রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

পদ্মা সেতু আশীর্বাদ না অভিশাপ


কথাটা শুনতে খারাপই শোনায়। যে পদ্মা সেতু নিয়ে আমাদের এত গর্ব, সেই পদ্মা সেতু কী শেষ পর্যন্ত আমাদের জন্য আশীর্বাদ না অভিশাপ হয়ে দেখা দেবে? পদ্মা সেতু আমাদের অর্থনীতিতে বড় ধরনের অবদান রাখবে, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের চেহারা আমূল বদলে দেবে, দারিদ্র্য দূরীকরণে পালন করবে একটি বড় ভূমিকা- এ কথাগুলোই আমরা এত দিন শুনে আসছিলাম। এর মধ্যে কোনো মিথ্যা ছিল না। কিন্তু এখন? দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান এবং অর্থায়নে দীর্ঘসূত্রতার কারণে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংককে 'না' করে দিল। সম্ভবত এটা ছাড়া সরকারের কাছে আর কোনো বিকল্পও ছিল না। কিন্তু যে প্রশ্নটি আমাদের জন্য চিন্তার কারণ, তা হচ্ছে বিকল্প অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে সরকারের সিদ্ধান্ত। মন্ত্রীরা আমাদের জানাচ্ছেন তাঁদের কাছে মালয়েশিয়া, ভারত ও চীনের বিকল্প প্রস্তাব আছে, এমনকি সরকার নিজস্ব অর্থায়নেও শরিকদের সঙ্গে অংশ নিতে পারে। সরকারের জন্য এটা একটা প্রেস্টিজ ইস্যু, নির্বাচনী ওয়াদা। সরকার পদ্মা সেতু করবেই। সরকার যে পারবে না, তেমনটি নয়। সরকার বড় অর্থায়ন করতে পারে। তাতে উন্নয়ন বাজেটে কাটছাঁট করতে হবে। অধিক সুদে ঋণ নিতে হবে। এতে করে পরোক্ষভাবে দারিদ্র্য দূরীকরণের ওপর প্রভাব পড়বে। পুরোটা নিজস্ব অর্থায়নের ব্যাপারে সরকার বোধকরি কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। একই সঙ্গে মালয়েশিয়া কিংবা ভারতীয় প্রস্তাবও আমাদের জন্য খুব লাভবান হবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। মালয়েশিয়ার অর্থায়ন নিয়ে নানা কথা আছে। আর ভারতীয়দের বড় সেতু নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে বলে মনে হয় না। চীনাদের অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু আমার আশঙ্কা, রাশিয়ার কাছ থেকে আট হাজার কোটি টাকার সমরাস্ত্র ক্রয়ের ফলে চীন বাংলাদেশের ব্যাপারে নতুন করে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। অতীতে পদ্মা সেতুর ব্যাপারে আগ্রহ দেখালেও চীন সেই আগ্রহ নিয়ে এগিয় যাবে- এটা কেন জানি মনে হচ্ছে না। আরো একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের ব্যাপারে দুর্নীতির অভিযোগ ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সর্বশেষ বিবৃতির পর কোনো দাতাগোষ্ঠীই আর এ প্রকল্পে অর্থায়নে এগিয়ে আসবে না। এডিবি ও জাইকার অপারগতা এর বড় প্রমাণ। এখন মালয়েশিয়া ও ভারতও যদি পিছুটান দেয়, আমি অবাক হব না।

নিঃসন্দেহে পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। এই 'অবনতি' বিশ্বব্যাংক অন্যান্য প্রকল্পে যে অর্থায়ন করে, তাতে আদৌ প্রভাব পড়বে না, তা দিব্যি দিয়ে বলা যাবে না। মোট ৩৪টি প্রকল্পে তাদের প্রতিশ্রুত সাহায্যের পরিমাণ ৫৮০ কোটি মার্কিন ডলার (পদ্মা সেতুতে দিতে চেয়েছিল ১২০ কোটি ডলার। এই হিসাব এর বাইরে)। এখন অর্থমন্ত্রী যতই বলুন না কেন যে অন্য প্রকল্পে অর্থ ছাড়করণে আদৌ কোনো প্রভাব পড়বে না, বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। বিদায়ী অর্থবছরে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে বাংলাদেশ পেয়েছিল মাত্র ৫০ কোটি ডলার। অথচ বিশ্বব্যাংক প্রতিবছর আমাদের ১০০ কোটি ডলার করে সহায়তা বাড়ানোর কথা বলেছিল। পদ্মা সেতু ছাড়াও বিশ্বব্যাংকের সাহায্যপুষ্ট যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংস্থাটি হতাশা প্রকাশ করেছে, সেগুলো হচ্ছে ঢাকা পানি সরবরাহ এবং পয়োনিষ্কাশন প্রকল্প (১৪৯ মিলিয়ন ডলার, শুরু ২০০৯ সালে), সামাজিক বিনিয়োগ প্রকল্প-২ (১১৫ মিলিয়ন ডলার), উচ্চশিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধি প্রকল্প (৮১ মিলিয়ন ডলার), চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন প্রকল্প, সিদ্ধিরগঞ্জ পিকিং পাওয়ার প্লান্ট, বিশুদ্ধ বায়ু এবং টেকসই পরিবেশ প্রকল্প, ঘূর্ণিঝড় পুনর্বাসন প্রকল্প, ডিজঅ্যাবিলিটি অ্যান্ড চিলড্রেন অ্যাট রিস্ক প্রকল্প, পানি ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রকল্প, সোশ্যাল ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম ইত্যাদি। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই অর্থ ছাড়করণের পরিমাণ খুবই কম। দুর্নীতি ছাড়াও অদক্ষতা, কাজের শ্লথ গতির কারণেও বিভিন্ন সময়ে বিশ্বব্যাংক অভিযোগ উত্থাপন করেছে। হাইটেক পার্কে চলাচলের সুবিধার জন্য ঢাকা-কালিয়াকৈর শাটল ট্রেনপথ নির্মাণ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য বিশ্বব্যাংক ৫৫০ কোটি টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। একটি এমওইউও স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু পদ্মা সেতুর ঘটনার পর বিশ্বব্যাংক এ প্রকল্পেও অর্থায়ন স্থগিত করেছে। এখন কোনো প্রকল্পেই বিশ্বব্যাংক অর্থ ছাড় দিচ্ছে না। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সরকার 'লেভারাইজিং আইসিটি ফর গ্রোথ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড গভর্ন্যান্স' প্রকল্পের আওতায় উপজেলা পর্যায়ে ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়ার এক মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। এতে ৩০ হাজার মানুষকে প্রযুক্তিগত জ্ঞানসম্পন্ন করে গড়ে তোলা হবে। এই পরিকল্পনায় সরকারের সঙ্গে ৫০৯ কোটি টাকার আর্থিক সাহায্য দেওয়ার একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল বিশ্বব্যাংক। ২০০৭ সালে বিশ্বব্যাংক এ প্রকল্পে অর্থ সাহায্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে এই প্রকল্পের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে এবং গত ফেব্রুয়ারি মাসে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার কথা। এখন জটিলতা তৈরি হওয়ায় প্রকল্পটি ঝুলে গেল। অথচ ইন্টারনেট প্রযুক্তিকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার জন্য এ প্রকল্পের খুবই প্রয়োজন ছিল। এমনিতেই আইসিটি ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান বিশ্বে খুব ভালো নয়। ইউএনডিপি বিশ্বব্যাপী আইসিটি ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের র‌্যাংকিং বা তালিকা করে। এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১১৩ নম্বরে। এ তালিকা আরো উন্নত করতে হলে ইন্টারনেট কানেকটিভিটি খুবই দরকার। কিন্তু এই কানেকটিভিটি কাজে লাগাতে দরকার প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ, যা আমরা ওই প্রকল্পের আওতায় তৈরি করতে পারতাম। এখন আমরা ওই প্রকল্প নিয়ে একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকে গেলাম।

বিশ্বব্যাংকের সাহায্য নিয়ে অনেক কথা আছে। গরিব দেশ বলে বিশ্বব্যাংক বিনা সুদে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রায় সাহায্য দেয় না। সুদে-আসলে তা তুলে নেয়। বিশ্বব্যাংক উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক সাহায্য দিয়েই নিজেরা টিকে আছে। তবে তুলনামূলক বিচারে তাদের সুদের পরিমাণ কম এবং পরিশোধের সময়সীমাও দীর্ঘ। যেমন পদ্মা সেতুতে তাদের সুদের পরিমাণ ছিল ০.৭৫ শতাংশ। অন্যদিকে মালয়েশিয়া কিংবা অন্য কোনো বাণিজ্যিক ঋণের মাধ্যমে সেতু নির্মিত হলে সুদের হার হবে ৪ থেকে ৫ শতাংশ। উপরন্তু দীর্ঘ সময় তাদের টোল আদায়ের সুযোগ দিতে হবে। আর ঋণের টাকা তুলতে তারা অতিরিক্ত টোল আদায় করবে, যাতে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে না। বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিয়ে কথা থাকলেও সহজলভ্যতা ও সুদের হার কম হওয়ায় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো বিশ্বব্যাংকের ঋণ নেয়। স্বাধীনতার পর থেকে এখন অবধি ২৫১টি প্রকল্পের বিপরীতে এক হাজার ৬৮০ কোটি মার্কিন ডলার তারা অর্থায়ন করেছে। এখন পর্যন্ত এ সংস্থার এক হাজার ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ অপরিশোধিত রয়েছে। বর্তমানে মোট ৩৪টি প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের মোট ৪৬০ কোটি ডলার বিনিয়োগ রয়েছে। যদিও খুব কম ক্ষেত্রে এবং বিশেষ কোনো কারণ না থাকলে বিশ্বব্যাংক সাধারণত অর্থায়ন বন্ধ করে দেয় না। পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খারাপ হয়েছে, সন্দেহ নেই তাতে। এতে বাকি প্রকল্পগুলোর ব্যাপারে একটি অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হলেও সরকারের আচরণের ওপরই এখন সব কিছু নির্ভর করছে। আমরা যত বেশি বিশ্বব্যাংকের সমালোচনা করব, তত তিক্ততা সৃষ্টি হবে, যা কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে না।

বিশ্বব্যাংক ফিরে গেল কিংবা অর্থায়নের অনুরোধ ফিরিয়ে নেওয়া- যেভাবেই বিষয়টি বিশ্লেষণ করি না কেন, এটা স্বীকার করতেই হবে বহির্বিশ্বে এ ঘটনায় আমাদের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট হয়েছে। দুর্নীতির যে অভিযোগ বিশ্বব্যাংক করেছিল, সেটাই এখন প্রাধান্য পাবে বেশি। টিআইর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম। আগামী রিপোর্টে এ অবস্থানের আরো অবনতি ঘটবে। সামনে নির্বাচন। সরকারের জন্য বিষয়টি সুখকর হবে না। ইতিহাসই প্রমাণ করবে, পদ্মা সেতু শেষ পর্যন্ত আমাদের জন্য অভিশাপ না আশীর্বাদ হয়ে থাকবে। যেহেতু সরকারের জন্য এটা প্রেস্টিজ ইস্যু, সুতরাং যেকোনোভাবেই হোক সরকার সিদ্ধান্ত একটা নেবে। ধারণা করছি, প্রধানমন্ত্রী একটা ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করবেন। তার পরও অর্থনীতির ঝুঁকির বিষয়টি যদি সরকার বিবেচনায় নেন এবং তড়িঘড়ি করে কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়, তাহলে তা সবার জন্যই মঙ্গল।

Daily KALERKONTHO
10.2.13

0 comments:

Post a Comment