রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি


যারা ইতিহাস চর্চা করেন, তারা আলেকক্সিস দ্য একিউভিলের (অষবীরং ফব ঞড়পয়ঁবারষষব) লেখনির সঙ্গে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস লিখে তিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন। যদিও তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ছিলেন না। ফরাসি এই দার্শনিক গণতান্ত্রিক সমাজে সংবাদপত্রের প্রয়োজজনীয়তা ও গুরুত্বের কথা বোঝাতে গিয়ে লিখেছিলেনÑ ‘ও ধস ভড়ৎ ভৎড়স ফবহুরহম ঃযধঃ হবংিঢ়ধঢ়বৎং রহ ফবসড়পৎধঃরপ পড়ঁহঃৎরবং ষবধফ পরঃরুবহং ঃড় ফড় াবৎু রষষ পড়হংরফবৎবফ ঃযরহম রহ পড়সসড়হ; নঁঃ রিঃযড়ঁঃ হবংিঢ়ধঢ়বৎং ঃযবৎব ড়িঁষফ নব যধৎফষু ধহু পড়সসড়হ ধপঃরড়হ ধঃ ধষষ. ঝড় ঃযবু সবহফ সড়ৎব রষষং ঃযধহ ঃযবু পধঁংব’। বাংলা করলে এটা অনেকটা এ রকমÑ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবাদপত্রগুলো যে খুবই অবিবেচক সাধারণ কর্মকাণ্ডের দিকে নাগরিকদের চালিত করে, এটি আমি জোর দিয়ে অস্বীকার করতে চাই না। কিন্তু সংবাদপত্র ছাড়া সাধারণ কর্মকাণ্ড বলতে প্রায় কিছু থাকবেই না। ফলে তারা যত ক্ষত তৈরি করে, তার চেয়ে অনেক বেশি সারায়। এই একটি বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে যে কথাটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তা হচ্ছে সমাজ উন্নয়নে, সমাজ বিকাশে সংবাদপত্র একটি বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। যুগে যুগে সংবাদপত্রের এই ভূমিকা স্বীকৃত। বিশেষ করে উন্নয়নশীল বিশ্বে গণতন্ত্রের বিকাশ যেখানে ঝুঁকির মুখে থাকে, সেখানে সংবাদপত্র গণতন্ত্র বিকাশে একটি সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। স্বাধীন সংবাদপত্র ছাড়া গণতন্ত্র অর্থহীন। তাই বলা যেতে পারে, গণতন্ত্র ও স্বাধীন সংবাদপত্র পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৪২ বছরে পা দিয়েছে। আমাদের স্বাধীনতার প্রবক্তারা একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সেই সঙ্গে স্বাধীন সংবাদপত্রের প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলেন। কিন্তু আজও সংবাদপত্র কর্মীদের সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে। তবে এটা বলতেই হয়, আমাদের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা স্বীকৃত।
বাংলাদেশে আমরা ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধান নিয়ে গর্ব করি। গেল ৪১ বছরে এই সংবিধানে অনেক পরিবর্তন এসেছে। মোট ১৫টি সংশোধনী সংবিধানে যুক্ত হয়েছে। উচ্চ আদালতের একটি রায়ের ফলে সংবিধান এখন মূল ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে গেছে। সংবিধান মূল সংবিধানে ফিরে গেলেও, একাধিক ধারা ও উপধারা নিয়ে প্রশ্ন আছে। দ্বিমত আছে। মূল একটি প্রশ্নে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এখনও দ্বিধা বিভক্ত। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল ঘোষিত হলেও, এ প্রশ্নে বিরোধী দল এখন জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। তবে সংবিধানের ৩৯নং অনুচ্ছেদটি যেভাবে ছিল, তা রয়ে গেছে। সংবিধানের ৩৯নং অনুচ্ছেদের ১নং ধারায় স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে যে, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল’। এই অনুচ্ছেদের ৩৯(২) ‘ক’ ও ‘খ’ ধারা দুটো আরও স্পষ্ট। ‘ক’তে বলা হয়েছে ‘প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের কথা এবং ‘খ’তে রয়েছে ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চয়তা দান করা হইল’। অর্থাৎ সংবিধানের পুরো ৩৯নং ধারাটিতে একজন সংবাদকর্মীকে যেমনই অধিকার দিয়েছে তার মত প্রকাশ করার, ঠিক তেমনি একই সঙ্গে রাষ্ট্র সংবাদপত্রকেও অনুমতি দিয়েছে সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে প্রকাশিত হওয়ার। সংবাদকর্মী তথা সংবাদপত্রের জন্য এই ধারাটি একটি রক্ষাকবচ। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, মাঝে-মধ্যে এই ৩৯নং ধারাটি লংঘিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির যখন জš§ হয়, তখন ওই সময়ের জাতীয় নেতারা এটা উপলব্ধি করেছিলেন বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হলে এখানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা না গেলে এই দেশটিতে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। তাই ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, তারা সংবিধানে ৩৯নং ধারাটি জুড়ে দিয়েছিলেন। যদিও ৩৯নং ধারার সঙ্গে ৩৬ ও ৩৭ অনুচ্ছেদ দুটিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এবং তা ৩৯নং অনুচ্ছেদের পরিপূরক। ৩৬নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে চলাফেরার স্বাধীনতার কথা। অর্থাৎ এই ধারা বলে বাংলাদেশের যে কোন নাগরিক একস্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়ার বা চলাচল করার অধিকার রাখেন। আর ৩৭নং ধারায় বলা হয়েছে, সমাবেশের স্বাধীনতার কথা। অর্থাৎ এই অনুচ্ছেদ একজন নাগরিককে জনসভা তথা শোভাযাত্রা করার অনুমতি দিয়েছে। সংবিধানের এই ৩৬, ৩৭ ও ৩৯নং অনুচ্ছেদ যদি একসঙ্গে পড়ি, তাহলে দেখব এখানেই নিহিত রয়েছে গণতন্ত্রের স্পিরিট। অর্থাৎ গণতন্ত্রের বিকাশ ও স্থায়িত্বের বিষয়টি লুকিয়ে আছে এই অনুচ্ছেদগুলোর অন্তরালে। এর একটি যদি লংঘিত তাহলে গণতন্ত্রের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা থাকেন, তাদের অনেক কর্মকাণ্ড গণতন্ত্রের এই বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। এটা স্বীকার করতেই হবে, ১৯৭২ সালে মূল সংবিধানে ৩৯নং অনুচ্ছেদটি সন্নিবেশিত থাকলেও ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে আমরা ৩৯নং অনুচ্ছেদে যে রক্ষাকবচ ছিল, তাতে ছুরি বসিয়েছিলাম। মাত্র ৪টি সংবাদপত্র রেখে বাকি সংবাদপত্রগুলো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। এমনকি ৪০নং অনুচ্ছেদে যেখানে ‘পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা’র কথা বলা হয়েছিল, তাও লংঘিত হয়েছিল। অনেক সংবাদপত্র কর্মীকে বেঁচে থাকার জন্য ভিন্ন পেশা বেছে নিতে হয়েছিল।
সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর (২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫) মাধ্যমে একদলীয় তথা রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে একদলীয় ব্যবস্থা রহিত করা হলেও, রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ব্যবস্থা থেকে যায়। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের রাষ্ট্রপতি সরকার ব্যবস্থা বহাল থাকে। ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট জাতীয় সংসদে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী এনে আমরা আবার সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে এসেছি। আর ১৫ সেপ্টেম্বর (১৯৯১) দ্বাদশ সংশোধনীর ওপর যে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়, তাতে সংসদীয় পদ্ধতি অনুমোদিত হয়। এই ফিরে যাওয়াকে আমি বলছি গণতন্ত্রের ‘দ্বিতীয় যাত্রাপথ’। এই ‘দ্বিতীয় যাত্রাপথ’ এ গণতন্ত্রের বিকাশ বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এখানে নির্বাচন হচ্ছে। এক সরকারের বদলে অন্য আরেকটি সরকার আসছে। কিন্তু গণতন্ত্রের যে মূল কথা পরস্পরের প্রতি আস্থা, সেই আস্থা নেই। সংসদ হয়ে পড়ছে একদলীয়। জাতীয় পর্যায়ে অনেক সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও সংসদে তা আলোচিত হতে দেখি না। যেখানে জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের শ্রদ্ধা জানানোর কথা, সেখানে জাতীয় সংসদে নেতাদের নিয়ে কটূক্তি করা হয়। সংসদে কালো পতাকা প্রদর্শন কিংবা স্লোগান দেয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। তাই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার গঠিত হয় বটে; কিন্তু শুধু নির্বাচন আয়োজন করার নাম গণতন্ত্র হতে পারে না। নির্বাচনের পাশাপাশি জড়িত মানবাধিকারের প্রশ্নটি। জড়িত সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রশ্নটি। একটি সমাজে যদি মানবাধিকারের প্রশ্নটি নিশ্চিত করা যায়, যদি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকে, তাহলে ওই সমাজকে আমরা গণতান্ত্রিক বলতে পারব। যদি সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম ‘সত্যি’ কথা বলতে না পারে, তাহলে সেই সমাজকে গণতান্ত্রিক বলা যাবে না।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিনির্মাণে সচেষ্ট রয়েছি বটে, কিন্তু গণমাধ্যমের কর্মীরা যখন হত্যা কিংবা গুমের সম্মুখীন হন, তখন তা গণতন্ত্রকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। এতদিন হয়ে গেল আমরা আজও জানতে পারলাম না কারা এবং কেন সাগর-রুনী সাংবাদিক দম্পতিকে হত্যা করেছিল। সংবাদপত্রের কর্মীরা এই হত্যার বিচারের জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছেন। সংবাদপত্র ও সংবাদকর্মীরা যখন অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকেন, তখন গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যায় না। আমরা সেটা চাই বটে, কিন্তু সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রশ্নে ক্ষমতাসীনরা বরাবরই নির্লিপ্ত। সংবাদপত্রকে নিয়ন্ত্রণে রেখে, একটা ‘ভয়ের আবহ’ তৈরি করে আর যাই হোক সত্যিকারের গণতন্ত্র বিনির্মাণ করা যাবে না। আমরা চাই সংবাদপত্র লিখুক, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশিত হোক, সরকারর দোষ-ত্র“টি ধরিয়ে দিক, সমাজে সব অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হোক, তাহলেই গণতন্ত্র রক্ষা পাবে এবং গণতন্ত্রকে আমরা আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব।
Daily JUGANTOR
91.03.13

0 comments:

Post a Comment