রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি উপেক্ষিত দিক

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে দক্ষিণ এশিয়াকে গুরুত্ব দেয়া হলেও দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পায়নি। অথচ ঐতিহাসিকভাবেই এ দেশটির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রয়েছে। বছর দুয়েক আগে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের কোনো সরকারপ্রধান শ্রীলঙ্কা সফর করেননি। কিংবা মন্ত্রী পর্যায়ের কোনো সফরের খবরও আমাদের জানা নেই। অথচ শ্রীলঙ্কাকে এশিয়ার দুটি দেশ চীন ও জাপান যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। দীর্ঘদিন শ্রীলঙ্কা অস্থিতিশীল থাকলেও বেশ ক'বছর ধরে সেখানে স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। ফলে বিশ্ব আসরে শ্রীলঙ্কার গুরুত্ব বেড়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে গেলেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী। তিনি বাংলাদেশ থেকেই ছুটে গিয়েছিলেন কলম্বোয়। এর আগে চীনা প্রেসিডেন্টও দেশটি সফর করে গেছেন। সেখানে এই দুটো দেশেরই বিনিয়োগ বেড়েছে। বিশেষ করে চীনের রয়েছে বিশাল এক বিনিয়োগ। বিশাল এক সম্ভাবনার দেশ শ্রীলঙ্কা। আমরা শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারি। শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের পুরনো বন্ধু। যে ক'টি দেশ প্রথমদিকে (১৯৭২) বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল শ্রীলঙ্কা তার মাঝে অন্যতম। তবে ইতিহাস বলে, ওই অঞ্চলটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক হাজার বছরের পুরনো। ইতিহাস থেকে জানা যায়, শ্রীলঙ্কার আদি রাজা ভিজয়ার (ঠরলধুধ) পূর্ব পুরুষ ছিল এ অঞ্চলের মানুষ। এক সময় বাংলাদেশের বিক্রমপুর, মুন্সীগঞ্জ, ঢাকা, ফরিদপুর ও গোপালগঞ্জ এবং পশ্চিম বাংলার একটি অংশ নিয়ে গড়ে উঠেছিল ভাংগা সাম্রাজ্য (অথবা বাংগা) বা ঠধহমধ করহমফড়স (ইধহমধ)। রাজা ভিজয়ার আদি পুরুষের জন্ম এই ভাংগা সাম্রাজ্যে। এক সময় এ অঞ্চল ও শ্রীলঙ্কা ব্রিটেনের কলোনি ছিল। ১৯৪৮ সালে শ্রীলঙ্কা স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত দেশটির পরিচিতি ছিল সিলোন হিসেবে। শুধু ব্রিটিশরাই ওই দেশটি দখল করেনি। পর্তুগিজরাও এসেছিল সেই ১৫০৫ সালের দিকে। গ্রিকরাও এসেছিল। তারা এর নামকরণ করেছিল ঞড়ঢ়ৎড়নধহব. আরব বণিকরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্য করতে এসে ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটিয়েছিল। তারা শ্রীলঙ্কায়ও এসেছিল। তারা শ্রীলঙ্কার নামকরণ করেছিল ঝবৎবহফরন. পর্তুগিজরা এ অঞ্চলটির নামকরণ করেছিল ঈবরষধড়, যা ইংরেজিতে অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ঈবুষড়হ. অর্থাৎ ব্রিটিশরা পর্তুগিজদের দেয়া নামই রেখে দিয়েছিল। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আমাদের তথা বৃহত্তর ভারতীয় উপমহাদেশের সম্পর্কের আরেকটা কারণ বৌদ্ধ ধর্ম। মহারাজা অশোকের পুত্র ভিসু মাহিন্দ বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের জন্য ওই অঞ্চল অর্থাৎ আজকের শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিলেন। ওই সময়ের এক রাজা দেভানাম (উবাধহধস) বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। সেই থেকে শুরু। শ্রীলঙ্কার জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭০ ভাগ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। মুসলমানরাও সেখানে আছেন। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে যোগসূত্র থাকলেও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সম্পর্ক যে খুব উন্নত, তা বলা যাবে না। প্রায় ৪২ বছর আগে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হলেও মাত্র ২০০৮ সালে দু'দেশের মাঝে সরাসরি বিমান চলাচল শুরু হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যও খুব আশাব্যঞ্জক নয়। ২০০০-২০০১ অর্থবছরে বাংলাদেশ যেখানে রফতানি করেছিল ১৪ কোটি ২৭ লাখ ৬৮ হাজার টাকার পণ্য, সেখানে ২০০৬-২০০৭ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭০ কোটি ৩৭ লাখ ২৪ হাজার টাকায়। এর চেয়ে বাংলাদেশ অনেক বেশি রফতানি করে তাইওয়ান, থাইল্যান্ড কিংবা সিঙ্গাপুরে। আমরা যদি শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আমদানির পরিসংখ্যান দেখি, তাহলে দেখব যেখানে ২০০০-২০০১ সালে আমদানি হয়েছে ৪৩ কোটি ১০ লাখ টাকার পণ্য, সেখানে ২০০৬-২০০৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৩ কোটি ১১ লাখ টাকায়। এর চেয়েও অনেক বেশি পণ্য আমরা আমদানি করি থাইল্যান্ড কিংবা সিঙ্গাপুর থেকে। সুতরাং বাণিজ্য বাড়ানো দরকার। বাংলাদেশ তার পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার চাইতে পারে। বিশেষ করে, বাংলাদেশের চামড়াজাত দ্রব্য, মেলামাইন ও প্লাস্টিক সামগ্রী, নিটওয়্যার, সাবান ও সিরামিক সামগ্রীর চাহিদা রয়েছে শ্রীলঙ্কায়। যদি শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়, তাহলে বাংলাদেশী পণ্যের একটি বড় বাজার হতে পারে শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কার বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশী তৈরি পোশাক, চামড়া ও ওষুধ শিল্পে বিনিয়োগ করতে পারে। আশার কথা, রাজাপাকসের সফরের সময় ওইসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছিল এবং প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছিলেন। শ্রীলঙ্কায় জাতিগত দ্বন্দ্ব ছিল। সংখ্যালঘু তামিলরা ১৯৮৪-৮৫ সালের পর থেকে স্বাধীন একটি তামিল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে আসছিল, যার নেতৃত্বে ছিল তামিল টাইগাররা। তামিল টাইগাররা একটি দুর্ধর্ষ গেরিলা বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল। যদিও তাদের সন্ত্রাসী কর্মকা-ের জন্য তারা বিতর্কিত ছিল। ১৯৮৫ সালের পর থেকে কোনো সরকারই তামিল টাইগারদের সঙ্গে যুদ্ধে বিজয়ী হতে পারেনি। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন মাহেন্দ্র রাজাপাকসে। ২০০৯ সালের মে মাসে তামিলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। এর আগে তিনি তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ পরিচালনা করেন। ওই যুদ্ধে টাইগার নেতা ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণ নিহত হন। টাইগারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ী হওয়াটা প্রয়োজন ছিল। কেননা গৃহযুদ্ধের কারণে সব ধরনের উন্নয়ন সেখানে বন্ধ হয়েছিল। এমনকি একসময় শ্রীলঙ্কা পোশাক শিল্পের নেতৃত্বে ছিল। তারা দক্ষ জনশক্তি তৈরি করেছিল এ খাতে। পোশাক শিল্পের অনেক বিশেষজ্ঞ শ্রীলঙ্কার নাগরিক এখন বাংলাদেশের বিভিন্ন পোশাক তৈরি কারখানায় কাজ করেন। যুদ্ধের পর সেখানে এক ধরনের স্থিতিশীলতা এসেছে। সেখানে বিনিয়োগ বেড়েছে। বাংলাদেশ এ সুযোগটি কাজে লাগাতে পারে। যৌথ উদ্যোগে সেখানে শিল্প প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা সম্ভব। বলতে দ্বিধা নেই, সমসাময়িক শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে রাজাপাকসের জনপ্রিয়তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পেঁৗছেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় কিংবা তামিল যুদ্ধের নায়ক জেনারেল ফনসেকার সঙ্গে তার বিরোধ তাকে কিছুটা বিতর্কিত করলেও টাইগারদের পরাজিত করায় সাধারণ সিংহলির মধ্যে তার জনপ্রিয়তা বেড়েছে। ২০০৫ সালে তিনি প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি দ্বিতীয়বারের মতোও বিজয়ী হয়েছেন। ছয় বছর পর পর সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরই মধ্যে সেখানে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে এবং রাজাপাকসের জন্য তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্টের পথ প্রশস্ত হয়েছে। রাজাপাকসে শ্রীলঙ্কার ফ্রিডম পার্টির নেতা। এ দলটি দীর্ঘদিন শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গাও ছিলেন এ দলটির নেতা। রাজাপাকসে দীর্ঘদিন ধরে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলেও বাংলাদেশে এর আগে আর আসেননি। বাংলাদেশের কোনো সরকারপ্রধানও ওই দেশে যাননি। রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মাঝে কোনো বিরোধ নেই। বরং বেশ কিছু ইস্যুতে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার অবস্থান এক ও অভিন্ন। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, আঞ্চলিক সহযোগিতা ইত্যাদি নানা ইস্যুতে দু'দেশের অবস্থান এক। দুটো দেশই চায় আঞ্চলিক সহযোগিতা আরও শক্তিশালী হোক। দরিদ্রতা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সমস্যা। দরিদ্রতা দূরীকরণের লক্ষ্যে ১৯৯১ সালে কলম্বো সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিশন ১৯৯২ সালে তাদের খসড়া রিপোর্ট উপস্থাপন করেছিল। পরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সপ্তম সার্ক সম্মেলনে ওই ঘোষণা অনুমোদিত হয়েছিল। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছিল, দক্ষিণ এশিয়ার শতকরা ৭৪ জন গ্রামে বাস করে। আর এদের মাঝে শতকরা ৮২ জনই দরিদ্র। এ দরিদ্রতা শ্রীলঙ্কায় যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বাংলাদেশেও। দেশ দুটি এখন দারিদ্র বিমোচনে কাজ করে যেতে পারে। শ্রীলঙ্কা একটি ছোট দেশ, বাংলাদেশের আয়তনের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের যে অর্জন, তা বিশ্বমানের। শুধু ক্রিকেট নিয়েই যে শ্রীলঙ্কা বিশ্ব জয় করেছে তা নয়, শ্রীলঙ্কা একটি শিক্ষিত জনশক্তি গড়ে তুলেছে। শ্রীলঙ্কার গ্রাজুয়েটরা আজ অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে এবং ইউরোপের সর্বত্র বিভিন্ন কর্মে নিয়োজিত। দেশটির শিক্ষার হার প্রায় ৮৮ ভাগ। শিশুমৃত্যুর হার তারা কমিয়ে এনেছে। উচ্চশিক্ষায় তারা একটা মান অনুসরণ করে আসছে। ঢালাওভাবে তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেনি। একটি দক্ষ ও প্রশিক্ষিত সেবিকাগোষ্ঠী (নার্স) রয়েছে শ্রীলঙ্কায়, যাদের যথেষ্ট চাহিদা আছে বিদেশে। আমরা এ সেক্টরে শ্রীলঙ্কার সহযোগিতা নিতে পারি। উচ্চশিক্ষার মডেলও আমরা গ্রহণ করতে পারি। ঢালাওভাবে সার্টিফিকেট বাণিজ্য না করে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বাংলাদেশ যদি তৈরি করতে পারে, তাহলে শ্রীলঙ্কার মতো এ জনশক্তি হবে বাংলাদেশের সম্পদ। এটা সত্যিই দুঃখজনক যে, আমাদের পররাষ্ট্রনীতির প্রণেতারা এ দেশটিকে কখনও বিবেচনায় আনেননি। যে কারণে বাংলাদেশের চার দশকের পররাষ্ট্রনীতিতে উপেক্ষিত থেকেছে শ্রীলঙ্কা। বাংলাদেশ সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা। ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বরে সার্কের যাত্রা শুরু হয়েছিল এই ঢাকা থেকেই। এরপর পর্যায়ক্রমে সার্কভুক্ত দেশগুলোতে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। শ্রীলঙ্কাতেও একাধিকবার সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং তাতে করে শ্রীলঙ্কার নেতাদের সঙ্গে বাংলাদেশের নেতাদের পরিচয় রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সম্পর্কের যে গভীরতা, তা তৈরি হয়নি। এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গেও গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়নি। অথচ আমরা পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির যে কথা বলছি, সেখানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হচ্ছে আমাদের মূল টার্গেট। সেখানে এক বিশাল মুক্তবাজার প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এর ফলে আমাদের পণ্যের বিশাল এক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হতে পারে। ভারত এরই মধ্যে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে একটি 'মুক্তবাজার' চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ভারত আসিয়ানের পূর্ণ সদস্যও হতে চায়। কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি অনেক। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের প্রবেশদ্বারকে আরও সহজ করতে পারে। শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হয়েছে। আমরা এ সমুদ্রবন্দরটি ব্যবহার করতে পারি। এতে করে সিঙ্গাপুরের বিকল্প হতে পারে হাম্বানটোটা। সময় ও অর্থ সাশ্রয়ও হবে এতে। শুধু তাই নয়, হাম্বানটোটার গভীর সমুদ্রবন্দর ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা আমরা কাজে লাগাতে পারি। চীন এ সমুদ্রবন্দরটি নির্মাণ করে দিয়েছে। সোনাদিয়ায় আমরা একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। চীন এ বন্দর নির্মাণে আগ্রহ দেখালেও প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের সময় এ সংক্রান্ত কোনো চুক্তি হয়নি। আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে আসবেন। ধারণা করছি, তখন চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হতে পারে। এ সময়সীমার মধ্যে আমরা হাম্বানটোটার গভীর সমুদ্রবন্দর ব্যবস্থাপনা এবং ভারতের মাদানি গ্রুপের প্রস্তাব স্টাডি করতে পারি। অর্থনীতিতে এখন আঞ্চলিক সহযোগিতা গুরুত্ব পাচ্ছে। আঞ্চলিক সহযোগিতাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠছে বিভিন্ন আঞ্চলিক সহযোগিতা। সদ্য শেষ হওয়া জেসিসির সভায় (নয়াদিলি্ল) চেন্নাই-মংলা-চট্টগ্রাম সমুদ্রপথ চালু ও তা সিঙ্গাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারিত করার একটি সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমরা এ সমুদ্রপথে কলম্বো অথবা হাম্বানটোটাকেও যোগ করতে পারি। মূল কথা হচ্ছে, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক তথা বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করা। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির প্রণেতারা বিষয়টি নিয়ে ভাবতে পারেন। Daily Alokito Bangladesh 29.09.14

কী পেল বাংলাদেশ

নয়াদিল্লিতে সদ্য শেষ হওয়া জেসিসি বা ভারত-বাংলাদেশ যৌথ পরামর্শক কমিটির তৃতীয় সভার পর খুব সংগত কারণেই একটা প্রশ্ন উঠেছে- আর তা হচ্ছে কী পেল বাংলাদেশ? পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এটা প্রথম বিদেশ সফর। তবে নিঃসন্দেহে তা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তিনি দেখা করেছেন অনেকের সঙ্গেই। মোদি থেকে শুরু করে নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল পর্যন্ত। তাই ওই সফরের গুরুত্ব আছে। কিন্তু কতটুকু প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে এ সফরের মধ্য দিয়ে? এ সফরের আগে ও পরে সফর নিয়ে এক ধরনের উচ্ছ্বাস আমি দেখেছি প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়। বাস্তবতা কী বলে? আমি যদি যৌথ ইশতেহার ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন বিশ্লেষণ করি, তাহলে কয়েকটি বিষয় পাব। এক. কয়েকটি সিদ্ধান্ত হয়েছে, যা আমাদের চেয়ে ভারতের স্বার্থ রক্ষা করবে বেশি। দুই. বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে আবারও 'আশ্বাস' দেওয়া হয়েছে। তিন. ভারতের কলকাতার সারদা কেলেঙ্কারি ও একজন ভারতীয় রাজ্যসভার সদস্য কর্তৃক বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দলকে অর্থায়নের বিষয়টি আলোচিত হয়েছে; কিন্তু বিস্তারিত বলা হয়নি। চার. ভারতের প্রধানমন্ত্রী নতুন একটি অর্থনৈতিক জোট গঠনের কথা বলেছেন। পাঁচ. ২৭ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠেয় মোদি-হাসিনা বৈঠক নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে বাংলাদেশি মিডিয়ায়; কিন্তু আমরা ভুলে গেছি নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠেয় বৈঠকটি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোনো শীর্ষ বৈঠক নয়। এটা হবে একটা সৌজন্য সাক্ষাৎ বা 'সাইড লাইন টক'। এ ধরনের সাক্ষাতে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনার সুযোগ থাকে না। ছয়. ভারতে সরকারের পরিবর্তন হলেও বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতীয় নীতিতে পরিবর্তন এসেছে- এটা বলা যাবে না।

কয়েকটি সিদ্ধান্ত হয়েছে। চেন্নাই হয়ে কলকাতা, অতঃপর বাংলাদেশের মংলা ও চট্টগ্রাম সমুদ্র উপকূল পথকে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত বিস্তার ঘটানো। এটা হয়তো ভালো। তাতে বাংলাদেশ-ভারত সামুদ্রিক বাণিজ্য সম্প্রসারিত হবে। এতে বাংলাদেশ কতটুকু লাভবান হবে, তা ভবিষ্যতের ব্যাপার। সিঙ্গাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারিত এই বাণিজ্য রুট (?) বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের কতটুকু আকৃষ্ট করতে পারবে, এটাও একটা প্রশ্ন। বাংলাদেশ ভারতীয় ব্যবসায়ীদের জন্য একাধিক রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব দিয়েছে। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এটা কি গ্রহণ করবেন? মনে হয় না। কারণ তাঁরা চান ব্যবসা করতে। সহজ-সরল কথায় জিনিস বিক্রি করতে। পুঁজি বিনিয়োগ তাঁরা করবেন না। ফলে বাংলাদেশের ওই প্রস্তাব কাগজ-কলমে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। গুয়াহাটি-শিলং-ঢাকা বাস সার্ভিস চালুর বিষয়টি কিংবা মৈত্রী ট্রেনের বগির সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়টি আগেই আলোচিত হয়েছে। এটা নতুন কিছু নয়; কিন্তু মৈত্রী ট্রেনে কেন যাত্রী বাড়ছে না, বিষয়টি তলিয়ে দেখা হয়নি। বাংলাদেশি যাত্রীরা মৈত্রী ট্রেনের যাত্রা পছন্দ করে; কিন্তু 'যাত্রী হয়রানি' বন্ধ না হলে বগির সংখ্যা বাড়িয়েও কোনো লাভ হবে না। গুয়াহাটি-শিলং বাস সার্ভিস শুনতে ভালো শোনায়; কিন্তু এ রুটের অবকাঠামোগত উন্নয়ন কে করবে? কবে হবে এসব কাজ। এসব ব্যাপারে কি কোনো সিদ্ধান্ত হয়েছে? ভাঙা পথে এসি বাস চললে, তাতে যাত্রী পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় রয়েছে অনেক। তিস্তার পানিবণ্টন, টিপাইমুখ বাঁধ, সীমান্ত হত্যা বন্ধ, স্থল সীমানা নির্ধারণ, শুল্ক কমানো ও বাংলাদেশি পণ্যের পরিমাণ বাড়ানো, ভারতের আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প, বন্দিবিনিময় ইত্যাদি। কোনো একটি বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট 'সিদ্ধান্ত' নেই। যৌথ ইশতেহারে বলা হয়েছে, তিস্তার পানি ভাগাভাগির বিষয়ে আগের প্রতিশ্রুতিতে অটল থাকবে ভারত। এটা কূটনীতির ভাষা। এটা আশ্বাস। এই আশ্বাসে আমাদের সন্তুষ্ট হওয়ার কথা নয়। আমরা আমাদের ন্যায্য হিস্যা চাই। আন্তর্জাতিক আইন আমাদের পক্ষে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্যা মমতা ব্যানার্জিকে নিয়ে। মমতার জন্য তিস্তার পানি একটি 'রাজনৈতিক ইস্যু'। ২০১৬ সালে বিধানসভার নির্বাচন। লোকসভার নির্বাচনে তৃণমূলের পক্ষে বেশি ভোট পড়েছে। সুতরাং তিস্তা তাঁর জন্য একটা ইস্যু। এটা তিনি আবারও ব্যবহার করবেন। দিল্লিকে তিনি ছাড় দেবেন না এতটুকুও। তবে সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে তিনি বেকায়দায় আছেন। তৃণমূল-জামায়াত সম্পর্কের বিষয়টি মাহমুদ আলী-অজিত দোভালের আলোচনায় এসেছে। সিবিআই তদন্ত করছে। এখন এই সারদা কেলেঙ্কারিকে কেন্দ্র কিভাবে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করবে, এটা দেখার বিষয়। তবে ২০১৬ সালের আগে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে কোনো সমঝোতার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ভারতীয় অনলাইন সংবাদ সংস্থা ২৪ ঘণ্টা ২১ সেপ্টেম্বর আমাদের জানিয়ে দিয়েছে 'তিস্তার জল ও স্থল সীমান্ত চুক্তি নিয়ে জটিলতার অবসান হয়নি।' সীমানা চিহ্নিত করার একটি উদ্যোগ নিয়েছিল সাবেক মনমোহন সরকার। রাজ্যসভায় একটি বিলও উপস্থাপিত হয়েছিল। এখন বলা হচ্ছে, তা এখন আছে স্থায়ী কমিটিতে। আর তিস্তা নিয়ে বলা হয়েছে, 'সব দলের (অর্থাৎ তৃণমূলের সঙ্গে!) সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছার চেষ্টা চলছে।' অর্থাৎ আশ্বাস। চেষ্টা চলছে! এসবই কূটনীতির ভাষা। বলা ভালো, বাংলাদেশের ভেতরে রয়েছে ১১১টি ভারতীয় ছিটমহল আর ভারতে রয়েছে ৫১টি বাংলাদেশি ছিটমহল। এদের কেউ ভারতের সঙ্গে থাকতে চায়, কেউ চায় বাংলাদেশের সঙ্গে থাকতে। স্থানীয় বিজেপি আবার এর বিরোধী। আসাম বিজেপিও স্থল সীমানা চিহ্নিতকরণের পক্ষে নয়। ফলে সংবিধান সংশোধনের জন্য আনীত বিল রাজ্যসভায় এবং পরে লোকসভায় অনুমোদিত হবে- এটা দেখার জন্য আমাদের আরো বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। স্থল সীমানা চিহ্নিতকরণের সঙ্গে ভারতীয় সংবিধানের সংশোধন প্রশ্নটি জড়িত।
আন্তনদী সংযোগ প্রকল্পের বিষয়ে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর হয়- এমন কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ারও আশ্বাস দিয়েছে ভারত সরকার। এটা বাংলাদেশিদের জন্য সুখকর। আমরা এটা জেনেছি একটি সংবাদমাধ্যমের নয়াদিল্লি থেকে পাঠানো প্রতিবেদন থেকে। কিন্তু যত দূর জানা যায়, মোদি ক্ষমতা গ্রহণ করে আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ও আছে মোদির পক্ষে। বাংলাদেশ আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের যে ক্ষতি হবে সে কথা বারবার বলে আসছে। এখন প্রকাশিত বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। সত্যিকার অর্থেই ভারত যদি এই প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে না যায়, তাহলে তাতে ভারতের পরিবেশবাদীরাই যে খুশি হবেন, তা নয়। বরং বাংলাদেশ বড় ধরনের পানি সংকট থেকে রক্ষা পাবে। একই কথা প্রযোজ্য টিপাইমুখ বাঁধের ক্ষেত্রেও। মোদি সরকার সাবেক মনমোহন সিং সরকারের দেওয়া বক্তব্যই উল্লেখ করেছে মাত্র। তাদের ভাষায়, ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ভারতে ইতিমধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছে এবং ভারত সরকার ৯ হাজার কোটি রুপি খরচও করে ফেলেছে। এ অর্থ তাহলে ব্যয় হলো কোথায়? গঙ্গা চুক্তি নিয়েও আলোচনার প্রয়োজন আছে। কেননা চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ পানি পাচ্ছে না। চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৭ সালে। জনসংখ্যা তখন বাড়বে তিন গুণ। পানির চাহিদাও বাড়বে। সুতরাং চুক্তিতে পর্যালোচনার যে সুযোগ রয়েছে, বাংলাদেশের উচিত এ ব্যাপারে ভারতকে রাজি করানো। অনুপ চেটিয়াকে (উলফা নেতা ও বাংলাদেশে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী) ফেরত দেওয়া ও নূর হোসেনকে (নারায়ণগঞ্জ সাত খুনের আসামি) ফেরত আনার বিষয়টিও আলোচিত হয়েছে। নূর হোসেন কলকাতায় একটি অপরাধ করেছেন। সেই অপরাধে তাঁর বিচার হচ্ছে। এখন বিচার চলাকালে তাঁকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো যাবে কি না, এটা একটা আইনগত প্রশ্ন। তবে অনুপ চেটিয়ার সঙ্গে এ বিষয়কে মেলানো যাবে না। অনুপ চেটিয়া নিজেই ভারতে যেতে চেয়েছেন। সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়নি সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও। সিদ্ধান্ত হয়েছে সীমান্তবর্তী জেলার জেলা প্রশাসকরা অক্টোবরে দিল্লিতে মিলিত হবেন; কিন্তু তাতে সীমান্ত হত্যা বন্ধ হবে কি? যেদিন জেসিসির বৈঠক চলছে, সেদিনও বিএসএফের গুলিতে তিনজন বাংলাদেশি আহত হয়েছেন। মোদির নেপাল, ভুটান, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও বাংলাদেশকে নিয়ে উপ-আঞ্চলিক জোটের যে ধারণা, তাতে মিয়ানমারের অন্তর্ভুক্তিও চাচ্ছেন। এতে নতুন একটা জোট গঠিত হতে পারে; যদিও বিসিআইএম জোট (বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার) কাজ করছে এবং বাংলাদেশ এই জোট কার্যকর করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করছে। এখন মোদির প্রস্তাবিত নয়া জোটের সঙ্গে বিসিআইএমের কী ভূমিকা থাকবে সেটা একটা প্রশ্ন হয়েই থাকবে। দুই দেশের বাণিজ্য ছয় বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার কথা বলা হয়েছে; কিন্তু ভারতে বাংলাদেশের পণ্যের সম্প্রসারণে কোনো উদ্যোগের কথা বলা হয়নি। ট্যারিফ ও প্যারা-ট্যারিফের কারণে বাংলাদেশি পণ্য ভারতে বাজার পাচ্ছে না। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির ব্যাপারে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। আমরা ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাচ্ছি। আরো ৫০০ মেগাওয়াটের প্রতিশ্রুতি মিলেছে। আসলে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করতে হবে আঞ্চলিক ভিত্তিতে। বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান ও ভারত সম্মিলিতভাবে বিনিয়োগ করে হিমালয় অঞ্চলে বিপুল বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে; কিন্তু ভারত এটা করছে দ্বিপক্ষীয়ভাবে।
ফলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জেসিসি বৈঠকে যোগদান এবং ভারত সফর কোনো বড় ধরনের সফলতা বয়ে আনতে পেরেছে- এটা বলা যাবে না। আমরা আশ্বাস পেয়েছি। এ ধরনের আশ্বাস আমরা আগেও পেয়েছিলাম। এ ক্ষেত্রে সরকার পরিবর্তন হলেও বাংলাদেশের ব্যাপারে মোদি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এসেছে- এটা বলা যাবে না। তবে আলাপ-আলোচনায় তথাকথিত বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর প্রসঙ্গটি ভারতীয় পক্ষ উপস্থাপন করেনি। মোদি নির্বাচনের আগে ও পরে একাধিকবার এই প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন।
একুশ শতকে বিশ্বরাজনীতির কেন্দ্রভূমি হবে এশিয়া। দুটি বড় অর্থনৈতিক শক্তি ভারত ও চীনের মধ্যকার সম্পর্ক, সেই সঙ্গে জাপানের ভূমিকা এ অঞ্চলের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। জেসিসির বৈঠকের সময়ই চীনের প্রেসিডেন্ট ভারত সফরে এসেছিলেন। এর আগে বাংলাদেশ ঘুরে গেলেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী। এ অঞ্চল যে গুরুত্ব পাচ্ছে এটা এর বড় প্রমাণ। ভারত বড় শক্তি। আমাদের উন্নয়নের অন্যতম অংশীদার। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর আস্থার সম্পর্ক যদি গড়ে তোলা না যায়, তাহলে দুই দেশের সম্পর্ক আরো উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যাবে না। ভারতের মনোভাবের পরিবর্তন তাই জরুরি। বাংলাদেশ শুধু এককভাবে দিয়ে যাবে; কিন্তু ভারতের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সহযোগিতা আমরা পাব না- এ প্রবণতা সন্দেহ সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট।
Daily Kaler Kontho
24.09.14

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সচিবদের সনদ বাতিল ও কিছু প্রশ্ন

চারজন সচিব, একজন যুগ্ম সচিবের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তটি নিয়েছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল। এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশন তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পায়। দুদক ইতোমধ্যে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছিল। ভুয়া এই মুক্তিযোদ্ধা সচিবদের ছবি ১৫ সেপ্টেম্বরের পত্র-পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছে। প্রথমে দুদক ও পরে মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। তবে জনপ্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা যখন এ ধরনের অপকর্ম করেন, তখন সমাজটা যে কোথায় চলে গেছে, এটা ভাবতেই অবাক লাগে। শীর্ষস্থানীয় এসব সচিবের মাঝে একজন আছেন, যিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব ও বর্তমানে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় দায়িত্বপ্রাপ্ত। একজন সচিব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দিয়ে পদোন্নতি নেবেন, সুযোগ-সুবিধা নেবেন, এটা কাম্য হতে পারে না। তাই সঙ্গত কারণেই অনেক প্রশ্ন এখন উঠেছে। এক. মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিলই কি যথেষ্ট? তারা অপরাধ করেছেন। প্রতিটি অপরাধেরই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। না হলে সমাজে অপরাধপ্রবণতা বাড়বে। এখন এ কাজটি করার কথা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের। সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা বিধি অনুযায়ী কোনো সরকারি কর্মকর্তার বিচার করার কথা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়েরই। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তা কি করবে? দুই. রাজনৈতিক কারণে অনেক বড় বড় অপরাধের বিচার হয় না। একজন প্রতিমন্ত্রী মর্যাদার ব্যক্তি, যিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব ছিলেন, তার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা কত গভীরে, তা বুঝতে আমাদের কারো কষ্ট হয় না। এখন তিনি বা তার সহকর্মী অভিযুক্তরা যে এই রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাকে ‘ব্যবহার’ করবেন না, এর গ্যারান্টি আমাদের কে দেবে? তবে সেই সঙ্গে এ কথাটাও সত্য, বর্তমান সরকার কেন একজন সচিবের অপকর্মের দায়ভার গ্রহণ করবে? এই সরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যিনি ব্যবসা করেন, তিনি বা তাদের রাষ্ট্র দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেবে, এটাই প্রত্যাশিত। তিন. অভিযুক্তরা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট ব্যবহার করে অনেক সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। এর মাঝে আর্থিক সুবিধার বিষয়টিও আছে। রাষ্ট্র কি এখন তাদের বাধ্য করবে ওইসব সুযোগ-সুবিধা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে? চার. অভিযুক্ত ব্যক্তিরা কি স্বপদে থাকবেন? যদি স্বপদে থাকেন, তাহলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব বিস্তার করবেন। তাদের সাময়িক চাকরিচ্যুত করাই কি মঙ্গল নয়? অভিযুক্তরা স্বপদে থাকলে নানা ফাঁক-ফোকর দিয়ে বের হয়ে আসবেন। পৃথিবীর কোথাও এভাবে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ‘মাফ’ পেয়ে যান না, যা বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়। এমনকি ভারতেও প্রতিটি তদন্তকারী সংস্থা অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা মন্ত্রীদের পর্যন্ত ছাড় দেয় না। এখন দেখার পালা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কী ঘটে। আমি দিব্যি বলতে পারি অভিযুক্তদের কারোরই বিচার হবে না। এরা বহালতবিয়তে থাকবেন।এ জাতির দুর্ভাগ্য যে, যারা স্বর্ণের ক্রেস্ট দেয়ার নামে একদিকে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে প্রতারণা করলেন, অপর দিকে আমাদের বিদেশি বন্ধুদের কাছে আমাদের সম্মান নষ্ট করলেন, রাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিল না! এটা তো একটা অপরাধ। মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে অপরাধ। এই অপরাধের জন্য যদি কেউ শাস্তি না পায়, তাহলে ছোটখাটো ঘটনায় অপরাধীদের আমরা শাস্তি দিতে পারি কি? পাঁচ. আবারো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে লাল মুক্তিবার্তা ও ভারতের কাছ থেকে পাওয়া প্রশিক্ষণের তালিকায় ১ লাখ ৪৪ হাজার ছাড়া বাকিদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ স্থগিত থাকবে। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরও যদি মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন করতে হয়, এর চেয়ে আর দুঃখজনক কিছু থাকতে পারে না। তাহলে কি এভাবেই চলতে থাকবে? এক সরকার যাবে আরেক সরকার আসবে আর সবাই নিজেদের মতো করে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরি করবে? এটা কি ঠিক? এসব তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে দুটি প্রধান উদ্দেশ্য কাজ করে। এক. রাজনৈতিক সুবিধা নেয়া। নিজেদের কর্মীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে উপস্থাপন করা। দুই. সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচুর সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেছে। ভাতা, চাকরি থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রচুর আর্থিক সুবিধার নিশ্চয়তা থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে। তাই ‘একখানা’ সার্টিফিকেটের জন্য সবাই ব্যস্ত থাকেন, তদ্বির করেন। অবৈধ পন্থার আশ্রয় নেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন থেকে চারজন শিক্ষকের নাম পত্র-পত্রিকায় এসেছে, যারা (ভুয়া) মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। একজন শিক্ষক কি পারেন এটা করতে? কোনো সার্টিফিকেট জমা না দিয়ে শুধু মুখের কথার ওপর ভিত্তি করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষইবা কিভাবে ওই শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা দেয়? এটা তো নৈতিকতার প্রশ্ন। একজন শিক্ষক নিজে যদি অসৎ হন, তাহলে ছাত্রদের কি শিক্ষা দেবেন তিনি? মিথ্যা তথ্য দিয়ে সুবিধা আদায় তো অপরাধের নামান্তর। সরকারি দলের হলেই মুক্তিযোদ্ধা, সরকারি দলের না হলে মুক্তিযোদ্ধা নন-এই প্রবণতা একটি রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা এখন অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও ছড়িয়ে পড়তে পারে। ইতোমধ্যে আমার নিজের বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগরে দু’জন সাবেক উপাচার্য এ ধরনের একটি দাবি করেছেন বলে শোনা যায়। শিক্ষকদের ক্ষেত্রে এই ধরনের ‘প্রবণতা’ নিন্দনীয় এবং ঘৃণ্য নয় কি? ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় দেশে রয়েছে। আইনগতভাবে শিক্ষকদের অবসরের বয়সসীমা এখন ৬৫। এর পর আরো দু’বছর শিক্ষকতার কি আদৌ প্রয়োজন আছে? যে সমাজে একজন অস্ত্রবাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন এবং রাষ্ট্র তাকে শাস্তি দেয় না, সেই সমাজে একজন শুভবুদ্ধির মানুষ কতদিন শিক্ষক থাকতে পারেন? ৬৫ বছর কি তার জন্য যথেষ্ট নয়?
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট সংক্রান্ত খবর বাধ্য করল আরো একটি বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দিতে। আর তা হচ্ছে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ভুয়া সার্টিফিকেটের ব্যবহার। হাজার হাজার ভুয়া পিএইচডি সার্টিফিকেটে দেশ এখন সয়লাব। একাধিক সাবেক সচিব এখন ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রি ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ আছে। একজন সাবেক সচিবের কথা বলি। তিনি গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ছিলেন। লেখালেখি করেন। অর্থনীতি বিষয়ক লেখালেখি করে নামের আগে ডক্টরেট শব্দটি ব্যবহার করেন। তার ডক্টরেট ভুয়া এবং এর কোনো ব্যবহার করতে পারবেন না। একজন এনজিও কর্মকর্তার কথা বলি। তিনি দিব্যি ‘অধ্যাপক’ ও ‘ডক্টরেট’ পদবি ব্যবহার করছেন। আমি উভয় ব্যক্তিকে ব্যক্তিগতভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়েছি এভাবে ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রি ব্যবহার আইনত অপরাধ। একজন বেসরকারি ব্যাংকের এমডি আছেন। তিনি ভুয়া ডক্টরেট ডিগ্রি ব্যবহার করছেন। আমার কাছে একাধিক ব্যক্তির পরিচিতি কার্ড রয়েছে, যেখানে ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রি ব্যবহার করা হয়েছে। একজন সচিব যদি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দেখিয়ে ‘অপরাধী’ হিসেবে গণ্য হতে পারেন, তাহলে একজন ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রিধারী অপরাধী হবেন না কেন? যারা সংবাদপত্রে ‘শিক্ষা বিট’ করেন, তারা তথাকথিত ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির খবর জানেন। দু’হাজার ডলারে কেনা যায় পিএইচডি ডিগ্রি! তারা রীতিমতো অফিস খুলে এই ব্যবসা করছেন! প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এ রকম পিএইচডি ডিগ্রিধারী একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি রয়েছেন উচ্চ আসনে। এখন দুদকের বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কি সেই ক্ষমতা আছে, তার ডিগ্রি নিয়ে চ্যালেঞ্জ করার? না, নেই। আর নেই বলেই ভুয়ারা এখন আসল সেজেছেন। ভুয়া পদবি ব্যবহার করে পত্রিকায় কলাম লিখছেন। বাংলাদেশ হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যেখানে ভুয়া সার্টিফিকেট দেখিয়ে চাকরি পাওয়া যায়। আর ভুয়া সার্টিফিকেটের জন্য কারো শাস্তি হয়েছে, এ রকম দৃষ্টান্ত আমরা দিতে পারব না। এই দায়িত্বটি আসলে কার? শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে বিদেশি ডিগ্রির সম্মান নির্ধারণ করে। মঞ্জুরি কমিশন একটি উদ্যোগ নিতে পারে। সব পিএইচডি ডিগ্রির (যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন, তাদেরটা সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ করে থাকেন) সমমান করিয়ে নেয়ার আহ্বান জানাতে পারে। এটি যত দ্রুত করা যায়, ততই মঙ্গল। যত দেরি হবে, ততই এক ধরনের ‘ল্যাজিটিম্যাসি’ তৈরি হয়ে যাবে।এক সময় এই ভুয়াদের চাপে আসলরা হারিয়ে যাবেন। এসব ভুয়া ডিগ্রিধারী যে কত শক্তিশালী তা সম্প্রতি প্রকাশিত বেশ ক’টি সংবাদ থেকে বোঝা গেল। ইন্টারমিডিয়েট পাস করা ব্যক্তিরা নেমেছেন দাঁতের ডাক্তারি করতে পদবি সাইনবোর্ড ও প্যাডে যুক্ত করে। আরেকজন রীতিমতো ‘অর্থোপেডিক সার্জন ডিগ্রি’ নিয়েছেন নিজেই! এরা নাকের ডগায় বসে ‘ডাক্তারি’ করে যাচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত র‌্যাবের হাতে ধরা পড়তে হয়েছে, কিন্তু বাকিদের কি হবে? এই ঢাকা শহরে এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ ধরনের ভুয়া ডাক্তারের সংখ্যা অনেক। ক’জনের খবর র‌্যাব জানে? মোড়ে মোড়ে ওষুধের দোকান খোলা হচ্ছে। আর যারা এসব ওষুধের দোকান চালান, তাদের কারোরই কোনো প্রশিক্ষণ নেই। খেটে খাওয়া মানুষ এদের কাছে নিত্যদিন প্রতারিত হচ্ছেন। ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে মানবকণ্ঠের শীর্ষ প্রতিবেদনে প্রকাশ, স্বীকৃতিবিহীন ডিগ্রির যথেচ্ছ ব্যবহার করছেন কতিপয় চিকিৎসক। এসব ডিগ্রিধারীর ফাঁদে পড়ে সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব বিষয় দেখার দায়-দায়িত্ব কার? ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সচিবদের বিষয়টি আমাদের চোখ খুলে দিল। আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি সচিবালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিংবা অন্যত্র আরো এ ধরনের ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’ রয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যারা প্রতারণা করেন, তারা জাতির শত্রু। সমাজের শত্রু। এই ভুয়ারা ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছেন। এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে একটি অন্যায় আরেকটি অন্যায়কে ডেকে আনে। একজন ভুয়ার অপকাণ্ডে আরেকজন ভুয়া উৎসাহিত হবে। সুতরাং সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এখনই। Daily MANOBKONTHO 22.09.14

জেসিসির বৈঠক ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি

গামী 2০ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লিতে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ পরামর্শক কমিশনের (জেসিসি) তৃতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ওই বৈঠকে যোগ দিতে ১৮ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লি গেছেন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় যে কাঠামোগত সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তারই অংশ হিসেবে গঠিত হয়েছিল জেসিসি। ২০১২ সালের মে মাসে নয়াদিল্লিতে জেসিসির প্রথম বৈঠক আর ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় দ্বিতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দুটি কারণে ওই জেসিসি বৈঠকের গুরুত্ব রয়েছে। প্রথমত, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের একাধিক দ্বিপক্ষীয় সমস্যা রয়েছে। ভারত বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও সেসব সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসেনি। জেসিসি বৈঠকে বাংলাদেশ নতুন করে ওই সমস্যাগুলো উত্থাপন করবে এবং ভারতের নয়া সরকারের মনোভাব জানতে চাইবে। বিশেষ করে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। সাম্প্রতিক সময়গুলোয় বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে কিছু কিছু পরিবর্তন লক্ষণীয়। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের পাশাপাশি রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের ‘বিশেষ সম্পর্ক’ স্থাপন বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির জন্য একটি ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হিসেবে বিবেচিত হতে বাধ্য। বিভিন্ন ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে টানাপড়েন চললেও ভারতীয় নয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফর প্রমাণ করে ভারতের নীতিনির্ধারকরা বাংলাদেশকে কত গুরুত্ব দিচ্ছে। এর আগে নয়াদিল্লি বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার ভাষায়, সেটা ছিল ‘নিঃশব্দ রণকৌশল পরিবর্তন।’ আর সরকারি ভাষ্য হচ্ছে, ‘বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও বহুদলীয় ব্যবস্থার সঙ্গে ভারতের চলমান যোগাযোগের অংশ।’ নিঃসন্দেহে ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের এই মূল্যায়ন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলবে। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর মস্কো সফরও যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখে। ‘পুরনো সম্পর্ককে নতুন করে ঝালাই’ করার একটি উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বৈদেশিক নীতিতে উজ্জ্বল একটি অধ্যায়। যদিও ১৯৭৫ সালের পর থেকে এই দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ ছিল না। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন বা বর্তমান রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাননি আমাদের নীতিনির্ধারকরা। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ ও ১৯৭৪ সালে মস্কো গিয়েছিলেন। এরপর কোনো সরকারপ্রধান মস্কো সফরে যাননি। রাশিয়া একটি বিশ্বশক্তি। অথচ দুদেশের মধ্যে সম্পর্ক উষ্ণ ছিল না। এখন প্রধানমন্ত্রীর মস্কো সফরের মধ্য দিয়ে নতুন করে সম্ভাবনার একটি ক্ষেত্র তৈরি হলো। এই সম্পর্ককে এখন আমাদের উন্নয়নের আলোকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। যারা বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতি নিয়ে কাজ করেন, তারা জানেন ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্ক ছিল চমৎকার। মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য ও সহযোগিতা আমাদের বাধ্য করেছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক আসরে সোভিয়েত পক্ষ অবলম্বন করে বাংলাদেশ যে বৈদেশিক নীতি রচনা করেছিল, তা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি ভিন্ন ধারণার জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে অতিসাম্প্রতিককাল পর্যন্ত রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক তেমন উষ্ণ ছিল না। যদিও ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থাও তেমন ভালো ছিল না। বিশ্ব অর্থনীতিতেও রাশিয়া তেমন একটা ভূমিকা রাখতে পারছিল না। ফলে বাংলাদেশ রাশিয়ার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পরই পুরনো সম্পর্ককে ঝালাই করার উদ্যোগ নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন মস্কো গিয়েছিলেন, তখন সঙ্গত কারণেই পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি এদিকে থাকে। শেখ হাসিনার মস্কো সফরের সময় তিনটি চুক্তি ও ছয়টি এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি ছিল দুটি। এক. প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে রাশিয়া থেকে সেনাবাহিনীর জন্য অস্ত্র ক্রয়। দুই. পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পে প্রস্তুতিমূলক অর্থায়নে সহযোগিতা। এখানে বাংলাদেশ ৫০ কোটি ডলার ঋণ পাবে। রূপপুরের পারমাণবিক কেন্দ্রের কারিগরি গবেষণার জন্য এই অর্থ। কেন্দ্র নির্মাণে কত টাকা লাগবে, তা এখনো নির্ধারিত হয়নি। এ ব্যাপারে পরে চুক্তি হবে। আপাতত দুবছরের মধ্যে এই ৫০ কোটি ডলার ব্যয় করা হবে কারিগরি গবেষণার জন্য। এর বাইরে যেসব এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও ৮ হাজার কোটি টাকার অস্ত্র ক্রয় বিতর্ক বাড়াতে পারে। মহাজোট সরকারের শেষ সময়ে এসে (২০১৩) সরকার এত বিপুল অর্থ ব্যয় করার যখন উদ্যোগ নিয়েছিল তখন বিতর্ক থাকবেই। প্রথম বিতর্ক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরিতে বিনিয়োগ অনেক বেশি। তুলনামূলক বিচারে খরচ অনেক বেশি। সেই সঙ্গে রয়েছে নিরাপত্তার প্রশ্নটি। রাশিয়া বিশ্বের অস্ত্র বাজারের অন্যতম বিক্রেতা। তাদের বৈদেশিক আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে এই অস্ত্র বিক্রি। পিস রিচার্স ইনস্টিটিউটের মতে, (সিপরি) রাশিয়া বর্তমানে অস্ত্র বিক্রির শীর্ষে। তাই বাংলাদেশের মতো একটি দেশ, যে দেশটি এখনো বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল, সেই দেশটি যখন ৮ হাজার কোটি টাকা দিয়ে অস্ত্র ক্রয় করে, তখন বিশ্বে বাংলাদেশের এই ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই এবং তা উঠেছে রাশিয়ার ঋণের ধরন (যা দিয়ে অস্ত্র কেনা হবে) দেখে বলা যায় এটি নন-কনসেশনাল। বাংলাদেশে কোনো স্বীকৃত প্রতিরক্ষা নীতিমালা নেই। কাজেই কোন অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এই অস্ত্র কেনা হবে তা পরিষ্কার নয়। আমাদের সেনাবাহিনীর অস্ত্রের অন্যতম উৎস হচ্ছে চীন। এখন সেই স্বাভাবিক বাদ দিয়ে রাশিয়া থেকে অস্ত্র কেনা, সঙ্গত কারণেই আমাদের পররাষ্ট্র কোনো পরিবর্তনের ইঙ্গিত কি না, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারে। তবে এটা যে পশ্চিমা বিশ্বে ভুল সিগন্যাল পৌঁছে দিতে পারে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। চীন বিষয়টি ভালো চোখে দেখবে না। চীনারা এখন ব্যবসা বোঝে। রাজনীতি তাদের কাছে এখন মুখ্য নয়, বরং গৌণ। তবে অবসরপ্রাপ্ত যে কারও অপছন্দও এটি। একজন সিনিয়র জেনারেল (অব.) একটি দৈনিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় অস্ত্র কেনা হয়েছে (আমার দেশ, ২০ জানুয়ারি)। অভিযোগ উঠেছে, রাশিয়ার অস্ত্র ক্রয়ে একটি ‘তৃতীয় পক্ষ’-এর উপস্থিতি রয়েছে। এই চুক্তি যে অস্পষ্টতা, তা হচ্ছে এর সঙ্গে কোনো শর্ত যুক্ত কি না। যদিও প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, শর্ত যুক্ত নেই। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, অস্ত্র কেনায় সুদ দিতে হবে চার শতাংশ। ব্যবহার করতে হবে এই ঋণ ২০১৩-১৭ সালের মধ্যে। আর ২০১৮ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০ কিস্তিতে ১০ বছর ধরে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। সেনাবাহিনী জানিয়েছিল, অস্ত্র ক্রয়ে কোনো অস্বচ্ছতা নেই। বলা হয়েছে, এই অস্ত্র সেনাবাহিনী রক্ষা কার্যক্রমে ব্যবহার করবে। এই পরিসংখ্যান নিয়েও কথা বলা যায়। বিশেষ করে সুদের হার বেশি বলেই মনে হয়। তবে আমার কাছে যা মনে হয়, তা হচ্ছে এটি আমাদের বৈদেশিক ও সামরিক নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের একটি ইঙ্গিত বহন করে। কেননা আমাদের বৈদেশিক নীতি ও নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা চীনের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের বিমানবাহিনী চীনা বিমান ব্যবহার করে। সেনাবাহিনীর অস্ত্রশস্ত্রও চীনের তৈরি। আমাদের সামরিক নেতৃত্ব চীনা যুদ্ধাস্ত্রের ওপর অনেক দিন থেকেই নির্ভরশীল। আমাদের উন্নয়নে চীন অন্যতম অংশীদার। চীন আমাদের নিকট-প্রতিবেশীও। আমাদের উন্নয়নে চীনের উপস্থিতি ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেই সরকারপ্রধান চীনে গিয়েছিলেন। এমনকি প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী বেগম জিয়াও অতিসম্প্রতি চীনে গিয়েছিলেন এবং তারা দুজন লালগালিচা সংবর্ধনা পেয়েছিলেন। চীন সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী কুনমিং-কক্সবাজার সড়ক ও গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের সহযোগিতা চেয়েছিলেন। যদিও কোনো চুক্তি হয়নি। বাংলাদেশের উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে এই মহাসড়ক ও গভীর সমুদ্রবন্দর বাংলাদেশের চেহারা আগামী দশকে বদলে দিতে পারে। বাংলাদেশ হতে পারে এ অঞ্চলের উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। চীন শ্রীলংকার হামবানটোটায় (প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের জন্মস্থান) গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করে দিয়েছে। সেখানে একটি বিমানবন্দরও চীন তৈরি করে দিয়েছে। এখন যতদূর জানা যায়, গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মাণে ভারতের একটি কোম্পানি আগ্রহও দেখিয়েছে। এটা নির্মিত হলে অদূরভবিষ্যতে ভারতের সাত বোন রাজ্যগুলো যেমনি এটি ব্যবহার করতে পারবে, তেমনি পারবে চীন তথা মিয়ানমারও। এখন সঙ্গত কারণেই একদিকে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক, অন্যদিকে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নানা কৌতূহলের জন্ম দেবে। বাংলাদেশ মূলত এই দুই নিকট-প্রতিবেশীর সঙ্গে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক রক্ষা করে চলছে। বাংলাদেশের স্বার্থ যেখানে বেশি, বাংলাদেশ সেখানেই যাবে। ভারতের ব্যাপারে আমাদের স্বার্থ অনেক বেশি। যে কারণে আমাদের পররাষ্ট্র নীতিতে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। ভারতের যেমনি প্রয়োজন রয়েছে আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করার, ঠিক তেমনি আমাদেরও প্রয়োজন রয়েছে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির। তবে সমস্যাগুলো যেভাবে ছিল, সেভাবেই রয়ে গেছে। কোনো সমাধান হয়নি। তিস্তার চুক্তি যেমনি হয়নি, ঠিক তেমনি টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও রয়ে গেছে এক ধরনের বিভ্রান্তি। বাণিজ্য ঘাটতি কমছে না। শুল্ক প্রত্যাহার করার কথা বলা হলেও বাস্তব ক্ষেত্রে এর কোনো প্রতিফলন নেই। সীমান্ত হত্যা বন্ধ হচ্ছে না। এর ওপর আবার যোগ হয়েছে তথাকথিত বাংলাদেশি খেদাও অভিযান। মোদি নির্বাচনের আগে পশ্চিমবঙ্গে অবৈধ বাংলাদেশিদের বসবাসের কথা বলে আসছিলেন। এখন ক্ষমতাসীন হয়ে তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতায় একটি ‘সেল’ গঠন করার নির্দেশ দিয়েছেন, যাদের কাজ হবে ‘বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসীদের’ মনিটর করা। তাই নয়া সরকার দিল্লিতে ক্ষমতাসীন হয়েও পুরনো নীতিই অনুসরণ করছে। বরং আরও কিছুটা কঠোর হয়েছে। এতে করে দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরও জটিলতা তৈরি হবে। এমনি এক পরিস্থিতিতে জেসিসির বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে বড় ধরনের ‘ব্রেক থ্রু’ অর্থাৎ সমস্যার সমাধান হবে, এটা মনে করা ঠিক হবে না। ভারত যদি বাংলাদেশের ব্যাপারে তার মনোভাবের পরিবর্তন না ঘটায়, তাহলে সম্পর্ক উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। হিতে বিপরীতও হতে পারে। বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব আরও শক্তিশালী হবে। ফলে বাংলাদেশকে ‘ভারতনির্ভর’ পররাষ্ট্র নীতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমরা ভারতকে ‘সবকিছু দেব’ বিনিময়ে আমরা আমাদের ন্যায্য হিস্যা পাব না, এটা হতে পারে না। ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় শক্ত অবস্থানে গেলে সমস্যার কিছুটা হলেও সমাধান হতে পারে। নয়তো শুধু ‘ভারতনির্ভর’ পররাষ্ট্রনীতি কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। জেসিসি সভায় শুধু আলোচনা হবে। সমস্যার সমাধানের কোনো দিকনির্দেশনা আমরা পাব না যদি না ভারত তার মনোভাবে পরিবর্তন আনে। Daily Amader Somoy 20.09.14

বল এখন মোদির কোর্টে

আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একটি সম্ভাব্য বৈঠকের কথা ইতিমধ্যে চাউর হয়ে গেছে। এটা কোনো সরকারি বৈঠক নয়। এটা অনানুষ্ঠানিক বৈঠক। দু’দেশের প্রধানমন্ত্রীই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৯তম অধিবেশনে যোগ দেবেন। প্রতিবেশী দু’দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন একটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে যোগ দেন, তখন পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি সেদিকে থাকবেই। প্রশ্ন হচ্ছে, শেখ হাসিনার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির এই প্রথম বৈঠক দু’দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে জটিলতা নিরসনে কোনো ভূমিকা রাখবে কি-না? ভারতে নরেন্দ্র মোদি দায়িত্ব গ্রহণ করে এটা স্পষ্ট করেছেন, তিনি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়াকে গুরুত্ব দেন। দক্ষিণ এশিয়া তার অগ্রাধিকার তালিকায় প্রথম। এ কারণেই দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথম সরকারি সফরে তিনি ভুটান গিয়েছিলেন। তারপর তিনি যান নেপালে। বাংলাদেশে তিনি আসেননি বটে, কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে পাঠিয়েছিলেন। বাংলাদেশ সরকারের মনোভাব এবং সেই সঙ্গে দেশের অপর বড় দল বিএনপির মনোভাব তার জানা প্রয়োজন ছিল। সেটা তিনি জেনেছেন। যতদূর জানা যায়, আগামী জানুয়ারির দিকে তিনি সরকারি সফরে বাংলাদেশে আসতে পারেন। তখন দ্বিপাক্ষিক বিষয়াদি নিয়ে সরকারি পর্যায়ে আলোচনা হওয়ার কথা। এর আগে নভেম্বরে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। সেখানেও হাসিনা-মোদি বৈঠক হবে। তবে সার্ক সম্মেলনে দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে আলোচানার সুযোগ কম। সৌজন্য সাক্ষাৎকারে সাধারণ কথাবার্তাই বেশি হয়। অনানুষ্ঠানিক কথাবার্তা হয়, যার কোনো ভিত্তি থাকে না। সার্ক চার্টারে দ্বিপাক্ষিক সমস্যা উত্থাপনেরও কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং নিউইয়র্কে যে বৈঠকটি হবে, সেখানে সিরিয়াস কোনো আলোচনা হবে না। দুই নেতা পরস্পর পরস্পরকে চিনবেন, জানবেন, একজন অপরজনকে তার দেশ সফরের আমন্ত্রণ জানাবেন। তবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়তো সুযোগটি গ্রহণ করতে পারেন। সীমিত সুযোগে তিনি বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশার কথা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানাতে পারেন।ভারত বড় দেশ। বড় অর্থনীতি। আমাদের উন্নয়নে ভারতের ভূমিকা আমরা অস্বীকার করতে পারি না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ভারত সমমর্যাদার দৃষ্টিতে বাংলাদেশকে দেখছে না। বিগত বছরগুলোয় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশ ভারতকে যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। সে তুলনায় বাংলাদেশের যে প্রত্যাশা তা পূরণে ভারত এগিয়ে আসেনি। বরং ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের ভূমিকায় একটি বাংলাদেশবিরোধী মনোভাব আমরা লক্ষ করেছি। মোদি নির্বাচনের আগে বারবার বলে আসছিলেন, ভারতে বাংলাদেশীরা অবৈধভাবে বসবাস করেন। পশ্চিমবঙ্গকে তিনি টার্গেট করেছেন। ক্ষমতাসীন হয়েই তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতায় আলাদা একটি সেল খুলেছেন, যাদের কাজ হবে তথাকথিত ‘বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের’ ব্যাপারে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা ও মনিটর করা। সম্প্রতি বিজেপির সভাপতি ও মোদির দক্ষিণ হস্ত বলে পরিচিত অমিত শাহ কলকাতায় বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে অবৈধ অধিবাসী ৫ গুণ বেড়েছে। সারদা কেলেংকারির ঘটনায় বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর নাম এসেছে। বলা হয়েছে, জামায়াতের মাধ্যমে জঙ্গি তৎপরতায় অর্থায়ন করেছে সারদা। ভারতের সিবিআই বিষয়টি তদন্ত করছে। যদিও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে তাদের অজ্ঞতার কথা জানিয়েছে। বিষয়টি যেহেতু স্পর্শকাতর, সেহেতু সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত।ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন তখনও বাংলাদেশ প্রত্যাশা করেছে, সমস্যাগুলোর সমাধানের ব্যাপারে তিনি একটি বড় উদ্যোগ নেবেন। কিন্তু তারপরও কংগ্রেস নেতাদের তিনি বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন ভারতীয় মন্ত্রিসভায় তিনি বাংলাদেশের বিষয়টি নিজেই দেখভাল করতেন- এ রকম একটি কথা আমরা বরাবরই শুনতে পেয়েছি। একজন বাঙালি হয়ে বাংলাদেশের সমস্যাগুলোর ব্যাপারে তিনি পূর্ণ অবগত ছিলেন। তবে রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার ভূমিকা সীমিত থাকায় তিনি সমাধানের কোনো পথ বের করতে পারেননি। আসলে ভারতের আমলাতন্ত্র অত্যন্ত শক্তিশালী। আমলারা নীতিনির্ধারণে প্রভাব খাটায়। এ আমলাতন্ত্রের কারণেই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ধীরে ধীরে তিক্ততায় পরিণত হয়েছিল। তাই ব্যক্তিগতভাবে প্রণব বাবুর বাংলাদেশের সমস্যাগুলোর ব্যাপারে ‘সিমপ্যাথি’ থাকলেও সমস্যা সমাধানে কোনো অগ্রগতি হয়নি। ড. মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন বাংলাদেশ সফরে এসে আমাদের আশ্বাসবাণী শুনিয়েছিলেন, সমস্যার সমাধান হবে। বিশেষ করে সীমান্ত হত্যা বন্ধের প্রতিশ্র“তি দিলেও তিনি দিল্লি ফিরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সীমান্তে হত্যারঘটনা ঘটেছে। তার ঢাকা সফরের সময়ই আমরা শুনেছিলাম, মমতা ব্যানার্জির কারণে তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মমতা ব্যানার্জিকে রাজি করানোর দায়িত্বটি কেন্দ্রীয় সরকারের, বাংলাদেশ সরকারের এখানে কোনো ভূমিকা নেই।তিস্তা চুক্তি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই ১৯৭২ সাল থেকেই তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা চলে আসছে। দু’বার ১৯৯৮ ও ২০০৭ সালে একটি চুক্তির কাছাকাছি আমরা চলে গিয়েছিলাম। সমানভাবে পানি বণ্টন করে কিছু পানি নদীতে রেখে দেয়ার একটি সিদ্ধান্তে দু’দেশ একপর্যায়ে রাজিও হয়েছিল। তারপরও চুক্তি হয়নি। এখন মূল সমস্যা পশ্চিমবঙ্গের আপত্তি। এতে বাংলাদেশের কোনো ভূমিকা নেই। আমরা আমাদের ন্যায্য অধিকার চাই। কিন্তু ভারত আমাদের সেই অধিকার নিশ্চিত করছে না। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও ভারত আমাদের বারবার মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছে। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং একাধিকবার বলেছেন, ভারত এমন কিছু করবে না যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? নয়াদিল্লিতে ইতিমধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং কেন্দ্রীয় সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সেখানে জলবিদুৎ কেন্দ্র নির্মাণের। প্রায় ৯ হাজার কোটি রুপিও ব্যয় করা হয়ে গেছে। বাঁধটি যদি নির্মিত হয় তাতে বাংলাদেশের কী ক্ষতি হবে, তা একাধিক সেমিনারে আলোচিত হয়েছে। এখানে আমাদের ব্যর্থতা, আমরা শক্ত অবস্থানে যেতে পারছি না। জেসিসির যৌথ ইশতেহারে এ সংক্রান্ত কোনো কথা বলা হয়নি। গঙ্গা চুক্তি আমরা করেছিলাম ১৯৯৬ সালে। চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৭ সালে। এর আগেই পদ্মায় পানি নেই। চুক্তি অনুযায়ী আমরা পানি পাচ্ছি না। ২০২৭ সালে লোকসংখ্যা বাড়বে তিনগুণ। যে বিপুল পানির চাহিদা থাকবে, তার কী হবে? চুক্তি অনুযায়ী পর্যালোচনার সুযোগ আছে। কিন্তু সেই সুযোগটি আমরা নিচ্ছি কোথায়? অতীতে কখনও আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনার প্রয়োজনীয়তা বোধ করিনি। সীমান্ত হত্যা আজও বন্ধ হয়নি। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের পরও একের পর এক সীমান্ত হত্যা হচ্ছে। এমন দৃষ্টান্ত নেই যেখানে বিজিবির গুলিতে কোনো ভারতীয় নাগরিক মারা গেছেন। প্রতিমাসেই মারা যাচ্ছেন নিরপরাধ বাংলাদেশী নাগরিকরা। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর এখন পর্যন্ত কতজন বাংলাদেশী মারা গেছেন তার পরিসংখ্যান মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাছে আছে। এ নিয়ে একাধিক শীর্ষ বৈঠক হয়েছে। কিন্তু হত্যা বন্ধ হয়নি। সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফরের সময়ও এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। সীমান্ত চিহ্নিত ও অপদখলীয় ভূমির ব্যাপারেও তিনি মুখ খোলেননি ঢাকায়। গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি কোনো। বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ১১১টি ছিটমহল ও ভারতের ভেতর বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের ব্যাপারে আমরা সবাই অবগত। ভারতের ভেতরে যারা রয়েছেন, তারা ভারতেই থাকতে চান। ঠিক তেমনি বাংলাদেশের ভেতরে যারা রয়েছেন, তারা বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবেই থাকতে চান। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল সেই ১৯৭৪ সালে। তারপর কখনোই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার উদ্যোগ নেয়নি সংবিধান সংশোধন করার। সমস্যাটা তো আমাদের নয়। সমস্যাটা ভারতের। আজ প্রায় ৪০ বছর পরও এ কথাগুলো আমাদের বলতে হয়। এটা কি ভারতের সদিচ্ছা প্রমাণ করে? ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল ভারত। প্রণব বাবু ঢাকায় এসে ২০ কোটি ডলার অনুদানের কথা বলে গিয়েছিলেন। কিন্তু ঋণের টাকা দিয়ে তো প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না? ১৩ প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু সমন্বয়হীনতার অভাবে কিছু প্রকল্প আটকে আছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের রয়েছে বিশাল এক বাণিজ্য ঘাটতি। ২০০৯-১০ সালে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার। আর ২০১০-১১ সালে তা এসে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারে। ২০১৩-১৪ সালের পরিসংখ্যান যখন আমাদের হাতে আসবে, ধারণা করছি তা ৪ বিলিয়ন ডলারের অংক ছাড়িয়ে যাবে। ভারত মাঝেমধ্যে কিছু পণ্যের শুল্কমূল্য প্রবেশাধিকারের কথা বলে বটে, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশ এসব পণ্যের অনেকগুলোই রফতানি করে না। ভারতের অশুল্ক বাধা দূর করা নিয়েও ‘নানা কাহিনী’ আছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় নানা ধরনের শুল্ক দূর করা যাচ্ছে না। ফলে ভারতে বাংলাদেশের রফতানি সে তুলনায় বাড়ছে না। শুধু ঘাটতি বাড়ছেই। এটা আমাদের জন্য শংকার কারণ।ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়টির একটা সমাধান হয়েছে সত্য, কিন্তু ২০১৫ সালে আমরা আদৌ বিদ্যুৎ পাব কি-না, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছি না। বাংলাদেশ বড় ধরনের বিদ্যুৎ সংকটের মুখে। বিদ্যুতের অভাবে উৎপাদন বন্ধ অনেক কারখানায়। অথচ ভারত যদি আন্তরিক হয়, তাহলে আমাদের বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান সম্ভব। মহাজোট ও বর্তমান সরকারের গত ৬৮ মাসের ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক যদি আমরা পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখব ভারতের দিকে পাল্লা ভারি, আমাদের প্রাপ্তি কম। আমরা ভারতকে ট্রানজিট দিয়েছি (ট্রান্সশিপমেন্ট অথবা করিডর), কিন্তু ট্রানজিট ‘ফি’ এখনও নির্ধারণ হয়নি। বলা হচ্ছে, ট্রানজিটের বিষয়টি বহুপাক্ষিকতার আলোকে দেখা হবে। কিন্তু দেখা গেল, ভারত একপক্ষীয়ভাবে তা ব্যবহার করছে, ভুটান বা নেপাল এখনও ট্রানজিট পায়নি। ভারতের এ দুটি দেশকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার কথা। কিন্তু ইতিমধ্যে এ সুবিধা এ দুটি দেশকে নিশ্চিত করা হয়েছে এমন তথ্য আমাদের জানা নেই। আগামীতে ভারতের ‘সাতবোন’ রাজ্যগুলো আমাদের চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করবে- এ সংক্রান্ত একটি সমঝোতা হয়েছে। অথচ আমাদের ন্যূনতম প্রাপ্তির ব্যাপারে এতটুকু ভারতীয় উদ্যোগ আমরা লক্ষ করিনি। আজ তাই নরেন্দ্র মোদি যখন ভারতের সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়েছেন, আমরা চাইব তার প্রতি সম্মান দেখিয়েই ভারত সমস্যাগুলোর সমাধানের উদ্যোগ নেবে। মোদি সরকারের জন্য একটি বন্ধুপ্রতিম বাংলাদেশ বড় দরকার।ভারতের একগুঁয়েমির কারণে যদি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের অবনতি ঘটে, তাহলে তা থেকে সুবিধা নেবে জঙ্গিরা, বিশেষ করে আল-কায়দা। জাওয়াহিরি তার একটি ভিডিও বার্তায় দক্ষিণ এশিয়া ও মিয়ানমারে আল-কায়দার শাখা খোলার কথা ঘোষণা করেছেন। এটা ভারত ও বাংলাদেশের জন্য চিন্তার অন্যতম কারণ। উভয় দেশেই জঙ্গিরা আছে। দু’দেশ জঙ্গি দমনে একসঙ্গে কাজ করতে পারে। মোদির জন্য বাংলাদেশের জনগণের আস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। শেখ হাসিনা-মোদির সৌজন্য সাক্ষাৎকারেই সব সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে না। আশা করাও ঠিক হবে না। তবে একটা আস্থার ভিত রচিত হতে পারে। নিঃসন্দেহে ‘বল’ এখন মোদির কোর্টে। উদ্যোগ নিতে হবে মোদি সরকারকেই। মোদি নিজে এবং তার উপদেষ্টারা যদি এটা না বোঝেন, তাহলে তা হবে আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যের একটি বিষয়। মোদি তার পররাষ্ট্রনীতিতে দক্ষিণ এশিয়াকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। সুতরাং বাংলাদেশ তার অগ্রাধিকারের তালিকা থেকে বাদ যাবে না, এটা আমরা প্রত্যাশা করতেই পারি। Daily JUGANTOR 20.09.14

পরিবেশ বিপর্যয় : বাংলাদেশ প্রেক্ষিত

২৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘের ৬৯তম অধিবেশন বসছে। এবারের অধিবেশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন অধিবেশন শুরুর আগে জলবায়ু পরিবর্তনকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে একটি চুক্তিতে উপনীত হওয়ার জন্য বিশ্বের নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এখানে বলা প্রয়োজন, বেশ ক'বছর ধরে জাতিসংঘের উদ্যোগে জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলন (যা 'কপ' নামে পরিচিত) অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কিন্তু শিল্পোন্নত দেশগুলোর ব্যর্থতার কারণে কোনো সমঝোতায় উপনীত হওয়া সম্ভব হয়নি। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন যে ভয়াবহ রূপ নিতে পারে, তা অতি সম্প্রতি প্রকাশিত দুটো রিপোর্ট থেকে বোঝা যায়। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ুমন্ডলে ৩৯৬ পিপিপি (গ্যাসের একক) কার্বন-ডাই-অক্সাইড বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বিগত বছরগুলোর তুলনায় অন্তত ৩ পিপিপি বেশি, অন্যদিকে অতি সম্প্রতি পাক-ভারত-বাংলাদেশ উপমহাদেশে যে বন্যা দেখা দিয়েছে, তাতে এক কাশ্মীরেই পানির নিচে চলে গেছে ৩০০ গ্রাম। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, কিছুদিন আগে ঘূর্ণিঝড় 'মহাসেন' বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে আঘাত করেছিল। বন্যা, ঘূর্ণিঝড় আর টর্নেডো এখন যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোর পাশাপাশি বড় বড় শহরগুলোও আক্রান্ত হচ্ছে। সারা বিশ্বই আজ পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে। বায়ুম-লে গ্রিনহাউস গ্যাস, বিশেষ করে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় উত্তপ্ত হয়ে উঠছে পৃথিবী। ফলে সাগর, মহাসাগরে জন্ম হচ্ছে ঘূর্ণিঝড়ের, যা একসময় প্রবল বেগে আছড়ে পড়ছে উপকূলে। ধ্বংস করে দিচ্ছে জনপদ। ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে উপকূলবর্তী গ্রাম, ছোট ছোট শহর। 'মহাসেন' ছিল সেরকম একটি ঘূর্ণিঝড়। এর আগে আমরা 'সিডর' ও 'আইলার' সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সমুদ্রে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়গুলোর নাম আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে। ইংরেজি বর্ণমালার ক্রম অনুসারে নামকরণের সুযোগ পায় ভারত উপমহাসাগরভুক্ত আটটি দেশ। প্রতিটি দেশকে চারটি করে নাম পাঠাতে হয়। এর মধ্য থেকে একটি নাম বেছে নেয়া হয়। এক সময়ের শ্রীলঙ্কার রাজা মহাসেন ধ্বংস করেছিলেন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বহু মন্দির। সে কারণে ধ্বংসাত্মক ঝড়ের নাম রাখা হয়েছিল ধ্বংসের প্রতীক সেই রাজা 'মহাসেন' এর নামে। এদিকে এ অঞ্চলে পরবর্তী ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ হবে থাইল্যান্ডের দেয়া নামে। আর এর নাম হবে ফাইলিন। 'মহাসেন'-এর পর এখন 'ফাইলিন'-এর জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। ঘূর্ণিঝড়ের পাশাপাশি অতি বন্যা, অসময়ে বন্যা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। যারা নিয়মিত সংবাদপত্র পাঠ করেন, তারা জানেন সীমান্তের ওপর থেকে নেমে আসা বিপুল পানির স্রোত বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত করে দিয়েছে। দেশের প্রায় ১৭টি জেলা এ বন্যায় আক্রান্ত। হাজার হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বন্যায়। অকাল বন্যার অন্যতম কারণ হচ্ছে, এ জলবায়ু পরিবর্তন। বিশ্বে উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে হিমালয়ে। সেখানে বরফ গলছে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে। আমাদের দেশের আবহাওয়াতেও পরিবর্তন আসছে। অসময়ে বৃষ্টি প্রমাণ করে, পরিবেশ কীভাবে বদলে যাচ্ছে। যে সময়ে বৃষ্টি হওয়ার কথা সে সময়ে বৃষ্টি হচ্ছে না। শীতের ব্যাপ্তি কমছে। মনে আছে, গেল শীত আসতে আসতেই চলে গেল। ফলে কৃষিতে সমস্যা হচ্ছে। উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের মানুষ লড়াকু। 'সিডর' ও 'আইলার' পর তারা বুঝে গেছে, এ ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গেই তাদের বসবাস করতে হবে। লোনা পানি তাদের জীবনযাত্রার মান হুমকির মুখে ঠেলে দিলেও এ লোনা পানির সঙ্গে 'যুদ্ধ' করেই তারা বেঁচে আছে। প্রকৃতিই তাদের শিখিয়েছে কীভাবে সব ধরনের প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে বেঁচে থাকতে হয়। আগের চেয়েও উপকূল এলাকার মানুষ আজ অনেক সচেতন সারা বিশ্ব জানে, বিশ্বের উষ্ণতা যে হারে বাড়ছে তাতে আগামী দিনে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশের উপকূলে প্রতি বছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। সমুদ্রের পানি যেভাবে বাড়ছে তাতে প্রতি সাতজনে একজন উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। এরা হচ্ছে জলবায়ু উদ্বাস্তু। আগামীতে বাংলাদেশের ১৭ ভাগ এলাকা সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে। বিশ্ববাসী জলবায়ু উদ্বাস্তুর সঙ্গে প্রথম পরিচিত হয় ২০০৫ সালে, যখন বাংলাদেশে ভোলার চরাঞ্চল থেকে ৫ লাখ মানুষ অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। ক্রিস্টিয়ান পেনেনটি (ঈযৎরংঃরধহ চবহবহঃর) তার সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ 'ঞৎড়ঢ়রপ ড়ভ ঈযড়ড়ংব : ঈষরসধঃব পযধহমব ধহফ ঃযব ঘব িএবড়মৎধঢ়যু ড়ভ ঠরড়ষবহপব (২০১১)'-এ উল্লেখ করেছেন সে কথা। পেনেনটি আরও উল্লেখ করেছেন, ২০৫০ সালের মধ্যেই ২২ মিলিয়ন অর্থাৎ ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চল থেকে অন্যত্র সরে যেতে বাধ্য হবে। আইপিসিসির রিপোর্টেও উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের কথা। অনেকের মনে থাকার কথা, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর পরিবেশের ব্যাপারে বিশ্ব জনমতের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ২০১২ সালের জানুয়ারিতে এন্টার্কটিকায় গিয়েছিলেন। আমাদের পরিবেশমন্ত্রীকেও তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সেখানে। সেটা ঠিক আছে। কেননা বিশ্বের উষ্ণতা বেড়ে গেলে যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশ। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ পর পর দু'বার বন্যা ও পরবর্তীকালে 'সিডর'-এর আঘাতের সম্মুখীন হয়। এরপর ২০০৯ সালের মে মাসে আঘাত করে 'আইলা'। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশে ব্যাপক খাদ্যদ্রব্যের ঘাটতি দেখা দেয়। দেশে খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যায়। অর্থনীতিতে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। 'সিডর'-এর পর বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়টি বারবার বিশ্বসভায় আলোচিত হচ্ছে। সিডরের ক্ষতি গোর্কির চেয়েও বেশি। মানুষ কম মারা গেলেও সিডরের অর্থনৈতিক ক্ষতি ছিল ব্যাপক। সিডরে ৩০টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এর মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ছিল ৯টি জেলা। ২০০ উপজেলার ১ হাজার ৮৭১টি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯ লাখ ২৮ হাজার ২৬৫ পরিবারের ৮৫ লাখ ৪৫ হাজার ৪৫৬ জন সিডরে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল। মারা গিয়েছিল ৩ হাজার ৩০০-এর বেশি। তবে অর্থনৈতিক ক্ষতি ছিল ব্যাপক। সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছিল ১৬ হাজার কোটি টাকা। 'সিডর' ও 'আইলা'র পর 'মহাসেন' বাংলাদেশে আঘাত করেছিল। এতে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তার হিসাব আমরা পাব না কোনো দিনই। 'সিডর' ও 'আইলা'র আঘাত আমরা এখনও পরিপূর্ণভাবে কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আইলার আঘাতের পর খুলনার দাকোপ, কয়রা ও পাইকগাছায় যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল, তা দূর করা সম্ভব হয়নি। জলাবদ্ধতা কোথাও কোথাও ১ মিটার থেকে ৩ মিটার পর্যন্ত। আইলায় ৮০ ভাগ ফলদ ও বনজ গাছ মরে গিয়েছিল। দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে আজ নোনা জলের আগ্রাসন। সুপেয় পানির বড় অভাব ওইসব অঞ্চলে। এরপর 'মহাসেন' আমাদের আবারও ক্ষতিগ্রস্ত করে গেল। আর এখন অকাল বন্যা। আমাদের মন্ত্রী, সচিব কিংবা পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা বিদেশ সফর ও সম্মেলনে অংশ নিতে ভালোবাসেন। কানকুন, ডারবান, কাতার কিংবা তারও আগে কোপেনহেগেনে (কপ সম্মেলন) আমাদের পরিবেশমন্ত্রী গেছেন। আমাদের কয়েকজন সংসদ সদস্য কোপেনহেগেনে প্লাকার্ড ও ফেস্টুন হাতে নিয়ে বিশ্ব জনমত আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। আমরা পরিবেশ রক্ষায় ফাস্ট স্টার্ট ফান্ডে পাওয়া টাকার (বাংলাদেশের জন্য ১৩০ মিলিয়ন ডলার) ব্যাপারে উৎসাহী। আরও টাকা চাই। সেটা হয়তো ঠিক আছে। কিন্তু 'তিতাসকে হত্যা' করে আমরা নিজেরাই (এর জন্য বিদেশিরা দায়ী নয়) যে বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলাম তার কী হবে? বাগেরহাটের রামপালে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি। বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা ব্যবহার করা হবে। এজন্য বছরে ৪ মিলিয়ন টন কয়লা আমদানি করতে হবে। বিদ্যুৎ আমাদের দরকার- সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু কয়লা পুড়িয়ে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে এবং তাতে যে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে, তা কী আমরা বিবেচনায় নিয়েছি? না, নিইনি। ভারতীয় ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ারের সঙ্গে একটি চুক্তি হয়েছে বটে; কিন্তু পরিবেশের প্রভাব নিরূপণের জন্য ইআইএ সমীক্ষা-তা করা হয়নি। রামপালের গৌরম্ভর কৈকরদশকাঠি ও সাতমারী মৌজায় ১ হাজার ৮৪৭ একর জমিতে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মিত হবে, যা সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরে। কয়লা পোড়ানো হলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, সালফার, নাইট্রিক এসিড বায়ুম-লে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে। এতে করে এসিড বৃষ্টি হবে। পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে। সুন্দরবনের গাছ, উদ্ভিদ মরে যাবে। পশু-পাখির প্রজনন বাধাগ্রস্ত হবে। ধ্বংস হয়ে যাবে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি কী অন্যত্র স্থানান্তরিত করা যেত না? আমাদের গর্ব এ সুন্দরবন। এর মধ্যে সুন্দরবনকে গ্লোবাল হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা এমন কিছু করতে পারি না, যেখানে বিশ্বের বৃহত্তম এ প্যারাবনের অস্তিত্ব হুমকির সৃষ্টি করে। রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করে সুন্দরবনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে আমরা আন্তর্জাতিক প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ সংক্রান্ত ইউনেস্কো কনভেশন লঙ্ঘন করেছি। মাননীয় মন্ত্রী, এ ব্যাপারে আপনি কী বলবেন? বর্তমান পরিবেশমন্ত্রী নতুন। আগে যিনি মন্ত্রী ছিলেন, তিনি এখন নেই। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন যে সরকার গঠিত হয়েছে, সেই সরকারে তিনি জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) থেকে মন্ত্রী। পরিবেশ বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা নেই। 'কপ' সম্মেলনগুলোতে তিনি অংশ নেননি। তবে ফাস্ট স্টার্ট ফান্ডে প্রাপ্ত টাকা নিয়ে যে দুর্নীতি হয়েছে, সে ব্যাপারে তিনি মুখ খুলেছেন। বলেছেন, এ ফান্ডের ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। প্রাপ্ত টাকা নিয়ে যে দুর্নীতি হয়েছে, এটা সত্য। দেখা গেছে, যারা কোনোদিন পরিবেশ নিয়ে কাজ করেননি, তারাও টাকা পেয়েছেন। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, এমন অভিযোগও উঠেছে। ফলে জলবায়ু ফান্ড থেকে যারা সত্যিকার অর্থে ভুক্তভোগী, তারা টাকা পাননি। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে যারা ক্ষতিগ্রস্ত এবং যাদের জন্যই ফান্ড এসেছিল, তারা কোনো সাহায্য পাননি। বাংলাদেশ এককভাবে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনরোধে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারে না। বাংলাদেশ এককভাবে যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ও, তা সামগ্রিকভাবে বিশ্বের উষ্ণতা রোধ করতে খুব একটা প্রভাব রাখবে না। এজন্য বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্তর্জাতিক আসরে জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় বিদেশি সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। কিন্তু এ সাহায্যের ওপর নির্ভর করা ঠিক নয়। পরিবেশ বিপর্যয়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বড় ভূমিকা রয়েছে। অতি সম্প্রতি যে বন্যা হলো, আবার আমাদের সে কথাটাই স্মরণ করিয়ে দিল। 'সিডর' ও 'আইলা'র আঘাতে আমাদের যা ক্ষতি হয়েছিল, সেই ক্ষতি সারাতে সরকারের বড়সড় উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় ১ হাজার ২৬৮ কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হলেও এখানেও 'রাজনীতি' ঢুকে গেছে। দলীয় বিবেচনায় টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। (কালের কণ্ঠ ২৭ মে)। ভাবতে অবাক লাগে, যেসব এনজিও জলবায়ু নিয়ে কাজ করেনি, যাদের কোনো অভিজ্ঞতাও নেই, শুধু দলীয় বিবেচনায় তাদের নামে টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। জলবায়ু তহবিলের অর্থ যাওয়া উচিত ওইসব অঞ্চলে যেখানে ঘূর্ণিঝড়, বন্যার আঘাত বেশি আর মানুষ 'যুদ্ধ' করে সেখানে বেঁচে থাকে। অথচ দেখা গেছে, জলবায়ুর জন্য বরাদ্দকৃত টাকা দেয়া হয়েছে ময়মনসিংহ পৌরসভাকে, মানিকগঞ্জের একটি প্রকল্পে কিংবা নীলফামারী তিস্তা বহুমুখী সমাজ কল্যাণ সংস্থাকে। সিরাজগঞ্জের প্রগতি সংস্থাও পেয়েছে থোক বরাদ্দ। অথচ এমন প্রতিষ্ঠানের একটিরও জলবায়ু সংক্রান্ত কাজের কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। জলবায়ু তহবিলের টাকা বরাদ্দেও যদি 'রাজনীতি' ঢুকে যায়, তাহলে এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু থাকতে পারে না। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী দেখা যায়, বরাদ্দ পাওয়া এনজিওগুলোর সঙ্গে সরকারি দলের নেতা ও কর্মীরা জড়িত। জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু দুর্নীতি যদি এখানেও স্পর্শ করে, তাহলে জলবায়ু ফান্ডে আর সাহায্য পাওয়া যাবে না। সচেতন হওয়ার সময় তাই এখনই। জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী। ধারণা করছি, তিনি বিশ্ববাসীকে জানাবেন বাংলাদেশ কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের ব্যাপারে বিশ্ববাসীর সমর্থন রয়েছে। এখন যা দরকার, তা হচ্ছে অভ্যন্তরীণভাবে আরও সচেতনতা বৃদ্ধি। আগামী বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে বিশ্বের উষ্ণতারোধ সংক্রান্ত কপ-২২ সম্মেলনে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা। বাংলাদেশের উচিত ওই সম্মেলনে জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করা। Daily ALOKITO BANGLADESH 19.09.14

জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে একটি শঙ্কার কথা

বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে একটি শঙ্কার কথা আমাদের জানিয়েছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বা এডিবি। বাংলাদেশ এই জলবায়ু পরিবর্তনে কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এডিবির রিপোর্টে সে কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এডিবি জানিয়েছে, ২০৫০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি গড়ে ১.৮ শতাংশ করে কম হতে পারে। আর চলতি শতাব্দী শেষে এই ক্ষতি হতে পারে প্রায় ৯ শতাংশ। আর বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়তে পারে ৪ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এডিবির ওই রিপোর্টে দক্ষিণ এশিয়ার অপর দুটি দেশ নেপাল ও মালদ্বীপের ক্ষতির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। গত ১৯ আগস্ট ঢাকায় এডিবির রিপোর্টটি উপস্থাপন করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশের যে ক্ষতি হবে, তা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। শুধু এডিবির রিপোর্টেই নয়, বরং জাতিসংঘের রিপোর্টেও এই ক্ষতির দিকটি উল্লেখ করা হয়েছে একাধিকবার। প্রতিবছরই জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত যে শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যা 'কপ' বা 'কমিটি অব দ্য পার্টিস' নামে পরিচিত, সেখানেও বাংলাদেশের পরিবেশগত সমস্যার কথা উঠে আসে। বাংলাদেশের যাঁরাই পরিবেশমন্ত্রী থাকেন তাঁরা ঘটা করে 'কপ' সম্মেলনে যান। কিন্তু ওই পর্যন্তই। ইতিমধ্যে নাসা আরো একটি আশঙ্কার কথা জানিয়েছে। নাসা আশঙ্কা করছে, গ্রিনল্যান্ডে যে বরফ জমা রয়েছে, তা যদি উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে গলে যায়, তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা সাত মিটার বৃদ্ধি পেতে পারে। তাই কার্বন ডাই-অক্সাইড হ্রাসের কথা বলছে নাসা। আল গোর তাঁর একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন, বিশ্বের বৃহত্তম বন্দরগুলোয় ইতিমধ্যে চার কোটি মানুষ মারাত্মক প্লাবনের হুমকির মুখে আছে। আল গোর বিশ্বের ১০৭ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে (বাংলাদেশের সাবেক বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদও ছিলেন ওই দলে) গিয়েছিলেন অ্যান্টার্কটিকায়। শুধু জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য। কিন্তু বিশ্ব সম্প্রদায় এখনো নীরব। প্রতিবছরই 'কপ' সম্মেলনে ভালো ভালো কথা বলা হয়। কোপেনহেগেন থেকে ডারবান সম্মেলন- বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্ব কার্বন নিঃসরণ কমাতে একটি চুক্তি করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। এ-সংক্রান্ত আলোচনা শুরু হয়েছে এবং ২০২০ সাল থেকে ওই চুক্তিটি কার্যকর হবে। তবে একটি গ্রিন ফান্ড গঠনের ব্যাপারে শিল্পোন্নত দেশগুলো রাজি হয়েছে। এই ফান্ডের পরিমাণ হয়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলার। ৪০ বিলিয়ন ডলার দিয়ে এই ফান্ড যাত্রা শুরু করছে। বিশ্বব্যাংক এই ফান্ডের ব্যবস্থাপনার তদারকি করছে। বাংলাদেশ ওই ফান্ড থেকে অর্থ পেয়েছে। 'কপ'-এর ডারবান সম্মেলনের পর (২০১১) যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে প্রতিবছর এ ধরনের সম্মেলন করে শেষ পর্যন্ত কি বিশ্বের উষ্ণতা রোধ করা সম্ভব হবে? বাংলাদেশের সাবেক পরিবেশমন্ত্রী সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। ঢাকায় ফিরে এসে তিনি কিছুটা হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন। তাই কপ সম্মেলন নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবেই। ইতিমধ্যে জাপান, কানাডা ও রাশিয়া কিয়োটো-পরবর্তী আলোচনা থেকে বেরিয়ে গেছে। সুতরাং বোঝাই যায়, এক ধরনের হতাশা এসে গেছে। আসলে বিশ্বের দেশগুলো এখন বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে গেছে। বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে একেক গ্রুপের একেক এজেন্ডা। উন্নত বিশ্ব কিংবা উন্নয়নশীল বিশ্বের যে দাবি, তার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আবার উন্নয়নশীল বিশ্বও একাধিক গ্রুপে বিভক্ত। ধনী দেশগুলো এনেক্স-১-এ অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বের জিডিপির ৭৫ শতাংশ এই দেশগুলোর। অথচ লোকসংখ্যা মাত্র বিশ্বের ১৯ শতাংশ। কিন্তু কার্বন নিঃসরণ করে সবচেয়ে বেশি, ৫১ শতাংশ। অন্যদিকে গ্রুপ ৭৭-এর দেশগুলো (মোট ১৩০টি দেশ) বিশ্বের জনসংখ্যার ৭৬ শতাংশ, জিডিপির মাত্র ১৯ শতাংশ। কিন্তু কার্বন উদ্গিরণ করে ৪২ শতাংশ। আবার সাগরপারের দেশগুলো, যারা বিশ্বের জনসংখ্যা, জিডিপি ও কার্বন নিঃসরণ করে মাত্র ১ শতাংশ; তাদের দাবি ২০২০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বর্তমান অবস্থার চেয়ে ৮৫ শতাংশ কমিয়ে আনার। বনাঞ্চলভুক্ত দেশগুলো, যারা 'রেইন ফরেস্ট কোয়ালিশন' হিসেবে পরিচিত, তারা বিশ্ব জনগোষ্ঠীর ১৯ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে। জিডিপির মাত্র ৩ শতাংশ তাদের। আর মাত্র ৪ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ করে। যুক্তরাষ্ট্র একা কার্বন নিঃসরণ করে ২০ শতাংশ, জিডিপির ৩০ শতাংশ তাদের। অথচ জনসংখ্যা মাত্র বিশ্বের ৫ শতাংশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বিশ্ব জিডিপির ২৫ শতাংশ ও জনসংখ্যার ৮ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু কার্বন নিঃসরণ করে ১৫ শতাংশ। চীনকে নিয়ে সমস্যা এখন অনেক। চীন একা কার্বন নিঃসরণ করে ২১ শতাংশ। বিশ্ব জনসংখ্যার ২০ শতাংশই চীনা নাগরিক। জিডিপির ৬ শতাংশ তাদের। প্রতিটি গ্রুপের অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন। সবাই নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে কার্বন নিঃসরণের হার কমাতে চায়। জাতিসংঘ এটাকে বলছে কার্বন ঘনত্ব। অর্থাৎ দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা মোট আয়ের (জিডিপি) অনুপাতে কার্বন ডাই-অক্সাইড উদ্গিরণের হারকে কার্বন ঘনত্ব বা গ্রিনহাউস গ্যাসের ঘনত্ব বলা হয়। উন্নয়নশীল বিশ্ব মনে করে, এই হার মাথাপিছু জনসংখ্যা ধরে করা উচিত। কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের হার কমানো উচিত- এটা মোটামুটিভাবে সবাই মেনে নিয়েছে। কিন্তু কে কতটুকু কমাবে সে প্রশ্নের কোনো সমাধান হয়নি। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ও চীন (এবং সেই সঙ্গে ভারতও) বিশ্বে সবচেয়ে বেশি দূষণ ছড়ায়, সে কারণে এই দুটি দেশের কাছ থেকে 'কমিটমেন্ট' আশা করেছিল বিশ্ব। কিন্তু তা হয়নি। চীন প্রস্তাব করেছিল ২০০৫ সালের কার্বন ঘনত্বের চেয়ে দেশটি ২০২০ সালে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কমাবে। আর যুক্তরাষ্ট্রের দাবি ছিল, তারা ১৭ শতাংশ কমাবে। কিন্তু চীন ও ভারত যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এখানে বলা ভালো, চীনের কার্বন ঘনত্ব ২.৮৫ টন, আর ভারতের ১.৮ টন। চীন ও ভারত দুটি দেশই বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে এ শতাব্দীতেই। বিশ্বব্যাংকের উপদেষ্টা হরিন্দর কোহলির মতে, আগামী ৩০ বছরে ভারত বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। মাথাপিছু আয় তখন ৯৪০ থেকে বেড়ে ২২ হাজার ডলারে উন্নীত হবে। ২০০৭ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত অবদান রাখত মাত্র ২ শতাংশ, ৩০ বছর পর অবদান রাখবে ১৭ শতাংশ। তবে এটা ধরে রাখতে হলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হতে হবে ৮ থেকে ৯ শতাংশ। এ কারণেই ভারতকে নিয়ে ভয়- তাদের কার্বন ঘনত্ব বাড়বে। কেননা প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালু রাখতে হবে। আর তাতে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বাড়বে। পাঠকদের এখানে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ১৯৯৭ সালে কিয়োটো সম্মেলনে ১৬০টি দেশ অংশ নিয়েছিল এবং সেখানে যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১৯৯০ সালের কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের মাত্রার চেয়ে ৮ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্র ৭ শতাংশ, জাপানের ৬ শতাংশ হ্রাস করার কথা। তা ছাড়া সার্বিকভাবে ৫.২ শতাংশ গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের আইনগত বাধ্যবাধকতা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সিদ্ধান্ত হয়েছিল সব দেশকে ২০০৮-২০১২ সালের মধ্যে গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। তৎকালীন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট গোর কিয়োটো চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও পরে বুশ প্রশাসন ওই চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে কিয়োটো চুক্তি কাগজে-কলমে থেকে গিয়েছিল। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে যে কটি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের উপকূলে গত ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। সমুদ্রের পানি বেড়ে যাওয়ায় উপকূলের মানুষ অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতি সাতজনে একজন মানুষ ভবিষ্যতে উদ্বাস্তু হবে। ১৭ শতাংশ এলাকা সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে। বাংলাদেশ কোপেনহেগেন সম্মেলনে পরিবেশগত উদ্বাস্তুদের Universal Natural Person হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছিল; কিন্তু তা গ্রহণ করা হয়নি। সর্বশেষ দোহা সম্মেলনেও বড় কোনো অগ্রগতি হয়নি। ফার্স্ট স্টার্ট ফান্ডে মাত্র পাওয়া গেছে আড়াই বিলিয়ন ডলার (২৫০০ মিলিয়ন ডলার) বাংলাদেশ সেখান থেকে পেয়েছে ১৩০ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু বাংলাদেশে আইলার কারণে যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল, তা দূর হয়নি। সার্ক সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছিল ঐক্যবদ্ধভাবে দক্ষিণ এশিয়ার সমস্যাগুলো আমরা তুলে ধরব। কিন্তু ডারবানে তা হয়নি। বাংলাদেশ ও ভারত একই ফোরামে ছিল না। একটি আইনি বাধ্যবাধকতার কথাও বলা হয়েছিল; কিন্তু তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। প্রযুক্তি হস্তান্তর সম্পর্কেও কোনো সমঝোতা হয়নি। কপ সম্মেলনে আসলেই বড় বড় কথা বলা হয়। কয়েক টন কার্বন নিঃসরণ করে সম্মেলন 'অনেক আশার কথা শুনিয়ে' শেষ হয় বটে; কিন্তু সে ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয় খুব কমই। আগে সমস্যা ছিল উন্নত বিশ্বকে নিয়ে। এখন চীন ও ভারত একটি সমস্যা। তাদের যুক্তি, নিঃসরণের পরিমাণ হ্রাস করলে, তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে। তাতে করে বাড়বে দরিদ্রতা। এই যুক্তি ফেলে দেওয়ার নয়। ফলে কপ সম্মেলন নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল। চলতি বছরের ডিসেম্বরে (১-১২ ডিসেম্বর) পেরুর রাজধানী লিমায় কপ-২১ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। কপ-১৮ (ডারবান) সম্মেলনের পর দোহায় কপ-১৯ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ২০১৫ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত হবে কপ-২২ সম্মেলন। কিন্তু তাতে আমাদের প্রাপ্তি কী? শুধু 'অংশগ্রহণ' ছাড়া আমাদের কোনো প্রাপ্তি নেই। আল গোর নিজে তাঁর প্রসঙ্গে বাংলাদেশের কথা উল্লেখ করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বাড়লে ২০৫০ সাল নাগাদ দুই থেকে আড়াই কোটি বাংলাদেশিকে অন্যত্র স্থানান্তর করতে হবে। এর অর্থ, প্রচুর মানুষ হারাবে তাদের বসতি, তাদের পেশা। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়া মানে কেবল বন্যা নয়, এর মানে নোনা পানির আগ্রাসন। সেই সঙ্গে ধানের আবাদ ধ্বংস হয়ে যাওয়া। দুই কোটি কৃষক, জেলে পেশা হারিয়ে শহরে, বিশেষ করে ঢাকা শহরে এসে নতুন নতুন বস্তি গড়ে তুলবে। রিকশা চালানোর জীবন বেছে নেবে। সৃষ্টি হবে একটি শ্রেণির, যারা শহুরে মানুষের ভাষায় 'জলবায়ু উদ্বাস্তু'। এই 'জলবায়ু উদ্বাস্তু'দের নিয়ে রাজনীতি হবে! বিদেশে অর্থ সাহায্য চাওয়া হবে। ইতিমধ্যে অর্থ সাহায্য পাওয়া গেছে। কিন্তু ওই অর্থ সাহায্য বিতরণ নিয়ে নানা অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। স্বয়ং বর্তমান পরিবেশমন্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন স্বচ্ছতা নিয়ে। বলেছেন, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ যাচ্ছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু এ অর্থ ঠিকমতো খরচ হচ্ছে কি না, তা মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নেই (২০ আগস্ট)। দুর্নীতি এখানে ভর করেছে। যারা সত্যিকার অর্থেই জলবায়ু উদ্বাস্তু, তারা এই সাহায্য পাচ্ছে না। তাই এডিবির রিপোর্টে প্রকৃত সত্য প্রকাশিত হলেও এ নিয়ে আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণ নেই। জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমলে দরিদ্রতা বাড়বে। বাড়বে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। একটি 'ভালো সরকারের' জন্য তা কোনো ভালো খবর নয়। Daily KALERKONTHO 16.09.14

অস্ত্রবাজ যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক!

সোশ্যাল মিডিয়ায় একজন অস্ত্রবাজের ছবি ছাপা হয়েছে, যিনি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এখন। এ নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। অনেকে আমাকেও প্রশ্ন করেছেন। তাহলে সমাজ কোথায় যাচ্ছে- যেখানে একজন অস্ত্রবাজকে আমরা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছি! যখন তিনি শিক্ষক, তখন তিনি অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেননি। যখন ছাত্র ছিলেন, তখন তিনি অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। যদিও তিনি তা স্বীকার করেন না। অভিযোগটি অস্বীকার করেছেন। বলেছেন, এটা ফটোশপের কাজ কারবার। কাট অ্যান্ড পেস্টের কথাও বলেছেন। কিন্তু বাস্তবতা কি তাই বলে? ছাত্রলীগের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) শাখার নেতাদের কেউ কেউ গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, তিনি আমন্ত্রিত হয়ে একটি বনভোজনে গিয়েছিলেন, আর সেখানেই ওই ছবিটি তোলা হয়। এতে করে স্পষ্ট হয়, ছবিটির সত্যতা আছে। তবে এটাও সত্য, তার নিজের কিছু শত্র“ ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে, যারা এটি গণমাধ্যম তথা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করেছে। এই ছবি ছাপা হওয়ায় অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এক. তিনি নিজেই শুধু বিতর্কিত হলেন না, বরং পুরো শিক্ষক সমাজকে তিনি জাতির কাছে বিতর্কিত করলেন। এই দায়ভার তাকে নিতেই হবে। নতুবা এ বিতর্ক চলতেই থাকবে এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আরও বিতর্কিত হয়ে পড়বে। আমার ছাত্রতুল্য ওই শিক্ষককে আমি অনুরোধ করব শিক্ষা ছুটিতে যাওয়ার, যাতে করে নতুন বিতর্ক আর সৃষ্টি না হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও তাকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠাতে পারে। অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্ষেত্রে এমনটি হয়েছে।দুই. এর দায়ভার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ঘাড়েও বর্তায়। উপাচার্য মহোদয় নিজে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি এখন আর আওয়ামী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ থাকা পর্যন্ত ছিলেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর তিনি প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে পদত্যাগ করেছিলেন, এটা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি। উপাচার্য হিসেবে তিনি যখন দায়িত্ব পালন করেন, তখন রাজনৈতিক আনুগত্যটা বিবেচনায় নিয়েছিলেন, এমন অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আছে। সেই বিবেচনায় তিনি ওই অস্ত্রবাজকে, যিনি একসময় ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন, তার নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি দিয়েছিলেন- এ অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আছে। ব্যক্তিগতভাবে তিনি একজন সজ্জন ব্যক্তি। তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয়ও ভালো। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করাদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ, কলেজের শিক্ষকদের অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে নিয়োগ (প্রকাশনা ও পদোন্নতির শর্ত পূরণ না করা) ইত্যাদি এন্তার অভিযোগ তার ভাবমূর্তিকে নষ্ট করেছে। একটা নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য যে ধরনের একাডেমিক পরিবেশ দরকার, তা তিনি নিশ্চিত করেছেন, এটা দিব্যি দিয়ে বলতে পারব না। এখন অস্ত্রবাজ শিক্ষক তার বিশ্ববিদ্যালয়ের হওয়ায় খুব সঙ্গত কারণেই মানুষ বলতে শুরু করবে, শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া সেখানে সুষ্ঠু হয়নি। রাজনৈতিক বিবেচনা সেখানে প্রাধান্য পেয়েছে বেশি।তিন. একজন সিনিয়র সাংবাদিক আমাকে জানিয়েছেন, এ ধরনের প্রায় ৩০ জন অস্ত্রবাজ শিক্ষক বর্তমানে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত। তারাও অস্ত্রের ট্রেনিং নিয়েছিলেন বলে তিনি আমাকে অবহিত করেছেন। তিনি একটি ইংরেজি দৈনিকের বিশেষ প্রতিনিধি এবং শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে রিপোর্ট করেন। সুতরাং তার প্রাপ্ত তথ্যে কোনো ঘাটতি আছে, এটা আমার মনে হয়নি। যদি তথ্যটি সত্য হয়ে থাকে (?), তা আমাদের জন্য আরেক দুশ্চিন্তার কারণ।চার. ওই ছবিটি প্রকাশ পাওয়ার পেছনে কাজ করছে ইবির ছাত্রলীগের অন্তর্দ্বন্দ্ব। এ অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রায় প্রতিটি পেশাতেই আছে এবং একজন কর্তৃক অপরজনকে ঘায়েল করার নগ্ন প্রতিযোগিতা আমরা বারবার প্রত্যক্ষ করি। এ ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে। দ্বন্দ্বটা রাজনৈতিক হওয়া ভালো। কিন্তু সেটা যদি ব্যক্তি চরিত্রকে স্পর্শ করে, তা শুধু যে সংগঠনের জন্যই খারাপ সংবাদ তা নয়, বরং তা সমাজ তথা প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্যও একটি খারাপ দৃষ্টান্ত। ওই ঘটনায় যিনি প্রশিক্ষক ছিলেন এবং যিনি ছাত্রলীগের ইবি শাখার যুগ্ম আহ্বায়কদের একজন, তাকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু শুধু বহিষ্কারই কি সবকিছু? এতে করে সংগঠনের ভাবমূর্তির যে ক্ষতি হল, তা এখন কাটিয়ে ওঠা যাবে কীভাবে?পাঁচ. ওই ঘটনা আমাদের দেখিয়ে দিল শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রচলিত নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে। এখন শিক্ষক নিয়োগ হয় রাজনৈতিক বিবেচনায় ও উপাচার্যের পছন্দের তালিকা অনুযায়ী। ভালো রেজাল্ট করেও শুধু দলীয় প্রার্থী না হওয়ায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাননি এ সংখ্যা শত শত। অন্যদিকে নিয়োগ পাওয়া তরুণ শিক্ষকদের পাঠদানের সক্ষমতা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। শুধু তাই নয়, আরেকটি বড় অভিযোগ হচ্ছে, তরুণ শিক্ষকরা নিয়োগ পেয়ে আর ক্লাস নিতে কোনো আগ্রহ দেখান না। এ ধরনের একটি সংবাদ সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের দুর্ভাগ্য এখানেই যে, একজন শিক্ষক নিয়মিত ক্লাস নেন কি-না তা দেখার কেউ নেই। উপাচার্য মহোদয়রা এ কাজটি কখনোই করেন না। সিনিয়র শিক্ষকরাও কখনোই এটি করেন না, কারণ এতে করে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্ষদের নির্বাচনে ভোট হারাতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভোটার রিক্রুট হয়, শিক্ষক রিক্রুট হয় না।ছয়. আমি দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বর্তমান পদ্ধতি পরিবর্তন করে তিন পদ্ধতিতে এই রিক্রুট সম্পন্ন করতে হবে। পিএসসির মতো একটি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন করতে হবে। কারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এখন ৩৫। আরও দুটি চালু হবে। ফলে এ দায়িত্বটি উপাচার্যদের হাতে থাকায় রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পায় বেশি। একটি কমিশন থাকলে নিরপেক্ষ ও ভালো শিক্ষক নিয়োগের সম্ভাবনা বেশি থাকে। মঞ্জুরি কমিশনের হাতেও এ নিয়োগের বিষয়টি দেয়া যেতে পারে। তিনভাবে এ নিয়োগ সম্পন্ন হবে। এক. প্রার্থীর অতীত রেজাল্ট। দুই. লিখিত পরীক্ষা। তিন. ডেমো অর্থাৎ তিনি পড়াতে পারেন কি-না তা যাচাই করা। একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল এ কার্যক্রম পরিচালনা করবে এবং চূড়ান্ত প্রার্থীদের নিয়োগ দেবে। এ ব্যবস্থা থাকলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে এরকমটি হতো না।সাত. ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইনেও বেশকিছু পরিবর্তন দরকার। তথাকথিত স্বাধীনতার নামে এ আইনের অপব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে। শিক্ষকরা স্বাধীনতা ভোগ করবেন, এটা ঠিক আছে। কিন্তু তথাকথিত স্বাধীনতার নামে তিনি দুজায়গায় চাকরি করবেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশি সময় দেবেন, এটা হতে দেয়া যাবে না। যেসব শিক্ষক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিজনেস স্কুলের সঙ্গে জড়িত, তারা প্রতিদিন কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেলা ৩টা পর্যন্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিচ্ছেন। ফলে তার নিজ প্রতিষ্ঠানে তার ছাত্ররা তাকে সময়মতো পায় না। এ ক্ষেত্রে আইনটি আরও সুস্পষ্ট করা দরকার। যেহেতু এর সঙ্গে অর্থপ্রাপ্তির একটি বিষয় আছে, সেহেতু তরুণ শিক্ষকরা টাকার জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ঝুঁকবেন। এটা বন্ধ করা যাবে না। এজন্য আইনটি আরও স্পষ্ট করা দরকার। শিক্ষকদের জন্য আলাদা পে-স্কেল থাকাটাও জরুরি।একসময় শিক্ষকতা ছিল মহান পেশা। এখন এটা আর আছে কি-না জানি না। ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষকতার ওপর আমার আর আস্থা নেই। এটাকে এখন আর পেশা হিসেবে দেখা হচ্ছে না, দেখা হচ্ছে একটা চাকরি হিসেবে। কিন্তু আমাদের যারা শিক্ষক ছিলেন, তাদের অনেকেই এটাকে কখনও চাকরি হিসেবে নেননি। নিয়েছিলেন মহান পেশা হিসেবে। আজ ওই অস্ত্রবাজকে দেখে আমার আস্থার জায়গাটা আর থাকে না। যদিও একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা দিয়ে পুরো শিক্ষক সমাজকে আমি দায়ী করতে পারব না। করাটা ঠিকও হবে না। কিন্তু একটা দাগ তো পড়ল! আমার ধারণা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গত ৫ থেকে ৭ বছরে যারা শিক্ষক হিসেবে রিক্রুট হয়েছেন, তাদের অনেকের অতীতই অন্ধকার। ফেসবুকে দেখলাম, জাহাঙ্গীরনগরের এক অ্যাকটিভিস্ট লিখেছে, টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ হলে অস্ত্রবাজরা জায়গা নেবেই। এর পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে বলতে পারব না। তবে অভিযোগ আছে। শিক্ষামন্ত্রী বিষয়টি কীভাবে দেখছেন, আমি জানি না। কিন্তু এর দায়ভার কি তিনি অস্বীকার করতে পারবেন?আওয়ামী লীগ সবসময়ই বিএনপি-জামায়াতের অতীত ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে। টিভিতে প্রাইম টাইমে একটি অনুষ্ঠান হয়, যেখানে বলা হয় বিএনপির কর্মীরা অতীতে কোথায় কোথায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করেছিল। পত্রিকায় দেখলাম, আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বিএনপি-জামায়াতি নৃশংসতার ভিডিও যাচ্ছে জাতিসংঘে (১০ সেপ্টেম্বর)। জাতিসংঘের মূল অধিবেশন শুরু হচ্ছে ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে। শোনা যাচ্ছে, ওই অধিবেশনে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি রাষ্ট্রের প্রতিনিধির কাছে তুলে দেয়া হবে এ ভিডিও। বাংলাদেশের একটি অভ্যন্তরীণ ঘটনায় পাপুয়া নিউগিনির প্রতিনিধির কী বলার বা জানার আছে, আমি জানি না। কিন্তু এটা বুঝতে পারি, এতে করে বড় দলগুলোর মাঝে বৈরিতা আরও বাড়বে। এখন তারা যদি আরেকটা ভিডিওচিত্র তৈরি করে, তাতে অস্ত্রবাজ ওই শিক্ষকের ছবি যদি থাকে, তাহলে কেমন হবে? নিশ্চয়ই সরকার বিব্রত হবে। এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। সমাজে খারাপ লোক আছে প্রতিটি সেক্টরে। সবাই ধোয়া তুলসীপাতা নন। শিক্ষকতায় খারাপ লোক থাকতেই পারে। এজন্য সরকারকে দোষ দেয়াও ঠিক হবে না। হয়তো ওই রিক্রুটটি সঠিক ছিল না। এখন আইনের বিধানমতে আইনশৃংখলা বাহিনী কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি কোনো ব্যবস্থা নেয়, তাহলে কারও কিছু বলার থাকবে না। এ সিদ্ধান্তটি নেয়ার আগে স্বয়ং ওই ব্যক্তি নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, যাতে সব বিতর্কের অবসান ঘটেআরও একটা কথা- শিক্ষাঙ্গন সবার, সব দলমত অনুসারী সব শিক্ষকের। এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। খুব স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সমর্থকরা ভিসি হবেন। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ড. আবুল বারকাতের প্রসঙ্গে একটি কথা বলেছেন- আওয়ামী লীগে অনেক ইনটেলেকচ্যুয়াল জায়গাটি আছে। তাদের দেখতে হয়। সহজ বাংলায় এর অর্থ হচ্ছে, আওয়ামী লীগে অনেক বুদ্ধিজীবী আছে। সবাইকেই সুযোগ দিতে হবে। শুধু ড. আবুল বারকাতকে দিলেই চলবে না! প্রশ্নটা এখানেই। যাদেরই সুযোগ দিচ্ছেন, তাদের সবার মেধা ও যোগ্যতা কি আছে? ৩৫টি বিশ্ববিদ্যালয়। যাদের উপাচার্য পদে, পিএসসিতে, মঞ্জুরি কমিশনে বসানো হয়েছে, তাদের অনেকের কর্মকাণ্ডই নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কাহিনী একসময় সংবাদপত্রের নিত্য সংবাদ ছিল। তিনি এখন নেই বটে, কিন্তু বাকিরাও কম যান না। প্রশ্ন সেখানে নয়। এ আমলে একজন আওয়ামীপন্থী শিক্ষক ভিসি হবেন, তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু শিক্ষক নিয়োগে শুধু আওয়ামী লীগের মতাদর্শের শিক্ষকদের বিবেচনায় নেয়া হবে, এটা মানতে কষ্ট হয়। আমি অনেক ভালো ছাত্রকে চিনি ও জানি, যারা ছাত্র অবস্থাতে গবেষণা প্রবন্ধ লিখে সবার দৃষ্টি কেড়েছে। শুধু ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক না থাকার কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সুযোগ তারা পায়নি। এখন একজন অস্ত্রবাজের ঘটনা দেখিয়ে দিল ক্যাম্পাসে এরকম আরও অনেক অস্ত্রবাজ লুকিয়ে থাকতে পারে শিক্ষকতার আড়ালে! শিক্ষামন্ত্রী ভালো মানুষ। তিনি কি একটি তদন্তের উদ্যোগ নেবেন? তিনি কি খতিয়ে দেখবেন শিক্ষক নিয়োগে ত্র“টি হয়েছে কোথায়? এটা মঞ্জুরি কমিশন করতে পারে। একটি কমিটি গঠন করে বিষয়টি তলিয়ে দেখতে পারে। কিন্তু আজাদ চৌধুরীর সদিচ্ছা থাকলেও তিনি এটা পারবেন না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাকে অনুমতি দেবে না। ফলে অযোগ্যরা থেকেই যাবেন ক্যাম্পাসগুলোতে।যখন এ নিবন্ধটি তৈরি করছি, তখন পর্যন্ত আমি নিশ্চিত নই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আদৌ কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করেছে কি-না। উপাচার্য মহোদয়ের ইচ্ছা থাকলেও তিনি পারবেন না। আমাদের এ বাস্তবতা মেনে নিতেই হবে। আর ভয়টা এখানেই। আগামী দিনগুলোতে আমরা কেমন ক্যাম্পাস পাব? একজন অস্ত্রবাজ যখন শিক্ষক হন, তখন তিনি একজন অস্ত্রবাজকেই তৈরি করবেন। আর একজন ভালো শিক্ষক একজন ভালো ছাত্রই তৈরি করবেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, ভালো শিক্ষকের বড় অভাব ক্যাম্পাসগুলোতে। আজ যিনি শিক্ষক হয়ে ক্লাসে যান না, রাজনীতি করেন; তিনি তো তার রাজনীতির মতাদর্শের ছাত্রছাত্রীদেরই প্রমোট করবেন। আর উপাচার্য মহোদয়রা যখন ভোটের রাজনীতির কারণে তরুণ শিক্ষকদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন, তখন ওই শিক্ষকরা আর একাডেমিক জগতে বিচরণ করে না। এটাই বাস্তবতা। অস্ত্রবাজ শিক্ষকের ছবি দেখে আমি কষ্ট পেয়েছি। কিন্তু এই কষ্ট আমাকে শক্তি জোগাবে না। Daily JUGANTOR 16.09.14

উচ্চশিক্ষা নিয়ে ভাবনাটা জরুরি

অতিসম্প্রতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি রিপোর্টের বক্তব্য উল্লেখ করে লেখাটা শুরু করতে চাই। ৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ওই সংবাদে বলা হয়েছে_ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স প্রথম বর্ষের জন্য ভর্তি পরীক্ষায় শতকরা ৮০ ভাগ পরীক্ষার্থী নূ্যনতম পাস মার্ক তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ এবার এইচএসসি পাস করেছে ৮ লাখ ৮৫ হাজার শিক্ষার্থী, যাদের মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭০ হাজার ৬০২ জন। এত বিপুলসংখ্যক ছাত্র জিপিএ-৫ পেয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য নূ্যনতম পাস নাম্বার পেল না? তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, এত বিপুলসংখ্যক জিপিএ-৫-ধারী ছাত্রছাত্রী কোথায় যাবে? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যা মাত্র ৭০ হাজার। বাকিদের ভাগ্যে কী আছে, যখন খোদ জিপিএ-৫-প্রাপ্তদের ভর্তিই নিশ্চিত নয়? দেশে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে এবং এটাও সত্য, দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও বেড়েছে। ৩৭টি পাবলিক (দুটি এখনো কাজ শুরু করেনি) আর ৭৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমাদের উচ্চশিক্ষা। এর বাইরে রয়েছে ৩৮টি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে নানা অভিযোগ। সব না হলেও কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় সার্টিফিকেট বাণিজ্য করছে। এটা ইউজিসি বন্ধ করতে পারছে না। নানা জটিলতায় আটকে আছে সিদ্ধান্ত। ফলে অবৈধ সার্টিফিকেট বাণিজ্য করে তারা লাখ লাখ টাকা আয় করছে। কিন্তু ক্ষতি করছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার। পাস না করেও সার্টিফিকেট কেনা যায়। আর ওই সার্টিফিকেটধারীরা দেশে বেকার সমস্যা বাড়াচ্ছে। আমরা উচ্চশিক্ষা নিয়ে রীতিমতো জুয়া খেলছি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর যে নজরদারি বাড়ানো দরকার তা মঞ্জুরি কমিশন করছে না। ইউজিসির নাম পরিবর্তন হচ্ছে। জনবলও বাড়বে। সদস্য সংখ্যাও বাড়বে। তাতে করে কি উচ্চশিক্ষার মান বাড়ানো যাবে? এতে করে সরকারের খরচ বাড়ল। আমি অনেক দিন থেকেই বলে আসছি, শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দেখভাল করার জন্য আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান দরকার। উচ্চশিক্ষা কমিশন দিয়েও হতে পারে। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাদা একটি স্বাধীন শাখা থাকবে। এখানে নূ্যনতম তিন থেকে চার জন সদস্য থাকবেন। আলাদা প্রশাসন থাকবে। না হলে মাত্র একজন সদস্যকে দিয়ে (যা এত দিন হয়ে আসছে) ৭৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করা সম্ভব নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে যুগের চাহিদা। এটা আমরা অস্বীকার করতে পারব না। এখানে মালিকপক্ষের মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। একে 'ব্যবসায়িক কেন্দ্র' করা যাবে না। মালিকরা পুঁজি বিনিয়োগ করবেন বটে, কিন্তু ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি থেকে তা তারা করবেন না। করবেন সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে। কিন্তু কী হচ্ছে ওই সেক্টরে? দারুল ইহসানের অবৈধ ক্যাম্পাস ৯৮টি। তারা বিজ্ঞাপন দিয়ে বলছে সরকার তাদের অনুমতি দিয়েছে। অথচ ইউজিসির চেয়ারম্যান স্বয়ং বলছেন আউটার ক্যাম্পাস অবৈধ। তাহলে কোন সাহসে এবং কাদের পরামর্শে এরা ছাত্র ভর্তি করাচ্ছে? উচ্চ আদালতের নজরে কি আসছে না বিষয়টি? শিক্ষা মন্ত্রণালয় কি পারে না উদ্যোগী হয়ে চিরস্থায়ীভাবে আউটার ক্যাম্পাস বন্ধ করে দিতে? 'শর্ষের মধ্যে যদি ভূত' থাকে তাহলে ভূত তাড়াব কীভাবে? প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয় দুটো? দুজন ভিসি, তারা দাবি করছেন তারা অনুমোদিত। উত্তরার এশিয়ান ইউনিভার্সিটির অবস্থা ভয়াবহ। শুধু সার্টিফিকেট বাণিজ্যই নয়, মালিকানা দাবি করেছেন দুই ভাই। আরো ভয়াবহ শিক্ষকরা 'নোট' বিক্রি করেন এবং ছাত্রদের তা কিনতে বাধ্য করেন। জন্মের পর থেকেই সাদেক সাহেব ভিসি। এখন তৈরি হচ্ছে তার ছেলে, তিনিও ভিসি হওয়ার পথে। ওখানে পড়ায় কারা? কী তাদের ডিগ্রি। অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষকদের দিয়ে চলছে 'বিশ্ববিদ্যালয়'। এটা যেন একটা পারিবারিক ব্যবসা কেন্দ্র। ইবাইস নিয়েও একই সমস্যা। মালিকপক্ষ একাধিক। মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ যার বিরুদ্ধে তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক-মোক্তার। যিনি মার্কিন দূতাবাসে চাকরি করতেন, তিনিও এখন ভিসি কিছু দিন আগে একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল_ ১৩ শতাংশ শিক্ষকের (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) শিক্ষা সনদ জাল। আমার মনে হয়, এ সংখ্যা আরো বেশি হবে। ভুয়া পিএইচডি নিয়ে চাকরি নিয়েছেন অনেকে। আশা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমনি এক ভুয়া পিএইচডির খবর আমি নিজে কর্তৃপক্ষকে দিয়েছি। কিন্তু তাতে পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির পিএচইডি ডিগ্রি জাল। আমি অন্তত দশজন ভিসির নাম বলতে পারব যারা কোনো দিন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকতা না করেই 'অধ্যাপক' পদবি ব্যবহার করছেন। কী দুর্ভাগ্য এ জাতির। দেখার কেউ নেই। অভিভাবকরা অসহায়। তারা একরকম বাধ্য হয়েই তাদের সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন। উচ্চশিক্ষা নিয়ে এই ছিনিমিনি খেলা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠন করে কিছু লোকের চাকরির সংস্থান হবে বটে (তাও আবার রাজনৈতিক বিবেচনায়), কিন্তু উচ্চশিক্ষার তাতে মানোন্নয়ন ঘটবে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও উচ্চশিক্ষায় ধস নেমেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচ্চশিক্ষায় অনিয়মের খবর উপাচার্য মহোদয়রা অবহিত হয়েও বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার 'স্বার্থে' তারা নিশ্চুপ। এখানেও তারা 'কমপ্রোমাইজ' করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ১৩ লাখ লোকের ইন্টারভিউ নিয়ে পিএইচডি অভিসন্দর্ভ রচনার কাহিনী সবার মুখে মুখে। কিন্তু বিতর্কিত তত্ত্বাবধায়ক এখনো 'দ্বিগুণ উৎসাহে' আরো পিএইচডি ছাত্র নিচ্ছেন। রাজশাহী ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের 'পিএইচডি কাহিনী' আরেক দিন বলা যাবে। এ মুহূর্তে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। যা করা খুব জরুরি তা হচ্ছে অবিলম্বে একটি 'এক্সিডিটেশন কাউন্সিল' গঠন করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান নির্ধারণ করে দেয়া, যাতে করে অভিভাবকরা 'মান' দেখে তার সন্তানকে 'ভালো' একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে পারেন। সেই সঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের 'ডাটাবেজ' তৈরি করা জরুরি, যাতে ভুয়া পিএইচডিধারীদের চিহ্নিত করা যায়। আমি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশে একটি শাখা স্থাপনেরও পক্ষপাতী। এতে আমাদের লাভ দুটো_ এক. আমাদের সন্তানরা পড়াশোনার একটা অংশ বিদেশে গিয়ে পড়তে পারবে। দুই. বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য ভালো শিক্ষক নিয়োগ দেবে এবং তাদের শিক্ষার মান বাড়ানোর উদ্যোগ নেবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকপক্ষ আবার এর বিরুদ্ধে। তারা 'ব্যবসা হারানো'র আশঙ্কা করছেন। তারা পুঁজি বিনিয়োগ করেছেন। এখন পুঁজি বাড়াতে চান। তাদের অনুরোধ করি, আপনারা গার্মেন্ট, আলু-পটোল ব্যবসায় বিনিয়োগ করুন। বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়। শিক্ষকতায় একটি 'পরিণত বয়সে' এসে মনে হয়েছে এ সেক্টরটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে শুধু আমাদের নেতৃত্বের অভাবে। আমাদের কোনো 'ভিশন' নেই। আমরা ২০২১ সালে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে চাই। কিন্তু আমরা সেই নেতৃত্ব কি প্রতিষ্ঠা করতে পারছি যারা আমাদের একুশ শতকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার 'রূপকল্প' তৈরি করবেন? আমরা লাখ লাখ গ্র্যাজুয়েট ও মাস্টার্স ডিগ্রি তৈরি করছি, যারা মেধাহীন। নেতৃত্ব দেয়ার 'কোয়ালিটি' তাদের নেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও পারছে না রাজনৈতিকভাবে নিয়োগকৃত ভিসিদের কারণে। আমরা একটা সার্টিফিকেট-সর্বস্ব জাতিতে পরিণত হতে যাচ্ছি। ঘরে ঘরে এখন মাস্টার্স আর বিবিএ। একজন এসআইও এসেছিল আমার কাছে পিএইচডি করতে। ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা বেড়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এদের সবাইকে ধারণ করতে পারে না বিধায়ই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু সার্টিফিকেট 'বিক্রি'র প্রতিষ্ঠান খুলে আর যাই হোক উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন করা যায় না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্যই থাকবে। কিন্তু সেখানে ইউজিসির নিয়ন্ত্রণ বাড়ুক। ব্যক্তিগতভাবে ইউজিসির চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি তিনি আন্তরিক। তিনি চান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সার্টিফিকেট বাণিজ্য করবে না। কিন্তু ফাঁক-ফোকর দিয়ে এসব বিশ্ববিদ্যালয় বেরিয়ে যাচ্ছে। আর হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী ওইসব অবৈধ সার্টিফিকেট নিয়ে উচ্চশিক্ষিত বেকার সমস্যাকে আরো জটিল করছে। অথচ নূ্যনতম ডিগ্রি নিয়ে (গ্র্যাজুয়েশন) তারা 'জব মার্কেটে' যেতে পারে। পরিকল্পনাহীনভাবে আমাদের সন্তানরা বিবিএ পাস করছে। বিবিএর জন্য যে মেধা ও জ্ঞান দরকার তা তাদের নেই। ফলে তারা একেকজন তথাকথিত বিবিএ ডিগ্রিধারী হয়ে 'ভদ্র কেরানিতে' পরিণত হয়েছে। এর আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই। আসলে কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই উচ্চশিক্ষা পরিচালিত হচ্ছে। জিপিএ-৫ নিয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারছে না অনেকে। উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে জিপিএ-৫ বাড়ানোর সিদ্ধান্তই ছিল ভুল। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির সংবাদটি আমাদের জন্য চিন্তার কারণ। নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি নিয়ে ভাববেন, এটাই আশা করি। Daily Jai Jai Din 16.09.14

‘কাইমেট চেঞ্জ মার্চ’ ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

আগামী ২১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য একটি বড় ধরনের মার্চ অনুষ্ঠিত হবে- যাকে উদ্যোক্তারা নামকরণ করেছেন ‘কাইমেট চেঞ্জ মার্চ’। উদ্দেশ্যটি পরিষ্কার। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু হচ্ছে। এই অধিবেশনে বিশ্বের প্রায় ১৯৬টি দেশের রাষ্ট্র তথা সরকারপ্রধানরা যোগ দেবেন। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে যে বড় ধরনের হুমকির মুখে এই মানব প্রজাতি, এ ব্যাপারে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই হচ্ছে এ রোড মার্চের উদ্দেশ্য। বলা হচ্ছে, প্রায় দু’লাখ মানুষ এই রোড মার্চে অংশ নেবে। চলতি সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি যে প্রাধান্য পাবে, তা বলাই বাহুল্য। ২০১৫ সালের নভেম্বরে প্যারিসে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ‘কপ’ সম্মেলনে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করার কথা। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি এখন বহুল আলোচিত। এ নিয়ে প্রতি বছরই পৃথিবীর কোথাও না কোথাও শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। জাতিসংঘ কর্তৃক আয়োজিত এসব সম্মেলনকে অভিহিত করা হচ্ছে ‘কপ’ বা ‘কমিটি অব দ্য পার্টিজ’ হিসেবে। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তই তারা নিতে পারছেন না শুধু শিল্পোন্নত দেশগুলোর অসহযোগিতার কারণে। জাতিসংঘের ‘ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন কাইমেট চেঞ্জ’-এর রিপোর্টে বারবার একটি ভয়াবহতার কথা উল্লেখ করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে সাগর-মহাসাগরের পানি। বন্যা, জলচ্ছ্বাস বাড়ছে। এর কারণ হচ্ছে আমরা, এই মানব প্রজাতি অতিরিক্ত জ্বালানি পোড়াচ্ছি। জাতিসংঘের ওই বিশেষজ্ঞ প্যানেল বলছে, একুশ শতকের মধ্যভাগে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে (৩ দশমিক ৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট) সীমাবদ্ধ রাখার যে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। ফলে বিশ্ব এ শতাব্দীতেই বড় ধরনের দুর্যোগের মধ্যে পড়বে। বিশ্বের তাপমাত্রা যদি ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যায়, তাহলে গ্রিনল্যান্ড ও এন্টার্কটিকার সব বরফ গলে যাবে। তখন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে ২৩ ফুট। চিন্তা করা যায় কী ভয়াবহ বিপর্যয় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে! বিশ্বের নেতৃবৃন্দ যে বিষয়টি জানেন না, তা নয়। তারা জানেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, বড় বড় শিল্পগোষ্ঠীর চাপে কোনো সরকারই বায়ুম-লে যে গ্রিন হাউস গ্যাস উদগিরণ হচ্ছে, তা কমাতে পারছে না। এসব শিল্পগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন। বিশেষ করে শিল্পোন্নত দেশগুলো যেসব প্রতিনিধি সেখানে পাঠায়, এতে তারা অংশ নেন। লবিং করেন। সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাব খাটান। এদিকে বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে একটি শঙ্কার কথা আমাদের জানিয়েছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বা এডিবি। বাংলাদেশ এই জলবায়ু পরিবর্তনে কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এডিপির রিপোর্টে সে কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এডিবি জানিয়েছে, ২০৫০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি গড়ে ১ দশমিক ৮ শতাংশ করে কম হতে পারে। চলতি শতাব্দী শেষে এই ক্ষতি হতে পারে প্রায় ৯ শতাংশ। আর বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়তে পারে ৪ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এডিবির ওই রিপোর্টে দক্ষিণ এশিয়ার অপর দুটি দেশ নেপাল ও মালদ্বীপের ক্ষতির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। গত ১৯ আগস্ট ঢাকায় এডিপির ওই রিপোর্টটি উপস্থাপন করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশের যে ক্ষতি হবে, তা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। শুধু এডিপির রিপোর্টেই নয়, বরং জাতিসংঘের রিপোর্টেও এ ক্ষতির দিকটি উল্লেখ করা হয়েছে একাধিকবার। প্রতি বছরই জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত যে শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়- যা কপ বা কমিটি অব দ্য পার্টিস নামে পরিচিত, সেখানেও বাংলাদেশের পরিবেশগত সমস্যার কথা উঠে আসে। বাংলাদেশের যারাই পরিবেশমন্ত্রী থাকেন, তারা তা করে কপ সম্মেলনে যান। কিন্তু ওই পর্যন্তই। ইতোমধ্যে নাসা আরও একটি আশঙ্কার কথা জানিয়েছে। নাসা আশঙ্কা করছে, গ্রিনল্যান্ডে যে বরফ জমা রয়েছে, তা যদি উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে গলে যায়- তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৭ মিটার বৃদ্ধি পাবে। তাই কার্বন ডাই-অক্সাইড হ্রাসের কথা বলছে নাসা। আল গোর তার একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন, বিশ্বের বৃহত্তম বন্দরগুলোয় ইতোমধ্যে ৪ কোটি মানুষ মারাত্মক প্লাবনের হুমকির মুখে আছে। আল গোর বিশ্বের ১০৭ বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে (বাংলাদেশের সাবেক বনমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদও ছিলেন ওই দ্রলে) গিয়েছিলেন এন্টার্কটিকায় শুধু জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য। কিন্তু বিশ্ব সম্প্রদায় এখনো নীরব। প্রতি বছরই কপ সম্মেলনে ভালো ভালো কথা বলা হয়। কোপেনহেগেন থেকে ডারবান সম্মেলন- বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্ব কার্বন নিঃসরণ কমাতে একটি চুক্তি করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। এ সংক্রান্ত আলোচনা শুরু হয়েছে অনেক আগে এবং ২০২০ সাল থেকে ওই চুক্তিটি কার্যকর হবে। তবে একটি গ্রিন ফান্ড গঠনের ব্যাপারে শিল্পোন্নত দেশগুলো রাজি হয়েছে। ওই ফান্ডের পরিমাণ হয়েছে ১০০ মিলিয়ন ডলার। ৪০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে এই ফান্ড যাত্রা শুরু করছে। বিশ্বব্যাংক এই ফান্ডের ব্যবস্থাপনার তদারক করছে। বাংলাদেশ ওই ফান্ড থেকে অর্থ পেয়েছে। কপের ডারবান সম্মেলনের পর (২০১১) যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে প্রতি বছর এ ধরনের সম্মেলন করে শেষ পর্যন্ত কী বিশ্বের উষ্ণতা রোধ করা সম্ভব হবে? বাংলাদেশের সাবেক পরিবেশমন্ত্রী সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। ঢাকায় ফিরে এসে তিনি কিছুটা হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন। তাই কপ সম্মেলন নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবেই। ইতোমধ্যে জাপান, কানাডা ও রাশিয়া কিয়োটা-পরবর্তী আলোচনা থেকে বেরিয়ে গেছে। সুতরাং বোঝাই যায়, এক ধরনের হতাশা এসে গেছে। আসলে বিশ্বের দেশগুলো এখন বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে গেছে। বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে একেক গ্রুপের একেক এজেন্ডা। উন্নত বিশ্ব কিংবা উন্নয়নশীল বিশ্বের যে দাবি, এর মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আবার উন্নয়নশীল বিশ্বও একাধিক গ্রুপে বিভক্ত। ধনী দেশগুলো এনেক্স ১-এ অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বের জিডিপির শতকরা ৭৫ ভাগ এই দেশগুলোর। অথচ লোকসংখ্যা মাত্র বিশ্বের ১৯ শতাংশ। কিন্তু কার্বন নিঃসরণ করে সবচেয়ে বেশি- শতকরা ৫১ ভাগ। অন্যদিকে গ্রুপ ৭৭-এর দেশগুলো (মোট ১৩০টি দেশ) বিশ্বের জনসংখ্যার ৭৬ শতাংশ, জিডিপির মাত্র ১৯ শতাংশ। কিন্তু কার্বন উদগিরণ করে ৪২ শতাংশ। আবার সাগরপাড়ের দেশগুলো- যারা বিশ্বের জনসংখ্যা, জিডিপি ও কার্বন নিঃসরণ করে মাত্র ১ শতাংশ, তাদের দাবি ২০২০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বর্তমান অবস্থার চেয়ে শতকরা ৮৫ ভাগ কমিয়ে আনার। বনাঞ্চলভুক্ত দেশগুলো- যারা ‘রেইন ফরেস্ট কোয়ালিশন’ হিসেবে পরিচিত, তারা বিশ্ব জনগোষ্ঠীর ১৯ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে। জিডিপির মাত্র ৩ শতাংশ তাদের এবং মাত্র ৪ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ করে। যুক্তরাষ্ট্র একা কার্বন নিঃসরণ করে ২০ শতাংশ। জিডিপির ৩০ শতাংশ তাদের। অথচ জনসংখ্যা মাত্র বিশ্বের ৫ শতাংশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বিশ্ব জিডিপির ২৫ শতাংশ ও জনসংখ্যার ৮ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু কার্বন নিঃসরণ করে ১৫ শতাংশ। চীনকে নিয়ে সমস্যা এখন অনেক। চীন একা কার্বন নিঃসরণ করে ২১ শতাংশ। বিশ্ব জনসংখ্যার ২০ শতাংশই চীনা নাগরিক। জিডিপির ৬ শতাংশ তাদের। প্রতিটি গ্রুপের অবস্থান ভিন্ন। সবাই নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে কার্বন নিঃসরণের হার কমাতে চায়। জাতিসংঘ এটিকে বলছে কার্বন ঘনত্ব। অর্থাৎ দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা মোট আয়ের (জিডিপি) অনুপাতে কার্বন ডাই-অক্সাইড উদগিরণের হারকে কার্বন ঘনত্ব বা গ্রিন হাউস গ্যাসের ঘনত্ব বলা হয়। উন্নয়নশীল বিশ্ব মনে করে, এই হার মাথাপিছু জনসংখ্যা ধরে করা উচিত। কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের হার কমানো উচিত। এটি মোটামুটিভাবে সবাই মেনে নিয়েছেন। কিন্তু কে কতটুকু কমাবে, এ প্রশ্নের কোনো সমাধান হয়নি। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ও চীন (ভারতও) বিশ্বে সবচেয়ে বেশি দূষণ ছড়ায়। এ কারণে এই দুটো দেশের কাছ থেকে ‘কমিটমেন্ট’ আশা করেছিল বিশ্ব। কিন্তু তা হয়নি। চীন প্রস্তাব করেছিল, ২০০৫ সালের কার্বন ঘনত্বের চেয়ে দেশটি ২০২০ সালে শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ কমাবে। আর যুক্তরাষ্ট্রের দাবি ছিল, তারা ১৭ শতাংশ কমাবে। কিন্তু চীন ও ভারত যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এখানে বলা ভালো, চীনের কার্বন ঘনত্ব ২ দশমিক ৮৫ টন এবং ভারতের ১ দশমিক ৮ টন। চীন ও ভারত দুটি দেশই বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে এই শতাব্দীতে। বিশ্বব্যাংকের উপদেষ্টা হরিন্দর কোহলির মতে, আগামী ৩০ বছরে ভারত বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। মাথাপিছু আয় তখন ৯৪০ থেকে বেড়ে ২২ হাজার ডলারে উন্নীত হবে। ২০০৭ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত অবদান রাখত মাত্র ২ শতংশ, ৩০ বছর পর রাখবে ১৭ শতংশ। তবে এটি ধরে রাখতে হলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হতে হবে ৮ থেকে ৯ শতংশ। এ কারণেই ভারতকে নিয়ে ভয়- তাদের কার্বন ঘনত্ব বাড়বে। কেননা প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু রাখতে হবে। এতে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বাড়বে। পাঠকদের এখানে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ১৯৯৭ সালে কিয়োটো সম্মেলনে ১৬০টি দেশ অংশ নিয়েছিল এবং সেখানে যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, এতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১৯৯০ সালের কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের মাত্রার চেয়ে ৮ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্র ৭ শতাংশ, জাপান ৬ শতাংশ হ্রাস করার কথা। তাছাড়া সার্বিকভাবে ৫ দশমিক ২ শতাংশ গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের আইনগত বাধ্যবাধকতা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সিদ্ধান্ত হয়েছিল সব দেশকে ২০০৮-১২ সালের মধ্যে গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। তৎকালীন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর কিয়োটো চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও পরে বুশ প্রশাসন ওই চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে কিয়োটো চুক্তি কাগজ-কলমে থেকে গিয়েছিল। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে যে কয়টি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের উপকূলে প্রতি বছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গত ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। সমুদ্রের পানি বেড়ে যাওয়ায় উপকূলের মানুষ অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি ৭ জনে ১ জন আগামীতে উদ্বাস্তু হবে। ১৭ শতাংশ এলাকা সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে। বাংলাদেশ কোপেনহেগেন সম্মেলনে পরিবেশগত উদ্বাস্তুদের টহরাবৎংধষ ঘধঃঁৎধষ চবৎংড়হ হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু তা গ্রহণ করা হয়নি। সর্বশেষ দোহা সম্মেলনেও বড় কোনো অগ্রগতি হয়নি। ফাস্ট স্টার্ট ফান্ডে মাত্র পাওয়া গেছে আড়াই মিলিয়ন ডলার (২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন ডলার)। বাংলাদেশ সেখানে থেকে পেয়েছে ১৩০ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু বাংলাদেশে আইলার কারণে যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল, তা দূর হয়নি। সার্ক সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছিল ঐক্যবদ্ধভাবে দক্ষিণ এশিয়ার সমস্যাগুলো আমরা তুলে ধরব। কিন্তু ডারবানে তা হয়নি। বাংলাদেশ ও ভারত একই ফোরামে ছিল না। একটি আইনি বাধ্যবাধকতার কথাও বলা হয়েছিল। কিন্তু তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। প্রযুক্তি হস্তান্তর সম্পর্কেও কোনো সমঝোতা হয়নি। কপ সম্মেলনে আসলেই বড় বড় কথা বলা হয়। কয়েক টন কার্বন নিঃসরণ করে সম্মেলন ‘অনেক আশার কথা শুনিয়ে’ শেষ হয় বটে, কিন্তু সেক্ষেত্রে অগ্রগতি হয় খুব কমই। আগে সমস্যা ছিল উন্নত বিশ্ব নিয়ে। এখন চীন ও ভারত একটি সমস্যা। তাদের যুক্তি, নিঃসরণের পরিমান হ্রাস করলে তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে। এতে বাড়বে দরিদ্রতা। এই যুক্তি ফেলে দেওয়ার নয়। ফলে কপ সম্মেলন নিয়ে প্রশ্ন থেকে গেলই। আগামী ডিসেম্বর (১-১২ ডিসেম্বর) পেরুর রাজধানী লিমায় কপ-২১ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। কপ-১৮ (ডারবান) সম্মেলনের পর দোহায় কপ-১৯ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ২০১৫ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত হবে কপ-২২ সম্মেলন। কিন্তু এতে আমাদের প্রাপ্তি কী? শুধু ‘অংশগ্রহণ’ ছাড়া আমাদের কোনো প্রাপ্তি নেই। আল গোর নিজে তার প্রবন্ধে বাংলাদেশের কথা উল্লেখ করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বাড়লে ২০৫০ সাল নাগাদ ২ থেকে আড়াই কোটি বাংলাদেশিকে অন্যত্র স্থানান্তরিত করতে হবে। এর অর্থ প্রচুর মানুষ হারাবে তাদের বসতি, তাদের পেশা। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়া মানে কেবল বন্যা নয়, এর মানে নোনাপানির আগ্রাসন। সেই সঙ্গে ধানের আবাদ ধ্বংস হয়ে যাওয়া। ২ কোটি কৃষক, জেলে পেশা হারিয়ে শহরে, বিশেষ করে ঢাকা শহরে এসে নতুন নতুন বস্তি গড়ে তুলবেন। রিকশা চালানোর জীবন বেছে নেবেন। সৃষ্টি হবে একটি শ্রেণির- যারা শহরে মানুষের ভাষায় ‘জলবায়ু উদবাস্তু’। এই ‘জলবায়ু উদবাস্তু’দের নিয়ে রাজনীতি হবে! বিদেশে অর্থ সাহায্য চাওয়া হবে। ইতোমধ্যে অর্থ সাহায্য পাওয়া গেছে। কিন্তু ওই অর্থ সাহায্য বিতরণ নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। স্বয়ং বর্তমান পরিবেশমন্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন স্বচ্ছতা নিয়ে। তিনি বলেছেন, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ যাচ্ছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু এ অর্থ ঠিকমতো খরচ হচ্ছে কি না, তা মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা পরিবেশন মন্ত্রণালয়ের নেই (২০ আগস্ট)। দুর্নীতি এখানে ভর করেছে। যারা সত্যিকার অর্থেই জলবায়ু উদবাস্তু, তারা এই সাহায্য পাচ্ছেন না। তাই এডিবির রিপোর্টে প্রকৃত সত্য প্রকাশিত হলেও এ নিয়ে আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণ নেই। জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমলে দরিদ্রতা বাড়বে। বাড়বে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। একটি ‘ভালো সরকারের’ জন্য তা কোনো ভালো খবর নয়। Daily Amder Somoy 14.09.14

শিক্ষকতায় একাল সেকাল

৯ সেপ্টেম্বর প্রতিটি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ছবি- তিনি অস্ত্র হাতে নিশানা প্র্যাকটিস করছেন। তাকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ছাত্রলীগের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক। 'ছাত্রলীগ নেতা যখন অস্ত্র প্রশিক্ষক' শীর্ষক সংবাদটি আমার ধারণা সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে আহত করে থাকবে। ওই শিক্ষক, যিনি একসময় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন এবং এখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক। ওই ঘটনায় আরও একজন শিক্ষকের পরিচয় পাওয়া গেছে। যিনি এখন বিসিএস ইকোনমিক ক্যাডার। একজন শিক্ষকের হাতে থাকার কথা বই। তার হাতে যখন পিস্তল থাকে, যখন ছাত্র অবস্থায় পিস্তলের প্রশিক্ষণ নেয়, তখন তার সামাজিক অবস্থান বুঝতে আমাদের কষ্ট হয় না। সংবাদটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রলীগ ওই নেতাকে বহিষ্কার করেছে। কিন্তু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়নি। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত যা হয় তা হচ্ছে, শিক্ষককে 'বাধ্যতামূলক ছুটিতে' পাঠিয়ে কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। হয়তো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এ কাজটিই করবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক সমিতির একটি বক্তব্য থাকা উচিত ছিল। গতকাল পর্যন্ত কোনো বিবৃতি আমার চোখে পড়েনি। তবে অভিযুক্ত ওই শিক্ষক দাবি করেছেন, প্রকাশিত সংবাদটি বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তার দাবি, সাবেক ইবি সহকর্মীদের সঙ্গে ব্যক্তিগত ভ্রমণ অনুষ্ঠানের একটি ছবি জিম্মি করে কাট-কপি-পেস্টের মাধ্যমে বিভিন্নভাবে সাজিয়ে একটি ভুল ও বানোয়াট, ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। শিক্ষক হিসেবে আমি এ ঘটনায় মর্মাহত, লজ্জিত ও দুঃখিত। অভিযোগটি মিথ্যা প্রমাণিত হোক, এটা আমি দেখতে চাই। আমি এ সংবাদটির জন্য অপেক্ষায় থাকলাম; কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? ৫ থেকে ৭ বছরে কারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন? কী তাদের পরিচয়? কোন পরিচয়টি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের কাছে মুখ্য হয়ে উঠেছিল? এসব আমরা সবাই জানি। তবে কষ্ট লাগে এই ভেবে যে, একজন শিক্ষক যখন দোষী সাব্যস্ত হন, ওই দোষের ভাগিদার আমরা সবাই। অভিযুক্ত ওই শিক্ষক যখন ছাত্র ছিলেন, তখন তিনি কারও না কারও ছাত্র ছিলেন। কীভাবে বদলে যাচ্ছে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক! আমি এ সম্পর্কে গুরুত্ব দিতে চাই। আমার অনেক ছাত্র আজ শিক্ষক, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা পড়ান। শিক্ষক-ছাত্রের সেই আন্তরিকতা আমি আজকাল আর খুঁজে পাই না। প্রসঙ্গক্রমেই আমার দুই শিক্ষকের কথা এখানে মনে পড়ে গেল। অধ্যাপক রওনক জাহান ও অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। দুজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। অধ্যাপক রওনক জাহান রাশভারী মানুষ। বিশাল পা-িত্যের অধিকারী। আমি তার প্রিয় ছাত্র ছিলাম কখনোই বলব না। কিন্তু ছাত্রকে কীভাবে সন্তানের মতো ভালোবাসতে হয়, তা তিনি প্রমাণ করেছিলেন। তখন তিনি ঢাকাতেই থাকেন। কালেভদ্রেও দেখা হয় না। জানি, তিনি গবেষণা করছেন সিপিডিতে। দীর্ঘদিন যোগাযোগ ছিল না, এমনকি এখনও নেই। আশির দশকের মাঝামাঝি আমার পিএইচডি প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে আমি যখন জেনেভায় গিয়েছিলাম অধ্যাপক রওনক জাহান তখন আইএলওতে। আমি যোগাযোগ করলাম। তিনি আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন। আইএলওর ক্যান্টিনে নিজে লাইনে দাঁড়িয়ে আমার জন্য খাবার কিনলেন। আমরা খেলাম। দ্বিতীয় ঘটনার কথা বলি। রওনক ম্যাডাম তখন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি তখন নিউইয়র্কে। ফোন করলাম। সেই একই কণ্ঠ, আসতে বললেন। কলম্বিয়ার স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল ও পাবলিক অ্যাফেয়ার্স বিল্ডিংয়ের খুব সম্ভবত ১১ তলায় তার সঙ্গে যখন দেখা করতে গিয়েছিলাম, তখন নিজ হাতে কফি বানিয়ে তিনি আমাকে দিয়েছিলেন। একজন শিক্ষকের তার একজন ছাত্রের প্রতি কতটুকু ভালোবাসা থাকে, কতটুকু আন্তরিক তিনি, অধ্যাপক রওনক জাহান তার বড় উদাহরণ। দ্বিতীয় আরেকটি দৃষ্টান্ত দিই। তিনি আমার শিক্ষক অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। এখন ইসলামাবাদ ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন। আমি ইসলামাবাদ গেছি। স্যারের ফোন জোগাড় করে একটি ক্যাব নিয়ে রাতে তার বাসায় গেলাম। মনে আছে, রাত প্রায় ১১টার দিকে তিনি অনেকদূর হেঁটে এসে মেইন রাস্তায় আমাকে একটি ট্যাঙ্কি্যাবে তুলে দিয়েছিলেন। একজন শিক্ষক তার ছাত্রকে কতটুকু ভালোবাসতে পারেন, নজরুল ইসলাম স্যার ছিলেন তার একটি প্রমাণ। তৃতীয় আরেকটি দৃষ্টান্ত নেই। অধ্যাপক আসাদুজ্জামান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমানে প্রয়াত। ২০০৬ সালে আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্যপদে নিয়োগ পেলাম, যেদিন আগারগাঁও অফিসে যোগ দিতে গেলাম, সেদিন আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। তার চোখে সেদিন আমি অশ্রু দেখেছিলাম। ধানমন্ডির ৩নং রোডে তার সরকারি কোয়ার্টারের পাশেই ছিল আমার সরকারি অ্যাপার্টমেন্ট। কতদিন যে ফোন করে তার বাসায় ডেকে নরসিংদীর মিষ্টি খাইয়েছেন, আমি বলতে পারব না। আমাকে অনেক স্নেহ করতেন। আমার অবর্তমানে অন্যদের কাছে প্রশংসাও করতেন। একজন শিক্ষক কত আন্তরিক হলে ছাত্রের প্রশংসা করে, অধ্যাপক আসাদুজ্জামান এর বড় প্রমাণ। শুধু বাংলাদেশের কথা বলি কেন? জার্মানিতে আমার পিএইচডির তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন অধ্যাপক ডিটসার রথারমুন্ড। বিখ্যাত হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের অধ্যাপক ও দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ। বাংলাদেশে আমরা অনেকে অধ্যাপক রথারমুন্ডের ছাত্র ছিলাম। আমাদের এক সহকর্মী যখন তার ছোট্ট বাচ্চাকে রেখে সমস্যায় পড়েছিলেন, তখন পিতার মতো তার ছাত্রের প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তার গবেষণার কাজটি দ্রুত দেখে দিয়েছিলেন। আমি নিজে কীভাবে তার কাছে উপকৃত হয়েছি, তা আজ নাই বা বললাম। আমার প্রথম তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন এর্গবাট ইয়ান (জার্মানিতে দুজন তত্ত্বাবধায়কের প্রয়োজন হয়)। আমরা প্রায় প্রতি রোববার তার বাসায় ঘরোয়া আলোচনায় মিলিত হতাম। তার উদ্যোগেই তিনি আমাকে মস্কো ও পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশে পাঠিয়েছিলেন। সেটা প্রয়োজন ছিল আমার গবেষণার জন্যই। মিসেস ইয়ান, যিনি ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা, আমাদের জন্য রান্না করতেন প্রতি রোববার। এ দৃষ্টান্তগুলো দিলাম এটা বোঝানোর জন্য যে, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক কেমন হয়, কেমন হওয়া উচিত। কিন্তু আজ যারা শিক্ষকতায় আসছেন, তাদের মধ্যে এ উপলব্ধিবোধটুকু কি আছে? আজ আমার ছাত্র, যারা শিক্ষক হয়েছেন, তাদের মধ্যে সে সৌজন্যবোধটুকুও নেই। এতটা বছর শিক্ষকতা করলাম, দুই যুগেরও বেশি- আমার প্রাপ্য 'শূন্য'। আমার ছাত্রদের কাছ থেকে আমরা কী শিখছি? পরিসংখ্যানের যে শিক্ষক, হাতে অস্ত্র, সংবাদপত্রে যে এখন অন্যতম আলোচিত ব্যক্তি, শিক্ষকদের তিনি কী 'উপহার' দিলেন? ইবির আমার সহকর্মীরা বিষয়টি কীভাবে নিয়েছেন জানি না। কিন্তু শিক্ষকতার ওপর আস্থা আমার আর নেই। আমি বা আমার সহকর্মীরা কী অস্ত্রবাজদের তৈরি করছি? একজন ভালো শিক্ষক আমরা তৈরি করতে পারলাম না। অধ্যাপক আসাদুজ্জামানের সঙ্গে আমি মঞ্জুরি কমিশনে কাজ করেছি। তার মতো শিক্ষক আমি নই। কিন্তু আমি আমার ছাত্রদের নিয়েও এরকমটি আশা করেছিলাম। কী জানি, হয়তো ওদের সৌজন্যবোধটুকু যে কী, তা বোঝাতে পারিনি। শেখাতে পারিনি। আমি ক্লাসে বলি, আমার ছাত্ররাই আমার সন্তান, আমার প্রাণ। ওরা আমার চেয়েও আরও বড় প-িত হোক; কিন্তু এ কোন জগতে বাস করছি? যেখানে অস্ত্রবাজরা এখন শিক্ষকতায় আসছেন! তারা কী শিক্ষা দেবেন তাদের ছাত্রদের? কারা আগামী দিনের শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণ করবে? শিক্ষাঙ্গনে যিনি বা যারা ক্যাডার হিসেবে পরিচিত কিংবা যারা রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান, আমরা তাদের কাছ থেকে কি-ই বা আশা করতে পারি! মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি শিক্ষকদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫-এ নির্ধারণ করেছেন। এ ৬৫ হতে আমার এখনও অনেক সময় বাকি। কিন্তু তার আগেই আমি অবসরে যাব। শিক্ষকতার প্রতি আমার আর মোহ নেই। ভালোবাসাও নেই। যে ৩৫টি বই লিখেছি, আমার মনে হয় ওখানে আমার ভুল হয়েছে। আমার বই লেখার কোনো প্রয়োজন ছিল না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্যাবাটিকাল ছুটি নিয়ে যে গবেষণা করেছি, তা বই আকারে প্রকাশও করেছি (অন্যরা করেছেন কিনা, তা আমার জানা নেই)। আমার অনেক সিনিয়র সহকর্মীর সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের সবার মাঝেই দেখেছি এক ধরনের হতাশা। কেন ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে? কেন? এ কেনর জবাব কে দেবে? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে অতীতে, যেখানে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক জড়িত। নৃ-বিজ্ঞান বিভাগে একজন সিনিয়র শিক্ষক কর্তৃক একজন জুনিয়র শিক্ষক (যে তার ছাত্র) প্রহৃত হয়েছিলেন। সেটা এখন অতীত। কিন্তু একজন সিনিয়র শিক্ষক কোন পর্যায়ে গেলে তার অসহিষ্ণুতা প্রকাশ পায় তা ভেবে দেখা দরকার। তবুও তিনি যে 'কা-টি' ঘটিয়েছিলেন তা সমর্থনযোগ্য নয়। তারপরও বলি, নতুন প্রজন্মের অনেক কিছু শেখার আছে সিনিয়রদের কাছ থেকে। তারা পিতৃতুল্য। পিতাকে অসম্মান করলে নিজেও অসম্মানিত হতে হয়। দ্বিতীয় ঘটনায় একজন তরুণ শিক্ষক 'অভিযুক্ত' হয়েছিলেন ছাত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখার অভিযোগে। সেসব এখন অতীত। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এখন তুলনামূলকভাবে অনেক 'ভালো'। নিয়মিত ক্লাস হচ্ছে। ছাত্ররাজনীতির প্রভাব তেমন একটা পড়েনি। এজন্য নিশ্চয়ই উপাচার্য ধন্যবাদ পেতেই পারেন। তিনি প্রমাণ করেছেন, 'রাজনীতির' ঊধর্ে্ব থেকে প্রশাসন পরিচালনা করা যায়। বিরোধী দলের রাজনীতির সমর্থক শিক্ষকরাও তাকে সহযোগিতা করছেন। এমনটাই হওয়া উচিত। ক্যাম্পাসে জাতীয় রাজনীতির কোনো প্রভাব না থাকাটাই মঙ্গলের। জাহাঙ্গীরনগর সেটা প্রমাণ করেছে। দুই-একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে বটে; কিন্তু তা বড় ধরনের কোনো 'প্রশ্নের' জন্ম দেয়নি। কিংবা ইবির ওই ছাত্র, যিনি এখন শিক্ষক, এমন কোনো শিক্ষকও আমরা পাইনি এ ক্যাম্পাসে। ওই ঘটনায় ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তথা ছাত্রদেরও সম্মানহানি হয়েছে। আমরা অবশ্যই একটি ঘটনা দিয়ে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারকে দোষী করব না। ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেক অবদান আছে। তাদের অবদানকে খাটো করা যাবে না। বেশ কিছু দিন আগে ঢাকার বাইরে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছিল। ওই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মৌন মিছিলকে উদ্দেশ করে কটূক্তি করেছিল ছাত্রলীগের চার কর্মী। তাদের পুলিশে দেয়া হলে ছাত্রলীগের কর্মীরা শিক্ষকদের ওপর হামলা চালিয়েছিল। তখন শিক্ষক সমিতির ডাকে শিক্ষকরা ক্লাস বর্জন করে। ওই ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও তদন্ত কমিটি থেকে রিপোর্ট দেয়নি। ছাত্ররা শিক্ষকদের ওপর হামলা চালাবে, এটা চিন্তাও করা যায় না। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা তাহলে কাদের পড়াচ্ছেন? ছাত্র মানেই তো সন্তান। এ 'সন্তান' এখন 'পিতার' গায়ে হাত তুলল? আর এ সন্তান এখন অস্ত্র হাতে বীরদর্পে দাঁড়িয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে! সবকিছু মিলিয়েই শিক্ষাঙ্গনে এখন অস্থিরতা বিরাজ করছে। জুনিয়র শিক্ষকরা সম্মান রাখতে পারছেন না। সিনিয়ররা এক ধরনের হতাশা ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এর কারণ একটাই, রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, যাদের কাছে 'রাজনৈতিক আনুগত্যটাই' বেশি, শিক্ষক সুলভ আচরণ তাদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। যে কারণে শিক্ষক তার যে 'সম্মান' বা শিক্ষক সংস্কৃতি, এ সংস্কৃতি তারা ধারণ করছেন না। একজন জুনিয়র শিক্ষক সরাসরি অস্ত্রবাজদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন কিংবা ভিসি তাদের 'নানা কাজে' ব্যবহার করবেন এটা কাম্য নয়। তাদের কাছে একাডেমির বিষয়গুলো 'মুখ্য' নয়, মুখ্য 'রাজনৈতিক আনুগত্য'। আমি জানি না, একুশ শতকে কোন ধরনের শিক্ষাঙ্গন আমরা পাব। তবে উচ্চশিক্ষা এক ধরনের ঝুঁকির মাঝেই আছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় যতদিন শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ না হবে, ততদিন জুনিয়র শিক্ষকরা 'রাজনৈতিক কর্মীর' মতোই আচরণ করবেন, তারা অসম্মানিত করবেন পুরো শিক্ষক সমাজকে। আজকে যারা বিশ্ববিদ্যালয় চালান, তারা যদি বিষয়টিকে গুরুত্ব না দেন, তাহলে ওই শিক্ষকের মতো একের পর এক ঘটনা প্রকাশিত হতে থাকবে। ওই ঘটনার এখানেই শেষ হওয়া উচিত। একটি তদন্ত কমিটি দ্রুত গঠন করা হোক। ওই শিক্ষকের অভিযোগটিও তদন্ত করে দেখা হোক। তার অভিযোগের পেছনে সত্যতাও থাকতে পারে! অপর পক্ষ তাকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য এ কাজটি করতে পারে! ওই ঘটনায় পুরো শিক্ষক সমাজকে অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো ঠিক হবে না। এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তবে নিঃসন্দেহে তা সম্মানহানিকর। আমি নিজে বিব্রত ও লজ্জিত। জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া আমার কি-ই বা করার আছে? Daily ALOKITO BANGLADESH 11.09.14