রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সৌদি জোট, বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি

সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন একটি সামরিক জোটে বাংলাদেশের যোগদান একই সঙ্গে যখন অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, অন্যদিকে তেমনি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির ভবিষ্যেক একরকম অনিশ্চিত করে তুলেছে। এই সৌদি জোট গঠনের সময় ও পরে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। এক. সিরিয়া প্রশ্নে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া একটি যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে এবং একটি পরিকল্পনাও প্রণয়ন করেছে। এই পরিকল্পনার আওতায় আগামী ছয় মাসের মধ্যে সেখানে একটি গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক ও অসাম্প্রদায়িক সরকার গঠিত হবে এবং জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ১৮ মাসের মধ্যে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। দুই. সৌদি জোট গঠনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) পক্ষ থেকে সৌদি আরবে হামলার হুমকি দেওয়া হয়েছে। এটি একটি ‘নির্বোধদের’ জোট এবং পশ্চিমা তথা ‘ক্রুসেডারদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র’ করে সৌদি আরব এটি করেছে বলে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের সাময়িকী ‘দাবিক’-এ আইএসের এই প্রতিক্রিয়াও প্রকাশিত হয়েছে। তিন. সৌদি জোটে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বাংলাদেশ প্রকাশ্যে স্বীকার করে নেওয়ার আগেই গত ১৪ ডিসেম্বর সৌদি কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এক চিঠিতে বাংলাদেশিদের ওমরাহ ভিসা দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিল। ৯ মাস ধরে মানবপাচারের অভিযোগে ওমরাহ ভিসা বন্ধ রেখেছে সৌদি আরব। সৌদি জোট গঠন ও বাংলাদেশের যোগদানের সঙ্গে এই তিনটি সিদ্ধান্ত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত।
এরই মধ্যে এই জোটে বাংলাদেশের যোগদান নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। গত এক সপ্তাহে এ নিয়ে একাধিক টিভি টক শোতে আমি অংশ নিয়েছি। ওমরাহ ভিসা দেওয়ার সিদ্ধান্তটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ এবং সৌদি জোটে যোগদানের ব্যাপারে বিষয়টি সরকারিভাবে জড়িত। ধারণা করছি, এ বিষয়ে সৌদি সরকার আগেই বাংলাদেশের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছিল। সবাই জানেন, সৌদি আরব বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল এবং বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরপরই সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। কিন্তু এটাও সত্য, বাংলাদেশ সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আসছিল। প্রায় ২২ লাখ বাংলাদেশি বর্তমানে সৌদি আরবে কর্মরত। তাদের পাঠানো অর্থ আমাদের বৈদেশিক আয়ের অন্যতম উত্স; যদিও বেশ কিছুদিন ধরেই সৌদি আরব বাংলাদেশিদের জন্য সৌদি শ্রমবাজার বন্ধ রেখেছে। সৌদি আরব নেপালের মতো দেশ থেকে কর্মী সংগ্রহ করলেও বাংলাদেশি কর্মীদের কোনো স্থান ছিল না সৌদি শ্রমবাজারে। এখন ওই শ্রমবাজার উন্মুক্ত হবে বলে ধারণা করছি। একসময় আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে ‘মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ককে’ বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। সংবিধানের ২৫(২) ধারায় বলা হয়েছিল, ‘রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সক্ষম হইবেন।’ এই ধারাটি বর্তমানে আর নেই। বর্তমান সরকারের আমলে সংবিধান সংশোধনের সময় এই ধারাটি বাদ দেওয়া হয়। ফলে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন গঠিত ‘সামরিক’ জোটে বাংলাদেশের যোগদান ইসলামিক ভ্রাতৃত্ববোধ তথা উম্মাহর কারণে হয়েছে, এটা মনে করা ঠিক হবে না। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ তার ‘জাতীয় স্বার্থ’কে বিবেচনায় নিয়ে এই জোটে যোগ দিয়েছে। এটা ভালো হতো যদি ইসলামিক ঐক্য সংস্থাটি এ ধরনের একটি জোট গঠনের উদ্যোগ নিত। উপরন্তু ওআইসিভুক্ত অনেক মুসলিম দেশ (সিরিয়া, ইরান) ও আঞ্চলিক শক্তি (ভারত, ইন্দোনেশিয়া) এই সামরিক জোটে যোগ না দেওয়ায় বিতর্কের মাত্রা বেড়েছে বৈকি! এই জোটটি সামরিক জোট কি না, তা নিয়েও বিতর্ক আছে এবং সম্ভাব্য একটি ‘সামরিক অভিযানে’ সব দেশ অংশ নেবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। বাংলাদেশ জানিয়ে দিয়েছে তারা কোনো সামরিক কার্যক্রমে অংশ নেবে না। একমাত্র ভবিষ্যত্ই বলতে পারবে এই জোটটির ভূমিকা কী হবে? জোটটি শুধু ‘গোয়েন্দা কার্যক্রম সমন্বয় ও সংগ্রহ’ করার মধ্য দিয়ে তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখবে কি না সেটাও একটা প্রশ্ন বটে। তবে নিঃসন্দেহে এটা বলা যায়, এই জোটটি গঠনের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন আসবে।
এই সৌদি জোট অনেক প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এলো এখন। সৌদি আরব নিজে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে অন্যতম একটি ‘অ্যাক্টর’ অর্থাত্ অন্যতম নির্ধারক হিসেবে নিজেকে দেখতে চায়। অতীতের কোনো সৌদি বাদশাহ এভাবে সৌদি পররাষ্ট্রনীতি ও নিরাপত্তা ইস্যুতে কোনো বড় ভূমিকা পালন করেননি। কিন্তু বর্তমান বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের ‘অ্যাপ্রোচ’ একটু ভিন্ন। তিনি সৌদি আরবকে দেখতে চান এ অঞ্চলের রাজনীতির অন্যতম নির্ধারক হিসেবে। তাই তাঁর নেতৃত্বে একটি সামরিক জোটের প্রয়োজন ছিল। সৌদি আরব পারস্য অঞ্চলে তার প্রভাব বাড়াতে চায়। এর প্রকাশ হিসেবে আমরা দেখেছি ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে সৌদি আরবের হস্তক্ষেপ তথা সৌদি বিমানবাহিনীর ইয়েমেনে বোমাবর্ষণ। এর আগে লেবাননের গৃহযুদ্ধে সৌদি ট্যাংকবহরকে আমরা লেবাননে প্রবেশ করতে দেখেছি। অতীতে কুয়েতের আমির যখন ইরাকি সেনাদের দ্বারা উত্খাত হন (১৯৯০) তখন সৌদি আরব আমিরকে আশ্রয় দিয়েছিল বটে; কিন্তু আমিরের সমর্থনে কোনো সেনা বা বিমান পাঠায়নি। ২০১১ সালে তিউনিসিয়ায় ‘জেসমিন বিপ্লব’ জাইন আল আবেদিন বেন আলিকে ক্ষমতাচ্যুত ও বেন আলি সৌদি আরবে আশ্রয় নিলেও সৌদি আরব তিউনিসিয়ায় হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ ক্ষমতাসীন হয়ে সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনেন। আর তারই ফলে নতুন এক ‘সৌদি আরব’কে আমরা দেখছি। সৌদি আরবের নীতিনির্ধারকদের একটা বড় ভয় ইরানকে নিয়ে। পারসীয় অঞ্চলের রাজনীতিতে ইরানের ভূমিকা বাড়ছে এবং ইরানের এই ভূমিকাকে যুক্তরাষ্ট্র এখন স্বীকারও করে। ইরানের সঙ্গে ছয় জাতি পারমাণবিক চুক্তি, ইরানের ধর্মীয় নেতা খামেনিকে ওবামার গোপন চিঠি লেখা ইত্যাদি প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে ইরানের ভূমিকাকে স্বীকার করে নিয়েছে।
ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ ছয় জাতি আলোচনায় যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে এই জানুয়ারি মাসেই (২০১৬) ইরানের ওপর থেকে ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। ফলে ইরান আবারও একটি ‘শক্তি’ হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে। অতীতে ইরানি বিপ্লবের আগে (১৯৭৯) রেজা শাহ পাহলভির সময়ে ইরানের ভূমিকাকে ‘পারসীয় অঞ্চলের পুলিশ’-এর ভূমিকার সঙ্গে তুলনা করা হতো। ইরান সেই ভূমিকায় আবার ফিরে যাচ্ছে। সৌদি আরবের ভয়টা এখানেই। ইরানের উত্থান সৌদি আরবসহ এ অঞ্চলের শিয়া সম্প্রদায়কে আরো বেশি উত্সাহিত করবে।
এই জোটে সিরিয়াকে রাখা হয়নি। এটা সবাই জানে সৌদি আরব চাচ্ছে সিরিয়ায় আসাদের উত্খাত। কিন্তু সৌদি পছন্দের তালিকায় আইএসও নেই। সম্প্রতি আসাদবিরোধী দলগুলোর একটি সম্মেলন হয়ে গেল রিয়াদে। সেখানে এমন অনেক দল অংশ নিয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ আছে। এ ক্ষেত্রে সৌদি আরবের ভূমিকা কী হবে, এসব দল ও জোটের বিরুদ্ধে? অনেকেই জানেন ইসলামিক স্টেটের নেতৃত্বে সিরিয়া ও ইরাকের একটা অংশ নিয়ে তথাকথিত একটি জিহাদি রাষ্ট্র ‘সুন্নিস্থান’-এর জন্ম হয়েছে, যারা ওয়াহাবি মতাদর্শ ও আদি ইসলামিক রাষ্ট্রের ধ্যানধারণায় পরিচালিত হচ্ছে। সৌদি রাষ্ট্রের ভিত্তিই হচ্ছে এই ওয়াহাবি মতাদর্শ। এ ক্ষেত্রে আপাতদৃষ্টিতে আইএসের সঙ্গে সৌদি নীতিনির্ধারকদের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও আদর্শগতভাবে মিল তো আছেই। সুতরাং সৌদি-আইএস সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। আরো একটি কথা বলা দরকার, ইরাক ও সিরিয়ার তেলের কূপগুলোর একটা বড় অংশ ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। কালোবাজারে আইএস এই তেল বিক্রি করে। দৈনিক তাদের গড় আয় দুই মিলিয়ন ডলার। আর এ কারণেই আইএস পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী জঙ্গিগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। এই তেল তুরস্কের মধ্য দিয়ে অন্যত্র যায়। ইসরায়েল এই তেলের অন্যতম ক্রেতা। এই তেল নিয়েই সেখানে একটি যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়ছে। কেননা আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য কমে যাওয়ায় (ব্যারেলপ্রতি বর্তমান মূল্য মাত্র ৩৬ ডলার) বহুজাতিক তেল কম্পানিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের আয় কমে যাচ্ছে। ফলে একটি ‘যুদ্ধ’ শুরু না হলে এই তেলের মূল্য বাড়ানো যাবে না। তাই ধারণা করছি, একটি যুদ্ধ সেখানে আসন্ন। বলা ভালো, আইএসের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ৬৫ দেশের সমন্বয়ে এ অঞ্চলকে ঘিরে গঠিত হয়েছে ‘গ্লোবাল কোয়ালিশন টু কাউন্টার আইএসআইএল’। পশ্চিমা বিশ্ব এই জোটে আছে। বাংলাদেশকে ওই জোটে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হলেও বাংলাদেশ তাতে যোগ দেয়নি। এই জোটের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়া আইএস টার্গেটে বিমান হামলা চালালেও তাতে  আইএসকে উত্খাত করা সম্ভব হয়নি। এখন সৌদি জোটকে যুক্তরাষ্ট্র প্ররোচিত করতে পারে আইএসের বিরুদ্ধে একটি স্থল অভিযান শুরু করার।
নিঃসন্দেহে ২০১৬ সালটি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির জন্য অত্যন্ত কঠিন একটি সময়। সিরিয়াকে ঘিরেই রাজনীতি আবর্তিত হবে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে সেখানে একটি সরকার আদৌ গঠিত হবে কি না কিংবা ওই সরকারে কারা যোগ দেবে, আইএসের বিরুদ্ধে সৌদি জোট কোনো সামরিক অভিযান শুরু করবে কি না কিংবা আইএস সৌদি আরবের ভেতরে কোনো নাশকতামূলক কার্যক্রম শুরু করে কি না, এ বিষয়গুলো ভবিষ্যতে বারবার আলোচিত হতে থাকবে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ সৌদি জোটে যোগ দিয়ে আইএসের টার্গেটে পরিণত হলেও বাংলাদেশ তার ‘প্রাপ্য’ কতটুকু নিশ্চিত করতে পারবে সে প্রশ্নটিও থাকবে। Daily Kalerkontho 03.01.2016

0 comments:

Post a Comment