রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

'শাহবাগের তরুণরা বদলে দাও দেশটা'


শাহবাগের গণজাগরণ দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। রাজনীতি এখন শাহবাগকেন্দ্রিক। সংসদ শাহবাগের আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করেছে। প্রধানমন্ত্রী শাহবাগে যেতে চেয়েছিলেন। আমার ধারণা বিরোধী দলের নেতার মনোভাবও অনেকটা তাই। স্বাধীনতা যুদ্ধচলাকালীন সময়ে যারা মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত ছিল, তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার দাবিতে যে গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয়েছে, তাকে হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। যে আইনে অভিযুক্তদের বিচার হয়েছে, সেই আইনে ত্রুটি ছিল। সেই ত্রুটি সংশোধন করা হয়েছে। মন্ত্রিসভায় তা অনুমোদনও করা হয়েছে। সংসদে আইনটি এখন পাস হবে, যা সময়ের ব্যাপার মাত্র। বাংলাদেশ কি বদলে যাচ্ছে? বস্নগাররা যে কত বড় শক্তিশালী, তা প্রমাণিত হলো। অতীতে বাংলাদেশ এ রকম একটি গণজাগরণের প্রত্যক্ষ করেছিল নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের সময়। সেদিন দুই নেত্রী ও বাম মনারা সবাই এক হয়েছিলেন। সেই গণঅভ্যুত্থানের ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়েছিলেন এইচ এম এরশাদ। আজ প্রেক্ষাপটটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। সনাতন রাজনীতিবিদরা আজ নেতৃত্বে নেই। আছে লাকি আক্তারের মতো কিছু তরুণ, যারা আজ ইতিহাসের অংশ। এই গণজাগরণকে আমরা 'বাংলা বসন্ত' হিসেবে অভিহিত করতে পারি। এই 'বাংলা বসন্ত'-এর একটি রাজনীতিকীকরণের প্রচেষ্টাও আমরা লক্ষ্য করেছিলাম। বিশেষ করে সরকারি দলের সিনিয়র নেতাদের গণজাগরণ মঞ্চে উপস্থিতি ও বক্তৃতা একটা বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল। যদিও শেষ মুহূর্তে তারা নিজেরাই নিজেদের প্রত্যাহার করে নেন। তবে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাদের অধিক তৎপরতা এবং অগি্নকন্যা লাকির ওপর হামলার ঘটনায় আন্দোলনকারীদের এতটুকু দমাতে না পারলেও, এ ধরনের ঘটনায় সংগঠনটির ইমেজ নষ্ট হয়েছে। আমি তরুণ সমাজের ওপর বরবারই আস্থাশীল। আমি বিশ্বাস করি, এরাই পারে দেশকে বদলে দিতে। তাই আমার সর্বশেষ গ্রন্থ 'বাংলাদেশ : রাজনীতির ৪০ বছর' আমি উৎসর্গ করেছি তরুণ সমাজের উদ্দেশ্যে। আমরা যে 'সফট পাওয়ার' এর কথা বলি এবং যে কথাটা বলে গেছেন স্বয়ং হিলারি ক্লিনটন, বাংলাদেশকে এই 'সফট পাওয়ার' এ পরিণত করতে পারে এই তরুণ সমাজ। শাহবাগের গণজাগরণে আমি উদ্বুদ্ধ। শাহবাগের তরুণরাই বদলে দিতে পারে দেশটা। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন একটি 'সিম্বল'। সমাজে নানা অনিয়ম, অসমতা, দরিদ্রতা, দুর্নীতি, ধর্ষণ, শিশু অধিকার, গুম, হত্যাকা- নানা কারণে সমাজটা নষ্ট হয়ে গেছে। রাজনীতিবিদদের মধ্যে 'কমিটমেন্ট'-এর বড় অভাব। দুর্নীতিবাজরা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। এই তরুণরা প্রতিবাদী হোক এসব ঘটনায়। ত্রিশ হাজার কোটি টাকা শেয়ারবাজার থেকে 'হাওয়া' হয়ে যাবে, অভিযুক্তদের বিচার করা যাবে না_ এটা তো অন্যায়। একটি অন্যায় হাজারটা অন্যায়ের জন্ম দিচ্ছে এই সমাজে। শাহবাগের তরুণরাই পারে বাংলাদেশে একটি অন্যায়মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে। ওদের ছবি ছাপা হয়েছে পত্রপত্রিকায়_ লাকি, বেনজির, তুবা, সামিয়া, তানিয়া, এ প্রজন্মের প্রতিনিধি ওরা। যেখানে সনাতন রাজনৈতিক দলগুলো ব্যর্থ, সেখানে এই 'অগি্নকন্যারা' প্রতিবাদী। ওরা সৃষ্টি করল বাংলাদেশের 'অক্যুপাই মুভমেন্ট'-এর। 'বাংলা বসন্ত' শুরু করল এ যুগের 'বিপ্লবীরা'। আমাদের লাকি আর তানিয়ারা দেখিয়ে দিল জুকোটি পার্ক কিংবা কায়রোর তাহরির স্কয়ারের মতো ওরাও সৃষ্টি করতে পারে 'ইতিহাস'। পার্থক্য তো থাকবেই। জুকোটি পার্ক কিংবা ওয়াল স্ট্রিট থেকে তাহরির স্কয়ার_ দেশ, সমাজ, প্রেক্ষাপট ভিন্ন। জুকোটি পার্ক গর্জে উঠেছিল অসমতা আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে। তাহরির স্কয়ার গর্জে উঠেছিল মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য। ১৭ ডিসেম্বর (২০১০) তিউনিসিয়ার ছোট্ট শহর সিডি বওজিদের একজন সাধারণ ফল বিক্রেতা (কিন্তু শিক্ষায় কম্পিউটার গ্র্যাজুয়েট, বেকার) মোহাম্মদ বওজিদ গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করে যে 'প্রতিবাদ'-এর জন্ম দিয়েছিল, সেই প্রতিবাদ (জেসমিন বিপ্লব) ছড়িয়ে গিয়েছিল আরব বিশ্বের এক দেশ থেকে অন্য দেশে। তিউনিসিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া, মিসর সব জায়গাতেই পরিবর্তন এসেছিল। মূল সুরটি ছিল এক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। আর এর সাথেই আমি মিল খুঁজে পাই শাহবাগের আন্দোলনের। এখানে তারুণ্য হচ্ছে আমার আলো। তারাই তো পথ দেখায়। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে ইউরোপে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার নেতৃত্ব দিয়েছিল তরুণরা। সেই প্রতিবাদ ইউরোপে শান্তিবাদী আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল। জুকোটি পার্কের তরুণরা, তাহরির স্কয়ারের তরুণরা, কিংবা বাংলাদেশের লাকি, ফাতেমা, সামিয়ারা সেই আন্দোলনেরই উত্তরসূরি। সুরটা এক_ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের যে অসমতা, তা জন্ম দিয়েছে এক ধরনের'Class Warfare'-এর। অর্থাৎ এক ধরনের শ্রেণীযুক্ত। মার্কস ও এঙ্গেলস বিখ্যাত Communist Manifesto
গ্রন্থে লিখেছিলেন,
'A fight that each time ended, either in a revolutionary reconstitution of society at large or in the Common ruin of the contending class'
অর্থাৎ দ্বন্দ্বের ফলে সমাজে বিপ্লবী পুনর্গঠন হবে, নতুবা শ্রেণীর বিলুপ্তি ঘটাবে। একুশ শতকে এসে মার্কসের এই ব্যাখ্যা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন। কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের যে ভাষা, তাতে মার্কসের বিশ্লেষণের প্রয়োজন পড়ে না। যুগ যুগ ধরে এই যে প্রতিবাদ, এই প্রতিবাদের ভাষা ভিন্ন। প্রতিবাদের ভাষা বদলে যায় জুকোটি পার্কে, তাহরির স্কয়ারে, আর সর্বশেষ শাহবাগে। ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯-১৮১৫) সংগঠিত করেছিল কৃষকরা, রুটির দাবিতে প্যারিসে রুটির দোকান আক্রমণ করেছিল। ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই জনতা স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের প্রতীক বাস্তিল দুর্গ আক্রমণ করে 'বিপ্লব'-এর সূচনা করেছিল। ফরাসি বিপ্লবের সঙ্গে রাশিয়ার বিপ্লবের (১৯১৭) কোনো মিল নেই। ফ্রান্সে বিপ্লবের পর যে সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, তার সঙ্গে বিপ্লব পরবর্তী রাশিয়ার সমাজব্যবস্থার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু মিল আছে এক জায়গায়_ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। আজো শাহবাগ 'অক্যুপাই মুভমেন্টে'র সঙ্গে ইতিহাসে সংগঠিত হওয়া বিপ্লবের কোনো মিল নেই সত্য। কিন্তু আমরা সমাজ বিজ্ঞানীরা একটা মিল খুঁজে পাব। অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ, সেই প্রতিবাদই ন্যায়সঙ্গত। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে একটি বড় ধরনের অপরাধ হয়েছিল। অপরাধীদের রাষ্ট্র শাস্তি দিয়েছে। কিন্তু 'অক্যুপাই মুভমেন্ট' কী থেমে যাবে? গত ৩ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কের 'অক্যুপাই মুভমেন্ট' তার ৫০২ দিন অতিক্রম করেছে। এখন আর এই 'মুভমেন্ট'-এর খবর তেমন একটা পাওয়া যায় না। সীমিত রাশিয়ার এই আন্দোলন এখনো পরিচালিত হচ্ছে। আগামীতে আমরা এই আন্দোলনকে কীভাবে দেখবো কিংবা এই আন্দোলন কোন পর্যায়ে গিয়ে পেঁৗছবে, তা এ মুহূর্তে বলা কঠিন। তবে নোয়াম চমস্কির একটা কথা আমি উল্লেখ করতে চাই। তিনি লিখেছিলেন,
'If they can be sustained and expanded, Occupy can lead to dedicate efforts to set society on a more human course'
। মার্কস যেখানে বিপ্লবের কথা বলেছেন, সেখানে চমস্কি বলেছেন,
'More Human Course'
  এর কথা। তাহরির স্কয়ারের আন্দোলন ড. মুরসি তথা ইসলামপন্থীদের সেখানে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। কিন্তু মুরসির ব্যর্থতা ও একটি গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় মুরসির অনাগ্রহ তাহরির স্কয়ারে আবার ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে সেই তরুণদের, যারা দীর্ঘ ১৭ দিন তাহরির স্কয়ারে অবস্থান করে একটি 'বিপ্লব'-এর সূচনা করেছিল। সেই 'বিপ্লব' থেকে ড. মুরসি ফায়দা তুলতে পারেননি। চমস্কি যে
'More Human Course'
এর কথা বলেছেন, সে পথে তিনি চালিত করতে পারেননি মিসরকে। মুরসির ব্যর্থতা সেখানেই। শাহবাগের 'অক্যুপাই মুভমেন্ট' আমাদের একটা ধাক্কা দিল। যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ যে প্রতিবাদী হতে পারে, 'শাহবাগ মুভমেন্ট' এর বড় প্রমাণ। আমাদের রাজনীতিবিদদের এ থেকে অনেককিছু শেখার আছে। এ 'পচা সমাজ'কে যদি বিশুদ্ধ করা না যায়, তাহলে আবারো জন্ম হবে আরেকটি 'শাহবাগ'-এর। 'নষ্ট সমাজ'কে বসবাসের ও পরবর্তী প্রজন্মের রেখে যাওয়ার জন্য এ 'শাহবাগ' আমাদের একটি পথ দেখিয়ে দিল। এখন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব সরকারের। Daily JAI JAI DIN15.02.13

0 comments:

Post a Comment