রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

পুলিশের মর্যাদায় শেষ পেরেক মেরেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী


গত ২৩ জানুয়ারি সংবাদটা এভাবেই ছাপা হয়েছে একটি জাতীয় দৈনিকে। সাথে ছাপা হয়েছে একটি ছবি। তাতে দেখা যায় পুলিশের একজন কর্মকর্তা জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদীন ফারুককে ঘুষি মারছেন। এই পুলিশ কর্মকর্তার নাম হারুন অর রশিদ, এক সময় যিনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। পুলিশ কর্তৃক ন্যক্কারজনকভাবে ফারুকের প্রহৃত হওয়ার ঘটনা ২০১১ সালের ৬ জুলাইয়ের। একটি প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নেয়ার অপরাধে পুলিশ অন্যায়ভাবে পিটিয়েছিল জয়নুল আবদীন ফারুককে। ওই সময় সমস্ত পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলো নৃশংসভাবে ফারুকের পেটানোর দৃশ্য দেখিয়েছিল। প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা সম্পন্ন একজন সংসদ সদস্যকে এভাবে প্রকাশ্যে পিটিয়ে, অজ্ঞান করে রাস্তায় ফেলে রেখে পুলিশের মর্যাদা সেদিন বাড়েনি। বরং পুলিশের ভূমিকা সমালোচিত হয়েছিল সেদিন। দুঃখজনক হলেও সত্য, ওই ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তি তিরস্কৃত তো হলেনই না, বরং কিছুদিনের মাথায় পদোন্নতি পেয়েছিলেন। সর্বশেষ ঘটনায় বিশ্বজিৎ দাসের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়ও ছিলেন তিনি ওই এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত। দায়িত্ব পালনে তিনি তো ব্যর্থতারই পরিচয় দিলেন না, বরং অভিযাগ উঠেছে তিনি ওই ‘হত্যাকাণ্ড’ ঘটতে দিয়েছিলেন। কেননা শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব ছিল তার উপর। এ রকম একজন ব্যর্থ, অযোগ্য পুলিশ কর্মকর্তাকে ‘সাহসিকতা ও কৃতিত্বের’ জন্য পুলিশ সপ্তাহ’২০১৩ উপলক্ষে পুরস্কৃত করা হল। প্রধানমন্ত্রী নিজে তাকে পিপিএম পদক পড়িয়ে দিলেন। একজন হুইপ পেটানো ব্যক্তি, যিনি কী-না বিশ্বজিৎ-এর হত্যাকাণ্ড রোধ করার ব্যাপারে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেননি, তিনি কী করে ‘সাহসিকতা’ ও ‘কৃতিত্বের’ জন্য পুরস্কৃত হন, আমরা জানি না। কিন্তু জানেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বললেন, ‘তাকে (জয়নুল আবদীন ফারুক) নিবারণ করে ডিসি হারুন সঠিক কাজটি করেছেন। তার ওপর দায়িত্ব ছিল বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার। এই দায়িত্ব হারুন কৃতিত্বের সাথে পালন করেছেন। হায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী!  এভাবে নগ্নভাবে একটি অন্যায়কে তিনি সমর্থন করলেন! সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশের ভূমিকা বিতর্কিত। আইজিপিকে ‘তিন তারকা জেনারেলের’ সমান পদমর্যাদা দেয়া হলেও, জনগণের প্রত্যাশা পুলিশ পূরণ করতে পারেনি। কিছুদিন আগে গেল বছরের জানুয়ারির শেষদিকে চাঁদপুরে পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিলেন গণমিছিলে অংশ নেয়া লিমন। উলঙ্গ লিমনের মৃতদেহ টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে দুই পুলিশ সদস্যÑ সেই ছবিও পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। ওই সময় পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিলেন ৫ জন সাধারণ মানুষ। পুলিশ এজন্য দুঃখ প্রকাশ করেনি।  অথচ অনেকেরই মনে থাকার কথা বিএসএফ কর্তৃক চাঁপাইনবাবগঞ্জের হাবিবুর রহমানকে পেটানোর দৃশ্য যখন বাংলাদেশে বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল, তখন এক পর্যায়ে ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যন্ত ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়েছিলেন। ওই সংবাদটিও আমাদের পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। যা করেছিলেন ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তা করলেন না। একটা দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করলেন না। বিশ্বজিৎ দাসকে পিটিয়ে ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করলো ছাত্রলীগের ‘সোনার ছেলেরা’। বিষাক্ত ‘পিপার ¯েপ্র’তে  মারা গেলেন সাধারণ একজন শিক্ষক, যিনি তাদের সবার দাবি-দাওয়া আদায় আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন। কিন্তু আমার ‘থ্রিস্টার জেনারেল’ আইজিপি একটি ঘটনায়ও দুঃখ প্রকাশ করলেন না। আইজিপি জানেন সংবিধান একজন নাগরিককে কী কী অধিকার দিয়েছে। সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে’। ৩২নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার রক্ষণের’ কথা। সংবিধানের ৩৬, ৩৭, ৩৮ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে চলাফেরা, সমাবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতার কথা। এ ক্ষেত্রে একজন লিমন, একজন আবুল হোসেন গাজী যখন গণমিছিলে অংশ নেন, আর সংবিধান তাকে এই অধিকার দেয়। কিন্তু গুলি করে হত্যা করে লাশ টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া শুধু একজন মৃত ব্যক্তির প্রতি অসম্মানই প্রদর্শন করা হয় না, বরং পুলিশের ভূমিকাকে প্রশ্নের মাঝে ফেলে দেয়। আজ বিতর্কিত একজন ডিসিকে যখন পুলিশ পদক দেয়া হয়, তাতেও পুলিশের মর্যাদা বাড়ে না।
এই রাষ্ট্র তো পুলিশ বাহিনীকে অনেক কিছু দিয়েছে। আইজিপি, ‘থ্রিস্টার জেনারেলের’ সম্মান পেয়েছেন। তার জন্য স্বরাষ্ট্র সচিবকে পরিবর্তন করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পুলিশ বাহিনীর শীর্ষ পাঁচজনকে ‘এ’ গ্রেডভুক্ত সচিব পদমর্যাদা দেয়া হয়েছে। এমনিতেই পুলিশ বাহিনীতে সুযোগ-সুবিধা ও তুলনামূলক বিচারে অনেক বেশি, যে সুযোগ-সুবিধা অন্যান্য পেশায় নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে তরুণ ‘ভালো ছাত্র হওয়ার’ বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক  হলো, তিনিও এ সুযোগ-সুবিধা পান না। রেশনের কথা না হয়, নাইবা বললাম। আমরা ধরে নেই পুলিশের চাকরির ‘চাপ’ বেশি, কাজ বেশি, ঝুঁকি বেশি, সুতরাং তারা একটু সুযোগ-সুবিধা বেশিই নিক, ক্ষতি কি? কিন্তু সেবা কী আমরা পাচ্ছি ঠিকমত? পুলিশ কী জনগনের প্রতি আদৌ দায়বদ্ধ? মিটিং মিছিলে গুলি কেন হবে? সেখানে আদৌ শান্তি-শৃঙ্খলা অবনতির মতো ঘটনা ঘটেনি। অতি সম্প্রতি যে বিষয়টি অন্যতম আলোচিত, তা হচ্ছে পুলিশের ‘পিপার স্প্রে’র ব্যবহার। নিরীহ সাধারণ শিক্ষকদের উপর পুলিশ ‘পিপার ¯েপ্র’ ব্যবহার করে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবার এর একটা যুক্তিও দেখিয়েছেনÑ লাঠি পেটার চাইতে ‘পিপার ¯েপ্র’ ভালো। ইতোমধ্যে ‘পিপার ¯েপ্র’ ও ‘রাসায়নিক ¯েপ্র’র ব্যবহার কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। ভাবতে অবাক লাগে যে, ‘পিপার ¯েপ্র’ অনেক আগেই পশ্চিমা বিশ্বে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল, তা এখন বাংলাদেশে ফিরে এসেছে এবং ব্যবহৃত হচ্ছে জনসাধারণের ওপর। যারা লেখালেখির  জগতে বাস করেন, তারা লক্ষ্য করে থাকবেন যে, সাম্প্রতিক সময়ে একটি গল্প প্রকাশিত হয়েছেÑ চট্টগ্রামের গণহত্যা : প্রত্যক্ষদশীর জবানবন্দী। বইটি লিখেছেন সাংবাদিক নিরূপম দাশগুপ্ত। বইটিতে ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি পুলিশ কর্তৃক গুলিবর্ষণের ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। আজকের প্রধানমন্ত্রী ও সেদিনের বিরোধী দলীয় নেত্রীর মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়েছিল। অভিযোগে আছে, তাতে মারা গিয়েছিলেন ২৪ জন। সাম্প্রতিককালে চারদলীয় জোটের গণমিছিলেও পুলিশের গুলিতে মানুষ মারা গেছে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা রাজশাহীতে পুলিশের গুলিতে নিহত জামায়াত কর্মী শফিকুল ইসলামের মৃত্যুর কথা। বিভিন্ন ঘটনায় পুলিশের প্রতি আমাদের যে আস্থা, সেই আস্থার জায়গাটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
আরো একটা কথা বিএনপি’র পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে যে, তাদের ১০ হাজার নেতা ও কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এটা ভালো নয়। সুস্থ গণতন্ত্র চর্চার জন্য এই প্রবণতা কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে না। মার্কিন রাষ্ট্রদূত কিছুদিন আগে চট্টগ্রামে বলেছিলেন, একটি ‘সংলাপ’ এর কথা। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সকল রাজনৈতিক শক্তির অংশগ্রহণের স্বার্থে ‘সংলাপটা জরুরি’। যদিও ‘সংলাপ’-এর ইতিহাস খুব একটা ভালো নয়। রাষ্ট্রপতি অতীতে একটি সংলাপ’ করেছিলেন নির্বাচন কমিশন পুনঃর্গঠন নিয়ে। বিএনপি তাতে অংশ নিয়েছিলো এটি ছিল একটি ভালো দিক। কিন্তু ওই ‘সংলাপ’ কোনো ফল বয়ে আনতে পারেনি।
পুলিশ যখন বিতর্কিত একজন কর্মকর্তাকে মেডেল দেয় এবং স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেন, ‘ফারুককে পেটানোর জন্যই ডিসি হারুনকে পদক দেয়া হয়েছে’ (সমকাল, ২৩ জানুয়ারি)। তখন আমার আস্থার জায়গাটা ফিঁকে হয়ে আসে। আইজিপি অনেক বিজ্ঞ মানুষ। তিনি জানেন, পুলিশ বাহিনী রাষ্ট্রের, কোনো দলের নয়। ‘পিপার ¯েপ্র’ নিক্ষেপে একজন শিক্ষকের মৃত্যুর ঘটনার রেশ ফুরিয়ে যাবার আগেই বিতর্কিত ডিসির পদক দেয়ার বিষয়টি আসলো। পুলিশের সম্মান আজ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে,  তা কী আইজিপি মহোদয় একবারও ভেবে দেখেছেন। মীর্জা ফখরুল ইসলামের মতো একজন সজ্জন রাজনীতিবিদকে মামলার পর মামলা দিয়ে জেলে আটকে রাখা হয়েছে। তার কী অপরাধ? তিনি পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর করেছেন! আজ আমাদের এ কথাটাও বিশ্বাস করতে হচ্ছে। সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে বিরোধ থাকবেই। কিন্তু পুলিশ ‘ব্যবহৃত’ হবে কেন? ‘অকুপাই মুভমেন্টে’ (নিউইয়র্ক) তার ৪০০ দিন পার করেছে গত ৩ জানুয়ারি। আন্দোলনকারীদের জুকোট্টি পার্ক থেকে উৎখাত করা হয়েছে। কিন্তু আন্দোলনকারীদের প্রতি গুলি ছোঁড়া হয়নি। মিসরের রাজধানী কায়রোতে দীর্ঘ ১৮ দিন অবস্থান করে মিসরবাসী যে ‘বিপ্লব’ সম্পন্ন করেছিলেন, সেখানে কী গুলি বর্ষণ করেছিল পুলিশ? হ্যাঁ সিরিয়াতে আধা সামরিক বাহিনীর গুলিতে মানুষ মারা গেছে সত্য, কিন্তু সিরিয়ার সাথে বাংলাদেশকে মেলানো যাবে না। সেখানে গৃহযুদ্ধ চলছে। বাংলাদেশে আমরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করেছি। গণতন্ত্র সহিষ্ণুতা শেখায়। পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রাখাটা শেখায়। কিন্তু পুলিশ যদি অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে, তাহলে গণতন্ত্রের ভিতটা দুর্বল হয়ে যায়। একজন বিতর্কিত অফিসারকে তো পদক দেয়ার প্রয়োজন ছিল না! আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই বা কীভাবে তা সমর্থন করলেন? একজন সংসদ সদস্যকে এক রকম ন্যাংটা করে, চ্যাংদোলা করে পুলিশ পেটায়, তাতে কী জাতীয় সংসদের মান মর্যাদা থাকে? স্পিকার  বিষয়টি দেখেছিলেন সত্য, কিন্তু তিনি কিছ্ইু করেনি। আমাদের দুঃখবোধটা এখানেই। হতে পারে তিনি বিরোধী দলের নেতা। কিন্তু তিনি তো সংসদ সদস্য। তাকে কেন পুলিশ পেটাবে? আমরা জানি না পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি কীভাবে নিয়েছিলেন, কিন্তু এর সাথে তাদের সম্মানও জড়িত। একজন বিতর্কিত ডিসি হারুনকে পদক দিয়ে পুরো পুলিশ সমাজকে অসম্মানিত করছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ ঘটনায় আমরা দুঃখিত ও মর্মাহত। আমরা স্পষ্টভাবে অনুধাবন করছি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশের মর্যাদায় শেষ পেরেকটি মেরে দিয়েছেন।
01.01.13

0 comments:

Post a Comment