গত সপ্তাহে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড
ক্যামেরন। তিনি বলেছেন, ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) থাকবে কি থাকবে না,
সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন ব্রিটেনের জনগণ। তিনি জানিয়েছেন, ২০১৫ সালের
নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টি যদি জয়ী হয়, তাহলে ২০১৭ সালে তিনি ব্রিটেনের
ইইউতে থাকা না-থাকা নিয়ে একটি গণভোটের আয়োজন করবেন। কয়েক বছর ধরে ইউরো
জোনের (ইউরো ব্যবহারকারী দেশগুলো) নানা সংকট ইইউ’র ভবিষ্যেক বড় ধরনের
প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। ইউরো জোনের দেশগুলো কোনোভাবেই অর্থনৈতিক মন্দা
কাটিয়ে উঠতে পারছে না। পরিসংখ্যান বলে, ইউরো (একক মুদ্রা) ব্যবহারকারী ১৭
দেশে দ্বিতীয় প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি আরো শূন্য দশমিক ২ শতাংশ কমেছে। শুধু
তাই নয়, ২৭ দেশের জোট ইইউতে প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এ
পরিস্থিতি, আশার কথা বলে না। ইইউ এখন ভেঙে যাওয়ার মুখে। অভিন্ন ইউরোপের
ধারণা কল্পনায়ই থেকে যেতে পারে। ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে অর্থনৈতিক সংকট
ঘনীভূত হওয়ার আগ পর্যন্ত অভিন্ন ইউরোপের ধারণাটি অমূলক ছিল না। বরং ১৯৫৭
সালে ইউরোপিয়ান কমিউনিটি সৃষ্টির পর ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্বাক্ষরিত
ম্যাসট্রিচট চুক্তি ছিল অভিন্ন ইউরোপ গঠনের লক্ষ্যে একটি বড় ধরনের পদক্ষেপ।
ম্যাসট্রিচট চুক্তিতে একক মুদ্রা ও একটি ইউরোপীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠার
সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এরপর ১৯৯৭ সালের মার্চে শেঙ্গেন চুক্তি এবং ১৯৯৯ সালের ১
জানুয়ারি ইউরোপের একক মুদ্রা ইউরো চালুর সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে অভিন্ন
ইউরোপের দিকে যাত্রা করেছিল ইউরোপ। বলা ভালো, ১৯৯৩ সালের ১ নভেম্বর ইউরোপীয়
কমিউনিটি ইইউ নাম ধারণ করে। এরই মধ্যে সম্প্রসারণ ঘটেছে। ইইউ’র পূর্ব
ইউরোপে সমাজতন্ত্রের পতনের পর ২০০৪ ও ২০০৭ সালে বেশ ক’টি পূর্ব ইউরোপের দেশ
ইইউতে যোগ দিয়েছে। ইইউ’র সদস্যসংখ্যা এখন ২৭। ১৯৯৯ সালে তত্কালীন ইইউ’র
১৫টির মধ্যে ১১টি দেশ ইউরো চালু করেছিল। এখন চালু রয়েছে ১৭টি দেশে। চালু
হওয়ার সময়ই ইউরো নিয়ে প্রশ্ন ছিল। তখন বলা হয়েছিল, এটি চালু হলে ইউরোপের
উত্তরের ধনী দেশগুলো এ থেকে সুবিধা নিতে পারে। আজ এত বছর পর এ আশঙ্কাই
সত্যে পরিণত হলো। উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালে ইউরো চালু হওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও তিন
বছর পর্যন্ত নিজ নিজ দেশের মুদ্রা চালু থাকে এবং ২০০২ সালের জুলাইয়ে ইউরোর
কাগজি ও ধাতব মুদ্রা চালু হওয়ার পর পুরনো মুদ্রা বাতিল হয়ে যায়। গত নয় বছর
ইউরো নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন দেখা না দিলেও গেল বছরের প্রথম দিকে ইইউ’র
কয়েকটি দেশ বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। দেশগুলো ঋণ শোধ করতে না পেরে
অনেকটা দেউলিয়া হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে গ্রিস ও ইতালির অর্থনৈতিক পরিস্থিতি
চরমে ওঠে। ইতালিতে বারলুসকোনির নেতৃত্বে সরকারের পতন ঘটে সেখানে একটি নতুন
সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু গ্রিসে পাপোদ্রু সরকারের পতন, বিচারপতি
পাপাদেমাসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং সর্বশেষ নির্বাচনের
মধ্য দিয়ে একটা নয়া সরকার গঠিত হওয়ার পরও দেশটি অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে
উঠতে পারছে না।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ইইউ একটি শক্তি। অনেক আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ইইউ
যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে গিয়ে এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু ইউরো জোনের
অর্থনৈতিক সংকট ইইউ’র ভূমিকাকে সংকুচিত করে দিয়েছে।
এখানে বলা ভালো, ১৯৫৭ সালে মাত্র ছয়টি দেশ নিয়ে (বেলজিয়াম, ফ্রান্স,
পশ্চিম জার্মানি, ইতালি, হল্যান্ড, লুক্সেমর্বাগ) ইউরোপীয় ঐক্যের যে যাত্রা
হয়েছিল, তা আজ পরিণত হয়েছে ইইউতে। ২৭টি দেশ এখন ইইউ’র সদস্য। এর মধ্যে
আবার ২৪টি দেশ ন্যাটোর সদস্য।
ইউরোপে এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি সংস্থার জন্ম হয়েছে, যে সংস্থাগুলো ইউরোপীয়
ঐক্যকে ধরে রেখেছে। যেমন বলা যেতে পারে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, ইউরোপীয়
কাউন্সিল, ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপীয় আদালত, নিরীক্ষক দফতর, অর্থনৈতিক ও
সামাজিক কমিটি, আঞ্চলিক কমিটি, ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ইউরোপীয় মুদ্রা
ইনস্টিটিউটের কথা। এ সংস্থাগুলো অভিন্ন ইউরোপের ধারণাকে শক্তিশালী করেছে।
কিন্তু ইউরোপের অর্থনৈতিক মন্দা পুরো দৃশ্যপটকে এখন বদলে দিল। এখন শুধু
ইউরোই নয় বরং খোদ ইইউ’র অস্তিত্বও প্রশ্নের মুখে। যে যুক্তি তুলে একসময়
ব্রিটেন ও ডেনমার্ক ইউরো জোনে (এক মুদ্রা নিজ দেশে চালু) যোগ দিতে চায়নি।
সেটিই এখন সত্য বলে প্রমাণিত হলো। অর্থনৈতিক সংকট থেকে উদ্ধারের কাজটি অত
সহজ নয়। একটি দেশের সমস্যায় অন্য দেশ আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে
ইউরোর ভবিষ্যত্ নিয়ে। এক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বড়, তা হচ্ছে— ইইউ’র
বর্তমান কাঠামো আদৌ টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে কিনা?
২০০৭ সালে ইইউ যখন তার পঞ্চাশতম পূর্তি উত্সব পালন করে, তখনই বার্লিন
ঘোষণার মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, ইইউ’র মধ্যে বিভক্তি আছে।
লুক্সেমবার্গ ইউরোপের অন্যতম প্রধান অর্জন হিসেবে ইউরোর মুদ্রার কথা উল্লেখ
করেছিল। অথচ মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই প্রমাণিত হলো, ইউরো সব দেশের স্বার্থ
রক্ষা করতে পারছে না। ব্রিটেন
ও ডেনমার্ক প্রথম থেকেই ইউরোকে প্রত্যাখ্যান করে আসছিল। পোল্যান্ড ও ইতালি
চেয়েছিল ইউরোপের ক্রিশ্চিয়ান মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিতে। কিন্তু ফ্রান্স
এর বিরোধিতা করেছিল। দেশটি ধর্মকে আলাদা রাখতে চেয়েছিল। চেক রিপাবলিক ও
পোল্যান্ড নিরাপত্তার ওপর গুরুত্ব দিলেও ফ্রান্স ও জার্মানি এটা নিয়ে
চিন্তিত ছিল এ কারণে যে, নিরাপত্তার বিষয়টিতে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ
রাশিয়াকে খেপিয়ে তুলতে পারে। জার্মানি ও স্পেন ইইউ’র জন্য নতুন একটি
সাংবিধানিক চুক্তি করতে চাইলেও ব্রিটেন ও নেদারল্যান্ডস ছিল এর বিরোধী।
পূর্ব ইউরোপের সাবেক সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোও তাদের ভবিষ্যত্ নিয়ে উদ্বিগ্ন
ছিল। ১৯৮৯ সালের ‘ভেলভেট রেভুলিউশন’ এ দেশগুলোকে সোভিয়েত নির্ভরতা থেকে বের
হয়ে আসতে সাহায্য করে। এখানে সমাজতন্ত্রের পতন হয় এবং দেশগুলো গণতন্ত্রের
পথে ধাবিত হয়। কিন্তু ২০০৪ সালের আগে পূর্ব ইউরোপের কোনো দেশই ইইউতে যোগ
দিতে পারেনি। এ দেশগুলোর ওপর কোপেনহেগেন ফর্মুলা চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। ওই
ফর্মুলায় কতগুলো শর্ত দেয়া হয়েছিল; যা পূরণ করলেই ইইউ’র সদস্যপদ পাওয়া
যাবে। শর্তগুলোর মধ্যে ছিল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু, মুক্তবাজার অর্থনীতি
প্রবর্তন, মানবাধিকার রক্ষা, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দান এবং রাজনৈতিক
স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। এসব শর্ত পূরণ হওয়ার পরই কয়েকটি পূর্ব ইউরোপীয়
দেশ ২০০৪ ও ২০০৭ সালে ইইউতে যোগ দেয়। বসনিয়া হারজেগোভিনা কিংবা ক্রোয়েশিয়া
এখনো ইইউতে যোগ দিতে পারেনি।
এখন অর্থনৈতিক সংকট সব সংকটকে ছাপিয়ে গেছে। ঋণসংকটে জর্জরিত ইউরোপে আবারো
মন্দার আশঙ্কা বাড়ছে। গেল বছর ইউরো ব্যবহারকারী ইউরো জোনের শূন্য প্রবৃদ্ধি
হয়েছিল। ইইউ’র প্রবৃদ্ধিও ছিল শূন্যের কোটায়। তাই ইউরোপ নিয়ে শঙ্কা থেকেই
গেল। এখন ইইউ’র ঐক্য নিয়ে যে সন্দেহ, তা আরো বাড়বে। এরই মধ্যে ইইউ’র
দেশগুলোকে দুই স্তরে বিভক্ত করার প্রস্তাব উঠেছে। জার্মানি ও ফ্রান্স একটি
দুই স্তরবিশিষ্ট ইইউ চাচ্ছে। ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট সারকোজি
খোলামেলাভাবেই এ বিভক্তির কথা বলেছিলেন। জার্মানির চ্যান্সেলর মার্কেলও
চাচ্ছেন একটা পরিবর্তন। তিনি বলছেন এক নয়া ইউরোপ গড়ার কথা। যদিও এ বিভক্তির
বিরোধিতা করেছেন ইউরোপীয় কমিশনের চেয়ারম্যান হোসে ম্যানুয়েল বারোসো। এখন
সত্যি সত্যিই ইউরোপ ভাগ হয়ে যাবে কিনা কিংবা ‘নতুন ইউরোপ’-এর স্বরূপ কী
হবে, তা এ মুহূর্তে বলা কঠিন। তবে একটি পরিবর্তন যে আসন্ন, তা গ্রিসের
অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ইইউ ছোট অর্থনীতির দেশগুলোর
নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। এটাই ইইউ’র বড় ব্যর্থতা। তাই ব্রিটিশ
প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন যখন ইইউতে থাকা না-থাকা বিষয়ে গণভোট করতে চান, তখন
ইউরোপের ঐক্যে যে ফাটল দেখা দিয়েছে, তারই ইঙ্গিত দিলেন তিনি। ক্যামেরন
স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘আমরা যদি এখনই এসব সমস্যা নিয়ে উদ্যোগ নিতে না পারি,
তাহলে ইউরোপের পতন হবে এবং ব্রিটিশরা পতনের দিকে যেতে থাকবে।’ অতীতে ইইউ
সর্ম্পকে এত ভয়ঙ্কর কথা কেউ বলেননি। এখন ক্যামেরন সাহস করেই বললেন। সামনের
দিনগুলো কঠিন সময় ইইউ’র জন্য। মন্দাভাব যদি ইইউ কাটিয়ে উঠতে না পারে, তাহলে
এটা দিব্যি দিয়েই বলা যায়, দুই দশকের মধ্যে আমরা এক ভিন্ন ইউরোপের চেহারা
দেখতে পাব।
Daily BONIK BARTA
02.02.13
0 comments:
Post a Comment