রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের বাংলাদেশ সফর


জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে ৫ সদস্যবিশিষ্ট মার্কিন কংগ্রেসের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। এ সফর একাধিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, মার্কিন প্রেসিডেন্ট গত ২১ জানুয়ারি দ্বিতীয় বারের মতো প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। তার দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র এক সপ্তাহের মাথায় একটি কংগ্রেসীয় প্রতিনিধি দলের বাংলদেশে উপস্থিতি অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ যখন তার পোশাক শিল্পের জন্য জেএসপি সুবিধা চাচ্ছে, তখনই বাংলাদেশ এই সুবিধা পেতে পারে কি না, তা দেখার জন্যই প্রতিনিধি দলটির বাংলাদেশ সফর। তৃতীয়ত, তৈরি পোশাকে জেএসপি সুবিধার সাথে পোশাক কারখানাগুলোতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি পরোক্ষভাবে জড়িত। তাজরিন পোশাক কারখানায় ১১১ জন শ্রমিকের মৃত্যুর পর বাংলাদেশি তৈরি পোশাক এখন বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে। এই পোশাক কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়নি। এমনকি মার্কিন কংগ্রেস সদস্যরা যখন ঢাকায়, তখন খোদ ঢাকা শহরে মোহাম্মদপুরে একটি কারখানায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেলেন ৭ জন পোশাক কর্মী। এতে করে যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে জেএসপি সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি এখন ঝুলে গেল। অথচ জেএসপি সুবিধার বিষয়টি বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। ঢাকায় মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি দলটি জানিয়ে গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা বাংলাদেশ যদি পেতে চায়, তাহলে বাংলাদেশ লবিস্ট নিয়োগ করতে পারে। মার্কিন কংগ্রেসের ওয়েজ অ্যান্ড পিস কমিটির চেয়ারম্যান ও রিপাবলিকান পার্টির সদস্য জ্যাক কিংস্টন নেতৃত্বাধীন কমিটির বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, জেএসপি সুবিধার বিষয়টি বাংলাদেশ যত সহজ ভাবছে, তত সহজ নয়। এখানে লবিস্ট নিয়োগ করেও কতটা সুবিধা পাওয়া যাবে, সে ব্যাপারেও আমি নিশ্চিত নই। আসলে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক খুব ভালো যাচ্ছে না। জেএসপি সুবিধা পাওয়ার বিষয়টিই একমাত্র বিষয় নয়, আরো অনেক বিষয় রয়েছে। যেখানে দু’দেশের সম্পর্ক আটকে আছে। সুতরাং একটা প্রশ্ন থেকেই গেল, ওবামার শাসনামালে দু’দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আদৌ কোনো পরিবর্তন আসবে কি না। কিছুদিন বলা হচ্ছিল, যুক্তরাষ্ট্র জেএসপির ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সরকারি পর্যায়ে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বিশেষ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র খুব দ্রুত টিকফা চুক্তি করতে চাচ্ছিল। বাংলাদেশ সরকার এক্ষেত্রে কালক্ষেপণ করেছে।
একই সঙ্গে শ্রমিকদের অধিকার লঙ্ঘন, শ্রমিক নেতা আমিনুলের হত্যাকারীদের খুঁজে বের না করার ব্যর্থতা, সর্বোপরি ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সরকার বিষয়গুলো কখনোই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়নি। ফলে ‘ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেনটিটিভ’ সম্প্রতি যে চিঠি ইস্যু করেছে, তাতে জেএসপি সুবিধা বাতিলের কথা পরোক্ষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে বলা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যের পরিমাণ ৪৮০ কোটি ডলার। বাংলাদেশ যেমন পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করে, তার মাঝে মাত্র ৫ শতাংশ পণ্য এ জেএসপি সুবিধা পায়। আমরা দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করে আসছি তৈরি পোশাকে জেএসপি সুবিধা পাওয়ার। কোনো কোনো মহল থেকে আমাদের আশ্বাসও দেয়া হয়েছিল যে, তৈরি পোশাকে জেএসপি সুবিধা দেয়া হবে। এখন সব ভেস্তে যেতে বসেছে। যুক্তরাষ্ট্র একজন নয়া বাণিজ্যমন্ত্রী ও একজন নয়া পরাষ্ট্রমন্ত্রী পাচ্ছে। তাতে করে বাংলাদেশের ব্যাপারে প্রচলিত নীতিতে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আসবে না।
ওবামার দ্বিতীয় দফা দায়িত্বগ্রহণ নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বসবাসকারীদের জন্য একটি আনন্দের সংবাদ। এতে করে অভিবাসী ও অবৈধ অধিবাসীদের জন্য সুযোগ আরো বাড়ল। ওবামার জন্য মূল চ্যালেঞ্জ হবে অর্থনীতিকে ‘বিপদের’ হাত থেকে রক্ষা করা। ‘ফিসক্যাল ক্লিফ’-এর ব্যাপারে সিনেট ও কংগ্রেস নীতিগতভাবে এক হলেও এখানে বলা হয়নি যুক্তরাষ্ট্রের ১৬ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলারের ঋণের কী হবে। এই ঋণ যে অর্থনীতিতে একটি অস্থিরতা তৈরি করবে, তা আর কাউকে বলে দিতে হয় না। অর্থনীতির ‘পাগলা ঘোড়া’কে তিনি যদি বাগে আনতে না পারেন, তাহলে অতিদ্রুত তিনি জনপ্রিয়তা হারাবেন। যে বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে তিনি হোয়াইট হাউসে থেকে গেলেন, অতিদ্রুত সেই জনপ্রিয়তা তিনি হারাতে পারেন।
তার জন্য আগামী ৪ বছর খুব ভালো সময় যাবে বলে মনে হচ্ছে না। তিনি ইতিমধ্যে কংগ্রেসের ঋণের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য অনুরোধ করেছেন। কেননা আগামী ১৫ মার্চের মধ্যে ফেডারেল সরকারকে ট্যাক্স রিটার্ন থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসেবা, সোশ্যাল সিকিউরিটি খাতে বিপুল অর্থ পরিশোধ করতে হবে। এজন্য তাকে ঋণ করতে হবে। তাই ঋণের পরিমাণ এখন ১৬ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার। রিপাবলিকানরা ঋণ ‘ফ্রিজ’ করে দিতে চাচ্ছেন। অর্থাৎ ঋণের পরিধি বাড়ানো যাবে না। আর সত্যি সত্যিই যদি ওবামা প্রশাসন ঋণের পরিধি না বাড়ান, তাহলে ট্যাক্স রিটার্নের ৮৬ বিলিয়ন ডলার, সোশ্যাল সিকিউরিটির ৬১ বিলিয়ন ডলার কিংবা মেডিকেয়ারের ৭৩ বিলিয়ন ডলারের ‘বিল’ পরিশোধে ব্যর্থ হবে। তাতে করে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে প্রবীণরা একটা বড় ধরনের সমস্যার মধ্যে পড়বেন। তাদের স্বাস্থ্যসেবা সংকুচিত হবে। সোশ্যাল সিকিউরিটির ‘চেক’ যারা পান, তারাও পড়বেন বিপদে। যে মধ্যবিত্ত ওবামাকে বিজয়ী হতে সাহায্য করেছিল, তারা পড়বেন বিপদে। তাই ওবামাকে ঋণ করতেই হবে। কংগ্রেস যদি ঋণ বহনে অনুমতি না দেয়, তাহলে বছরের শুরুতেই এক ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে তিনি যাত্রা করবেন। সমস্যা তার জন্য আরো আছে। আফগানিস্তান, সিরিয়া, ফিলিস্তিন তার জন্য বড় সমস্যা। আফগানিস্তান থেকে সব সেনা প্রত্যাহারের (২০১৪) সিদ্ধান্তে তিনি অটল। কিন্তু অতঃপর? তালেবানদের সঙ্গে কোনো ‘সমঝোতা’ হয়নি। ২০১৪ সাল কারজাইয়ের শেষ বছর হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। চলতি বছর আফগানিস্তানের জন্য একটি ‘বিকল্প সমাধান’ তিনি বের করতে পারবেন বলেও মনে হয় না। আর কারজাইয়ের পতন যদি সেখানে তালেবানদের ক্ষমতা গ্রহণের পথকে প্রশস্ত করে, সেটা হবে ওবামার বৈদেশিক নীতির জন্য দুঃসংবাদ। পাকিস্তানে অব্যাহত ড্রোন হামলা সেখানে ‘পাকিস্তানি তালেবান’দের নির্মূল করা যায়নি; বরং পাকিস্তান আজ ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। সিরিয়ার গৃহযুুদ্ধের ব্যাপ্তি সিরিয়াকে এক ‘নয়া লেবাননে’ পরিণত করতে পারে। আর মিসরে ইসলামপন্থিদের উত্থান ওবামা প্রশাসনের জন্য আদৌ কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনবে না আগামী দিনে।  মার্কিন প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণ সেখানে এক ধরনের উৎসবের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, প্রায় ১০ লাখ মানুষ এ উৎসবে অংশ নিয়েছিল। এটা ৫৭তম শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। এটাও চাঁদানির্ভর। ২০০৯ সালে প্রথমবারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে ওবামা ব্যয় কয়েছিলেন ৫৩ মিলিয়ন ডলার। সিনিয়র বুশ ও ক্লিনটন ব্যয় করেছিলেন যথাক্রমে ৩০ ও ৪২ মিলিয়ন ডলার।
জন কেরি এখন হিলারি ক্লিনটনের স্থলাভিষিক্ত হবেন। এতে বাংলাদেশের ব্যাপারে তাদের নীতিতে পরিবর্তন আসবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশের গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ড, শ্রমিকদের নিরাপত্তা রক্ষায় ব্যর্থতা, কমপ্লায়েন্সের ব্যর্থতা ইত্যাদি কারণে খোদ মার্কিন কংগ্রেসও শ্রমিক সংগঠনগুলোর ‘চাপ’-এর মুখে আছে। যুক্তরাষ্ট্রে তিন থেকে চারটি শ্রমিক সংগঠন রয়েছে, যারা শ্রমিকদের স্বার্থ নিয়ে কাজ করে। মার্কিন পত্রপত্রিকায় বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টর নিয়ে যেসব নেতিবাচক সংবাদ ছাপা হয়েছে, তাতে করে বাংলাদেশের জেএসপি সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। এখানে বলা ভালো, বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার রফতানিকৃত পণ্যসামগ্রীর মাঝে কিছু কিছু ক্ষেত্রে জেএসপি তথা শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়। তৈরি পোশাকের সব আইটেমে পায় না; খুব সীমিত আইটেমে পায়। বাংলাদেশ প্রায় ১৫ ভাগ শুল্ক পরিশোধ করে তার তৈরি পোশাক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করছে এবং ব্যবসা করছে। এ ১৫ ভাগ শুল্ক যাতে দিতে না হয়, সে দাবিই করে আসছিল বিজিএমইএ। কিন্তু বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পশ্চিমা ক্রেতারা এখন বাংলাদেশি পণ্যের ব্যাপারে শঙ্কিত। মার্কিন ৫ জন কংগ্রেস সদস্যের বাংলাদেশ সফর প্রমাণ করে, তারা বিষয়টিকে কত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। বাংলাদেশ সরকার কিংবা বিজিএমইএ কেউই পোশাক কারখানাগুলোতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। এখানে এক ধরনের উদাসীনতা লক্ষণীয়। আরো দুঃখজনক সংবাদ হচ্ছে, কোনো অনুমতি ছাড়াই প্রশাসনের নাকের ডগায় মোহাম্মদপুরের অগ্নিদগ্ধ কারখানাটি কাজ করছিল। এটা কী করে সম্ভব, ভাবতেই অবাক লাগে! বলা যেতে পারে, পোশাক কারখানাগুলোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আমাদের জন্য এক আশনি সংকেত। আমরা এ ব্যাপারে যদি ‘সিরিয়াস’ না হই, তাহলে আমাদের জন্য আগামীতে আরো খারাপ খবর অপেক্ষা করছে। ওবামার দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে আমাদের ‘বড় কিছু’ অর্জিত হয়েছে এটা মনে করারও কোনো কারণ নেই। তবে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের ঢাকা সফর আমাদের একটা বার্তা পৌঁছে দিয়ে গেল। সতর্ক হওয়ার সময় এখনই।
Daily MANOBKONTHO
05.02.13

0 comments:

Post a Comment