রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

অনেক সংবাদ, প্রশ্নও অনেক




করোনাভাইরাস নিয়ে অনেক সংবাদ এখন পত্রপত্রিকায়। একটি সংবাদে বলা হয়েছে, ভয়ানক করোনাভাইরাসের জোরে যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যু হতে পারে ২২ লাখ মানুষের, আর ব্রিটেনে এ সংখ্যা পাঁচ লাখের মতো। একটি প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।  প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন ইম্পিরিয়াল কলেজ অব লন্ডনের ম্যাথম্যাটিক্যাল বায়োলজির অধ্যাপক ফার্গুসন। ফার্গুসনের গবেষণাদল জানিয়েছে, সঠিক পদক্ষেপ না নিলে মৃত্যুর সংখ্যা আরো বাড়বে। এর সঙ্গে তিনি ১৯১৮ সালে ফ্লু আউটব্রেকের তুলনা করেছেন। (নিউজ ১৮ বাংলা, ১৮ মার্চ) এই প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কি না জানি না, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন সব ধরনের সামাজিক জীবনযাপন বন্ধ করে দিয়েছেন। সেই সঙ্গে ৭০-এর বেশি বয়স্ক অসুস্থদের ক্ষেত্রে প্রতিষেধক পদক্ষেপ হিসেবে একেবারে আইসোলেশনের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। তাঁর মতো কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোও ‘সেলফ আইসোলেশনে’ গেছেন। সেলফ আইসোলেশনে যাওয়ার তালিকায় নাম আছে আরো অনেকের। আরো এটি সংবাদ—ব্লুমবার্গের মতে, ভারত
পারে পরবর্তী রাষ্ট্র, যেখানে করোনাভাইরাসের ধস নামতে পারে। মুনেজা নাকভির একটি লেখা,  “India could be next virus hotspot with ‘Avalanche’ of cases” ছাপা হয়েছে ব্লুমবার্গ ম্যাগাজিনে গত ১৭ মার্চ। ওই প্রতিবেদনে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে অধ্যাপক ডা. শ্রীনাথ রেড্ডির। অধ্যাপক রেড্ডি হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথের অধ্যাপক। তিনি বলেছেন, Coronavirus spread puts demsely polulated India on high alert—ঘনবসতিপূর্ণ ভারতের জনগোষ্ঠীর জন্য হাই অ্যালার্ট। ভারত (কিংবা বাংলাদেশ) অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। ভারতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৪২০ জন মানুষ। এই ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়। যদি ‘প্রতিরোধের’ কোনো ব্যবস্থা করা না যায়, তাহলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ জন্যই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘সেলফ আইসোলেশন’ বা কোয়ারেন্টিনের কথা। এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে একটি মহামারি। এই মহামারি এখন ছড়িয়ে গেছে চীন থেকে ইউরোপে। ইউরোপের অনেক দেশ এখন ‘লকডাউন’—অর্থাৎ বিশ্ব থপরিপূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। মানুষ এখন গৃহবন্দি। ইতালি, স্পেন এখন সংবাদপত্রের পাতায়। বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, পরবর্তী ‘হটস্পট’ হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া। ভারতে এরই মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে ১২২ জন আর বিদেশি ২৫ জন। সবচেয়ে বেশি সংক্রমিত হয়েছে মহারাষ্ট্রে, ৪১ জন।

পাকিস্তানেও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশ আছে বড় ধরনের ঝুঁকিতে। বুধবার করোনাভাইরাসে একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের ১১টি দেশে করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে জরুরি ভিত্তিতে এবং কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এই আহ্বান জানিয়েছেন সংস্থাটির মহাপরিচালক ড. টেড্রোস আধানম গ্রেব্রিয়েসিস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া প্রতিহত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে সন্দেহভাজনদের শনাক্ত করা, পরীক্ষা করা, আলাদা করা, চিকিৎসা করা এবং রোগীর সংস্পর্শে যারা এসেছিল, তাদের শনাক্ত করা (বিসিসি)। কিন্তু আমরা কি বিশ্ব সংস্থার উপদেশগুলো গ্রহণ করতে পেরেছি? গ্রহণ করতে পারলে কতটুকু করতে পেরেছি? বাংলাদেশ নিয়েও আছে আতঙ্কের খবর। পত্রিকার খবর—যাঁরা ইতালি থেকে এসেছেন, তাঁদের ‘হোম কোয়ারেন্টিনে’ থাকার কথা বলা হলেও তাঁরা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছেন, বাজারে, যেখানে বিপুল মানুষের জমায়েত থাকে, সেখানে যাচ্ছেন। মানুষের সঙ্গে করমর্দন করছেন। তাঁরা যে কত বড় ঝুঁকি সৃষ্টি করেছেন, তা হয় তাঁরা বোঝেন না অথবা তাঁদের ‘হোম কোয়ারেন্টিনে’ রাখতে বাধ্য করা যায়নি। এ ব্যর্থতা কাদের? এটি কি এক ধরনের শৈথিল্য নয়? সরকার সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কায় স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়েছে, যাতে বহু মানুষের উপস্থিতির কারণে রোগটি সংক্রমিত হতে না পারে। কিন্তু আমরা কী দেখলাম? শত শত মানুষ ছুটে গেছে কক্সবাজারে। সি-বিচে শত শত মানুষ পাশাপাশি হাঁটছে—এ ছবি প্রকাশিত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। লক্ষ্মীপুরে লক্ষাধিক লোকের সমাবেশে করোনামুক্তির দোয়া চাওয়া হয়েছে—এসংক্রান্ত প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে একটি ইংরেজি দৈনিকে।

যেখানে যেকোনো ধরনের জমায়েতকে নিরুৎসাহ করা হয়েছে, যেখানে জমায়েত থেকে রোগটি সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি, সেখানে স্থানীয় প্রশাসন কী করে এবং কোন যুক্তিতে লক্ষাধিক লোকের জমায়েতের অনুমতি দিল? আমাদের সচেতনতা যে আদৌ বৃদ্ধি পায়নি, এটি একটি বড় দৃষ্টান্ত। ইন্দোনেশিয়ার একটি ছবি ছাপা হয়েছে—সেখানে দেখা যায়, স্বাস্থ্যকর্মীরা বিমানবন্দর, বাস-ট্রেন স্টেশন, এটিএম বুথ, দোকান ইত্যাদিতে নিয়মিত জীবাণুনাশক স্প্রে করছেন। কিন্তু বাংলাদেশে কি এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে? অন্তত আমার চোখে তা ধরা পড়েনি। প্রতিদিনই প্রেস ব্রিফিং হচ্ছে। কিন্তু পাবলিক প্লেসে স্প্রে করার প্রয়োজনীয়তার কথা কি হচ্ছে সেখানে?

আবার ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম  পাবলিক প্লেসে হাত ধোয়ার বেসিন স্থাপন করে একটি ‘ফটোসেশন’ করেছেন। হাত ধোয়া জরুরি, সন্দেহ নেই। সেটি প্রকাশ্যে পাবলিক প্লেসে না করে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নিচে স্থাপন করা জরুরি ছিল। এর চেয়েও জরুরি জীবাণুনাশক ওষুধ প্রতিদিন স্প্রে করা। সামনে আসছে ডেঙ্গুর ‘সিজন’। আমাদের কর্তব্য কী এখানে? দুই নির্বাচিত মেয়রের দায়িত্বটি কী? এমনিতেই করোনাভাইরাস নিয়ে আমরা বিপদে আছি। এখন আসছে ডেঙ্গুর সিজন। আমরা কতটুকু সচেতন? আমরা যেন গেল বছরের ডেঙ্গু পরিস্থিতির কথা ভুলে না যাই।

আরো একটি কথা। দেশে মহামারি রোগ আইন চালু করা জরুরি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সম্প্রতি করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ১৮৯৭ সালের ‘দি এপিডেমিক ডিজিজেস অ্যাক্ট’ বা মহামারি রোগ আইন প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ আইন হলো : ১. করোনা সন্দেহভাজন ভর্তি হতে না চাইলে বলপূর্বক ভর্তি করানো, ২. সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে করোনা পরীক্ষা, ৩. রোগী করোনাকবলিত দেশ থেকে এলে রিপোর্ট করা, ৪. রোগী শনাক্তে স্থানীয় প্রশাসনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা ইত্যাদি। এটি জরুরি এ কারণে যে বিদেশ থেকে প্রবাসী যেসব বাংলাদেশি দেশে এসেছেন, বিশেষ করে ইতালি থেকে যাঁরা ফেরত এসেছেন তাঁরা কোনো ধরনের ‘নির্দেশনা’ পালন করছেন না। তাঁদের ‘আইসোলেশনে’ থাকার কথা; কিন্তু থাকছেন না। এরই মধ্যে একজনকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়েছে। এ ধরনের একটি আইন করা হলে তা প্রশাসনের জন্য বিদেশ প্রত্যাগতদের ‘নিয়ন্ত্রণে’ আনতে সহজ হবে। বিশ্ব সত্যিকার অর্থেই বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে আছে, যাকে কেউ কেউ ‘স্বাস্থ্যযুদ্ধ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

করোনাভাইরাস যে শুধু চীন ও ইউরোপে একটি স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করল, তেমনটি নয়। বরং তা বিশ্বব্যবস্থায়ও আঘাত হেনেছে। করোনাভাইরাস প্রমাণ করল, পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহতার চেয়ে এই ভাইরাসের ঝুঁকি কম নয়। আমরা এটিকেই বলছি অপ্রচলিত নিরাপত্তাঝুঁকি। প্রচলিত নিরাপত্তাঝুঁকির চেয়েও এই ঝুঁকি অনেক বেশি। করোনাভাইরাসে এ পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়েছে। সার্স (২০০২-২০০৩), মার্স (২০১২), ইবোলা (২০১৪), এইচওয়ান এনওয়ান ফ্লু (২০০৯), জিকা ভাইরাসে (২০১৫) আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষ মারা গিয়েছিল। ফলে ধারণা করছি, আমরা ভবিষ্যতে এ ধরনের অনেক নতুন মহামারি রোগের সংস্পর্শে আসব। এ ধরনের অনেক রোগ, যার প্রতিষেধক এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি, আমাদের জননিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেবে। বাংলাদেশ বিপুল জনসংখ্যাধিক্য দেশ। এখানে যেকোনো ধরনের মহামারি আমাদের নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটাবে। চীন করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় যেসব উদ্যোগ হাতে নিয়েছে, পশ্চিম ইউরোপ কিংবা যুক্তরাষ্ট্র যা করতে পেরেছে, আমরা তা পারব বলে মনে হয় না। আমাদের দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। বিশেষায়িত হাসপাতালও আমাদের নেই। নেই ওষুধও। ফলে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব যদি নিয়ন্ত্রণের মাধ্য আনা না যায়, বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এ দেশের নিরাপত্তা বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে থাকবেই। তবে এটি ঠিক, একটি জনসচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে মানুষ বুঝতে পারছে না এর ভয়াবহতা। করোনাভাইরাসের কারণে মুজিববর্ষের মূল অনুষ্ঠানে কাটছাঁট করা হয়েছিল, বিদেশি অতিথিরাও আসেননি। পুরো অনুষ্ঠান পুনর্বিন্যাস করা হয়েছিল। তবে আরো কর্মসূচি নেওয়া প্রয়োজন। বিমানবন্দরগুলোতে করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য যেসব থার্মাল স্ক্যানার রয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। ইতালি থেকে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ কভিড-১৯-এর জীবাণু বহন করে থাকতে পারেন। আমাদের ভয় এখানেই। এরই মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের যে পরিসংখ্যান আমরা পেয়েছি, তা এ রকম : পাকিস্তানে ২৩৬ জন (মৃত্যু একজন), ভারতে ১৩৭ জন (মৃত্যু তিনজন), শ্রীলঙ্কায় ৪৩ জন, আফগানিস্তানে ২২ জন, মালদ্বীপে ১৩ জন, বাংলাদেশে ১৩ জন (মৃত্যু একজন), নেপালে একজন ও ভুটানে একজন। বাংলাদেশে ভয়াবহতা এখনো ছড়িয়ে পড়েনি—আমাদের আশার জায়গাটি এখানেই।

আন্তর্জাতিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের জানাচ্ছে করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে কী পরিমাণ ক্ষতি হতে যাচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বনেতাদের কেউ কেউ এরই মধ্যে ‘সেলফ কোয়ারেন্টিনে’ গেছেন। ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ এরই মধ্যে করোনাভাইরাসের ভয়ে বাকিংহাম প্রাসাদ ছেড়েছেন। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বলসোনারের আক্রান্ত হওয়ার খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজে পরীক্ষা করিয়েছেন। তবে তাঁর শরীরে করোনাভাইরাস পাওয়া যায়নি। আরো অনেক দেশের প্রেসিডেন্ট, শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্ব ‘হোম কোয়ারেন্টিনে’ যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। প্রাপ্ত তথ্য মতে, এখন পর্যন্ত মোট চারটি দেশে (চীন, ইতালি, ইরান ও দক্ষিণ কোরিয়া) ৯০ শতাংশ সংক্রমিত রোগীর অস্তিত্বের খবর পাওয়া গেছে। দ্য গ্লোবালিস্টের  (The Globalist) তথ্য মতে, ইতালিতে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে সংক্রমিত রোগীর হার ২০.৬২ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ায় এই সংখ্যা ১৫.২ শতাংশ। বাকি দেশগুলোর পরিসংখ্যান অনেকটা এ রকম—ইরানে ১১, স্পেনে ৪.৮৭, যুক্তরাষ্ট্রে ০.৫৩। তবে এই পরিসংখ্যান দ্রুত বদলে যাচ্ছে। স্পেনে সংক্রমণের হার বাড়ছে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এক মহাবিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন। ফলে জরুরি ভিত্তিতে আমাদের কিছু কাজ করা দরকার। ১. মন্ত্রীদের গণসংযোগ হ্রাস করা ও যেকোনো ধরনের গণজমায়েত নিষিদ্ধ করা। মিলাদ মাহফিল কিংবা ওয়াজ মাহফিল আপাতত নিষিদ্ধ করা; ২. বিশেষ বিশেষ এলাকায় কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করা। হাসপাতাল, স্কুল-কলেজগুলোকে কোয়ারেন্টিনে পরিণত করার ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া। কোনো বসতি এলাকায় কোয়ারেন্টিন করা যাবে না; ৩. সেনাবাহিনীর দক্ষতা ব্যবহার করা; ৪. চীনের সহযোগিতা নিয়ে দ্রুত স্বাস্থ্যকর্মী তৈরি করা; ৫. সাময়িকভাবে হলেও সব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বন্ধ করে দেওয়া; ৬. ঢাকার সঙ্গে অন্য জেলার যোগাযোগে বিধি-নিষেধ আরোপ করা। বাস চলাচল বন্ধ করে দেওয়া; ৭. জনগণকে মাস্ক পরতে বাধ্য করা; ৮. বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত রাখা; ৯. অফিসে বসে যাতে কাজ করা যায়, সেই ওয়ার্ক কালচার কিছুদিনের জন্য হলেও চালু করা
Kalerkontho
22.03.2020

সংক্রমিত বিশ্ব রাজনীতি ও বাংলাদেশ

I

রোনাভাইরাস

 

করোনাভাইরাস বা কভিড-১৯ বদলে দিয়েছে বিশ্বকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বোধকরি বিশ্ব এত বড় সংকটের মুখে আর পড়েনি। করোনা পরিস্থিতি চীনে যখন কিছুটা উন্নতি হয়েছে, ঠিক তখনই 'লক-ডাউন' হয়ে গেছে ইউরোপের অনেক দেশ। এই পরিস্থিতির সঙ্গে নাইন-ইলেভেন পরিস্থিতি কিছুটা মিল থাকলেও বর্তমান সংকট একটা ভিন্নমাত্রা এনে দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে জানানো হচ্ছে, বিশ্বের প্রায় ১৫৮টি দেশে কভিড-১৯ সংক্রমিত হয়েছে। প্রায় প্রতিটি দেশই কভিড-১৯ ঠেকাতে বিশেষ বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সংবাদপত্র থেকে জানা গেছে, আরব আমিরাতের সব মসজিদের নামাজ চার সপ্তাহের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। তবে প্রতি ওয়াক্তের আজান হবে। প্রতিটি গালফ স্টেটে মসজিদে নামাজ আদায় আপাতত নিরুৎসাহিত করা হয়েছে (আলজাজিরা)। সৌদি আরব ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসের ভয়ে বিদেশিদের ওমরাহ হজ পালন নিষিদ্ধ করেছে। সৌদি আরবের মসজিদ আল হারাম, মসজিদে নববিতে নামাজ আদায়ও নিষিদ্ধ হয়েছে (মেইল অনলাইন)। ফ্রান্সেও মসজিদে নামাজ আদায় নিষিদ্ধ হয়েছে (আরব নিউজ)। ফিলিস্তিনে বিখ্যাত আল-আকসা মসজিদ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার মতো মুসলিমপ্রধান দেশেও মসজিদে নামাজ আদায় নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতির গভীরতা কতটুকু, তা ওপরে উল্লিখিত সংবাদগুলো পাঠ করলেই বোঝা যায়।

অনেক দেশে বিমান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বিমানবন্দরে এখন আর ইউরোপ থেকে কোনো বিমান অবতরণ করতে পারছে না। এরপরও যেসব যাত্রী অন্য দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসছেন, তাদেরকে দীর্ঘ সময় বিমানবন্দরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একজন যাত্রীকে ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে। বোঝাই যায়, পরিস্থিতি আজ কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। এটা এক ধরনের 'স্বাস্থ্যযুদ্ধ'। বিশ্ব এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি কখনও। এই স্বাস্থ্যযুদ্ধ মোকাবিলা করার মতো মারণাস্ত্র এখন পর্যন্ত মানবসভ্যতা আবিস্কার করতে পারেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি ইনজেকশন আবিস্কার ও তা মানুষের শরীরে পুশ করার দৃশ্য সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। কিন্তু আমরা এখনও নিশ্চিত নই, তা করোনা প্রতিরোধে কতটুকু সফল হবে।

ইতোমধ্যে বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে এনেছে করোনাভাইরাস। কয়েকটি পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ করোনাভাইরাসের ভয়ে বাকিংহাম প্রাসাদ ছেড়েছেন। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজে পরীক্ষা করিয়েছেন। তবে তার শরীরে করোনাভাইরাস পাওয়া যায়নি। অনেক দেশের প্রেসিডেন্ট, শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্ব হোম কোয়ারেন্টাইনে গেছেন।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এক মহাবিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন। অতীতে এ ধরনের ভাইরাসে যত বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল, তার একটি তথ্য দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ১৯১৮-২০ সালে স্প্যানিস ফ্লুতে মারা গিয়েছিল ১০ কোটি মানুষ, ১৯৮১-২০১৭ এইচআইভিতে চার কোটি, ২০০২ সালে সার্সে ৭৭৪ জন, ২০০৯-এ সোয়াইন ফ্লুতে ২,৮৪,৫০০ জন, ২০১৩-১৬ সালে এভিয়ান ফ্লুতে ২৯৫ জন, ২০১৪-১৬ সালে ইবোলা ভাইরাসে ১১,৩২৫ জন। করোনাভাইরাসে ইতোমধ্যে ৭৫১৮ জনের মৃত্যু রেকর্ড হয়েছে। এই মৃত্যুর মিছিল কোথায় গিয়ে শেষ হবে, আমরা এই মুহূর্তে তা বলতে পারছি না। বলার অপেক্ষা রাখে না, করোনাভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে আমরা এর প্রভাবটা হয়তো তেমন একটা উপলব্ধি করতে পারব না; কিন্তু ৫-৬ মাস পর বিপর্যয়টা ক্রমান্বয়েই স্পষ্ট হবে।

ব্লুমবার্গের মতে, বিশ্ব অর্থনীতি ২ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। সংস্থাটির মতে, চলতি বছরের প্রথম কোয়ার্টারে বিশ্ব জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যাবে ১ দশমিক ২ ভাগে। ব্লুমবার্গের গবেষণায় দেখা গেছে, যেহেতু সারাবিশ্ব চীনের পণ্য, কাঁচামাল আর প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল, সেহেতু চীনের অর্থনীতিতে স্থবিরতা দেখা দেওয়ায় চীনের সরবরাহে ঘাটতি সৃষ্টি হবে। এতে করে চীনের ওপর নির্ভরশীল প্রতিটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমবে। যদি পরিস্থিতির উন্নতি না হয়, তাহলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে। পাঠকদের একটু পেছনের দিকে নিয়ে যেতে চাই।
২০০৩ সালে সার্স ভাইরাসের কারণে চীনের প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ কমে গিয়েছিল; যার কারণে বিশ্বের অর্থনীতিতে ক্ষতি হয়েছিল ৪০ মিলিয়ন ডলার। সার্সের উৎপত্তিও চীনে। ওই সময় চীনের অর্থনীতি ছিল বিশ্ব জিডিপির ৪ ভাগ। কিন্তু বর্তমানে এর হার ১৬ দশমিক ৩ ভাগ। করোনাভাইরাসের আগে চীনের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ৬ ভাগ। নিশ্চিত করেই বলা যায়, এই প্রবৃদ্ধির হার এখন অনেক কমে যাবে, ৫ ভাগেরও নিচে নেমে যেতে পারে। ফলে অবধারিতভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতেও এর প্রভাব পড়বে। বিশ্ব ধীরে ধীরে এক বড় ধরনের মন্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ মন্দা থেকে কীভাবে উত্তরণ সম্ভব, সে ব্যাপারে শঙ্কিত সবাই। একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, চীনে এখন আর করোনাভাইরাসে মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় না। চীন এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে বলেই মনে হয়। চীন এখন তার বিশেষজ্ঞদের ইতালি পাঠিয়েছে। স্পেনে পাঠিয়েছে মেডিকেল ইকুইপমেন্ট।

বাংলাদেশেরও দুশ্চিন্তার কারণ রয়েছে অনেক। বুধবার প্রথমবারের মতো করোনাভাইরাস আক্রান্ত একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। এছাড়া বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বড় বাজার ইউরোপ। পোশাক খাতের ৬ শতাংশ রপ্তানি হয় ইউরোপে। কিন্তু সেখানে মানুষ গৃহবন্দি হওয়ায় তৈরি পোশাকের কোনো চাহিদা নেই। ফলে আরএমজির অর্ডার বাতিল হচ্ছে। কারখানা বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে শ্রমিক ছাঁটাই হবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। অভ্যন্তরীণভাবে অসন্তোষ বাড়তে পারে। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংক বলছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ঋণ পরিস্থিতি কঠিন হবে। অনেক দেশের পক্ষেই নির্দিষ্ট সময়ে ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। বাংলাদেশ এ থেকে বাইরে নয়। একটা আশঙ্কা হচ্ছে, করোনাভাইরাস আক্রান্ত দেশ ছেড়ে বিনিয়োগ চলে যাবে অন্য দেশে। বাংলাদেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। উপরন্তু চীন বাংলাদেশে বড় বিনিয়োগকারী। চীনের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শ্নথগতি আসতে পারে। অনেক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যার মধ্যে একটি হচ্ছে পর্যটন। এ খাতে বাংলাদেশে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ভয়টা হচ্ছে, করোনাভাইরাসের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশে অসাধু ব্যবসায়ীরা ঋণখেলাপি হবে। এমনিতেই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধ না করার কালচার বাংলাদেশে রয়েছে। এখন অসাধু ব্যবসায়ীরা করোনাভাইরাসের দোহাই দিয়ে ঋণখেলাপি হবে। ফলে ব্যাংকি খাতে ঝুঁকি আরও বাড়বে।

এখন করণীয় কী? এক. প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে, যারা কর্মপন্থা নির্ধারণ করবেন; দুই. স্বাস্থ্য খাতকে শক্তিশালী করা জরুরি। এখানে সরকারি বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এই খাতের দুর্নীতি বহুল আলোচিত। কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই দুর্নীতির সঙ্গে যারা জড়িত, তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়েছে। ফলে একটি অন্যায় আরেকটি অন্যায়ের জন্ম দিয়েছে। সরকার এই খাতে যে অর্থ বরাদ্দ করছে, তার সুষ্ঠু ব্যবহার হচ্ছে না।

কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে ক্রয় করা অত্যাধুনিক মেশিন বছরের পর বছর বাক্সবন্দি থাকছে কিংবা নষ্ট হয়ে গেছে- এ খবর প্রায়ই ছাপা হয়। কিন্তু এর সঙ্গে যারা জড়িত, তারা অতি ক্ষমতাধর হওয়ায় আমরা তাদের শাস্তি দিতে পারিনি। সুতরাং স্বাস্থ্য খাতে অর্থের পরিমাণ বাড়ালেই চলবে না, সেই সঙ্গে এই খাতে দুর্নীতি যাতে না হয়, সে ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে হবে; তিন. আইইডিসিআরের মতো (যেখানে একমাত্র করোনাভাইরাসের ওপর গবেষণা সম্ভব) আরও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিভাগীয় শহরগুলোতে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেখানে দক্ষ জনবল তৈরি করতে হবে ও নিয়োগ দিতে হবে; চার. মেডিকেল কলেজগুলোতে 'ভাইরোলজি' বিভাগটি একরকম উপেক্ষিত বলেই মনে হয়। এই বিভাগে গবেষণার পরিধি বাড়াতে হবে; পাঁচ. দেশে মহামারি রোগ আইন চালু করা জরুরি।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ১৮৯৭ সালের 'দ্য এপিডেমিক ডিজিজেস অ্যাক্ট' বা মহামারি রোগ আইন প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই আইনবলে- ১. করোনা সন্দেহভাজন ভর্তি হতে না চাইলে বলপূর্বক ভর্তি করানো; ২. সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে করোনা পরীক্ষা; ৩. রোগী করোনাকবলিত দেশ থেকে এলে রিপোর্ট করা; ৪. স্থানীয় প্রশাসনের ক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদি সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশেও এমন আইন করা জরুরি এ কারণে যে- সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে, যারা ইতালি থেকে এসেছেন, তারা সরকারি নির্দেশ অমান্য করে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সরকার যে কোনো সমাবেশ বা জমায়েতকে নিরুৎসাহিত করলেও জমায়েত হচ্ছে, যেখানে শত শত লোকের উপস্থিতি আছে। নির্বাচনও হচ্ছে। প্রচারও হচ্ছে, যেখানে শত শত লোকের জমায়েত করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। বিশ্ব করোনাভাইরাস নিয়ে একটা উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমরা সচেতনতা খুব একটা বৃদ্ধি করতে পেরেছি বলে মনে হয় না।Kalerkontho

করোনা ভাইরাস বিশ্বকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে








করোনা ভাইরাস, যার বৈজ্ঞানিক নাম কোভিড-১৯, একটি মহামারীতে রূপ নিয়েছে। গত ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে করোনা ভাইরাসের অস্তিত্বের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর এই চার মাসে এ ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে ১৫৬টি দেশে। আক্রান্তের খবর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ১ লাখ ৬২ হাজার ৫০১ জন (১৬ মার্চ পর্যন্ত)। মৃতের সংখ্যা বলা হচ্ছে ৬ হাজার ৬৮ জন। এ সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছেই।
একটি মরণঘাতী ভাইরাস যখন ১৫৬ দেশে ছড়িয়ে যায়, তখন কত বড় বিপর্যয় যে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। এ মুহূর্তের বিশ্বের দিকে যদি তাকাই, তা হলে মহাবিপর্যয়টা আমরা উপলব্ধি করতে পারব কিছুটা হলেও। যুক্তরাষ্ট্রে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। বলতে গেলে যুক্তরাষ্ট্র এখন ইউরোপ তথা এশিয়া থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। ইউরোপ থেকে কোনো বিমান যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্র থেকে অন্যত্র বেরিয়ে যাওয়ার পথও রুদ্ধ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা এই মহামারীর ব্যাপারে খুব যে একটা কড়াকড়ি ব্যবস্থা আরোপ করতে পেরেছি, তা মনে হয় না। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা প্রতিদিনই প্রেস ব্রিফিং করছেন। আপডেট জানাচ্ছেন। এতে সাধারণ মানুষের মাঝে এক ধরনের সচেতনতা বেড়েছে, সন্দেহ নেই তাতে।
কিন্তু হোম ‘কোয়ারেনটিন’-এর কথা তিনি মুখে বলছেন বটে, কিন্তু এটা কার্যকরী হচ্ছে কিনা তা দেখার কেউ নেই। এক ধরনের শৈথিল্য রয়েছে, যারা হুকুম পালন করার কথা, তাদের উপলব্ধিতে বিষয়টি নেই। করোনা ভাইরাসের ক্ষতির ঝুঁকি যে কত, তা তারা বোঝেন বলে মনে হয় না। আমরা হোম কোয়ারেনটিনের কথা বলছি বটে, কিন্তু দেখা গেল কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও জামালপুরে যারা সদ্য বিদেশ থেকে ফিরেছেন, তারা যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছেন। শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে উৎসব করছেন।
নিত্যদিন স্থানীয় বাজারে গিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশছেন। এটা করে তারা যে কত বড় ঝুঁকি সৃষ্টি করছেন, তা তারা নিজেরা বুঝছেন না, কেউ তাদের বোঝাচ্ছেনও না। যারা ইতালি থেকে এসেছেন, তাদের একটা অংশকে ‘কোয়ারেনটিন’-এ রাখা হচ্ছে, এটা সত্য। কিন্তু একটা অংশ তো বাড়িতে চলে গেছেন। তাদের মনিটর করছে কে? শুধু প্রেস ব্রিফিং করে কী এ রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে? চীনের পর সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর খবর আমরা পাচ্ছি ইতালি থেকে। তা এখন ছড়িয়ে গেছে স্পেনে। অথচ এই ইতালি থেকেই বাংলাদেশিরা দেশে ফিরে আসছেন।
আমরা ইউরোপ থেকে বাংলাদেশে আসা সব ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছি বটে, কিন্তু কিছুটা দেরি হয়ে গেছে। সরকার গণজমায়েতকে নিরুৎসাহিত করছে। এ ক্ষেত্রে গণযাতায়াত ব্যবস্থায় কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা জরুরি। প্রয়োজন ছাড়া জনসাধারণের মুভমেন্টে বিধিনিষেধ আরোপ করা উচিত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেখানে অনেক শিক্ষার্থীর জমায়েত হয়, সেখানে শিক্ষা কার্যক্রম আপতত বন্ধ রাখা হয়েছে। ৩১ মার্চ পর্যন্ত সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।
করোনা ভাইরাস বদলে দিয়েছে আমাদের নিত্যদিনের পরিবেশ। বিদেশে কর্মক্ষেত্রে উপস্থিতি নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে, মানুষ এখন বাসাবাড়িতে থেকে কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের ‘ওয়ার্ক কালচার’ শুরু হয়েছে। এতে প্রচুর মানুষের এক সঙ্গে উপস্থিতি কমানো যায় এবং তাতে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা হ্রাস করা যায়। অনলাইনভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আমরাও এ দিকটার দিকে নজর দিতে পারি।
অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশে এ পদ্ধতির সম্ভাবনা যাচাই করে দেখা যেতে পারে। দেশে বসে বিদেশি ডিগ্রি অর্জন করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে, আমাদের জন্যও এটা একটা সুযোগ।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেশ কিছু বিষয় আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, করোনা ভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি বড় প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে আমরা এর প্রভাবটা হয়তো তেমন একটা উপলব্ধি করতে পারব না, কিন্তু পাঁচ-ছয় মাস পর অর্থনৈতিক বিপর্যয়টা ক্রমান্বয়েই স্পষ্ট হবে। ব্লুমবার্গের মতে, বিশ্ব অর্থনীতি ২ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে। সংস্থাটির মতে, চলতি বছরের প্রথম কোয়ার্টারে বিশ্ব জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যাবে ১ দশমিক ২ শতাংশে।
ব্লুমবার্গের গবেষণায় দেখা গেছে, যেহেতু সারাবিশ্ব চীনের পণ্য, কাঁচামাল আর প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল, সেহেতু চীনের অর্থনীতিতে স্থবিরতা দেখা দেওয়ায় চীনের সরবরাহে ঘাটতি সৃষ্টি হবে। এতে চীনের ওপর নির্ভরশীল প্রতিটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমবে। স্পেন ও জার্মানিতে মাইনাস শূন্য দশমিক ১, কানাডায় মাইনাস শূন্য দশমিক ১, জাপানে মাইনাস শূন্য দশমিক ১, দক্ষিণ কোরিয়া মাইনাস শূন্য দশমিক ৩, ইন্দোনেশিয়ার মাইনাস শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কমেছে। যদি পরিস্থিতির উন্নতি না হয়, তা হলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে। পাঠকদের একটু পেছনের দিকে নিয়ে যেতে চাই। ২০০৩ সালের SARS (Severe Acute Respiratory Syndrome) ভাইরাসের কারণে চীনের প্রবৃদ্ধি শতকরা ১ ভাগ কমে গিয়েছিল, যার কারণে বিশ্বের অর্থনীতিতে ক্ষতি হয়েছিল ৪০ মিলিয়ন ডলার। ঝঅজঝ-এর উৎপত্তি চীনে। ওই সময় চীনের অর্থনীতি ছিল বিশ্ব জিডিপির ৪ শতাংশ। কিন্তু বর্তমানে এর পরিমাণ ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ। করোনা ভাইরাসের আগে চীনের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ৬ শতাংশ।
কিন্তু নিশ্চিত করেই বলা যায়, এই প্রবৃদ্ধির হার এখন অনেক কমে যাবে, ৫ শতাংশেরও নিচে নেমে যেতে পারে। ফলে অবধারিতভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতেও এর প্রভাব পড়বে। বিশ্ব ধীরে ধীরে এক বড় ধরনের মন্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ মন্দা থেকে কীভাবে উত্তরণ সম্ভব, সে ব্যাপারে শঙ্কিত সবাই। একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, চীনে এখন আর করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় না। চীন এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে বলেই মনে হয়। চীন এখন তার বিশেষজ্ঞদের ইতালি পাঠিয়েছে।
অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলো এবং যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে আক্রান্ত হয়েছে, আমাদের একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে আমরা সেভাবে আক্রান্ত হয়নি। কিন্তু দুশ্চিন্তার কারণ রয়েছে অনেকগুলো। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বড় বাজার ইউরোপে। পোশাক খাতের ৬৫ শতাংশ রপ্তানি হয় ইউরোপে। কিন্তু সেখানে মানুষ গৃহবন্দি হওয়ায় তৈরি পোশাকের কোনো চাহিদা নেই। ফলে আরএমজির অর্ডার বাতিল হচ্ছে। কারখানা বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। তৈরি পোশাক কারখানাগুলোয় শ্রমিক ছাঁটাই হবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। অভ্যন্তরীণভাবে অসন্তোষ বাড়তে পারে। দ্বিতীয়ত, বিশ্বব্যাংক বলছে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ঋণ পরিস্থিতি কঠিন হবে। অনেক দেশের পক্ষেই নির্দিষ্ট সময়ে ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। বাংলাদেশ এ থেকে বাইরে নয়।
তৃতীয়ত, করোনা ভাইরাস আক্রান্ত দেশ ছেড়ে বিনিয়োগ চলে যাবে অন্য দেশে। বাংলাদেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। উপরন্তু চীন বাংলাদেশে বড় বিনিয়োগকারী। চীনের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শ্লথগতি আসতে পারে। অনেকগুলো খাত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যার মাঝে একটি হচ্ছে পর্যটন। এ খাতে বাংলাদেশে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। চতুর্থত, করোনা ভাইরাসের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশে অসাধু ব্যবসায়ীরা ঋণখেলাপি হবে। এমনিতেই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধ না করার কালচার বাংলাদেশে রয়েছে। এখন অসাধু ব্যবসায়ীরা করোনা ভাইরাসের দোহাই দিয়ে ঋণখেলাপি হবে! ফলে ব্যাংক খাতে ঝুঁকি আরও বাড়বে। ফলে করণীয় কী? প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ‘নিরাপত্তা কাউন্সিল’-এর কার্যক্রম দৃশ্যমান করা। সেখানে একটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে, যারা কর্মপন্থা নির্ধারণ করবেন। স্বাস্থ্য খাতকে শক্তিশালী করা জরুরি। এখানে সরকারি বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এ খাতের দুর্নীতি বহুল আলোচিত।
কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই দুর্নীতির সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়েছে। ফলে একটি অন্যায় আরেকটি অন্যায়ের জন্ম দিয়েছে। সরকার এ খাতে যে অর্থ বরাদ্দ করছে, তার সুষ্ঠু ব্যবহার হচ্ছে না। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে ক্রয় করা অত্যাধুনিক মেশিন বছরের পর বছর বাক্সবন্দি থাকছে কিংবা নষ্ট হয়ে গেছে-এ খবর প্রায়ই ছাপা হয়। কিন্তু এর সঙ্গে যারা জড়িত, তারা অতি ক্ষমতাধর হওয়ায় আমরা তাদের শাস্তি দিতে পারিনি। সুতরাং স্বাস্থ্য খাতে অর্থের পরিমাণ বাড়ালেই চলবে না, সেই সঙ্গে এ খাতে দুর্নীতি যাতে না হয়, সে ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে হবে। আইইডিসিআরের মতো (যেখানে একমাত্র করোনা ভাইরাসের ওপর গবেষণা ও চিকিৎসা সম্ভব) আরও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিভাগীয় শহরগুলোয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেখানে দক্ষ জনবল তৈরি করতে হবে ও নিয়োগ দিতে হবে। মেডিক্যাল কলেজগুলোয় ‘ভাইরোলজি’ বিভাগটি এক রকম উপেক্ষিত বলেই মনে হয়। সারাবিশ্বই ভাইরাসজনিত রোগ নিয়ে উৎকণ্ঠিত।
২০০১ সালে অ্যানথ্রাকস, ২০০২ সালের ওয়েস্ট নীল ভাইরাস, ২০০৩ সালে সার্স, ২০০৫ সালে বার্ড ফ্লু, ২০০৬ সালে ইকোলি, ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু, ২০১৪ সালে ইবোলা, ২০১৬ সালে জিকা ভাইরাস আর ২০২০ সালে করোনা ভাইরাসের মহামারী আমাদের জানান দিয়ে গেল আমরা কী ধরনের নিরাপত্তাঝুঁকিতে রয়েছি! এই নিরাপত্তাঝুঁকি পারমাণবিক যুদ্ধের ভয়াবহতার চেয়েও বেশি। সুতরাং আমাদের নীতিনির্ধারকরা যদি বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেন, আমাদের স্বস্তির জায়গাটা সেখানেই।
আইএমএফ এরই মাঝে ১ হাজার ২০০ কোটি ডলারের সহযোগিতা ঘোষণা করেছে। আমরা কীভাবে এই সহযোগিতা নিতে পারি, তা ভেবে দেখতে হবে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং জানিয়েছেন, চীন কোভিড-১৯ (করোনা ভাইরাস) চিকিৎসায় বিশ্বের সব দেশকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। চীনের দক্ষতা প্রমাণিত। আমরা এই সুযোগটা কাজে লাগাতে পারি। চীনা বিশেষজ্ঞদের বাংলাদেশে এনে আমাদের চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়, অথবা বিশেষজ্ঞ তরুণ চিকিৎসকদের চীনে পাঠানো যায়। করোনা ভাইরাসের ঘটনা আমাদের জন্য একটা ‘ওয়েক-আপ’ কল। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনই
Amader Somoy
19.03.2020

আফগান শান্তিচুক্তি ও উপমহাদেশের রাজনীতি




সংবাদটি আমাদের কতটুকু আশাবাদী করে?


  

একটি আশাবাদী সংবাদ ছাপা হয়েছে গত ১১ মার্চের পত্র-পত্রিকায়। সংবাদটিতে বলা হয়েছে, ইন্টারপোলের সাহায্যে ১১ জনকে ফেরত আনার উদ্যোগ নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (যুগান্তর)। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ আত্মসাৎ করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্য থেকে দুদক ১১ জনকে দেশে ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের সহযোগিতা চেয়েছে।
সংবাদটি নিঃসন্দেহে আমাদের আশাবাদী করে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কতটুকু সফল হতে পারবে দুদক? পাপিয়া কাহিনী যখন দেশে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে, যখন পুলিশ পাপিয়াকে রিমান্ডে নিয়ে তথ্য-উপাত্ত যাচাই করছে, ঠিক তখনই এলো দুদকের এ উদ্যোগের খবর।
সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক লুটপাটের ঘটনা পুরো ব্যাংক ব্যবস্থাপনার ওপর মানুষের এক ধরনের অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ এখন আর ব্যাংকে তাদের আমানত রাখতে সাহস পাচ্ছে না। সাধারণ মানুষের মাঝে আরও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে যখন মানুষ সংবাদপত্র পাঠ করে জেনেছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান লুটকারী হালদাররা কানাডায় বিলাসী জীবনযাপন করছেন।
বাংলাদেশ থেকে টাকা লুট করে কানাডার টরন্টোয় ‘বেগম পাড়া’য় বাড়ি কেনার কাহিনী অনেক পুরনো। বাংলাদেশি টাকায় হালদাররা সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। বাংলাদেশে এসব ব্যাংক লুটেরার বিরুদ্ধে বড় ধরনের রাজনৈতিক প্রতিবাদ কিংবা মানববন্ধনের মতো ঘটনা না ঘটলেও টরন্টোয় ঘটেছে- এটাও একটা আশাবাদী করার মতো সংবাদ। কানাডায় বাস করা প্রবাসীরা ওই ব্যাংক লুটেরাদের সামাজিকভাবে বয়কট করে সেখানে মানববন্ধন করেছেন।
দুর্নীতি আজ সমাজের কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে, তা সাম্প্রতিককালে উদ্ঘাটিত এনু-রুপন আর পাপিয়া-‘কাহিনী’ থেকে বোঝা যায়। এ ধরনের ‘কাহিনী’ রূপকথাকেও হার মানায়। আমরা সাধারণ আমজনতা অবাক হয়ে দেখি কীভাবে সাধারণ ঘরের মানুষ রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে হাজার কোটি টাকার মালিক হন।
সম্প্রতি র‌্যাবের এক অভিযানে (২৫ ফেব্রুয়ারি) পুরনো ঢাকার স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুই নেতার বাসায় ৫টি সিন্দুকে পাওয়া গেছে নগদ ২৬ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, ৫ কোটি ১৫ লাখ টাকার এফডিআর আর ১ কেজি স্বর্ণ। এর আগে গেল বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান পরিচালনার সময় তাদের দুই কর্মচারীর বাসায় অভিযান চালিয়ে ৫ কোটি টাকা ও সাড়ে ৭ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করেছিল র‌্যাব।
ঢাকা শহরে তাদের অন্তত ১৫টি বাড়ির অস্তিত্বের খবর পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরা দুই ভাই এনু ভূঁইয়া ও রুপন ভূঁইয়া গেণ্ডারিয়া আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা।
একজন পাপিয়ার কাহিনীও পাঠক জেনেছে ২৫ ফেব্রুয়ারি। তিনি নরসিংদী জেলা আওয়ামী যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এখন অবশ্য বহিষ্কৃত। তার বিলাসী জীবনের কাহিনী মানুষ জেনেছে সংবাদপত্র পাঠ করে। সুনির্দিষ্ট কোনো পেশা ছাড়াই পাপিয়ার দৈনিক লাখ লাখ টাকা ব্যয়, ‘কিউ অ্যান্ড সি’ নামে একটি ব্যক্তিগত বাহিনীর মাধ্যমে গড়ে তোলা নিজস্ব সাম্রাজ্য, অবৈধ অস্ত্র, চাকরির তদবিরের নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া, অর্থ পাচার, মাদক কারবার, অসহায় নারীদের নিয়ে দেহ ব্যবসা ইত্যাদি নানা কাহিনী এখন সংবাদপত্রের পাতায়।
গত তিন মাসে পাপিয়া হোটেলের বিল পরিশোধ করেছেন ৩ কোটি টাকা। একটি নামকরা হোটেলের প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুট ভাড়া করে তিনি থাকতেন এবং কিছু তরুণীকে দিয়ে দেহ ব্যবসার মতো অনৈতিক কাজে লিপ্ত ছিলেন। ওই হোটেলের মদের একটি বার তিনি সারা রাতের জন্য ভাড়া করে রাখতেন। পাপিয়া কোটি কোটি টাকার মালিক হলেও তার বাবার সংসার চলে অটো গাড়ির ভাড়ায়।
পতিতালয়ের সর্দারনি মার্কা পাপিয়ার একটি ছবি তখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছিল। একটি অনলাইন পোর্টালের খবর (বাংলা ইনসাইডার)- পাপিয়ার কললিস্টে ১১ মন্ত্রী ও ৩৩ এমপির নাম। এ পাপিয়া ও তার স্বামী সুমন এখন দু’দফায় আরও ১৫ দিনের রিমান্ডে। আমরা জানি না তার অবৈধ অর্থের হিসাব পুলিশ কতটুকু উদ্ধার করতে পারবে!
কিন্তু যারা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলকে ব্যবহার করে, উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ রক্ষা করে, অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করে শত শত কোটি টাকার মালিক হন, তারা রাজনীতির জন্য আশীর্বাদ নন, বরং অভিশাপ। যারা তাকে জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক বানিয়েছেন, তারাও সমান অপরাধী।
পাঠক, জি কে শামীম ও সম্রাটের কথা নিশ্চয় মনে আছে আপনাদের। দু’জনই এখন জেলে। কীভাবে রাজনৈতিক সখ্য গড়ে তুলে ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ব্যবহার করে সম্রাটরা টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছিলেন, তা পাঠকরা এর মধ্যে জেনে গেছেন। জেনে গেছেন ক্যাসিনো সম্রাটদের নাম, ঠিকানা ও তাদের কর্মকাণ্ড। প্রধানমন্ত্রী ক্যাসিনো সম্রাটদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়ে বেশ প্রশংসিত হয়েছিলেন।
রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, বিশেষ করে যুবলীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে যুবলীগকে ব্যবহার করে এই ক্যাসিনো সম্রাটরা অবৈধ টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছিলেন। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের প্রয়োজন ছিল। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রশংসিত হয়েছিলেন। সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি- ছয় মাসের ব্যবধানে পাপিয়ারা যখন গ্রেফতার হন, তখন বুঝতে হবে রাজনীতির নামে যারা অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে আরও অভিযান প্রয়োজন।
একজন সম্রাট, একজন এনু-রুপন কিংবা পাপিয়ার কারণে রাজনীতিটা ‘নষ্ট’ হয়ে গেছে। রাজনীতি আর রাজনীতির জায়গায় থাকেনি। সম্রাট আর পাপিয়ারা রাজনীতিকে ব্যবহার করেছেন তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থে। এদের রাজনীতি দলের জন্য তো বটেই, জাতিরও কোনো মঙ্গল ডেকে আনছে না। অথচ এ দেশে অনেক কৃতী রাজনীতিবিদ আছেন ও ছিলেন।
বঙ্গবন্ধু শুধু রাজনীতির কারণেই জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো জেলে কাটিয়েছেন। মওলানা ভাসানী রাজনীতি করে শেষ জীবন কুঁড়েঘরেই কাটিয়ে দিয়েছেন। কোনো দিন প্রয়োজনবোধ করেননি ঢাকায় প্লট, ফ্ল্যাট নেয়ার। আবেদনও করেননি কোনোদিন। এমন খবরও আমরা জানি, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে মওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির বিরোধিতা করলেও বঙ্গবন্ধু তাকে নিয়মিত লুঙ্গি ও গেঞ্জি সরবরাহ করতেন। এটা ছিল ভাসানীর প্রতি বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত ভালোবাসা।
আজ যারা বঙ্গবন্ধুর নামে রাজনীতি করেন, তারা কি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করেন? অবৈধ কোটি কোটি টাকা যারা সিন্দুকে রেখে দেন, তিন দিনে হোটেলে তিন কোটি টাকা ‘বিল’ দেন, তাদের আয়ের উৎস কী? সর্দারনি মার্কা চেহারা আর বেশ-ভুষা যাদের, তারা আর যাই হোক, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করেন না। আমি জানি না এসব অবৈধ অর্থ উপার্জনকারীদের বিচারে কী হবে।
আশঙ্কার একটা জায়গা হচ্ছে, এসব তথাকথিত ‘রাজনীতিকদের’ সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের ‘যোগসাজশ’। র‌্যাবের কর্মকর্তারাও সংবাদকর্মীদের কাছে তা স্বীকার করেছেন। এখন এই ‘যোগসাজশ’ তাদের পুনর্বাসন তথা মুক্তির ব্যাপারে আদৌ কোনো ভূমিকা পালন করে কি না, সেটাই দেখার বিষয়।
আরও কিছু কথা। একটি জাতীয় সংবাদপত্র (বণিক বার্তা) তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে (৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০) ‘ভালোই আছেন ব্যাংক ও আর্থিক খাতের দুষ্কৃতকারীরা’। ভালো আছেন- সংবাদপত্রটি আমাদের জানাচ্ছে! তিনজনের নাম সংবাদপত্রটি উল্লেখ করেছে- প্রশান্ত কুমার হালদার, আবদুল আজিজ ও আবদুল হাই বাচ্চু। এ তিনজনের নতুন করে পরিচয় দেয়ার দরকার নেই। পাঠক মাত্রেই এদের নামে চেনেন।
পত্রিকার ভাষ্যমতে, প্রশান্ত কুমার হালদার কানাডায় আছেন। একই দেশে আছেন আবদুল আজিজও। আর আবদুল হাই বাচ্চু নিউইয়র্ক-লন্ডনে সপরিবারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। প্রশান্ত কুমার হালদার কানাডায় একটি কোম্পানি গঠন করে সেখানে কয়েক হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন। বিদেশে ৯১৯ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে আজিজের বিরুদ্ধে। এটা শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের।
দুদকের অভিযোগ ১ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা আত্মসাতের। আর জনতা ব্যাংকের অভিযোগ ৩ হাজার ৫৭২ কোটি টাকা ফেরত না দেয়ার। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন আবদুল হাই বাচ্চু। বেসিক ব্যাংকের সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ৬১টি মামলা করেছে দুদক। দুদক তাকে কয়েকবার জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।
অভিযোগ আছে, বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারিতে ব্যাংকের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা ও গ্রাহকদের মামলায় আসামি করা হলেও অজ্ঞাত কারণে আসামি করা হয়নি পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের। এসব ‘কাহিনী’ আমাদের জন্য কোনো ভালো খবর নয়।
তবুও আমরা আশাবাদী হতে চাই। দুদকের ওপর আস্থাটা রাখতে চাই। শামীম আর হালদারদের চাই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। দায়িত্বটা তাই দুদকের। সম্প্রতি রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অর্থাৎ অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আপিল বিভাগে এক শুনানিতে মন্তব্য করেছেন এভাবে : ‘এখন অনেকেই ব্যাংক করেন জনগণের টাকা লুটের জন্য’ (যুগান্তর, ২৫ ফেব্রুয়ারি)।
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা যখন এ ধরনের মন্তব্য করেন, তখন একটা হতাশা প্রকাশ পায় বৈকি! জনগণের টাকা লুটের জন্য ব্যাংক। কী সাংঘাতিক কথা! এ সরকারের সময় রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যাংকগুলো ঠিকমতো পরিচালিত হচ্ছে না। ব্যাংক থেকে অবৈধ পন্থায় টাকা ‘লুট’ করে নেয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমরা দেখছি বিদ্যমান আইনের দুর্বলতা। আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে অভিযুক্তরা পার পেয়ে যাচ্ছেন।
দুদককে মাঝে মধ্যে আমরা অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থানে দেখি। কিন্তু তারপরও অর্থ পাচারকারীরা, ব্যাংক লুটপাটকারীরা দুদককে বৃদ্ধাঙুলি প্রদর্শন করে অভিযোগ থেকে পার পেয়ে যাচ্ছেন। ব্যাংক নিশ্চয়ই লুটপাটের জায়গা হতে পারে না। রাষ্ট্র যদি আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করতে না পারে তার চেয়ে আর দুঃখজনক কিছু থাকতে পারে না।
সুতরাং দুদক যখন ইন্টারপোলের মাধ্যমে অর্থ লুটপাটকারীদের দেশে ফিরিয়ে আনতে চায়, আমরা এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। তবে দুদক যেন শুধু ইন্টারপোলে চিঠি লিখেই তাদের দায়িত্ব শেষ না করে। তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক বেশি। আর্থিক দুষ্কৃতকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করে সাধারণ মানুষের মাঝে দুদকের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো জরুরি।
Jugantor
14.03.2020

পররাষ্ট্রনীতির চ্যালেঞ্জগুলো




পররাষ্ট্রনীতির চ্যালেঞ্জগুলো
আগামী ২৬ মার্চ বাংলাদেশ যখন তার স্বাধীনতার ৫০ বছরে পা দেবে তখন চারটি বিষয় গুরুত্ব পাবে বেশি, যা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি ভারতের এনআরসি ও সিএএ নিয়ে বাংলাদেশে প্রতিক্রিয়া ও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক। দ্বিতীয়টি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আইসিজের রায় বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক। তৃতীয়টি জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের ক্ষতিপূরণ আদায়ে ব্যর্থতা। চতুর্থটি হচ্ছে করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের ক্ষতি ও ক্ষতিপূরণে বাংলাদেশের উদ্যোগ। ভারতে এনআরসি (ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস) ও সিএএর (সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট) কারণে ভারতজুড়ে যে বড় ধরনের গণ-আন্দোলন গড়ে উঠছে তার প্রভাব বাংলাদেশে এসেও লেগেছে। আসামে এনআরসির কারণে প্রায় ১৯ লাখ মানুষ (বিবিসির মতে) ভারতের নাগরিক অধিকার হারিয়েছে। ২০১৯ সালের ৩১ আগস্ট আসামের নাগরিকপঞ্জির যে তালিকা প্রকাশ করা হয়, তাতে বাংলাভাষী পাঁচ লাখ হিন্দু ও সাত লাখ মুসলমান ভারতের নাগরিকত্ব হারায়। এই নাগরিকপঞ্জি পশ্চিমবঙ্গে বড় বিতর্ক তোলে এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এনআরসির বিরুদ্ধে সরব হতে দেখা যায়। চলতি ২০২০ সালে এই এনআরসি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে অন্যতম একটি ইস্যু হয়ে থাকবে। বাংলাদেশে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এ কারণে, বলা হচ্ছে নাগরিকত্ব হারানো প্রায় ১৯ লাখ মানুষের সবাই বাংলাদেশি এবং তারা বাংলাদেশ থেকে গিয়ে আসামে অবৈধভাবে বসবাস করে আসছিল। কিছু ক্ষেত্রে ২০১৯ সালে ‘পুশ ইনে’র ঘটনাও ঘটেছে। কিছু বাংলাভাষী মানুষ যশোরের সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে—এমন খবরও বিদেশি গণমাধ্যমে পরিবেশিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি ‘দুর্বল’ অবস্থানে গেছে বলে মনে হয়। এর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এনআরসি নিয়ে বাংলাদেশকে কোনো চিন্তা না করতে আশ্বাস দিলেও ২০১৯ সালে বাংলাদেশ বেশ বড় ধরনের অস্বস্তিতেই ছিল। একপর্যায়ে বাংলাদেশের দুজন মন্ত্রী তাঁদের ভারত সফর স্থগিত করেন। তখন এর সঙ্গে এনআরসির একটি যোগসূত্র আছে বলেও কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছেন, যদিও সরকারের পক্ষ থেকে তা অস্বীকার করা হয়েছে। এনআরসির বিষয়টি একটু পুরনো। ২০১৩ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এই নাগরিকপঞ্জি নিয়ে একটি রায় দেন। ওই রায় অনুসরণ করেই আসামে নাগরিক তালিকা তৈরি করা হয়। তবে এটি বিতর্ক বাড়ায় যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ২০১৯ সালের ২০ নভেম্বর লোকসভায় ঘোষণা করেন, ভারতের সব রাজ্যে এনআরসি করা হবে। এর পরই পশ্চিমবঙ্গে এনআরসিবিরোধী বড় আন্দোলন গড়ে ওঠে। এনআরসি নিয়ে বিতর্কের রেশ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই ভারতের সংসদে সিএএ পাস হয়। এটি বর্তমানে একটি আইন। এই আইনবলে উপমহাদেশের তিনটি দেশের (বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান) মুসলমান বাদে অন্যান্য ধর্মের নাগরিকদের ভারতীয় নাগরিকত্ব অর্জনের পথ সহজ করা হয়। মুসলমানদের নাগরিকত্ব অর্জনে বঞ্চিত রাখা হয়। এই আইনও ভারতে বড় বিতর্ক তৈরি করে।
এনআরসি ও সিএএ ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোনো ভূমিকা নেই এবং বাংলাদেশ কোনো মন্তব্যও করতে পারে না। তবে অত্যন্ত ক্ষমতাবান অমিত শাহ যখন বাংলাদেশিদের ‘ছারপোকা’র সঙ্গে তুলনা করেন এবং প্রকাশ্যে জনসভায় বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্য দেন তখন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে তা প্রভাব ফেলে বৈকি। চলতি বছর এই ইস্যু দুটি দুই দেশের সম্পর্কের জন্য একটি ‘টেস্ট কেস’। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যদি এনআরসি ও সিএএর ব্যাপারে শক্ত অবস্থানে না যায়, তাহলে তা এক ভুল ‘সিগন্যাল’ দেবে। বাংলাদেশ ‘দ্বিতীয় আরেকটি রোহিঙ্গা সংকটের’ মুখোমুখি হতে যাচ্ছে কি না সে ভাবনা এখন অনেকের। ভারতকে আস্থায় নিতে খোদ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের উদ্যোগটিই এখন বড়। এ ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎপরতা নেই বললেই চলে। বাংলাদেশের জন্য আরো চিন্তার কারণ দুটি—রোহিঙ্গা সংকট ও জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সমস্যা। এ সমস্যা দুটি ২০২০ সালে আলোচিত হতে থাকবে বারবার। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় অর্থায়নের ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ কপ-২৫ সম্মেলনও শেষ হলো গত ডিসেম্বরে কোনো রকম অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি ছাড়াই। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি বড় সমস্যা।
অক্সফামের এক প্রতিবেদনে একটি উদ্বেগজনক সংবাদ ছাপা হয়েছিল কয়েক দিন আগে। এতে বলা হয়েছে, প্রতি দুই সেকেন্ডে একজন মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। এটি একটি উদ্বেগের বিষয়। বাংলাদেশ বারবার ‘কপ’ সম্মেলনে এই বাস্তুচ্যুত নাগরিকদের ব্যাপারে তার উদ্বেগের কথা বিশ্ব কমিউনিটিকে জানিয়ে আসছে। বাংলাদেশে প্রতিবছর শত শত মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয়ে রাজধানীতে বস্তিবাসী হচ্ছে। সাগরে পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় তারা গৃহহীন হয়েছে। তাদের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল বাংলাদেশ। স্পেনে প্রধানমন্ত্রী আবারও সেই আহ্বান জানিয়েছিলেন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করারও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এটিই হচ্ছে আসল কথা। যুক্তরাষ্ট্র মূলধারায় না থাকলেও আজ বিশ্বসম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে। কপ-২১ সম্মেলনে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল, তা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত আজ বিশ্ববাসীর। বাংলাদেশের একার পক্ষে বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে একক কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। তবে বাংলাদেশ কতগুলো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। মুজিববর্ষ উপলক্ষে ২০২০ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ২০ কোটি গাছ লাগানো, সোলার এনার্জি বাধ্যতামূলক করা। নবায়নযোগ্য এনার্জির ব্যবহার বাড়ানো, কয়লাচালিত বিদ্যুতের ব্যবহার হ্রাস করা। পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখার স্বার্থে যানবাহন চলাচল সীমিত করা এবং রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরে ‘দিল্লি মডেল’ অনুসরণ করা ইত্যাদির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলাদেশ একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। দুঃখজনক হলেও সত্য, পরিবেশ বিপর্যয় রোধকল্পে পরিবেশ ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের কোনো উদ্যোগ চোখে লাগার মতো নয়।
রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশ আইসিজের একটি রায় পেয়েছে। রায়টি প্রত্যাখ্যান করেছে মিয়ানমার। চূড়ান্ত রায়টি কী হবে, আমরা তা জানি না। তবে সেই সিদ্ধান্ত যে ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে এই মুহূর্তে কোনো সাহায্য করবে না, তা বলাই যায়। এই সমস্যার সমাধান নিহিত রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দানের মধ্য দিয়ে। ১৯৮২ সালে মিয়ানমার যে আইন প্রণয়ন করেছিল, তাতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। গেল প্রায় তিন বছর রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারের কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি। এ ক্ষেত্রে আমরাও বহির্বিশ্বে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো শক্ত অবস্থানে যেতে পারিনি।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে কয়েক বছর ধরে আলোচনা চলে এলেও উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। চীনের মধ্যস্থতায় একটি উদ্যোগও আমরা লক্ষ করেছি। কিন্তু মিয়ানমার তাদের নাগরিকদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে চাচ্ছে না। আলোচনার নামে মিয়ানমার সময়ক্ষেপণ করছে। মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় কিংবা চীনের মধ্যস্থতা সত্ত্বেও বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা একটি ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। নাগরিকত্বের বিষয়টি নিশ্চিত না হওয়ায় রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফেরত যেতে চাচ্ছে না। কিন্তু মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি নিশ্চিত করেনি। মিয়ানমারের কোনো ডকুমেন্টে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি পর্যন্ত নেই। তারা এদের বলছে ‘বাস্তুচ্যুত নাগরিক’। বাংলাদেশের সঙ্গে যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, তাতেও উল্লেখ আছে বাস্তুচ্যুত নাগরিক হিসেবে। চীন একটি মধ্যস্থতার সুযোগ নিলেও এখন পর্যন্ত মিয়ানমারকে এ ব্যাপারে রাজি করাতে পারেনি। ফলে বিষয়টি ঝুলে আছে। এদিকে ভারতও মিয়ানমারের ওপর বড় কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। মিয়ানমারের স্ট্র্যাটেজি পরিষ্কার—তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া সব রোহিঙ্গাকে ফেরত নেবে না। একটি বড় অংশকেই তারা ফেরত নেবে না। উপরন্তু রোহিঙ্গারা নিজ বাসভূমিতেও ফেরত যেতে পারবে না। কেননা ওই সব বাসভূমির আদৌ কোনো অস্তিত্ব নেই। ওই সব বাড়িঘর এখন গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই সব এলাকা এখন বিদেশিদের কাছে ইজারা দেওয়া হচ্ছে। গত ২২ নভেম্বর (২০১৯) মিয়ানমার টাইমসের খবর : চীন রাখাইনসহ কয়েকটি অঞ্চলে কৃষিক্ষেত্রে ১৩০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। উত্খাতকৃত রোহিঙ্গা বসতিতেই এসব কৃষি খামার গড়ে তোলা হবে। আর প্রত্যাগত রোহিঙ্গাদের রাখা হবে ক্যাম্পে। তাদের বেছে নিতে হবে ক্যাম্প জীবন। সুতরাং রোহিঙ্গারা নিজ বাসভূমি ছাড়া অন্যত্র, বিশেষ করে ক্যাম্প জীবন বেছে নেবে কি না, তাতে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বলা ভালো, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে যে কমিটি গঠিত হয়েছিল, সেই কমিটির সুপারিশে রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমে পুনর্বাসনের কথা বলা হয়েছিল। সে সম্ভাবনাও এখন ক্ষীণ।
এই যখন পরিস্থিতি তখন এলো করোনাভাইরাসের খবরটি। গত ৮ মার্চের খবর, বাংলাদেশে তিনজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর খবর পাওয়া গেছে। করোনাভাইরাস নিয়ে বাংলাদেশ বড় ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে। এডিবির মতে, এ ভাইরাসের আঘাতে বিশ্বজুড়ে সর্বনিম্ন ক্ষতির পরিমাণ ৭৭ মিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশের ক্ষতি হয়েছে ৮৩ লাখ ৭০ হাজার ডলার। এতে বাংলাদেশের জিডিপি কমবে ০.০১ শতাংশের মতো। করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের বাণিজ্যে এর প্রভাব পড়ছে। করোনাভাইরাস দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
ফলে বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। জনশক্তি খাতে আয় কমছে। আরএমজি সেক্টরও রয়েছে ঝুঁকির মুখে। এ সংকট মোকাবেলায় পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কী ভূমিকা নেয়, সেটিই দেখার বিষয়।
স্পষ্টতই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির জন্য বিষয়গুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ। জাতি যখন মুজিব জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার ৫০ বছর পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, ঠিক তখনই ওপরে উল্লিখিত বিষয়গুলো আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক বেশি। দায়িত্ব পালনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা যদি শৈথিল্য প্রদর্শন করেন, তাহলে উন্নত রাষ্ট্র গঠনের যে প্রত্যাশা, সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে আমরা ব্যর্থ হব।
Kalerkontho
12.03.2020