রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

অথঃ জরিপ সমাচার

আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে জরিপ চালায়। এসব জরিপে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির একটি চিত্র ফুটে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইন্সটিটিউটের (আইআরআই) একটি জরিপ সম্প্রতি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ওই জরিপে বেশকিছু তথ্য উঠে এসেছে, যা বেশ কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। জরিপে উঠে এসেছে যে, এ দেশের ৬৮ ভাগ মানুষ এখনও তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। বলা ভালো, সংবিধানে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল, তা বাতিল করা হয়েছে এবং ক্ষমতাসীন সরকারকে একটি ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ হিসেবে বিবেচনায় নিয়েই এ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ নির্বাচন (৫ জানুয়ারি ২০১৪) যে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি, তা ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। একটি বড় দলের অংশগ্রহণহীন এবং ১৫৩ জন সংসদ সদস্যের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা শুধু ‘নির্বাচন ব্যবস্থাকে’ প্রশ্নবিদ্ধ করেনি, বরং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য রেখে গেছে একটি অশনিসংকেত। সুতরাং আইআরআই যখন প্রকাশ করে যে, এ দেশের জনগোষ্ঠীর ৬৮ ভাগ চায় পুনরায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হোক, তখন নানা প্রশ্ন ওঠে বৈকি! তবে এটা বলতেই হয়, কোনো জরিপই চূড়ান্ত নয় এবং কোনো সরকারই তা মানতে বাধ্য নয়।

তবে এ জরিপটিতে সরকারের প্রশংসামূলক অনেক কিছু আছে। যেমন- জরিপ অনুযায়ী ৬৪ শতাংশ মানুষ মনে করে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারণে বাংলাদেশ সঠিক পথেই এগোচ্ছে। তবে ৩২ ভাগ মানুষ মনে করে, দেশ ভুল পথে যাচ্ছে। ৭৯ শতাংশ মানুষ নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে সন্তুষ্ট। জরিপের একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে- ৫১ শতাংশ মানুষ মনে করে, উন্নয়নের চেয়ে গণতন্ত্র বেশি জরুরি। আবার ৫১ শতাংশ মানুষই মনে করে, বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরই জাতীয় নির্বাচন হওয়া উচিত। দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের পক্ষে মাত্র ৩৬ শতাংশ মানুষ। মজার ব্যাপার, ৫৯ শতাংশ মানুষ অভিমত দিয়েছে যে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। ৪৮ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগের ওপর আস্থা রাখতে চায়, আর বিএনপির ওপর আস্থা রাখতে চায় মাত্র ২৪ শতাংশ মানুষ।

এখানে বলা ভালো, আইআরআই এই প্রথম যে এ ধরনের একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে, তা নয়। সচেতন পাঠক একটু স্মরণ করতে পারেন, গত বছরের ২ সেপ্টেম্বরও আইআরআই এ ধরনের একটি জরিপ প্রকাশ করেছিল। প্রায় একই সময় ব্রিটেনের ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট অপর একটি জরিপ প্রকাশ করেছিল। জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত ১৫ সেপ্টেম্বর ‘গণতন্ত্র দিবস’ উপলক্ষে ওই সময় ওই জরিপ দুটি প্রকাশ করা হয়েছিল। উভয় জরিপেই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বিকাশ, সমস্যা, সম্ভাবনার একটি চিত্র ফুটে উঠেছিল। যে কেউ এ ধরনের জরিপ থেকে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি ধারণা পেতে পারেন। বিশেষ করে বাংলাদেশের বিকাশমান গণতন্ত্র, এর চরিত্র এবং সম্ভাবনা নিয়ে বহির্বিশ্বে একটি ধারণার জন্ম হতে পারে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, আন্তর্জাতিক গবেষণামূলক সংস্থা Global Strategic Partners-এর পক্ষ হয়ে আইআরআই বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় এ সার্ভে পরিচালনা করে। সার্ভেতে সেসময় যেসব ফলাফল পাওয়া গিয়েছিল তাতে দেখা যায় : ১. ৬৬ ভাগ মানুষ মনে করে সরকার জনপ্রিয় এবং প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তা রয়েছে ৬৭ ভাগ মানুষের কাছে; ২. ৬২ ভাগ মানুষ মনে করে দেশ ঠিকমতো চলছে; ৩. ৭২ ভাগ মানুষ মনে করে অর্থনীতি ইতিবাচক; ৪. দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রয়েছে, এটা মনে করে ৬৪ ভাগ মানুষ; ৫. ৪৩ ভাগ মানুষ মনে করে সংসদ নির্বাচন দরকার, ৬. ৬৭ ভাগ মানুষ মনে করে একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনা করা ভালো। সার্ভেতে দেখা যায়, ৬০ ভাগ মানুষ আওয়ামী লীগকে পছন্দ করে (অপছন্দ করে ২৯ ভাগ)। অন্যদিকে ৪২ ভাগ মানুষ বিএনপিকে পছন্দ করে (অপছন্দ করে ৪৬ ভাগ)। ৫৯ ভাগ মানুষ মনে করে, গণতন্ত্র দেশটির জন্য ভালো। নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ- এটা মনে করে মাত্র ৩৩ ভাগ মানুষ। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে এটা মনে করে ৬১ ভাগ মানুষ, আর ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে- এটা মনে করে ৬৩ ভাগ মানুষ। পাঠক লক্ষ্য করুন, সেপ্টেম্বর মাসে যেখানে ৬৭ ভাগ মানুষ চেয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, এখন তা বেড়েছে ৬৮ ভাগে। ৬০ ভাগ মানুষ আওয়ামী লীগকে পছন্দ করত, আর বর্তমান জরিপে দেখা গেল এ সংখ্যা ৪৮ শতাংশ। ৪২ ভাগ মানুষের পছন্দ ছিল বিএনপি, এ সংখ্যা এখন মাত্র ২৪ শতাংশ।

ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট বিশ্বের ১৬৭টি দেশের গণতন্ত্রের ধরন, বিকাশ নিয়ে রাষ্ট্রগুলোর র‌্যাংকিং করেছিল। তাতে দেখা যায়, যেখানে স্কোর ১০-এর মধ্যে নরওয়ে ৯ দশমিক ৯৩ স্কোর নিয়ে শীর্ষে ছিল, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৫তম (স্কোর ৫ দশমিক ৭৮)। তবে ২০০৬ সালের তুলনায় বাংলাদেশ তার অবস্থান উন্নতি করেছিল। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৬ দশমিক ১১। মোট ৫টি ক্ষেত্রকে সামনে রেখে এই র‌্যাংকিং করা হয়েছিল। যেমন- নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও বহুমুখিতা (বাংলাদেশের স্কোর ৭ দশমিক ৪২), সরকারের পরিচালনা (বাংলাদেশের স্কোর ৫ দশমিক ০৭), রাজনৈতিক অংশগ্রহণ (বাংলাদেশের স্কোর ৫), রাজনৈতিক সংস্কৃতি (বাংলাদেশের স্কোর ৪ দশমিক ৩৮) ও ব্যক্তি স্বাধীনতা (বাংলাদেশের স্কোর ৭ দশমিক ০৬)। ইকোনমিস্টের সার্ভেতে সরাসরি অর্থনৈতিক বিষয়টি স্থান না পেলেও আইআরআইর সার্ভেতে বিষয়টি উঠে এসেছে। গণতন্ত্রের বিকাশের সঙ্গে যে অর্থনীতির বিষয়টি জড়িত তা দেখা গেছে। গবেষকরা এখন এ বিষয়টিকে সামনে রেখে গণতন্ত্রের স্বার্থে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কতটুকু প্রয়োজন, সে ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারেন। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বহুল আলোচিত একটি বিষয়- আগে উন্নয়ন নাকি আগে গণতন্ত্র? উল্লিখিত দুটি সার্ভেতে এ বিষয়টি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এসেছে।

স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের ঢেউ বয়ে যায়। বিশেষ করে রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে কী ধরনের সমাজ-সংস্কৃতি বিকশিত হয়, এ ব্যাপারে আগ্রহ ছিল অনেকের। দীর্ঘ ৭৩ বছর ধরে রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো একদলীয় সমাজতান্ত্রিক সরকারের অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছিল। কিন্তু ১৯৮৯ সালে সাবেক চেক প্রেসিডেন্ট ভাসলাভ হাভেলের নেতৃত্বে যে ‘ভেলভেট রেভ্যুলেশনের’ জন্ম হয়েছিল, তা বদলে দিল পূর্ব ইউরোপকে, সেই সঙ্গে রাশিয়াকেও। অবসান ঘটেছিল স্নায়ুযুদ্ধের। আমেরিকার তাত্ত্বিকদের কেউ কেউ তখন বলার চেষ্টা করেছিলেন, ‘সমাজতন্ত্র একটি ভ্রান্ত ধারণা হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে’ এবং লিবারেলিজমেরই জয় হল (ফ্রান্সিস ফুকিয়ামা)। তখন থেকেই পূর্ব ইউরোপ তথা রাশিয়ার বিকাশমান গণতন্ত্র নিয়ে যেমন প্রশ্ন ছিল, ঠিক তেমনি প্রশ্ন ছিল উন্নয়নশীল বিশ্বের গণতন্ত্র নিয়েও। এখানে অধ্যাপক হানটিংটনের বিখ্যাত প্রবন্ধ (যা পরে বই আকারে প্রকাশিত হয়) The Clash of Civilizations- The Next Pattern or Conflict-এর কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন, যেখানে তিনি বলার চেষ্টা করেছেন কোন ‘সভ্যতা’ ভবিষ্যতে ঠিকে থাকবে এবং উন্নয়নশীল বিশ্ব কোন বিষয়টাকে বেশি গুরুত্ব দেবে। অধ্যাপক হানটিংটন লিখেছিলেন, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় নৈকট্যের কারণে বিভিন্ন জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রগুলো ৮টি ‘সভ্যতার’ ছত্রচ্ছায়ায় একত্র হবে এবং এদের মধ্যকার দ্বন্দ্বই বিশ্ব রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। তিনি অর্থনৈতিক শক্তিজোট ও আঞ্চলিক শক্তিকে একেবারে অস্বীকার করেননি। তিনি মন্তব্য করেছিলেন এভাবে : 'economic regionalism may succeed only when it is rooted in a common civilization', অর্থাৎ অর্থনৈতিক জোটগুলো সাফল্য লাভ করবে যদি সাংস্কৃতিক (তথা ধর্মীয়) বন্ধনটা অটুট থাকে। এখানেই রয়েছে মোদ্দা কথাটি। অর্থনৈতিক সাফল্যটাই আসল, রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রধান নয়। যদি আরও খোলাসা করে বলা যায় তাহলে বলা যেতে পারে, গণতন্ত্র হতে পারে, তবে কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়নই মঙ্গল। গণতন্ত্রকে কাটছাঁট করে যদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ এই সংস্কৃতিকে গ্রহণ করবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিটাই আসল। উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া এর বড় প্রমাণ। মালয়েশিয়ার কথাও আমরা উল্লেখ করতে পারি। এসব দেশে সীমিত গণতন্ত্র আছে। এসব সমাজে বিকাশমান প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের সঙ্গে পশ্চিমা সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না, এটা সত্য। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও সত্য, সিঙ্গাপুর বা দক্ষিণ কোরিয়ার গণতন্ত্র নিয়ে সেখানকার মানুষ খুশি।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রের বিকাশ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নটি এসে যায়। বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ছাড়া তা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সূচকগুলো একেবারে খারাপ নয়। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ ভাগ ধরে রাখা, রিজার্ভ প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত, দরিদ্রতা কমিয়ে আনা (২৪ ভাগ), তৈরি পোশাকে বিপুলসংখ্যক উদ্যোক্তা ও ২৫ লাখ বেকারের কর্মসংস্থান, শক্তিসূচকে ৯৮তম স্থান, ডিজিটাল স্বাধীনতায় ৬৩তম স্থান (৮৬টি দেশের মধ্যে) ইত্যাদি সূচক আশার কথা বলে। কিন্তু বড় ব্যর্থতা হল প্রধান বিরোধী দলকে সরকার আস্থায় নিতে পারেনি। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজার্স’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা তা প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। সর্বশেষ ৫ জানুয়ারি (২০১৪) একটি নির্বাচন হয়েছে, যেখানে ‘সব দলের অংশগ্রহণ’ ছিল না। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ সীমিত হয়ে পড়েছে। রাজনীতি এখন হয়ে পড়েছে অনেকটা একদলীয়। দুর্নীতি বাড়ছে। সরকারি দলের প্রভাব-প্রতিপত্তি সমাজের সর্বক্ষেত্রে এত প্রকট যে, গণতন্ত্র এখানে অনেকটা ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রে’র পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। এমনকি বিরোধী দলের টানা তিন মাসের ‘আন্দোলন’ বাংলাদেশে একটি ‘বোমাবাজির রাজনীতি’র জন্ম দিয়েছে। এই রাজনীতি সুস্থ গণতন্ত্র চর্চার জন্য কোনো ভালো খবর নয়।

যারা বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করেন, রাজনীতি নিয়ে সারা জীবন থাকতে চান, তাদের কাছে এসব সার্ভে বা তাদের পর্যবেক্ষণ অনেক চিন্তার খোরাক জোগাবে। আইআরআইর পর্যবেক্ষণ নিয়ে (সারা দেশের মাত্র ২ হাজার ৫৫০ জনের মতামত এতে প্রতিফলিত হয়েছে) প্রশ্ন থাকলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে জরিপে যা উঠে এসেছে, তা বেশ ইন্টারেস্টিং। এ জরিপ এলো এমন একটি সময়ে যখন প্রধান বিচারপতির একটি মন্তব্যকে (অবসরে যাওয়ার পর রায় লেখা যায় না) কেন্দ্র করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা সম্পর্কিত রায়টি নিয়ে নতুন করে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এ ধরনের জরিপ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায় না। আইআরআইর সর্বশেষ জরিপ নিয়ে আমারও প্রশ্ন আছে। নির্বাচন কমিশন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিংবা বিএনপি সম্পর্কে মূল্যায়নে সঠিক তথ্য উঠে এসেছে কি-না সন্দেহ। তবুও এ ধরনের জরিপ আমাদের চিন্তার খোরাক জোগাবে। - See more at: http://www.jugantor.com/window/2016/01/31/7838/%E0%A6%85%E0%A6%A5%E0%A6%83-%E0%A6%9C%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%AA-%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%B0#sthash.TJXuP0Tf.dpuf

ইমেজ সংকটের মুখে মালয়েশিয়া

মালয়েশিয়া একটি বড় ধরনের ইমেজ সংকটের মুখে পড়েছে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে ৬৮ কোটি ডলার পাওয়া গিয়েছিল। এ নিয়ে ২০১৫ সালের আগস্ট মাসের শেষ দিকে রাজাকের পদত্যাগের দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছিল মালয়েশিয়া। কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে হাজার হাজার মানুষ সেদিন রাজপথে নেমে এসেছিল। তখন মালয়েশিয়ার জনক হিসেবে পরিচিত মাহাথির মোহাম্মদও এই বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের পদত্যাগ দাবি করেছিলেন। মালয়েশিয়ার প্রেক্ষাপটে এ ধরনের ঘটনা অকল্পনীয়। কারণ সেখানে ঘুষ, দুর্নীতি অত্যন্ত কঠোর হাতে দমন করা হয়। নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ শক্তিশালী হলে তিনি তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন। গত ২৬ জানুয়ারি তদন্ত কমিটি তাকে সব অভিযোগ থেকে মুক্তি দেয়। মালয়েশিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল গণমাধ্যমে দেওয়া এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন রাজাকের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া অর্থ তিনি সৌদি রাজপরিবার থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছেন। তবে সৌদি রাজপরিবার তাকে ব্যক্তিগতভাবে কেন এই বিপুল টাকা দিয়েছিল, তার কোনো ব্যাখ্যা এই তদন্তে পাওয়া যায়নি। মালয়েশিয়ার মতো দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন এত বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশি কোনো সূত্র (সৌদি) থেকে গ্রহণ করেন, তখন প্রশ্ন ওঠে বৈকি। ‘ইহুদি হুমকি মোকাবিলায়’ এই অর্থের দরকার ছিল কিংবা ‘মালয়েশিয়ার সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে ওই অর্থ একটি উপহার’Ñএসব কথা নাজিব সমর্থকদের মুখ থেকে শোনা গেলেও সাধারণ মানুষের মাঝে এ নিয়ে প্রশ্ন ছিল। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এই সংবাদটি পরিবেশন করলেও উৎস সম্পর্কে কোনো কথা বলেনি। যে কারণেই ‘বিদেশি উৎস’ থেকে এ টাকা পাওয়া যাক না কেন, নিশ্চয়ই তা সরকারি ফান্ডে অথবা সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু যখনই তা প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে জমা হয়, তখন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত ইমেজকে তা ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ রকমটি অতীতে কখনো দেখা যায়নি। অতীতে কোনো প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ আমরা শুনিনি। এর মধ্য দিয়ে মালয়েশিয়ার নেতৃত্বে পরিবর্তন যদি নাও আসে, বলার অপেক্ষা রাখে না এতে করে বহির্বিশ্বে রাষ্ট্রটির ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট হলো।
তুলনামূলকভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতি বেশ স্থিতিশীল। এ অঞ্চলের দেশগুলোর মাঝে থাইল্যান্ডে ‘কালার রেভ্যুলুশন’ সেখানে সরকার পতন ও সামরিক অভ্যুত্থানের পথ প্রশস্ত করলেও বাকি দেশগুলোতে স্থিতিশীলতা লক্ষ করা যায়। মালয়েশিয়ার রাজনীতিও অস্থিতিশীল ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করে প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হওয়ায় দেশটি অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছিল। সেখানেও এক ধরনের ‘কালার রেভ্যুলুশন’-এর জন্ম হয়েছিল, যারা হলুদ শার্ট পরিধান করে রাজধানী কুয়ালালামপুরের কেন্দ্রস্থল দখল করে নিয়েছিল। এই আন্দোলন আরও গুরুত্ব পেয়েছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের অংশগ্রহণের কারণে। যদিও এই ‘কালার রেভ্যুলুশন’ থাইল্যান্ডের মতো কিংবা অতীতে ফিলিপাইনে কোরাজান আকিনোর ‘ইয়োলো শার্ট’ ম্যুভমেন্টের মতো স্থায়ী হয়নি। এখানে স্পষ্টতই একটা পার্থক্য লক্ষ করা যাচ্ছে। ফিলিপাইনে কোরাজান আকিনো ১৯৮৬ সালে নিজে তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান মার্কোসের বিরুদ্ধে ‘ইয়োলো শার্ট’ ম্যুভমেন্টের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। থাইল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রা ও তার বোন ইংলাক সিনাওয়াত্রার সমর্থকরা ‘লাল শার্ট’পন্থি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আর তার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল, তার নেতৃত্বে দিয়েছিল (২০০৬) ‘হলুদ শার্ট’পন্থিরা ‘পিপলস অ্যালায়েন্স ফর ডেমোক্রেসি’র ব্যানারে। এই ‘লাল’ ও ‘হলুদ’ শার্ট আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেনা অভ্যুত্থানের পথ প্রশস্ত হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার আন্দোলনের সাথে পার্থক্য এখানেই যে, মালয়েশিয়ার ‘হলুদ শার্ট’ আন্দোলন স্থায়ী হয়নি। আন্দোলন শুরু হওয়ার পর আন্দোলনের খবর আমরা এখন তেমন একটা পাই না। পৃথিবীর অন্যত্র যেভাবে ‘কালার রেভ্যুলুশন’ সংগঠিত হয়েছে, মালয়েশিয়াতে তেমনটি হয়নি। কায়রোর ‘তাহরির স্কয়ার’-এ আন্দোলনকারীরা দুসপ্তাহ অবস্থান করে ‘আরব বসন্ত’-এর জন্ম দিয়েছিল মিসরে। হোসনি মোবারকের পতন ঘটেছিল। থাইল্যান্ডেও আমরা এমনটি লক্ষ করেছিলাম। কিন্তু মালয়েশিয়ায় তেমনটি হয়নি। এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে সাধারণ মানুষের মাঝে যে হতাশা আছে তা দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো। প্রথমত, ১৯৫৭ সালের ৩১ আগস্ট ব্রিটিশদের কাছ থেকে রক্তপাতহীন প্রক্রিয়ায় স্বাধীনতা অর্জন করার পর থেকেই একটি অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা ‘বারিসোয়া নেসিওনাল’ (ইধৎরংড়ধ ঘধংরড়হধষ) ক্ষমতা ধরে রেখেছে। এখানে কোনো শক্ত বিরোধী দলের জন্ম হয়নি। ক্ষমতাসীন ফ্রন্টে ১৩টি রাজনৈতিক দল রয়েছে। মূল শক্তি হচ্ছে উমনো বা টহরঃবফ গধষধুধ ঘধঃরড়হধষ ঙৎমধহরুধঃরড়হ। এই ফ্রন্টে গধষধুংরধহ ঈযরহবংব অংংড়পরধঃরড়হ ও গধষধুংরধহ ওহফরধহ ঈড়হমৎবংং-এর মতো দলও আছে। এই দুটি সংগঠন চিনা ও ভারতীয় জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে। মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪৬ ভাগ মালয়, আর ৩৫ ভাগ চিনা ও ১১ ভাগ ভারতীয় বংশোদ্ভূত। ২০১৩ সালে সর্বশেষ জাতীয় সংসদের (উবধিহ জধশুধঃ) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে দেখা যায়, মোট আসন ২২২টির মাঝে ন্যাশনাল ফ্রন্ট পেয়েছে ১৩৩ আসন (উমনো একা ৮৮ আসন), শতকরা হিসাবে ৫৯ দশমিক ৯১ ভাগ। অন্যদিকে এই প্রথমবারের মতো একটি শক্তিশালী বিরোধী জোট রয়েছে সংসদে (চধশধঃধহ জধশুধঃ)। এই বিরোধী ফ্রন্টের মূল শক্তি হচ্ছে ডেমোক্র্যাটিক অ্যাকশন পার্টি, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন আনোয়ার ইব্রাহিম। বিরোধী ফ্রন্টের আসন সংখ্যা হচ্ছে ৮৯, শতকরা হিসাবে ৪০ দশমিক ০৯ ভাগ। তিনটি দল নিয়ে এই বিরোধী ফ্রন্ট, যেখানে মালয়েশিয়ান ইসলামিক পার্টির (আসন ২১) মতো ইসলামিক দলও রয়েছে। শক্তিশালী বিরোধী দল গড়ে না ওঠায় ক্ষমতাসীন ‘বারিসোয়া ন্যাশনাল’ বারবার ক্ষমতায় আসছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে নাজিব রাজাকের (যিনি ক্ষমতায় আছেন ২০০৯ সাল থেকে) বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল একটি মানবাধিকার সংগঠনÑ ‘বেরসিহ’। পরে অবশিষ্ট ৫টি বিরোধী দল এই আন্দোলনে শরিক হয় (ডেমোক্র্যাটিক অ্যাকশন পার্টি, পার্টি ইসলাম সে মালয়েশিয়া, পার্টি কেয়াফিলান রাকায়েত, পার্টি সোসাইলিস মালয়েশিয়া, সারাওয়াক ন্যাশনাল পার্টি)। দ্বিতীয়ত, নাজিব রাজাক নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐক্যের ‘ওয়ান মালয়েশিয়া’ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তিনি কথা দিয়েছিলেন মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ, স্বচ্ছ ও প্রশাসনিক অর্থ ব্যবস্থা গড়ে তুলবেন। কিন্তু সংখ্যালঘুরা অভিযোগ করছেন যে, তারা বৈষম্যের শিকার। তৃতীয়ত, নাজিব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সরাসরি জনগণের সাথে সম্পর্ক রাখবেন। তিনি নিজে ফেসবুক ও টুইটারের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কিছু কিছু অভিযোগ উত্থাপিত হতেই, তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় কড়াকড়ি ব্যবস্থা আরোপ করেন। এখন শোনা যাচ্ছে, তিনি নতুন একটি আইন করতে যাচ্ছেন, যাতে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যাপারে কিছু বিধিনিষেধ থাকবে। চতুর্থত, তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন দেশকে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত করবেন। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেল তিনি খাদ্য ও জ্বালানিতে ভর্তুকি কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছেন। এতে করে বিত্তবানরা খুশি হবে, সাধারণ মানুষ খুশি হয়নি। তাই একটা অসন্তোষ ছিল। পঞ্চমত, তিনি দুর্নীতি কমানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও তার নিজের আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে তিনি বিতর্কিত হয়েছেন। ষষ্ঠত, বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য তার স্ত্রী রোজমাহ মনসুর বারবার বিতর্কিত হয়েছেন (শুধু চুলের স্টাইল করার জন্য প্রতিবার খরচ করেন ৪০০ ডলাস, বাংলাদেশি টাকায় ৩২ হাজার টাকা)। এটা পরোক্ষভাবে নাজিবের ইমেজ বৃদ্ধিতে কোনো সাহায্য করেনি।
প্রশ্ন হচ্ছে নাজিববিরোধী এই আন্দোলন সরকারের ভিতকে কি আদৌ কাঁপিয়ে দিতে পেরেছে? মনে হয় না। নিঃসন্দেহে নাজিবের ব্যক্তি ইমেজ এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সরকারের অবস্থান বেশ শক্তিশালী। মনে রাখতে হবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যত্র যে আন্দোলন হয়েছিল, তা ছিল সরকারবিরোধী একটি আন্দোলন। এখানে অর্থাৎ মালয়েশিয়াতে আন্দোলনের চরিত্র কিন্তু সরকারবিরোধী নয়, ব্যক্তি নাজিবের বিরুদ্ধে। এক সময় মনে করা হতো, মালয়েশিয়া এমন একটি সমাজ বিনির্মাণ করেছে, যেখানে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় না এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে রয়েছে কঠোর আইন। এমনকি সুশাসনের জন্যও মালয়েশিয়া সরকার আলোচিত। যদিও এটা সত্য, এখানে যে গণতন্ত্র বিকশিত হয়েছে, তা অনেকটা নিয়ন্ত্রিত। বিরোধীদলীয় কর্মকা-ও সীমিত। এখানে রাজনীতির চাইতে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে উন্নয়নকে। অনেকেই বলার চেষ্টা করেন মালয়েশিয়া উন্নয়নশীল দেশের জন্য একটি মডেল। এটা সম্ভব হয়েছিল মাহাথির মোহাম্মদের কারণে, যিনি ১৯৮১ সালে মালয়েশিয়ার চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। আর ২০০৩ সালের ৩১ অক্টোবর তিনি অবসরে যান। উমনো থেকেও বিদায় নেন ২০০৮ সালে। তবে ২০০৯ সালে আবার উমনোতে ফিরেও এসেছিলেন। তার ভূমিকা নিয়েও এখন প্রশ্ন আছে। অতীতে তিনি আনোয়ার ইব্রাহিমকে দল থেকে, ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বহিষ্কার পর্যন্ত করেছিলেন। আনোয়ারের বিরুদ্ধে সমকামিতার অভিযোগ ছিল। অনেকের ধারণা তিনি দলে তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী রাখতেন না (আনোয়ার ইব্রাহিম তার নিকটাত্মীয় এবং তাকে ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গণ্য করা হতো)। এখন নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে তার অবস্থানও সেখানে ‘মিশ্র’ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। দলকে মাহাথির মোহাম্মদ সাথে পাননি। শুধু তাই নয়, ‘সরকার উৎখাতের’ অভিযোগে পুশিল তখন মাহাথিরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল।
এক সময় মালয়েশিয়াকে নিয়ে অনেকে গর্ব করতেন। মাহাথির মালয়েশিয়াকে অনেক ‘উচ্চতায়’ নিয়ে গিয়েছিলেন। এখন দেখা গেল খোদ প্রধানমন্ত্রীও দুর্নীতির অভিযোগ থেকে ‘মুক্তি’ পেলেন না। সৌদি সরকার কেন তাকে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়েছিল, তাও বোধহয় জানা যাবে না কোনোদিন। এই ঘটনায় নাজিব রাজাক ‘মুক্তি’ পেলেন বটে, কিন্তু মালয়েশিয়া একটি বড় ধরনের ইমেজ সংকটের মুখে পড়েছে। Daily Amader Somoy 31.01.16

বিশ্ব সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমের নতুন মাত্রা



অতিসাম্প্রতিককালে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসবাদী ঘটনা ঘটেছে এবং প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের সংশ্লিষ্টতা জানা গেছে। ঘটনার শুরু প্যারিসে জঙ্গি হামলার মধ্য দিয়ে, যেখানে আইএসের জঙ্গিরা ১২৯ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছিল। এরপর ঘটল মালির রাজধানী বামাকোতে সন্ত্রাসবাদী ঘটনা। আইএসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জঙ্গিরা হোটেল র‌্যাডিসনে ১৭০ জন মানুষকে জিম্মি করেছিল। তাদের উদ্ধারে মারা যান ২৭ জন সাধারণ মানুষ। এরপর জঙ্গিরা বর্ষবরণে হামলা চালাল তুরস্কের বড় ও প্রাচীন শহর ইস্তাম্বুলে। ওই হামলায় ১০ জন জার্মান পর্যটক নিহত হয়েছিলেন। এরপরের ঘটনাও মালিতে। মধ্য জানুয়ারিতে দুটি ঘটনায় দুই সেনা ও এক রক্ষীসহ ৫ জন নিহত হয়েছেন। আফ্রিকার মালির মধ্যাঞ্চলীয় শহর মোপতি ও মরু শহর তিম্বাকুতে ইসলামপন্থীরা এই হামলা চালায়। এরপরের ঘটনা ইন্দোনেশিয়া ও আফ্রিকার বুরকিনা ফাসোতে। ইন্দোনেশিয়ায় জঙ্গি হামলা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতির জন্য একটি বড় ধরনের ঘটনা। ইসলামিক স্টেট (আইএস) যে ‘দূরবর্তী খেলাফত’ প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেছে, তারই অংশ হিসেবে ইন্দোনেশিয়ায় এই হামলা চালানো হয়েছে। এ হামলায় অন্তত ১৪ জন বন্দুকধারী অংশ নিয়েছে, যদিও মাত্র ৭ জন নিহত হয়েছেন। এই ঘটনাটি অনেকটা প্যারিস স্টাইলের হামলার মতো। বলা হচ্ছে, আইএসের দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় শাখা কাতিবা নুসানতারা এ হামলার জন্য দায়ী। আইএস এ হামলার দায় স্বীকার করেছে। এর মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হলো যে, আইএস তথাকথিত ইসলামিক খেলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্থানীয় কোনো কোনো সংগঠনকে স্বীকৃতি দেয়। আর জাকার্তায় জঙ্গি হামলার রেশ শেষ হওয়ার আগেই সর্বশেষ জঙ্গি হামলায় আক্রান্ত হলো পশ্চিম আফ্রিকার অপর একটি দেশ বুরকিনা ফাসো। এতে মারা যান ২৭ জন এবং এর দায়-দায়িত্ব স্বীকার করেছে আল কায়েদা ইন ইসলামিক মাগরেব। জঙ্গি তৎপরতা এখন মধ্যপ্রাচ্য ছাড়িয়ে পশ্চিম আফ্রিকাতে। মালির উত্তরে TUAREG  অঞ্চলে ন্যূনতম চারটি ইসলামিক জঙ্গিগোষ্ঠীর খবর আমরা জানি, যারা একটি জিহাদি যুদ্ধ পরিচালনা করছে। একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেও তারা কাজ করে যাচ্ছে। এই চারটি সংগঠন হচ্ছে আনসার দ্বীন (Ansar dine), আল কায়েদা ইন ইসলামিক মাগরেব (AQIM), মোজওআ (MOJWA) ও আল মুয়াক্কিন বি ডিমা (Al-Muwaqin Bidima)। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে ‘সাহেল জোন’র অন্তর্ভুক্ত মালি, মৌরিতানিয়া ও নাইজারে ইসলামিক জঙ্গিদের তৎপরতা বেড়েছে। মাগরেবভুক্ত এ অঞ্চলের বাইরে নাইজেরিয়াতে ইসলামিক জঙ্গিগোষ্ঠী বোকো হারামের নৃশংস ঘটনাবলি সারা বিশ্বের দৃষ্টি কেড়েছিল। বোকো হারামের জঙ্গিরা কিশোরী মেয়েদের স্কুল থেকে অপহরণ করত এবং তারা জঙ্গি কমান্ডারদের তথাকথিত যৌন দাসী হিসেবে ব্যবহার করত। শত শত কিশোরী মেয়েকে অপহরণের পর আর তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। বোকো হারাম সম্প্রতি ইসলামিক স্টেটের নেতৃত্বের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেছে। একিউআইএম চাচ্ছে একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে। ২০০৭ সালে তারা এই ঘোষণা দেয়। আলজেরিয়া, লিবিয়া, মালি, মরক্কো ও তিউনিসিয়ায় তাদের তৎপরতা সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে নাইজেরিয়াতে বোকো হারাম ও আনসারুল্লাহর মতো সংগঠন একটি খেলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। নাইজার ও ক্যামেরুনেও তাদের কর্মকা- সম্প্রসারিত হয়েছে। বলা হয়, নাইজেরিয়ার ৩৬টি প্রদেশের মধ্যে ১৪টিতে বোকো হারামের অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী। আর মালিতে ২০১১ সালে জঙ্গি সংগঠন আনসার দ্বীন সেখানে তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় শরিয়া আইন বলবৎ করেছে। ফলে এ অঞ্চলগুলো একটি বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে আছে। উত্তর আফ্রিকার অনেক দেশ এক সময় ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল। ফলে এসব দেশের অনেক মানুষ ফ্রান্স, বিশেষ করে রাজধানী প্যারিসে বসবাস করেন। এদের দ্বিতীয় তথা তৃতীয় জেনারেশন ফ্রান্সে বসবাস করে আসছেন। কিন্তু ফ্রান্সের নাগরিকত্ব পেলেও এরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। চাকরির ক্ষেত্রে, সামাজিক দিক দিয়ে এরা বৈষম্যের স্বীকার হয়ে আসছিলেন। আর এই সুযোগটিই নিয়েছিল আইএস। এরা তরুণ সমাজের মাঝে তাদের অবস্থান শক্তিশালী করেছিল। ধর্ম, বিশেষ করে ইসলাম ধর্ম এ ক্ষেত্রে আদৌ কোনো ভূমিকা পালন করেনি। এর বড় প্রমাণ হাসনাআইত বুলাচেনের ঘটনা যিনি ইউরোপে প্রথম নারী আত্মঘাতী হিসেবে পরিচিতি পান। বুলাচেন কিছুদিন আগ পর্যন্ত পশ্চিমা পোশাক ও পশ্চিমা সংস্কৃতিতে আকৃষ্ট ছিলেন। তার বন্ধুরা ইংল্যান্ডের টেলিগ্রাফকে জানিয়েছে, হাসনা ব্যক্তিজীবনে জিনস প্যান্ট কোকাকোলা আর পশ্চিমা সংগীতে বুঁদ হয়ে থাকতেন। তার কাছে ইসলাম ধর্মের কোনো আবেদন ছিল না। হঠাৎ করেই তিনি ‘হিজাবি’ হয়ে যান ও জিহাদি তৎপরতায় জড়িয়ে যান। আইএসের সমর্থক হাসনা বুলাচেন পুলিশের আক্রমণের মুখে গত ১৯ নভেম্বর প্যারিসে নিজেকে উড়িয়ে দেন। আইএস এভাবেই তরুণ প্রজন্মের ভেতর তার ‘প্রভাব’ বিস্তার করেছিল।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সিরিয়ায় আইএস বা ইসলামিক স্টেটের নাম প্রথম শোনা যায় ২০১৩ সালে। তখন সংগঠনটির নাম ছিল ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড লেভান্ট। এই এলাকার ঐতিহাসিক নাম লেভান্ট। জঙ্গিরা এই নামটি গ্রহণ করেছিল। পরে নামটি পরিবর্তন করে। তবে ১৯৯১ সালে ‘জামাত আল তওহিদ ওয়াল জিহাদ নামে একটি সংগঠনের ব্যাপারে মূলত এটি সংগঠিত হয়েছিল। পরে এরা ‘আল কায়েদা ইন ইরাক’ নাম ধারণ করে। এই সংগঠনটি মূলত সুন্নি প্রভাবাধীন ও সুন্নি সম্প্রদায়নির্ভর। ২০০৬ সালে ইরাকে সুন্নি প্রভাবাধীন মুজাহিদিন শূরা কাউন্সিলে সংগঠনটি যোগ দেয়। ২০১৩ সালে সারা বিশ্ব প্রথমবারের মতো আবু বকর বাগদাদির নাম জানতে পারে। ২০১৪ সালের ২৯ জুন বাগদাদি একটি খেলাফতের ডাক দিলে সংগঠনটি ব্যাপক পরিচিতি পায়। তখন সংগঠনটি নতুন নাম ধারণ করে আইএস বা ইসলামিক স্টেট। তবে আল কায়েদার সঙ্গে সংগঠনটির সম্পর্ক কী, এটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। বলা হচ্ছে ২০১৪ সালের জুন মাস থেকে আইএসের সঙ্গে আল কায়েদার কোনো সম্পর্ক নেই। আল কায়েদার রাজনৈতিক দর্শন ও ইসলামিক স্টেটের রাজনীতির মাঝে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। দুটো সংগঠনই মূলত জিহাদি, সালাফি ও ওয়াহাবি মতবাদ দ্বারা পরিচালিত হয়। আল কায়েদা জিহাদি ও ওয়াহাবি মতবাদ অনুসরণ করলেও খেলাফতের কথা বলেনি কখনো। আইএস খেলাফতের কথা বলেছে। বাগদাদি নিজেকে খলিফা বা আমিরুল মুমেনিন হিসেবে ঘোষণা করেছেন, যা আল কায়েদার নেতা লাদেন যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন নিজেকে খলিফা ঘোষণা করেননি। বাগদাদি নিজেকে সারা মুসলিম বিশ্বের নেতা বা খলিফা হিসেবে ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে দাবি করেছেন সব মুসলমানের দায়িত্ব হচ্ছে এই খেলাফতের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করা। তিনি মুসলমানপ্রধান সব দেশকে নিয়ে এক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেন। অন্যদিকে আল কায়েদার স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে ছোট্ট ছোট্ট আমিরাত প্রতিষ্ঠা করা। আল কায়েদা মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে অপারেট করে। কিন্তু আইএস তা করে না। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, আল কায়েদা ও আইএসÑ উভয় সংগঠনই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার জন্ম দেওয়া। পুরো মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের একটা বড় স্ট্র্যাটেজি রয়েছে। এখানে তার স্বার্থ অনেক। স্বার্থ রয়েছে ফ্রান্সেরও। বাহরাইন ও কাতারে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি। ফ্রান্স ও ব্রিটেনের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে আমিরাত ও সাইপ্রাসে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে সস্তায় তেল পাওয়া যায়। এই তেলের ওপর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের নির্ভরশীলতা অনেক বেশি। লিবিয়ার তেলের ওপর ৩টি পশ্চিমা দেশের নির্ভরশীলতা ইতোমধ্যে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ইতালির প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেলের ২৯ ভাগ আসে লিবিয়া থেকে। ফ্রান্সের ও স্পেনের এই নির্ভরশীলতার হার যথাক্রমে ১৪ ভাগ ও ১০ ভাগ। তারা চাইবে সস্তায় তেল নিতে। সিরিয়ায় খুব বেশি তেলসম্পদ নেই। কিন্তু এই তেলই এখন ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের আয়ের অন্যতম উৎস। আইএস প্রতিদিন তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে ৪০ হাজার ব্যারেল তেল উত্তোলন করে। কালোবাজারে তা বিক্রি করে। এর মূল্য বছর হিসেবে ৩২ কোটি ডলার। আর প্রতিদিনের তেল বিক্রির অর্থ জমা হচ্ছে ইসলামিক স্টেটের ফান্ডে। এই ফান্ড ব্যবহৃত হয় জঙ্গিদের মাসিক বেতন (৪৩০ ডলার থেকে ১ হাজার ডলার) ও সেই সঙ্গে বিদেশে জঙ্গি তৎপরতার কাজে। যেমন বলা যেতে পারে প্যারিসে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের জন্য প্রায় ৫০ হাজার ডলার ব্যয় হয়েছে বলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার ধারণা। কাকতালীয়ভাবে ২০০১ সালের ‘টুইন টাওয়ার’ হামলার সঙ্গে সম্প্রতি বিভিন্ন দেশে সংঘটিত হত্যাকা-ের অনেক মিল আছে। দীর্ঘ ১৪ বছর পরও ‘টুইন টাওয়ার’ হত্যাকা-ের প্রকৃত ‘রহস্য’ আজও উদঘাটিত হয়নি। কেন ‘টুইন টাওয়ার’ হামলায় একজন ইহুদিও মারা গেল না, কারা অভিযুক্ত সৌদি নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল, এর পেছনে কাদের আর্থিক স্বার্থ বেশি ছিল, একটা মুসলমান বিদ্বেষী মনোভাব তৈরি করে কারা লাভবান হয়েছে, কেন সৌদি আরব রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলো না- এসব প্রশ্নের কোনো জবাব আমাদের জানা নেই। আমি ইতোমধ্যে আমাদের সময়ে ৯/১১ নিয়ে একাধিক লেখা প্রকাশ করেছি। তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বলার চেষ্টা করেছি ৯/১১-এর ঘটনাবলি ছিল একটি বড় ধরনের ‘ষড়যন্ত্রের’ই ফল। আজ যখন ভিন্ন আঙ্গিকে সন্ত্রাসী কর্মকা- সংঘটিত হতে দেখি, তখন স্পষ্টতই আবারও সেই ‘ষড়যন্ত্র’-এর কথাই মনে হয়ে যায়। আল কায়েদার চ্যাপ্টার এখন ‘শেষ’। ওসামা বিন লাদেন এখন ইতিহাস। রাজনীতির মঞ্চে এখন আছেন বাগদাদি আর ইসলামিক স্টেট। কে এই বাগদাদি, কারা আইএস তৈরি করল- এ নিয়ে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যারা গবেষণা করেন, তারাই বলেন এটা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সৃষ্টি। টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মিসেল চম্বুডোভস্কি তো স্পষ্টই ইঙ্গিত করেছেন, প্যারিস ট্র্যাজেডি হচ্ছে ৯/১১ ফ্রেন্স স্টাইল  (LE 11 september a la francaise)।  যারা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা নিশ্চয়ই  greater middle east policy সম্পর্কে কিছুটা ধারণা রাখেন। কয়েক বছর আগে একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ওয়েসলি কার্ক ৭টি দেশের পরিবর্তনের কথা বলেছিলেন। এই ৭টি দেশ হচ্ছে- ইরান, সিরিয়া, লেবানন, লিবিয়া, সোমালিয়া, সুদান ও ইরাক। ইতোমধ্যে লিবিয়া ও ইরাকে পরিবর্তন হয়েছে। সিরিয়া পরিবর্তনের পথে। ২০২০-পরবর্তী মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে মানচিত্র আঁকতে হবে। সৌদি আরব ভেঙে যাওয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া ও ইরাক একাধিক রাষ্ট্রে বিভক্ত হওয়া- এসবই এখন ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে। আর সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে, এ থেকে উপকৃত হচ্ছে একমাত্র ইসরায়েল। আজ তাই কোনো কোনো পক্ষের কাছে যেমনি প্রয়োজন ছিল ৯/১১-এর জন্ম দেওয়ার, ঠিক তেমনি প্রয়োজন ছিল প্যারিস ট্র্যাজেডি সৃষ্টি করার। আর এর রেশ ধরেই মালি এবং বুরকিনা ফাসোতে ঘটল সন্ত্রাসী কর্মকা-। এর মধ্য দিয়ে এখানেই ‘সন্ত্রাসী কর্মকা-’ শেষ হয়ে যাবেÑ এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। কেননা আইএসের স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে ‘সন্ত্রাসের মাঝে বিজয় অর্জন’। বাগদাদি এই স্ট্র্যাটেজি রচনা করেছেন। সন্ত্রাসের মাধ্যমে তিনি সিরিয়া ও ইরাকের বিশাল এলাকায় আইএসের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন বটে, কিন্তু তা বিশ্ববাসীর কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। প্যারিসে ১২৯ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করে আইএস ঘৃণাই অর্জন করেছে। সাধারণ মানুষ তাদের কর্মকা- পছন্দ করছে না। বাগদাদি তার সন্ত্রাসী কর্মকা- আফ্রিকাতেও ছড়িয়ে দিতে চান। আর তাই মালির রাজধানী বামাকো এবং কুরকিনা ফাসাতে যে সন্ত্রাসী কর্মকা- ঘটল তা সমর্থন পাবে না। তবে একটা ভয়ের আবহ ছড়িয়ে দিল। আফ্রিকা এখন আইএসের টার্গেট। এর শেষ কোথায়? আইএস হোয়াইট হাউস উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। আল কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠন মালির রাজধানীতে জঙ্গি তৎপরতা চালিয়ে বিশ্ববাসীকে জানান দিল ইসলাম নয়, বরং সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মাধ্যমেই তারা ‘বিজয়’ অর্জন করতে চায়! আইএসের বিরুদ্ধে একটি সর্বাত্মক ‘যুদ্ধ’ শুরু করা জরুরি। আর ভয়টা হচ্ছে আইএসের যে দূরবর্তী খেলাফত প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা তাতে করে আমাদের মতো দেশও আক্রান্ত হতে পারে! ইতোমধ্যে বাংলাদেশে আইএস আছে কী নেই এ নিয়ে একটা ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার ঘটনা থেকে আমাদের সতর্ক হতে হবে। স্থানীয় জঙ্গিরা আছে। তারা যে কোনোভাবেই হোক আইএসের কাছ থেকে একটা ‘অনুমোদন’ পাওয়ার চেষ্টা করছে। ইন্দোনেশিয়ার জনগোষ্ঠীর (২৫ কোটি) একটা বড় অংশ মুসলমান। জানা যায়, প্রায় ৫০০ থেকে ৭০০ যুবক আইএসের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ইন্দোনেশিয়াতে ফিরে এসেছে। এরাই সর্বশেষ সন্ত্রাসী হামলা পরিচালনা করেছে। এই বিষয়টা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। আইএসের বাংলাদেশ কিংবা ভারতীয় মহাদেশের কোনো ‘শাখা’ গঠিত না হলেও আল কায়েদার শাখা আছে। আমাদের তাই সতর্ক হতে হবে। আমাদের গোয়েন্দাদের তৎপরতা বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে মুসলমানপ্রধান দেশগুলোতে যে সন্ত্রাসী তৎপরতা বাড়ছে, তাতে বাংলাদেশও আক্রান্ত হতে পারে। আমাদের তাই সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। 
Daily Amader Somoy
24.1.16

ইরানের পারমাণবিক সমঝোতা কি ভেস্তে গেল

গেল বছরের জুলাই মাসে ইরানের সঙ্গে ৬ জাতি আলোচনায় যে পারমাণবিক সমঝোতা হয়েছিল, তা কি এখন ভেস্তে যেতে বসেছে? এ প্রশ্নটি নতুন করে আলোচনায় এসেছে যখন যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে আবারও ১১টি ইরানি কোম্পানি ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এর মাত্র ২৪ ঘণ্টা আগে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন জাতিসংঘের আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। আইএইএ গত ১৬ জানুয়ারি ঘোষণা দেয় যে ইরান পারমাণবিক চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করেছে। ইতিমধ্যে ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পরপরই ইরানে আটক ৫ মার্কিন নাগরিক আর যুক্তরাষ্ট্রে আটক ৭ ইরানিকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। এরপরই এলো নতুন করে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্তটি। নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে বিশ্বব্যাপী ইরানের যে হাজার হাজার কোটি ডলার জব্দ করা হয়েছিল, তা ইরান ফেরত পাবে কিনা, তা স্পষ্ট নয়। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার পর বিশ্ববাজারে ইরানের তেল রফতানি করার কথা। এখন নতুন করে ১১টি কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আসায় ইরানি কোম্পানিগুলো তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কি-না, সেটা দেখার বিষয়। তবে এটা বলতেই হবে, ইরান ৬ জাতি পারমাণবিক আলোচনায় যে সমঝোতায় উপনীত হয়েছিল, তা ছিল এ অঞ্চলের রাজনীতির জন্য উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা।

ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প নিয়ে সমঝোতা হওয়ায় দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এতে দেখা যায়, আগামী ১০ বছরের মধ্যে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে পারবে না। তাদের পরমাণু কেন্দ্রে চলবে নজরদারি। অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকছে এবং তেহরান শর্ত ভাঙলে ৬৫ দিনের মধ্যে ফের কিছু নিষেধাজ্ঞা বহাল হবে। একই সঙ্গে ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে কতটা এগিয়েছে, তা তদন্ত করবে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ)। ফের আইএইএ-ইরান বিরোধ সৃষ্টি হলে তা মেটাবে একটি সালিশি বোর্ড। ওই চুক্তির পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ইরানের যে সম্পদ জব্দ করা হয়েছিল, তা ইরানকে ফেরত দেয়া হবে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার ফলে ইরান তার যাত্রীবাহী বিমান সংস্থার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ আমদানি করতে পারবে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ১০ বছর পর ইরান তার পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আরও গবেষণা ও উন্নয়নের কাজ করতে পারবে। এখন নতুন নিষেধাজ্ঞার ফলে এ সমঝেতার কোন্ কোন্ অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা দেখার বিষয়।

এ অঞ্চলের রাজনীতির জন্য ওই চুক্তিটি উত্তেজনা হ্রাসে সহায়ক হওয়ার কথা। ওবামা প্রশাসনের ওপর ইসরাইলি প্রশাসনের প্রচণ্ড ‘চাপ’ থাকা সত্ত্বেও ওবামা প্রশাসন এ ধরনের শর্তে রাজি হয়েছিল। তাই আলোচনায় বাকি বৃহৎ শক্তিগুলোও রাজি হয়েছিল। ওবামার জন্য একটি প্লাস পয়েন্ট ছিল সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট কার্টার এবং প্রায় ১০০ সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত কর্তৃক তার প্রতি সমর্থন প্রকাশ। কংগ্রেস সদস্যদের বিরোধিতার মুখে ওবামা এটাও জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, কংগ্রেস যদি এ সমঝোতা প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে তিনি ‘ভেটো’ দেবেন। অর্থাৎ তিনি চান কংগ্রেস এ চুক্তি অনুমোদন করুক। ইরানের ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার কারণে এ সমঝোতা এখন প্রশ্নের মুখে।

ইরানের ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে গেল বটে। কিন্তু নতুন করে নিষেধাজ্ঞা ও মানবাধিকার সম্পর্কিত অবরোধ উঠছে না। ইরানের অবস্থা অনেকটা ফাঁদে পড়ার মতো। ইরান পুরোপুরিভাবে ‘মুক্ত’ হচ্ছে না। নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্ক এখন প্রশ্নের মুখে থাকলেও বলতে দ্বিধা নেই, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি উঠে গেলে ইরান এ অঞ্চলে অন্যতম একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে, যা ইসরাইল ও সৌদি আরব কারোই পছন্দ নয়। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে অন্যতম ফ্যাক্টর হচ্ছে ইসরাইল। পারমাণবিক চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু মন্তব্য করেছিলেন, ‘এটা একটা ঐতিহাসিক ভুল।’ ইসরাইলের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ চুক্তির কোনো কোনো ধারা নিয়ে সমালোচনাও করেছেন। ফলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা এ চুক্তির প্রশংসা করলেও এবং ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি এ চুক্তির মধ্য দিয়ে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে বলে মন্তব্য করলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে এখন দ্রুত বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন। ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরি করছে, এ অভিযোগ ওঠার পর ২০০৬ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি বাতিল করার দাবি সংবলিত একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। এরপর অন্তত এ সংক্রান্ত আরও ৬টি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে এবং ইরান ওই কর্মসূচি বাতিল না করায় ২০১০ সালে জাতিসংঘ ইরানের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক মালিকানার সম্পদ জব্দসহ দেশটির বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তবে ২০০৬ সাল থেকেই ইরানের সঙ্গে ৬ জাতি (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও জার্মানি) আলোচনা চলে আসছিল। কিন্তু তাতে কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছিল না। ২০১৩ সালে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে উদারপন্থী হিসেবে পরিচিত হাসান রুহানি বিজয়ী হলে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যায়। ফলে এ ৬ জাতি আলোচনা আরও গতি পায়। ২০১৪ সালের নভেম্বরে একটি চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু হয় এবং এপ্রিলে (২০১৫) সুইজারল্যান্ডের লুজানে ইরান ও ৬ জাতি একটি খসড়া চুক্তিতে উপনীত হয়। ওই বছরের ৩০ জুনের মধ্যে এ খসড়া চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। জুলাই (২০১৫) মাসে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়।

এ চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে অন্তত একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছিল- যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক বৃদ্ধির একটি সম্ভাবনা। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এ সম্পর্ক আরও উন্নত করার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ, প্রশাসন, সেনাবাহিনীতে এখনও ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লবের পর রেভ্যুলেশনারি স্টুডেন্টস কর্তৃক তেহরানের মার্কিন দূতাবাস দীর্ঘ ৪৪৪ দিন দখল করে নেয়ার ঘটনার স্মৃতি একটি ‘ক্ষতচিহ্ন’ হিসেবে রয়ে গেছে। ফলে সম্পর্ক বৃদ্ধির সম্ভাবনাটা অত সহজ ছিল না। এরপর যোগ হয় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি। ওই ঘটনার দীর্ঘ ৩৬ বছর পর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি এ দেশ দুটিকে আরও কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল। এর ফল স্বরূপই এ চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ইসরাইলের আপত্তি সত্ত্বেও। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিস্টরা মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে ইরাক-সিরিয়ায় জঙ্গিবাদী ইসলামিক স্টেটের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে হলে তাদের ইরানের সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, গেল নভেম্বরে (২০১৪) বারাক ওবামা স্বীকার করেছিলেন তিনি গোপনে ইরানি সমর্থন চেয়ে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনিকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। প্রত্যুত্তরে খামেনিও তাকে গোপনে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। আইএস (ইসলামিক স্টেট) জঙ্গিদের ঠেকাতে ওবামা খামেনির সমর্থন চেয়েছিলেন। পরে ইয়েমেনে ‘হুথি বিদ্রোহ’ প্রমাণ করল এখানেও একটি স্থিতিশীল সরকার গঠনে ইরানের সমর্থন প্রয়োজন রয়েছে। কারণ হুথিরা শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত এবং অভিযোগ আছে, হুথি বিদ্রোহীরা ইরান থেকে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য পেয়ে থাকে, যদিও ইরান বারবার তা অস্বীকার করে আসছে।

‘ইরান চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হওয়ায় সৌদি আরবের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক আরও স্বাভাবিক হবে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এটাই চাইছিল। একটি সৌদি-ইরান জোট পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের রাজনীতিতে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে, এটা মনে করেন অনেক মার্কিন গবেষক। কারণ ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহে সেখানে সরকারের পতন ঘটে এবং প্রেসিডেন্ট দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরপর মার্চে সৌদি বিমান হুথি বিদ্রোহী ঘাঁটিতে বোমা হামলা চালালেও সেখানে স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। এরই মধ্যে সৌদি আরবে শিয়া নেতা নিমর আল নিমরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় সৌদি-ইরান সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এ দেশ দুটির মধ্যে আস্থাহীনতার সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছে। উপরন্তু সৌদি আরবের নেতৃত্বে একটি সামরিক জোট গঠিত হওয়ায় ইরান এটাকে ভালোভাবে নেয়নি। নতুন করে শিয়া-সুন্নি বিতর্কটি সামনে চলে এসেছে আবার। এরই মাঝে নতুন করে যোগ হল ইরানের ওপর নয়া নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি।

এখন নতুন নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা লক্ষ্য করার বিষয়। সিরিয়া সংকট সমাধানে ইরানের সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। জুনে সিরিয়ায় একটি সর্বদলীয় সরকার গঠিত হওয়ার কথা এবং আগামী বছর সেখানে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এখন ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের যদি আরও অবনতি ঘটে, তাহলে তা সিরিয়ার ঘটনাবলীতেও প্রভাব ফেলবে। চলতি জানুয়ারিতেই জেনেভায় সিরিয়া নিয়ে একটি বহুদলীয় আলোচনা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। ওই আলোচনায় ইরান ও সৌদি আরবও অংশ নেবে। এখন নতুন করে ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় তা সামগ্রিকভাবে আলোচনায় একটা অচলাবস্থা এনে দিতে পারে। এটা সবাই জানে, ইরান সিরিয়ার আসাদ সরকারকে সমর্থন করছে। আর ইরান পাশে পেয়েছে রাশিয়ার মতো বড় একটি শক্তিকে। ফলে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতিতে সিরিয়ায় শান্তি প্রক্রিয়া বিঘিœত হবে। দীর্ঘ প্রায় ৩৬ বছর ইরান আন্তর্জাতিক আসরে একা। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির কারণে ইরান বিশ্বে একা হয়ে গিয়েছিল। ইরানের বৈদেশিক আয়ের বড় উৎস পেট্রোলিয়াম সেক্টরে কোনো বিনিয়োগ আসছিল না। এমনকি ইরান তেল রফতানিও করতে পারছিল না। এজন্যই ইরানিদের প্রয়োজন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের। কট্টর শিয়া ধর্মীয় ভাবধারায় বিশ্বাসী ইরানি ধর্মীয় নেতারা যে এটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন- সেটাই হচ্ছে বাস্তববাদী নীতির মূল কথা। ২০১৬ সালে ইরানের পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমার বিশ্বাস, ওই নির্বাচনে রুহানি সমর্থকরা বিজয়ী হবেন। একই সঙ্গে ২০১৭ সালে ইরানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এ নির্বাচনে রুহানির দ্বিতীয়বারের মতো বিজয়ী হওয়ার পথও প্রশস্ত হবে। তবে কট্টরপন্থীরা সেখানে এখনও তৎপর।

ইসরাইলের বিরোধিতার কারণে মার্কিন কংগ্রেসে এ চুক্তির বিরোধিতা রয়েছে। ২০১৬ সালের নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এ ইরান ইস্যু কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলতে পারে। ফলে ডেমোক্রেট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের ‘সহজ বিজয়ে’ একটা বড় অন্তরায় সৃষ্টি হতে পারে। রিপাবলিকানদের অবস্থান এতে করে শক্তিশালী হয়েছে। যদিও হিলারি ক্লিনটন স্পষ্ট করেই বলেছেন, তিনি কোনো অবস্থাতেই ইরানকে পারমাণবিক বোমা বানাতে দেবেন না। মার্কিনিদের জন্য একটি সুযোগ এসেছে উপসাগরীয় অঞ্চলে এক ধরনের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার। ‘যুদ্ধবাজ’ মার্কিন প্রশাসন যদি এ ‘সম্ভাবনাকে’ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেখানে যুদ্ধ আরও প্রলম্বিত হবে।

চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ইরানের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দার্শনিক রামিন জাহানবেগলু (Ramin Jahanbegloo) একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির মেরুকরণে এ মুহূর্তে ইরান একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।’ এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। ইরানকে ছাড়া যে উপসাগর তথা মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করা যাবে না, এটা প্রমাণিত হয়েছে। এখন দেখার পালা মার্কিন নীতিতে এ পরিবর্তনটা কীভাবে প্রতিফলিত হয়। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লবের আগে, অর্থাৎ রেজা শাহ পাহলভীর শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ইরান। ইরানকে সঙ্গে নিয়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থ নিশ্চিত করেছিল। কিন্তু সেই দৃশ্যপট বদলে যায় ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর। এখন নতুন আঙ্গিকে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক সেই বৃত্তে ফিরে গেলেও সেখানে এখন নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে, যার কারণে নতুন করে আবারও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। তবে অনেক বিশ্লেষক স্বীকার করেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে কূটনীতিই শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়েছে। এর জন্য অনেকেই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ও ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জাফরিকে কৃতিত্ব দিয়েছেন। এই ‘সফল কূটনীতি’র কারণেই ইরানে দীর্ঘদিন বন্দি অবস্থায় থাকা ৫ জন আমেরিকানকে মুক্ত করতে পেরেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এ ‘সমঝোতা’ এখন ধরে রাখতে হবে এমন মন্তব্য করেছেন ন্যাশনাল ইরানিয়ান আমেরিকান কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ত্রিতা পারসি ও ফেলো টাইলার কালিস এক যৌথ নিবন্ধে। নিবন্ধটি ছাপা হয়েছে গত ২০ জানুয়ারি হাফিংটন পোস্টের সহযোগী দ্য ওয়ার্ল্ড পোস্টে। তারা তিন পর্যায়ে এ সম্পর্ক বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। এক. যুক্তরাষ্ট্র-ইরান স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক, দুই. দু’দেশের আইন প্রণেতাদের মাঝে একটি সংলাপ, তিন. সমাজের (দু’দেশের) বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে সম্পর্ক বাড়ানো। তারা মন্তব্য করেছেন এভাবে : True opportunities to start a dialogue between US and Iran have only appeared once a decade. Opportunities to change the paradigm of relationship may only come once a generation. এটাই হচ্ছে মূল কথা। সুযোগ বারবার আসে না। যে ‘সমঝোতা’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা যেন ভেস্তে না যায়। Daily Jugantor 23.1.16

সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় আলো কি নিভে গেল

সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় একচিলতে আলো দেখা গিয়েছিল। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তিনটি জনসভা করেছিল। জনসভা শেষ হয়েছিল শান্তিপূর্ণভাবে। জনসভায় যেসব বক্তব্য দেওয়া হয়েছিল, তা আশার সঞ্চার করেছিল সাধারণ মানুষের মধ্যে। বেগম খালেদা জিয়া ওইদিন গণতন্ত্র হত্যা দিবস পালন করলেও আলোচনার মাধ্যমে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছিলেন। আর সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যও ছিল অনেকটা ‘পজিটিভ’। তিনি ‘শান্তিপূর্ণ রাজনীতি’ এগিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘দেশে নির্বাচন হলে, সেই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। ওই নির্বাচনের জন্য একটি জীবনও হত্যার প্রয়োজন হবে না। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি।’ সরকারি দল ৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ আর বিএনপি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করলেও কোনো সহিংস ঘটনা ঘটেনি। কোনো পটকা ফোটেনি। দুটি বড় দলই তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে জনসভা করেছে। দুটি বড় দল ওইদিন শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ শেষ করলেও গত ১১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত জনসভায় এই ‘মনোভাব’ কতটুকু প্রতিফলিত হয়েছে, তা প্রশ্নই রয়ে গেল। জনসভায় দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য আবারও হতাশার জন্ম দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘বিডিআর বিদ্রোহে খালেদা-তারেকের ষড়যন্ত্র ছিল।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘জিয়া অবৈধ রাষ্ট্রপতি, আর তার দলও অবৈধ।’ এ ধরনের বক্তব্য আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে কতটুকু সাহায্য করবে, সে প্রশ্ন এখন উঠতেই পারে। গত ৩০ ডিসেম্বর ২০১৫ পৌর নির্বাচন নিয়ে যা ঘটল এবং মিডিয়ায় যা প্রকাশিত হয়েছে কিংবা চ্যানেলগুলোতে যা সম্প্রচারিত হয়েছে, তা সরকার কতটুকু গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে, আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু সরকারের শরিক দল জাতীয় পার্টি যখন অনিয়ম ও কেন্দ্র দখলের অভিযোগ করে এবং ইসি ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ করে তখন সরকারের গুরুত্ব দেওয়া উচিত। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত। আমাদের সংবিধানের ১১নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ আমরা বারবার সাংবিধানিক প্রাধান্যের কথা বলি। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এই ১১নং অনুচ্ছেদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখন একটি প্রশ্ন থাকবেই পৌর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংবিধানের ১১নং ধারার মূল স্পিরিটটি কতটুকু প্রতিফলিত হয়েছে? আমরা যতই বলি ইসি স্বাধীন এবং সংবিধানের দোহাই দিই না কেন (১১৮-৪), বাস্তবতাই বলে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন নয়। আমরা যে অর্থে ভারতের নির্বাচন কমিশনকে তাদের ‘অধিকার’ চর্চা করতে দেখি, আমাদের এখানে এটা কাগজ-কলমেই তাদের ‘স্বাধীনতা’ সীমাবদ্ধ। ইসিকে অর্থের জন্য সরকারের ওপর নির্ভর করতে হয়। এর ফলে এক ধরনের নির্ভরতা তৈরি হয়। ইসি নিজে কোনো ‘বাজেট’ প্রণয়ন করতে পারে না। ইসির নিজের কোনো ‘ক্যাডার কর্মকা-’ নেই, যারা পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া নিজেরা পরিচালনা করতে পারে। পৌর নির্বাচনে প্রায় ৭০ লাখ ভোটার ছিল। জড়িত ছিল কয়েক কোটি মানুষ। এটা একটা বিশাল কর্মকা-। সরকারের সহযোগিতা তাদের প্রয়োজন ছিল আর নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সরকারি কর্মকর্তারা জড়িত হয়ে গেলে, তা সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। কেননা আমাদের সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে ‘দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা’ ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। ভালো পোস্টিং, সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার আশায় অনেকটা জ্ঞাতসারেই সরকারি দলের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেন। এই প্রবণতা খারাপ। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে এই প্রবণতা অনেক বেড়েছে। মাঠ পর্যায়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে এই ‘প্রবণতা’ বড় ধরনের প্রতিবন্ধক। ৫ জানুয়ারি (২০১৪)-পরবর্তী বাংলাদেশের চলমান রাজনীতিতে তিন তিনটি নির্বাচন হয়েছে। পাঁচ পর্যায়ে উপজেলা নির্বাচন, তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন এবং সর্বশেষ পৌরসভা নির্বাচন। তিনটি নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়নি। ভোটকেন্দ্র দখল, জালভোট প্রদান আর সহিংসতা নির্বাচনী স্পিরিটকে ধ্বংস করেছে। এখানে সুস্থ নির্বাচনী প্রতিযোগিতা হয়নি। অথচ ‘নির্বাচনী প্রতিযোগিতা’ হচ্ছে গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত। প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়েই একজন প্রার্থী তার গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ পাবেন। কিন্তু জালভোট প্রদান করলে সেই সুযোগটা আর থাকে না। তা গণতন্ত্রের স্পিরিটকেও ধ্বংস করে। তাই আগামী একাদশতম সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ন্যূনতম ইস্যুতে একটি ঐকমত্যে উপনীত হওয়া প্রয়োজন। না হলে দেশে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতা বিরাজ করবে এবং এ থেকে আমরা মুক্তি পাব না। বিএনপির জন্য সুযোগ এসেছে মূল ধারার রাজনীতিতে আরও সক্রিয় হওয়ার। বিএনপির টার্গেট থাকা উচিত ২০১৯ সালের সংসদ নির্বাচন। পৌর নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি হয়েছে, তারপরও বিএনপিকে আগামী নির্বাচন নিয়ে ভাবতে হবে। দল গোছাতে হবে। কর্মীদের উজ্জীবিত করতে হবে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বয়কট করে বিএনপি কোনো সুবিধাই ঘরে তুলতে পারেনি। সরকার সর্বক্ষেত্রে তার একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে সংসদে বিএনপির অনুপস্থিতিতে। নির্বাচন বয়কটের পেছনে যুক্তি যতই শক্তিশালী হোক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে তাদের অনুপস্থিতিতে যে সুযোগটি তৈরি হয়েছে, আওয়ামী লীগ তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছে। নির্বাচনী মাঠে কোনো দল না থাকলে আওয়ামী লীগ ‘গোল’ করবে এটাই স্বাভাবিক। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নিয়ে ‘ভুল’ করেছিল কিনা, তা আগামীতে ‘বিচার’ হবে। ইতিহাস একদিন নিশ্চয়ই তার মূল্যায়ন করবে। কিন্তু ৫ জানুয়ারি নির্বাচন-পরবর্তী যে সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে, তা আমাদের কোনো আশার কথা বলে না। আমাদের হতাশার সাগরে নিমজ্জিত করে বৈকি! আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে বাকি আছে প্রায় ৩৬ মাস। সময়টা একেবারে কম নয়। তাই ন্যূনতম কতগুলো বিষয়ে আমাদের ঐকমত্য থাকা প্রয়োজন। নির্বাচনই একমাত্র পথ, যার মাধ্যমেই সরকার পরিবর্তিত হতে হবে। বিএনপির এই উপলব্ধি নিশ্চয়ই ভালো লক্ষণ। কিন্তু নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু হয়, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। ‘জালভোট’ আর ‘সিল মারার সংস্কৃতি’ থেকে আমরা যদি বেরিয়ে আসতে না পারি তা বহির্বিশ্বে আমাদের সম্মানই শুধু ক্ষুণœ করবে না, বরং ‘আস্থার সম্পর্ক’ গড়ে উঠতে সাহায্য করবে না। আমরা সামনের দিকে তাকাতে চাই। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচন এখন অতীত। এই ‘অতীত’ নিয়ে আমরা যদি পরস্পরকে দোষারোপ করি, তাতে করে আমরা মূল লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব না। প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই দেশটিতে উন্নয়নের সুফল যদি প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চাই, তাহলে সব দলের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন। পরস্পরকে দোষারোপ করে দেওয়া বক্তব্য, আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠার পথে প্রধান অন্তরায়ই নয়, বরং তা সহিংসতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। পৌরসভা নির্বাচন সবার জন্যই একটি শিক্ষা। সরকার যদি ‘জালভোট প্রদানের’ সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে না পারে, তা সরকারকে ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করবে বটে, কিন্তু তাতে করে সত্যিকার অর্থেই একটি সুস্থ নির্বাচনী সংস্কৃতি এ দেশ থেকে হারিয়ে যাবে। তাতে করে আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারব বলে আমার মনে হয় না। ২৩ ‘সিটের’ বিএনপির জনপ্রিয়তা কি বর্তমানে এ পর্যায়ে এসেছে? প্রশ্ন এখানেই। সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাস বলে অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যেসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, এমনকি ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও বিএনপির ভোটপ্রাপ্তি ছিল শতকরা ৩৩ ভাগের ওপরে। সেই পরিসংখ্যানের সঙ্গে ‘২৩ সিট’-এর হিসাব মেলে না। একটি নির্বাচন হয়েছে। এটাকে ভালো বলা যাবে না। এই নির্বাচন এই অভিমতকে আরও শক্তিশালী করবে যে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না। আর ইসিও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে না। তারপরও সব ‘ত্রুটি’কে ফেলে দিয়ে দুটি বড় দলের মধ্যে যদি একটি আস্থার সম্পর্ক তৈরি হয়, তাহলে তা আমাদের জন্য মঙ্গল। কিন্তু আমরা আবারও হতাশার মধ্যে পড়ে যাই, যখন দেখি সৈয়দ আশরাফের ‘শান্তিপূর্ণ রাজনীতি’ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আহ্বানও প্রশ্নবিদ্ধ হয়, যখন বলা হয় বিএনপি একটি অবৈধ দল। এটা সত্য উচ্চ আদালতের একটি অভিমত ছিল জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণের ব্যাপারে। উচ্চ আদালতের রায়ের সমালোচনা করা যায় না। এতে করে আদালত অবমাননা হতে পারে। কিন্তু বিএনপিকে একটি অবৈধ দল বলা যাবে কি? লাখ লাখ লোকের উপস্থিতি (৫ জানুয়ারি ২০১৬) কি প্রমাণ করে বিএনপি একটি অবৈধ দল! উপরন্তু সংসদীয় রাজনীতিতে এই দলটির অবস্থান কি আমরা অস্বীকার করতে পারব? বিএনপি রাজনীতিতে ‘ভুল’ করতেই পারে! প্রতিটি রাজনৈতিক দলই ‘ভুল’ করে। আওয়ামী লীগও যে ‘ভুল’ করছে না, তাও বলা যাবে না! রাজনীতিতে ‘ভুল’ করলে তার জন্য মাসুল দিতে হয়। বিএনপি সেই মাসুুল দিচ্ছে এখন! কিন্তু বিএনপিকে পুরোপুরি অস্বীকার করা যাবে না। বিএনপিকে আস্থায় নিয়েই গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ইতোমধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে ‘নানা অভিযোগ’ উঠেছে। কোনো কোনো মন্ত্রীর বক্তব্যে এমনটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, সরকার হয়তো ‘নতুন এক বিএনপিকে’ দেখতে চায়, যেখানে নেতৃত্বে বেগম জিয়া ও তারেক রহমান থাকবেন না! এর পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে, তা প্রমাণ করা যাবে না। কিন্তু বেগম জিয়া কিংবা তারেক রহমান বিএনপির নেতৃত্বে থাকবেন কিনাÑ এটা বিএনপির অভ্যন্তরীণ বিষয়। সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য না করাই মঙ্গল। এতে করে বিভ্রান্তি বাড়তে পারে। সময়ই বলে দেবে এ দেশের রাজনীতিতে বিএনপির অবস্থান কী হবে! তবে বাস্তবতা হচ্ছে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টির যে সম্ভাবনা ছিল, সেই সম্ভাবনা জাতীয় পার্টি পূরণ করতে পারেনি। সংসদে জাতীয় পার্টি আছে বটে, কিন্তু তাদের কর্মকা- সরকারি না বিরোধী দলে, তা আজ অবধি নিশ্চিত হয়নি। ফলে সংসদের বিরোধীদলীয় রাজনীতিতে রয়ে গেছে প্রচ- এক ‘শূন্যতা’। গণতন্ত্রের স্বার্থেই প্রয়োজন একটি শক্তিশালী বিরোধী দল। বিএনপি এই ‘শূন্যতা’ পূরণ করতে পারে। কিন্তু বিএনপিকে অবৈধ দল হিসেবে আখ্যায়িত করলে আস্থার সম্পর্কটা আর থাকে না। আওয়ামী লীগ আর বিএনপি দুটি বড় দল। এর বাইরে আরও দল রয়েছে, যা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উন্নয়নে অবদান রাখছে। ফলে আস্থার সম্পর্ক বৃদ্ধি পেলে গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব। তাই ‘সকল দলের অংশগ্রহণে’ একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে দুটি বড় দলসহ সব দলের মধ্যে বিরোধ যত দ্রুত কমিয়ে আনা যায়, ততই আমাদের সবার জন্য মঙ্গল। Daily Amader Somoy 17.1.16

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়নের প্রশ্নটি এখন বহুল আলোচিত একটি বিষয়। সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তান সরকারের বেশ কিছু আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে দুই দেশের সম্পর্ক সর্বনিম্ন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। পাকিস্তান সরকারের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে বাংলাদেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে এবং বিভিন্ন মহল থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি জানানো হয়েছে। পাকিস্তান সরকার ইসলামাবাদস্থ বাংলাদেশের কাউন্সিলর মৌসুমি রহমানকে প্রত্যাহারের অনুরোধ করায় বাংলাদেশ তাঁকে পর্তুগালের রাজধানী লিসবন দূতাবাসে ট্রান্সফার করে। ধারণা করা হয়, জঙ্গি কানেকশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় পাকিস্তান দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারি ফারিনা আরশাদকে প্রত্যাহার করার বাংলাদেশের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই পাকিস্তান এই কাজটি করল। অথচ মৌসুমি রহমানের বিরুদ্ধে কোনো অকূটনৈতিক আচরণের প্রমাণ পাকিস্তান উপস্থাপন করতে পারেনি। অন্যদিকে জেএমবির এক শীর্ষ নেতার স্বীকারোক্তিতে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ফারিনা আরশাদের মাধ্যমে জেএমবিকে অর্থ সহায়তা করত। শুধু তা-ই নয়, এর আগে পাকিস্তান দূতাবাসের কর্মকর্তা মাজহার খান ভারতীয় জাল টাকাসহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পরে পাকিস্তান তাঁকে প্রত্যাহার করে নেয়। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির আদেশ কার্যকর করার পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ওই ঘটনাকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। ওই ঘটনায় তারা যে ‘উদ্বিগ্ন’ এবং ‘বেদনাগ্রস্ত’—এ কথাটাও তারা উল্লেখ করতে ভোলেনি। এর চেয়েও পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছিল—যখন তারা বলেছিল, ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ বা নৃশংসতার কোনো ঘটনা ঘটেনি এবং এ ধরনের ঘটনার জন্য পাকিস্তানের কোনো দায় ছিল না।’ কী ধৃষ্টতাপূর্ণ কথা! যেখানে সারা বিশ্ব জানে নৃশংসতার কথা, সেখানে পাকিস্তান তাদের সেই ‘কালো ইতিহাস’ বদলে দিতে চায়। পাকিস্তানের এ ধরনের আচরণ জাতিসংঘ সনদের ৭ নম্বর ধারার পরিপন্থী। ওই ধারা অনুযায়ী পাকিস্তানের কোনো অধিকার নেই বাংলাদেশের কোনো অভ্যন্তরীণ ঘটনায় মন্তব্য বা সমালোচনা করার। ফলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই বক্তব্যটি বাংলাদেশের মানুষ গ্রহণ করে নেয়নি। বিভিন্ন মহল থেকে এর সমালোচনা করা হয়েছে। ঢাকাস্থ পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরের পর বাংলাদেশের বিজয় দিবসে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল। বাংলাদেশ তখনো এর প্রতিবাদ জানিয়েছিল। আবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাল পাকিস্তান। আসলে ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের যে ৪১ বছরের ইতিহাস, এই ইতিহাস সব সময় ‘আস্থা ও বিশ্বাসের’ নিরিখে পরিচালিত হয়েছে—এটা বলা যাবে না। এ সম্পর্ক উজ্জ্বল ছিল—এটাও বলা যাবে না। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেসব জটিলতা ছিল তার সমাধান হয়নি এত দিন পরও। ফলে দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন ছিলই। একটি মুক্তিযুদ্ধ ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ বিজয়ী হয়েছিল এবং বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটির আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। ৩০ লাখ শহীদ, দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তান মুক্তিযুদ্ধের প্রতি কখনোই সম্মান জানায়নি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল তার জন্য ক্ষমাও চায়নি কোনো দিন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবার ক্ষমা চাওয়ার কথা বলা হলেও পাকিস্তানের নেতারা তা করেননি। এমনকি পাকিস্তানের অনেক বুদ্ধিজীবী ও সুধীসমাজের প্রতিনিধিরা পাকিস্তান সরকারের প্রতি ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানালেও পাকিস্তানে অতীতে কোনো সরকারই এ কাজটি করেনি। বরং পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘এসব পুরনো কথা’ এবং এসব ভুলে সামনের দিকে তাকাতে বলা হয়েছে। কিন্তু একাত্তরে গণহত্যার কথা বাংলাদেশের মানুষ ভুলে যায় কিভাবে? পাকিস্তানের সরকার কিংবা শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলো এই গণহত্যা স্বীকার করে না তাদের দলীয় স্বার্থে। কিন্তু শুভবুদ্ধির কিছু মানুষ আছে, যারা গণহত্যার কথা স্বীকার করে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যখন গণহত্যার কথা অস্বীকার করছে, ঠিক তখনই ঢাকায় পাকিস্তানের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ ও সাউথ এশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটসের চেয়ারপারসন হিনা জিলানি স্বীকার করেছেন—মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিবাদ জানিয়েছে দেশটির নাগরিকদের একটি অংশ। তিনি ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা স্বীকার করেন (যায়যায়দিন ৭ ডিসেম্বর ২০১৫)। ফলে পাকিস্তানের শাসকচক্র ১৯৭১ সালের গণহত্যার কথা স্বীকার না করলেও সুধীসমাজের একটা অংশ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম মনে করে সেনাবাহিনী গণহত্যা চালিয়েছিল। এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় যেসব সমস্যা ছিল তার সমাধান হয়নি একটিরও। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একাধিবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও পাকিস্তান কোনো ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় পাকিস্তান এসব প্রশ্ন এড়িয়ে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে এমন কথাও আমরা শুনেছি যে বিরাজমান সমস্যাগুলো ‘ডেড ইস্যু’ অর্থাৎ ওগুলো মূল্যহীন! ১৯৭৪ থেকে ২০১৬ সাল সময়টা অনেক লম্বা। এত দীর্ঘ সময়ে দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান সমস্যাগুলোর পূর্ণ সমাধান হয়েছে, তা বলা যাবে না। পাকিস্তানের কাছে পাওনা সম্পদ ফেরত, বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানি নাগরিকদের পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তন, বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে অগ্রগতি তেমন হয়নি। পাকিস্তানের কাছে পাওনা সম্পদের বিষয়টি একাধিকবার বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা হলেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। ১৯৭৪ সালে প্ল্যানিং কমিশন ২৪৪৬ কোটি টাকা পাওনা দাবি করে একটি রিপোর্ট প্রণয়ন করেছিল। ১৯৭১ সালের যুক্ত পাকিস্তানের সম্পত্তি, জনসংখ্যা, সংখ্যাসাম্য নীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও সম্পদের পরিমাণ হিসাব করে ওই পাওনা টাকার দাবি উত্থাপন করা হয়েছিল। গত ৪০ বছরে এ ব্যাপারে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। বাংলাদেশ বিভিন্ন সময়ে এই দাবি উত্থাপন করলেও পাকিস্তান এ ব্যাপারে কোনো উত্সাহ দেখায়নি। তবে ‘বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ’ পাকিস্তান বাংলাদেশ বিমানকে একটি পুরনো টাইপের বোয়িং বিমান দিয়েছিল। কিন্তু যুক্ত পাকিস্তানের সম্পদের তুলনায় তা কিছুই নয়। ১৯৮৯ সালে পাকিস্তানের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের সময় পাকিস্তান নীতিগতভাবে এ ব্যাপারে একটি ‘কাউন্সিল’ গঠন করতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু এ ব্যাপারেও পরবর্তী সময়ে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারেও তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। এই আটকে পড়া পাকিস্তানি নাগরিকরা ‘বিহারি’ হিসেবে পরিচিত। এসব পাকিস্তানি নাগরিক এখনো পাকিস্তানে যেতে চায়। এটা সত্য, কিছু আটকে পড়া পাকিস্তানি ইতিমধ্যে পাকিস্তানে চলে গেছে। প্রায় দুই লাখ পাকিস্তানি এখনো ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বসবাস করছে। ১৯৮৫ সালে পাকিস্তানের তত্কালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক এদের নিতে রাজি থাকলেও পরবর্তী সময়ে বেনজির ভুট্টোর বিরোধিতার কারণে এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া থেমে যায়। ভুট্টো এদের পাকিস্তানি বলতেও রাজি ছিলেন না। সাম্প্রতিক সময়ে এ ব্যাপারে তেমন কিছু শোনা যায় না। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যেভাবে অগ্রগতি হওয়ার কথা ছিল তা-ও হয়নি। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে পাকিস্তানের রপ্তানির পরিমাণ বেড়েছে ২৭.৬ শতাংশ হারে। অথচ বাংলাদেশ থেকে আমদানি বেড়েছে মাত্র ৯.২ শতাংশ হারে। দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্যের পরিমাণও কমতির দিকে। ২০১০-১১ সময় সীমান্ত বাণিজ্যের পরিমাণ যেখানে ছিল ৯৮৩ মিলিয়ন ডলার, বর্তমানে তা নেমে এসেছে মাত্র ৩৪০ মিলিয়ন ডলারে। আসলে পাকিস্তান আমাদের জন্য আদৌ কোনো মডেল নয়। পাকিস্তানে আমাদের পণ্যের বড় বাজারও নেই। সামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে সব ক্ষেত্রেই এগিয়ে আছে। যেখানে বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬.২ শতাংশ, সেখানে পাকিস্তানে এর পরিমাণ মাত্র ৩.৬ শতাংশ। যেখানে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ৩০.১ বিলিয়ন ডলার, সেখানে পাকিস্তানে এর পরিমাণ মাত্র ২৪.৫ বিলিয়ন। শিশুমৃত্যুর হার (হাজারে) বাংলাদেশে ৩৭ আর পাকিস্তানে ৫৯। শান্তিসূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৮তম আর পাকিস্তানের ১৫৪তম। রিজার্ভের পরিমাণ আমাদের ২৭ বিলিয়ন ডলার, পাকিস্তানে এর পরিমাণ মাত্র ১৪ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশে ৫৬ শতাংশ মানুষের স্যানিটেশন সুবিধা আছে। পাকিস্তানের আছে মাত্র ৪৮ শতাংশ। বাংলাদেশের শিক্ষিতের হারও পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। তাই পাকিস্তান আমাদের জন্য কখনোই কোনো মডেল নয়। বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সার্ক, কমনওয়েলথ, ডি-৮ কিংবা ওআইসিসহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থায় জড়িত। এ ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরো দৃঢ় থাকার কথা থাকলেও তা হয়নি। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় পাকিস্তান যখন ‘হস্তক্ষেপ’ করে তখন দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরো অবনতি হতে বাধ্য। বাংলাদেশের মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পাকিস্তানিদের নেতিবাচক প্রচারণাকে সহ্য করবে না। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব আরো শক্তিশালী হবে। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গর্ব করে। পাকিস্তান এখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন তুলে আমাদের আত্মসম্মানবোধে আঘাত করেছে। তাদের এই আচরণ বন্ধুসুলভ নয়। তাই বিভিন্ন মহল থেকে যে প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে, তা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার সময় এখনো আসেনি। তবে বাংলাদেশ ইসলামাবাদে তার দূতাবাসের কর্মকাণ্ড সীমিত করতে পারে। দূতাবাসে কনস্যুলার পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব রাখা যেতে পারে। কূটনীতিকদের সংখ্যা কমিয়ে এনে পাকিস্তানকেও বলা যেতে পারে তাদের কূটনীতিকদের সংখ্যা কমাতে। এ বছরের শেষ দিকে ইসলামাবাদে সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার এই সম্মেলনে অংশ নেওয়ার কথা। এ ক্ষেত্রে সরকারপ্রধান নন, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সম্মেলনে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ তার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি মেসেজ দিতে পারে। পাকিস্তান সরকার মূলত পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর স্বার্থ রক্ষা করছে। আর এ জন্যই তারা মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সেনাবাহিনীর অত্যাচারকে অস্বীকার করছে। তবে সুধীসমাজের একটা অংশ এমনটা মনে করে না। তাই সুধীসমাজের ওই অংশের সঙ্গে আমরা সম্পর্ক রাখতে পারি। মোদ্দাকথা, পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন রয়েছে। daily Kalerkontho 17.1.16

সৌদি-ইরান দ্বন্দ্ব ও উপসাগরীয় অঞ্চলের রাজনীতি

পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) জঙ্গিদের উত্থান নিয়ে সারা বিশ্ব যখন উদ্বিগ্ন, তখন ইরান-সৌদি আরব দ্বন্দ্ব নতুন করে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে উত্তেজনা বাড়িয়েছে। যদিও ঐতিহাসিকভাবেই শিয়া ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে সুন্নি ধর্মাবলম্বীদের দ্বন্দ্ব-বিভেদ রয়েছে। এ নিয়ে অতীতে এ অঞ্চলে অনেক হিংসাত্মক ঘটনারও জন্ম হয়েছে। কিন্তু বোধকরি এবারের এই দ্বন্দ্বের মাত্রাটা একটু ভিন্ন ধরনের। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার বোমাবর্ষণের পরও যখন সিরিয়া ও ইরাক থেকে আইএসের জঙ্গিদের উৎখাত করা যাচ্ছে না, তখন শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব উসকে দিয়ে কোন ‘পক্ষ’ এখান থেকে কী সুবিধা নিতে চায়- এ প্রশ্নও কোনো কোনো মহল থেকে উচ্চারিত হয়েছে। শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে, যা আগামী দিনের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। ইরান তার জলসীমায় ‘অনুপ্রবেশের অভিযোগে’ ২টি জলযানসহ ১০ মার্কিন মেরিনকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল (যাদের পরবর্তীকালে ছেড়ে দেয়া হয়েছে)। এর আগে একটি মার্কিন জাহাজ লক্ষ্য করে ইরানি মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এ ধরনের ঘটনা নয়া ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে প্রশ্নবিদ্ধ করতে বাধ্য। ইরানের সঙ্গে ৬ জাতি আলোচনায় যে ‘পারমাণবিক সমঝোতা’ হয়েছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে চলতি জানুয়ারি মাসে ইরানের ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়ার কথা। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে কয়েকশ’ বিলিয়ন ডলারের ইরানি ‘সম্পদ’ জব্দ করা হয়েছিল। সেই আদেশও প্রত্যাহার করে নেয়ার কথা। কিন্তু সেখানে এখন জটিলতা আসতে পারে। উপসাগরীয় অঞ্চলের জ্বালানি তেলের ওপর ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র নির্ভরশীল। সেই জ্বালানি তেলের মূল্য এখন ব্যারেলপ্রতি ৩০ ডলারের নিচে নেমে এসেছে। নিঃসন্দেহে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে। শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বের রেশ ধরে সৌদি আরব ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। এদিকে সম্প্রতি সৌদি আরবের নেতৃত্বে একটি ‘সামরিক জোট’ গঠিত হয়েছে (বাংলাদেশ যার সদস্য), যদিও বলা হচ্ছে এ ‘জোটটি’ শুধু সন্ত্রাসবিরোধী একটি কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে এবং জোট কার্যত একটি তথ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করবে, যার মাধ্যমে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সংক্রান্ত তথ্য আদান-প্রদান করা হবে। কিন্তু বাস্তবে এটি শুধু একটি তথ্য বিনিময় কেন্দ্র হিসেবেই থাকবে, নাকি সত্যিকার অর্থে একটি সামরিক জোট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে, এ প্রশ্ন থাকলই। ইতিমধ্যে সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী পাকিস্তান সফর করেছেন এবং অত্যন্ত ক্ষমতাধর পাক সেনাপ্রধানের সঙ্গে তার আলোচনাও হয়েছে। ফলে একটি সামরিক জোট গঠনের সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। ফলে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোট নিয়ে প্রশ্ন থাকলই। এই জোট গঠন ও এ অঞ্চলের রাজনীতিতে সৌদির ভূমিকা একই সূত্রে গাঁথা। ফলে সৌদি শিয়া সম্প্রদায়ের নেতা নিমর আল-নিমরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা নিয়ে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে, তা হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। এর ফলে, অর্থাৎ শিয়া-সুন্নিদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও বিভেদ উপসাগরের অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়বে। এখানে একটা কথা বলা দরকার, পারস্য উপসাগরভুক্ত অঞ্চলে সুন্নিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ অঞ্চলের জনসংখ্যার ৫৬ ভাগ সুন্নি সম্প্রদায়ভুক্ত, আর ৩৬ ভাগ শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত। এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে ইরান, ইরাক, লেবানন, ইয়েমেন আর বাহরাইনে শিয়া সম্প্রদায়ের লোক বেশি বাস করে। যেমন- বলা যেতে পারে, ইরানে যেখানে ৮৫ ভাগ লোক শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত, সেখানে সুন্নি মাত্র ১৫ ভাগ। ইরাকে ৬৩ ভাগ শিয়া, ৩২ ভাগ সুন্নি। সিরিয়ায় ১৫ ভাগ শিয়া, আর ৭৩ ভাগ সুন্নি। বাহরাইনে ৭৫ ভাগ শিয়া, ২৫ ভাগ সুন্নি। ইয়েমেনে ৪৪ ভাগ শিয়া, ৫৬ ভাগ সুন্নি। মজার ব্যাপার হল, বাহরাইনে শিয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের কোনো ভূমিকা নেই। সুন্নি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে খলিফা হামাদ ও তার পরিবার সেখানে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায়। সিরিয়ার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদ আলাউট সম্প্রদায়ের লোক। আলাউট সম্প্রদায় শিয়াদের একটি উপশাখা। একটি গোত্র। এই গোত্র সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। বাসার আল আসাদের বাবা হাফিজ আল আসাদও সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সিরিয়া ও ইরাকে একসময় বামমনা বাথ পার্টি গঠিত হয়েছিল। হাফিজ আল আসাদ সেনাবাহিনীর লোক হয়েও বাথ পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ২০০০ সালে তার স্বাভাবিক মৃত্যু হলে তার ছেলে বাসার আল আসাদকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছিল। ইরাকে সাদ্দাম-পরবর্তী জমানায় শিয়ারা ক্ষমতা পরিচালনা করলেও সাদ্দামের (সুন্নি) সময় শিয়ারা ছিলেন উপেক্ষিত। এখন ইরাকে শিয়ারা ক্ষমতায়। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন। শিয়া নেতা নিমর আল-নিমরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হল এমন একটি সময় যখন এ অঞ্চলে সৌদি আরবের নেতৃত্বে একটি সামরিক জোট গঠিত হয়েছে। এ জোট গঠনকে ইরান ভালো চোখে দেখেনি। খুব সঙ্গত কারণেই এই সামরিক জোটটি গঠনের প্রেক্ষাপট আলোচনার দাবি রাখে। এই সৌদি জোট অনেক প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এল এখন। সৌদি আরব নিজে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে অন্যতম ‘অ্যাক্টর’ অর্থাৎ অন্যতম নির্ধারক হিসেবে নিজেকে দেখতে চায়। অতীতের কোনো সৌদি বাদশাহ এভাবে সৌদি পররাষ্ট্রনীতি ও নিরাপত্তা ইস্যুতে এমন বড় ভূমিকা পালন করেননি। কিন্তু বর্তমান বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের ‘অ্যাপ্রোচ’ একটু ভিন্ন। তিনি সৌদি আরবকে দেখতে চান এ অঞ্চলের রাজনীতির অন্যতম নির্ধারক হিসেবে। তাই তার নেতৃত্বে একটি সামরিক জোটের প্রয়োজন ছিল। সৌদি আরব পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে তার প্রভাব বাড়াতে চায়। এর প্রকাশ হিসেবে আমরা দেখেছি ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে সৌদি আরবের হস্তক্ষেপ তথা সৌদি বিমানবাহিনীর ইয়েমেনে বোমাবর্ষণের মধ্য দিয়ে। এর আগে লেবাননের গৃহযুদ্ধে সৌদি ট্যাংকবহরকে আমরা লেবাননে প্রবেশ করতে দেখেছি। অতীতে কুয়েতের আমীর যখন ইরাকি সেনাদের দ্বারা উৎখাত হন (১৯৯০), তখন সৌদি আরব আমীরকে আশ্রয় দিয়েছিল বটে, কিন্তু আমীরের সমর্থনে কোনো সেনা বা বিমান পাঠায়নি। ২০১১ সালে তিউনিসিয়ায় ‘জেসমিন বিপ্লব’ জাইন আল-আবেদিন বেন আলিকে ক্ষমতাচ্যুত করলে এবং তিনি সৌদি আরবে আশ্রয় নিলেও সৌদি আরব তিউনিসিয়ায় হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ ক্ষমতাসীন হয়ে সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনেন। তারই ফলস্বরূপ নতুন এক সৌদি আরবকে আমরা দেখছি। সৌদি আরবের নীতিনির্ধারকদের বরাবরই একটা বড় ভয় ইরানকে নিয়ে। পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের রাজনীতিতে ইরানের ভূমিকা বাড়ছে এবং ইরানের এই ভূমিকাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন স্বীকারও করে। ইরানের সঙ্গে ৬ জাতি পারমাণবিক চুক্তি, ইরানের ধর্মীয় নেতা খামেনিকে ওবামার গোপন চিঠি লেখা ইত্যাদি প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে ইরানের ভূমিকাকে স্বীকার করে নিয়েছে। ৬ জাতি সমঝোতা অনুযায়ী ইরানের ওপর থেকে ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়া হলে ইরান আবারও একটি ‘শক্তি’ হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে। অতীতে ইরানি বিপ্লবের আগে (১৯৭৯), রেজা শাহ পাহলভির সময়ে ইরানের ভূমিকাকে ‘পারস্য অঞ্চলের পুলিশের’ ভূমিকার সঙ্গে তুলনা করা হতো। ইরান সেই ভূমিকায় আবার ফিরে যাচ্ছে। সৌদি আরবের ভয়টা এখানেই। ইরানের উত্থান সৌদি আরবসহ এ অঞ্চলের শিয়া সম্প্রদায়কে আরও বেশি উৎসাহিত করবে। সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটে সিরিয়াকে রাখা হয়নি। সবাই জানেন, সৌদি আরব চাচ্ছে সিরিয়ায় আসাদের উৎখাত। কিন্তু সৌদি পছন্দের তালিকায় আইএসও নেই। সম্প্রতি আসাদবিরোধী দলগুলোর একটি সম্মেলন হয়ে গেল রিয়াদে। সেখানে এমন অনেক দল অংশ নিয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ আছে। সে ক্ষেত্রে সৌদি আরবের ভূমিকা কী হবে এসব দল ও জোটের বিরুদ্ধে? অনেকেই জানেন, সিরিয়া ও ইরাকের একটা অংশ নিয়ে ইসলামিক স্টেটের নেতৃত্বে ‘সুন্নিস্তান’ নামে তথাকথিত একটি জিহাদি রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে, যারা ওয়াহাবি মতাদর্শ ও আদি ইসলামিক রাষ্ট্রের ধ্যান-ধারণায় পরিচালিত হচ্ছে। সৌদি রাষ্ট্রের ভিত্তিই হচ্ছে এই ওয়াহাবি মতাদর্শ। সুতরাং আপাতদৃষ্টিতে আইএসের সঙ্গে সৌদি নীতিনির্ধারকদের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও আদর্শগতভাবে মিল তো আছেই। সে ক্ষেত্রে সৌদি-আইএস সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। আরও একটা কথা বলা দরকার। ইরাক ও সিরিয়ার তেলের কূপগুলোর একটা বড় অংশ ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। কালোবাজারে আইএস এই তেল বিক্রি করে। দৈনিক তাদের গড় আয় ২ মিলিয়ন ডলার। আর এ কারণেই আইএস পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী জঙ্গিগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। এই তেল তুরস্কের মধ্য দিয়ে অন্যত্র যায়। ইসরাইল এই তেলের অন্যতম ক্রেতা। এই তেল নিয়েই সেখানে একটি ‘যুদ্ধের’ সম্ভাবনা বাড়ছে। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে যাওয়ায় বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের আয় কমে যাচ্ছে। একটি ‘যুদ্ধ’ শুরু না হলে তেলের দাম বাড়ানো যাবে না। তাই ধারণা করছি, একটি যুদ্ধ সেখানে আসন্ন। পাঠকদের উপসাগরীয় অঞ্চলের তেলের গুরুত্ব সম্পর্কে একটি ধারণা দিতে চাই। ইরান ও সৌদি আরবের মাঝখানে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ যা ‘স্ট্রেইট অব হরমুজ’ (হরমুজ প্রণালী) নামে পরিচিত। এই সমুদ্রপথটি তেল সরবরাহের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বে সমুদ্রপথে যে পরিমাণ তেল পরিবহন করা হয় (প্রতিদিন ৫৬ দশমিক ৫ মিলিয়ন ব্যারেল), তার ২০ ভাগ (১৭ মিলিয়ন ব্যারেল) এই পথে পরিবাহিত হয়। ২০০৯ সালে এর পরিমাণ ছিল ১৫ দশমিক ৭ মিলিয়ন ব্যারেল (প্রতিদিন)। এখন তা বেড়েছে ১৭ মিলিয়ন ব্যারেলে (২০১৩)। ২০১৬ সালের পরিসংখ্যান নিলে দেখা যাবে, তা প্রায় ২০ মিলিয়ন ব্যারেলে উন্নীত হয়েছে। প্রায় ৩ দশমিক ২ কিলোমিটার দীর্ঘ হরমুজ প্রণালীর অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করে ইরানি নৌবাহিনী। যে কোনো সংকটে ইরান যদি এই জ্বালানি তেল সরবরাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তাহলে তা বিশ্ব অর্থনীতিকে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দেবে। সৌদি আরবে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্রের বাজার। উত্তেজনা বাড়লে এ অঞ্চলে মার্কিন অস্ত্র ব্যবসা বাড়বে, যা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে। যারা আন্তর্জাতিক রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন তারা জানেন, যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে আরও বেশ কটি সামরিকঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে। এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত হয়েছে। পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়ছে। একদিকে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের উৎখাতে ব্যর্থতা, অন্যদিকে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব এবং ইরানের নতুন করে ‘পারস্য অঞ্চলের পুলিশের’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া এ অঞ্চলের রাজনীতির চিত্রকে বদলে দিয়েছে। একুশ শতকে এ অঞ্চল প্রত্যক্ষ করবে এক ‘নয়া স্নায়ুযুদ্ধ’। ‘আরব বসন্ত’ যে প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছিল, তা এখন ‘মৃত’। সিরিয়া সংকটের দ্রুত সমাধান হবে, এটা মনে করারও কোনো কারণ নেই। তাই ২০১৬ সাল এ অঞ্চলের রাজনীতির জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন রাজনীতিতে একটি কট্টরপন্থী মনোভাব শক্তিশালী হচ্ছে। এই মনোভাব যদি রিপাবলিকানদের ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হতে সাহায্য করে, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে চতুর্থ যুদ্ধের (আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া) সম্ভাবনা বাড়বেই। Daily Jugantor 17.1.16

আদৌ কি আস্থার সম্পর্ক তৈরি হবে?

গত ৫ জানুয়ারি মঙ্গলবার দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ঢাকায় একাধিক জনসভার আয়োজন করে। দুটি বড় দলই এ দিনটি পালন করেছে ভিন্নভাবে। যেখানে আওয়ামী লীগ এ দিনটি পালন করেছে 'গণতন্ত্রের বিজয়' দিবস উপলক্ষে, সেখানে বিএনপি এ দিনটি পালন করেছে 'গণতন্ত্র হত্যা' দিবস উপলক্ষে। কিন্তু ওইদিন বেগম জিয়া একটি 'সংলাপ' ও দ্রুত একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আহ্বান জানালেও আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা বেগম জিয়াকে বাদ দিয়ে বিএনপিকে সংগঠিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ফলে ৫ জানুয়ারি (২০১৪) নির্বাচন সামনে রেখে এ দুটি বড় দলের মধ্যে যে বিভেদ, বিদ্বেষ আর আস্থাহীনতা, তা রয়ে গেল। এমনকি ৩০ ডিসেম্বর দেশে পৌরসভা নির্বাচন হয়ে গেছে। ওই নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত বিএনপি থাকলেও একটি ভালো ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়নি। ভোট কেন্দ্র দখল, জাল ভোট প্রদান আর সহিংসতার মধ্য দিয়ে পৌরসভা নির্বাচনটি শেষ হয়েছে বটে, কিন্তু আমাদের নির্বাচনী সংস্কৃতির জন্য রেখে গেছে একটা বড় প্রশ্ন। এর মধ্য দিয়ে আগামী দিনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কিনা, সে প্রশ্ন থাকলই। বিএনপি ইতোমধ্যে পৌর নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে এবং সরকারের পদত্যাগ দাবি করেছে। সংবাদপত্রগুলো ৩১ ডিসেম্বর বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রের যে ছবি ছেপেছে তা একটি শুদ্ধ নির্বাচনের ধারণাকে সমর্থন করে না। কিন্তু তার পরও এ নির্বাচন অনেক 'সাফল্য' দাবি করতে পারে। এ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থেকেছে। মিডিয়ার কারণে দুপুরের আগেই কোথাও কোথাও সহিংসতা, জাল ভোট প্রদান, ভোট কেন্দ্র দখলের খবর এলেও বিএনপি নির্বাচন বর্জনের কথা বলেনি। বরং দুবার নির্বাচন কমিশনে গিয়ে তাদের 'প্রতিবাদ' লিপিবদ্ধ করেছে। এর মধ্য দিয়ে 'সব দলের অংশগ্রহণ' নিশ্চিত করে নির্বাচন কমিশন একটি বাহ্বা নিতেই পারে। নির্বাচনে নারীরা সেই সকালেই প্রায় প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। এটা নিঃসন্দেহে একটা প্লাস পয়েন্ট। এবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কোনো খবর আমরা পাইনি। অথচ আমাদের অভিজ্ঞতা বলে অতীতে প্রায় প্রতিটি নির্বাচনের আগে ও পরে বিশেষ জাতিগোষ্ঠীর লোকদের ওপর হামলা হয়েছে। তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এবার তেমনটি হয়নি। এটা একটা প্লাস পয়েন্ট। এবারো বেসরকারি নির্বাচক পর্যবেক্ষকরা প্রায় সবাই পৌর নির্বাচনকে শতকরা একশভাগ শুদ্ধ হয়েছে বলে স্বীকার করেননি। তবে বলেছেন, তুলনামূলক বিচারে ভালো হয়েছে। নির্বাচন কমিশন বলেছে শতকরা ৭৩ ভাগ ভোট পড়েছে। এটা নিঃসন্দেহে উৎসাহব্যঞ্জক। কিন্তু ছোট ছোট 'ঘটনা' যেমনি বড় অর্জনকে মস্নান করে দেয়, ঠিক তেমনি পৌর নির্বাচন সম্পন্ন করতে ইসির সফলতার চেয়ে ইসির সীমাবদ্ধতাই বেশি ফুটে উঠেছে। এ নির্বাচনের পর এ প্রশ্নটিই এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে দলীয় সরকারের অধীনে এ দেশে আগামীতে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আদৌ সম্ভব কিনা? ৫ জানুয়ারির (২০১৪) জাতীয় সংসদ (দশম) নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন (শেষের তিনটি) এবং সর্বশেষ পৌরসভা নির্বাচন প্রমাণ করল নির্বাচন কমিশনের অসহায়ত্ব। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (২০১৪) ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেটা ছিল সংসদীয় রাজনীতির একটি 'কালো অধ্যায়'। তখন এর সঙ্গে যোগ হলো সাতজন মেয়রের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনের খবর। এটা কোনো ভালো খবর নয়। ইসি এ ব্যাপারে আদৌ তদন্তের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এ ঘটনা ইসির ভূমিকাকে আবারো প্রশ্নবিদ্ধ করল। প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের সভাপতির এখতিয়ার বলে নিজ স্বাক্ষরে দলীয় মনোনয়ন দিয়েছিলেন। অন্যদিকে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন স্থানীয় পর্যায়ের সরকারি আমলারা। এ ক্ষেত্রে সরকারি দলের প্রার্থীদের বিজয় নিশ্চিত করতে রিটার্নিং তথা সহকারী রিটার্নিং অফিসারদের ওপর যে এক ধরনের মনস্তাত্তি্বক চাপ ছিল তা কি অস্বীকার করা যাবে?
পৌর নির্বাচন নিয়ে যা 'ঘটল' মিডিয়ায় যা প্রকাশিত হয়েছে, কিংবা চ্যানেলগুলোতে যা সম্প্রচারিত হয়েছে তা সরকার কতটুকু গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে, আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু সরকারের শরিক দল জাতীয় পার্টি যখন অনিয়ম ও কেন্দ্র দখলের অভিযোগ করে এবং ইসি ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ করে তখন সরকারের গুরুত্ব দেয়া উচিত। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত। আমাদের সংবিধানের ১১ নাম্বার ধারায় বলা হয়েছে, 'প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।' আমরা বার বার সাংবিধানিক প্রাধান্যের কথা বলি। তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এই ১১ নাম্বার অনুচ্ছেদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখন একটি প্রশ্ন থাকবেই, পৌর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংবিধানের ১১ নাম্বার ধারার মূল স্পিরিটটি কতটুকু প্রতিফলিত হয়েছে? আমরা যতই বলি ইসি স্বাধীন এবং সংবিধানে দোহাই দিই না কেন (১১৮-৪), বাস্তবতাই বলে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন নয়। আমরা যে অর্থে ভারতের নির্বাচন কমিশনকে তাদের 'অধিকারচর্চা' করতে দেখি আমাদের এখানে কাগজে-কলমেই তাদের 'স্বাধীন' সীমাবদ্ধ। ইসিকে অর্থের জন্য সরকারের ওপর নির্ভর করতে হয়। এর ফলে এক ধরনের নির্ভরতা তৈরি হয়। ইসি নিজে কোনো 'বাজেট' প্রণয়ন করতে পারে না। ইসির নিজের কোনো 'ক্যাডার' কর্মকা- নেই, যারা পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া নিজেরা পরিচালনা করতে পারে। পৌর নির্বাচনে প্রায় ৭০ লাখ ভোটার ছিল। জড়িত ছিল কয়েক কোটি মানুষ। এটা একটা বিশাল কর্মযজ্ঞ। সরকারের সহযোগিতা তাদের প্রয়োজন ছিল আর নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সরকারি কর্মকর্তারা জড়িত হয়ে গেলে, তা সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। কেননা আমাদের সরকারি কর্মকর্তাদের মাঝে 'দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা' ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। আমলারা ভালো পোস্টিং, সুযোগ-সুবিধা নেয়ার আশায় অনেকটা জ্ঞাতসারেই সরকারি দলের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেন। এ প্রবণতা খারাপ। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে এ প্রবণতা অনেক বেশি বেড়েছে। মাঠ পর্যায়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে এ 'প্রবণতা' বড় ধরনের প্রতিবন্ধক।
৫ জানুয়ারি (২০১৪)-পরবর্তী বাংলাদেশের চলমান রাজনীতিতে তিনটি নির্বাচন হয়েছে। পাঁচ পর্যায়ে উপজেলা নির্বাচন, তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচন এবং সর্বশেষ পৌরসভা নির্বাচন। তিনটি নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়নি। ভোট কেন্দ্র দখল, জাল ভোট প্রদান আর সহিংসতা নির্বাচনী স্পিরিটকে ধ্বংস করেছে। এখানে সুস্থ নির্বাচনী প্রতিযোগিতা হয়নি। অথচ নির্বাচনী প্রতিযোগিতা হচ্ছে গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত। প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়েই একজন প্রার্থী তার গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ পাবেন। কিন্তু জাল ভোট প্রদান করলে সে সুযোগটা আর থাকে না। এবং তা গণতন্ত্রের স্পিরিটকেও ধ্বংস করে। তাই আগামী একাদশতম সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নূ্যনতম ইস্যুতে একটি ঐকমত্যে উপনীত হওয়া প্রয়োজন। না হলে দেশে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতা বিরাজ করবে এবং এ থেকে আমরা মুক্তি পাব না।
বিএনপির জন্য সুযোগ এসেছে মূলধারার রাজনীতিতে আরো সক্রিয় হওয়ার। বিএনপির টার্গেট থাকা উচিত ২০১৯ সালের সংসদ নির্বাচন। পৌর নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি হয়েছে, তার পরও বিএনপিকে আগামী নির্বাচন নিয়ে ভাবতে হবে। দল গোছাতে হবে। কর্মীদের উজ্জীবিত করতে হবে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বয়কট করে বিএনপি কোনো সুবিধাই ঘরে তুলতে পারেনি। সরকার সব ক্ষেত্রে তার একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে সংসদে বিএনপির অনুপস্থিতিতে। নির্বাচন বয়কটের পেছনে যুক্তি যতই শক্তিশালী হোক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে তাদের অনুপস্থিতিতে যে সুযোগটি তৈরি হয়েছে, আওয়ামী লীগ তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করছে। 'খালি মাঠে কোনো দলকেই গেল' করতে দেয়া উচিত নয় বিএনপির।
বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সে সংস্কৃতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অন্যতম দুটি শক্তি। একটিকে বাদ দিয়ে যেমনি গণতন্ত্রকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যাবে না, ঠিক তেমনি এ দুটি বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্কই অসাংবিধানিক শক্তির ক্ষমতা গ্রহণের আশঙ্কাকে রোধ করতে পারে। তাই পৌর নির্বাচনটিকে গুরুত্বহীন ভাবলে আমাদের চলবে না। এ নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের মধ্য দিয়ে সরকারের অবস্থান যথেষ্ট শক্তিশালী হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে যত প্রশ্নই থাকুক না কেন, সরকার যে মাঠ পর্যায়ে এখন তার ক্ষমতার বলয় সম্প্রসারিত করতে পারল, এতে কারো দ্বিমত থাকা আর উচিত নয়। সরকারি দল যখন শত অভিযোগের পরও মাঠ পর্যায়ে তার ক্ষমতা সম্প্রসারিত করতে পারে, তখন সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
আমরা সামনের দিকে তাকাতে চাই। ৫ জানুয়ারি (২০১৪) নির্বাচন এখন অতীত। এ 'অতীত' নিয়ে আমরা যদি পরস্পরকে দোষারোপ করি, তাতে আমরা মূল লক্ষ্যে পেঁৗছাতে পারব না। প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত এ দেশটিতে উন্নয়নের সুফল যদি প্রতিটি মানুষের কাছে পেঁৗছে দিতে চাই, তাহলে সব দলের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন। পরস্পরকে দোষারোপ করে দেয়া বক্তব্য, আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠার পথে প্রধান অন্তরাই নয়, বরং তা সহিংসতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
পৌরসভা নির্বাচন সবার জন্যই একটি পরীক্ষা। সরকার যদি 'জাল ভোট প্রদানের' সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে না পারে, তা সরকারকে ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করবে বটে, কিন্তু তাতে করে সত্যিকার অর্থে একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিনির্মাণ করা যাবে না। আর তা একটি বাজে মেসেজ পেঁৗছে দেবে গণতান্ত্রিক বিশ্বের কাছে। আর পৌরসভা নির্বাচন, এর আগে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি সনাতন রাজনীতির ধারায় ফিরে এসেছে। সহিংস ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে যে সরকারকে উৎখাত করা যায় না, এটা প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং সরকার পরিবর্তনের একমাত্র মাপকাঠি হচ্ছে সুষ্ঠু ও সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন। সব দল এ লক্ষ্যে কাজ করবে, এ প্রত্যাশা এখন সবার। Daily Jai Jai Din 12.01.16

পারস্যীয় উপসাগরীয় অঞ্চলে উত্তেজনার নতুন মাত্রা

সৌদি আরবের শিয়া নেতা নিমর আল নিমরের মৃত্যুদ- কার্যকর করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। সৌদি আরব ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। একই সিদ্ধান্ত নিয়েছে পারস্যীয় উপসাগরের অন্য দুটি দেশÑ বাহরাইন ও কুয়েত। শিয়া নেতার মৃত্যুদ- কার্যকর করার মধ্য দিয়ে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বটি আবার সামনে চলে এলো। এটা অনেকটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, এই দ্বন্দ্ব ও বিভেদ উপসাগরের অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়বে। এখানে একটা কথা বলা দরকার, পারস্যীয় উপসাগরভুক্ত অঞ্চলে সুন্নিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ অঞ্চলের জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগ সুন্নি সম্প্রদায়ভুক্ত আর ৩৬ ভাগ মানুষ হচ্ছে শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত। এ অঞ্চলের মধ্যে ইরাক, লেবানন, ইয়েমেন আর বাহরাইনে শিয়া সম্প্রদায়ের লোক বেশি বাস করে। যেমন বলা যেতে পারে, ইরানে যেখানে ৮৫ ভাগ লোক শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত, সেখানে সুন্নিদের সংখ্যা শতকরা মাত্র ১৫ ভাগ। ইরাকের ৬৩ ভাগ যেখানে শিয়া, ৩২ ভাগ সেখানে সুন্নি। সিরিয়ায় ১৫ ভাগ শিয়া আর ৭৩ ভাগ সুন্নি। বাহরাইনে ৭৫ ভাগ শিয়া, ২৫ ভাগ সুন্নি। ইয়েমেনে ৪৪ ভাগ শিয়া, ৫৬ ভাগ সুন্নি। মজার ব্যাপার, বাহরাইনে শিয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও রাষ্ট্রপরিচালনায় তাদের কোনো ভূমিকা নেই। সুন্নি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে খলিফা হামাদ ও তার পরিবার সেখানে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায়। সিরিয়ার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ আলাউট সম্প্রদায়ের লোক। আলাউট সম্প্রদায় শিয়াদের একটি উপশাখা। একটি গোত্র। এই গোত্র সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। বাশার আল আসাদের পিতা হাফিজ আল আসাদও সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সিরিয়া ও ইরাকে এক সময় বামমনা বা বাথ পার্টি গঠিত হয়েছিল। হাফিজ আল আসাদ সেনাবাহিনীর লোক হয়েও বাথ পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তার স্বাভাবিক মৃত্যু ২০০০ সালে তার ছেলে বাশার আল আসাদকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। ইরাকে সাদ্দাম-পরবর্তী জমানায় শিয়ারা ক্ষমতা পরিচালনা করলেও সাদ্দামের (সুন্নি) সময় শিয়ারা ছিল উপেক্ষিত। এখন ইরাকে শিয়ারা ক্ষমতায়। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন। এই শিয়া নেতা নিমর আল নিমরের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হলো এমন এক সময় যখন এ অঞ্চলে সৌদি আরবের নেতৃত্বে একটি সামরিক জোট গঠিত হয়েছে। এই জোট গঠনকে ইরান ভালো চোখে দেখেনি। খুব সঙ্গত কারণেই এই সামরিক জোটটি গঠনের প্রেক্ষাপট আলোচনার দাবি রাখে।
এই সৌদি জোট অনেক প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এলো এখন। সৌদি আরব নিজে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে অন্যতম একটি ‘অ্যাকটর’ অর্থাৎ অন্যতম নির্ধারক হিসেবে নিজেকে দেখতে চায়। অতীতের কোনো সৌদি বাদশাহ এভাবে সৌদি পররাষ্ট্রনীতি ও নিরাপত্তা ইস্যুতে বড় ভূমিকা পালন করেননি। কিন্তু বর্তমানে বাদশাহ সালমান বিন আবদুুল আজিজের ‘অ্যাপ্রোচ’ একটু ভিন্ন। তিনি সৌদি   আরবকে দেখতে চান এ অঞ্চলের রাজনীতির অন্যতম নির্ধারক হিসেবে। তাই তার নেতৃত্বে একটি সামরিক জোটের প্রয়োজন ছিল। সৌদি আরব পারস্যীয় অঞ্চলে তার প্রভাব বাড়াতে চায়। এর প্রকাশ হিসেবে আমরা দেখেছি ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে সৌদি আরবের হস্তক্ষেপ তথা সৌদি বিমানবাহিনীর ইয়েমেনে বোমাবর্ষণ। এর আগে লেবাননের গৃহযুদ্ধে সৌদি ট্যাংকবহরকে আমরা লেবাননে প্রবেশ করতে দেখেছি। অতীতে কুয়েতের আমির যখন ইরাকি সেনাদের দ্বারা উৎখাত হন (১৯৯০), তখন সৌদি আরব আমিরকে আশ্রয় দিয়েছিল বটে। কিন্তু আমিরের সমর্থনে কোনো সেনা বা বিমান পাঠায়নি। ২০১১ সালে তিউনিশিয়ায় ‘জেসমিন বিপ্লব’ জাইন আল বেন আলিকে ক্ষমতাচ্যুত ও বেন আলি সৌদি আরবে আশ্রয় নিলেও সৌদি আরব তিউনিশিয়ায় হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু বাদশাহ সালমান বিন আবদুুল আজিজ ক্ষমতাসীন হয়ে সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনেন। আর তারই ফলে নতুন এক ‘সৌদি আরব’কে আমরা দেখছি। সৌদি আরবের নীতিনির্ধারকদের বরাবরই একটা বড় ভয় ইরানকে নিয়ে। পারস্যীয় অঞ্চলের রাজনীতিতে ইরানের ভূমিকা বাড়ছে এবং ইরানের এই ভূমিকাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন স্বীকারও করে। ইরানের সঙ্গে ৬ জাতি পারমাণবিক চুক্তি, ইরানের ধর্মীয় নেতা খামেনিকে ওবামার গোপন চিঠি লেখা ইত্যাদি প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে ইরানের ভূমিকাকে স্বীকার করে নিয়েছে।
ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ ৬ জাতি আলোচনায় যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে এই জানুয়ারি মাসেই (২০১৬) ইরানের ওপর থেকে ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। ফলে ইরান আবারও একটি ‘শক্তি’ হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে। অতীতে ইরানি বিপ্লবের আগে (১৯৭৯) রেজা শাহ পাহলভির সময়ে ইরানের ভূমিকাকে ‘পারস্যীয় অঞ্চলের পুলিশ’-এর ভূমিকার সঙ্গে তুলনা করা হতো। ইরান সেই ভূমিকায় আবার ফিরে যাচ্ছে। সৌদি আরবের ভয়টা এখানেই। ইরানের উত্থান সৌদি আরবসহ এ অঞ্চলের শিয়া সম্প্রদায়কে আরও বেশি উৎসাহিত করবে।
এই জোটে সিরিয়াকে রাখা হয়নি। এটা সবাই জানে, সৌদি আরব চাচ্ছে সিরিয়ায় আসাদের উৎখাত। কিন্তু সৌদি পছন্দের তালিকায় আইএসও নেই। সম্প্রতি আসাদবিরোধী দলগুলোর একটি সম্মেলন হয়ে গেল রিয়াদে। সেখানে এমন অনেক দল অংশ নিয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ আছে। এ ক্ষেত্রে সৌদি আরবের ভূমিকা কী হবে এসব দল ও জোটের বিরুদ্ধে? অনেকেই জানেন ইসলামিক স্টেটের নেতৃত্বে সিরিয়া ও ইরাকের একটা অংশ নিয়ে তথাকথিত একটি জিহাদি রাষ্ট্র ‘সুন্নিস্তান’-এর জন্ম হয়েছে, যারা ওয়াহাবি মতাদর্শ ও আদি ইসলামিক রাষ্ট্রের ধ্যান-ধারণায় পরিচালিত হচ্ছে। সৌদি রাষ্ট্রের ভিত্তিই হচ্ছে এই ওয়াহাবি মতাদর্শ। এ ক্ষেত্রে আপাতদৃষ্টিতে আইএসের সঙ্গে সৌদি নীতিনির্ধারকদের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও আদর্শগতভাবে মিল তো আছেই! সুতরাং সৌদি-আইএস সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই।
আরও একটা কথা বলা দরকার। ইরাক ও সিরিয়ার তেলের কূপগুলোর একটা বড় অংশ ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। কালোবাজারে আইএস এই তেল বিক্রি করে। দৈনিক তাদের গড় আয় ২ মিলিয়ন ডলার। আর এ কারণেই আইএস পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী জঙ্গিগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। এই তেল তুরস্কের মধ্য দিয়ে অন্যত্র যায়। ইসরায়েল এই তেলের অন্যতম ক্রেতা। এই তেল নিয়েই সেখানে একটি ‘যুদ্ধ’-এর আশঙ্কা বাড়ছে। কেননা আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য কমে যাওয়ায় (ব্যারেলপ্রতি বর্তমান মূল্য মাত্র ৩৬ ডলার) বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের আয় কমে যাচ্ছে। ফলে একটি ‘যুদ্ধ’ শুরু না হলে এই তেলের মূল্য বাড়ানো যাবে না। তাই ধারণা করছি, একটি যুদ্ধ সেখানে আসন্ন! বলা ভালো আইএসের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ৬৫ দেশের সমন্বয়ে এ অঞ্চলকে ঘিরে গঠিত হয়েছে ‘গ্লোবাল কোয়ালিশন টু কাউন্টার আইএসআইএল।’ পশ্চিমা বিশ্ব এই জোটে আছে। বাংলাদেশকে এই জোটে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হলেও বাংলাদেশ তাতে যোগ দেয়নি। এই জোটের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া আইএস টার্গেটে বিমান হামলা চালালেও তাতে করে আইএসকে উৎখাত করা সম্ভব হয়নি। এখন সৌদি জোটকে যুক্তরাষ্ট্র প্ররোচিত করতে পারে আইএসের বিরুদ্ধে একটি স্থল অভিযান শুরু করার জন্য! এই যখন পরিস্থিতি ঠিক তখনই সৌদি আরবে শিয়া নেতা নিমর আল নিমরের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হলো। এখানে বলা ভালো, ২০১১-পরবর্তী আরব বিশ্বে ‘আরব বসন্ত’-এর যে ঢেউ ছড়িয়ে গিয়েছিল তাতে নিমর আল নিমর উৎসাহিত হয়ে সৌদি আরবে সৌদি রাজবংশের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের ডাক দিয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে তখন অভিযোগ আনা হয়েছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতার। ২০১২ সালে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিচারে তাকে মৃত্যুদ- দেওয়া হয়েছিল, যা কার্যকর করা হলো এখন। এই মৃত্যুদ- কার্যকর করার মধ্য দিয়ে বেশ কিছু পরিবর্তন আমরা এখন লক্ষ করব। এক. এই জানুয়ারি মাসে জেনেভায় সিরিয়াকে নিয়ে যে শান্তি আলোচনা শুরু হচ্ছে তাতে অনিশ্চয়তা আসতে পারে। কেননা সৌদি আরব ও ইরান এই শান্তি আলোচনার অন্যতম পক্ষ। এই আলোচনায়ই নির্ধারিত হবে আগামী ৬ মাসের মধ্য সিরিয়ায় কোন ধরনের ঐকমত্যের সরকার গঠিত হবে। আগামী ১৮ মাসের মধ্যে সিরিয়ায় একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু সৌদি-ইরান যুদ্ধে পুরো প্রক্রিয়াটি বাধাগ্রস্ত হতে পারে এখন। দুই. ইরাক, লেবানন, ইয়েমেন ও বাহরাইনে শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি ‘সৌদিবিরোধিতা’ এ অঞ্চলের রাজনীতিকে আরও উত্তপ্ত করে তুলবে। খোদ সৌদি আরবের নিরাপত্তা এতে বিঘিœত হতে পারে। তিন. সৌদি সামরিক জোটের বিরোধিতা করে ইরানের নেতৃত্বে এ অঞ্চলে আরও একটি সামরিক জোট গঠিত হতে পারে। চার. উপসাগরীয় অঞ্চলে ‘স্ট্রেইট অব হরমুজ’ প্রণালি দিয়ে জ্বালানি তেল সরবরাহের পথে ইরানি রেভ্যুলেশনারি গার্ড সদস্যরা আগামীতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। এই পথটি তেল সরবরাহের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বে সমুদ্রপথে যে পরিমাণ তেল পরিবহন করা হয় (প্রতিদিন ৫৬ দশমিক ৫ মিলিয়ন ব্যারেল) তার ২০ ভাগ (১৭ মিলিয়ন ব্যারেল) এই পথে পরিবাহিত হয়। এই পথ যদি ‘বন্ধ’ হয়ে যায় কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে তা বিশ্ব অর্থনীতিকে আঘাত করবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে মার্কিন অর্থনীতিও। পাঁচ. ইরানের সঙ্গে ৬ জাতি যে পারমাণবিক চুক্তি হয়েছে, তা এখন ভেঙে যেতে পারে। ছয়. যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সৌদি নির্ভরশীলতা এখন আরও বাড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অস্ত্রের বড় বাজার সৃষ্টি হবে সৌদি আরবে (৫০ মিলিয়ন ডলার)। এটা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে। সাত. সৌদি সামরিক জোটটি একটি স্থায়ী রূপও নিতে পারে। সৌদি সহকারী প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইতোমধ্যে পাকিস্তান সফর করেছেন। তাই ২০১৬ সালটি পারস্যীয় উপসাগরীয় রাজনীতির জন্য কোনো ভালো খবর নয়। সিরিয়ার পর সৌদি-ইরান দ্বন্দ্ব এখন বিশ্ব মিডিয়ায় বারবার আলোচিত হতে থাকবে। আর এ অঞ্চলের উত্তেজনা বিশ্ব রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে। Daily Amader Somoy 10.01.16

আস্থার সম্পর্ক আদৌ তৈরি হবে কি?

বহুল আলোচিত পৌর নির্বাচন শেষ হয়ে যাওয়ার পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, এই নির্বাচন কি দুটি বড় দলের (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) মাঝে আস্থার সম্পর্ক তৈরি করতে আদৌ সহায়ক হবে? বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটা বাস্তবতা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ আর বিএনপির মাঝে যদি সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে গণতন্ত্রকে উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যাবে না। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন কিংবা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন নিয়ে নানা ‘প্রশ্ন’ থাকলেও পৌর নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণে একটা সম্ভাবনার জন্ম হয়েছিল যে, এই নির্বাচনের ফলাফলের ওপর দুই বড় দলের মধ্যে একটি সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হবে! এখন সে সম্ভাবনা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে। কেন্দ্র দখল, জাল ভোট, সংঘাত-সহিংসতার মধ্য দিয়ে যে নির্বাচনটি শেষ হল, তা রেখে গেছে অনেক প্রশ্ন। এবং একটি ‘সমঝোতাকে’ বড় ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

বিএনপি এরই মধ্যে এ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে এবং সরকারের পদত্যাগ দাবি করেছে। সংবাদপত্রগুলো গত ৩১ ডিসেম্বর বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রের যে ছবি ছেপেছে, তা একটি শুদ্ধ নির্বাচনের ধারণাকে সমর্থন করে না। কিন্তু তারপরও এ নির্বাচন অনেকগুলো ‘সাফল্য’ দাবি করতে পারে। প্রথমত, এই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থেকেছে। মিডিয়ার কারণে দুপুরের আগেই কোথাও কোথাও সহিংসতা, জাল ভোট প্রদান, ভোট কেন্দ্র দখলের খবর এলেও বিএনপি নির্বাচন বর্জনের কথা বলেনি। বরং দু’দুবার নির্বাচন কমিশনে গিয়ে তাদের ‘প্রতিবাদ’ লিপিবদ্ধ করেছে। এর মধ্য দিয়ে ‘সব দলের অংশগ্রহণ’ নিশ্চিত করে নির্বাচন কমিশন একটি বাহবা নিতেই পারে। দ্বিতীয়ত, নারীরা সেদিন সকালেই প্রায় প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে। এটা নিঃসন্দেহে একটা প্লাস পয়েন্ট। তৃতীয়ত, এবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কোনো খবর আমরা পাইনি, অথচ আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, অতীতে প্রায় প্রতিটি নির্বাচনের আগে ও পরে বিশেষ জাতিগোষ্ঠীর লোকদের ওপর হামলা হয়েছে। তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এবার তেমনটি হয়নি। এটা একটা প্লাস পয়েন্ট। চতুর্থত, বেসরকারি নির্বাচন-পর্যবেক্ষকদের প্রায় কেউই পৌর নির্বাচনকে শতকরা একশ’ ভাগ শুদ্ধ বলেননি। তবে বলেছেন, তুলনামূলক বিচারে ভালো হয়েছে। নির্বাচন কমিশন বলেছে, শতকরা ৭৩ ভাগ ভোট পড়েছে। এটা নিঃসন্দেহে উৎসাহব্যঞ্জক। কিন্তু ছোট ছোট ‘ঘটনা’ যেমনি বড় অর্জনকে ম্লান করে দেয়, ঠিক তেমনি পৌর নির্বাচন সম্পন্ন করতে সফলতার চেয়ে ইসির সীমাবদ্ধতাই বেশি ফুটে উঠেছে।

এ নির্বাচনের পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, দলীয় সরকারের অধীনে এ দেশে আগামীতে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আদৌ সম্ভব কি-না? ৫ জানুয়ারির (২০১৪) জাতীয় সংসদ (দশম) নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন (শেষের তিনটি) এবং সর্বশেষ পৌরসভা নির্বাচন প্রমাণ করল নির্বাচন কমিশনের অসহায়ত্ব। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (২০১৪) ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেটা ছিল সংসদীয় রাজনীতির একটা ‘কালো অধ্যায়’। এখন এর সঙ্গে যোগ হল ৭ জন মেয়রের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার খবর। এটা কোনো ভালো খবর নয়। ইসি এ ব্যাপারে আদৌ তদন্তের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এ ঘটনা ইসির ভূমিকাকে আবারও প্রশ্নবিদ্ধ করল। প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের সভাপতির এখতিয়ার বলে নিজ স্বাক্ষরে দলীয় মনোনয়ন দিয়েছিলেন। অন্যদিকে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন স্থানীয় পর্যায়ের সরকারি আমলারা। এক্ষেত্রে সরকারি দলের প্রার্থীদের বিজয় নিশ্চিত করতে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারদের ওপর যে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক ‘চাপ’ ছিল, তা কি অস্বীকার করা যাবে?

পৌর নির্বাচন নিয়ে যা ‘ঘটল’, মিডিয়ায় যা প্রকাশিত হয়েছে, কিংবা চ্যানেলগুলোতে যা সম্প্রচারিত হয়েছে, তা সরকার কতটুকু গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে, আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু সরকারের শরিক দল জাতীয় পার্টি যখন অনিয়ম ও কেন্দ্র দখলের অভিযোগ করে, ইসি ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ করে, তখন সরকারের গুরুত্ব দেয়া উচিত। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত। আমাদের সংবিধানের ১১নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ আমরা বারবার সাংবিধানিক প্রাধান্যের কথা বলি। সেক্ষেত্রে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এই ১১নং অনুচ্ছেদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখন একটি প্রশ্ন থাকবেই, পৌর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংবিধানের ১১নং ধারার মূল স্পিরিটটি কতটুকু প্রতিফলিত হয়েছে? আমরা যতই বলি ইসি স্বাধীন এবং যতই সংবিধানের দোহাই দিই না কেন (১১৮-৪), বাস্তবতাই বলে, নির্বাচন কমিশন স্বাধীন নয়। আমরা যে অর্থে ভারতের নির্বাচন কমিশনকে তাদের ‘অধিকার’ চর্চা করতে দেখি, আমাদের এখানে এটা কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ। ইসিকে অর্থের জন্য সরকারের ওপর নির্ভর করতে হয়। এর ফলে এক ধরনের নির্ভরতা তৈরি হয়। ইসি নিজে কোনো ‘বাজেট’ প্রণয়ন করতে পারে না। ইসির নিজের কোনো ‘ক্যাডার কর্মকাণ্ড’ নেই, যারা পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া নিজেরা পরিচালনা করতে পারে। পৌর নির্বাচনে প্রায় ৭০ লাখ ভোটার ছিল। জড়িত ছিল কয়েক কোটি মানুষ। এটা একটা বিশাল কর্মযজ্ঞ। সরকারের সহযোগিতা তাদের প্রয়োজন ছিল। আর নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সরকারি কর্মকর্তারা জড়িত হয়ে গেলে তা সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। কারণ আমাদের সরকারি কর্মকর্তাদের মাঝে ‘দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা’ ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। আমলাদের অনেকে ভালো পোস্টিং, সুযোগ-সুবিধা নেয়ার আশায় অনেকটা জ্ঞাতসারেই সরকারি দলের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেন। এ প্রবণতা খারাপ। সাম্প্রতিক সময়ে এ প্রবণতা অনেক বেশি বেড়েছে। মাঠ পর্যায়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে এ ‘প্রবণতা’ বড় ধরনের প্রতিবন্ধক।

এখন যে বিষয়টির ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে তা হচ্ছে, একটি ‘সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ নির্বাচন আয়োজন করা কীভাবে সম্ভব? সংবিধানের ১১৮-৪ ধারা আমাদের ‘সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। সংবিধানের ৫৮ ধারায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিধান ছিল। এখন যা অতীত। বিদেশী পর্যবেক্ষক, বিশেষ করে জাতিসংঘ কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব। যেমনটি করেছে নেপাল। কিন্তু এখানেও প্রশ্ন আছে। নির্বাচন সম্পূর্ণভাবে আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘বিদেশীদের’ ডেকে আনা কোনো ভালো লক্ষণ নয়। উপরন্তু জাতিসংঘ তখনই নির্বাচন-পর্যবেক্ষক পাঠাবে অথবা নির্বাচনের আয়োজন করবে (যেমন- নেপাল, কম্বোডিয়া) যখন বিবদমান ‘পক্ষ’ জাতিসংঘকে অনুরোধ করবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এরকম কোনো সম্ভাবনা নেই।

তাহলে কি এ রকম চলতেই থাকবে? নির্বাচন মানেই জাল ভোট, ব্যালট পেপার ছিনতাই, কেন্দ্র দখল, কিংবা সহিংসতা! এই বৃত্ত আমাদের ভাঙা দরকার। কিন্তু কীভাবে? দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে পারে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই দলীয় সরকারের (ওই সময় সরকার থাকে নির্বাচনকালীন সরকার। তাদের কোনো প্রশাসনিক ক্ষমতা থাকে না) অধীনে নির্বাচন হয়। কিন্তু বাংলাদেশের সংস্কৃতি একটু ভিন্ন। বুদ্ধিজীবীরা একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারতেন। আমি দুঃখজনকভাবে অনেক তথাকথিত সুশীলকে দেখছি টক-শোতে, যারা কিছুদিন আগেও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলতেন, পত্রিকায় কলাম লিখতেন; আজ দেখি তারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চাচ্ছেন। আমি অবাক হয়ে দেখি, যারা সাংবিধানিক পদে আছেন, শপথ নিয়েছেন, তারা টক-শোতে দলীয় রাজনৈতিক বক্তব্য রাখছেন। অতীতে কখনোই এমনটি হয়নি। অতীতেও রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় ছিল। ভিসিরা ছিলেন, মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানরা ছিলেন। তারা সাধারণ ‘রাজনৈতিক বক্তব্য’ এড়িয়ে চলতেন। আজ পাল্টে গেছে সব। আর এভাবেই আমরা রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে পাল্টে দিয়েছি। পাল্টে দিয়েছি নির্বাচনের সংস্কৃতি।

আজ যখন সংবাদপত্রগুলো বলে ‘প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন’, ‘শতাধিক পৌরসভায় হামলা, সংঘাত, গুলি, ব্যালট ছিনতাই’, ‘বিএনপির এজেন্টদের কেন্দ্রে ঢুকতে বাধা’; কিংবা যখন বহিরাগতদের ভোট কেন্দ্রে ঢুকে জাল ভোট প্রদানের দৃশ্য প্রথম পাতায় ছাপা হয়, কিংবা ভাঙা ব্যালট বাক্স জঙ্গলে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়ার ছবি ছাপা হয়, তখন আস্থার জায়গাটা নষ্ট হয়ে যায়। এই যে সংস্কৃতি, এই সংস্কৃতি সুস্থ গণতন্ত্র চর্চার জন্য সহায়ক নয়। এই সংস্কৃতি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ ও দূরত্ব আরও বৃদ্ধি করবে। রাষ্ট্র ধীরে ধীরে হয়ে পড়বে একদলীয়। লংঘিত হবে মানবাধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও সুস্থ চিন্তার চর্চা।

বিএনপি মাত্র ২৩টি আসনে, আর আওয়ামী লীগ ১৭০+৭ আসনে বিজয়ী হল। এই পরিসংখ্যান সত্য হলে বলতে হবে বিএনপি তার জনপ্রিয়তা হারিয়েছে(?)। সেটা কি বর্তমানে এমন পর্যায়ে এসেছে (২৩ আসন)? প্রশ্ন এখানেও। সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাস বলে, অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যেসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, এমনকি ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও বিএনপির ভোট প্রাপ্তির হার ছিল শতকরা ৩৩ ভাগের ওপরে। সেই পরিসংখ্যানের সঙ্গে ‘২৩ আসনের’ হিসাব মেলে না।

একটি নির্বাচন হয়েছে। এটাকে ভালো নির্বাচন বলা যাবে না। এ নির্বাচন এই অভিমতকে আরও শক্তিশালী করবে যে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না। আর ইসিও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে না। তারপরও সব ‘ত্র“টি’কে ফেলে দিয়ে দুই বড় দলের মাঝে যদি একটি আস্থার সম্পর্ক তৈরি হয়, তাহলে তা আমাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে। Daily Jugantor 08.01.2016

আর নয় সাংঘর্ষিক রাজনীতি

আগামী ৫ জানুয়ারিকে ঘিরে রাজনীতি আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির সমাবেশের সিদ্ধান্তের পর একই স্থানে একই দিন সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এই সিদ্ধান্ত আবারও প্রমাণ করল এদেশে আস্থাহীনতার যে রাজনীতি এবং যে রাজনীতি বারবার সংকটের জন্ম দিচ্ছে, সেই রাজনীতি থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারিনি। ৫ জানুয়ারি এ দেশের ‘নির্বাচনী রাজনীতি’র জন্য একটি কলঙ্কময় দিন। ২০১৪ সালে এই দিনে এ দেশে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদে যেখানে বলা হয়েছে ‘প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে’, সংবিধানের এই অনুচ্ছেদটি সেদিন লঙ্ঘিত হয়েছিল যখন আমরা দেখেছি ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এখানে ‘জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ’ নিশ্চিত হয়নি। ১৫টি জেলায় মাত্র ১টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, আর শতকরা ৫২ ভাগ মানুষ সেখানে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল বটে, কিন্তু নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রয়োজন ছিল, তা হয়নি। এমনকি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে এদেশে যে সহিংস রাজনীতির জন্ম হয়েছিল, তা এক নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে। ২০১৫ সালে বিএনপি প্রায় তিন মাস অবরোধ অব্যাহত রাখে। দীর্ঘ এই ‘অবরোধ’ আর সহিংস ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হতে পারেনি। বরং শত শত মামলা-মোকদ্দমার দায়ভার বহন করে বিএনপির অনেক নেতা ও কর্মী এখনও জেলে।

৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুটি বড় দলের মাঝে যে আস্থাহীনতার জন্ম হয়েছিল, সেই আস্থাহীনতা আজও বজায় রয়েছে, যা মাঝে-মধ্যে সহিংসরূপ ধারণ করে। ৫ জানুয়ারির পর এ দেশে নতুন এক ‘নির্বাচনী সংস্কৃতি’র জন্ম হয়েছে, যেখানে ‘ভোট কেন্দ্র দখল’ আর ‘সিলমারা সংস্কৃতি’র জন্ম হয়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলেও, পরবর্তী সময়ে উপজেলা নির্বাচন ও সর্বশেষ পৌর নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছিল। কিন্তু যে প্রত্যাশা ছিল নির্বাচন সুষ্ঠু হবে, তা হয়নি। এবং পরস্পরবিরোধী এক ঘৃণ্য রাজনীতির জন্ম হয়েছে। আর এরই প্রতিফলন ঘটেছে ৫ জানুয়ারি (২০১৫) সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের একই স্থানে ও একই সময় সমাবেশের আহ্বানে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেবে, তা স্পষ্ট নয়। তবে আওয়ামী লীগের সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে বিএনপিকে আস্থায় নিয়ে ২০১৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি যে সম্ভাবনা, তাতে আসবে এক বড় ধরনের অনিশ্চয়তা। বিএনপি দলীয়ভাবে পৌর নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। ওই নির্বাচনে ‘ব্যাপক কারচুপি’ হলেও বিএনপি ‘কারচুপি’র প্রতিবাদে কোনো বড় ধরনের কর্মসূচি দেয়নি। বিএনপির এ সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।

বড় দলগুলোর মধ্যে আস্থার সম্পর্ক না থাকলে গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যাবে না। গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়বে এবং গণতন্ত্র ক্রমেই হয়ে উঠবে একদলীয়। গণতন্ত্রের স্বার্থেই শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা দরকার। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি ‘শক্তিশালী বিরোধী দলের’ অভাব অগণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে উৎসাহ জোগাবে মাত্র। বাংলাদেশে বিএনপির আবির্ভাব একটি বাস্তবতা। এ দেশের জনগোষ্ঠীর ৩২ থেকে ৩৩ ভাগ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে বিএনপি। সুতরাং এ দলটিকে বাদ দেয়া যাবে না। বিএনপি ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচনে অংশ না নিয়ে কতটুকু ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ হয়েছে কিংবা তাদের ‘নির্বাচন বয়কটের’ সিদ্ধান্ত কতটুকু যৌক্তিক ছিল, তা ইতিহাস একদিন বিচার করবে। কিন্তু মূলধারার রাজনীতিতে বিএনপি ফিরে আসায়, সরকারের উচিত ছিল বিএনপির এই ‘অবস্থান’কে সমর্থন করা। কিন্তু আওয়ামী লীগের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করার সিদ্ধান্ত রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়াবে মাত্র। এই উত্তাপ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য কোনো ভালো খবর নয়। Daily Jugantor 04.01.16

সৌদি জোট, বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি

সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন একটি সামরিক জোটে বাংলাদেশের যোগদান একই সঙ্গে যখন অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, অন্যদিকে তেমনি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির ভবিষ্যেক একরকম অনিশ্চিত করে তুলেছে। এই সৌদি জোট গঠনের সময় ও পরে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। এক. সিরিয়া প্রশ্নে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া একটি যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে এবং একটি পরিকল্পনাও প্রণয়ন করেছে। এই পরিকল্পনার আওতায় আগামী ছয় মাসের মধ্যে সেখানে একটি গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক ও অসাম্প্রদায়িক সরকার গঠিত হবে এবং জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ১৮ মাসের মধ্যে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। দুই. সৌদি জোট গঠনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) পক্ষ থেকে সৌদি আরবে হামলার হুমকি দেওয়া হয়েছে। এটি একটি ‘নির্বোধদের’ জোট এবং পশ্চিমা তথা ‘ক্রুসেডারদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র’ করে সৌদি আরব এটি করেছে বলে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের সাময়িকী ‘দাবিক’-এ আইএসের এই প্রতিক্রিয়াও প্রকাশিত হয়েছে। তিন. সৌদি জোটে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বাংলাদেশ প্রকাশ্যে স্বীকার করে নেওয়ার আগেই গত ১৪ ডিসেম্বর সৌদি কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এক চিঠিতে বাংলাদেশিদের ওমরাহ ভিসা দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিল। ৯ মাস ধরে মানবপাচারের অভিযোগে ওমরাহ ভিসা বন্ধ রেখেছে সৌদি আরব। সৌদি জোট গঠন ও বাংলাদেশের যোগদানের সঙ্গে এই তিনটি সিদ্ধান্ত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত।
এরই মধ্যে এই জোটে বাংলাদেশের যোগদান নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। গত এক সপ্তাহে এ নিয়ে একাধিক টিভি টক শোতে আমি অংশ নিয়েছি। ওমরাহ ভিসা দেওয়ার সিদ্ধান্তটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ এবং সৌদি জোটে যোগদানের ব্যাপারে বিষয়টি সরকারিভাবে জড়িত। ধারণা করছি, এ বিষয়ে সৌদি সরকার আগেই বাংলাদেশের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছিল। সবাই জানেন, সৌদি আরব বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল এবং বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরপরই সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। কিন্তু এটাও সত্য, বাংলাদেশ সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আসছিল। প্রায় ২২ লাখ বাংলাদেশি বর্তমানে সৌদি আরবে কর্মরত। তাদের পাঠানো অর্থ আমাদের বৈদেশিক আয়ের অন্যতম উত্স; যদিও বেশ কিছুদিন ধরেই সৌদি আরব বাংলাদেশিদের জন্য সৌদি শ্রমবাজার বন্ধ রেখেছে। সৌদি আরব নেপালের মতো দেশ থেকে কর্মী সংগ্রহ করলেও বাংলাদেশি কর্মীদের কোনো স্থান ছিল না সৌদি শ্রমবাজারে। এখন ওই শ্রমবাজার উন্মুক্ত হবে বলে ধারণা করছি। একসময় আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে ‘মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ককে’ বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। সংবিধানের ২৫(২) ধারায় বলা হয়েছিল, ‘রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সক্ষম হইবেন।’ এই ধারাটি বর্তমানে আর নেই। বর্তমান সরকারের আমলে সংবিধান সংশোধনের সময় এই ধারাটি বাদ দেওয়া হয়। ফলে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন গঠিত ‘সামরিক’ জোটে বাংলাদেশের যোগদান ইসলামিক ভ্রাতৃত্ববোধ তথা উম্মাহর কারণে হয়েছে, এটা মনে করা ঠিক হবে না। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ তার ‘জাতীয় স্বার্থ’কে বিবেচনায় নিয়ে এই জোটে যোগ দিয়েছে। এটা ভালো হতো যদি ইসলামিক ঐক্য সংস্থাটি এ ধরনের একটি জোট গঠনের উদ্যোগ নিত। উপরন্তু ওআইসিভুক্ত অনেক মুসলিম দেশ (সিরিয়া, ইরান) ও আঞ্চলিক শক্তি (ভারত, ইন্দোনেশিয়া) এই সামরিক জোটে যোগ না দেওয়ায় বিতর্কের মাত্রা বেড়েছে বৈকি! এই জোটটি সামরিক জোট কি না, তা নিয়েও বিতর্ক আছে এবং সম্ভাব্য একটি ‘সামরিক অভিযানে’ সব দেশ অংশ নেবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। বাংলাদেশ জানিয়ে দিয়েছে তারা কোনো সামরিক কার্যক্রমে অংশ নেবে না। একমাত্র ভবিষ্যত্ই বলতে পারবে এই জোটটির ভূমিকা কী হবে? জোটটি শুধু ‘গোয়েন্দা কার্যক্রম সমন্বয় ও সংগ্রহ’ করার মধ্য দিয়ে তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখবে কি না সেটাও একটা প্রশ্ন বটে। তবে নিঃসন্দেহে এটা বলা যায়, এই জোটটি গঠনের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন আসবে।
এই সৌদি জোট অনেক প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এলো এখন। সৌদি আরব নিজে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে অন্যতম একটি ‘অ্যাক্টর’ অর্থাত্ অন্যতম নির্ধারক হিসেবে নিজেকে দেখতে চায়। অতীতের কোনো সৌদি বাদশাহ এভাবে সৌদি পররাষ্ট্রনীতি ও নিরাপত্তা ইস্যুতে কোনো বড় ভূমিকা পালন করেননি। কিন্তু বর্তমান বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের ‘অ্যাপ্রোচ’ একটু ভিন্ন। তিনি সৌদি আরবকে দেখতে চান এ অঞ্চলের রাজনীতির অন্যতম নির্ধারক হিসেবে। তাই তাঁর নেতৃত্বে একটি সামরিক জোটের প্রয়োজন ছিল। সৌদি আরব পারস্য অঞ্চলে তার প্রভাব বাড়াতে চায়। এর প্রকাশ হিসেবে আমরা দেখেছি ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে সৌদি আরবের হস্তক্ষেপ তথা সৌদি বিমানবাহিনীর ইয়েমেনে বোমাবর্ষণ। এর আগে লেবাননের গৃহযুদ্ধে সৌদি ট্যাংকবহরকে আমরা লেবাননে প্রবেশ করতে দেখেছি। অতীতে কুয়েতের আমির যখন ইরাকি সেনাদের দ্বারা উত্খাত হন (১৯৯০) তখন সৌদি আরব আমিরকে আশ্রয় দিয়েছিল বটে; কিন্তু আমিরের সমর্থনে কোনো সেনা বা বিমান পাঠায়নি। ২০১১ সালে তিউনিসিয়ায় ‘জেসমিন বিপ্লব’ জাইন আল আবেদিন বেন আলিকে ক্ষমতাচ্যুত ও বেন আলি সৌদি আরবে আশ্রয় নিলেও সৌদি আরব তিউনিসিয়ায় হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ ক্ষমতাসীন হয়ে সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনেন। আর তারই ফলে নতুন এক ‘সৌদি আরব’কে আমরা দেখছি। সৌদি আরবের নীতিনির্ধারকদের একটা বড় ভয় ইরানকে নিয়ে। পারসীয় অঞ্চলের রাজনীতিতে ইরানের ভূমিকা বাড়ছে এবং ইরানের এই ভূমিকাকে যুক্তরাষ্ট্র এখন স্বীকারও করে। ইরানের সঙ্গে ছয় জাতি পারমাণবিক চুক্তি, ইরানের ধর্মীয় নেতা খামেনিকে ওবামার গোপন চিঠি লেখা ইত্যাদি প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে ইরানের ভূমিকাকে স্বীকার করে নিয়েছে।
ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ ছয় জাতি আলোচনায় যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে এই জানুয়ারি মাসেই (২০১৬) ইরানের ওপর থেকে ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। ফলে ইরান আবারও একটি ‘শক্তি’ হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে। অতীতে ইরানি বিপ্লবের আগে (১৯৭৯) রেজা শাহ পাহলভির সময়ে ইরানের ভূমিকাকে ‘পারসীয় অঞ্চলের পুলিশ’-এর ভূমিকার সঙ্গে তুলনা করা হতো। ইরান সেই ভূমিকায় আবার ফিরে যাচ্ছে। সৌদি আরবের ভয়টা এখানেই। ইরানের উত্থান সৌদি আরবসহ এ অঞ্চলের শিয়া সম্প্রদায়কে আরো বেশি উত্সাহিত করবে।
এই জোটে সিরিয়াকে রাখা হয়নি। এটা সবাই জানে সৌদি আরব চাচ্ছে সিরিয়ায় আসাদের উত্খাত। কিন্তু সৌদি পছন্দের তালিকায় আইএসও নেই। সম্প্রতি আসাদবিরোধী দলগুলোর একটি সম্মেলন হয়ে গেল রিয়াদে। সেখানে এমন অনেক দল অংশ নিয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ আছে। এ ক্ষেত্রে সৌদি আরবের ভূমিকা কী হবে, এসব দল ও জোটের বিরুদ্ধে? অনেকেই জানেন ইসলামিক স্টেটের নেতৃত্বে সিরিয়া ও ইরাকের একটা অংশ নিয়ে তথাকথিত একটি জিহাদি রাষ্ট্র ‘সুন্নিস্থান’-এর জন্ম হয়েছে, যারা ওয়াহাবি মতাদর্শ ও আদি ইসলামিক রাষ্ট্রের ধ্যানধারণায় পরিচালিত হচ্ছে। সৌদি রাষ্ট্রের ভিত্তিই হচ্ছে এই ওয়াহাবি মতাদর্শ। এ ক্ষেত্রে আপাতদৃষ্টিতে আইএসের সঙ্গে সৌদি নীতিনির্ধারকদের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও আদর্শগতভাবে মিল তো আছেই। সুতরাং সৌদি-আইএস সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। আরো একটি কথা বলা দরকার, ইরাক ও সিরিয়ার তেলের কূপগুলোর একটা বড় অংশ ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। কালোবাজারে আইএস এই তেল বিক্রি করে। দৈনিক তাদের গড় আয় দুই মিলিয়ন ডলার। আর এ কারণেই আইএস পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী জঙ্গিগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। এই তেল তুরস্কের মধ্য দিয়ে অন্যত্র যায়। ইসরায়েল এই তেলের অন্যতম ক্রেতা। এই তেল নিয়েই সেখানে একটি যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়ছে। কেননা আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য কমে যাওয়ায় (ব্যারেলপ্রতি বর্তমান মূল্য মাত্র ৩৬ ডলার) বহুজাতিক তেল কম্পানিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের আয় কমে যাচ্ছে। ফলে একটি ‘যুদ্ধ’ শুরু না হলে এই তেলের মূল্য বাড়ানো যাবে না। তাই ধারণা করছি, একটি যুদ্ধ সেখানে আসন্ন। বলা ভালো, আইএসের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ৬৫ দেশের সমন্বয়ে এ অঞ্চলকে ঘিরে গঠিত হয়েছে ‘গ্লোবাল কোয়ালিশন টু কাউন্টার আইএসআইএল’। পশ্চিমা বিশ্ব এই জোটে আছে। বাংলাদেশকে ওই জোটে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হলেও বাংলাদেশ তাতে যোগ দেয়নি। এই জোটের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়া আইএস টার্গেটে বিমান হামলা চালালেও তাতে  আইএসকে উত্খাত করা সম্ভব হয়নি। এখন সৌদি জোটকে যুক্তরাষ্ট্র প্ররোচিত করতে পারে আইএসের বিরুদ্ধে একটি স্থল অভিযান শুরু করার।
নিঃসন্দেহে ২০১৬ সালটি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির জন্য অত্যন্ত কঠিন একটি সময়। সিরিয়াকে ঘিরেই রাজনীতি আবর্তিত হবে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে সেখানে একটি সরকার আদৌ গঠিত হবে কি না কিংবা ওই সরকারে কারা যোগ দেবে, আইএসের বিরুদ্ধে সৌদি জোট কোনো সামরিক অভিযান শুরু করবে কি না কিংবা আইএস সৌদি আরবের ভেতরে কোনো নাশকতামূলক কার্যক্রম শুরু করে কি না, এ বিষয়গুলো ভবিষ্যতে বারবার আলোচিত হতে থাকবে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ সৌদি জোটে যোগ দিয়ে আইএসের টার্গেটে পরিণত হলেও বাংলাদেশ তার ‘প্রাপ্য’ কতটুকু নিশ্চিত করতে পারবে সে প্রশ্নটিও থাকবে। Daily Kalerkontho 03.01.2016