রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বাংলাদেশের নির্বাচন, ভারতীয় ভাবনা



রাজনীতি সচেতন পাঠকরা বিবিসি বাংলা প্রচারিত (১৮ এপ্রিল) একটি সংবাদ নিশ্চয়ই স্মরণ করতে পারেন। বিবিসি বাংলা তাদের প্রচারিত সংবাদে নয়াদিল্লির একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো মনোজ যোশীর উদ্ধৃতি দিয়েছিল। মনোজ যোশী বলেছেন ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচন আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য ‘চ্যালেঞ্জ’ ছুড়ে দিতে পারে। মনোজ যোশী বিবিসির সঙ্গে আলাপে বিএনপি, সেনাবাহিনী, জঙ্গিবাদের উত্থান ইত্যাদি নানা প্রশ্ন নিয়ে কথা বলেছেন। যোশীর কথা যে ভারত সরকারের কথা তেমনটা নয়। তবে বিবিসি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন অনেক সরকারি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। তারা গুরুত্বপূর্ণ ‘রাইসীনা ডায়লগ’ আয়োজন করে থাকে। বিবিসি এই অনুষ্ঠান প্রচার করল এমন এক সময় যখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টিম বিজেপির আমন্ত্রণে এর পরপরই ভারত সফরে যায়। আওয়ামী লীগ বর্তমানে ক্ষমতায় এবং ডিসেম্বরে যে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তাতে আওয়ামী লীগ আবারো বিজয়ী হবে- এমন কথা এখন আওয়ামী লীগের নেতাদের মুখ থেকেই উচ্চারিত হচ্ছে। অন্যদিকে বিজেপির নেতৃত্বাধীন একটি জোট এখন ভারতে ক্ষমতায়। ২০১৯ সালে সেখানে লোকসভার নির্বাচন। সুতরাং বিজেপির আমন্ত্রণে আওয়ামী লীগের একটি দল যখন ভারতে যায়, তখন তাতে মানুষের আগ্রহ থাকবে- এটাই স্বাভাবিক। এখানে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু একটি বিষয়কে নিয়ে- আর তা হচ্ছে বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন। একাধিক কারণে এই নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক বেশি। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের ভারত সফর এমন একটি ধারণার জন্ম দিতে পারে যে, বিজেপি বোধহয় আওয়ামী লীগকেই সমর্থন করছে! যদিও ওবায়দুল কাদের এটা স্পষ্ট করেছেন যে, মোদির সঙ্গে তার আলোচনায় বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা হয়নি। তবে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। এটা স্বাভাবিক। ওবায়দুল কাদের একজন সিনিয়র মন্ত্রী। তিনি ভালো করে জানেন বাংলাদেশের মানুষের মনের কথা। বর্তমান সরকার বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে গুরুত্ব দিলেও এটা তো ঠিক বেশকিছু ইস্যু রয়ে গেছে, যার সমাধান হয়নি। বাংলাদেশের মানুষ মনে করে এসব সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত ছিল। সামনে নির্বাচন। নির্বাচনে বিরোধী পক্ষ এসব বিষয়কে সামনে নিয়ে আসতে পারে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত একটি ফ্যাক্টর। চলতি বছরের মার্চে ভারতীয় কংগ্রেসের যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাতেও আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল অংশ নিয়েছিল। আওয়ামী লীগ কংগ্রেস ও বিজেপি দুটো দলের সঙ্গেই সম্পর্ক রেখে চলেছে। কিন্তু দু’দেশের মধ্যে বিরাজমান সমস্যার কী হবে? শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় মোদি নিজে বলেছিলেন, মোদি ও শেখ হাসিনার সরকারের সময়েই তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। তার ওই বক্তব্য ওই সময় সংবাদপত্রে ছাপাও হয়েছিল। কিন্তু মোদি সরকারের তেমন উদ্যোগ আমরা দেখিনি। ২০১৯ সালে ভারতে লোকসভার নির্বাচন। পশ্চিমবঙ্গেও বিধান সভার নির্বাচন আগামীতে। এক্ষেত্রে তিস্তার পানি বণ্টন একটি ফ্যাক্টর। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গকে পাশ কাটিয়ে তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে আদৌ কোনো তিস্তা চুক্তি করবেন বলে মনে হয় না। যদিও সংবিধান তাকে অধিকার দিয়েছে- তিনি চুক্তি করতে পারেন। এখন ওবায়দুল কাদের যখন বলেন, ‘ভেরি ভেরি পজিটিভ আউটকাম’, তখন আশ্বস্ত হই কিভাবে? নাকি এটা কথার কথা! নয়াদিল্লিতে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বিজেপির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাম মাধবের ছবিও ছাপা হয়েছে। তবে বিজেপি প্রেসিডেন্ট অমিত শাহর সঙ্গে বৈঠকের কোনো খবর সংবাদপত্র দেয়নি। বিজেপি-আওয়ামী লীগ আলোচনার পর এক শীর্ষ বিজেপি নেতার কথায় ‘আওয়ামী লীগকে এই আমন্ত্রণের মধ্য দিয়ে আমরা এটাই বোঝাতে চাই যে, বাংলাদেশে আমাদের সমর্থন গণতন্ত্রের প্রতি গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের প্রতি।’ অর্থাৎ, বিজেপি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যকে সমর্থন করে! এটাই স্বাভাবিক। ভারত একটি বড় গণতান্ত্রিক দেশ। বিজেপি একটি ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দল হলেও জনগণের ভোটে তারা ক্ষমতায় এসেছে। বাংলাদেশের জনগণ, সিভিল সোসাইটি মনে করে, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে ভারত তথা ভারতের ক্ষমতাসীন দল একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। কোনো একটি ‘বিশেষ দলকে নয়, বরং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতিই ভারতের কমিটমেন্ট থাকা উচিত। তবে এই সফরে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কোনো বৈঠক করেনি। গুরুত্বপূর্ণ হলো ঢাকায় ফিরে এসে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে ভারতের নাক গলানোর কিছু নেই। ভারত নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করে না। এবারো করবে না। কিন্তু তার এই বক্তব্যে রাজনৈতিক মহল কতটুকু আশ্বস্ত হতে পেরেছে আমি নিশ্চিত নই। বিএনপি প্রায় প্রতিদিনই বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে। রিজভী প্রায় প্রতিদিনই প্রেস ব্রিফিং করছেন। এই একটি ক্ষেত্রে দেখলাম বিএনপি কোনো কথা বলল না। সাধারণত আওয়ামী লীগকে কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠ বলে বিবেচনা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে সাবেক ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ও কংগ্রেস নেতা প্রণব মুখার্জির খুব ঘনিষ্ঠ বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু ভারত সফরে আওয়ামী লীগ কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে দেখা করল না। এতে করে আওয়ামী লীগ ভারতে ক্ষমতাসীন পার্টিকে বেশি গুরুত্ব দেয়- এটা প্রমাণিত হতে পারে। রাজনৈতিকভাবে বিজেপি আর আওয়ামী লীগ এক নয়। আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি করলেও বিজেপি ধর্মনির্ভর একটি রাজনৈতিক দল। হিন্দুত্ববাদে তারা বিশ্বাসী। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও বিজেপির মধ্যে মিল হওয়ার কথা নয়। তবু হয়েছে। কারণ ওখানে তাদের স্বার্থের প্রশ্নটি জড়িত।
বাংলাদেশে ভারতের প্রচুর স্বার্থ রয়েছে। মোদি সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বার্থ যত বেশি উন্নতি হয়েছে, অতীতে কোনো সরকারের আমলেই সম্পর্ক এত উঁচু পর্যায়ে উন্নীত হয়নি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে কোন সরকার ক্ষমতায়, এটা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো বিবেচ্য নয়। তারা তাদের স্বার্থ দেখে। এক্ষেত্রে বিজেপি সরকার আর কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে কতটুকু আদায় করে নিতে পেরেছে? সীমান্ত চুক্তিটি এই মোদি সরকারের সময়েই চূড়ান্ত হয়েছে। সীমানা চিহ্নিত হয়েছে। সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়েছে। আমরা ভারত থেকে কিছু বিদ্যুৎ পাচ্ছি- এসবই অর্জন। কিন্তু আমরা অনেক কিছুই পাইনি। তিস্তার চুক্তি তো বহুল আলোচিত। এই চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা কম। বর্তমান মোদি সরকার কেন, অতীতের সব সরকারই আমাদের আশ্বাস দিয়ে গেছে। কিন্তু চুক্তি হয়নি। আমরা মমতা ব্যানার্জির ব্যাপারে আগ্রহান্বিত ছিলাম। মমতা ঢাকায় এসে বলে গিয়েছিলেন ‘তিনি কাঠ-বিড়ালি হয়ে কাজ করবেন!’ অর্থাৎ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে ‘গো-বিটুইন’ হিসেবে কাজ করবেন- এমনটাই বোঝায় তার কথায়। কিন্তু কই? কেন্দ্র তো রাজি তিস্তা চুক্তিতে। রাজি নয় মমতা ব্যানার্জি। গত বছরের জানুয়ারি মাসে তিন ধরনের বাংলাদেশি পাটপণ্যের ওপর ভারত শুল্কারোপ করেছে। জুন মাসে শুল্কারোপ করা হয় হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের ওপর। বাংলাদেশে তৈরি ফিশিং নেটও শুল্কারোপের আওতায় এসেছে। পাটপণ্যের (পাট সুতা, বস্তা ও চট) ওপর শুল্কারোপে সাফটা চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের পণ্যের যে সুবিধা পাওয়ার কথা, তা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হয়েছে। ভারত তার স্বার্থ দেখে। বড় দেশ হিসেবে ভারত প্রভাব খাটাতে চায়। আমাদের ব্যর্থতা এখানেই যে, আমরা দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় আমাদের স্বার্থ আদায় করে নিতে পারছি না। রাজনৈতিক নেতৃত্ব সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারছেন না।
এখন ওবায়দুল কাদেরের ভারত সফরের পর বিএনপির নেতৃবৃন্দের মুখেও শুনছি একই কথা- আমন্ত্রণ পেলে তারাও ভারতে যেতে চান। ভারত সফরে তাদেরও আপত্তি নেই। বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী এমনটাই বলেছিলেন মিডিয়াকে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা বিদেশি দূতদের সঙ্গে ঢাকায় বসবেন। সব মিলিয়ে আগামী নির্বাচনটাই হলো মুখ্য বিষয়। নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা এখনো আছে। বেগম জিয়া জেলে। বিএনপি এখনো একটি নির্বাচনকালীন সরকারের দাবিতে অনড়। একটি সমঝোতার সম্ভাবনাও ক্ষীণ হয়ে আসছে। সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় এখনো অন্ধকার। তাই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন অনেক। বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য তিনটি ক্ষমতার কেন্দ্র আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ভারত। বাংলাদেশের জন্য এই তিনটি ‘ক্ষমতার কেন্দ্র’ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এরা সবাই মূলত চাচ্ছে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিক। একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সবাই দেখতে চায়। ২০১৪ সালের নির্বাচন আয়োজন করা যেমনি ছিল সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, ঠিক তেমনি ওই নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক হয়নি। সেটাও বাস্তব। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে নির্বাচন হলো একটি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জনগণ তাদের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করে। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য হওয়া প্রয়োজন। নির্বাচনের নামে যদি ভোটকেন্দ্র দখল আর সিলমারার সংস্কৃতি অব্যাহত থাকে, সেই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। আমাদের অর্থনীতির স্বার্থে, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর স্বার্থে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন। আর এর জন্য যা প্রয়োজন তা হচ্ছে একটি ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং’, একটি আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা। রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকবেই। কিন্তু তা যেন সহিংসতায় রূপ না নেয়। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থেই দুটি বড় দলের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন, যা বর্তমানে নেই। তাই বিজেপির সঙ্গে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির বৈঠক, আমাদের আশাবাদী করে না। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কেউ ‘হস্তক্ষেপ’ করুক, তাও আমরা চাই না। ভারত বড় দেশ। তাদের ভূমিকা আছে এবং থাকবেও। ভারতের নিজের স্বার্থেও বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রয়োজন।
ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র
Daily BangladesherKhobor
13.05.2018

0 comments:

Post a Comment