মালয়েশিয়া
একটি বড় ধরনের ইমেজ সংকটের মুখে পড়েছে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব
রাজাকের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে ৬৮ কোটি ডলার পাওয়া গিয়েছিল। এ নিয়ে ২০১৫
সালের আগস্ট মাসের শেষ দিকে রাজাকের পদত্যাগের দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছিল
মালয়েশিয়া। কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে হাজার হাজার মানুষ সেদিন
রাজপথে নেমে এসেছিল। তখন মালয়েশিয়ার জনক হিসেবে পরিচিত মাহাথির মোহাম্মদও
এই বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের পদত্যাগ
দাবি করেছিলেন। মালয়েশিয়ার প্রেক্ষাপটে এ ধরনের ঘটনা অকল্পনীয়। কারণ সেখানে
ঘুষ, দুর্নীতি অত্যন্ত কঠোর হাতে দমন করা হয়। নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে
দুর্নীতির অভিযোগ শক্তিশালী হলে তিনি তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন
করেছিলেন। গত ২৬ জানুয়ারি তদন্ত কমিটি তাকে সব অভিযোগ থেকে মুক্তি দেয়।
মালয়েশিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল গণমাধ্যমে দেওয়া এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন
রাজাকের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া অর্থ তিনি সৌদি রাজপরিবার থেকে
উপহার হিসেবে পেয়েছেন। তবে সৌদি রাজপরিবার তাকে ব্যক্তিগতভাবে কেন এই বিপুল
টাকা দিয়েছিল, তার কোনো ব্যাখ্যা এই তদন্তে পাওয়া যায়নি। মালয়েশিয়ার মতো
দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন এত বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশি কোনো সূত্র (সৌদি)
থেকে গ্রহণ করেন, তখন প্রশ্ন ওঠে বৈকি। ‘ইহুদি হুমকি মোকাবিলায়’ এই অর্থের
দরকার ছিল কিংবা ‘মালয়েশিয়ার সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে ওই অর্থ একটি
উপহার’Ñএসব কথা নাজিব সমর্থকদের মুখ থেকে শোনা গেলেও সাধারণ মানুষের মাঝে এ
নিয়ে প্রশ্ন ছিল। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এই সংবাদটি পরিবেশন করলেও উৎস
সম্পর্কে কোনো কথা বলেনি। যে কারণেই ‘বিদেশি উৎস’ থেকে এ টাকা পাওয়া যাক না
কেন, নিশ্চয়ই তা সরকারি ফান্ডে অথবা সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে
জমা হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু যখনই তা প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে
জমা হয়, তখন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত ইমেজকে তা ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ রকমটি
অতীতে কখনো দেখা যায়নি। অতীতে কোনো প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ
আমরা শুনিনি। এর মধ্য দিয়ে মালয়েশিয়ার নেতৃত্বে পরিবর্তন যদি নাও আসে,
বলার অপেক্ষা রাখে না এতে করে বহির্বিশ্বে রাষ্ট্রটির ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট
হলো।
তুলনামূলকভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতি বেশ স্থিতিশীল। এ অঞ্চলের দেশগুলোর মাঝে থাইল্যান্ডে ‘কালার রেভ্যুলুশন’ সেখানে সরকার পতন ও সামরিক অভ্যুত্থানের পথ প্রশস্ত করলেও বাকি দেশগুলোতে স্থিতিশীলতা লক্ষ করা যায়। মালয়েশিয়ার রাজনীতিও অস্থিতিশীল ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করে প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হওয়ায় দেশটি অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছিল। সেখানেও এক ধরনের ‘কালার রেভ্যুলুশন’-এর জন্ম হয়েছিল, যারা হলুদ শার্ট পরিধান করে রাজধানী কুয়ালালামপুরের কেন্দ্রস্থল দখল করে নিয়েছিল। এই আন্দোলন আরও গুরুত্ব পেয়েছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের অংশগ্রহণের কারণে। যদিও এই ‘কালার রেভ্যুলুশন’ থাইল্যান্ডের মতো কিংবা অতীতে ফিলিপাইনে কোরাজান আকিনোর ‘ইয়োলো শার্ট’ ম্যুভমেন্টের মতো স্থায়ী হয়নি। এখানে স্পষ্টতই একটা পার্থক্য লক্ষ করা যাচ্ছে। ফিলিপাইনে কোরাজান আকিনো ১৯৮৬ সালে নিজে তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান মার্কোসের বিরুদ্ধে ‘ইয়োলো শার্ট’ ম্যুভমেন্টের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। থাইল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রা ও তার বোন ইংলাক সিনাওয়াত্রার সমর্থকরা ‘লাল শার্ট’পন্থি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আর তার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল, তার নেতৃত্বে দিয়েছিল (২০০৬) ‘হলুদ শার্ট’পন্থিরা ‘পিপলস অ্যালায়েন্স ফর ডেমোক্রেসি’র ব্যানারে। এই ‘লাল’ ও ‘হলুদ’ শার্ট আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেনা অভ্যুত্থানের পথ প্রশস্ত হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার আন্দোলনের সাথে পার্থক্য এখানেই যে, মালয়েশিয়ার ‘হলুদ শার্ট’ আন্দোলন স্থায়ী হয়নি। আন্দোলন শুরু হওয়ার পর আন্দোলনের খবর আমরা এখন তেমন একটা পাই না। পৃথিবীর অন্যত্র যেভাবে ‘কালার রেভ্যুলুশন’ সংগঠিত হয়েছে, মালয়েশিয়াতে তেমনটি হয়নি। কায়রোর ‘তাহরির স্কয়ার’-এ আন্দোলনকারীরা দুসপ্তাহ অবস্থান করে ‘আরব বসন্ত’-এর জন্ম দিয়েছিল মিসরে। হোসনি মোবারকের পতন ঘটেছিল। থাইল্যান্ডেও আমরা এমনটি লক্ষ করেছিলাম। কিন্তু মালয়েশিয়ায় তেমনটি হয়নি। এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে সাধারণ মানুষের মাঝে যে হতাশা আছে তা দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো। প্রথমত, ১৯৫৭ সালের ৩১ আগস্ট ব্রিটিশদের কাছ থেকে রক্তপাতহীন প্রক্রিয়ায় স্বাধীনতা অর্জন করার পর থেকেই একটি অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা ‘বারিসোয়া নেসিওনাল’ (ইধৎরংড়ধ ঘধংরড়হধষ) ক্ষমতা ধরে রেখেছে। এখানে কোনো শক্ত বিরোধী দলের জন্ম হয়নি। ক্ষমতাসীন ফ্রন্টে ১৩টি রাজনৈতিক দল রয়েছে। মূল শক্তি হচ্ছে উমনো বা টহরঃবফ গধষধুধ ঘধঃরড়হধষ ঙৎমধহরুধঃরড়হ। এই ফ্রন্টে গধষধুংরধহ ঈযরহবংব অংংড়পরধঃরড়হ ও গধষধুংরধহ ওহফরধহ ঈড়হমৎবংং-এর মতো দলও আছে। এই দুটি সংগঠন চিনা ও ভারতীয় জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে। মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪৬ ভাগ মালয়, আর ৩৫ ভাগ চিনা ও ১১ ভাগ ভারতীয় বংশোদ্ভূত। ২০১৩ সালে সর্বশেষ জাতীয় সংসদের (উবধিহ জধশুধঃ) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে দেখা যায়, মোট আসন ২২২টির মাঝে ন্যাশনাল ফ্রন্ট পেয়েছে ১৩৩ আসন (উমনো একা ৮৮ আসন), শতকরা হিসাবে ৫৯ দশমিক ৯১ ভাগ। অন্যদিকে এই প্রথমবারের মতো একটি শক্তিশালী বিরোধী জোট রয়েছে সংসদে (চধশধঃধহ জধশুধঃ)। এই বিরোধী ফ্রন্টের মূল শক্তি হচ্ছে ডেমোক্র্যাটিক অ্যাকশন পার্টি, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন আনোয়ার ইব্রাহিম। বিরোধী ফ্রন্টের আসন সংখ্যা হচ্ছে ৮৯, শতকরা হিসাবে ৪০ দশমিক ০৯ ভাগ। তিনটি দল নিয়ে এই বিরোধী ফ্রন্ট, যেখানে মালয়েশিয়ান ইসলামিক পার্টির (আসন ২১) মতো ইসলামিক দলও রয়েছে। শক্তিশালী বিরোধী দল গড়ে না ওঠায় ক্ষমতাসীন ‘বারিসোয়া ন্যাশনাল’ বারবার ক্ষমতায় আসছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে নাজিব রাজাকের (যিনি ক্ষমতায় আছেন ২০০৯ সাল থেকে) বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল একটি মানবাধিকার সংগঠনÑ ‘বেরসিহ’। পরে অবশিষ্ট ৫টি বিরোধী দল এই আন্দোলনে শরিক হয় (ডেমোক্র্যাটিক অ্যাকশন পার্টি, পার্টি ইসলাম সে মালয়েশিয়া, পার্টি কেয়াফিলান রাকায়েত, পার্টি সোসাইলিস মালয়েশিয়া, সারাওয়াক ন্যাশনাল পার্টি)। দ্বিতীয়ত, নাজিব রাজাক নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐক্যের ‘ওয়ান মালয়েশিয়া’ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তিনি কথা দিয়েছিলেন মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ, স্বচ্ছ ও প্রশাসনিক অর্থ ব্যবস্থা গড়ে তুলবেন। কিন্তু সংখ্যালঘুরা অভিযোগ করছেন যে, তারা বৈষম্যের শিকার। তৃতীয়ত, নাজিব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সরাসরি জনগণের সাথে সম্পর্ক রাখবেন। তিনি নিজে ফেসবুক ও টুইটারের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কিছু কিছু অভিযোগ উত্থাপিত হতেই, তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় কড়াকড়ি ব্যবস্থা আরোপ করেন। এখন শোনা যাচ্ছে, তিনি নতুন একটি আইন করতে যাচ্ছেন, যাতে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যাপারে কিছু বিধিনিষেধ থাকবে। চতুর্থত, তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন দেশকে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত করবেন। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেল তিনি খাদ্য ও জ্বালানিতে ভর্তুকি কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছেন। এতে করে বিত্তবানরা খুশি হবে, সাধারণ মানুষ খুশি হয়নি। তাই একটা অসন্তোষ ছিল। পঞ্চমত, তিনি দুর্নীতি কমানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও তার নিজের আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে তিনি বিতর্কিত হয়েছেন। ষষ্ঠত, বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য তার স্ত্রী রোজমাহ মনসুর বারবার বিতর্কিত হয়েছেন (শুধু চুলের স্টাইল করার জন্য প্রতিবার খরচ করেন ৪০০ ডলাস, বাংলাদেশি টাকায় ৩২ হাজার টাকা)। এটা পরোক্ষভাবে নাজিবের ইমেজ বৃদ্ধিতে কোনো সাহায্য করেনি।
প্রশ্ন হচ্ছে নাজিববিরোধী এই আন্দোলন সরকারের ভিতকে কি আদৌ কাঁপিয়ে দিতে পেরেছে? মনে হয় না। নিঃসন্দেহে নাজিবের ব্যক্তি ইমেজ এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সরকারের অবস্থান বেশ শক্তিশালী। মনে রাখতে হবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যত্র যে আন্দোলন হয়েছিল, তা ছিল সরকারবিরোধী একটি আন্দোলন। এখানে অর্থাৎ মালয়েশিয়াতে আন্দোলনের চরিত্র কিন্তু সরকারবিরোধী নয়, ব্যক্তি নাজিবের বিরুদ্ধে। এক সময় মনে করা হতো, মালয়েশিয়া এমন একটি সমাজ বিনির্মাণ করেছে, যেখানে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় না এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে রয়েছে কঠোর আইন। এমনকি সুশাসনের জন্যও মালয়েশিয়া সরকার আলোচিত। যদিও এটা সত্য, এখানে যে গণতন্ত্র বিকশিত হয়েছে, তা অনেকটা নিয়ন্ত্রিত। বিরোধীদলীয় কর্মকা-ও সীমিত। এখানে রাজনীতির চাইতে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে উন্নয়নকে। অনেকেই বলার চেষ্টা করেন মালয়েশিয়া উন্নয়নশীল দেশের জন্য একটি মডেল। এটা সম্ভব হয়েছিল মাহাথির মোহাম্মদের কারণে, যিনি ১৯৮১ সালে মালয়েশিয়ার চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। আর ২০০৩ সালের ৩১ অক্টোবর তিনি অবসরে যান। উমনো থেকেও বিদায় নেন ২০০৮ সালে। তবে ২০০৯ সালে আবার উমনোতে ফিরেও এসেছিলেন। তার ভূমিকা নিয়েও এখন প্রশ্ন আছে। অতীতে তিনি আনোয়ার ইব্রাহিমকে দল থেকে, ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বহিষ্কার পর্যন্ত করেছিলেন। আনোয়ারের বিরুদ্ধে সমকামিতার অভিযোগ ছিল। অনেকের ধারণা তিনি দলে তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী রাখতেন না (আনোয়ার ইব্রাহিম তার নিকটাত্মীয় এবং তাকে ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গণ্য করা হতো)। এখন নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে তার অবস্থানও সেখানে ‘মিশ্র’ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। দলকে মাহাথির মোহাম্মদ সাথে পাননি। শুধু তাই নয়, ‘সরকার উৎখাতের’ অভিযোগে পুশিল তখন মাহাথিরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল।
এক সময় মালয়েশিয়াকে নিয়ে অনেকে গর্ব করতেন। মাহাথির মালয়েশিয়াকে অনেক ‘উচ্চতায়’ নিয়ে গিয়েছিলেন। এখন দেখা গেল খোদ প্রধানমন্ত্রীও দুর্নীতির অভিযোগ থেকে ‘মুক্তি’ পেলেন না। সৌদি সরকার কেন তাকে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়েছিল, তাও বোধহয় জানা যাবে না কোনোদিন। এই ঘটনায় নাজিব রাজাক ‘মুক্তি’ পেলেন বটে, কিন্তু মালয়েশিয়া একটি বড় ধরনের ইমেজ সংকটের মুখে পড়েছে। Daily Amader Somoy 31.01.16
তুলনামূলকভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতি বেশ স্থিতিশীল। এ অঞ্চলের দেশগুলোর মাঝে থাইল্যান্ডে ‘কালার রেভ্যুলুশন’ সেখানে সরকার পতন ও সামরিক অভ্যুত্থানের পথ প্রশস্ত করলেও বাকি দেশগুলোতে স্থিতিশীলতা লক্ষ করা যায়। মালয়েশিয়ার রাজনীতিও অস্থিতিশীল ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করে প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হওয়ায় দেশটি অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছিল। সেখানেও এক ধরনের ‘কালার রেভ্যুলুশন’-এর জন্ম হয়েছিল, যারা হলুদ শার্ট পরিধান করে রাজধানী কুয়ালালামপুরের কেন্দ্রস্থল দখল করে নিয়েছিল। এই আন্দোলন আরও গুরুত্ব পেয়েছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের অংশগ্রহণের কারণে। যদিও এই ‘কালার রেভ্যুলুশন’ থাইল্যান্ডের মতো কিংবা অতীতে ফিলিপাইনে কোরাজান আকিনোর ‘ইয়োলো শার্ট’ ম্যুভমেন্টের মতো স্থায়ী হয়নি। এখানে স্পষ্টতই একটা পার্থক্য লক্ষ করা যাচ্ছে। ফিলিপাইনে কোরাজান আকিনো ১৯৮৬ সালে নিজে তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান মার্কোসের বিরুদ্ধে ‘ইয়োলো শার্ট’ ম্যুভমেন্টের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। থাইল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রা ও তার বোন ইংলাক সিনাওয়াত্রার সমর্থকরা ‘লাল শার্ট’পন্থি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আর তার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল, তার নেতৃত্বে দিয়েছিল (২০০৬) ‘হলুদ শার্ট’পন্থিরা ‘পিপলস অ্যালায়েন্স ফর ডেমোক্রেসি’র ব্যানারে। এই ‘লাল’ ও ‘হলুদ’ শার্ট আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেনা অভ্যুত্থানের পথ প্রশস্ত হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার আন্দোলনের সাথে পার্থক্য এখানেই যে, মালয়েশিয়ার ‘হলুদ শার্ট’ আন্দোলন স্থায়ী হয়নি। আন্দোলন শুরু হওয়ার পর আন্দোলনের খবর আমরা এখন তেমন একটা পাই না। পৃথিবীর অন্যত্র যেভাবে ‘কালার রেভ্যুলুশন’ সংগঠিত হয়েছে, মালয়েশিয়াতে তেমনটি হয়নি। কায়রোর ‘তাহরির স্কয়ার’-এ আন্দোলনকারীরা দুসপ্তাহ অবস্থান করে ‘আরব বসন্ত’-এর জন্ম দিয়েছিল মিসরে। হোসনি মোবারকের পতন ঘটেছিল। থাইল্যান্ডেও আমরা এমনটি লক্ষ করেছিলাম। কিন্তু মালয়েশিয়ায় তেমনটি হয়নি। এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে সাধারণ মানুষের মাঝে যে হতাশা আছে তা দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো। প্রথমত, ১৯৫৭ সালের ৩১ আগস্ট ব্রিটিশদের কাছ থেকে রক্তপাতহীন প্রক্রিয়ায় স্বাধীনতা অর্জন করার পর থেকেই একটি অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা ‘বারিসোয়া নেসিওনাল’ (ইধৎরংড়ধ ঘধংরড়হধষ) ক্ষমতা ধরে রেখেছে। এখানে কোনো শক্ত বিরোধী দলের জন্ম হয়নি। ক্ষমতাসীন ফ্রন্টে ১৩টি রাজনৈতিক দল রয়েছে। মূল শক্তি হচ্ছে উমনো বা টহরঃবফ গধষধুধ ঘধঃরড়হধষ ঙৎমধহরুধঃরড়হ। এই ফ্রন্টে গধষধুংরধহ ঈযরহবংব অংংড়পরধঃরড়হ ও গধষধুংরধহ ওহফরধহ ঈড়হমৎবংং-এর মতো দলও আছে। এই দুটি সংগঠন চিনা ও ভারতীয় জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে। মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪৬ ভাগ মালয়, আর ৩৫ ভাগ চিনা ও ১১ ভাগ ভারতীয় বংশোদ্ভূত। ২০১৩ সালে সর্বশেষ জাতীয় সংসদের (উবধিহ জধশুধঃ) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে দেখা যায়, মোট আসন ২২২টির মাঝে ন্যাশনাল ফ্রন্ট পেয়েছে ১৩৩ আসন (উমনো একা ৮৮ আসন), শতকরা হিসাবে ৫৯ দশমিক ৯১ ভাগ। অন্যদিকে এই প্রথমবারের মতো একটি শক্তিশালী বিরোধী জোট রয়েছে সংসদে (চধশধঃধহ জধশুধঃ)। এই বিরোধী ফ্রন্টের মূল শক্তি হচ্ছে ডেমোক্র্যাটিক অ্যাকশন পার্টি, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন আনোয়ার ইব্রাহিম। বিরোধী ফ্রন্টের আসন সংখ্যা হচ্ছে ৮৯, শতকরা হিসাবে ৪০ দশমিক ০৯ ভাগ। তিনটি দল নিয়ে এই বিরোধী ফ্রন্ট, যেখানে মালয়েশিয়ান ইসলামিক পার্টির (আসন ২১) মতো ইসলামিক দলও রয়েছে। শক্তিশালী বিরোধী দল গড়ে না ওঠায় ক্ষমতাসীন ‘বারিসোয়া ন্যাশনাল’ বারবার ক্ষমতায় আসছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে নাজিব রাজাকের (যিনি ক্ষমতায় আছেন ২০০৯ সাল থেকে) বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল একটি মানবাধিকার সংগঠনÑ ‘বেরসিহ’। পরে অবশিষ্ট ৫টি বিরোধী দল এই আন্দোলনে শরিক হয় (ডেমোক্র্যাটিক অ্যাকশন পার্টি, পার্টি ইসলাম সে মালয়েশিয়া, পার্টি কেয়াফিলান রাকায়েত, পার্টি সোসাইলিস মালয়েশিয়া, সারাওয়াক ন্যাশনাল পার্টি)। দ্বিতীয়ত, নাজিব রাজাক নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐক্যের ‘ওয়ান মালয়েশিয়া’ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তিনি কথা দিয়েছিলেন মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ, স্বচ্ছ ও প্রশাসনিক অর্থ ব্যবস্থা গড়ে তুলবেন। কিন্তু সংখ্যালঘুরা অভিযোগ করছেন যে, তারা বৈষম্যের শিকার। তৃতীয়ত, নাজিব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সরাসরি জনগণের সাথে সম্পর্ক রাখবেন। তিনি নিজে ফেসবুক ও টুইটারের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কিছু কিছু অভিযোগ উত্থাপিত হতেই, তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় কড়াকড়ি ব্যবস্থা আরোপ করেন। এখন শোনা যাচ্ছে, তিনি নতুন একটি আইন করতে যাচ্ছেন, যাতে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যাপারে কিছু বিধিনিষেধ থাকবে। চতুর্থত, তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন দেশকে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত করবেন। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেল তিনি খাদ্য ও জ্বালানিতে ভর্তুকি কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছেন। এতে করে বিত্তবানরা খুশি হবে, সাধারণ মানুষ খুশি হয়নি। তাই একটা অসন্তোষ ছিল। পঞ্চমত, তিনি দুর্নীতি কমানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও তার নিজের আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে তিনি বিতর্কিত হয়েছেন। ষষ্ঠত, বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য তার স্ত্রী রোজমাহ মনসুর বারবার বিতর্কিত হয়েছেন (শুধু চুলের স্টাইল করার জন্য প্রতিবার খরচ করেন ৪০০ ডলাস, বাংলাদেশি টাকায় ৩২ হাজার টাকা)। এটা পরোক্ষভাবে নাজিবের ইমেজ বৃদ্ধিতে কোনো সাহায্য করেনি।
প্রশ্ন হচ্ছে নাজিববিরোধী এই আন্দোলন সরকারের ভিতকে কি আদৌ কাঁপিয়ে দিতে পেরেছে? মনে হয় না। নিঃসন্দেহে নাজিবের ব্যক্তি ইমেজ এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সরকারের অবস্থান বেশ শক্তিশালী। মনে রাখতে হবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যত্র যে আন্দোলন হয়েছিল, তা ছিল সরকারবিরোধী একটি আন্দোলন। এখানে অর্থাৎ মালয়েশিয়াতে আন্দোলনের চরিত্র কিন্তু সরকারবিরোধী নয়, ব্যক্তি নাজিবের বিরুদ্ধে। এক সময় মনে করা হতো, মালয়েশিয়া এমন একটি সমাজ বিনির্মাণ করেছে, যেখানে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় না এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে রয়েছে কঠোর আইন। এমনকি সুশাসনের জন্যও মালয়েশিয়া সরকার আলোচিত। যদিও এটা সত্য, এখানে যে গণতন্ত্র বিকশিত হয়েছে, তা অনেকটা নিয়ন্ত্রিত। বিরোধীদলীয় কর্মকা-ও সীমিত। এখানে রাজনীতির চাইতে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে উন্নয়নকে। অনেকেই বলার চেষ্টা করেন মালয়েশিয়া উন্নয়নশীল দেশের জন্য একটি মডেল। এটা সম্ভব হয়েছিল মাহাথির মোহাম্মদের কারণে, যিনি ১৯৮১ সালে মালয়েশিয়ার চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। আর ২০০৩ সালের ৩১ অক্টোবর তিনি অবসরে যান। উমনো থেকেও বিদায় নেন ২০০৮ সালে। তবে ২০০৯ সালে আবার উমনোতে ফিরেও এসেছিলেন। তার ভূমিকা নিয়েও এখন প্রশ্ন আছে। অতীতে তিনি আনোয়ার ইব্রাহিমকে দল থেকে, ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বহিষ্কার পর্যন্ত করেছিলেন। আনোয়ারের বিরুদ্ধে সমকামিতার অভিযোগ ছিল। অনেকের ধারণা তিনি দলে তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী রাখতেন না (আনোয়ার ইব্রাহিম তার নিকটাত্মীয় এবং তাকে ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গণ্য করা হতো)। এখন নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে তার অবস্থানও সেখানে ‘মিশ্র’ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। দলকে মাহাথির মোহাম্মদ সাথে পাননি। শুধু তাই নয়, ‘সরকার উৎখাতের’ অভিযোগে পুশিল তখন মাহাথিরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল।
এক সময় মালয়েশিয়াকে নিয়ে অনেকে গর্ব করতেন। মাহাথির মালয়েশিয়াকে অনেক ‘উচ্চতায়’ নিয়ে গিয়েছিলেন। এখন দেখা গেল খোদ প্রধানমন্ত্রীও দুর্নীতির অভিযোগ থেকে ‘মুক্তি’ পেলেন না। সৌদি সরকার কেন তাকে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়েছিল, তাও বোধহয় জানা যাবে না কোনোদিন। এই ঘটনায় নাজিব রাজাক ‘মুক্তি’ পেলেন বটে, কিন্তু মালয়েশিয়া একটি বড় ধরনের ইমেজ সংকটের মুখে পড়েছে। Daily Amader Somoy 31.01.16
0 comments:
Post a Comment