রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

যে মৃত্যু বন্ধুত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে

ফেলানি এ দেশের আলোবাতাসে বেড়ে ওঠা এক কিশোরীর নাম। ঝুলে ছিল লাশ হয়ে, কাঁটাতারের বেড়ায়। ১৪ বছরের ফেলানির বিয়ের পিঁড়িতে বসার কথা ছিল পরদিন। কিন্তু বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি আর যাওয়া হলো না ফেলানির। লাশ হয়ে ঝুলে থাকল কয়েক ঘণ্টা। ৮ জানুয়ারিতে লাল পায়জামা পরা লাশ হয়ে ঝুলে থাকা ফেলানির ছবি দৈনিক নয়া দিগন্তে যারা দেখেছেন, তাদের হৃদয় কতটুকু হাহাকার করে উঠেছিল, আমি বলতে পারব না। কিন্তু আমার চোখে পানি এসেছিল। আমি কেঁদেছি। কেঁদেছি ফেলানির জন্য, আমার মেয়ের মতো যার বয়স। ফেলানি এক টুকরো বাংলাদেশ। বিএসএফের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিল ফেলানি। ওই পাটনা কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি গ্রামের। অনন্তপুর বিএসএফ ক্যাম্পের সেনারা গুলি করে মেরেছিল ফেলানিকে। ঘটনা ভোর সোয়া ৬টার। ফেলানিরা কাজ করত দিল্লিতে। বাবা ছিলেন নির্মাণকর্মী। মেয়ের বিয়ে ঠিক করে বাবা মেয়েকে নিয়ে দেশে এসেছিলেন। বাবা কাঁটাতার পার হতে পারলেও মেয়ে ফেলানির জামা আটকে গিয়েছিল কাঁটাতারের বেড়ায়। বাবার করার কিছুই ছিল না। কাঁটাতারের বেড়ায় আটকে থাকা ফেলানিকে পাখির মতো গুলি করে মেরেছিল বিএসএফের সৈন্যরা। আধঘণ্টা পানি পানি করে চিত্কার করেছিল ফেলানি। কেউ আসেনি। ৩০ ঘণ্টা পর ফেলানির লাশ ফেরত দিয়েছিল বিএসএফ। এভাবেই ছোট্ট ফেলানিকে গুলি করে মেরে ‘বন্ধুত্বের’ প্রতিদান দিল ভারতের বিএসএফ। এর চেয়ে আর ‘বন্ধুত্বের’ প্রতিদান কী হতে পারে! আমরা কি এই বন্ধুত্ব চেয়েছি?

গেল বছর প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করলেন। সেখানেও বিএসএফের হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গটি উঠেছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী আশ্বাসও দিয়েছিলেন এ ধরনের হত্যাকাণ্ড আর ঘটবে না। দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের উচ্চপর্যায়ের বৈঠকেও প্রসঙ্গটি উঠেছে বারবার। সেখানেও বলা হয়েছে— এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না। কিন্তু ঘটছে। বারে বারে ঘটছে। গেল বছর বিএসএফের হাতে কতজন বাংলাদেশী মারা গেছে এই পরিসংখ্যান আমাদের কাছে আছে। পত্রপত্রিকায় এই পরিসংখ্যান বেরও হয়েছে। কিন্তু বিএসএফ কর্তৃক এই ‘গণহত্যা’ বন্ধ হয়নি। তাহলে ভারতের নেতারা যে আশ্বাস দেন, তা কি লোক দেখানো আশ্বাস দিয়ে নিজেদের স্বার্থ আদায় করে নেয়া?

ফেলানির ঝুলে থাকা লাশের ছবি দেখে আমি মনে করেছিলাম আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা এর প্রতিবাদ করবেন। নিদেনপক্ষে ভারতীয় হাইকমিশনারকে সেগুনবাগিচায় তলব করবেন। না, কিছুই ঘটেনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কোনো সমবেদনার বক্তব্যও আমরা পেলাম না পত্রপত্রিকায়। না, ফেলানি কোনো ভিআইপি ছিল না। তাই ক্ষমতাবানদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছিল ফেলানি। অথচ এই ফেলানি, ফেলানির বাবারা, চাচারা ভোট দেন। সরকার গঠিত হয়। এরপর ভোটারদের প্রতি আর কারও দায়বদ্ধতা যেন থাকে না।

বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব এখন ওই কাঁটাতারের বেড়ার মতোই প্রশ্ন চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বাংলাদেশে এই ট্রানজিট নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সরকার ওই চুক্তিটি স্বাক্ষর করেছে। আমার ধারণা ছিল ট্রানজিট চুক্তির বিষয়টি নিয়ে সংসদে আলোচনা হবে, যাতে করে আমরা বিস্তারিত জানতে পারব। কিন্তু সেটা হয়নি। ভারত আর্থিক সুবিধা দিয়েছে। তাও দেয়া হয়েছে শুধু ট্রানজিটের অবকাঠামোগত সুবিধার জন্য। এতে লাভটা ষোলআনা ভারতেরই। বাংলাদেশ এতে লাভবান হবে না। ভারতের পানিসম্পদ সচিব এসেছিলেন বাংলাদেশে। বৈঠক করলেন আমাদের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গে। আমার বন্ধু পানিসম্পদ সচিব বিবিসির বাংলা বিভাগকে বললেন, একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তিতে জেআরসির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে। তিনি জানালেন চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয় মন্ত্রিপর্যায়ের বৈঠকে। কিন্তু বিবিসির ওই অনুষ্ঠানেই শুনলাম পশ্চিমাদের পানিসম্পদমন্ত্রীর আপত্তির কথা। তিনি জানালেন অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তির ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। এই চুক্তিতে পশ্চিমবঙ্গ একটি অংশ—কথাটাও তিনি জানিয়ে দিলেন। তাহলে কোনটাকে আমরা সত্য বলে ধরে নেব? বাংলাদেশের জন্য তিস্তার পানিচুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বারবার বাংলাদেশ একটি চুক্তির কথা বলে আসছে। এবারও কি চুক্তির আশপাশ দিয়ে আমাদের অন্ধকারে রাখা হলো? আমাদের প্রাপ্য তাহলে কী? আমরা গঙ্গার পানিচুক্তি করেছিলাম পদ্মায় পানি পাব বলে। সেই পদ্মা এখন মরা খাল। পানি নেই। সংবাদপত্রগুলো আমাদের জানাচ্ছে চুক্তি অনুযায়ী যে পানি পাওয়ার কথা, সেই পরিমাণ পানি আমরা গত ক’বছর ধরেই পাচ্ছি না। এর প্রতিবাদ আমরা কার কাছে করব? বাংলাদেশ তো শুধু দিয়েই যাচ্ছে। প্রতিদানে পাচ্ছি কী? ফেলানির লাশ!

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। আমরা ভারত থেকে আমদানি করি বেশি, রফতানি করি কম। অথচ বাংলাদেশী পণ্যের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে ভারতে। কিন্তু ট্যারিফ, প্যারাট্যারিফ, নেগেটিভ লিস্টের জন্য আটকে আছে বাংলাদেশী পণ্য। বাংলাদেশী পণ্য ভারতের বাজারে প্রবেশ করতে পারছে না। বাংলাদেশ বড় ধরনের ‘জ্বালানি ফাঁদ’-এ পড়তে যাচ্ছে। বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। বিদ্যুত্ উত্পাদিত হচ্ছে না। আঞ্চলিক ভিত্তিতে জলবিদ্যুত্ প্রকল্প হাতে নিয়ে বাংলাদেশের বিদ্যুতের ঘাটতি মেটানো সম্ভব। অর্থাত্ নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে জলবিদ্যুত্ প্রকল্প হাতে নেয়া যায়। কিন্তু ভারত তা চায় না। ভারত চায় দ্বিপাক্ষিকতা। দ্বিপাক্ষিকভাবে (ভারত-ভুটান, ভারত-নেপাল) ভারত তার বিদ্যুত্ ঘাটতি কাটিয়ে উঠছে। ভারত বাংলাদেশে বিদ্যুত্ বিক্রি করবে। এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ভারতে সফরের সময়। কিন্তু বাংলাদেশী একজন বিশেষজ্ঞ বললেন ভিন্ন কথা। বললেন, ভারত কোনদিনই বিদ্যুত্ বিক্রি করতে পারবে না। জলবিদ্যুত্ উত্পাদনে আপেক্ষিকতায় ভারত রাজি নয়। অথচ ট্রানজিটের ব্যাপারে ভারত ‘কানেকটিভিটি’ বা বহুমুখী যোগাযোগের যুক্তি দেখিয়েছে। আর আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাতেই খুশি। তার মুখ দিয়েও বেরুচ্ছে ‘কানেকটিভিটি’র কথা। বিশ্বায়নের যুগে ‘কানেকটিভিটি’কে গুরুত্ব দেয়া হয়। এটা বাস্তব। কিন্তু কানেকটিভিটি তো একপক্ষীয় হয়ে যাচ্ছে। আমরা কি ভুটান ও নেপালে যাওয়ার ট্রানজিট পাচ্ছি? বলা হয়েছিল বাংলাদেশ যে ‘ট্রানজিট ফি’ পাবে, তা দিয়ে ভারতের সঙ্গে তার বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে পারবে। কিন্তু ভারত এখন বলছে, তারা কোনো ‘ট্রানজিট ফি’ দেবে না। আমরা ভারতকে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে দিতেও রাজি হয়েছি। অথচ বাংলাদেশী পণ্যের রফতানি, বিশেষ করে তৈরি পোশাক রফতানি করতেই চট্টগ্রাম বন্দর হিমশিম খাচ্ছে। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে পোশাক রফতানিকারকদের মাঝেমধ্যে কার্গো বিমানও ব্যবহার করতে হচ্ছে। এমনই এক পরিস্থিতিতে ভারতীয় কার্গো হ্যান্ডলিং করতে দিলে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?

বাংলাদেশে অবস্থানরত অনেক ভারতীয় সন্ত্রাসীকে এরই মধ্যে আমরা ভারতীয়দের হাতে তুলে দিয়েছি। কিন্তু ভারতে অবস্থানরত একজন বাংলাদেশী সন্ত্রাসীকেও কি ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের হাতে তুলে দিয়েছে? টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আমাদের যে শঙ্কা, তা এখনও দূর হয়নি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। বক্তব্যটি নিঃসন্দেহে ভালো। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? গেল সপ্তাহেও আসামে এই বাঁধের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে। আর এর ছবি বাংলাদেশী পত্রপত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। অর্থাত্ এটা স্পষ্ট যে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়নি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী যা বলেছিলেন, তা কথার কথা। সীমান্ত এখনও চিহ্নিত হয়নি। তিন বিঘা করিডোরের ওপর দিয়ে একটি ফ্লাইওভার নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দিল্লি। সেই প্রস্তাবও কার্যকর করেনি ভারত। তাহলে ব্যাপারটা কী গড়াচ্ছে? ভারত যা চাইছে, তাই তারা পাচ্ছে বা আদায় করে নিচ্ছে। আর আমাদের প্রতিশ্রুতি দেয়া হচ্ছে। সেই প্রতিশ্রুতি কোনোদিনই বাস্তবায়ন করছে না ভারত।

একজন ফেলানির হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণিত হলো ভারত তার কথা রাখেনি। এ ক্ষেত্রে সরকারের দুর্বলতা লক্ষ্য করার মতো। ফেলানির হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সরকার প্রতিবাদ তো দূরের কথা, কোনো মন্ত্রী, এমপি পর্যন্ত দুঃখ প্রকাশ করেননি। গেল মাসে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল যে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে মানবাধিকার পরিস্থিতি গাজা-ইসরাইল সীমান্তের চেয়েও ভয়াবহ। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির দৃষ্টি এতে আকৃষ্ট হয়েছিল কি না জানি না। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, আমাদের জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন হচ্ছে। সমমর্যাদাভিত্তিক যে সম্পর্ক গড়ে ওঠার কথা, তাতে ব্যত্যয় ঘটেছে। আমরা সমমর্যাদা পাচ্ছি না। ফেলানির মৃত্যু এ কথাটা আবার প্রমাণ করল। আমাদের পররাষ্ট্র নীতির ব্যর্থতা এখানেই যে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে আমরা সেই সমমর্যাদাভিত্তিক সম্পর্ক নিশ্চিত করতে পারছি না।
লেখক : রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ
[সূত্রঃ আমার দেশ, ১৬/০১/১১]

0 comments:

Post a Comment