংশ  (২০১৫), ডেনমার্কে পিপলস পার্টি ২১.১ শতাংশ (২০১৫), ফিনল্যান্ডে ফিনস পার্টি ১৭.৭ শতাংশ (২০১৫), ফ্রান্সে ন্যাশনাল ফ্রন্ট ২৭.৭ শতাংশ (২০১৫), হাঙ্গেরিতে ফিডেস-কেডিএনপি ৪৪.৮ শতাংশ (২০১৪), হল্যান্ডে পার্টি অব ফ্রিডম ১৩.১ শতাংশ (২০১৭), পোল্যান্ড ল অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি ৩৭.৬ শতাংশ (২০১৫), স্লোভাকিয়ায় ন্যাশনাল পার্টি ৮.৬ শতাংশ (২০১৬), সুইডেনে ডেমোক্রেটস ১২.৯ শতাংশ (২০১৪)  কিংবা সুইজারল্যান্ডে পিপলস পার্টি ২৯.৪ শতাংশ (২০১৫)। এখন এসব উগ্র দক্ষিণপন্থী দলগুলোর তালিকায় যুক্ত হলো এএফডির (জার্মানি) নাম। অথচ এই দলটি ২০১৩ সালে পেয়েছিল মাত্র ৪.৭ শতাংশ ভোট। ফলে পার্লামেন্টে তাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল না। ৫ শতাংশ ভোটের দরকার হয় পার্লামেন্টে যেতে। এই উগ্র ডানপন্থী উত্থান এখন ইউরোপের জন্য একটা হুমকি। এর প্রভাব ইউরোপের অন্য দেশগুলোয় পড়বে এটা স্বাভাবিক। ফ্রান্স ও ইতালিতে উগ্র দক্ষিণপন্থীরা সক্রিয়। এরা সবাই মিলে ইউরোপে উগ্র দক্ষিণপন্থী উত্থানের জন্ম দিতে পারে। তাই এএফডির উত্থান জার্মানির জন্য কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনবে না।
এএফডি চাচ্ছে ইউরো জোন থেকে জার্মানি বেরিয়ে আসুক। এটা নিশ্চয়ই মার্কেল করবেন না। কিন্তু তিনি চাপে থাকবেন। এ ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় কিছু সংস্কার আসতে পারে। ইইউতে জার্মানি বড় দেশ। দেশটির যেকোনো সিদ্ধান্ত ইইউর রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। দক্ষিণপন্থীদের ব্যাপক উত্থান পুরো ইউরোপের চেহারা ভবিষ্যতে বদলে দিতে পারে। শরণার্থী ইস্যুকে কেন্দ্র করে ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে গেছে। নির্বাচনে টেরেসা মে সেখানে সুবিধা করতে পারেননি। তিনি অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন আরেকটি দলের ওপর। এখন অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের অবস্থা হতে যাচ্ছে তেমনটি। কট্টরপন্থী এএফডিকে ব্যালান্স করার জন্য তাঁকে এখন দুটি বড় দল ও কোয়ালিশন পার্টনার এফডিপি ও গ্রিন পার্টিকে ছাড় দিতে হবে। এই দল দুটির মধ্যেও তাঁকে সমন্বয় করতে হবে। তিনি যদি ব্যর্থ হন, তাহলে নয়া নির্বাচন অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু এই ঝুঁকিটি এই মুহূর্তে কোনো দলই নিতে চাইবে না। কেননা, দ্রুত আরেকটি নির্বাচন মানে এএফডিকে আরো সুযোগ করে দেওয়া। নয়া নির্বাচন এএফডিকে একটি দর-কষাকষি অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে। এমনকি ক্ষমতাসীন সিডিইউ-সিএসইউকে বাধ্য করতে পারে গ্রিন পার্টিকে বাদ দিয়ে তাদের কোয়ালিশন সরকারে নিতে! শুধু তা-ই নয়, সিডিইউয়ের নেতৃত্ব থেকে মার্কেল সটকে পড়তে পারেন।
আগামী ২৪ অক্টোবর পার্লামেন্টের অধিবেশন বসছে। মার্কেল চ্যান্সেলরের দায়িত্ব নেবেন। মোট চারবার তিনি জার্মানিকে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পেতে যাচ্ছেন। এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় ঘটনা। তিনি কনরাড অ্যাডেনাওয়ার, হেলমুট কোল কিংবা উইলি ব্রান্ডের নামের তালিকায় নিজের নামটি অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হলেন বটে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, দ্রুত বদলে যাচ্ছে ইউরোপের রাজনীতি। কট্টর দক্ষিণপন্থী উত্থান ঘটছে। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের উত্থান এই শক্তিকে আরো শক্তিশালী করেছে। এখন দেখার পালা জার্মানিতে উগ্র ডানপন্থীর উত্থান অন্য দেশগুলোতে কতটুকু প্রভাব ফেলে। ফ্রান্সে যে প্রত্যাশা নিয়ে ম্যাক্রো ক্ষমতায় এসেছিলেন, সেই প্রত্যাশায় ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর জনপ্রিয়তা কমছে। মে মাসে তাঁর জনপ্রিয়তা যেখানে ছিল ৬২ শতাংশ, আগস্টে তা কমে এসে দাঁড়িয়েছে ৪০ শতাংশে (টাইম, অক্টোবর ৯, ২০১৭)। তাঁর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমেছে গত ২৩ সেপ্টেম্বর। বড় বিক্ষোভ হয়েছে সেখানে। ফ্রান্সে এসে লক্ষ করলাম, ম্যাক্রোর ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা কমছে। ফ্রান্সের রাজনীতি দীর্ঘদিন নিয়ন্ত্রণ করেছে একদিকে মধ্যপন্থী ডানরা, আর মধ্যপন্থী বামরা। এই দুটি বড় রাজনৈতিক দলের আদর্শ মানুষকে টানতে পারেনি। তাই নির্বাচনে (প্রেসিডেন্ট) তারা ম্যাক্রোকে বেছে নিয়েছিল। ম্যাক্রো মাত্র দুই বছর আগে একটি দল গঠন করে সাধারণ মানুষের কাছে গিয়েছিলেন। তাঁর তারুণ্য, স্পষ্ট বক্তব্য মানুষ গ্রহণ করেছিল। এখন ম্যাক্রো যদি ব্যর্থ হন, তাহলে লি পেনের উত্থানকে ঠেকানো যাবে না। সমস্যা আছে ইতালিতেও। একটি ভঙ্গুর সরকার সেখানে রয়েছে, যেকোনো সময় এই সরকারের পতন ঘটতে পারে। কমেডিয়ান বেপ্পে গ্রিল্লও এবং তাঁর নবগঠিত দল ফাইভ স্টার মুভমেন্ট-এর উত্থান ইতালির সনাতন রাজনীতির জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। এই দলটি শরণার্থীবিরোধী এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নবিরোধী। এরই মধ্যে ইতালি ৮০ হাজারের ওপরে শরণার্থী গ্রহণ করেছে। এই শরণার্থী আগমন ইতালির রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে বদলে দিয়েছে। জন্ম হচ্ছে নব্য নাজি পার্টির।
শরণার্থীদের ব্যাপকহারে ইউরোপে প্রবেশ শুধু জার্মানি, ফ্রান্স আর ইতালির রাজনীতিকেই বদলে দেয়নি, বরং পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, চেক রিপাবলিক আর স্লোভাকিয়ার রাজনীতিকেও বদলে দিয়েছে। শরণার্থীরা যখন ইউরোপে ব্যাপকহারে প্রবেশ করতে শুরু করে, তখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক ধরনের কোটা সিস্টেম আরোপ করেছিল। ওই কোটা সিস্টেমে প্রতিটি দেশকে শরণার্থী গ্রহণে নির্দিষ্ট কোটা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, চেক ও স্লোভাকিয়া তা মানতে অস্বীকৃতি জানায়। প্রতিটি দেশকে ১১ হাজার করে শরণার্থী নিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু এই দেশগুলো তা মানেনি। এমনকি হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়া ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিসে  আবেদন করলে তা বাতিল হয়। এসব দেশে শরণার্থীদের ব্যাপক অভিবাসনকে কেন্দ্র করে যেমনি একদিকে দক্ষিণপন্থী উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির উত্থান ঘটেছে, অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নবিরোধী মনোভাবও শক্তিশালী হচ্ছে।

বদলে যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজনীতি। নতুন নতুন রাজনীতিবিদের উত্থান ঘটছে ইউরোপে, যাঁরা তথাকথিত পপুলিজম-এর কারণে জনপ্রিয় হচ্ছেন। সস্তা স্লোগান, জাতীয়তাবোধের ধারণা তাঁদের জনপ্রিয় করছে। একসময়ের ট্র্যাডিশনাল রাজনৈতিক দলগুলো চলে গেছে পেছনের সারিতে। লিপেন, উইলডাস, গ্রিল্লাও, ভিক্টর উরবানএই নামগুলো এখন ইউরোপের রাজনীতিতে বারবার আলোচিত হচ্ছে। হল্যান্ডে গ্রিয়াট উইলডার্সের দল নির্বাচনে সনাতন রাজনৈতিক দলগুলোকে পেছনে ঠেলে দ্বিতীয় হয়েছিল, অনেকটা ফ্রান্সের মিরিয়ান লি পেনের মতো। লি পেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে (ফ্রান্সে) দ্বিতীয় হয়েছিলেন। তাঁদের সবার মধ্যে একটা মিল আছে। তাঁরা সবাই মুসলমান তথা শরণার্থীবিরোধী। তাঁরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের ধারণারও বিরোধী। উগ্র জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ দ্বারা সবাই চালিত। তাই সংগত কারণেই যে প্রশ্নটি ওঠে, তা হচ্ছে এই উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনা ইউরোপকে কোথায় নিয়ে যাবে? ২৮টি দেশ নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠিত। লোকসংখ্যা প্রায় ৫১০ মিলিয়ন। ১৯৯৯ সালে একক মুদ্রার (ইউরো) সিদ্ধান্ত নিলেও তা কার্যকর হয় ২০০২ সালে। যদিও মাত্র ১৯টি দেশ ইউরো চালু করেছে নিজ দেশের মুদ্রাকে অবলুপ্ত করে। ১৯৫১ সালে প্যারিস চুক্তির মধ্য দিয়ে ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিউনিটি তার যাত্রা শুরু করলেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ১৯৯৩ সালে। ১৬ দশমিক ৪৭৭ ট্রিলিয়ন ডলারের ইইউর যে অর্থনীতি, তা বিশ্বের জিডিপির প্রায় ২৩ শতাংশ। বড় অর্থনীতির এই সংস্থাটি বিশ্ব আসরে এত দিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিল। এখন এতে বিভক্তি আসছে। তৈরি হচ্ছে নানা জটিলতা। এই জটিলতা, বিভক্তি, দ্বন্দ্ব ইউরোপীয় ইউনিয়নকে কোথায় নিয়ে যাবে, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন।