২১ ফেব্রুয়ারি প্রজন্ম চত্বরে তরুণ প্রজন্ম দীর্ঘ ১৭ দিনের একটানা অবস্থান ধর্মঘটের সমাপ্তি ঘোষণা করলেও ২২ ফেব্রুয়ারি জামায়াত সমর্থিত কয়েকটি ইসলামী দলের তা-বের পর আন্দোলনকারীরা আবার ফিরে এসেছে শাহবাগ চত্বরে। ২৪ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতালও পালন করেছে ইসলামী দলগুলো। ২৮ ফেব্রুয়ারিও তারা হরতাল পালন করেছে জামায়াত নেতা সাঈদীর মামলার রায়ের প্রতিবাদে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের তৃতীয় রায় ঘোষণা করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এই রায়ে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে রাজনীতি এখন উত্তপ্ত। একদিকে শাহবাগ চত্বর দখল করে তরুণ প্রজন্ম জামায়াতকে নিষিদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি অব্যাহত রেখেছে, অন্যদিকে জামায়াত সমর্থিত ইসলামী দলগুলো পবিত্র কোরআন অবমাননার অভিযোগে তাদের আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। এর মাঝখানে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কোনো অবস্থান নেই। এর আগে তরুণ প্রজন্ম জামায়াতকে নিষিদ্ধ করাসহ তাদের ৫ দফা দাবি উত্থাপন করেছিল। তাদের অন্যতম একটি দাবি ২৬ মার্চের মধ্যে জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার ব্যাপারে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করা। এর বাইরে অন্য দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে রাজীবসহ আন্দোলনে নিহতদের হত্যাকারীদের ৭ দিনের মধ্যে গ্রেপ্তার, জামায়াতের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থের উৎস অনুসন্ধান করা, ট্রাইব্যুনালকে স্থায়ী রূপ দেয়া, আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় জামায়াতের অপরাধমূলক কর্মকা- প্রচার করা ইত্যাদি। শাহবাগ অক্যুপাই আন্দোলন আমাদের জন্য একটি মাইলস্টোন। আগামীদিনের রাজনীতিতে এর একটা প্রভাব থাকবেই। এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, সরকার এ আন্দোলন থেকে ফায়দা উঠিয়েছে এবং বিএনপির আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। তরুণ প্রজন্মের একটা জয় হয়েছে সত্য। কিন্তু তারা একটা বড় প্রত্যাশা সৃষ্টি করেছে। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা তাদের কাছে অনেক বেশি। এখন সেই প্রত্যাশা তারা কতটুকু পূরণ করতে পারেন, সেটাই দেখার বিষয়। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো যেখানে ব্যর্থ হয়েছিল, সেখানে এগিয়ে এসেছিল তরুণরা। এখন তাদের সবার মন জয় করতে হবে। শেয়ারবাজার থেকে ত্রিশ হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে বাইরে পাচার হয়েছে। তদন্তে তা প্রমাণিতও হয়েছে। তরুণ সমাজকে এখন এ ব্যাপারে কথা বলতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নাগালের বাইরে। দ্রব্যাদির মূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ আজ অসহায়। নতুন ভিত্তি বছর (২০০৫-০৬) অনুযায়ী ডিসেম্বরে (২০১২) মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ। অথচ নভেম্বরে ছিল ৬ দশমিক ১৪ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী ডিসেম্বর (২০১২) মাসে চাল, আটা, ডাল, মাছ-মাংস, মসলা, দুধ ও তেলের দাম বেড়েছে। ওই সময় খাদ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে দশমিক ৩৫ শতাংশ। একই সঙ্গে খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের দাম বেড়েছে দশমিক ৩৮ শতাংশ। আমরা জানুয়ারির (২০১৩) পরিসংখ্যান যদি নেই, তাহলে দেখব, খাদ্যে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়েছে। এ মূল্যস্ফীতি কি আমাদের তরুণদের স্পর্শ করে না? শাহবাগের তরুণ প্রজন্ম দীর্ঘ ১৭ দিন একনাগাড়ে, শাহবাগ চত্বরে অবস্থান করে রেকর্ড করল। কিন্তু জানল না তাদের বাবারা কী কষ্ট করে সংসার চালান? জিজ্ঞেস করল না বাবাকে সীমিত আয়ে বাবা কীভাবে সংসার চালান? নিউইয়র্কে অক্যুপাই মুভমেন্ট হয়েছিল অসমতা, বৈষম্য ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে। মার্কিন সমাজে শ্রেণীতে শ্রেণীতে ব্যবধান বাড়ছে। একটি ধনিক শ্রেণীর জন্ম হয়েছে, যাদের কাছে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব ছিল 'অক্যুপাই মুভমেন্ট'। কায়রোতে তাহরির স্কয়ারে আন্দোলন হয়েছিল স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে। ১৯৮১ সাল থেকেই ক্ষমতায় ছিলেন হোসনি মোবারক। গণতন্ত্র চর্চা সেখানে ছিল না। তরুণ প্রজন্ম সেখানে বিক্ষোভকে সংগঠিত করেছিল সরকারের বিরুদ্ধে। আজ দেখলাম ভিন্ন চিত্র। সরকারই মদদ দিচ্ছে বিক্ষোভকারীদের অবস্থান ধর্মঘট করতে। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পুলিশ সিসি ক্যামেরা বসিয়েছিল ভালো, সন্দেহ নেই। কিন্তু ঢাকার রাস্তায় পুলিশ যখন বিরোধীকর্মীদের পেটায়, গ্রেপ্তার করে, তখন একটি বৈসাদৃশ্য আমার চোখে ধরা পড়ে। একদল আন্দোলনকারীকে পুলিশ প্রটোকল দিচ্ছে আর অন্য আন্দোলনকারীকে পেটাচ্ছে। গ্রেপ্তার করছে। শত শত তরুণ এখন সরকারের কর্মকা-ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে জেলে। সরকার ও সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা সংবিধানের মহাত্ম প্রচার করতে গিয়ে মুখে গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলেন। সংবিধানের ৩৯নং অনুচ্ছেদের ১নং ধারায় স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে যে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল। এ অনুচ্ছেদের ৩৯(২) 'ক' ও 'খ' ধারা দুটো আরো স্পষ্ট। 'ক'-তে বলা হয়েছে 'প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের কথা এবং 'খ'-তে রয়েছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা। আজ যখন পুলিশ বিরোধীকর্মীদের পেটায় তখন ৩৯(১) ও ৩৯(২-ক) ধারা লঙ্ঘিত হয়। যখন শাহবাগে আমার দেশ, নয়া দিগন্ত, সংগ্রাম বন্ধ ঘোষণা করার দাবি উত্থাপিত হয়, তখন সংবিধানের ৩৯(২)(ক) ধারাও লঙ্ঘিত হয়। সংবাদপত্র অফিসে যখন আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় (নয়া দিগন্ত), তখন শাহবাগের তরুণদের স্পিরিটে আমি বিভ্রান্ত হই। হতবাক হই। এদের উদ্দেশ্য বুঝতে আমার কষ্ট হয়। এ ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন আমরা হয়েছিলাম ১৯৭৫ সালে। যখন চারটি পত্রিকা রেখে বাকি সব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এ প্রজন্মের তরুণরা তা জানে না। জানে না সেদিন কোন উদ্দেশে ওইসব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে দাবি উঠেছিল ত্রিদলীয় ঐক্য জোট (আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ মো.) গঠন করার। তা গঠিতও হয়েছিল। এ ত্রিদলীয় ঐক্যজোটই এক দলীয় বাকশালে রূপান্তরিত হয়। আজো শাহবাগের চত্বরে দেখি সেই সব দলের মুখ। আওয়ামী লীগের ভেতরে, নীতি নির্ধারণীতে, মন্ত্রিসভায় সাবেক 'মস্কোপন্থীদের সংখ্যা বেশি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে তারা প্রভাবান্বিত করতে পেরেছিল। আজ এতবছর পর তারা প্রধানমন্ত্রীকে প্রভাবান্বিত করতে পেরেছেন বলে আমার ধারণা। শাহবাগের তরুণ প্রজন্ম আজ প্রতিবাদী। পুরো তথ্য, ইতিহাস তাদের জানা দরকার। তাই প্রতিবাদের যে ভাষা, তাতে সাধারণ মানুষের অধিকারের কথা থাকুক তাদের ওপর আস্থা রাখার জায়গাটা যেন নষ্ট না হয়। পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির বিষয়টি আজ আন্তর্জাতিক আসরে অন্যতম একটি আলোচিত বিষয়। কিন্তু ব্যক্তির দুর্নীতির কারণে আমাদের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। টিআই'র রিপোর্টেও আছে এ দুর্নীতির খবর। কিন্তু শাহবাগে দুর্নীতির কোনো সস্নোগান ছিল না। পদ্মা সেতু আর আবুল হোসেন পরস্পর সম্পর্কিত। কিন্তু কোনো সস্নেস্নাগান নেই। কেন নেই? শুভঙ্করের ফাঁকিটা এখানেই। গণমানুষের দাবি ছিল দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করার। এ দাবি গণদাবিতে পরিণত হয়েছিল। খালেদা জিয়া এ অসুস্থ শরীর নিয়ে রোডমার্চ করেছেন একাধিক। ঢাকায় সর্বকালের বৃহৎ গণজমায়েত করেছে বিএনপি। বিএনপি যখন ধীরে ধীরে এ আন্দোলনকে একটি চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই সৃষ্টি হয়েছিল এ শাহবাগকেন্দ্রিক গণআন্দোলন। এখন একটি বিজয় অর্জিত হয়েছে বটে! কিন্তু যেতে হবে অনেক দূর। গণমানুষের সঙ্গে সম্পর্কহীন কোনো আন্দোলন চূড়ান্ত বিচারে স্থায়ী হয় না। আমি চাই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ক্রয়মূল্য আমাদের সাধ্যের মধ্যে থাকবে। আমি চাই পদ্মা সেতুর দুর্নীতির সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, তার বিচার। যারা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে, তাদের দাঁড় করানো হোক আসামির কাঠগড়ায়। যারা শেয়ারবাজার, হলমার্ক, ডেসটিনির অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত তাদের বিচার। আমি বিশ্বাস করি তরুণ প্রজন্ম যদি এসব বিষয়ে আন্দোলন গড়ে তোলে সাধারণ মানুষ তাদের পাশে থাকবে। আবেগ দিয়ে সাময়িকভাবে লাভবান হওয়া যায় বটে, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী কোনো অবদান রাখা যায় না। এ দেশের তরুণদের একটি ঐতিহ্য রয়েছে। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলন, কিংবা পরে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের সময় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তরুণ সম্প্রদায়ের অবদান ইতিহাসে সোনালি অক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এ দেশের তরুণ সমাজ একটি ইতিহাস রচনা করল। 'অক্যুপাই শাহবাগ' আজ আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়। বিশ্বের বড় বড় সংবাদপত্রে আজ অক্যুপাই শাহবাগ-এর নাম। এ নাম যুক্ত হলো অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রিটের সঙ্গে। যুক্ত হলো তাহরির স্কয়ারের সঙ্গে। এ আন্দোলন সৃষ্টি করল 'বাংলা বসন্ত' এর। মূল দাবি অবশ্যই থাকবে। তবে মনে রাখতে হবে আমরা আদালতকে কোনোভাবেই প্রভাবিত করতে পারি না। সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করে আইন পরিবর্তন হয়েছে। এখন পুরো বিষয়টি ছেড়ে দিতে হবে আপিল বিভাগের হাতে। তাদের ওপর আস্থা রাখতে হবে। আমরা কোনো পর্যায়েই আপিল বিভাগকে 'হুকুম' করতে পারি না? এ আন্দোলনের মধ্যদিয়ে যদি সব অনাচারের, সব দুর্নীতির বিচার হয়, এ আন্দোলনের সাফল্য সেখানেই নিহিত। তবে মনে রাখতে হবে এ আন্দোলন যেন কোনো অবস্থায়ই কোরআন বা ইসলামের বিরুদ্ধে পরিচালিত না হয়।Daily JAI JAI DIN02.03.13
উত্তপ্ত রাজনীতি অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
16:58
No comments
২১ ফেব্রুয়ারি প্রজন্ম চত্বরে তরুণ প্রজন্ম দীর্ঘ ১৭ দিনের একটানা অবস্থান ধর্মঘটের সমাপ্তি ঘোষণা করলেও ২২ ফেব্রুয়ারি জামায়াত সমর্থিত কয়েকটি ইসলামী দলের তা-বের পর আন্দোলনকারীরা আবার ফিরে এসেছে শাহবাগ চত্বরে। ২৪ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতালও পালন করেছে ইসলামী দলগুলো। ২৮ ফেব্রুয়ারিও তারা হরতাল পালন করেছে জামায়াত নেতা সাঈদীর মামলার রায়ের প্রতিবাদে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের তৃতীয় রায় ঘোষণা করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এই রায়ে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে রাজনীতি এখন উত্তপ্ত। একদিকে শাহবাগ চত্বর দখল করে তরুণ প্রজন্ম জামায়াতকে নিষিদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি অব্যাহত রেখেছে, অন্যদিকে জামায়াত সমর্থিত ইসলামী দলগুলো পবিত্র কোরআন অবমাননার অভিযোগে তাদের আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। এর মাঝখানে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কোনো অবস্থান নেই। এর আগে তরুণ প্রজন্ম জামায়াতকে নিষিদ্ধ করাসহ তাদের ৫ দফা দাবি উত্থাপন করেছিল। তাদের অন্যতম একটি দাবি ২৬ মার্চের মধ্যে জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার ব্যাপারে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করা। এর বাইরে অন্য দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে রাজীবসহ আন্দোলনে নিহতদের হত্যাকারীদের ৭ দিনের মধ্যে গ্রেপ্তার, জামায়াতের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থের উৎস অনুসন্ধান করা, ট্রাইব্যুনালকে স্থায়ী রূপ দেয়া, আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় জামায়াতের অপরাধমূলক কর্মকা- প্রচার করা ইত্যাদি। শাহবাগ অক্যুপাই আন্দোলন আমাদের জন্য একটি মাইলস্টোন। আগামীদিনের রাজনীতিতে এর একটা প্রভাব থাকবেই। এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, সরকার এ আন্দোলন থেকে ফায়দা উঠিয়েছে এবং বিএনপির আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। তরুণ প্রজন্মের একটা জয় হয়েছে সত্য। কিন্তু তারা একটা বড় প্রত্যাশা সৃষ্টি করেছে। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা তাদের কাছে অনেক বেশি। এখন সেই প্রত্যাশা তারা কতটুকু পূরণ করতে পারেন, সেটাই দেখার বিষয়। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো যেখানে ব্যর্থ হয়েছিল, সেখানে এগিয়ে এসেছিল তরুণরা। এখন তাদের সবার মন জয় করতে হবে। শেয়ারবাজার থেকে ত্রিশ হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে বাইরে পাচার হয়েছে। তদন্তে তা প্রমাণিতও হয়েছে। তরুণ সমাজকে এখন এ ব্যাপারে কথা বলতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নাগালের বাইরে। দ্রব্যাদির মূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ আজ অসহায়। নতুন ভিত্তি বছর (২০০৫-০৬) অনুযায়ী ডিসেম্বরে (২০১২) মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ। অথচ নভেম্বরে ছিল ৬ দশমিক ১৪ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী ডিসেম্বর (২০১২) মাসে চাল, আটা, ডাল, মাছ-মাংস, মসলা, দুধ ও তেলের দাম বেড়েছে। ওই সময় খাদ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে দশমিক ৩৫ শতাংশ। একই সঙ্গে খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের দাম বেড়েছে দশমিক ৩৮ শতাংশ। আমরা জানুয়ারির (২০১৩) পরিসংখ্যান যদি নেই, তাহলে দেখব, খাদ্যে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়েছে। এ মূল্যস্ফীতি কি আমাদের তরুণদের স্পর্শ করে না? শাহবাগের তরুণ প্রজন্ম দীর্ঘ ১৭ দিন একনাগাড়ে, শাহবাগ চত্বরে অবস্থান করে রেকর্ড করল। কিন্তু জানল না তাদের বাবারা কী কষ্ট করে সংসার চালান? জিজ্ঞেস করল না বাবাকে সীমিত আয়ে বাবা কীভাবে সংসার চালান? নিউইয়র্কে অক্যুপাই মুভমেন্ট হয়েছিল অসমতা, বৈষম্য ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে। মার্কিন সমাজে শ্রেণীতে শ্রেণীতে ব্যবধান বাড়ছে। একটি ধনিক শ্রেণীর জন্ম হয়েছে, যাদের কাছে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব ছিল 'অক্যুপাই মুভমেন্ট'। কায়রোতে তাহরির স্কয়ারে আন্দোলন হয়েছিল স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে। ১৯৮১ সাল থেকেই ক্ষমতায় ছিলেন হোসনি মোবারক। গণতন্ত্র চর্চা সেখানে ছিল না। তরুণ প্রজন্ম সেখানে বিক্ষোভকে সংগঠিত করেছিল সরকারের বিরুদ্ধে। আজ দেখলাম ভিন্ন চিত্র। সরকারই মদদ দিচ্ছে বিক্ষোভকারীদের অবস্থান ধর্মঘট করতে। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পুলিশ সিসি ক্যামেরা বসিয়েছিল ভালো, সন্দেহ নেই। কিন্তু ঢাকার রাস্তায় পুলিশ যখন বিরোধীকর্মীদের পেটায়, গ্রেপ্তার করে, তখন একটি বৈসাদৃশ্য আমার চোখে ধরা পড়ে। একদল আন্দোলনকারীকে পুলিশ প্রটোকল দিচ্ছে আর অন্য আন্দোলনকারীকে পেটাচ্ছে। গ্রেপ্তার করছে। শত শত তরুণ এখন সরকারের কর্মকা-ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে জেলে। সরকার ও সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা সংবিধানের মহাত্ম প্রচার করতে গিয়ে মুখে গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলেন। সংবিধানের ৩৯নং অনুচ্ছেদের ১নং ধারায় স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে যে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল। এ অনুচ্ছেদের ৩৯(২) 'ক' ও 'খ' ধারা দুটো আরো স্পষ্ট। 'ক'-তে বলা হয়েছে 'প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের কথা এবং 'খ'-তে রয়েছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা। আজ যখন পুলিশ বিরোধীকর্মীদের পেটায় তখন ৩৯(১) ও ৩৯(২-ক) ধারা লঙ্ঘিত হয়। যখন শাহবাগে আমার দেশ, নয়া দিগন্ত, সংগ্রাম বন্ধ ঘোষণা করার দাবি উত্থাপিত হয়, তখন সংবিধানের ৩৯(২)(ক) ধারাও লঙ্ঘিত হয়। সংবাদপত্র অফিসে যখন আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় (নয়া দিগন্ত), তখন শাহবাগের তরুণদের স্পিরিটে আমি বিভ্রান্ত হই। হতবাক হই। এদের উদ্দেশ্য বুঝতে আমার কষ্ট হয়। এ ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন আমরা হয়েছিলাম ১৯৭৫ সালে। যখন চারটি পত্রিকা রেখে বাকি সব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এ প্রজন্মের তরুণরা তা জানে না। জানে না সেদিন কোন উদ্দেশে ওইসব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে দাবি উঠেছিল ত্রিদলীয় ঐক্য জোট (আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ মো.) গঠন করার। তা গঠিতও হয়েছিল। এ ত্রিদলীয় ঐক্যজোটই এক দলীয় বাকশালে রূপান্তরিত হয়। আজো শাহবাগের চত্বরে দেখি সেই সব দলের মুখ। আওয়ামী লীগের ভেতরে, নীতি নির্ধারণীতে, মন্ত্রিসভায় সাবেক 'মস্কোপন্থীদের সংখ্যা বেশি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে তারা প্রভাবান্বিত করতে পেরেছিল। আজ এতবছর পর তারা প্রধানমন্ত্রীকে প্রভাবান্বিত করতে পেরেছেন বলে আমার ধারণা। শাহবাগের তরুণ প্রজন্ম আজ প্রতিবাদী। পুরো তথ্য, ইতিহাস তাদের জানা দরকার। তাই প্রতিবাদের যে ভাষা, তাতে সাধারণ মানুষের অধিকারের কথা থাকুক তাদের ওপর আস্থা রাখার জায়গাটা যেন নষ্ট না হয়। পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির বিষয়টি আজ আন্তর্জাতিক আসরে অন্যতম একটি আলোচিত বিষয়। কিন্তু ব্যক্তির দুর্নীতির কারণে আমাদের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। টিআই'র রিপোর্টেও আছে এ দুর্নীতির খবর। কিন্তু শাহবাগে দুর্নীতির কোনো সস্নোগান ছিল না। পদ্মা সেতু আর আবুল হোসেন পরস্পর সম্পর্কিত। কিন্তু কোনো সস্নেস্নাগান নেই। কেন নেই? শুভঙ্করের ফাঁকিটা এখানেই। গণমানুষের দাবি ছিল দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করার। এ দাবি গণদাবিতে পরিণত হয়েছিল। খালেদা জিয়া এ অসুস্থ শরীর নিয়ে রোডমার্চ করেছেন একাধিক। ঢাকায় সর্বকালের বৃহৎ গণজমায়েত করেছে বিএনপি। বিএনপি যখন ধীরে ধীরে এ আন্দোলনকে একটি চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই সৃষ্টি হয়েছিল এ শাহবাগকেন্দ্রিক গণআন্দোলন। এখন একটি বিজয় অর্জিত হয়েছে বটে! কিন্তু যেতে হবে অনেক দূর। গণমানুষের সঙ্গে সম্পর্কহীন কোনো আন্দোলন চূড়ান্ত বিচারে স্থায়ী হয় না। আমি চাই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ক্রয়মূল্য আমাদের সাধ্যের মধ্যে থাকবে। আমি চাই পদ্মা সেতুর দুর্নীতির সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, তার বিচার। যারা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে, তাদের দাঁড় করানো হোক আসামির কাঠগড়ায়। যারা শেয়ারবাজার, হলমার্ক, ডেসটিনির অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত তাদের বিচার। আমি বিশ্বাস করি তরুণ প্রজন্ম যদি এসব বিষয়ে আন্দোলন গড়ে তোলে সাধারণ মানুষ তাদের পাশে থাকবে। আবেগ দিয়ে সাময়িকভাবে লাভবান হওয়া যায় বটে, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী কোনো অবদান রাখা যায় না। এ দেশের তরুণদের একটি ঐতিহ্য রয়েছে। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলন, কিংবা পরে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের সময় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তরুণ সম্প্রদায়ের অবদান ইতিহাসে সোনালি অক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এ দেশের তরুণ সমাজ একটি ইতিহাস রচনা করল। 'অক্যুপাই শাহবাগ' আজ আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়। বিশ্বের বড় বড় সংবাদপত্রে আজ অক্যুপাই শাহবাগ-এর নাম। এ নাম যুক্ত হলো অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রিটের সঙ্গে। যুক্ত হলো তাহরির স্কয়ারের সঙ্গে। এ আন্দোলন সৃষ্টি করল 'বাংলা বসন্ত' এর। মূল দাবি অবশ্যই থাকবে। তবে মনে রাখতে হবে আমরা আদালতকে কোনোভাবেই প্রভাবিত করতে পারি না। সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করে আইন পরিবর্তন হয়েছে। এখন পুরো বিষয়টি ছেড়ে দিতে হবে আপিল বিভাগের হাতে। তাদের ওপর আস্থা রাখতে হবে। আমরা কোনো পর্যায়েই আপিল বিভাগকে 'হুকুম' করতে পারি না? এ আন্দোলনের মধ্যদিয়ে যদি সব অনাচারের, সব দুর্নীতির বিচার হয়, এ আন্দোলনের সাফল্য সেখানেই নিহিত। তবে মনে রাখতে হবে এ আন্দোলন যেন কোনো অবস্থায়ই কোরআন বা ইসলামের বিরুদ্ধে পরিচালিত না হয়।Daily JAI JAI DIN02.03.13
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment