সংবাদ শির
বাংলাদেশে, আমরা ১৯৭২ সালের সংবিধান নিয়ে গর্ব করি। গেল ৪২ বছরে সংবিধানে ১৫টি সংশোধনী এসেছে। সংবিধান মূল সংবিধানে ফিরে গেলেও একাধিক ধারা ও উপধারা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তবে সংবিধানের ৩৯ নং অনুচ্ছেদটি যেভাবে ছিল, তা রয়ে গেছে। ৩৯নং অনুচ্ছেদের ১নং ধারায় স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে যে, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল। এই অনুচ্ছেদের ৩৯(২) ‘ক’ ও ‘খ’ ধারা দুটো আরো স্পষ্ট। ‘ক’তে বলা হয়েছে প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের কথা এবং ‘খ’তে রয়েছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চয়তা দান করা হইল। অর্থাৎ সংবিধানের পুরো ৩৯নং ধারাটিকে একজন সংবাদ কর্মীকে যেমনি অধিকার দিয়েছে তার মত প্রকাশ করার, ঠিক তেমনি একই সাথে রাষ্ট্র সংবাদপত্রকেও অনুমতি দিয়েছে সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে প্রকাশিত হবার। সংবাদকর্মী তথা সংবাদপত্রের জন্য এই ধারাটি একটি রক্ষাকবজ। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, মাঝে মধ্যে এই ৩৯নং ধারাটি লঙ্ঘিত হয়। আদালত অবমাননার অভিযোগে আমার দেশ-এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমান যখন বিচারের সম্মুখীন হয়েছিলেন, সেদিন এ দেশের বিজ্ঞ আইনজীবীরা আদালতে ৩৯নং ধারা বার বার উল্লেখ করেছিলেন। তারা বলেছিলেন ‘৩৯নং ধারা বলেই একজন সম্পাদক তার মত প্রকাশের অধিকার রাখেন।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির যখন জন্ম হয়, তখন ওই সময়ের জাতীয় নেতৃবৃন্দ এটা উপলব্ধি করেছিলেন বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হলে, এখানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা না গেলে এই দেশটিতে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। তাই ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সাথে যারা জড়িত ছিলেন, তারা সংবিধানে ৩৯নং ধারাটি জুড়ে দিয়েছিলেন। যদিও ৩৯নং ধারার সাথে ৩৬ ও ৩৭ অনুচ্ছেদ দু’টিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এবং তা ৩৯নং অনুচ্ছেদের পরিপূরক। ৩৬ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে চলাফেরার স্বাধীনতার কথা। অর্থাৎ এই ধারা বলে বাংলাদেশের যে কোনো নাগরিক একস্থান থেকে অন্য স্থানে যাবার বা চলাচল করার অধিকার রাখেন। আর ৩৭নং ধারায় বলা হয়েছে সমাবেশের স্বাধীনতার কথা। অর্থাৎ এই অনুচ্ছেদ একজন নাগরিককে জনসভা তথা শোভাযাত্রা করার অনুমতি দিয়েছে। সংবিধানের এই ৩৬, ৩৭ ও ৩৯ নং অনুচ্ছেদ যদি একসাথে পড়ি, তাহলে দেখবো এখানেই নিহিত রয়েছে গণতন্ত্রের স্পিরিট। অর্থাৎ গণতন্ত্রের বিকাশ ও স্থায়ীত্বের বিষয়টি লুকিয়ে আছে। এই অনুচ্ছেদগুলোর কোনো একটি যদি লংঘিত হয়, তাহলে গণতন্ত্রের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা থাকেন, তাদের অনেক কর্মকাণ্ড গণতন্ত্রের এই বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। এটা স্বীকার করতেই হবে ১৯৭২ সালে মূল সংবিধানে ৩৯নং অনুচ্ছেদটি সন্নিবেশিত থাকলেও ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তনের মধ্যে দিয়ে আমরা ৩৯নং অনুচ্ছেদে যে রক্ষাকবচ ছিল, তাতে ছুরি বসিয়েছিলাম। মাত্র ৪টি সংবাদপত্র রেখে বাকি সংবাদপত্রগুলো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। এমনকি ৪০নং অনুচ্ছেদে যেখানে পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছিল, তাও লঙ্ঘিত হয়েছিল। অনেক সংবাদপত্র কর্মীকে বেঁচে থাকার জন্য ভিন্ন পেশা বেছে নিতে হয়েছিল।
সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনীর (২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫) মাধ্যমে একদলীয় তথা রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল। পরবর্তীতে একদলীয় ব্যবস্থা রহিত করা হলেও, রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা থেকে যায়। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে রাষ্ট্রপতি সরকার ব্যবস্থা বহাল থাকে। ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট জাতীয় সংসদে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী এনে আমরা পুনরায় সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে এসেছি। আর ১৫ সেপ্টেম্বর (১৯৯১) দ্বাদশ সংশোধনীর ওপর যে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়, তাতে সংসদীয় পদ্ধতি অনুমোদিত হয়। এই ফিরে যাওয়াকে আমি বলছি গণতন্ত্রের দ্বিতীয় যাত্রাপথ। এই দ্বিতীয় যাত্রাপথ ও গণতন্ত্রের বিকাশ বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এখানে নির্বাচন হচ্ছে। এক সরকারের বদলে অন্য আরেকটি সরকার আসছে। কিন্তু গণতন্ত্রের যে মূল কথা পরস্পরের প্রতি আস্থা, সেই আস্থা নেই। সংসদ হয়ে পড়েছে একদলীয়। জাতীয় পর্যায়ে অনেক সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও সংসদে তা আলোচিত হতে দেখি না। যেখানে জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের শ্রদ্ধা জানানোর কথা, সেখানে জাতীয় সংসদে জাতীয় নেতাদের নিয়ে কটূক্তি করা হয়। সংসদে কালো পতাকা প্রদর্শন কিংবা স্লোগান দেয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হচ্ছে। তাই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার গঠিত হয় বটে, কিন্তু শুধু নির্বাচন আয়োজন করার নাম গণতন্ত্র হতে পারে না। নির্বাচনের পাশাপাশি জড়িত মানবাধিকারের প্রশ্নটি। জড়িত সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রশ্নটি। একটি সমাজে যদি মানবাধিকারের প্রশ্নটি নিশ্চিত করা যায়, যদি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকে, তাহলে এই সমাজকে আমরা গণতান্ত্রিক বলতে পারবো। যদি সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম সত্যি কথা বলতে না পারে, তাহলে সেই সমাজকে গণতান্ত্রিক বলা যাবে না।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিনির্মাণে সচেষ্ট রয়েছি বটে, কিন্তু গণমাধ্যমের কর্মীরা যখন হত্যা কিংবা গুমের সম্মুখীন হন, তখন তা গণতন্ত্রকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। এতদিন হয়ে গেল আমরা আজো জানতে পারলাম না কারা এবং কেন সাগর-রুনি সাংবাদিক দম্পত্তিকে হত্যা করেছিল। সংবাদপত্রের কর্মীরা এই হত্যার বিচারের জন্য এখনও আন্দোলন করে যাচ্ছেন। সংবাদপত্র ও সংবাদকর্মীরা যখন অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকেন, তখন গণতন্ত্রকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যায় না। আমরা সেটা চাই বটে, কিন্তু সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রশ্নে ক্ষমতাসীনরা বরাবরই নির্লিপ্ত। সংবাদপত্রকে নিয়ন্ত্রণে রেখে, একটা ভয়ের আবহ তৈরি করে আর যাই হোক, সত্যিকারে গণতন্ত্র বিনির্মাণ করা যাবে না। আমরা চাই সংবাদপত্র লিখুক, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশিত হোক, সরকারের দোষত্রুটি ধরিয়ে দিক, সমাজে সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হোক, তাহলেই গণতন্ত্র রক্ষা পাবে এবং গণতন্ত্রকে আমরা আরো উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবো। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনায় নয়া দিগন্ত অফিসে আগুন লাগানো কিংবা আমার দেশসহ আরো কয়েকটি পত্রিকায় আগুন লাগানোর ঘটনা গণতন্ত্রের পেছনে ছুরিকাঘাতের সামিল। কিংবা সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করার যে ঘোষণা, তাও সুস্থ মানসিকতা সম্পন্ন নয়। আমরা চাইবো শুভবুদ্ধির উদয় হোক এবং এ দেশে গণতন্ত্র চর্চা আরো শক্তিশালী হোক। শুধুমাত্র সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার মধ্যে দিয়েই এই গণতন্ত্র চর্চা শক্তিশালী হতে পারে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অতি সাম্প্রতিককালে শাহবাগ চত্বরে বারবার কয়েকটি বিশেষ পত্রিকা বন্ধের দাবি করা হচ্ছে। ওইসব পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন বন্ধেরও দাবি করা হচ্ছে। ধারণা করছি অচিরেই হয়তো বিজ্ঞাপনও কৌশলে বন্ধ করা হবে। কোনো সুস্থ সমাজে এভাবে কী পত্রিকা বন্ধ করার নজির আছে? ১৯৭৫ সালে বাকশালী ব্যবস্থা প্রবর্তন করে যখন ৪টি পত্রিকা রেখে বাকি সংবাদপত্র বন্ধ করা হয়েছিল, আজ পরিস্থিতি অনেকটা সেদিকে যাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। বিজ্ঞাপন বন্ধ করা হলে, অথবা বিজ্ঞাপন দাতারা বিজ্ঞাপন না দেয়ার হুমকির মুখে থাকলে, ধীরে ধীরে ওইসব পত্রিকা ও চ্যানেল একটি বড় ধরনের আর্থিক ঝুঁকির মুখে থাকবে। সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে কোনো কোনো এলাকায় দিগন্ত চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। একটি জনপ্রিয় ব্লগ সোনার বাংলাদেশ ব্লক করে দেয়া হয়েছে। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। যারা সত্য কথা বলেন, লেখেন, তারা আছেন ঝুকির মুখে। শাহবাগ চত্বরের আন্দোলনে এদের বিরুদ্ধে হুমকি দেয়া হয়েছে। একটি শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মধ্যে আমরা বসবাস করছি। একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য এই ধরনের পরিস্থিতি প্রত্যাশিত নয় আমরা চাইবো পরিস্থিতির উন্নতি হোক।
01.03.2013
0 comments:
Post a Comment