রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

তৃতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধ কি আসন্ন!



পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে তৃতীয় আরেকটি যুদ্ধ কি আসন্ন? প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কর্তৃক ছয় জাতি ইরান পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বের হয়ে আসার ঘোষণা ও জেরুজালেমে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস স্থাপনের পর এই প্রশ্নটি এখন উঠেছে যে উপসাগরীয় অঞ্চলে তৃতীয় আরেকটি যুদ্ধের সম্ভাবনা এখন প্রবল। এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেট ইরান। বিগত দুটি গালফ বা উপসাগরীয় যুদ্ধও যুক্তরাষ্ট্র শুরু করেছিল। ইরাক কর্তৃক কুয়েত দখল হয়ে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ৩৫টি দেশের একটি কোয়ালিশন বাহিনী ইরাকের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ শুরু করেছিল (১৭ জানুয়ারি ১৯৯১-২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১), ইতিহাসে তা চিহ্নিত হয়ে আছে প্রথম গালফ যুদ্ধ হিসেবে। ওই যুদ্ধে ইরাকের পরাজয় হয়েছিল এবং কুয়েত দখলমুক্ত হয়েছিল। দ্বিতীয় গালফ যুদ্ধও শুরু করেছিল যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের বিরুদ্ধে ২০০৩ সালের ২০ মার্চ। অভিযোগ ছিল, ইরাকের কাছে WMD (Weapons of Mass Destruction) বা মারাত্মক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যা এই এলাকার নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে সেনা অভিযান পরিচালনা করেছিল। ওই অভিযানে ইরাকের শাসক সাদ্দাম হোসেন উৎখাত হয়েছিলেন। যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র দেশটি দখল করে নেয় এবং ২০১১ সালের ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশটি তাদের দখলে থাকে। ২০০৩ সালের পর ২০১৮ সালে এসে আরেকটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে আরো একটি সেনা অভিযান পরিচালনা করতে পারে।
তৃতীয় গালফ যুদ্ধে আরব রাষ্ট্রগুলো পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত থাকবে। ইসরায়েলের ওই যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এই যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করবে একদিকে ইরান এবং দেশটির পক্ষে সিরিয়া, লেবাননের হিজবুল্লাহ ও ইরাক এবং ইয়েমেনের শিয়া গোষ্ঠী, অন্যদিকে ইসরায়েল, সৌদি আরব, আরব আমিরাত ও পর্দার অন্তরালে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রই এই যুদ্ধকে উসকে দিচ্ছে এবং এরই মধ্যে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে এক ধরনের ‘ছায়াযুদ্ধ’ আমরা প্রত্যক্ষ করছি। তৃতীয় গালফ যুদ্ধ যদি বেঁধে যায়, তাহলে বিশ্ব রাজনীতিতে এটি বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডরা ‘স্ট্রেইট অব হরমুজ’ প্রণালি বন্ধ করে দিতে পারে, যেখান থেকে বিশ্বে সরবরাহকৃত জ্বালানি তেলের ৬৩ শতাংশ সরবরাহ করা হয়। প্রতিদিন ১৭ মিলিয়ন ব্যারেল তেল এ পথে সরবরাহ করা হয়। ওই পথ যদি বন্ধ হয়ে যায় বিশ্ব বড় ধরনের জ্বালানি সংকটে পড়বে। এ অঞ্চলে ইরানের যে কয়টি সমুদ্রবন্দর রয়েছে, ইসরায়েলি আক্রমণে তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের উদ্দেশ্য পরিষ্কার—ইরানের অর্থনীতিকে ধ্বংস করা।
কোনো কোনো ভিন্নধর্মী সংবাদমাধ্যম আমাদের জানাচ্ছে ভিন্ন কথা। তারা আমাদের এই তথ্য দিচ্ছে যে আসলে ইসরায়েলি লবি এই যুদ্ধটি চাচ্ছে। কেবিন জেসে ও মার্গারেট ফ্লাওয়ার ওই নিউজ পোর্টালে লিখিত এক প্রতিবেদনে (১৩ মে ২০১৮) আমাদের জানাচ্ছেন কিভাবে ইহুদি লবি ট্রাম্পকে উদ্বুদ্ধ করছে যুদ্ধে যেতে। তাদের একজন ক্যাসিনো ব্যবসায়ী শেলডন আডেলসন ট্রাম্পের প্রচারণা তহবিলে ৮৩ মিলিয়ন ডলার দান করেছিলেন। ট্রাম্পের শপথ অনুষ্ঠান আয়োজনে যে ফান্ড জোগাড় করা হয়েছিল, তাতে তিনি দিয়েছিলেন পাঁচ মিলিয়ন ডলার। তিনি ইহুদি লবির প্রতিনিধিত্ব করেন। তাঁরাই চেয়েছিলেন ইসরায়েলে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তেল আবিবের পরিবর্তে জেরুজালেমে সরিয়ে নেওয়া হোক। এই কাজটি এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে, যা মধ্যপ্রাচ্যের সংকটকে, বিশেষ করে গাজা এলাকার পরিস্থিতি জটিল করেছে।
আল জাজিরা তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে (২৩ এপ্রিল, ২০১৮) ইরানের আশপাশে কয়েক ডজন মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে। ওমান, আরব আমিরাত, কুয়েত, তুরস্ক, ইসরায়েল, এমনকি কাতারে মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে, যেখানে যুদ্ধবিমান মোতায়েন করা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে যেকোনো যুদ্ধে (সিরিয়া অথবা ইরান) এসব যুদ্ধবিমান ব্যবহৃত হতে পারে। ওই প্রতিবেদনে একটি ম্যাপও দেখানো হয়, যাতে স্পষ্ট করা হয়েছে কোথায় কোথায় মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে। ম্যাপে স্পষ্ট দেখা যায় ওই ঘাঁটি এবং বিমান মোতায়েন একরকম চারদিকে ইরানকে ঘিরে রেখেছে। ইরানে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে, সেখানে সরকার পরিবর্তন (রেজিম চেঞ্জ)। সাম্প্রতিককালে ইরানে যে ব্যাপক সরকারবিরোধী বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধন আছে বলে কোনো কোনো গণমাধ্যম উল্লেখ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র এতে কয়েক মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে বলেও গণমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক একটি থিংক ট্যাংক Brookings Institute ২০০৯ সালে তাদের এক প্রতিবেদনে (Which path to persia? Options for a new American strategy for Iran) ইরানে সরকার পরিবর্তনের একটি ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল। এখন ট্রাম্প প্রশাসন সেদিকে যাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যে নানা মাত্রার সংকট আমরা এখন প্রত্যক্ষ করছি। সিরিয়া সংকটের সমাধানের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কুর্দিস্তান কার্যত এখন সিরিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সেখানে তুরস্কের সেনাবাহিনী কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান পরিচালনা করছে। কুর্দি অঞ্চল আফরিন, যা কি না সিরিয়ার অংশ, সেখানে মার্কিন সৈন্য ‘উপদেষ্টা’ হিসেবে নিয়োজিত রয়েছে। ইসরায়েল সিরীয় সংকটে এত দিন নির্লিপ্ত থাকলেও এখন সরাসরি সিরিয়ার অভ্যন্তরে বিমান হামলা চালিয়ে এই যুদ্ধে শরিক হয়ে গেল। এদিকে সৌদি আরব-ইসরায়েল সমঝোতার একটি লক্ষণ ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র সরবরাহ করছে। ইরান-সৌদি দ্বন্দ্বও বাড়ছে। বলা হচ্ছে সৌদি আরব ইয়েমেনে ইরান সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীদের ওপর যে নিয়মিত বিমান হামলা চালাচ্ছে, তার পেছনে ওয়াশিংটনের সমর্থন রয়েছে। রাশিয়ার ভূমিকাও এখানে লক্ষ রাখার মতো। প্রকাশ্যে আসাদ সরকারকে রাশিয়া সমর্থন করলেও ইসরায়েল সিরিয়ায় ইরানি অবস্থানের ওপর বিমান হামলা চালালে রাশিয়া তাতে নীরব ভূমিকা পালন করে। এরই মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের অবনতি ও জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করে জেরুজালেমে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস স্থানান্তরের ঘটনা ঘটল।
মধ্যপ্রাচ্যের এই উত্তপ্ত রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা, যা কি না শুধু এ অঞ্চলের রাজনীতি নয়, বরং বিশ্বে উত্তেজনা বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট। জেরুজালেমে রাজধানী স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত কার্যকর করার মধ্য দিয়ে ট্রাম্প মূলত তাঁর প্রতিশ্রুতি পালন করলেন। গত ডিসেম্বরে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি অতিসত্বর যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে নেবেন। এই কাজটি তিনি এখন করলেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির একটি পরিবর্তনের দিকনির্দেশ  করলেন। এই কাজটি তিনি করলেন এমন একটা সময় যখন তিনি ইরান পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিলেন। দ্বিতীয়ত, ইসরায়েল স্পষ্টতই সিরিয়া যুদ্ধের একটা অংশ হয়ে গেছে এবং ইসরায়েল-ইরান এক ধরনের ‘ছায়াযুদ্ধ’ শুরু হয়ে গেছে। তৃতীয়ত, সিরিয়া সংকটের কোনো সমাধানও হচ্ছে না। এরই মধ্যে লেবানন ও ইরাকে নির্বাচন হয়েছে। এবং তাতে বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। লেবাননে ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ গ্রুপ নির্বাচনে ভালো করেছে এবং হিজবুল্লাহ সমর্থিত একটি সরকার সেখানে প্রতিষ্ঠিত হবে। হারিরি যদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে যান, তিনি হিজবুল্লাহর বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। ইরাকে মুকতাদা আল সদরের সমর্থকরা ভালো করেছে। ওয়াশিংটন সমর্থিত প্রধানমন্ত্রী হায়দার আল আবাদি সরকারের পতন ঘটেছে। মুকতাদা আল সদর ইরান সমর্থিত এবং প্রচণ্ড আমেরিকান বিরোধী। একই সঙ্গে হিজবুল্লাহরাও যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী। ফলে পারস্য অঞ্চলের রাজনীতিতে ইরানের প্রভাব বাড়ল। এটা একদিকে যেমন সৌদি আরবের জন্য চিন্তার কারণ, ঠিক তেমনি চিন্তার কারণ ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও। তাই অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছে যে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে প্রলুব্ধ করে একটি তৃতীয় গালফ যুদ্ধ শুরু করতে পারে।
তবে সত্যিকার অর্থে যদি গালফ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, তাহলে এই যুদ্ধ শুধু পারস্য অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, আরব বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। সম্ভাব্য এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা, তেল শোধনাগার যেমনি ধ্বংস করে দেবে, ঠিক তেমনি ইরানও সৌদি আরবের তেল পরিশোধন কেন্দ্রগুলো ধ্বংস করে দেবে। ফলে বিশ্ব ভয়াবহ জ্বালানি সংকটের মুখোমুখি হবে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেছে। বিশ্ববাজারে এই জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলারে উঠতে পারে। একজন গবেষক মাইকেল ক্লায়র ২০০৫ সালে একটি বই লেখেন ‘Blood and Oil’। বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘রক্ত ও তেল’। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন এই তেলের জন্য প্রথম দুটি গালফ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এটাকে তিনি বলেছেন Geopolitics of oil। অর্থাৎ তেলের ভূ-রাজনীতি। মোদ্দাকথা যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব পরিপূর্ণভাবে পারস্য অঞ্চলের তেলের ওপর নির্ভরশীল। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, ২০০৩ সালে দ্বিতীয় গালফ যুদ্ধে ইরাকের অবকাঠামো পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এরপর ইরাক অতিরিক্ত তেল উৎপাদন করে তার অবকাঠামো (রাস্তা, বিদ্যুৎ, পানি নিষ্কাশন ও পানি সরবরাহ) পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিল। ওই সব অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করেছিল শুধু মার্কিন কম্পানি। যার মধ্যে একটি কম্পানি ছিল ডিক চেনির, যিনি ছিলেন বুশের ভাইস প্রেসিডেন্ট।
সিরিয়া সংকটের পেছনেও এই তেলের ভূ-রাজনীতি কাজ করছে। সিরিয়ার কুর্দি নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে (আফরিন) মার্কিন উপদেষ্টারা মোতায়েন রয়েছে, যারা কুর্দি বিদ্রোহী বাহিনীকে সহায়তা করছে। এ অঞ্চলে রয়েছে জ্বালানি তেলের বিশাল ভাণ্ডার, যা কুর্দিদের দখলে এবং মার্কিন কম্পানিগুলো এখান থেকে একতরফাভাবে তেল উত্তোলন করছে। অতিসম্প্রতি ইসরায়েল অধিকৃত গোলান উপত্যকায় বিপুল তেল আবিষ্কৃত হয়েছে। এই গোলান উপত্যকা ছিল সিরিয়ার। ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে গোলান উপত্যকা ইসরায়েল দখল করে নেয়। সেই দখলি স্বত্ব এখনো বহাল আছে। সুতরাং তেল মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির অন্যতম নির্ধারক। এই তেলের জন্যই এখানে বারে বারে যুদ্ধ হচ্ছে। ইরানকে কবজায় নেওয়ার পেছনেও এই তেলের ভূ-রাজনীতি কাজ করছে। এখানে কার্টার ডকট্রিনের কথা উল্লেখ করা যায় (১৯৮০)। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার এই মতবাদের প্রবক্তা। এই মতবাদের মূল কথা হচ্ছে, সৌদি আরব ও গালফ অঞ্চলের তেলের সরবরাহ নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র বল প্রয়োগ করতে পারবে, যাতে কোনো ‘শক্তি’ এই তেল সরবরাহে বাধা দিতে না পারে। পরবর্তী সময়ে রিগ্যানও এই মতবাদ অনুসরণ করেন। ইরাক-ইরান যুদ্ধে (১৯৮০-১৯৮৮) ‘স্ট্রেইট অব হরমুজ’ (strait of Hormuz) প্রণালি দিয়ে যেসব তেলবাহী জাহাজ চলাচল করত, সেগুলো মার্কিন নেভির ছত্রচ্ছায়ায় ও প্রটেকশনে চলাচল করত, যাতে করে ইরান এই তেল ট্যাংকারগুলো ধ্বংস করে দিতে না পারে। তেল রিজার্ভের তালিকায় বিশ্বে ইরানের অবস্থান চতুর্থ (বিশ্বের ১০ শতাংশ)। এই রিজার্ভের পরিমাণ ধরা হয় ১৫০ বিলিয়ন ব্যারেল। ইরানের গ্যাসও রয়েছে। সরকারি তথ্য মতে, বর্তমানে ইরানে ১০২টি তেলের ফিল্ড এবং ৪৩টি গ্যাসফিল্ড রয়েছে। এবং ২০৫টি তেলের রিজার্ভার ও ৯২টি গ্যাসের রিজার্ভার বর্তমান। সুতরাং ইরানের তেলের ওপর মার্কিন তেল কম্পানিগুলোর যে আগ্রহ থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। একজন ইতিহাসবিদ আন্দ্রো বেসেভিচ (Andrew Bacevich) তাই এ অঞ্চলে সম্ভাব্য একটি সৌদি-যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল অক্ষ গড়ে ওঠার কথা বলেছেন (America goes rogue, spectator USA, 9 May 2018)। সেই অক্ষ এখন ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। চূড়ান্ত বিচারে তাই তৃতীয় গালফ যুদ্ধের সম্ভাবনা থাকবে, নাকি ‘ছায়াযুদ্ধ’-এর মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধ প্রলম্বিত হবে, সেটাই দেখার বিষয়।
ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
Daily Kalerkontho
23.05.2018

0 comments:

Post a Comment