রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

‘অক্যুপাই শাহবাগ’ যে আবেদন সৃষ্টি করেছে


গত শুক্রবার ১৫ ফেব্র“য়ারি প্রজন্ম চত্বরে গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য এ আন্দোলন কোন দিকে যাচ্ছে, তা বোঝা। প্রচুর মানুষ। একদিকে বইমেলা, অন্যদিকে প্রজন্ম চত্বরের স্লোগান। সাধারণ মানুষ হয়ে প্রজন্ম চত্বরে আগেও গেছি সংহতি জানাতে, গত শুক্রবারও গেলাম। সেই মুখ, সেই স্লোগান। আদিবাসী ছাত্ররাও এসেছে। তারাও স্লোগান দিচ্ছে তাদের ভাষায়। আর সে স্লোগানে সুর মিলিয়েছে বাঙালিরা। এ এক মহামিলন মেলা। এ মেলা দেখেনি কেউ কোনো দিন। কিন্তু এর শেষ কোথায়? শুক্রবার একটি সিদ্ধান্ত হয়েছিল সমাবেশ সাত ঘণ্টার মাঝে সীমিত রাখার। কিন্তু রাতে এক ব্লগার রাজীব হায়দার শোভনের (থাবা বাবা) মৃত্যু বদলে দিল আগের সিদ্ধান্তকে। সমাবেশ চলবে লাগা চব্বিশ ঘণ্টা। তারুণ্যের এ ‘প্রতিবাদ’-এর সঙ্গে দ্বিমত করার যেমন কোনো সুযোগ নেই, ঠিক তেমনি অনির্দিষ্টকালের জন্য এ সমাবেশ চলতে পারে না, কারো কারো এ কথাটাও আজ অস্বীকার করা যাবে না। এ আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনীতির এক মাইলস্টোন। তরুণ সমাজ যে একটি শক্তি, তা রাজনৈতিক নেতারা এখন উপলব্ধি করবেন। দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বের সারিতে তরুণদের প্রতিনিধিত্ব বাড়বে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের ব্যাপারে সরকার আরো সতর্ক হবে এবং ইতিমধ্যেই আইন পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা এ আন্দোলন থেকে সুবিধা আদায় করে নিতে চাইবে এবং তারা নিয়েছেও। সরকারের অবস্থান এ মুহূর্তে তাদের অনুকূলে রয়েছে, এটা ভেবে তারা যদি আত্মতুষ্টিতে ভোগে, তাহলে তারাও ভুল করবে। এ গণঅসন্তোষ এক সময় সরকারের বিরুদ্ধেও চলে যেতে (?) পারে। ইস্যু তো অনেক রয়েছেই। পদ্মা সেতু, হলমার্ক, ডেসটিনি, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, সাংবাদিক দম্পত্তি রুনি-সাগর হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি নানা ইস্যুতে মাঠ আবার ‘গরম’ হয়ে যেতে পারে। সরকার যদি এসব বিষয়েও দৃষ্টি দেয় ভালো করবে। বিএনপির ‘প্রায় নীরবতা’ বিএনপির ভবিষ্যৎকে একটি প্রশ্নের মাঝে ঠেলে দিতে পারে। নিঃসন্দেহে বিএনপি একটি ‘ডায়নামা’ ফেস করছে। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং লাখ লাখ লোকের ‘সেন্টিমেন্ট’, অন্যদিকে শরিক দল জামায়াতকে সমর্থন। কাদের মোল্লার ফাঁসির ব্যাপারে বিএনপি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। এর একটা ভালো দিক আছে। বিচারাধীন বিষয়ে মন্তব্য না করাই ভালো। এমনিতেই বিএনপির সিনিয়র নেতারা নানা ধরনের মামলা-মোকদ্দমার মাঝে আছেন। আবার কোনো মন্তব্য করে আদালত অবমাননা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে যেতে পারেন। তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু এখন চাপা পড়ে যেতে পারে। মানুষের দৃষ্টি এখন আদালতের দিকে, চূড়ান্ত রায়ের দিকে। আগামীতে আরো অন্তত দুটি রায় আসছে। সাধারণ মানুষের দৃষ্টি এখন  সেদিকেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুটি এ মুহূর্তে ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের’ ইস্যুতে হারিয়ে যেতে পারে। শাহবাগ চত্বরের ‘অক্যুপাই আন্দোলন’ জামায়াতকে বিএনপির কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে। জামায়াত ১৮ দল ছেড়ে গেলে (?) অবাক হব না। যদিও জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, তারা ঐক্য ধরে রাখবেন এবং সরকারের সঙ্গে তাদের কোনো ‘সমঝোতা’ হয়নি। প্রথম কথা, জামায়াত কর্মীরা চলমান আন্দোলনে বিএনপি কর্মীদের সঙ্গে না পেয়ে এক ধরনের হতাশা ও বিভ্রান্তিতে ভুগতে পারেন। দ্বিতীয় কথা, ‘সমঝোতা’ হয়নি বলে দাবি করলেও কেউ কেউ মনে করেন ভেতরে ভেতরে এক ধরনের ‘সমঝোতা’ (?) হয়েছে। আগামী দিনগুলোই প্রমাণ করবে এর পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে।
‘অক্যুপাই শাহবাগ’ কতদিন চলবে এ মুহূর্তে তা স্পষ্ট নয়। ‘অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলনেরও আর কোনো আবেদন নেই। তাহরির স্কয়ার একটা ‘বিপ্লব’ সম্পন্ন করলেও আবার তাহরির স্কয়ার আগের মতো ফুঁসে উঠবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই।
‘অক্যুপাই শাহবাগ’ একটি আবেদন সৃষ্টি করেছে। তাদের সে দাবি ছুঁয়ে গেছে দেশের প্রায় ১৬ কোটি মানুষকে। তাদের বিজয় তো হয়েছেই। এখন এর একটা পরিসমাপ্তি টানা প্রয়োজন। গত ক’দিনে ঢাকা শহরে গণদুর্ভোগ বেড়েছে। এক ঘণ্টার জায়গা যেতে হচ্ছে তিন ঘণ্টায়। আন্দোলনকারীরাও তা স্বীকার করেছেন। প্রথম দিকে মানুষ এ গণদুর্ভোগকে গুরুত্ব দেয়নি। বৃহত্তম স্বার্থে তারা এটা মেনে নিয়েছেন। এখন দু’একজন দুর্ভোগের কথা বলছেন। শুক্রবার গণজাগরণ সভা হয়েছে। শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের প্রায় সবাই সেখানে ছিলেন, বক্তৃতা করেছেন। সেখানেও আমি দু’একটি কথা শুনেছি; হাল্কা একটি বিভেদের প্রতিধ্বনিও শুনেছি। কেউ কেউ বলছেন, ব্লগার আর ছাত্র ইউনিয়ন চাচ্ছে আন্দোলনকে দীর্ঘায়িত করতে। আর সরকারের সমর্থক ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ, জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগ ও ওয়ার্কার্স পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্র মৈত্রীর সমর্থকরা চাচ্ছেন আপাতত পরিসমাপ্তি টানতে। কেননা যে গণজোয়ারের সৃষ্টি হয়েছে, এটাকেই তারা বিজয় হিসেবে মনে করছে। আরো একটা কথা। আইন ও সালিশ কেন্দে র নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল গত ১৪ ফেব্র“য়ারি ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘বিচার বিভাগকে চাপ দিয়ে রায় আদায় করা ঠিক নয়।’ সুলতানা কামাল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। তিনি যখন এ ধরনের কথা বলেন, তখন তা গুরুত্ব না দিয়ে পারা যায় না। প্রজন্ম চত্বরের যে আন্দোলন এখানে আবেগ আছে, কিন্তু বাস্তবতাও স্বীকার করতে হবে। আদালতে একটি রায় হয়েছে। এ রায় নিয়ে কেউ খুশি হতে পারেন, কেউ অখুশি হতে পারেন। আদালত বিচার করেন আইন, সাক্ষী-সাবুদ ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে। আদালতকে ‘হুকুম’ দেয়া যায় না। আবেগ দিয়ে বিচার হয় না। আমি বিশ্বাস করি, তরুণদের এ দাবি এখন গণদাবি। কিন্তু তরুণদের এ আন্দোলনের সুফল কেউ দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করবে, আমরা তা চাই না।
গণমানুষের সঙ্গে সম্পর্কহীন কোনো আন্দোলনই চূড়ান্ত বিচারে স্থায়ী হয় না। আমরা একইসঙ্গে চাই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আমাদের সাধ্যের মধ্যে থাকবে। চাই পদ্মা সেতুর দুর্নীতির সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, তার বিচার। যারা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে, তাদের দাঁড় করানো হোক আসামির কাঠগড়ায়। যারা শেয়ারবাজার, হলমার্ক ও ডেসটিনির অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিচার। আমি বিশ্বাস করি, তরুণ প্রজন্ম যদি এসব বিষয়ে আন্দোলন গড়ে তুলে সাধারণ মানুষ তাদের পাশে থাকবে। এদেশের তরুণদের একটি ‘ঐতিহ্য’ রয়েছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলন কিংবা পরবর্তীকালে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের সময় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তরুণ সম্প্রদায়ের অবদান ইতিহাসে সোনালি অক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এসবের সঙ্গে তরুণ সমাজ একটি নতুন ইতিহাস রচনা করল। ‘অক্যুপাই শাহবাগ’ আজ আন্তর্জাতিক মিডিয়া। বিশ্বের বড় বড় সংবাদপত্রে আজ অক্যুপাই শাহবাগের নাম। এ নাম যুক্ত হলো ‘অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রিটের’ সঙ্গে। যুক্ত হলো তাহরির স্কয়ারের সঙ্গে। এ আন্দোলন সৃষ্টি করল ‘বাংলা বসন্ত’-এর। মূল দাবি অবশ্যই থাকবে। তবে মনে রাখতে হবে আমরা আদালতকে কোনোভাবেই প্রভাবিত করতে পারি না। সরকারের একটি উদ্যোগও লক্ষণীয়। সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করে আইন পরিবর্তন হয়েছে। এখন পুরো বিষয়টি ছেড়ে দিতে হবে আপিল বিভাগের হাতে। তবে এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যদি সব অনাচারের, দুর্নীতির বিচার হয়, এ আন্দোলনের সাফল্য সেখানেই নিহিত।
Daily Manobkontho
18.2.13

0 comments:

Post a Comment