রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

পারস্যীয় উপসাগরীয় অঞ্চলে উত্তেজনার নতুন মাত্রা

সৌদি আরবের শিয়া নেতা নিমর আল নিমরের মৃত্যুদ- কার্যকর করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। সৌদি আরব ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। একই সিদ্ধান্ত নিয়েছে পারস্যীয় উপসাগরের অন্য দুটি দেশÑ বাহরাইন ও কুয়েত। শিয়া নেতার মৃত্যুদ- কার্যকর করার মধ্য দিয়ে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বটি আবার সামনে চলে এলো। এটা অনেকটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, এই দ্বন্দ্ব ও বিভেদ উপসাগরের অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়বে। এখানে একটা কথা বলা দরকার, পারস্যীয় উপসাগরভুক্ত অঞ্চলে সুন্নিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ অঞ্চলের জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগ সুন্নি সম্প্রদায়ভুক্ত আর ৩৬ ভাগ মানুষ হচ্ছে শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত। এ অঞ্চলের মধ্যে ইরাক, লেবানন, ইয়েমেন আর বাহরাইনে শিয়া সম্প্রদায়ের লোক বেশি বাস করে। যেমন বলা যেতে পারে, ইরানে যেখানে ৮৫ ভাগ লোক শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত, সেখানে সুন্নিদের সংখ্যা শতকরা মাত্র ১৫ ভাগ। ইরাকের ৬৩ ভাগ যেখানে শিয়া, ৩২ ভাগ সেখানে সুন্নি। সিরিয়ায় ১৫ ভাগ শিয়া আর ৭৩ ভাগ সুন্নি। বাহরাইনে ৭৫ ভাগ শিয়া, ২৫ ভাগ সুন্নি। ইয়েমেনে ৪৪ ভাগ শিয়া, ৫৬ ভাগ সুন্নি। মজার ব্যাপার, বাহরাইনে শিয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও রাষ্ট্রপরিচালনায় তাদের কোনো ভূমিকা নেই। সুন্নি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে খলিফা হামাদ ও তার পরিবার সেখানে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায়। সিরিয়ার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ আলাউট সম্প্রদায়ের লোক। আলাউট সম্প্রদায় শিয়াদের একটি উপশাখা। একটি গোত্র। এই গোত্র সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। বাশার আল আসাদের পিতা হাফিজ আল আসাদও সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সিরিয়া ও ইরাকে এক সময় বামমনা বা বাথ পার্টি গঠিত হয়েছিল। হাফিজ আল আসাদ সেনাবাহিনীর লোক হয়েও বাথ পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তার স্বাভাবিক মৃত্যু ২০০০ সালে তার ছেলে বাশার আল আসাদকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। ইরাকে সাদ্দাম-পরবর্তী জমানায় শিয়ারা ক্ষমতা পরিচালনা করলেও সাদ্দামের (সুন্নি) সময় শিয়ারা ছিল উপেক্ষিত। এখন ইরাকে শিয়ারা ক্ষমতায়। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন। এই শিয়া নেতা নিমর আল নিমরের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হলো এমন এক সময় যখন এ অঞ্চলে সৌদি আরবের নেতৃত্বে একটি সামরিক জোট গঠিত হয়েছে। এই জোট গঠনকে ইরান ভালো চোখে দেখেনি। খুব সঙ্গত কারণেই এই সামরিক জোটটি গঠনের প্রেক্ষাপট আলোচনার দাবি রাখে।
এই সৌদি জোট অনেক প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এলো এখন। সৌদি আরব নিজে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে অন্যতম একটি ‘অ্যাকটর’ অর্থাৎ অন্যতম নির্ধারক হিসেবে নিজেকে দেখতে চায়। অতীতের কোনো সৌদি বাদশাহ এভাবে সৌদি পররাষ্ট্রনীতি ও নিরাপত্তা ইস্যুতে বড় ভূমিকা পালন করেননি। কিন্তু বর্তমানে বাদশাহ সালমান বিন আবদুুল আজিজের ‘অ্যাপ্রোচ’ একটু ভিন্ন। তিনি সৌদি   আরবকে দেখতে চান এ অঞ্চলের রাজনীতির অন্যতম নির্ধারক হিসেবে। তাই তার নেতৃত্বে একটি সামরিক জোটের প্রয়োজন ছিল। সৌদি আরব পারস্যীয় অঞ্চলে তার প্রভাব বাড়াতে চায়। এর প্রকাশ হিসেবে আমরা দেখেছি ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে সৌদি আরবের হস্তক্ষেপ তথা সৌদি বিমানবাহিনীর ইয়েমেনে বোমাবর্ষণ। এর আগে লেবাননের গৃহযুদ্ধে সৌদি ট্যাংকবহরকে আমরা লেবাননে প্রবেশ করতে দেখেছি। অতীতে কুয়েতের আমির যখন ইরাকি সেনাদের দ্বারা উৎখাত হন (১৯৯০), তখন সৌদি আরব আমিরকে আশ্রয় দিয়েছিল বটে। কিন্তু আমিরের সমর্থনে কোনো সেনা বা বিমান পাঠায়নি। ২০১১ সালে তিউনিশিয়ায় ‘জেসমিন বিপ্লব’ জাইন আল বেন আলিকে ক্ষমতাচ্যুত ও বেন আলি সৌদি আরবে আশ্রয় নিলেও সৌদি আরব তিউনিশিয়ায় হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু বাদশাহ সালমান বিন আবদুুল আজিজ ক্ষমতাসীন হয়ে সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনেন। আর তারই ফলে নতুন এক ‘সৌদি আরব’কে আমরা দেখছি। সৌদি আরবের নীতিনির্ধারকদের বরাবরই একটা বড় ভয় ইরানকে নিয়ে। পারস্যীয় অঞ্চলের রাজনীতিতে ইরানের ভূমিকা বাড়ছে এবং ইরানের এই ভূমিকাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন স্বীকারও করে। ইরানের সঙ্গে ৬ জাতি পারমাণবিক চুক্তি, ইরানের ধর্মীয় নেতা খামেনিকে ওবামার গোপন চিঠি লেখা ইত্যাদি প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে ইরানের ভূমিকাকে স্বীকার করে নিয়েছে।
ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ ৬ জাতি আলোচনায় যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে এই জানুয়ারি মাসেই (২০১৬) ইরানের ওপর থেকে ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। ফলে ইরান আবারও একটি ‘শক্তি’ হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে। অতীতে ইরানি বিপ্লবের আগে (১৯৭৯) রেজা শাহ পাহলভির সময়ে ইরানের ভূমিকাকে ‘পারস্যীয় অঞ্চলের পুলিশ’-এর ভূমিকার সঙ্গে তুলনা করা হতো। ইরান সেই ভূমিকায় আবার ফিরে যাচ্ছে। সৌদি আরবের ভয়টা এখানেই। ইরানের উত্থান সৌদি আরবসহ এ অঞ্চলের শিয়া সম্প্রদায়কে আরও বেশি উৎসাহিত করবে।
এই জোটে সিরিয়াকে রাখা হয়নি। এটা সবাই জানে, সৌদি আরব চাচ্ছে সিরিয়ায় আসাদের উৎখাত। কিন্তু সৌদি পছন্দের তালিকায় আইএসও নেই। সম্প্রতি আসাদবিরোধী দলগুলোর একটি সম্মেলন হয়ে গেল রিয়াদে। সেখানে এমন অনেক দল অংশ নিয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ আছে। এ ক্ষেত্রে সৌদি আরবের ভূমিকা কী হবে এসব দল ও জোটের বিরুদ্ধে? অনেকেই জানেন ইসলামিক স্টেটের নেতৃত্বে সিরিয়া ও ইরাকের একটা অংশ নিয়ে তথাকথিত একটি জিহাদি রাষ্ট্র ‘সুন্নিস্তান’-এর জন্ম হয়েছে, যারা ওয়াহাবি মতাদর্শ ও আদি ইসলামিক রাষ্ট্রের ধ্যান-ধারণায় পরিচালিত হচ্ছে। সৌদি রাষ্ট্রের ভিত্তিই হচ্ছে এই ওয়াহাবি মতাদর্শ। এ ক্ষেত্রে আপাতদৃষ্টিতে আইএসের সঙ্গে সৌদি নীতিনির্ধারকদের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও আদর্শগতভাবে মিল তো আছেই! সুতরাং সৌদি-আইএস সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই।
আরও একটা কথা বলা দরকার। ইরাক ও সিরিয়ার তেলের কূপগুলোর একটা বড় অংশ ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। কালোবাজারে আইএস এই তেল বিক্রি করে। দৈনিক তাদের গড় আয় ২ মিলিয়ন ডলার। আর এ কারণেই আইএস পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী জঙ্গিগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। এই তেল তুরস্কের মধ্য দিয়ে অন্যত্র যায়। ইসরায়েল এই তেলের অন্যতম ক্রেতা। এই তেল নিয়েই সেখানে একটি ‘যুদ্ধ’-এর আশঙ্কা বাড়ছে। কেননা আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য কমে যাওয়ায় (ব্যারেলপ্রতি বর্তমান মূল্য মাত্র ৩৬ ডলার) বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের আয় কমে যাচ্ছে। ফলে একটি ‘যুদ্ধ’ শুরু না হলে এই তেলের মূল্য বাড়ানো যাবে না। তাই ধারণা করছি, একটি যুদ্ধ সেখানে আসন্ন! বলা ভালো আইএসের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ৬৫ দেশের সমন্বয়ে এ অঞ্চলকে ঘিরে গঠিত হয়েছে ‘গ্লোবাল কোয়ালিশন টু কাউন্টার আইএসআইএল।’ পশ্চিমা বিশ্ব এই জোটে আছে। বাংলাদেশকে এই জোটে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হলেও বাংলাদেশ তাতে যোগ দেয়নি। এই জোটের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া আইএস টার্গেটে বিমান হামলা চালালেও তাতে করে আইএসকে উৎখাত করা সম্ভব হয়নি। এখন সৌদি জোটকে যুক্তরাষ্ট্র প্ররোচিত করতে পারে আইএসের বিরুদ্ধে একটি স্থল অভিযান শুরু করার জন্য! এই যখন পরিস্থিতি ঠিক তখনই সৌদি আরবে শিয়া নেতা নিমর আল নিমরের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হলো। এখানে বলা ভালো, ২০১১-পরবর্তী আরব বিশ্বে ‘আরব বসন্ত’-এর যে ঢেউ ছড়িয়ে গিয়েছিল তাতে নিমর আল নিমর উৎসাহিত হয়ে সৌদি আরবে সৌদি রাজবংশের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের ডাক দিয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে তখন অভিযোগ আনা হয়েছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতার। ২০১২ সালে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিচারে তাকে মৃত্যুদ- দেওয়া হয়েছিল, যা কার্যকর করা হলো এখন। এই মৃত্যুদ- কার্যকর করার মধ্য দিয়ে বেশ কিছু পরিবর্তন আমরা এখন লক্ষ করব। এক. এই জানুয়ারি মাসে জেনেভায় সিরিয়াকে নিয়ে যে শান্তি আলোচনা শুরু হচ্ছে তাতে অনিশ্চয়তা আসতে পারে। কেননা সৌদি আরব ও ইরান এই শান্তি আলোচনার অন্যতম পক্ষ। এই আলোচনায়ই নির্ধারিত হবে আগামী ৬ মাসের মধ্য সিরিয়ায় কোন ধরনের ঐকমত্যের সরকার গঠিত হবে। আগামী ১৮ মাসের মধ্যে সিরিয়ায় একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু সৌদি-ইরান যুদ্ধে পুরো প্রক্রিয়াটি বাধাগ্রস্ত হতে পারে এখন। দুই. ইরাক, লেবানন, ইয়েমেন ও বাহরাইনে শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি ‘সৌদিবিরোধিতা’ এ অঞ্চলের রাজনীতিকে আরও উত্তপ্ত করে তুলবে। খোদ সৌদি আরবের নিরাপত্তা এতে বিঘিœত হতে পারে। তিন. সৌদি সামরিক জোটের বিরোধিতা করে ইরানের নেতৃত্বে এ অঞ্চলে আরও একটি সামরিক জোট গঠিত হতে পারে। চার. উপসাগরীয় অঞ্চলে ‘স্ট্রেইট অব হরমুজ’ প্রণালি দিয়ে জ্বালানি তেল সরবরাহের পথে ইরানি রেভ্যুলেশনারি গার্ড সদস্যরা আগামীতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। এই পথটি তেল সরবরাহের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বে সমুদ্রপথে যে পরিমাণ তেল পরিবহন করা হয় (প্রতিদিন ৫৬ দশমিক ৫ মিলিয়ন ব্যারেল) তার ২০ ভাগ (১৭ মিলিয়ন ব্যারেল) এই পথে পরিবাহিত হয়। এই পথ যদি ‘বন্ধ’ হয়ে যায় কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে তা বিশ্ব অর্থনীতিকে আঘাত করবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে মার্কিন অর্থনীতিও। পাঁচ. ইরানের সঙ্গে ৬ জাতি যে পারমাণবিক চুক্তি হয়েছে, তা এখন ভেঙে যেতে পারে। ছয়. যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সৌদি নির্ভরশীলতা এখন আরও বাড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অস্ত্রের বড় বাজার সৃষ্টি হবে সৌদি আরবে (৫০ মিলিয়ন ডলার)। এটা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে। সাত. সৌদি সামরিক জোটটি একটি স্থায়ী রূপও নিতে পারে। সৌদি সহকারী প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইতোমধ্যে পাকিস্তান সফর করেছেন। তাই ২০১৬ সালটি পারস্যীয় উপসাগরীয় রাজনীতির জন্য কোনো ভালো খবর নয়। সিরিয়ার পর সৌদি-ইরান দ্বন্দ্ব এখন বিশ্ব মিডিয়ায় বারবার আলোচিত হতে থাকবে। আর এ অঞ্চলের উত্তেজনা বিশ্ব রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে। Daily Amader Somoy 10.01.16

0 comments:

Post a Comment