রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

যেতে হবে অনেক দূর


শাহবাগ আন্দোলন এখন কোন পথে? গত ২১ ফেব্রুয়ারি ৬ দফা ঘোষণার মধ্য দিয়ে শাহবাগ আন্দোলনের টানা ১৭ দিনের অবস্থান কর্মসূচি পরিসমাপ্তি ঘোষণা করা হলেও গত শুক্রবার জামায়াত সমর্থিত ইসলামী দলগুলোর তাণ্ডবের পর শাহবাগ চত্বরে আবার ফিরে এসেছে আন্দোলনকারীরা। রাজনীতি আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এটা অস্বীকার করা যাবে না, এ দেশের তরুণ প্রজন্মের বড় বিজয় অর্জিত হয়েছে। ৬ দফা তারা দিয়েছে বটে, কিন্তু এখন যেতে হবে অনেক দূর। যে প্রত্যাশা তরুণরা সৃষ্টি করেছে, সে প্রত্যাশা ধরে রাখতে হবে। ইতিহাসের কি পুনরাবৃত্তি হয়? আমরা বলি হয় না। নিউইয়র্কের \'অকুপাই মুভমেন্ট\' আর দ্বিতীয়বার সংঘটিত করা যাবে বলে মনে হয় না। দ্বিতীয় আরেকটি \'তাহরির স্কয়ার\' আর সৃষ্টি হয়নি কায়রোতে। অথচ কায়রোতে এখনও অসন্তোষ আছে। অসন্তোষ আছে নিউইয়র্ক থেকে শুরু করে সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে। অসমতা, বৈষম্য সেখানে দূর হয়নি। একজন ওবামার পক্ষে এই বৈষম্য দূর করা সম্ভব নয়। কিংবা একজন মুরসি ধীরে ধীরে মিসরকে একটি ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাচ্ছেন, যা তাহরির স্কয়ারে যারা জমায়েত হয়েছিলেন, তারা চেয়েছিলেন, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। দীর্ঘ ৩০ বছর পর ফুঁসে উঠেছিল তাহরির স্কয়ার। সমসাময়িক যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এ ধরনের \'অকুপাই মুভমেন্ট\' কেউ কখনও দেখেনি। ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি তিউনিসিয়ায় জেসমিন বিপ্লব ক্ষমতাচ্যুত করেছিল দীর্ঘদিনের শাসক বেন আলিকে। মাত্র দুই বছরের মাথায় সেই প্রত্যাশায় এখন চিড় ধরেছে। প্রধানমন্ত্রী হামাদি জেবালি পদত্যাগ করেছেন। \'জেসমিন বিপ্লব\' প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। ইয়েমেনে কারমান গৃহবধূ, সাংবাদিক আর ছাত্রদের সংগঠিত করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। সানা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থান করে বাধ্য করেছিলেন আবদুল্লাহ সালেহকে দেশ ত্যাগ করতে। একজন তাওয়াকুল কারমান নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু ইয়েমেনে অস্থিরতা রয়ে গেছে। সেখানেও পূরণ হয়নি মানুষের প্রত্যাশা।
\'অকুপাই শাহবাগ\' আন্দোলনের পরিসমাপ্তি হয়েছে, এটা বলা যাবে না। একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি হলো। আগামী ২৬ মার্চের মধ্যে জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার ব্যাপারে একটি আইনি প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। রাজীবসহ এই আন্দোলনে যারা নিহত হয়েছেন, সাতদিনের মধ্যে তাদের হত্যাকারীদের গ্রেফতার করতে হবে। জামায়াতের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থের উৎস অনুসন্ধান করতে হবে ইত্যাদি।
এসব দাবি-দাওয়ার মধ্যে আপত্তি করার কিছু নেই। কিন্তু সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত দাবি কী আছে? আমি খুশি হতাম যদি তরুণ প্রজন্ম বলত সমাজে অসমতা দূর করার কথা, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করার কথা। যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ, গুম, বাল্যবিয়ে, ছাত্রলীগের তাণ্ডব_ এসব কথা একবারও উচ্চারিত হলো না। হয়তো \'এক বাক্সে সব ডিম এক সাথে\' রাখতে চায়নি তারা। শুধু একটি দাবিকেই তারা প্রাধান্য দিয়েছে_ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি। তবে তাদের বিজয় তো হয়েছেই। আইনে সংশোধনী আনা হয়েছে এবং চূড়ান্ত বিচারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। এখন আপিল বিভাগের ওপর আস্থাটা রাখতে হবে।
এই আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে হবে তৃণমূল পর্যায়ে। \'দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে\'র কথা বলেছে তরুণ প্রজন্ম। আসলেই তো এটা \'দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ\'! এই গণজাগরণ আগে কেউ কখনও দেখেনি। মানুষ শাহবাগে গেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। শাহবাগ হয়ে উঠেছে একটি জুকোটি পার্ক, একটি তাহরির স্কয়ার। সাধারণ মানুষের এই যে \'উত্থান\' এটাকে \'বিপ্লব\' হিসেবে আখ্যায়িত করতে দ্বিধাবোধ করেননি সমাজবিজ্ঞানীরা। যুগে যুগে সাধারণ মানুষ এভাবেই প্রতিবাদী হয়েছে। তবে ধরন পাল্টেছে। আজ সামাজিক নেটওয়ার্ক \'বিপ্লবে\'র অন্যতম হাতিয়ার। আজ তরুণরা \'বিপ্লবে\'র অন্যতম পথপ্রদর্শক। নোয়াম চমস্কি তার সর্বশেষ গ্রন্থ ঙপপঁঢ়ু-এ এই গণঅবস্থানকে সমর্থন করেছেন। এটা বিপ্লবের একটা ধরন। ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯-১৮১৫) সংগঠিত করেছিল কৃষকরা, রুটির দাবিতে দোকান আক্রমণ করেছিল। ফরাসি সমাজে বৈষম্য ছিল। রাজা ছিলেন স্বৈরাচারী। সাধারণ মানুষ ছিল অবহেলিত, নিষ্পেষিত, শোষিত। ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই জনতা স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের প্রতীক বাস্তিল দুর্গ আক্রমণ করে বিপ্লবের সূচনা করেছিল। ফরাসি বিপ্লব ফ্রান্সে জন্ম দিয়েছিল আইনের শাসন ও একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির। ফরাসি বিপ্লবের সঙ্গে রাশিয়ার বিপ্লবের (১৯১৭) কোনো মিল হয়তো নেই। রাশিয়ার বিপ্লবের পর সেখানে সমাজতন্ত্রনির্ভর একটি সমাজব্যবস্থার জন্ম হয়েছিল, যে সমাজব্যবস্থা বিংশ শতাব্দীর অনেক দেশ গ্রহণ করেছিল। তবে এই দুই \'বিপ্লবের\' সঙ্গে মিল আছে এক জায়গায়_ অসমতা, দারিদ্র্য আর বৈষম্য। আজ নিউইয়র্কের অকুপাই মুভমেন্টেও শুনি, এই অসমতা আর দারিদ্র্যের কথা। তাহরির স্কয়ারের গণজোয়ার স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে পরিচালিত হলেও তরুণ সমাজের বেকারত্ব আর দারিদ্র্য এই আন্দোলনকে শক্তিশালী করেছিল। আজ শাহবাগ আন্দোলনে যুদ্ধাপরাধীদের চরম বিচারের দাবি শুনি বটে, কিন্তু অনেক বেকার তরুণের ক্ষোভও মিলিত হয়েছে এই শাহবাগে।
আইন তার পথে চলুক। সুলতানা কামাল একটি কথা বলেছেন গত ১৪ ফেব্রুয়ারি। তিনি বলেছিলেন, \'বিচার বিভাগকে চাপ দিয়ে রায় আদায় করা ঠিক নয়\'। তাই আইন তার পথে চলুক। একটি আলটিমেটাম দিয়েছে তরুণ প্রজন্ম। এখন সরকারকে কাজ করতে দেওয়াই ভালো। তবে \'নষ্ট\' এই সমাজকে সঠিক পথে চলতে এ তরুণ প্রজন্ম একটি \'ওয়াচ ডগ\' হিসেবে কাজ করতে পারে। দুর্নীতি আজ আমাদের বড় সমস্যা। সমাজের প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি আজ \'অক্টোপাসের থাবায়\' আক্রান্ত। দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। \'সিডর\' ও \'আইলা\' আক্রান্ত অঞ্চলে মানুষ অসহনীয় দিনযাপন করছে। সুপেয় পানি নেই। শিশুদের স্কুল নেই। সমাজে বৈষম্য আর দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হোক তরুণ প্রজন্ম। ২১ ফেব্রুয়ারি শাহবাগে ব্লগার আর অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরামের আহ্বায়ক যখন ছয় দফা দাবি পাঠ করেন, তখন এ দেশের লাখ লাখ দর্শক টিভির পর্দায় দেখেছে। মনে রাখতে হবে প্রতিটি সফল \'বিপ্লবের\' পর পরই প্রতিবিপ্লবীরা তৎপর হয়। ফরাসি বিপ্লবের পর জ্যাকোবিনরা বিপ্লবকে নস্যাৎ করে দিতে চেয়েছিল। রাশিয়াতেও বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লবীরা তৎপর ছিল। শাহবাগ গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশ কেন, বিশ্বের সমকালীন ঘটনাবলিতে একটি স্থান করে নিয়েছে। এখন আর ফেরার পথ নেই। যেতে হবে অনেক দূর। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি থাকুক। আইন তার নিজ পথে চলুক। শাহবাগ যে \'শক্তির\' জন্ম দিয়েছে, সেই \'শক্তি\' সমাজের সব অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হোক, সব রাজনৈতিক দলের প্রভাবমুক্ত হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কাজ করুক। আমার বিশ্বাস, ইতিহাসে তারা নাম লেখাবেন। একাত্তরের প্রজন্ম যেমনি ইতিহাসে আছে স্বর্ণাক্ষরে, ঠিক তেমনি এই প্রজন্মও ইতিহাসে থেকে যাবে অনুপ্রেরণার এক উৎস হয়ে।
Daily Samakal
24.2.13

0 comments:

Post a Comment