রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

গাজায় গণহত্যা ও বিশ্ববিবেক

গেল সপ্তাহে গাজায় অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনিরা যখন ঐতিহাসিক নাকবা (Nakba) দিবস পালন করছিলেন, তখন ইসরাইলি সেনাবাহিনী তাদের ওপর বড় ধরনের হামলা চালায়। প্রকাশ্যে গুলি আর ড্রোন বিমান ব্যবহার করে বোমা নিক্ষেপ করে ইসরাইল সেখানে গণহত্যা চালায়। তাতে প্রাণ হারিয়েছেন ৬০ জন নিরীহ ফিলিস্তিনি, আর আহতদের সংখ্যা কয়েক হাজার। ইসরাইল এই হত্যাকা-ের জন্য এমন একটা সময় বেছে নিয়েছিল, যখন যুক্তরাষ্ট্র তার দূতাবাস তেলআবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে নেয়। নিঃসন্দেহে ট্রাম্প প্রশাসনের ওই সিদ্ধান্ত তেলআবিব সরকারকে উৎসাহ জুগিয়ে থাকবে গাজায় গণহত্যা চালাতে। এই গণহত্যা, বিশেষ করে একজন পঙ্গু ফিলিস্তিনি ফাদি আবু সালেহ ও ৮ মাসের শিশু লাইলা আল গান্দেউরের হত্যাকা- সারা বিশ্ব বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছিল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গাজার এই হত্যাকা-কে যুদ্ধাপরাধ বলেছে। আর জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন গাজার হত্যাকা- নিয়ে তদন্ত করতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার বাধার মুখে তা বাতিল হয়ে যায়। তবে খোদ জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান। আর ইসরাইলের হাত থেকে ফিলিস্তিনিদের রক্ষার জন্য একটি আন্তর্জাতিক সুরক্ষা বাহিনী গঠনের আহ্বান জানানো হয়েছে আংকারায় অনুষ্ঠিত ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) জরুরি সম্মেলনে। ইসরাইলি এই গণহত্যার প্রতিবাদ উঠেছে সর্বত্র। অনেক দেশ ইসরাইল থেকে তাদের নিজ নিজ দূত প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এমনকি খোদ ইসরাইলের ভেতরেও এই হত্যাকা-ের প্রতিবাদ উঠেছে।
গেল ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন জেরুজালেমে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেন, ওই সময় তা বড় ধরনের বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। ট্রাম্প যখন ডিসেম্বরে (২০১৭) তার এই সিদ্ধান্তের কথা জানান, তখন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছিল। জাতিসংঘে ওই সময় আয়োজিত ভোটাভুটির সময় যুক্তরাষ্ট্র হুমকি দিয়েছিল, যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করবে, তাদের নামধাম লিখে রাখা হবে এবং তাদের অর্থনৈতিক সহায়তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। কিন্তু এই হুমকির পরও ১২৮টি দেশ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ‘জেরুজালেম নগরীর মর্যাদার বিষয়ে যে কোনো সিদ্ধান্ত অকার্যকর ও বাতিলযোগ্য’ শীর্ষক যে প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছিল, তার পক্ষে ভোট দিয়েছিল। আর বিপক্ষের অর্থাৎ ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের পক্ষে ভোট দিয়েছিল ৯টি দেশ। ভোটদানে বিরত ছিল ৩৫টি দেশ। এখানে বলে রাখা ভালো, মুসলিমবিশ্বের জন্য জেরুজালেম একটি স্পর্শকাতর বিষয়। পূর্ব জেরুজালেম যে স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাজধানী হবে, এটা অনেক আগেই স্বীকৃত। এখানে রয়েছে পবিত্র আল আকসা মসজিদ। তবে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয়। সেই থেকে পূর্ব জেরুজালেমে ইসরাইলি দখলদারি বজায় রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ১৯৮০ সালে ইসরাইল এক আইনবলে সমগ্র জেরুজালেমকে ইসরাইলি রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু জাতিসংঘ গৃহীত এক সিদ্ধান্তে (সিদ্ধান্ত নম্বর ৪৭৮) এর সমালোচনা করা হয়েছিল। গেল বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে এসেও যে সিদ্ধান্তটি নিয়েছিল, তাতে বলা হয়েছে, ‘জেরুজালেম নগরীর মর্যাদার বিষয়ে যে-কোনো সিদ্ধান্ত অকার্যকর ও বাতিলযোগ্য।’ সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও ইসরাইলের মধ্যে একটি ‘শান্তিপূর্ণ’ সহাবস্থানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। একটি ‘দুই রাষ্ট্র’ ফরমুলার দিকে ধীরে ধীরে দুই পক্ষে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত এখন সেই ফরমুলার পেছনে ছুরিকাঘাতের শামিল। দুই রাষ্ট্রের ফরমুলায় পূর্ব জেরুজালেম ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাজধানী হবেÑ এমন কথা স্বীকৃত ছিল। ওবামা প্রশাসন সেই ‘দুই রাষ্ট্র’ ফরমুলায় অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন সেখান থেকে সরে এসেছেন। তারা ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘদিনের সংগ্রামকে উপেক্ষা করে পুরো জেরুজালেম যে ইসরাইল রাষ্ট্রের রাজধানী, তা তারা পরোক্ষভাবে স্বীকার করল। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি যখন উত্তপ্ত, ইসরাইলের সঙ্গে ইরানের যখন এক ধরনের ‘ছায়াযুদ্ধ’ চলছে, এমনকি সিরিয়া সংকটের যখন কোনো সমাধান হচ্ছে না, তখন এই উত্তপ্ত রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এটি শুধু এ অঞ্চলের রাজনীতি নয়, বরং বিশ্বে উত্তেজনা বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট। জেরুজালেমে রাজধানী স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার মধ্য দিয়ে ট্রাম্প মূলত তার প্রতিশ্রুতি পালন করলেন। গেল ডিসেম্বরে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তিনি অতি সত্বর যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তেলআবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে নেবেন। এই কাজটি তিনি এখন করলেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির একটি পরিবর্তনের দিক নির্দেশ করলেন। এই কাজটি তিনি করলেন এমন একটা সময়, যখন তিনি ইরান পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিলেন। দ্বিতীয়ত, ইসরাইল স্পষ্টই সিরিয়া যুদ্ধের একটা অংশ হয়ে গেছে এবং ইসরাইল-ইরান এক ধরনের ‘ছায়াযুদ্ধ’ শুরু হয়ে গেছে। তৃতীয়ত, সিরিয়া সংকটের কোনো সমাধানও হচ্ছে না। ইতোমধ্যে লেবানন ও ইরাকে নির্বাচন হয়েছে এবং তাতে বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। লেবাননে ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ গ্রুপ নির্বাচনে ভালো করেছে এবং হিজবুল্লাহ সমর্থিত একটি সরকার সেখানে প্রতিষ্ঠিত হবে। হারিরি যদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে যান, তিনি হিজবুল্লাহর বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। ইরাকে মুকতাদা আল সদরের সমর্থকরা ভালো করেছে। ওয়াশিংটন সমর্থিত প্রধানমন্ত্রী হায়দার আল আবাদি সরকারের পতন ঘটেছে। মুকতাদা আল সদর ইরান সমর্থিত এবং প্রচ- আমেরিকানবিরোধী। একই সঙ্গে হিজবুল্লাহরাও যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী। ফলে পারসীয় অঞ্চলের রাজনীতিতে ইরানের প্রভাব বাড়ল। এটা একদিকে যেমন সৌদি আরবের জন্য চিন্তার কারণ, ঠিক তেমনি চিন্তার কারণ ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও। 
সুতরাং গাজা সংকটকে উসকে দিয়ে ইসরাইল এ অঞ্চলে আরেকটি যুদ্ধের পাঁয়তারা করছে বলে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন। অতীতে একাধিকবার আরব রাষ্ট্রগুলো ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছিল। ১৯৪৮-৪৯, ১৯৫৬, ১৯৬৭, ১৯৭৩ এবং ১৯৮২। ১৯৪৮ সালে ইসরাইলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে প্রথম ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে মিশর, জর্ডান, ইরাক, সিরিয়া ও লেবানন। ১৯৫৬ সালে মিশরের জাতীয়তাবাদী নেতা জামাল আবদেল নাসের সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করলে ইসরাইল মিশরের সিনাই মরুভূমি দখল করে নেয়। ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে ৬ দিনব্যাপী যুদ্ধে আরবরাষ্ট্রগুলো আবারও যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছিল ইসরাইলের সঙ্গে। ওই যুদ্ধে ইসরাইল সিনাই উপত্যকা ও গোলান উপত্যকা দখল করে নিয়েছিল। পরবর্তীতে মিশরের সঙ্গে শান্তি চুক্তির বিনিময়ে মিশর সিনাই উপত্যকা ফেরত পেলেও সিরিয়া গোলান উপত্যকা ফেরত পায়নি। গোলান উপত্যকা ফেরত দেওয়ার সম্ভাবনাও কম। কেননা এখানে সম্প্রতি তেল পাওয়া গেছে। আর ইসরাইলের পানির অন্যতম উৎস হচ্ছে এই গোলান উপত্যকা। ১৯৮২ সালে ইসরাইল লেবাননে পিএলও অবস্থানের ওপর বোমা বর্ষণ করে। একপর্যায়ে পিএলও’কে লেবানন থেকে সরে যেতে বাধ্য করে। আর ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরে গাজায় ব্যাপক সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে ফিলিস্তিনিরা ‘ইন্তিফাদা’ আন্দোলন শুরু করেছিলেন। সেই আন্দোলন কখনও আর থেমে থাকেনি। 
তবে ইসরাইলের সাম্প্রতিক এই ‘গণহত্যা’ প্রমাণ করল, ইসরাইল এ অঞ্চলে আরেকটি যুদ্ধ শুরু করতে চায়। নেতানিয়াহু এবং ট্রাম্প দুজনই অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বড় ধরনের সংকটে আছেন। দুর্নীতির অভিযোগে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে সেখানে তদন্ত হচ্ছে। আর ট্রাম্প নিজে নানা সংকটে জড়িত। তার যৌন কেলেঙ্কারির পাশাপাশি তিনি চীন ও ইউরোপের সঙ্গে একধরনের ‘বাণিজ্য যুদ্ধে’ জড়িয়ে গেছেন। এ থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়ার জন্যই মধ্যপ্রাচ্যে এ সংকট নতুন করে সৃষ্টি করা হচ্ছে। কিন্তু এতে ফিলিস্তিনিদের দমিয়ে রাখা যাবে না। এতদিন যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনি সংকট সমাধানে একধরনের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে আসছিল। কিন্তু ট্রাম্পের ইসরাইলপন্থি নীতি সেই অবস্থান থেকে এখন সরে এলো। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস তো স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন, তারা আর যুক্তরাষ্ট্রকে ‘মধ্যস্থতাকারী’ হিসেবে মানেন না। এটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য লজ্জাজনক। এমনকি বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্র এখন আর রাখে নাÑ এমন কথাও উচ্চারিত হয়েছে বিভিন্ন মহলে। একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে, জেরুজালেমে যখন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস ভবন (১৪ মে) উদ্বোধন করা হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বন্ধুরাষ্ট্র ওই অনুষ্ঠানে যোগদান করেনি। আলজাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের ট্র্যাডিশনাল মিত্ররা (জার্মানি, ব্রিটেন, ফ্রান্স) অনুষ্ঠানে যোগ দেয়নি। ভারতের সঙ্গে ইসরাইলের ‘ভালো’ সম্পর্ক থাকলেও ভারতও ওই অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত ছিল। চীনও অনুপস্থিত ছিল। এর মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত হলো যে, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে অনেক দেশই একমত নয়। এটা ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতির জন্য খুব ভালো সংবাদ নয়। 
বন্দুকের জোরে ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের অধিকারবঞ্চিত করছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় স্থান পেয়েছে গাজাবাসীর অবর্ণনীয় দুরবস্থার কথা। বলা হচ্ছে গাজা হচ্ছে উন্মুক্ত একটা কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। একটি সীমিত এলাকায় ইসরাইলি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকে গাজাবাসী। এতে কি ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা সংগ্রাম দমিয়ে রাখা যাবে? ফিলিস্তিনি তরুণ ফাদি আবু সালাহর ছবি সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। ২০০৮ সালে ফাদি প্রতিবাদ জানাতে এসে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর গুলিতে পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলেন। ২০১৮ সালে হুইলচেয়ারে প্রতিবাদ করতে এসে তিনি শহীদ হলেন। ৮ মাসের শিশু লাইলা আল গান্দেউরের ছবিও ভাইরাল হয়েছে। ইসরাইলি সেনাদের নিক্ষেপিত টিয়ারশেলের ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায় লায়লা। ফাদি আর লায়লার মৃত্যু প্রমাণ করে ফিলিস্তিনি আন্দোলন দমিয়ে রাখা যাবে না। ট্রাম্পের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে উত্তেজনা বেড়েছে। কিন্তু তাতে ফিলিস্তিনি আন্দোলন বন্ধ হবে না। দীর্ঘ ৭০ বছর ফিলিস্তিনিরা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে আসছে। কিন্তু একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রও আজ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তা এখনও অনেকটা কাগজে-কলমে আটকে আছে। ১৯৯৩ সালে পিএলও এবং ইসরাইল পরস্পরকে স্বীকৃতি এবং ওয়াশিংটনে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর, ১৯৯৪ সালে গাজা ও জেরিকোয় ফিলিস্তিনি শাসন প্রতিষ্ঠা, ১৯৯৫ সালে পশ্চিমতীরে স্বায়ত্তশাসনসংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর ইত্যাদি শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসেবে চিহ্নিত হলেও মূল সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। অর্থাৎ স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। একটি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়েছে, কিন্তু এর কোনো সার্বভৌমত্ব নেই। উপরন্তু পশ্চিমতীর ও গাজা নিয়ে যে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের জন্ম, তা কার্যত অনেকটাই ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি ‘রাষ্ট্রে’ পরিণত হয়েছে। ইসরাইল এমন একটি ‘ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র’ দেখতে চায়, যা তাদের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হবে। 
পাঠক ২০১৪ সালের পরিস্থিতির কথা স্মরণ করতে পারেন। ওই সময় ইসরাইলি বিমান আর ট্যাংকের গোলায় গাজা নগরী একটি ধ্বংসের নগরীতে পরিণত হয়েছিল। সাত সপ্তাহ ধরে এই আগ্রাসন অব্যাহত ছিল। ইসরাইলি বিমান হামলায় শত শত শিশু সেখানে মারা গিয়েছিল। কিন্তু জাতিসংঘ ও বিশ্বসম্প্রদায় ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো ববস্থা নিতে পারেনি। কিংবা গণহত্যার জন্য ইসরাইলি নেতাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে নিয়ে যেতে পারেনি। আর এটাই হচ্ছে মূল সমস্যা। ইসরাইলি আগ্রাসী নীতির কারণে আজও সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক জেরুজালেমে তাদের দূতাবাস স্থানান্তরের কারণে এই শান্তি প্রক্রিয়া অনির্দিষ্টকারের জন্য পিছিয়ে গেল। এর মধ্য দিয়ে যে অসন্তোষের জন্ম হয়েছে, তা সহজে থামবে বলে মনে হয় না। যুক্তরাষ্ট্র বড় দেশ এবং তার ভূমিকা আন্তর্জাতকিভাবে স্বীকৃত। ওবামা প্রশাসন একটি দুই রাষ্ট্র ফর্মুলা নিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন। ট্রাম্প প্রশাসন যদি এদিকে অগ্রসর হয়, তাহলে ফিলিস্তিন সমস্যার একটা সমাধান সম্ভব। আর এতে করে তা হবে স্থিতিশীল মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একধাপ অগ্রগতি।
Daily Alokito Bangladesh
27.05.2018

মালয়েশিয়া ও কর্নাটক নির্বাচনের শিক্ষা



 ২৬ মে ২০১৮, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সম্প্রতি মালয়েশিয়া ও ভারতের কর্নাটক রাজ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুটি নির্বাচনই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। মালয়েশিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, এই নির্বাচন ১৯৫৭ সালের পর এই প্রথম একটি বিরোধী জোটকে ক্ষমতায় বসিয়েছে এবং ৯২ বছর বয়সে মাহাথির মোহাম্মদ পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন। এখানে বড় প্রশ্ন একটিই- তিনি মালয়েশিয়াকে কী দিতে পারবেন? ভারতের কর্নাটক রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন হয়েছে। এতে বিজেপি বিজয়ী হলেও সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবে সেখানে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পদত্যাগ করেছেন। নয়া মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন মাত্র ৩৮ আসন পাওয়া (বিধানসভার মোট আসন ২২০) এইচডি কুমারাস্বামী, যিনি জনতা দলের (সেকুলার) রাজ্য শাখার প্রধান। এ নির্বাচন থেকে আমাদের দেশের রাজনীতিকরা কি কিছু শিক্ষা নিতে পারেন?
এখানে বলা ভালো, মাহাথির মোহাম্মদ আর কুমারাস্বামীর মধ্যে একটা মিল আছে। মালয়েশিয়ার সংসদের নিুকক্ষ ‘দেওয়ান রাকিয়াতে’র নির্বাচনে ২২২ আসনের মধ্যে মাহাথির মোহাম্মদের দল পিপিবিএম মাত্র ১৩ আসন পেয়েছে। তবে তার নেতৃত্বাধীন জোট পাকাতান হারাপান পেয়েছে ১১৩টি আসন। সরকার গঠনের জন্য দরকার ছিল ১১২ আসন। সরকারি জোট বারিসান ন্যাসিওনাল পেয়েছে মাত্র ৭৯ আসন। মজার কথা, মাহাথির যে জোটের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সেই জোটে বড় দল পিপলস জাস্টিস পার্টি পেয়েছে ৪৭ আসন। আনোয়ার ইব্রাহিমের নেতৃত্ব দেয়া দলটি প্রধানমন্ত্রীর পদ দাবি করতে পারত। যদিও নতুন সরকারে আনোয়ার ইব্রাহিমের স্ত্রী ডা. ওয়ান আজিজা ওয়ান বিনতি ইসমাইলকে ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীর পদ দেয়া হয়েছে। সম্পর্কে তিনি মাহাথির মোহাম্মদের শ্যালিকা। এমনকি জোটে দ্বিতীয় বড় দল ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন পার্টি ৪২ আসন পেয়েও প্রধানমন্ত্রীর পদটি দাবি করেনি। দলটির সিনিয়র নেতা লিম গুয়ান ইং, যিনি চীনা বংশোদ্ভূত, প্রথমাবরের মতো মালয়েশিয়ার ইতিহাসে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন। আগে অর্থমন্ত্রীর পদটি বরাবরই প্রধানমন্ত্রীর হাতে ছিল।
আমরা এবার একটু কর্নাটকের দিকে তাকাতে পারি। কর্নাটকের নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ ছিল এ কারণে যে, ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির কর্নাটক বিজয় ভারতব্যাপী গেরুয়া বিপ্লবের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারত। কর্নাটকে বিধানসভার আসন ২২০। বিজেপি পেয়েছে ১০৪ আসন, কংগ্রেস ৭৮, আর জনতা দল (সেকুলার) ৩৮ আসন। কংগ্রেস আর জনতা দলের যৌথ আসন ১১৬। সরকার গঠনের জন্য দরকার ১১১। বিজেপি নির্বাচনের পরপর বড় দল হিসেবে সরকার গঠনের আমন্ত্রণও পেয়েছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। শেষ খেলাটা খেললেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী। জনতা দলের সঙ্গে সমঝোতা হল। মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন কুমারাস্বামী, যিনি কর্নাটকে একজন বিতর্কিত রাজনীতিক। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেব গৌড়ার জ্যেষ্ঠ সন্তান তিনি। কুমারাস্বামীর মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় লোকসভা নির্বাচনের জন্য একটি ‘শিক্ষা’।
এ দুটি নির্বাচন অনেক প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে। এক. বড় দলগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে ছোট দলগুলোও যে সরকার গঠন করতে পারে এটা তার বড় প্রমাণ। বড় দলগুলো তাদের দলীয় স্বার্থের বিবেচনায় ছোট দলগুলোর সঙ্গে ‘ঐক্য’ করতে পারে, এমনকি প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীর পদটিও ছেড়ে দিতে পারে। এটাই রাজনীতি, আর রাজনীতির ‘চাল’। দুই. বড় দলগুলোর যে অহমিকা, তা সরকার গঠনের ক্ষেত্রে কোনো অন্তরায় সৃষ্টি করে না। তিন. রাজনীতিতে ‘বাস্তবতা’ বলে একটা কথা আছে। বড় দলগুলোকে শেষ পর্যন্ত এটা মানতে হয়। চার. তরুণ প্রজন্ম একটা ফ্যাক্টর। বড় দলগুলোকে এটা উপলব্ধি করতে হয়েছে। পাঁচ. অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তি ও ব্যক্তির ভূমিকা একটা ফ্যাক্টর।
আমরা কি বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে পারি? এটা ঠিক, বাংলাদেশের রাজনীতি দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে। কোনোভাবেই এ দুটি বড় দলের সহাবস্থান হচ্ছে না। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় একটা ‘ঐক্য’ হয়েছিল। পঞ্চম জাতীয় সংসদেও একটা ‘ঐক্য’ হয়েছিল। পঞ্চম সংসদে বিজয়ী বিএনপি আর আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংবিধানে সংশোধনী আনার ফলে আমরা সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে গিয়েছিলাম। এরপর ২৭ বছর পার হয়েছে। দুটি বড় দলের মাঝে বিভেদ, অনৈক্য, রেষারেষি দিন দিন বাড়ছেই। সুস্থ গণতন্ত্রের স্বার্থে একটি সহাবস্থানের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা হয়নি। বরং দেখা গেছে একটি দল অপর দলকে ‘উৎখাত’ করতেই বেশি তৎপর। রাজনীতি এখানে গৌণ হয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে তৃতীয় একটি রাজনৈতিক শক্তির প্রয়োজনীয়তা থাকলেও সেই শক্তি গড়ে ওঠেনি। সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ। সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী বিএনপির ইফতার মাহফিলে বিএনপি নেতাদের উপস্থিতিতে একটি তৃতীয় শক্তির উত্থানের কথা বলেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তার উদ্যোগে সম্প্রতি যে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়েছে, সেই যুক্তফ্রন্ট কি তৃতীয় শক্তি? মাহাথির মালয়েশিয়ার প্রেক্ষাপটে এটি পেরেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। মাহাথিরের যে ক্যারিশমা, কমিটমেন্ট, রাজনৈতিক সততা, যুক্তফ্রন্টের নেতাদের তা নেই। যুক্তফ্রন্টের নেতারা ঢাকাকেন্দ্রিক ও বিবৃতিসর্বস্ব কয়েকটি দল, যাদের কোনো গণভিত্তি নেই। তবে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে যুক্তফ্রন্টের একটি ‘ঐক্য’ হতে পারে। নির্বাচনী ঐক্য। সে ক্ষেত্রে বিএনপিকে বড় ছাড় দিতে হবে। পাকিস্তানে জেনারেল পারভেজ মোশাররফের বিরুদ্ধে বেনজির ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পিপিপি এবং দলটির চিরশত্র“ নওয়াজ শরিফের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ ‘গণতন্ত্র উদ্ধার কমিটি’ গঠন করেছিল। মালয়েশিয়ায় বিরোধী জোটের বড় দল পিপলস জাস্টিস পার্টি ছোট দল পিপিবিএম প্রধান মাহাথির মোহাম্মদকে নেতৃত্ব দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। এতে করে জাস্টিস পার্টির নেতৃত্ব, বিশেষ করে মাহাথিরের একসময়ের শত্র“ আনোয়ার ইব্রাহিমের মধ্যেও কোনো অহংবোধ কাজ করেনি। এখানে সরকার পরিবর্তনের বিষয়টি ছিল মুখ্য। কর্নাটকেও তা-ই হয়েছে। রাহুল গান্ধী সেখানে বাস্তববাদী নীতি গ্রহণ করেছেন। তার দল সরকার গঠনের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এটা চাণক্য কৌশল। ‘শত্র“র শত্র“ আমার মিত্র’ চাণক্যের এই কৌশল মালয়েশিয়া কিংবা কর্নাটকে আমরা দেখেছি। আমরা মানি আর না মানি, রাজনীতিতে বিএনপি এখন কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে। রাজপথে বিএনপি আন্দোলন করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপির নেতারাও অনেকটা ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে গেছেন। বেগম জিয়ার অবর্তমানে ঢাকার বাইরে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগও বিএনপির পক্ষ থেকে দেখা যাচ্ছে না। বিএনপি নিঃসন্দেহে বড় দল। এ মুহূর্তে তাদের কোনো অহমিকা থাকা উচিত নয়। আর এটা বোধহয় এখন বাস্তবতা যে, বেগম জিয়া ও তারেক রহমান জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না! মামলা-মোকদ্দমা আর মামলার রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের প্রার্থিতা বাতিল হতে পারে। প্রার্থী পদের প্রশ্নে তাদের উচ্চ আদালতের রায়ের ওপর নির্ভর করতে হবে। কিন্তু ততদিনে প্রার্থী মনোনয়নের সময়সীমা পার হয়ে যেতে পারে। তাই বিএনপিকে একটি বাস্তববাদী নীতি গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ‘মাহাথির ফর্মুলা’কে সামনে রেখে বিএনপি সর্বজন গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তিকে সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করে যদি নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে, তাতে বিএনপির ক্ষতির চেয়ে লাভই হবে বেশি। এ নির্বাচনটি বিএনপির জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কটের পেছনে দলটির যত যুক্তিই থাকুক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে সেই বয়কট বিএনপিকে যথেষ্ট দুর্বল করে দিয়েছে। ২০১৮ সালেও বিএনপি যদি আবারও নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়(?), তা দলটির জন্য আত্মঘাতী হবে। কারণ এতে করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বন্ধ করা যাবে না। বিএনপির পক্ষে আন্দোলন করাও সম্ভব হচ্ছে না। মানুষ আর আগের মতো হরতাল-অবরোধে সাড়া দেয় না। হরতাল-অবরোধে বাসে আগুন দেয়াসহ নানা অপরাধ সংঘটিত হয় এবং সঙ্গত কারণেই এর দায়ভার পড়ে বিএনপির ওপর।
বিএনপি এখন আন্দোলনের কথা বলছে। দলটি অনেকটা বিবৃতিসর্বস্ব দলে পরিণত হয়েছে। সরকারের দমননীতি এখনও বিদ্যমান। মামলা-মোকদ্দমা এখনও দলটির নেতারা কাটিয়ে উঠতে পারছেন না। এ কারণেই তারা আন্দোলনের কথা বলে নির্লিপ্ত থাকছেন। নির্বাচনী সংস্কৃতিতে এখন অনিয়ম স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যে ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’ বিদ্যমান (কম্বোডিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া), তার ছোঁয়া লেগেছে বাংলাদেশেও। আগামী নির্বাচন নিয়ে তাই শঙ্কা আছে। তবুও নির্বাচনে যেতে হবে। নির্বাচন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। একটি জাতীয় ঐক্যের কথা বলেছেন মির্জা ফখরুল। কিন্তু এর রূপরেখা কী? কার সঙ্গে কার ঐক্য? এসব বিষয় খোলাসা হওয়া প্রয়োজন। এখন যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে ২০ দলীয় জোটের যদি সমঝোতা হয়, তাহলে লাভবান হবে বিএনপিই। নতুবা এ সুযোগটি আওয়ামী লীগও গ্রহণ করতে পারে।
আমরা একটি সুস্থ ধারার রাজনীতি চাই। সুস্থ ধারার রাজনীতিই বাংলাদেশের উন্নয়নের রাজনীতিকে ত্বরান্বিত করতে পারে। দুর্নীতি রোধ করতে পারে। সরকারের দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করতে পারে। আর এই সুস্থ ধারার রাজনীতির অন্যতম শর্তই হচ্ছে সব দলের অংশগ্রহণ। এটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব যেমন সরকারের, তেমনি বিরোধী দলেরও।
ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র
Daily Jugantor
26.05.2018

তৃতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধ কি আসন্ন!



পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে তৃতীয় আরেকটি যুদ্ধ কি আসন্ন? প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কর্তৃক ছয় জাতি ইরান পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বের হয়ে আসার ঘোষণা ও জেরুজালেমে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস স্থাপনের পর এই প্রশ্নটি এখন উঠেছে যে উপসাগরীয় অঞ্চলে তৃতীয় আরেকটি যুদ্ধের সম্ভাবনা এখন প্রবল। এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেট ইরান। বিগত দুটি গালফ বা উপসাগরীয় যুদ্ধও যুক্তরাষ্ট্র শুরু করেছিল। ইরাক কর্তৃক কুয়েত দখল হয়ে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ৩৫টি দেশের একটি কোয়ালিশন বাহিনী ইরাকের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ শুরু করেছিল (১৭ জানুয়ারি ১৯৯১-২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১), ইতিহাসে তা চিহ্নিত হয়ে আছে প্রথম গালফ যুদ্ধ হিসেবে। ওই যুদ্ধে ইরাকের পরাজয় হয়েছিল এবং কুয়েত দখলমুক্ত হয়েছিল। দ্বিতীয় গালফ যুদ্ধও শুরু করেছিল যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের বিরুদ্ধে ২০০৩ সালের ২০ মার্চ। অভিযোগ ছিল, ইরাকের কাছে WMD (Weapons of Mass Destruction) বা মারাত্মক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যা এই এলাকার নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে সেনা অভিযান পরিচালনা করেছিল। ওই অভিযানে ইরাকের শাসক সাদ্দাম হোসেন উৎখাত হয়েছিলেন। যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র দেশটি দখল করে নেয় এবং ২০১১ সালের ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশটি তাদের দখলে থাকে। ২০০৩ সালের পর ২০১৮ সালে এসে আরেকটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে আরো একটি সেনা অভিযান পরিচালনা করতে পারে।
তৃতীয় গালফ যুদ্ধে আরব রাষ্ট্রগুলো পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত থাকবে। ইসরায়েলের ওই যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এই যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করবে একদিকে ইরান এবং দেশটির পক্ষে সিরিয়া, লেবাননের হিজবুল্লাহ ও ইরাক এবং ইয়েমেনের শিয়া গোষ্ঠী, অন্যদিকে ইসরায়েল, সৌদি আরব, আরব আমিরাত ও পর্দার অন্তরালে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রই এই যুদ্ধকে উসকে দিচ্ছে এবং এরই মধ্যে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে এক ধরনের ‘ছায়াযুদ্ধ’ আমরা প্রত্যক্ষ করছি। তৃতীয় গালফ যুদ্ধ যদি বেঁধে যায়, তাহলে বিশ্ব রাজনীতিতে এটি বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডরা ‘স্ট্রেইট অব হরমুজ’ প্রণালি বন্ধ করে দিতে পারে, যেখান থেকে বিশ্বে সরবরাহকৃত জ্বালানি তেলের ৬৩ শতাংশ সরবরাহ করা হয়। প্রতিদিন ১৭ মিলিয়ন ব্যারেল তেল এ পথে সরবরাহ করা হয়। ওই পথ যদি বন্ধ হয়ে যায় বিশ্ব বড় ধরনের জ্বালানি সংকটে পড়বে। এ অঞ্চলে ইরানের যে কয়টি সমুদ্রবন্দর রয়েছে, ইসরায়েলি আক্রমণে তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের উদ্দেশ্য পরিষ্কার—ইরানের অর্থনীতিকে ধ্বংস করা।
কোনো কোনো ভিন্নধর্মী সংবাদমাধ্যম আমাদের জানাচ্ছে ভিন্ন কথা। তারা আমাদের এই তথ্য দিচ্ছে যে আসলে ইসরায়েলি লবি এই যুদ্ধটি চাচ্ছে। কেবিন জেসে ও মার্গারেট ফ্লাওয়ার ওই নিউজ পোর্টালে লিখিত এক প্রতিবেদনে (১৩ মে ২০১৮) আমাদের জানাচ্ছেন কিভাবে ইহুদি লবি ট্রাম্পকে উদ্বুদ্ধ করছে যুদ্ধে যেতে। তাদের একজন ক্যাসিনো ব্যবসায়ী শেলডন আডেলসন ট্রাম্পের প্রচারণা তহবিলে ৮৩ মিলিয়ন ডলার দান করেছিলেন। ট্রাম্পের শপথ অনুষ্ঠান আয়োজনে যে ফান্ড জোগাড় করা হয়েছিল, তাতে তিনি দিয়েছিলেন পাঁচ মিলিয়ন ডলার। তিনি ইহুদি লবির প্রতিনিধিত্ব করেন। তাঁরাই চেয়েছিলেন ইসরায়েলে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তেল আবিবের পরিবর্তে জেরুজালেমে সরিয়ে নেওয়া হোক। এই কাজটি এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে, যা মধ্যপ্রাচ্যের সংকটকে, বিশেষ করে গাজা এলাকার পরিস্থিতি জটিল করেছে।
আল জাজিরা তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে (২৩ এপ্রিল, ২০১৮) ইরানের আশপাশে কয়েক ডজন মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে। ওমান, আরব আমিরাত, কুয়েত, তুরস্ক, ইসরায়েল, এমনকি কাতারে মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে, যেখানে যুদ্ধবিমান মোতায়েন করা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে যেকোনো যুদ্ধে (সিরিয়া অথবা ইরান) এসব যুদ্ধবিমান ব্যবহৃত হতে পারে। ওই প্রতিবেদনে একটি ম্যাপও দেখানো হয়, যাতে স্পষ্ট করা হয়েছে কোথায় কোথায় মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে। ম্যাপে স্পষ্ট দেখা যায় ওই ঘাঁটি এবং বিমান মোতায়েন একরকম চারদিকে ইরানকে ঘিরে রেখেছে। ইরানে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে, সেখানে সরকার পরিবর্তন (রেজিম চেঞ্জ)। সাম্প্রতিককালে ইরানে যে ব্যাপক সরকারবিরোধী বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধন আছে বলে কোনো কোনো গণমাধ্যম উল্লেখ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র এতে কয়েক মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে বলেও গণমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক একটি থিংক ট্যাংক Brookings Institute ২০০৯ সালে তাদের এক প্রতিবেদনে (Which path to persia? Options for a new American strategy for Iran) ইরানে সরকার পরিবর্তনের একটি ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল। এখন ট্রাম্প প্রশাসন সেদিকে যাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যে নানা মাত্রার সংকট আমরা এখন প্রত্যক্ষ করছি। সিরিয়া সংকটের সমাধানের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কুর্দিস্তান কার্যত এখন সিরিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সেখানে তুরস্কের সেনাবাহিনী কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান পরিচালনা করছে। কুর্দি অঞ্চল আফরিন, যা কি না সিরিয়ার অংশ, সেখানে মার্কিন সৈন্য ‘উপদেষ্টা’ হিসেবে নিয়োজিত রয়েছে। ইসরায়েল সিরীয় সংকটে এত দিন নির্লিপ্ত থাকলেও এখন সরাসরি সিরিয়ার অভ্যন্তরে বিমান হামলা চালিয়ে এই যুদ্ধে শরিক হয়ে গেল। এদিকে সৌদি আরব-ইসরায়েল সমঝোতার একটি লক্ষণ ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র সরবরাহ করছে। ইরান-সৌদি দ্বন্দ্বও বাড়ছে। বলা হচ্ছে সৌদি আরব ইয়েমেনে ইরান সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীদের ওপর যে নিয়মিত বিমান হামলা চালাচ্ছে, তার পেছনে ওয়াশিংটনের সমর্থন রয়েছে। রাশিয়ার ভূমিকাও এখানে লক্ষ রাখার মতো। প্রকাশ্যে আসাদ সরকারকে রাশিয়া সমর্থন করলেও ইসরায়েল সিরিয়ায় ইরানি অবস্থানের ওপর বিমান হামলা চালালে রাশিয়া তাতে নীরব ভূমিকা পালন করে। এরই মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের অবনতি ও জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করে জেরুজালেমে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস স্থানান্তরের ঘটনা ঘটল।
মধ্যপ্রাচ্যের এই উত্তপ্ত রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা, যা কি না শুধু এ অঞ্চলের রাজনীতি নয়, বরং বিশ্বে উত্তেজনা বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট। জেরুজালেমে রাজধানী স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত কার্যকর করার মধ্য দিয়ে ট্রাম্প মূলত তাঁর প্রতিশ্রুতি পালন করলেন। গত ডিসেম্বরে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি অতিসত্বর যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে নেবেন। এই কাজটি তিনি এখন করলেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির একটি পরিবর্তনের দিকনির্দেশ  করলেন। এই কাজটি তিনি করলেন এমন একটা সময় যখন তিনি ইরান পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিলেন। দ্বিতীয়ত, ইসরায়েল স্পষ্টতই সিরিয়া যুদ্ধের একটা অংশ হয়ে গেছে এবং ইসরায়েল-ইরান এক ধরনের ‘ছায়াযুদ্ধ’ শুরু হয়ে গেছে। তৃতীয়ত, সিরিয়া সংকটের কোনো সমাধানও হচ্ছে না। এরই মধ্যে লেবানন ও ইরাকে নির্বাচন হয়েছে। এবং তাতে বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। লেবাননে ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ গ্রুপ নির্বাচনে ভালো করেছে এবং হিজবুল্লাহ সমর্থিত একটি সরকার সেখানে প্রতিষ্ঠিত হবে। হারিরি যদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে যান, তিনি হিজবুল্লাহর বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। ইরাকে মুকতাদা আল সদরের সমর্থকরা ভালো করেছে। ওয়াশিংটন সমর্থিত প্রধানমন্ত্রী হায়দার আল আবাদি সরকারের পতন ঘটেছে। মুকতাদা আল সদর ইরান সমর্থিত এবং প্রচণ্ড আমেরিকান বিরোধী। একই সঙ্গে হিজবুল্লাহরাও যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী। ফলে পারস্য অঞ্চলের রাজনীতিতে ইরানের প্রভাব বাড়ল। এটা একদিকে যেমন সৌদি আরবের জন্য চিন্তার কারণ, ঠিক তেমনি চিন্তার কারণ ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও। তাই অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছে যে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে প্রলুব্ধ করে একটি তৃতীয় গালফ যুদ্ধ শুরু করতে পারে।
তবে সত্যিকার অর্থে যদি গালফ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, তাহলে এই যুদ্ধ শুধু পারস্য অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, আরব বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। সম্ভাব্য এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা, তেল শোধনাগার যেমনি ধ্বংস করে দেবে, ঠিক তেমনি ইরানও সৌদি আরবের তেল পরিশোধন কেন্দ্রগুলো ধ্বংস করে দেবে। ফলে বিশ্ব ভয়াবহ জ্বালানি সংকটের মুখোমুখি হবে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেছে। বিশ্ববাজারে এই জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলারে উঠতে পারে। একজন গবেষক মাইকেল ক্লায়র ২০০৫ সালে একটি বই লেখেন ‘Blood and Oil’। বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘রক্ত ও তেল’। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন এই তেলের জন্য প্রথম দুটি গালফ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এটাকে তিনি বলেছেন Geopolitics of oil। অর্থাৎ তেলের ভূ-রাজনীতি। মোদ্দাকথা যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব পরিপূর্ণভাবে পারস্য অঞ্চলের তেলের ওপর নির্ভরশীল। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, ২০০৩ সালে দ্বিতীয় গালফ যুদ্ধে ইরাকের অবকাঠামো পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এরপর ইরাক অতিরিক্ত তেল উৎপাদন করে তার অবকাঠামো (রাস্তা, বিদ্যুৎ, পানি নিষ্কাশন ও পানি সরবরাহ) পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিল। ওই সব অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করেছিল শুধু মার্কিন কম্পানি। যার মধ্যে একটি কম্পানি ছিল ডিক চেনির, যিনি ছিলেন বুশের ভাইস প্রেসিডেন্ট।
সিরিয়া সংকটের পেছনেও এই তেলের ভূ-রাজনীতি কাজ করছে। সিরিয়ার কুর্দি নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে (আফরিন) মার্কিন উপদেষ্টারা মোতায়েন রয়েছে, যারা কুর্দি বিদ্রোহী বাহিনীকে সহায়তা করছে। এ অঞ্চলে রয়েছে জ্বালানি তেলের বিশাল ভাণ্ডার, যা কুর্দিদের দখলে এবং মার্কিন কম্পানিগুলো এখান থেকে একতরফাভাবে তেল উত্তোলন করছে। অতিসম্প্রতি ইসরায়েল অধিকৃত গোলান উপত্যকায় বিপুল তেল আবিষ্কৃত হয়েছে। এই গোলান উপত্যকা ছিল সিরিয়ার। ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে গোলান উপত্যকা ইসরায়েল দখল করে নেয়। সেই দখলি স্বত্ব এখনো বহাল আছে। সুতরাং তেল মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির অন্যতম নির্ধারক। এই তেলের জন্যই এখানে বারে বারে যুদ্ধ হচ্ছে। ইরানকে কবজায় নেওয়ার পেছনেও এই তেলের ভূ-রাজনীতি কাজ করছে। এখানে কার্টার ডকট্রিনের কথা উল্লেখ করা যায় (১৯৮০)। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার এই মতবাদের প্রবক্তা। এই মতবাদের মূল কথা হচ্ছে, সৌদি আরব ও গালফ অঞ্চলের তেলের সরবরাহ নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র বল প্রয়োগ করতে পারবে, যাতে কোনো ‘শক্তি’ এই তেল সরবরাহে বাধা দিতে না পারে। পরবর্তী সময়ে রিগ্যানও এই মতবাদ অনুসরণ করেন। ইরাক-ইরান যুদ্ধে (১৯৮০-১৯৮৮) ‘স্ট্রেইট অব হরমুজ’ (strait of Hormuz) প্রণালি দিয়ে যেসব তেলবাহী জাহাজ চলাচল করত, সেগুলো মার্কিন নেভির ছত্রচ্ছায়ায় ও প্রটেকশনে চলাচল করত, যাতে করে ইরান এই তেল ট্যাংকারগুলো ধ্বংস করে দিতে না পারে। তেল রিজার্ভের তালিকায় বিশ্বে ইরানের অবস্থান চতুর্থ (বিশ্বের ১০ শতাংশ)। এই রিজার্ভের পরিমাণ ধরা হয় ১৫০ বিলিয়ন ব্যারেল। ইরানের গ্যাসও রয়েছে। সরকারি তথ্য মতে, বর্তমানে ইরানে ১০২টি তেলের ফিল্ড এবং ৪৩টি গ্যাসফিল্ড রয়েছে। এবং ২০৫টি তেলের রিজার্ভার ও ৯২টি গ্যাসের রিজার্ভার বর্তমান। সুতরাং ইরানের তেলের ওপর মার্কিন তেল কম্পানিগুলোর যে আগ্রহ থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। একজন ইতিহাসবিদ আন্দ্রো বেসেভিচ (Andrew Bacevich) তাই এ অঞ্চলে সম্ভাব্য একটি সৌদি-যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল অক্ষ গড়ে ওঠার কথা বলেছেন (America goes rogue, spectator USA, 9 May 2018)। সেই অক্ষ এখন ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। চূড়ান্ত বিচারে তাই তৃতীয় গালফ যুদ্ধের সম্ভাবনা থাকবে, নাকি ‘ছায়াযুদ্ধ’-এর মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধ প্রলম্বিত হবে, সেটাই দেখার বিষয়।
ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
Daily Kalerkontho
23.05.2018

ইতিহাস মাহাথিরকে কীভাবে স্মরণ করবে


মাহাথির মোহাম্মদ এখন আবারো মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী। এর আগে চার চারবার তিনি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছিলেন। কেননা তার তখন বয়স হয়েছিল। তিনি নয়া এক নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন। সেটা ছিল একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা। সাধারণত তৃতীয় বিশ্বের নেতারা ক্ষমতা ছাড়তে চান না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ক্ষমতা ধরে রাখতে চান। পাঠক নিশ্চয়ই স্মরণ করতে পারবেন জিম্বাবুয়ের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মুগারের কথা। ৯৩ বছর বয়সে এসে তিনি গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন। তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট বেজি সাঈদের বয়সও ৯০। মালয়েশিয়ার বর্তমান যে রাজা মুহিবুদ্দিন তুয়ানকো আবদুল হালিম সুলতান বদলিশাহ, তার বয়স ৮৯। কুয়েতের আমির সাবাহ আল-জাবের আল সাবাহ, তার বয়স ৮৭। ৮৫ বছর বয়সে রাহুল ক্যাস্ট্রো ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছেন চলতি বছর মার্চে (কিউবা)। পল বিয়া, ক্যামেরুনের প্রেসিডেন্ট, তার বয়সও ৮৫। সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান, তার বয়স ৯০ ছুঁই ছুঁই করছে। এ পরিসংখ্যান হয়ত আরো দেওয়া যায়। কিন্তু এদের সঙ্গে মাহাথিরের পার্থক্য অনেক জায়গায়। মাহাথির স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছিলেন। তার দেশের মানুষের কাছে তিনি ছিলেন পরমপূজনীয় এক ব্যক্তিত্ব। মালয়েশিয়ার তরুণ সমাজকে একটি স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। যে কারণে গেল সপ্তাহে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে তরুণ প্রজন্ম ব্যাপকভাবে তাকে সমর্থন করে। এই ৯২ বছর বয়সকে তরুণ প্রজন্ম গুরুত্ব দেয়নি। তারা মনে করেছে জীবনের শেষপ্রান্তে এসেও মাহাথির এখনো কিছু দিতে পারবেন। ১৫ বছর পর তার এই ফিরে আসা তাই সঙ্গতকারণেই অনেক প্রশ্নের জন্ম দেবে। কতদূর যেতে পারবেন মাহাথির এখন? বয়স কি তার কর্মস্পৃহাকে বেঁধে ফেলবে? ইতিহাসে কীভাবে চিহ্নিত হবেন তিনি এখন? একজন সংস্কারবাদী নেতা? একজন কট্টর শাসক?
যারা মাহাথির মোহাম্মদের লিখিত The Malay Dilemma পাঠ করেছেন, তারা দেখেছেন কীভাবে মালয় জাতীয়তাবাদী আদর্শকে ধারণ করে মাহাথির মালয়েশিয়ার এক অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। ১৯৭০ সালে বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। একধরনের উগ্র মালয় জাতীয়তাবাদী আদর্শ প্রচারের কারণে (মালয়ীরা ভূমিপুত্র, মালয়ভাষা মালয়েশিয়ার একমাত্র ভাষা এবং এ ভাষা সবাইকে জানতে হবে, মালয়েশিয়ায় চীনা ব্যবসায়ীদের প্রভাব কমানো ইত্যাদি) তার নিজ  দল উমনো (ইউনাইটেড মালয়াস ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন) থেকে তিনি বহিষ্কৃতও হয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালের ১৩ মে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে যে দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছিল (মালয় বনাম চীনা বংশোদ্ভূতদের মধ্যে), তার জন্য মাহাথিরকে দায়ী করা হয়েছিল। ওই ঘটনায় রাজা দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পর্যন্ত বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু এসব ঘটনা এখন অতীত। সাধারণ মানুষ তার নেতৃত্বাধীন জোটকে বিজয়ী করায় এটা প্রমাণিত হলো তার প্রতি মানুষের এখনো সমর্থন আছে। মাহাথির মোহাম্মদের এই বিজয় নিঃসন্দেহে মালয়েশিয়ার রাজনীতির জন্য একটি বড় ঘটনা। তবে তার প্রধান কাজ এখন পিকেআর (পার্টি কেয়াদিলান রাকায়েত বা পিপলস জাস্টিস পার্টি) প্রধান আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে একটা স্থায়ী সমঝোতায় যাওয়া। ইতোমধ্যে রাজার ক্ষমা প্রার্থনা মঞ্জুর হয়েছে এবং আনোয়ার ইব্রাহিম মুক্তি পেয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, আনোয়ার ইব্রাহিমই হবেন ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী। অথচ মাহাথির যখন এর আগে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে তিনি আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। সমকামিতার অভিযোগ এনে তাকে তিনি জেলেও পাঠিয়েছিলেন। সেই আনোয়ারই কিনা এখন তার শত্রু থেকে মিত্র। আনোয়ারই জেলে থাকা অবস্থায় পাকাতান হারপানের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য মাহাথির মোহাম্মদকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। একসময় আনোয়ার ইব্রাহিম মাহাথির মোহাম্মদের নেতৃত্বাধীন সরকারে উপ-প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন।
মাহাথির মোহাম্মদ এই ৯২ বছর বয়সে এসেও যে ‘সাহস’ দেখিয়েছেন, তাতে অবাক না হয়ে পারা যায় না। নিজেই বলেছেন ক্ষমতায় থাকার সময় তিনি কিছু ভুল করেছিলেন। এই ভুল শোধরানো ও মালয়েশিয়াকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্যই তিনি আবারো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বটি নিতে চান। তিনি ভুল করেছেন- এই যে স্বীকারোক্তি, এই স্বীকারোক্তিকে মানুষ সেখানে সম্মান দেখিয়েছে। তার প্রতি মানুষ আস্থা রেখেছে। এর ফল নির্বাচনে তার জোটের বিজয়। তার জন্য বিষয়টি অত সহজ ছিল না। কেননা মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে বারিসান ন্যাসিওনাল জোটের (১০ দল) একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। দীর্ঘ ৬০ বছরের ওপর এই জোট ক্ষমতায়। উপরন্তু পুরনো সব দলই দশদলীয় এই জোটে আছে। যেমন উমনো বা ইউনাইটেড ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের পাশাপাশি রয়েছে মালয়েশিয়ান চাইনিজ অর্গানাইজেশন, মালয়েশিয়ান ইন্ডিয়ান কংগ্রেস, সারওয়াক ইউনাইটেড পিপলস পার্টি, সাবাহ ইউনাইটেড পার্টি। চীনা ও ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে স্বাধীনতার পর পরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এদের সহযোগিতা নিয়েই উমনো দীর্ঘ ৬০ বছর একটি জোট বা ফ্রন্ট গঠন করে ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছিল। এরা যে নির্বাচনে হেরে যাবে, এটা ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার। কিন্তু মাহাথির মোহাম্মদ এই অসম্ভব কাজটি সম্ভব করলেন।
এটা বলতে দ্বিধা নেই যে, মাহাথির মোহাম্মদ দেশটিকে এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। তিনি আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার। গত ১৫ বছর তিনি সরকার পরিচালনার সঙ্গে ছিলেন না। অর্থনীতিও আগের মতো নেই। আঞ্চলিক তথা বিশ্ব রাজনীতিতেও পরিবর্তন এসেছে। এ অঞ্চলে চীনের যে প্রভাব বাড়ছে, সে ব্যাপারে তিনি অবহিত। তাই দায়িত্ব নেওয়ার পর পরই মাহাথির বলেছেন চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচিকে তিনি সমর্থন করবেন। অর্থাৎ উন্নয়ন ধারাকে চীনা অর্থায়নে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে চান তিনি। মালয়েশিয়াকে একটি শিল্পোন্নত দেশে পরিণত করতে চান। আর তাই বলেছেন, মালয়েশিয়া হবে একটি রফতানিকারক দেশ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে তার নীতি কী হয়, তা এখন দেখার বিষয়। অতীতে তিনি এ অঞ্চলে মার্কিনি নীতির সমালোচনা করেছিলেন। মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগও তিনি একসময় নিয়েছিলেন। জাতিসংঘের আদলে মুসলিম বিশ্বের জন্য ‘একটি জাতিসংঘ’ গঠন করারও প্রস্তাব ছিল তার। মালয়েশিয়ায় উগ্র ইসলামপন্থিরা সক্রিয়- এ ব্যাপারে তার ভূমিকা কী হয়, সেটাও দেখার বিষয়।
মালয়েশিয়ায় এই যে পরিবর্তন, এই পরিবর্তনকে অনেকে ‘রাজনৈতিক সুনামি’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। অনেকগুলো প্রশ্ন এখন সামনে আছে। কী হতে পারে মালয়েশিয়ায় এখন? কিংবা মাহাথির কি আবারো তার পূর্বের ক্যারিশমা দেখাতে পারবেন? নির্বাচনী প্রচারণায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে মাহাথির যে ডাক দিয়েছিলেন, তা সাধারণ মানুষ গ্রহণ করেছে। মানুষ বিশ্বাস করেছে যে, ক্ষমতার শীর্ষ পর্যায়, প্রধানমন্ত্রী (নাজিব রাজাক) নিজে দুর্নীতিগ্রস্ত ছিলেন। Malaysian Development Berhad নামে একটি বিনিয়োগ সংস্থা গঠন করেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নাজিব রাজাক। ওই বিনিয়োগ সংস্থা থেকে ৭০০ মিলিয়ন ডলার নাজিব রাজাকের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের (জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট) বরাতে এই দুর্নীতির তথ্য উদঘাটিত হয়েছিল। এই তথ্য নাজিব রাজাককে একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে ফেলে দেয়। তিনি এর জবাব দিতে পারেননি। শুধু বলেছেন, এই অর্থ এক সৌদি যুবরাজ তাকে দিয়েছে। কিন্তু মানুষ ওটা বিশ্বাস করেনি। একসময় নাজিব রাজাক ছিলেন মাহাথিরের ভাবশিষ্য। ২০০৮ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। একসময় রাজাক যাকে গুরু মানতেন সেই মাহাথির মোহাম্মদই তার পতন ডেকে আনেন। প্রশ্ন একটাই, এখন কি মাহাথির দুর্নীতির অভিযোগে নাজিব রাজাককে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাবেন? এ প্রশ্নটি উঠেছে যখন দেশত্যাগে তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। যদিও মাহাথির বলেছেন তিনি কোনো প্রতিশোধ নেবেন না। তবে তিনি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবেন! এর অর্থ পরিষ্কার। নাজিব রাজাককে এখন ওই ৭০০ মিলিয়ন ডলারের বিষয়টি নিয়ে রাষ্ট্রীয় তদন্ত কমিটির মুখোমুখি হতে হবে। মাহাথির মোহাম্মদকে ওই বিষয়টির ফয়সালা করতেই হবে। কেননা তিনি নির্বাচনী প্রচারণায় ওই দুর্নীতির বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছিলেন। এমনকি আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে তার সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, সেটাও দেখার বিষয়। আনোয়ার ইব্রাহিমকে জেল থেকে মুক্তি, তার জন্য সংসদে একটি আসন দেওয়া, অর্থাৎ একটি উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সংসদে আসা- এসবই এখন মাহাথিরকে করতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, সংসদে মাহাথিরের নিজ দলের আসন সংখ্যা কম, মাত্র ১২টি। তাকে সরকার পরিচালনায় আনোয়ার ইব্রাহিমের দলের ওপর নির্ভর করতে হবে, যাদের আসন সংখ্যা ৪৯। চূড়ান্ত বিচারে আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে তিনি যদি কোনো বিষয়ে ‘বিবাদে’ জড়িয়ে যান, তাহলে তা তার জন্য ভালো কোনো সংবাদ বয়ে আনবে না। তার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। আগের মতো কর্মক্ষম নন তিনি। তিনি নিজে বলেছেন তিনি আনোয়ার ইব্রাহিমের হাতে ক্ষমতা দিয়ে পুনরায় ‘অবসরে’ যাবেন! তিনি যদি এদিকে অগ্রসর হন, তার নিজের জন্যও তা ভালো। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, তৃতীয় বিশ্বের অনেক নেতাই ক্ষমতা ধরে রাখতে চান শেষ বয়সে এসেও (জিম্বাবুয়ের রবার্ট মুগাবে)। এখন মাহাথির এটি করবেন কিনা সেটাই দেখার বিষয়। সংসদের বর্তমান বিরোধী জোট হচ্ছে বারিসান ন্যাসিওনাল। সুষ্ঠু সরকার পরিচালনার জন্য মাহাথিরকে বড় দল ৪২ আসন পাওয়া ডেমোক্র্যাটিক অ্যাকশন পার্টি (জোট সদস্য) এবং তার পূর্বের দল উমনোর সঙ্গে একটা আস্থার সম্পর্কে যেতে হবে। এই দুটি বড় জোটের সঙ্গে আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক না থাকলে, তিনি সরকার পরিচালনা করতে পারবেন না। বলা ভালো, দীর্ঘ ৬০ বছর যে দলটি অথবা জোট রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল, প্রশাসনের সর্বত্র তার একটি সমর্থক শ্রেণি তৈরি হয়েছে। মাহাথিরকে এদের আস্থা অর্জন করতে হবে। কাজটি মাহাথিরের জন্য খুব সহজ নয় এবং মালয়েশিয়ার অর্থনীতি আর আগের অবস্থানে নেই। অর্থনীতিকে আগের জায়গায় নিয়ে যেতে হলে সেখানে একটি সুষ্ঠু নীতি ও স্থিতিশীলতা দরকার। মাহাথিরের একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, তিনি তার সঙ্গে পুরনো অনেক সহকর্মীকে পেয়েছেন, যারা যোগ্য। ফলে সরকার পরিচালনায় নতুনদের পাশাপাশি পুরনোদের সহযোগিতাও তিনি পাবেন। নিশ্চিত করেই বলা যায়, মালয়েশিয়ার এই নির্বাচন প্রমাণ করল নেতৃত্ব যদি সৎ হয়, তাহলে পরিবর্তন সম্ভব। এক্ষেত্রে বয়স কোনো ফ্যাক্টর নয়। মাহাথির সেটা দেখিয়ে দিলেন।
মাহাথির যেমন সম্মান কুড়িয়েছেন, ঠিক তেমনি তার বিরুদ্ধে অভিযোগও আছে। তিনি একধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। তার দীর্ঘ ২২ বছরের শাসনামলে বিরোধী দলের কার্যক্রম অত্যন্ত কঠোর হস্তে মোকাবেলা করেছিলেন। যে কারণে দেখা যায়, ওই সময় বিরোধী দলের কার্যক্রম তেমন একটা ছিল না। এখন যদি তিনি তা-ই করেন, তাহলে তিনি তার নামের প্রতি সুবিচার করবেন না। মালয়েশিয়ার রাজনীতির একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিভিন্ন জাতি, উপজাতি, সংস্কৃতিতে বিভক্ত মানুষকে নিয়েই দেশটিতে একটি জোট রাজনীতি শুরু হয়েছিল। বারিসান ন্যাসিওনাল ছিল তারই ফলশ্রুতি। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনে এই জোট রাজনীতিরই অনেকটা পতন ঘটেছে। বারিসান ন্যাসিওনালের সঙ্গে যে ১০টি দল ছিল, তাদের প্রায় সবারই (বড় দল উমনো বাদে) ভরাডুবি ঘটেছে। মাহাথির একটি জোট রাজনীতির নেতৃত্ব দিচ্ছেন বটে, কিন্তু সেখানে চীন ও ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের তেমন কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। মাত্র ১০ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভা তিনি গঠন করেছেন। এতে করে তার জোটবদ্ধরা কতটুকু খুশি হবেন, সেটাও একটা প্রশ্ন।
ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র
Bangladesher Khobor
20.5.2018

ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে ছায়াযুদ্ধ



চলতি মে মাসে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার জন্ম হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে, যা মধ্যপ্রাচ্যের সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ যখন আট বছরে পা দিল, ঠিক তখনই দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ আমরা পেয়েছি। প্রথমত, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বহুল আলোচিত ইরান পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। দ্বিতীয়ত, ট্রাম্পের এই ঘোষণার পরপরই ইসরাইল সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানি ঘাঁটিগুলোর ওপর ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে। এই বিমান হামলা কার্যত সিরিয়ার সঙ্গে ইসরাইলের এক ধরনের যুদ্ধের শামিল। বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে আমরা যদি বিষয়টি বিশ্লেষণ করি, তাহলে এ ঘটনার মধ্য দিয়ে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এক ধরনের ছায়াযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে! সিরিয়া সংকটে ইরান প্রথম থেকেই আসাদ সরকারকে সমর্থন করে আসছে, যা প্রত্যক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের বিরোধী ছিল। যুক্তরাষ্ট্র প্রথম থেকেই আসাদ সরকারের বিরোধিতা করে আসছে এবং এটা মোটামুটিভাবে সবাই জানে যে, যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় ‘রেজিম চেঞ্জ’ এর পক্ষপাতি। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র চায় সিরিয়ায় একটি আসাদবিরোধী সরকার। আইএস সিরিয়া থেকে উৎখাতের পরও সিরিয়ায় যেসব ইসলামিক জঙ্গিগোষ্ঠী আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে ‘যুুদ্ধ’ করে আসছে, তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে অর্থ ও অস্ত্র পেয়ে আসছে। উপরন্তু সিরিয়ার কুর্দি অঞ্চলে চার হাজারের মতো মার্কিন সেনা অবস্থান করছে। বলা হচ্ছে, এরা কুর্দি গ্যারিলাদের ‘উপদেষ্টা’ হিসেবে কাজ করছে! এমনই একটি পরিস্থিতিতে ইরান পারমাণবিক চুক্তি ট্রাম্প কর্তৃক বাতিল ঘোষণা এবং ইসরাইলের সিরিয়ার ভেতরে ইরানি অবস্থানের ওপর হামলা এ অঞ্চলে যে ‘ছায়াযুদ্ধের’ জন্ম দিয়েছে, তা শুধু উত্তেজনাই বাড়াবে না, বরং একটি বড় ধরনের যুদ্ধেরও সূচনা করতে পারে। এই ‘ছায়াযুদ্ধ’ এখন অনেকগুলো সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছে। ইসরাইল এখন সরাসরি ইরানের ভেতরে অবস্থিত ইরানি পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করে দিতে পারে, যেমনটি তারা করেছিল ইরাকে সাদ্দামের জীবিতকালে। এমনকি ইরানি বন্দর ‘পোর্ট অব খারগ’ এ বিমান হামলা চালিয়ে ধ্বংস করে দিতে পারে, যেখান থেকে ইরান তার জ্বালানির শতকরা ৯০ ভাগ (গ্যাস ও তেল) বিদেশে রপ্তানি করে। তেল পরিশোধনের জন্য ইরানের যে বড় বড় রিফাইনারি আছে, তা ধ্বংস করে দিতে পারে ইসরাইল। এক্ষেত্রে ইসরাইলি উদ্দেশ্য পরিষ্কার, ইরানি অর্থনীতিকে পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিয়ে ইরানকে দুর্বল করা। ইরানে সরকার পরিবর্তনের সম্ভাবনাও দেখছেন কেউ কেউ। ‘আরব বসন্ত’ সময়কালে ‘সরকার পরিবর্তনের’ একটা স্ট্র্যাটেজি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। ইরানের ক্ষেত্রেও এই সম্ভাবনা দেখছেন কেউ কেউ। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরান চুক্তিটি বাতিলের সঙ্গে সঙ্গে ইসরাইলি বিমান সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের পার্শ্ববর্তী ছোট শহর কিসভেতে বিমান হামলা চালিয়ে সেখানে ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ গ্রুপের একটি কনভয়কে ধ্বংস করে দিয়েছে। সিরিয়ার অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে ইসরাইলি বিমান হামলা এখন নিত্যকার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্পষ্টই ইসরাইল এখন সিরিয়ার যুদ্ধে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে।
ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত ইউরোপে তার বন্ধুদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের একটা দূরত্ব তৈরি করে দিতে পারে। ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের পর যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি ইউরোপীয় মিত্র দেশ যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং জার্মানি এক যৌথ বিবৃতিতে ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। যৌথ বিবৃতিতে তারা বলেছে, ÔTogether we Emphasize our Continuing Commitment to the JCPOA. This Agreement reaming Important for our shared Security’। পরিষ্কার মেসেজ। পশ্চিমা দেশগুলো ইরান চুক্তিতে থাকতে চায়। তারা এই চুক্তিকে তাদের নিরাপত্তার প্রতি এক ধরনের গ্যারান্টি বলে মনে করছে। এর অর্থ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র JCPOA  বা ইরান চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলেও অপর তিন ইউরোপীয় শক্তির (জার্মানি, ব্রিটেন ও ফ্রান্স) এই চুক্তির প্রতি কমিটমেন্ট থাকছে। এর ফলে দূরত্ব তৈরি হবে। এর আগে ইউরোপীয় স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপের সম্পর্কের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে।
ট্রাম্প একই সঙ্গে ইরানের বিরুদ্ধে কড়া অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার কথাও বলেছেন। এতে চীন ও ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের কিছুটা ঘাটতি দেখা দিতে পারে। চীন ও ভারত ইরানি তেলের ওপর নির্ভরশীল। ইরান প্রতিদিন ২০ লাখ ব্যারেল তেল রপ্তানি করে। চীন হচ্ছে তার বড় ক্রেতা। ২০১৭ সালে চীন ইরানের রপ্তানিকৃত জ্বালানি তেলের শতকরা ২৪ ভাগ একাই ক্রয় করেছিল। ভারত কিনেছিল শতকরা ১৮ ভাগ, আর দক্ষিণ কোরিয়া ১৪ ভাগ। এখন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে Us National Defense Authorization Act অনুযায়ী কোনো কোম্পানি যদি ইরানের সঙ্গে ব্যবসা করে, তারা যুক্তরাষ্ট্রে কোনো ব্যবসা করতে পারবে না। এর অর্থ চীনা ও ভারতীয় রাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলো এরপরও যদি ইরানের সঙ্গে ব্যবসা করে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের কালো তালিকাভুক্ত হয়ে যাবে।
ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত, যা নিউইয়র্ক টাইমসের নিকোলাস ক্রিসটফ Nicholas Kristof) ÔvandalismÕহিসেবে আখ্যায়িত করেছেন  (Trump’s move on Iran Deal : Simple Vandalism, May, 2018),, ২০১৮), তা বিশ্বকে আবারও একটি জটিল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে পারে। এতে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি এখন একট নতুন দিকে মোড় নিল। সেখানে নতুন একটি ফ্রন্ট ‘ওপেন’ হলো। বিশ্ব নয়া স্নায়ুযুদ্ধের যে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছে, এখন এতে নতুন মাত্রা যোগ হলো। ইরানি পার্লামেন্টে মার্কিন পতাকায় আগুন দেওয়ার দৃশ্য পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এই দৃশ্য ১৯৭৯ সালের একটি দৃশ্যের কথা মনে করিয়ে দিল, যখন ইরানি ছাত্ররা তেহরানের মার্কিন দূতাবাস দখল করে নিয়েছিল। সিরিয়ার সংকটকে কেন্দ্র করে মস্কো-বেইজিং-তেহরান অক্ষ গড়ে উঠেছিল। এখন এই অক্ষ আরও শক্তিশালী হবে মাত্র। ইরান সমঝোতা চুক্তি বাতিল করে ট্রাম্প বিশ্বে উত্তেজনার মাত্রা বাড়ালেন মাত্র। ওয়াশিংটনের নিউ কনজারভেটিভরা এখন একটা যুদ্ধ চায়। এই যুদ্ধটি হবে ইরানের বিরুদ্ধে! এতে ট্রাম্প তার বিরুদ্ধে একের পর এক যে ‘অভিযোগ’ উঠছে এবং একটি সম্ভাবনা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে যে, তিনি হয়তো আর দ্বিতীয় টার্মের জন্য রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন পাবেন না। এ থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নিতে পারবেন। একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারেন নাÑ এটা আইনের বিধান। তাকে কংগ্রেসের অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বুশ এই অনুমোদন নেননি ইরাকের ক্ষেত্রে ২০০৩ সালে। প্রেসিডেন্ট ওবামা নেননি লিবিয়ায় বোমা বর্ষণের সময় ২০১১ সালে। এখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কি নেবেন ইরানের ক্ষেত্রে? এটা ভবিষ্যতের ব্যাপার। তবে ইসরাইল এখন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এই ‘যুদ্ধ’ শুরু করল। যুক্তরাষ্ট্রের অনেকেই মন্তব্য করেছেন যে, ইসরাইল চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র এই ‘যুদ্ধে’ যোগ দিক। একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা কর্নেল লরেন্স উইলকারসন গত মার্চ মাসে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ধীরে ধীরে ইরানের সঙ্গে একটি সম্ভাব্য যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ইসরাইল এটা চাচ্ছে। আর যুক্তরাষ্ট্র যদি যুদ্ধে জড়িয়ে যায়, তাহলে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র তার ভাবমূর্তি হারাবে (mintpressnews.com, 12 March 2018)| Popular Resistance.org নামে একটি ভিন্নধর্মী নিউজ পোর্টাল আমাদের এই তথ্য দিচ্ছে যে, ইসরাইলি লবি আসলে এই যুদ্ধটি চাচ্ছে। কেভিন জেমে ও মার্গারেট ফ্লাওয়ার ওই নিউজ পোর্টালে লিখিত এক প্রতিবেদনে (১৩ মে ২০১৮) আমাদের জানাচ্ছেন, কীভাবে ইহুদি লবি ট্রাম্পকে উদ্বুদ্ধ করছে যুদ্ধে যেতে। তারা একজন ক্যাসিনো ব্যবসায়ী সেলডন আডেলসন ট্রাম্পের প্রচারণা তহবিলে ৮৩ মিলিয়ন ডলার দান করেছিলেন। ট্রাম্পের শপথ অনুষ্ঠান আয়োজনে যে ফান্ড জোগাড় করা হয়েছিল, তাতে তিনি দিয়েছিলেন ৫ মিলিয়ন ডলার। তিনি ইহুদি লবির প্রতিনিধিত্ব করেন। এরাই চেয়েছিলেন ইসরাইলে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তেল আবিবের পরিবর্তে জেরুজালেমে সরিয়ে নেওয়া হোক। এই কাজটি ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে, যা মধ্যপ্রাচ্যের সংকটকে, বিশেষ করে গাজা এলাকায় পরিস্থিতি জটিল করেছে।
আলজাজিরা তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে (২৩ এপ্রিল ২০১৮), ইরানের আশপাশে কয়েক ডজন মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে। ওমান, আরব আমিরাত, কুয়েত, তুরস্ক, ইসরাইল, এমনকি কাতারে মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে, যেখানে যুদ্ধবিমান মোতায়েন করা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে যে-কোনো যুদ্ধে (সিরিয়া অথবা ইরান) ওইসব যুদ্ধবিমান ব্যবহৃত হতে পারে। ওই প্রতিবেদনে একটি ম্যাপও দেখানো হয়, যাতে স্পষ্ট করা হয়েছে, কোথায় কোথায় মার্কিনি ঘাঁটি রয়েছে। ম্যাপে স্পষ্ট দেখা যায়, ওই ঘাঁটি এবং বিমান মোতায়েন এক রকম চারদিকে ইরানকে ঘিরে রেখেছে। ইরানে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে সেখানে সরকার পরিবর্তন (রেজিম চেঞ্জ)। সাম্প্রতিককালে ইরানে যে ব্যাপক সরকারবিরোধী বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধন আছে বলে কোনো কোনো গণমাধ্যম উল্লেখ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র এতে কয়েক মিলিয়ন ডলার ব্যায় করেছে বলেও গণমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক একটি লিংক ট্যাংক Brookings Institute ২০০৯ সালে তাদের এক প্রতিবেদনে(Wich path to persia? Options for A New American Strategy For Iran) ইরানে সরকার পরিবর্তনের একটি ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল। এখন ট্রাম্প প্রশাসন সেদিকে যাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যে নানা মাত্রার সংকট আমরা এখন প্রত্যক্ষ করছি। সিরিয়া সংকটের সমাধানের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কুর্দিস্তান কার্যত এখন সিরিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে! সেখানে তুরস্কের সেনাবাহিনী কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান পরিচালনা করছে। কুর্দি অঞ্চল আফরিন, যা কিনা সিরিয়ার অংশ, সেখানে মার্কিন সৈন্য ‘উপদেষ্টা’ হিসেব নিয়োজিত রয়েছে। ইসরাইল সিরীয় সংকটে ততদিন নির্লিপ্ত তাকলেও এখন সরাসরি সিরিয়ার অভ্যন্তরে বিমান হামলা চালিয়ে এই যুদ্ধে শরিক হয়ে গেল। এদিকে সৌদি আরব ইসরাইল সমঝোতার একটি লক্ষণ ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র সরবরাহ করছে। ইরান-সৌদি দ্বন্দ্ব বাড়ছে। বলা হচ্ছে, সৌদি আরব ইয়েমেনে ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীদের ওপর যে নিয়মিত বিমান হামলা চালাচ্ছে, তার পেছনে ওয়াশিংটনের সমর্থন রয়েছে। রাশিয়ার ভূমিকাও এখানে লক্ষ রাখার মতো। প্রকাশ্যে আসাদ সরকারকে রাশিয়া সমর্থন করলেও ইসরাইল সিরিয়ায় ইরানি অবস্থানের ওপর বিমান হামলা চালালে, রাশিয়া তাতে নীরব ভূমিকা পালন করে। এরই মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের অবনতি ও জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করে জেরুজালেমে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস স্থানান্তরের ঘটনা ঘটল। মধ্যপ্রাচ্যের এই উত্তপ্ত পরিস্থিতি সেখানে আরেকটি যুদ্ধের জন্ম দেয় কি না, স্টোই দেখার বিষয় এখন। 
ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র
Daily Alokito Bangladesh
20.05.2018

কী বার্তা দিয়ে গেল কেসিসি নির্বাচন


খুলনা সিটি কর্পোরেশনের (কেসিসি) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল গত মঙ্গলবার। এই নির্বাচন নানা কারণে আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রথমত, নির্বাচনটি যদি পূর্ণ সুষ্ঠু হতো, তাহলে সরকার তার জনসমর্থন বেড়েছে এটা প্রমাণ করতে পারত। দ্বিতীয়ত, দলীয় সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, তা প্রমাণ করা সহজ হতো। তৃতীয়ত, সামনে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন। কেসিসি নির্বাচনের ফলাফল গাজীপুরে প্রভাব ফেলত। চতুর্থত, ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন। এ নির্বাচনকে বিতর্কহীন করতে নিঃসন্দেহে কেসিসি ও গাজীপুরের নির্বাচন একটা প্রভাব ফেলবে। পঞ্চমত, সরকার মনে করছে তাদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে মানুষ খুশি। তারাই পুনর্বার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসাবে। ষষ্ঠত, বিদেশি বন্ধুদেরও সরকারের দেখানোর প্রয়োজন ছিল যে বিএনপি কেসিসি নির্বাচনে অংশ নিয়েছে এবং জাতীয় নির্বাচনেও বিএনপি অংশ নেবে। মোটামুটি এসব সমীকরণকে সামনে রেখেই সরকার কেসিসি নির্বাচনের আয়োজন করেছিল। এখন কেসিসি নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর এর ফলাফল নিয়ে আলোচনা করা যেতেই পারে।
একটি নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনটি সুষ্ঠু হয়েছে, এটা বোধকরি বলা যাবে না। ভোট কেন্দ্র দখল, প্রিসাইডিং অফিসারদের কোথাও কোথাও অসহায়ত্ব, সিল মারা সংস্কৃতি, পুনরায় ভোট গ্রহণের আহ্বান- নির্বাচনের এসব দৃশ্য আবার ফিরে এসেছে। তবে এ প্রবণতা যে ব্যাপক, তা বোধহয় বলা যাবে না। ভোটের ফলাফলের ব্যবধান বিশাল। আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। এটা অবশ্য একদিক থেকে ভালো হয়েছে। খুলনায় মানুষ এখন কিছুটা হলেও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দেখতে পাবেন। বিএনপি প্রার্থী যদি বিজয়ী হতেন(?) তাহলে হয়তো তাকে কোর্টের বারান্দাতেই থাকতে হতো কিছুটা সময়। এমনকি বরখাস্ত হওয়ার ঝুঁকিও ছিল! আমাদের অভিজ্ঞতা তো তা-ই বলে। এদিক থেকে অন্তত খুলনাবাসী আশ্বস্ত হতে পারেন এই ভেবে যে, তারা এখন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দেখতে পাবেন। খুলনা বিভাগীয় শহর হলেও সেখানে তেমন উন্নয়ন হয়নি বিগত বছরগুলোয়। খুলনা বরাবরই অবহেলিত ছিল। অথচ এ শহরের অনেক সম্ভাবনা ছিল। মংলা সমুদ্রবন্দর এখান থেকে কাছে হওয়ায় এ অঞ্চলে ব্যাপক শিল্পায়ন হতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। তৈরি পোশাক শিল্পও (আরএমজি) এখানে বিকশিত হতে পারত। তাও হয়নি। এ অঞ্চলের বেকার ও আধা বেকার জনশক্তিকে কাজে লাগানো যেতে পারত শিল্পায়নের মাধ্যমে। তাও হয়নি। এখন সরকারদলীয় প্রার্থী এখানে বিজয়ী হওয়ায় খুলনাবাসী নিশ্চয়ই এটা প্রত্যাশা করবেন যে, এ অঞ্চলের মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘব হবে। নির্বাচিত মেয়র আবদুল খালেক নিশ্চয়ই উপলব্ধি করবেন, মানুষ তার কাছ থেকে এখন অনেক কিছু প্রত্যাশা করে। তিনি দলীয় বৃত্তের বাইরে থেকে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বার্থে কাজ করবেন, এটাই মানুষের প্রত্যাশা।
নির্বাচন কেমন হয়েছে এটা আলোচনা করা অর্থহীন। কেননা ভোটের ব্যবধানটা অনেক বেশি। তবে প্রত্যাশিত নির্বাচন যে হয়নি, তা বলাই যায়। এর তো কোনো প্রয়োজন ছিল না। দুই বছরের একটি শিশুর ভোট দেয়া, ৪০টি কেন্দ্রে বিএনপি প্রার্থীর পোলিং এজেন্টকে ঢুকতে না দেয়া, ভোট কেন্দ্র দখল করে নৌকা মার্কায় সিল মারা, জাল ভোট, অনিয়মে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়ক ভূমিকা ইত্যাদি যে চিত্র আমরা কেসিসি নির্বাচনে দেখলাম, এটা নির্বাচন কমিশনকে ‘সন্তুষ্ট’ করলেও এই নির্বাচন একটা প্রশ্ন রেখে গেছে। আর সেটি হচ্ছে, নির্বাচনী সংস্কৃতির কি তাহলে ‘মৃত্যু’ হতে যাচ্ছে এ দেশে? ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’- নির্বাচনের এই যে সনাতন চিত্র, তা কি হারিয়ে গেল? কেন একটা দু’বছর বয়সের শিশুকে ভোট দিতে দেয়া হল? ভোট কেন্দ্রে যারা ছিলেন, তাদের দায়িত্বটা তাহলে পালিত হল কোথায়? এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের ব্যাখ্যা দেয়া উচিত ছিল।
৪০টি কেন্দ্রে বিএনপি প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের ঢুকতে না দেয়ার যে অভিযোগ, এর পেছনে সত্যতা কতটুকু? ইসি এরও একটা ব্যাখ্যা দিতে পারত? নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য যারা ছিলেন, তাদের ভূমিকাই বা কী? তারা কি সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছিলেন? কোনো কোনো ভোট কেন্দ্র দখল করে প্রকাশ্যে সিল মারার দৃশ্য তো টিভি ফুটেজে আমরা দেখেছি। এটা অস্বীকার করি কীভাবে? এর আদৌ প্রয়োজন ছিল না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা যথার্থ ছিল, এটাও বলতে পারছি না। বিএনপি তো নির্বাচনের আগেই দাবি তুলেছিল এদের প্রত্যাহারের। এটা যদি করা হতো, তাহলে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা আরও নিশ্চিত হতো। খুলনায় আবদুল খালেক নিঃসন্দেহে জনপ্রিয়। আমার ধারণা সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও তিনি জিততেন। তারপরও কেন এসব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটল? এ নির্বাচনও পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
কেসিসির নির্বাচন দিয়ে আমি জাতীয় নির্বাচনকে বিবেচনা করব না। তারপরও কথা থেকে যায়। এ নির্বাচন কতগুলো বিষয়কে সামনে নিয়ে আসবে এখন, যে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সরকারকেই। এক. দলীয় সরকারের অধীনে যখন ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তখন অতি উৎসাহী কর্মীরা এ ধরনের কর্মকাণ্ড করতে পারেন। সেক্ষেত্রে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এখন সংবিধান যেভাবে আছে অর্থাৎ বর্তমান প্রধানন্ত্রীকে রেখে, যিনি দলীয় প্রধান, নির্বাচনটি হবে। একইসঙ্গে বর্তমানে যিনি সংসদ সদস্য, তাকে স্বপদে বহাল রেখেই তার এলাকায় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এতে করে সংসদ সদস্য নিজে এবং তার সমর্থকরা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার করবেন। এটা আমরা অস্বীকার করতে পারব না। বর্তমান সংসদ সদস্যকে রেখে নির্বাচন করলে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ‘নিরপেক্ষ’ থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। যদিও বলা হচ্ছে, ওই সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সরাসরি নির্বাচন কমিশনের আওতায় থাকবেন। বাস্তব চিত্র হচ্ছে, তারা ওই সময় থাকবেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন। আর প্রশাসন থাকবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে। এদের পক্ষে কি তখন নিরপেক্ষ থাকা সম্ভব? সবারই চাকরি হারানো, শাস্তি, বদলির ভয় থাকে।
একটি শক্ত নির্বাচন কমিশন আমরা এখনও গড়ে তুলতে পারিনি। আর বর্তমান সিইসিকে নিয়ে তো ‘বিতর্ক’ আছেই। তিনি যত ভালো ভালো কথাই বলুন না কেন, তার পক্ষে ‘নিরপেক্ষ’ থাকা সত্যিকার অর্থেই কষ্টকর। খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারত। এর খুব প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তারা তা পারল না। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যখন বলেন, ‘সেনাবাহিনী থাকলে খুলনায় এই দশা হতো না’, তখন তার এ কথাকে অস্বীকার করি কীভাবে? নির্বাচনে সেনা মোতায়েন নিয়ে একটা বিতর্ক আছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেনাবাহিনী মোতায়েন ছাড়া সুষ্ঠু ভোট প্রয়োগের সংস্কৃতি আমরা ফিরিয়ে আনব কীভাবে? সরকারি দলকে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। ‘নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে’- এই মানসিকতা নিয়ে আমরা যদি আত্মতুষ্টিতে ভুগি, আমরা ভুল করব। গাজীপুরেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে বলে আমি আশঙ্কা করছি। তাই সরকারের দায়িত্বটা এখানে বেশি।
আমার কাছে কেসিসি নির্বাচনের চেয়ে জাতীয় নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক বেশি। সব দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণের যে কথা বলা হচ্ছে, তার ওপর গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। বিএনপি এ নিশ্চয়তাটুকু চায়। দাতা দেশগুলোর প্রতিনিধিরাও এটা চায়। প্রায়ই তাদের প্রতিনিধিদের মুখ থেকে এ ধরনের কথা উচ্চারিত হয়। গত ১৫ মে জাতিসংঘের ঢাকায় নিযুক্ত আবাসিক সমন্বয়কারী মিয়া সেপ্পু এক টুইট বার্তায় জানিয়েছেন, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের এক শুনানিতে শেখ হাসিনার মানবিকতার যেমন প্রশংসা করা হয়েছে, তেমনি ওই শুনানিতে অংশ নেয়া জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের তাগিদ দিয়েছেন। গত ১৪ মে জেনেভায় এ শুনানি অনুষ্ঠিত হয় (মানবজমিন, ১৬ মে ২০১৮)। এ ধরনের বক্তব্য এই প্রথম নয়, আগেও আমরা দেখেছি। বিএনপি বারবার বিদেশি দূতাবাসে যাচ্ছে। অভিযোগ করছে। তাদের অভিযোগের তালিকায় কেসিসি নির্বাচন যে যুক্ত হবে, তা বলাই বাহুল্য।
কেসিসি নির্বাচনের আয়োজন করে সরকার তার জনপ্রিয়তা বেড়েছে বলে প্রমাণ করতে চাইলে তা কতটুকু সফল হবে, এটা একটা মৌলিক প্রশ্ন। বাস্তবতা হচ্ছে, জাতীয় রাজনীতিতে বিএনপি এখনও একটি ফ্যাক্টর। দলটিকে কোনোমতেই বাদ দেয়া যাবে না। নির্বাচনে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে জাতীয় পার্টির প্রার্থীও ছিলেন। কিন্তু মূল প্রতিন্দ্বন্দ্বিতা থেকে তিনি ছিটকে পড়েছেন। এটাই বাস্তব চিত্র। জাতীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিই ফ্যাক্টর। সুষ্ঠু রাজনীতির জন্য তাই এ দুটি বড় দলের মাঝে ‘আস্থা ও বিশ্বাসের’ সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন। কেসিসি নির্বাচনে আবারও প্রমাণিত হল এই ‘আস্থা ও বিশ্বাসের’ বড় ঘাটতি রয়েছে। এ ঘাটতি নিয়ে জাতীয় নির্বাচন কতটুকু সফল হবে, আমি বলতে পারব না। তবে বলতে পারি, সরকার যদি আবারও ২০১৪ সালের নির্বাচনের মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়, তাতে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে না। সরকার আরও একবার এ ধরনের ঝুঁকি গ্রহণ করবে বলে মনে হয় না। কেসিসি নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির যে দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে, তা সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেনি। তাই আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলাটা জরুরি। জাতীয় নির্বাচনের এখনও বাকি আছে সাত মাস। সময়টা একেবারে কম নয়। এখনও একটা ‘আস্থা ও বিশ্বাসের’ সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া যায়। মনে রাখতে হবে, সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন মুখ্য বিষয় নয়। মুখ্য বিষয় জাতীয় নির্বাচন। আর জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে সরকারের লাভটা সেখানেই। এখন কেসিসি নির্বাচন বিএনপি প্রত্যাখ্যান করেছে। জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রেও কী দলটি এই পথে হাঁটছে?
ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র
Daily Jugantor
19.05.2018

বাংলাদেশের নির্বাচন, ভারতীয় ভাবনা



রাজনীতি সচেতন পাঠকরা বিবিসি বাংলা প্রচারিত (১৮ এপ্রিল) একটি সংবাদ নিশ্চয়ই স্মরণ করতে পারেন। বিবিসি বাংলা তাদের প্রচারিত সংবাদে নয়াদিল্লির একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো মনোজ যোশীর উদ্ধৃতি দিয়েছিল। মনোজ যোশী বলেছেন ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচন আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য ‘চ্যালেঞ্জ’ ছুড়ে দিতে পারে। মনোজ যোশী বিবিসির সঙ্গে আলাপে বিএনপি, সেনাবাহিনী, জঙ্গিবাদের উত্থান ইত্যাদি নানা প্রশ্ন নিয়ে কথা বলেছেন। যোশীর কথা যে ভারত সরকারের কথা তেমনটা নয়। তবে বিবিসি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন অনেক সরকারি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। তারা গুরুত্বপূর্ণ ‘রাইসীনা ডায়লগ’ আয়োজন করে থাকে। বিবিসি এই অনুষ্ঠান প্রচার করল এমন এক সময় যখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টিম বিজেপির আমন্ত্রণে এর পরপরই ভারত সফরে যায়। আওয়ামী লীগ বর্তমানে ক্ষমতায় এবং ডিসেম্বরে যে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তাতে আওয়ামী লীগ আবারো বিজয়ী হবে- এমন কথা এখন আওয়ামী লীগের নেতাদের মুখ থেকেই উচ্চারিত হচ্ছে। অন্যদিকে বিজেপির নেতৃত্বাধীন একটি জোট এখন ভারতে ক্ষমতায়। ২০১৯ সালে সেখানে লোকসভার নির্বাচন। সুতরাং বিজেপির আমন্ত্রণে আওয়ামী লীগের একটি দল যখন ভারতে যায়, তখন তাতে মানুষের আগ্রহ থাকবে- এটাই স্বাভাবিক। এখানে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু একটি বিষয়কে নিয়ে- আর তা হচ্ছে বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন। একাধিক কারণে এই নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক বেশি। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের ভারত সফর এমন একটি ধারণার জন্ম দিতে পারে যে, বিজেপি বোধহয় আওয়ামী লীগকেই সমর্থন করছে! যদিও ওবায়দুল কাদের এটা স্পষ্ট করেছেন যে, মোদির সঙ্গে তার আলোচনায় বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা হয়নি। তবে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। এটা স্বাভাবিক। ওবায়দুল কাদের একজন সিনিয়র মন্ত্রী। তিনি ভালো করে জানেন বাংলাদেশের মানুষের মনের কথা। বর্তমান সরকার বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে গুরুত্ব দিলেও এটা তো ঠিক বেশকিছু ইস্যু রয়ে গেছে, যার সমাধান হয়নি। বাংলাদেশের মানুষ মনে করে এসব সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত ছিল। সামনে নির্বাচন। নির্বাচনে বিরোধী পক্ষ এসব বিষয়কে সামনে নিয়ে আসতে পারে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত একটি ফ্যাক্টর। চলতি বছরের মার্চে ভারতীয় কংগ্রেসের যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাতেও আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল অংশ নিয়েছিল। আওয়ামী লীগ কংগ্রেস ও বিজেপি দুটো দলের সঙ্গেই সম্পর্ক রেখে চলেছে। কিন্তু দু’দেশের মধ্যে বিরাজমান সমস্যার কী হবে? শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় মোদি নিজে বলেছিলেন, মোদি ও শেখ হাসিনার সরকারের সময়েই তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। তার ওই বক্তব্য ওই সময় সংবাদপত্রে ছাপাও হয়েছিল। কিন্তু মোদি সরকারের তেমন উদ্যোগ আমরা দেখিনি। ২০১৯ সালে ভারতে লোকসভার নির্বাচন। পশ্চিমবঙ্গেও বিধান সভার নির্বাচন আগামীতে। এক্ষেত্রে তিস্তার পানি বণ্টন একটি ফ্যাক্টর। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গকে পাশ কাটিয়ে তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে আদৌ কোনো তিস্তা চুক্তি করবেন বলে মনে হয় না। যদিও সংবিধান তাকে অধিকার দিয়েছে- তিনি চুক্তি করতে পারেন। এখন ওবায়দুল কাদের যখন বলেন, ‘ভেরি ভেরি পজিটিভ আউটকাম’, তখন আশ্বস্ত হই কিভাবে? নাকি এটা কথার কথা! নয়াদিল্লিতে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বিজেপির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাম মাধবের ছবিও ছাপা হয়েছে। তবে বিজেপি প্রেসিডেন্ট অমিত শাহর সঙ্গে বৈঠকের কোনো খবর সংবাদপত্র দেয়নি। বিজেপি-আওয়ামী লীগ আলোচনার পর এক শীর্ষ বিজেপি নেতার কথায় ‘আওয়ামী লীগকে এই আমন্ত্রণের মধ্য দিয়ে আমরা এটাই বোঝাতে চাই যে, বাংলাদেশে আমাদের সমর্থন গণতন্ত্রের প্রতি গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের প্রতি।’ অর্থাৎ, বিজেপি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যকে সমর্থন করে! এটাই স্বাভাবিক। ভারত একটি বড় গণতান্ত্রিক দেশ। বিজেপি একটি ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দল হলেও জনগণের ভোটে তারা ক্ষমতায় এসেছে। বাংলাদেশের জনগণ, সিভিল সোসাইটি মনে করে, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে ভারত তথা ভারতের ক্ষমতাসীন দল একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। কোনো একটি ‘বিশেষ দলকে নয়, বরং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতিই ভারতের কমিটমেন্ট থাকা উচিত। তবে এই সফরে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কোনো বৈঠক করেনি। গুরুত্বপূর্ণ হলো ঢাকায় ফিরে এসে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে ভারতের নাক গলানোর কিছু নেই। ভারত নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করে না। এবারো করবে না। কিন্তু তার এই বক্তব্যে রাজনৈতিক মহল কতটুকু আশ্বস্ত হতে পেরেছে আমি নিশ্চিত নই। বিএনপি প্রায় প্রতিদিনই বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে। রিজভী প্রায় প্রতিদিনই প্রেস ব্রিফিং করছেন। এই একটি ক্ষেত্রে দেখলাম বিএনপি কোনো কথা বলল না। সাধারণত আওয়ামী লীগকে কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠ বলে বিবেচনা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে সাবেক ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ও কংগ্রেস নেতা প্রণব মুখার্জির খুব ঘনিষ্ঠ বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু ভারত সফরে আওয়ামী লীগ কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে দেখা করল না। এতে করে আওয়ামী লীগ ভারতে ক্ষমতাসীন পার্টিকে বেশি গুরুত্ব দেয়- এটা প্রমাণিত হতে পারে। রাজনৈতিকভাবে বিজেপি আর আওয়ামী লীগ এক নয়। আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি করলেও বিজেপি ধর্মনির্ভর একটি রাজনৈতিক দল। হিন্দুত্ববাদে তারা বিশ্বাসী। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও বিজেপির মধ্যে মিল হওয়ার কথা নয়। তবু হয়েছে। কারণ ওখানে তাদের স্বার্থের প্রশ্নটি জড়িত।
বাংলাদেশে ভারতের প্রচুর স্বার্থ রয়েছে। মোদি সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বার্থ যত বেশি উন্নতি হয়েছে, অতীতে কোনো সরকারের আমলেই সম্পর্ক এত উঁচু পর্যায়ে উন্নীত হয়নি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে কোন সরকার ক্ষমতায়, এটা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো বিবেচ্য নয়। তারা তাদের স্বার্থ দেখে। এক্ষেত্রে বিজেপি সরকার আর কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে কতটুকু আদায় করে নিতে পেরেছে? সীমান্ত চুক্তিটি এই মোদি সরকারের সময়েই চূড়ান্ত হয়েছে। সীমানা চিহ্নিত হয়েছে। সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়েছে। আমরা ভারত থেকে কিছু বিদ্যুৎ পাচ্ছি- এসবই অর্জন। কিন্তু আমরা অনেক কিছুই পাইনি। তিস্তার চুক্তি তো বহুল আলোচিত। এই চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা কম। বর্তমান মোদি সরকার কেন, অতীতের সব সরকারই আমাদের আশ্বাস দিয়ে গেছে। কিন্তু চুক্তি হয়নি। আমরা মমতা ব্যানার্জির ব্যাপারে আগ্রহান্বিত ছিলাম। মমতা ঢাকায় এসে বলে গিয়েছিলেন ‘তিনি কাঠ-বিড়ালি হয়ে কাজ করবেন!’ অর্থাৎ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে ‘গো-বিটুইন’ হিসেবে কাজ করবেন- এমনটাই বোঝায় তার কথায়। কিন্তু কই? কেন্দ্র তো রাজি তিস্তা চুক্তিতে। রাজি নয় মমতা ব্যানার্জি। গত বছরের জানুয়ারি মাসে তিন ধরনের বাংলাদেশি পাটপণ্যের ওপর ভারত শুল্কারোপ করেছে। জুন মাসে শুল্কারোপ করা হয় হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের ওপর। বাংলাদেশে তৈরি ফিশিং নেটও শুল্কারোপের আওতায় এসেছে। পাটপণ্যের (পাট সুতা, বস্তা ও চট) ওপর শুল্কারোপে সাফটা চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের পণ্যের যে সুবিধা পাওয়ার কথা, তা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হয়েছে। ভারত তার স্বার্থ দেখে। বড় দেশ হিসেবে ভারত প্রভাব খাটাতে চায়। আমাদের ব্যর্থতা এখানেই যে, আমরা দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় আমাদের স্বার্থ আদায় করে নিতে পারছি না। রাজনৈতিক নেতৃত্ব সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারছেন না।
এখন ওবায়দুল কাদেরের ভারত সফরের পর বিএনপির নেতৃবৃন্দের মুখেও শুনছি একই কথা- আমন্ত্রণ পেলে তারাও ভারতে যেতে চান। ভারত সফরে তাদেরও আপত্তি নেই। বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী এমনটাই বলেছিলেন মিডিয়াকে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা বিদেশি দূতদের সঙ্গে ঢাকায় বসবেন। সব মিলিয়ে আগামী নির্বাচনটাই হলো মুখ্য বিষয়। নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা এখনো আছে। বেগম জিয়া জেলে। বিএনপি এখনো একটি নির্বাচনকালীন সরকারের দাবিতে অনড়। একটি সমঝোতার সম্ভাবনাও ক্ষীণ হয়ে আসছে। সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় এখনো অন্ধকার। তাই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন অনেক। বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য তিনটি ক্ষমতার কেন্দ্র আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ভারত। বাংলাদেশের জন্য এই তিনটি ‘ক্ষমতার কেন্দ্র’ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এরা সবাই মূলত চাচ্ছে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিক। একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সবাই দেখতে চায়। ২০১৪ সালের নির্বাচন আয়োজন করা যেমনি ছিল সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, ঠিক তেমনি ওই নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক হয়নি। সেটাও বাস্তব। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে নির্বাচন হলো একটি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জনগণ তাদের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করে। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য হওয়া প্রয়োজন। নির্বাচনের নামে যদি ভোটকেন্দ্র দখল আর সিলমারার সংস্কৃতি অব্যাহত থাকে, সেই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। আমাদের অর্থনীতির স্বার্থে, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর স্বার্থে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন। আর এর জন্য যা প্রয়োজন তা হচ্ছে একটি ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং’, একটি আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা। রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকবেই। কিন্তু তা যেন সহিংসতায় রূপ না নেয়। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থেই দুটি বড় দলের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন, যা বর্তমানে নেই। তাই বিজেপির সঙ্গে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির বৈঠক, আমাদের আশাবাদী করে না। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কেউ ‘হস্তক্ষেপ’ করুক, তাও আমরা চাই না। ভারত বড় দেশ। তাদের ভূমিকা আছে এবং থাকবেও। ভারতের নিজের স্বার্থেও বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রয়োজন।
ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র
Daily BangladesherKhobor
13.05.2018

ইরান চুক্তি বাতিল করে বিশ্বে উত্তেজনা ছড়ালেন ট্রাম্প




শেষ পর্যন্ত যা প্রত্যাশা করা হয়েছিল, তা-ই হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে যে ছয় জাতি পরমাণু চুক্তি হয়েছিল, তা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন। ১২ মে পর্যন্ত তাঁর কাছে সময় ছিল। কিন্তু এর আগেই তিনি চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিলেন। তিনি যে এই কাজটি করবেন, সে ব্যাপারে অনেক আগেই তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই তিনি ঘোষণা করেছিলেন, তিনি এই চুক্তি মানেন না। এখানে বলা ভালো, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো একরকম আতঙ্কে ছিল। তাদের সবার ধারণা ছিল, ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরি করছে! আর ইরান যদি শেষ পর্যন্ত পারমাণবিক বোমা তৈরি করে ফেলে, তাহলে তা এ অঞ্চলে বড় ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করবে। এ লক্ষ্যেই ইরানের সঙ্গে ছয় জাতি পারমাণবিক আলোচনা শুরু করে। এই জাতির মধ্যে ছিল—যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স, জার্মানি ও ব্রিটেন। একমাত্র জার্মানি বাদে বাকি দেশগুলোর সবাই পারমাণবিক শক্তির অধিকারী। পরমাণু চুক্তি আলোচনায় জার্মানিকে নেওয়া হয়েছিল এ কারণে যে জার্মানির সঙ্গে তেহরানের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। কেননা ইরানের পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম সরবরাহকারী দেশ হচ্ছে জার্মানি। জার্মান ফার্ম সিমেন্স এ খাতে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে আসছিল। প্রায় ৫০টির মতো জার্মান ফার্ম ইরানে কাজ করত। এটা বিবেচনা করেই ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি আলোচনায় জার্মানিকে নেওয়া হয়েছিল। দীর্ঘ আলোচনার পর ২০১৫ সালে একটি পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি পরিত্যাগ করেছিল। বিনিময়ে ইরানের ওপর থেকে যে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হয়েছিল, তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রে যে ইরানের সম্পদ ‘ফ্রিজ’ করা হয়েছিল, তা ‘ওপেন’ করে দেওয়া হয়। ইরানের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যও শুরু হয়। ইরানের রাষ্ট্রীয় যাত্রীবাহী বিমানের জন্য খুচরা যন্ত্রাংশ কেনারও সুযোগ পায় ইরান। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ইরান তার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। গত তিন বছর ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা তৈরি হয়নি। মোটামুটি সবাই সন্তুষ্ট ছিল যে ইরান শর্ত মেনে চলছে। কিন্তু গেল সপ্তাহে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন যে ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি অব্যাহত রাখছে। তিনি সংবাদ সম্মেলনে একটি ম্যাপ ও কয়েকটি নির্দিষ্ট স্থান দেখিয়ে দাবি করেন, ইরান এসব জায়গায় তার পারমাণবিক কর্মসূচি অব্যাহত রাখছে। কিন্তু নেতানিয়াহুর এই দাবি কখনোই গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। নেতানিয়াহুর সংবাদ সম্মেলনের পরপরই International Atomic Energy Agency (IAEA) এক বিবৃতিতে এটি নিশ্চিত করেছিল যে ইরান চুক্তির সব ধারা অনুসরণ করে আসছে। ইরানের সঙ্গে ওই পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তিটি Joint Comprehensive Plan of Action (JCPOA) নামে অভিহিত হয়ে আসছে। এটি অনেকেই জানেন যে পদত্যাগকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিলারসনের সঙ্গে উত্তর কোরিয়া ও ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এক ধরনের মতবিরোধ ছিল। টিলারসন কিছুটা নমনীয় ছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প একটি শক্ত অবস্থানে গিয়েছিলেন। ফলে টিলারসনকে চলে যেতে হয়েছিল।
এখন পরমাণু সমঝোতা কর্মসূচি থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ায় এই চুক্তি শেষ পর্যন্ত অকার্যকর হয়ে গেল। যদিও ফ্রান্স ও জার্মানি বলছে, তারা এই কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যেতে চায়। কিন্তু এতে চুক্তিটির কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। কেননা যুক্তরাষ্ট্র বড় শক্তি। যুক্তরাষ্ট্রের অবর্তমানে এই চুক্তির গ্রহণযোগ্যতা একটি প্রশ্নের মুখে থাকবে। ট্রাম্প কর্তৃক এই চুক্তি বাতিলের আগেই ব্রাসেলসে নিযুক্ত ইরানি রাষ্ট্রদূত হামিদ বাইদিনেজাদ বলেছিলেন, ট্রাম্প চুক্তিটি বাতিল করলে ইরান আবার তার আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। তাঁর কথায়, ‘Without US, there is no deal left.’ এটিই হচ্ছে আসল কথা। যুক্তরাষ্ট্র না থাকলে ওই সমঝোতার কোনো মূল্য নেই। চুক্তিটি বাতিল করার সময় ট্রাম্প ইরান পারমাণবিক সমঝোতাকে ‘ক্ষয়ে যাওয়া’ ও ‘পচা’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। তিনি এও বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ওটি একটি বাজে চুক্তি! ট্রাম্পের ওই একগুঁয়েমি মনোভাব পরিবর্তন করতে অতি সম্প্রতি ওয়াশিংটনে এসেছিলেন জার্মান চ্যান্সেলর মার্কেল ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁ। এমনকি ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও ওয়াশিংটন সফর করেছিলেন। তাঁরা সবাই চেষ্টা করেছেন ট্রাম্পকে বোঝাতে যে এই সমঝোতা চুক্তিটির প্রয়োজন কত বেশি। কিন্তু ইসরায়েলি লবির কারণেই ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত ওই চুক্তিটি বাতিল করলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে ইসরায়েল ও সৌদি আরব। ইরান-সৌদি আরব দ্বন্দ্ব ও ইসরায়েলের সঙ্গে প্রিন্স সুলতানের সখ্যের খবর সবাই জানেন। ইরান পারস্য অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে চায়—এ অভিযোগ সৌদি আরবের। ইয়েমেনে সৌদি আরবের অব্যাহত বোমা হামলার পেছনে কাজ করছে এই সৌদি মানসিকতা। ইরান ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের সমর্থন করছে—এ অভিযোগ সৌদি আরবের দীর্ঘদিনের। এ ক্ষেত্রে সৌদি আরব ইরানের বিরুদ্ধে আরোপিত যেকোনো ‘অবরোধে’ খুশি হবে। ইসরায়েলের অবস্থানও অনেকটা তেমনই। ইসরায়েলের অভিযোগ, ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড সিরিয়ায় নিয়োজিত রয়েছে। এ ধরনের একটি ক্যাম্পে ইসরায়েলের বিমানবাহিনী গত সপ্তাহে হামলা চালিয়েছে। সুতরাং ইরানের বিরুদ্ধে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক না কেন, তাতে ইসরায়েল খুশি হবে। কিন্তু ইরান এখন কী করবে? ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেছেন, প্রাথমিকভাবে কিছু সমস্যা হলেও বিশ্বের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাবে তাঁর দেশ। চুক্তিটি বাতিলের আগে তেহরানে এক সম্মেলনে তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় দু-তিন মাস কিছু সমস্যা হলেও তা কাটিয়ে ওঠা যাবে। একই সঙ্গে ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সচিব বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সংঘাত সৃষ্টি করলে ইরান বসে থাকবে না।
মার্কিন মিডিয়ায় এখন নানা খবর। কী করতে পারে ইরান এখন? ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, (৯ মে) ইরানি হ্যাকাররা এখন যুক্তরাষ্ট্রে ‘সাইবার অ্যাটাক’ করতে পারে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম অকার্যকর করে ফেলার উদ্যোগ নিতে পারে সীমিত সময়ের জন্য। এতে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকিং ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। নিউ ইয়র্ক টাইমসে সুসান ই রাইস লিখেছেন, ‘Trumps Most Foolish Decision Yet.’ সুসান রাইস ওবামা প্রশাসনের দ্বিতীয় টার্মে প্রেসিডেন্ট ওবামার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর মতে, ‘Iran will be able to resume its nuclear activities without being blamed for violating the agreement.’ শক্ত যুক্তি। ইরান চুক্তি অনুযায়ী ইরান দায়বদ্ধ ছিল। তখন যদি ইরান আবার পরমাণু কার্যক্রম শুরু করে ইরানকে দোষ দেওয়া যাবে না। একটি ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের আশঙ্কাও দেখছেন কেউ কেউ। বলা হচ্ছে ইসরায়েলি যুদ্ধ বিমানগুলো একসঙ্গে হামলা চালিয়ে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করে দিতে পারে। এসব পারমাণবিক প্রকল্প থেকে ইরান তার প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের ৬০ শতাংশ উৎপাদন করে। ইসরায়েলের একই সময় টার্গেট হতে পারে খারগ পোর্টকে (Port of Kharg) ধ্বংস করে দেওয়া, যার মাধ্যমে ইরান তার জ্বালানির ৯০ শতাংশ (গ্যাস ও তেল) বিদেশে রপ্তানি করে। তেল পরিশোধনের জন্য যেসব বড় রিফাইনারি আছে (যেমন—কেরমানশাহ, লাভাগ, তাবরিজ, আরভান্দ, বাহমান-গেন ইত্যাদি), তা-ও ধ্বংস করে দিতে পারে। উদ্দেশ্য ইরানি অর্থনীতিকে পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিয়ে ইরানকে দুর্বল করা। ইরানে সরকার পরিবর্তনের সম্ভাবনাও দেখছেন কেউ কেউ। ‘আরব বসন্ত’ সময়কালে ‘সরকার পরিবর্তনের’ একটা স্ট্র্যাটেজি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। ইরানের ক্ষেত্রেও এই সম্ভাবনা দেখছেন কেউ কেউ। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরান চুক্তিটি বাতিলের সঙ্গে সঙ্গে ইসরায়েলি বিমান সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের পার্শ্ববর্তী ছোট্ট শহর কিসভেতে বিমান হামলা চালিয়ে ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ গ্রুপের একটি কনভয়কে ধ্বংস করে দিয়েছে। সিরিয়ার অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে ইসরায়েলি বিমান হামলা এখন নিত্যকার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্পষ্টতই ইসরায়েল এখন সিরিয়ার যুদ্ধে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে।
ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত ইউরোপে তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের একটা দূরত্ব তৈরি করে দিতে পারে। ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের পর যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি ইউরোপীয় মিত্র দেশ—যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি এক যৌথ বিবৃতিতে ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। যৌথ বিবৃতিতে তারা বলেছে, Together we emphasize our continuing commitment to the JCPOA. This agreement remains important for our shared security. পরিষ্কার মেসেজ। পশ্চিমা দেশগুলো ইরান চুক্তিতে থাকতে চায়। তারা এই চুক্তিকে তাদের নিরাপত্তার প্রতি এক ধরনের গ্যারান্টি বলে মনে করছে। এর অর্থ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র JCPOA বা ইরান চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলেও অপর তিন ইউরোপীয় শক্তি (জার্মানি, ব্রিটেন ও ফ্রান্স) চুক্তির প্রতি কমিটমেন্ট থাকছে। এর ফলে দূরত্ব তৈরি হবে। এর আগে ইউরোপীয় স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপের সম্পর্কের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে।
ট্রাম্প একই সঙ্গে ইরানের বিরুদ্ধে কড়া অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার কথাও বলেছেন। এতে চীন ও ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের কিছুটা ঘাটতি দেখা দিতে পারে। চীন ও ভারত ইরানি তেলের ওপর নির্ভরশীল। ইরান প্রতিদিন ২০ লাখ ব্যারেল তেল রপ্তানি করে। চীন হচ্ছে তার বড় ক্রেতা। ২০১৭ সালে চীন ইরানের রপ্তানি করা জ্বালানি তেলের ২৪ শতাংশই একাই ক্রয় করেছিল। ভারত কিনেছিল ১৮ শতাংশ আর দক্ষিণ কোরিয়া ১৪ শতাংশ। এখন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে US National Defense Authorization Act অনুযায়ী কোনো কম্পানি যদি ইরানের সঙ্গে ব্যবসা করে, তারা যুক্তরাষ্ট্রে কোনো ব্যবসা করতে পারবে না। এর অর্থ চীনা ও ভারতীয় রাষ্ট্রীয় কম্পানিগুলো এর পরও যদি ইরানের সঙ্গে ব্যবসা করে, তারা যুক্তরাষ্ট্রে কালো তালিকাভুক্ত হয়ে যাবে।
ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত, যা কিনা নিউ ইয়র্ক টাইমসের নিকোলাস ক্রিসটফ (Nicholas Kristof) Vandalism হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। (Trums Move on Iran Deal : Simple Vandalism, May 9, 2018), তা বিশ্বকে আবারও একটি জটিল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে পারে। এতে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি এখন একটি নতুন দিকে মোড় নিল। সেখানে নতুন একটি ফ্রন্ট ‘ওপেন’ হলো। বিশ্ব নয়া স্নায়ুযুদ্ধের যে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছে, এখন এতে নতুন মাত্রা যোগ হলো। ইরানি পার্লামেন্টে মার্কিন পতাকায় আগুন দেওয়ার দৃশ্য পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এই দৃশ্য ১৯৭৯ সালের একটি দৃশ্যের কথা মনে করিয়ে দিল, যখন ইরানি ছাত্ররা তেহরানের মার্কিন দূতাবাস দখল করে নিয়েছিল। সিরিয়ার সংকটকে কেন্দ্র করে মস্কো-পেইচিং-তেহরান অক্ষ গড়ে উঠেছিল। এখন এই অক্ষ আরো শক্তিশালী হবে মাত্র। ইরান সমঝোতা চুক্তি বাতিল করে ট্রাম্প শুধু বিশ্বে উত্তেজনার মাত্রা বাড়ালেন।
ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র
Daily Kalerkontho
14.05.2018