রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

আরব বিশ্বে ইসলামিক শক্তির পুনরুত্থান?

এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে সারা আরব বিশ্বেই আন্দোলন হচ্ছে সত্য, কিন্তু সেখানে বিকল্প কী? বিকল্প কোন শক্তি সেখানে ক্ষমতা গ্রহণ করবে? আগামী ২৪ জুলাই তিউনিসিয়ায় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে ইসলামপন্থি দল এন্নাহাদ্দার দিকে লক্ষ্য থাকবে অনেকের। গত ২০ বছর ধরে দলটি নিষিদ্ধ ছিল। সম্প্রতি এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছে।

আরব বিশ্বের দীর্ঘদিনের একনায়কতান্ত্রিক সরকারগুলোর পতনের পর সেখানে যে রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, সেই রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণ করতে যাচ্ছে মডারেট ইসলামিক শক্তিগুলো। তবে এই শক্তি অতটা কট্টর নয় এবং এদের সঙ্গে রাজনীতিগতভাবে আল কায়দারও বিরোধ রয়েছে। আরব বিশ্বে শাসকরা দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষমতায়। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতা ধরে রাখার কারণে এখানে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হয়নি। তিউনিসিয়ার বেন আলি (২৩ বছর), মিসরের হোসনি মোবারক (৩০) এখন ইতিহাসের অংশ। লিবিয়ায় গাদ্দাফির ৪১ বছরের শাসনের পতন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এর পরে রয়েছেন আলী আবদুল্লাহ সালেহ (ইয়েমেনে ১৯৭৮ সাল থেকে) ও আবদুল আজিজ বুতেফলিকা (আলজেরিয়ায় ১৯৯৯ সাল থেকে)। শুধু এ দেশগুলো কেন বলি, আরব লীগভুক্ত ২২টি দেশের প্রতিটিতেই শাসকরা একদলীয় শাসন কায়েম করেছেন, যেখানে গণতন্ত্রের এতটুকু লেশমাত্র নেই। ফ্রিডম হাউস ১৬৭ দেশের গণতন্ত্রের চর্চা নিয়ে একটি জরিপ করেছিল। তাতে আরব বিশ্বের অবস্থান খুব আশাব্যঞ্জক নয়। যেমন_ তিউনিসিয়ার অবস্থান ১৪৪, মিসরের ১৩৮ আর লিবিয়ার ১৫৮। লিবিয়ায় তো আদৌ কোনো দল ব্যবস্থাই নেই। এমনকি মুয়াম্মার গাদ্দাফি সরকারিভাবে লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট নন। তিনি প্রেসিডেন্টের সুযোগ-সুবিধা ও বিদেশে এই প্রটোকল পান বটে, কিন্তু লিবিয়ায় তার পদ 'বিপ্লবের নেতা'। তার লিখিত 'গ্রিন বুক'ই হচ্ছে লিবিয়ার অলিখিত সংবিধান। আমরা যাকে পার্লামেন্ট বলি, লিবিয়ায় তা আছে বটে। কিন্তু তারা এটাকে বলেছে 'জেনারেল পিপলস কংগ্রেস'। গ্রাম তথা মিউনিসিপ্যালিটি পর্যায়েও 'পিপলস কংগ্রেস' রয়েছে। সেখান থেকেই প্রতিনিধিরা 'জেনারেল পিপলস কংগ্রেস'-এ যান। সেখানে কোনো দল নেই। আজ তাই যখন গাদ্দাফির পদত্যাগের দাবি উঠেছে, তখন তিনি জানিয়ে দিয়েছেন_ তিনি তো 'নির্বাচিত' নন যে পত্যাগ করবেন। উপরন্তু লিবিয়ার সমাজব্যবস্থায় দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি নেই, যার কাছে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারেন। এর বাইরে আলজেরিয়া ও ইয়েমেনে, যেখানে বড় ধরনের গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, সেখানে গণতন্ত্র সূচকে অবস্থান যথাক্রমে ১২৫ ও ১৪৬। রাজতন্ত্রশাসিত দেশগুলোতেও গণতন্ত্র সূচক কোনো আশার কথা বলে না। যেমন_ আরব আমিরাতের অবস্থান ১৪৮, ওমানের ১৪৩, সৌদি আরবের ১৬০, বাহরাইনের ১২২ আর মরক্কোর ১১৬। অর্থাৎ বাহরাইন কিংবা মরক্কোয় কিছুটা হলেও গণতন্ত্রের চর্চা হয়।

এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে সারা আরব বিশ্বেই আন্দোলন হচ্ছে সত্য, কিন্তু সেখানে বিকল্প কী? বিকল্প কোন শক্তি সেখানে ক্ষমতা গ্রহণ করবে? আগামী ২৪ জুলাই তিউনিসিয়ায় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে ইসলামপন্থি দল এন্নাহাদ্দার দিকে লক্ষ্য থাকবে অনেকের। গত ২০ বছর ধরে দলটি নিষিদ্ধ ছিল। সম্প্রতি এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছে। ফলে এন্নাহাদ্দার নেতা ও দীর্ঘদিন লন্ডনে নির্বাসিত জীবনযাপনরত রশিদ ঘানুচি সম্প্রতি দেশে ফিরে এসেছেন। ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে দলটি ১৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। স্পষ্টতই এন্নাহাদ্দা যে তিউনিসিয়ায় অন্যতম একটি শক্তি, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এন্নাহাদ্দা সংসদ নির্বাচনের ওপরই গুরুত্ব দিচ্ছে। রশিদ ঘানুচি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না বলেও জানিয়ে দিয়েছেন। মিসরে ইসলামিক ব্রাদারহুড পার্টিও আলোচনায় এসেছে। বলা হচ্ছে, মোবারক-পরবর্তী মিসরে ইসলামিক ব্রাদারহুড হচ্ছে বিকল্প শক্তি। দলটি বর্তমানে নিষিদ্ধ। সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকার এখনও দলটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়নি। দলটির ইতিহাস অনেক পুরনো। জন্ম ১৯২৮ সালে। একজন স্কুলশিক্ষক হাসান আল বান্না দলটি গঠন করেছিলেন। মূলত ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেই দলটির জন্ম। এটি ছিল মূলত একটি ধর্মীয় আন্দোলন। তাদের বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ আছে, তারা একসময় জার্মানির নাজিবাদে উৎসাহিত হয়েছিল। ত্রিশ ও চলি্লশের দশকে তারা হিটলারের বিতর্কিত গ্রন্থ 'মাইন ক্যাম্প' (mein kampf)-এর প্রচুর কপি দলীয় কর্মীদের মধ্যে বিতরণ করেছিল, এমন কথাও শোনা যায়। দলটি নিষিদ্ধ থাকার কারণে এর কর্মীরা বিভিন্ন দলের ভেতরে কাজ করে। মিসরের সর্বশেষ সংসদে তাদের সদস্যসংখ্যা ছিল ৮৮, শতকরা ২০ ভাগ। তারা সবাই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাদের সঙ্গে চরমপন্থি আল কায়দার কী ধরনের যোগাযোগ রয়েছে, এটা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। কেননা আল কায়দার দ্বিতীয় নেতা আইমান আল জাওয়াহিরি একসময় ইসলামিক ব্রাদারহুডেরও নেতা ছিলেন। যদিও ব্রাদারহুড ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছিল। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বে দলটি তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পারেনি। এমনকি সেনাবাহিনীর কাছেও দলটি বিতর্কিত। এ কারণেই দলটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে বলে মনে হয় না। তবে দলটি পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নেবে। এ ক্ষেত্রে তারা ভিন্ন একটি রাজনৈতিক সংগঠনের জন্ম দিতে পারে। মিসরে সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানে সংগঠনের তরুণ কর্মীরা অংশ নিয়েছিল। জানা যায়, Revolutionary Youth Council (RYC) -এর ব্যানারে ইসলামিক ব্রাদারহুডের কর্মীরা অংশ নিয়েছিল। RYC'র নেতা আব্বাসকেও দলটির ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে মনে করেন কেউ কেউ। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, দলটি নিষিদ্ধ থাকার কারণে এর একটি অংশ Kafaya Movement-এর ব্যানারে সংগঠিত হয়েছিল। ২০০৪ সালে ইসলামিক ব্রাদারহুডের নেতা আবুল লা আলা মাদি এই Kafaya Movement-কে সংগঠিত করেছিলেন। একসময় দলটির পক্ষ থেকে Al-Wasat পার্টিরও জন্ম দেওয়া হয়েছিল। তাই সংসদ নির্বাচনে ইসলামিক ব্রাদারহুড অন্যতম পক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হবে।

আলজেরিয়ায় ইসলামী পুনরুজ্জীবন আন্দোলনের ইতিহাস বেশ পুরনো। রুটির দামের প্রতিবাদে ১৯৮৮ সালে এ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে এটাকে পুঁজি করেই জন্ম হয়েছিল ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্টের (আইএসএফ)। দলটির নেতা ছিলেন আব্বাস মাদানি। ১৯৮৮ সালের ডিসেম্বরে সেখানে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে আইএসএফ পেয়েছিল ১৮৮টি সিট। আইএসএফের দাবির মুখে ১৯৮৯ সালে আলজেরিয়ায় গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাতে শতকরা ৭৩ ভাগ ভোটে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা পরিত্যাগ ও বহুদলীয় রাজনীতির একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। ১৯৯১ সালের নির্বাচনেও ফ্রন্ট ১৮৮টি সিট পেয়েছিল। অন্যদিকে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (এনএলএফ) পেয়েছিল মাত্র ১৫টি সিট, আর সোশ্যালিস্টরা ২৮টি সিট। ১৯৬২ সালের স্বাধীনতার পর থেকেই এনএলএফ এককভাবে ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছিল। কিন্তু স্যালভেশন ফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হলেও দলটি ক্ষমতা পায়নি। বরং দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে ইসলামপন্থিরা সেখানে তৎপর ও যথেষ্ট শক্তিশালী। মাগরেবভুক্ত অপর একটি দেশ মরক্কোয় রাজতন্ত্র থাকলেও সেখানেও ইসলামপন্থিরা তৎপর। মরক্কোয় ইসলামী পুনরুজ্জীবন আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে 'আল আদল ওয়াল ইহসান' (জাস্টিস অ্যান্ড চ্যারিটি) নামে একটি সংগঠন। সংগঠনটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন আবদেল সালাম ইয়াসিব।

উত্তর আফ্রিকায় মাগরেবভুক্ত অঞ্চলে ইসলামী পুনরুজ্জীবন আন্দোলনের উত্থানের পেছনে কাজ করছে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর একনায়কতান্ত্রিক আচরণ। এখানে দীর্ঘদিন বিকল্প কোনো শক্তি গড়ে ওঠেনি, যারা সাধারণ মানুষের সমস্যা নিয়ে আন্দোলন করবে। তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া কিংবা লিবিয়ায় তথাকথিত বামপন্থি কমিউনিস্ট, সোশ্যালিস্ট আর ন্যাশনালিস্টরা হয় ক্ষমতাসীন দলকে সমর্থন করেছে, তাদের অংশীদার হয়েছে, নতুবা তারা ঐক্যজোট গঠন করে সামরিক বাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে ক্ষমতা পরিচালনা করেছে। এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের পুঞ্জীভূত সমস্যা নিয়ে কথা বলেছে ওইসব সংগঠন, যাদের রাজনৈতিক দল হিসেবে কোনো পরিচিতি ছিল না। তাদের কারও কারও পরিচিতি সংস্কারবাদী একটি আন্দোলন হিসেবে (যেমন_ এন্নাহাদ্দা)। তবে এটাও সত্য, মৌলবাদী চিন্তা-চেতনা তাদের মধ্যে ভর করেছে (যেমন_ আলজেরিয়া)।

আলজেরিয়ায় মৌলবাদীরা সেনা ক্যাম্পে আক্রমণ পর্যন্ত করেছিল। ভয়ের কারণ হচ্ছে, এ অঞ্চলজুড়ে রয়েছে Al-Qaeda in the Islamic Maghreb (AQIM)-এর বিশাল নেটওয়ার্ক। ঐতিহাসিকভাবেই অছওগ-এর নেতা ছিলেন আবদেল মালেক ড্রউকডেল। AQIM-এর আলজেরীয় অংশ ২০০৭ সালে গঠন করে Salafist Group for Preaching and Combat (GSPC). GSPC-ই পরবর্তীকালে আল কায়দা নাম ধারণ করে। বিশ্বব্যাপী 'জিহাদ'-এর অংশ হিসেবে এরা এখন বিশ্বের অনেক দেশেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত।

আজ হঠাৎ করেই একদলীয় শাসকদের পতনের পর এই ইসলামিক শক্তিগুলো তৎপর হয়ে উঠেছে। বিকল্প কোনো গণতান্ত্রিক শক্তি সেখানে গড়ে ওঠেনি। তবে যুক্তরাষ্ট্র বেশ কিছুদিন ধরে Greater Middle East Policy নিয়ে কাজ করছে, যেখানে তারা মধ্যপ্রাচ্য তথা উত্তর আফ্রিকায় বিকল্প একটি শক্তি (এনজিও, তরুণ প্রতিনিধি) গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। মডারেট মুসলিম সংগঠনগুলোকেও তারা প্রমোট করছে। ফলে নরমপন্থি, আধুনিকমনস্ক, আল কায়দাবিরোধী একটি শক্তির যদি পুরো মাগরেবভুক্ত অঞ্চলে জন্ম হয় এবং তারা যদি নির্বাচনে বিজয়ী হয়, যুক্তরাষ্ট্রের তাতে আপত্তি থাকবে না। স্পষ্টতই আরব বিশ্ব পরবর্তী নেতৃত্বের জন্য তৈরি হচ্ছে। আর একটি মডারেট মুসলিম নেতৃত্বই (অনেকটা তুরস্ক মডেল) একুশ শতকে আরব জাহানকে বিশ্ব আসরে নেতৃত্ব দিতে পারে।

ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

0 comments:

Post a Comment