রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বদলে যাওয়ার দিন


সেই কবে কবি হেলাল হাফিজ লিখেছিলেন, 'এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।' তারপর বুড়িগঙ্গায় অনেক পানি বয়ে গেছে। সরকার এসেছে। গেছে। কিন্তু পরিবর্তন হয়েছে সামান্যই। ভাষার মাসে সারা বিশ্ব বাংলাদেশকে দেখল এক ভিন্ন বাংলাদেশকে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ সারা জাতিকে একত্র করেছিল। গুটিকয়েক স্বাধীনতাবিরোধী বাদে সারা জাতি এক পতাকাতলে একত্র হয়েছিল- স্বাধীনতা। আজ ৪২ বছর পর বিশ্ব দেখছে এক 'দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ'। দিনের পর দিন শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে অবস্থান করে তারা যে ইতিহাস রচনা করল, সেই ইতিহাসকে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তরুণ প্রজন্ম আজ একটি ইস্যুতে সমাবেত হয়েছে- একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। দলমত-নির্বিশেষে সবাই তরুণদের এই আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছে। কিছুটা দেরিতে হলেও প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও এই দাবিকে অস্বীকার করতে পারেনি।
বিশ্বজুড়েই তরুণদের জয়-জয়কার। নিউ ইয়র্কের জুকোট্টি পার্ক থেকে শুরু করে ঢাকার শাহবাগ। মিলটা এক জায়গায়- তরুণরা প্রতিবাদী হয়েছে। প্রচলিত সমাজব্যবস্থাকে তারা চ্যালেঞ্জ করেছে। আর তাদের আন্দোলনের পাশে তারা পেয়েছে সাধারণ মানুষকে। জুকোট্টি পার্কে জন্ম হওয়া 'অক্যুপাই মুভমেন্ট'-এ যেমনি সাধারণ মানুষ সমবেত হয়েছিল, ঠিক তেমনি তাহরির স্কয়ারেও আমরা দেখেছি সেসব মুখ, যারা সুবিধাবঞ্চিত। রাষ্ট্র যাদের জন্য কিছু করেনি। সেই একই ছবি আমরা দেখেছি নয়াদিল্লিতে, যখন 'দামিনীর' ধর্ষণ ও মৃত্যুর পর প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিবাদী হতে পারেনি, সেদিন প্রতিবাদী হয়েছিল তরুণরা। আর সাধারণ মানুষ সেই প্রতিবাদে শরিক হয়ে রচনা করেছিল এক ইতিহাস। আজ প্রজন্ম চত্বরে যা ঘটল, তার সঙ্গে বিশ্বব্যাপী চলা 'অক্যুপাই মুভমেন্টের' কোনো পার্থক্য নেই।
এই তরুণরাই পারে সব কিছু বদলে দিতে। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে আবার ফিরে এসেছে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের স্পিরিট। ফিরে এসেছে ছেষট্টি, ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন আর একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলন। যে তরুণ একাত্তরে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে গিয়েছিল, এ প্রজন্মের 'সেই তরুণ' আবার ফিরে এসেছে শাহবাগে, যা এখন প্রজন্ম চত্বর। আমাদের সনাতন রাজনীতিবিদদের দেখিয়ে দিল, এই 'নষ্ট' সমাজের সুবিধাভোগী মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখন এই তরুণরা সারা রাত জেগে প্রতিবাদের এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। লাকি আক্তারের এক-একটি স্লোগান যে কত ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে, তার বড় প্রমাণ ওই প্রজন্ম চত্বর। লাকির সেই স্লোগান ছুঁয়ে গেছে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত প্রতিটি মানুষকে। ইতিহাসে স্থান করে নেওয়া লাকিরা একুশ শতকের তোফায়েল আর মেনন। আগামীর ইতিহাস ওদের কিভাবে চিহ্নিত করবে, আমি জানি না। তবে এ দেশের অনেক কষ্টে থাকা মানুষের প্রত্যাশা ওদের কাছে অনেক বেশি। প্রবীণ সাংবাদিক এ বি এম মূসা কবি জলিল চৌধুরীর কবিতার উদ্ধৃতি উল্লেখ করে লিখেছেন, 'ও আলোর পথযাত্রী, এ যে রাত্রি। এখানে থেমো না।' লাকিরা কী থামবে এখানে? আমি জানি না। 'শাহবাগ অক্যুপাই মুভমেন্টের শেষই বা কোথায়?
প্রতিটি আন্দোলনেরই একটি সমাপ্তি থাকে। নিউ ইয়র্কের অক্যুপাই মুভমেন্টের সেই আবেদন এখন আর নেই। 'দ্বিতীয় আরেকটি তাহরির স্কয়ার আর জন্ম হবে না মিসরে। তাই শাহবাগ অক্যুপাই মুভমেন্টেরও সমাপ্তি প্রয়োজন। এই প্রজন্মের তরুণদের আন্দোলনের প্রাপ্তি একেবারে কম নয়।
এক. সোশ্যাল মিডিয়া যে কত বড় একটি শক্তি, বাংলাদেশের তরুণসমাজ তা আবার প্রমাণ করল। এই সোশ্যাল মিডিয়াকে এখন সমাজ উন্নয়নে কাজে লাগানো সম্ভব। একই সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়া একটি 'ওয়াচ ডগ' হিসেবেও কাজ করতে পারে। সমাজে নানা অনিয়ম, অসমতা, দরিদ্রতা, দুর্নীতি, ধর্ষণ, শিশু অধিকার, গুম, হত্যাকাণ্ড নানা কারণে সমাজটা নষ্ট হয়ে গেছে। রাজনীতিবিদদের মধ্যে 'কমিটমেন্ট'-এর বড় অভাব। দুর্নীতিবাজরা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। তরুণরা প্রতিবাদী হোক এসব ঘটনায়। শেয়ারবাজার, পদ্মা সেতু, হলমার্ক, ডেসটিনি প্রভৃতি নানা ঘটনায় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি একেবারে তলানিতে। এই তরুণরাই পারে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে।
দুই. বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন বাংলাদেশকে একটি 'সফ্ট পাওয়ার'-এর মর্যাদা দিয়েছে। হিলারি ক্লিনটনের মতো ব্যক্তিত্ব ঢাকায় এ কথা বলে গেছেন। তারুণ্যের এই শক্তি যদি দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে অগ্রণী ভূমিকা নেয়, যদি দুর্নীতিমুক্ত একটি সমাজ প্রতিষ্ঠায় নিজেদের নিয়োজিত করে, আমার বিশ্বাস বাংলাদেশকে বিশ্ব গণ্য করতে বাধ্য।
তিন. যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা এই আন্দোলনে একটি 'প্রতীক', যা আমাদের রাজনীতিবিদদের একটা মেসেজ দিয়ে গেল। কোনো রাজনৈতিক দলের ব্যানারে এই আন্দোলন পরিচালিত হয়নি এটা যেমন সত্য; ঠিক তেমনি এটাও সত্য, ক্ষমতাসীন সরকার তথা সরকার সমর্থক ১৪ দলের নেতাদের সাংস্কৃতিক কর্মীদের ছাত্র নেতাদের মধ্যে বক্তৃতা দেওয়া, সারাক্ষণ উপস্থিত থাকা ও আন্দোলন তদারকি করা কোনো কোনো মহলে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তরুণ নেতৃত্বকে আজ এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
চার. আমাদের তরুণ সমাজ এখন 'সকল প্রকার অন্যায়ের বিরুদ্ধে' প্রতিবাদের একটি প্লাটফর্ম গড়ার উদ্যোগ নিতে পারে। তারা যদি তাদের আন্দোলনে বিরোধী দলকে সংযুক্ত করতে পারে, সেটা হবে তাদের জন্য বড় পাওয়া। জাতীয় 'ঐক্য' প্রতিষ্ঠার একটি ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে তারা। এ মুহূর্তে এটাই চাওয়া। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার একটি দাবি। পর্যায়ক্রমে অন্য দাবিগুলোও সামনে নিয়ে আসতে হবে। 'পচা সমাজ'কে বিশুদ্ধ করার সময় এখনই।
পাঁচ. যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি যৌক্তিক। কিন্তু শুধু এক দাবিতে তরুণরা যদি অনড় থাকে এবং আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে প্রশ্ন উঠবে আন্দোলনকারীরা বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করছে কি না! এই প্রশ্ন সম্প্রতি তুলেছেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, বিচার বিভাগকে চাপ দিয়ে রায় আদায় করা ঠিক নয়। তার এই বক্তব্যের মেরিট আছে। অনেক সিনিয়র আইনজীবীর অভিমতও অনেকটা তাই। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করা যায় না। স্বাধীন বিচার বিভাগ গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত। বিচার বিভাগ স্বাধীন না হলে গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়বে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একটি রায় হয়েছে। এই রায়ে সংযুক্ত হয়েছে অনেকেই। চরম শাস্তি হয়নি। তাই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সংশোধিত ট্রাইব্যুনাল আইন সংসদে পাস হয়েছে। এখন হয়তো সরকার আপিল করবে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তা শুনবেন। উচ্চ আদালতকে কিছুটা সময় তো দিতে হবে। এখন যদি আদালতকে চাপ প্রয়োগ করার আন্দোলন অব্যাহত থাকে, তাহলে সুলতানা কামালের মতো অনেকেই বলতে শুরু করবেন বিচার বিভাগে প্রভাব খাটানো ঠিক নয়। সুলতানা কামাল কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকলেও তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লোক ও সরকারের খুব কাছের মানুষ। সুতরাং তার অভিমতকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
ছয়. শাহবাগ অক্যুপাই মুভমেন্টের ফসল লাকি আক্তার সর্বত্র রাজাকারবিরোধী ব্রিগেড গঠন করার আহ্বান জানিয়েছেন। এটাও ঠিক নয়। এ আহ্বান আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার শামিল এবং রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত সমাজে প্রতিপক্ষকে 'রাজাকার' হিসেবে চিহ্নিত করার একটা প্রবণতা দেখা যাবে। এটা হবে আইনের শাসনের অন্তরায়। প্রচলিত আইনেই রাজাকারদের বিচার হোক। ব্রিগেড গঠনের কোনো প্রয়োজন নেই।
সাত. প্রতিবাদী তরুণ প্রজন্ম আন্দোলনকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি সংগঠনের জন্ম দিতে পারে। তবে দলনিরপেক্ষদের নেতৃত্বে স্থান দেওয়াই মঙ্গল। কেননা ব্লগারদের কারো কারো বিরুদ্ধে সরকারি ছাত্র তথা যুব সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। সুতরাং নিরপেক্ষতার স্বার্থেই এদের কোনো পর্যায়ে স্থান না দেওয়াই মঙ্গল।
আট. অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ন্যায়সংগত। এটা তরুণ প্রজন্ম আবার প্রমাণ করল। তারা যদি একটা 'ঐক্য' প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তাহলে আমাদের রাজনীতিবিদরা পারবেন না কেন? এই আন্দোলন দেখিয়ে দিল জাতীয় ইস্যুতে ঐক্যের প্রয়োজন অনেক জরুরি।
নোয়াম চমস্কি তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থ Occupy-এ বিশ্বব্যাপী যে 'অক্যুপাই মুভমেন্ট' পরিচালিত হচ্ছে, সে ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন। তিনি এর পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন। সেখানে চমস্কি বলেছেন, 'More Human Course-এর কথা। শাহবাগ 'অক্যুপাই মুভমেন্ট' সমাজকে একটা বড় ধাক্কা দিল। এ ধরনের 'মুভমেন্ট' সমাজে বারবার জন্ম হয় না। দশকে একবারই হয়। বাংলাদেশের অতীত এর বড় প্রমাণ। তাই শাহবাগের তরুণ প্রজন্ম এই আন্দোলনকে যদি আগামীতে More Human Course-এর আলোকে পরিচালিত করতে পারে, তাদের সাফল্য সেখানেই নিহিত।Daily Kalerkontho20.2.13

0 comments:

Post a Comment