মিসরে হোসনি মোবারকের দীর্ঘ ৩০ বছরের শাসনের অবসানের পর একটি প্রশ্ন এখন কোনো কোনো মহলে আলোচিত হচ্ছে, মিসর কি তুরস্কের মডেল অনুসরণ করতে যাচ্ছে? এরই মধ্যে মিসরে পার্লামেন্ট ও সংসদ বাতিল করা হয়েছে। সামরিক কাউন্সিল আগামী ৬ মাসের মধ্যে একটি নির্বাচন আয়োজন করার কথা বলেছে। তবে অনেক প্রশ্নের সমাধান এখনও হয়নি। এ ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধনের পরই কি নির্বাচন হবে, নাকি প্রথমে নির্বাচন, পরে সংবিধান সংশোধন—ব্যাপারটি এখনও স্পষ্ট নয়। যদিও মোবারকের ক্ষমতা ছাড়ার আগ মুহূর্তে একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল, যারা সংবিধান সংশোধনের সুপারিশ করে। ওই কমিটির কোনো খবরাখবরও এখন পাওয়া যাচ্ছে না। তবে বাস্তবতা হচ্ছে একটি পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে মিসরে। আর এতে করে এক ধরনের জনগণের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হতে যাচ্ছে। দুটো জিনিস হতে পারে মিসরে। এক. প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা কমিয়ে প্রেসিডেন্টকে অলঙ্কারিক পদে রাখা। দুই. একটি সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠা। জনগণের ভোটে সরকার নির্বাচিত হবে এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সরকার পরিচালনা করবেন। এ ক্ষেত্রে পর্দার অন্তরালে থেকে সেনাবাহিনী ‘ওয়াচডগ’ হিসেবে কাজ করবে। এটাই তুরস্ক মডেল। তুরস্কের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই মিল আছে মিসরের। এক. উভয় দেশেই মুসলমান ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং ইসলামপন্থী দলের ব্যাপক গণভিত্তি রয়েছে। দুই. উভয় দেশেই সেনাবাহিনী অত্যন্ত শক্তিশালী। উভয় দেশেই সেনাবাহিনী কর্তৃক ক্ষমতা দখলের ইতিহাস রয়েছে। তিন. উভয় দেশের সঙ্গেই ইসরাইলের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। ‘তুরস্ক’ মডেল নিয়ে আলোচনা করতে হলে তুরস্কের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাস আমাদের জানা প্রয়োজন।
তুরস্কের সনাতন রাজনৈতিক দলগুলো যখন ব্যাপক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল, তখন সেখানে ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী ইসলামিক ওয়েলফেয়ার কমিটির আত্মপ্রকাশ ঘটে। দলটির ইসলামিক আদর্শ সাধারণ মানুষ সমর্থন করলেও সেনাবাহিনীর সমর্থন পায়নি দলটি। দলটির নেতা রিসেপ তাইয়েব এরদোগান ১৯৯৬ সালের জুনের নির্বাচনের পর সরকার গঠন করেছিলেন। তিনি ধর্মনিরপেক্ষ ট্রুপাথ পার্টির সঙ্গে তাকে কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন; কিন্তু সেনাবাহিনীর চাপের মুখে এরদোগানকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। তখন পতন ঘটে কোয়ালিশন সরকারের (জুন ১৯৯৭)। এরদোগানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে নষ্ট করে আনাচে-কানাচে অসংখ্য ধর্মীয় স্কুল, মাদ্রাসা ইত্যাদি গড়ে তুলেছেন, যা তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের প্রতি সরাসরি হুমকিস্বরূপ। সেনাবাহিনী ওই সময় ধর্মীয় স্কুলগুলো বন্ধ করে দেয়ার দাবি জানালে এরদোগান তা মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলেন; কিন্তু অত্যন্ত ক্ষমতাধর সেনাবাহিনীর চাপের মুখে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরদোগানের পদত্যাগের পর ওই সময় সরকার গঠন করেছিলেন মাদারল্যান্ড পার্টির নেতা মেসুত ইলমাজ; কিন্তু ইলমাজের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে ১৯৯৮ সালের শেষদিকে তিনি পদত্যাগ করেন। ওই সময় ইসলামিক ওয়েলফেয়ার পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। দলটি এতে করে ধ্বংস হয়ে যায়নি। তারা ভার্চু পার্টি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। ভার্চু পার্টিরই পরিবর্তিত নাম ইসলামিক জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি। মেসুত ইলমাজের পদত্যাগ ও প্রবীণ নেতা বুলন্দ এচিভিট সাময়িকভাবে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর তুরস্কে আবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের প্রাক্কালে এরদোগানকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। পরে উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি সংসদে আসেন। তার অবর্তমানে তার দল নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হয় ও সরকার গঠন করে। প্রথমদিকে মি. গুল সরকার প্রধানের দায়িত্ব নিলেও এরদোগান উপনির্বাচনে বিজয়ী হলে তিনিই সরকার প্রধান অর্থাত্ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। সেই থেকে এরদোগান তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী।
চলতি বছর সেখানে পরবর্তী নির্বাচনের কথা এবং এরদোগান সম্ভবত দেশটির প্রেসিডেন্ট হবেন।
এরদোগান প্রথম যখন সরকার গঠন করেন (১৯৯৬), তখন তার অনেক সিদ্ধান্ত তাকে বিতর্কিত করেছিল। এরদোগানের ১২ মাসের শাসনামলে মোট ১২ বার তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছিল। তিনি তার কোয়ালিশন পার্টনারের সঙ্গেও দ্বন্দ্বে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। দু’জন মন্ত্রী তখন পদত্যাগ করেছিলেন। এরদোগানের ইসলামীকরণ কর্মসূচি এবং ওই সময় তার ইরান, লিবিয়া ও সিরিয়া সফর বহির্বিশ্বে তুরস্কের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছিল। এই তিনটি দেশের সঙ্গে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভালো নয়। তুরস্কের সেনাবাহিনী ইসরাইলের সঙ্গে সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ এবং ইসরাইলের সঙ্গে ওই তিনটি দেশের সম্পর্কও ভালো নয়। ধারণা করা হয়, তুরস্কের সেনাবাহিনী এরদোগানের ওই সফরকে অনুমোদন করেনি। এরদোগানকে তাই পদত্যাগে বাধ্য করেছিল সেনাবাহিনী।
তুরস্কের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর এই ভূমিকা অনেকটা স্বীকৃত। রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর এই পরোক্ষ অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করেছিলেন সে দেশের অবিসংবাদিত নেতা কামাল আতাতুর্ক। কামাল আতাতুর্ককে আধুনিক তুরস্কের জনক বলা হয়। তার নেতৃত্বে তুরস্ক অটোমান সাম্রাজ্যের বিলোপ করে স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিল। ১৯২০ সালের এপ্রিলে আঙ্কারায় স্বাধীন তুরস্কের গ্রান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির প্রথম অধিবেশন হয়। ১৯২১ সালের ২০ জানুয়ারি অ্যাসেম্বলি নতুন সংবিধানের পক্ষে ভোট দেয়। নতুন সংবিধান অনুযায়ী জনগণের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেয়া হয়। রাষ্ট্রের মৌলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানে লিপিবদ্ধ হয়। ১৯২৩ সালের ২৯ অক্টোবর তুরস্ক প্রজাতন্ত্র জন্মলাভ করে। এর প্রায় ৩৭ বছর পর ১৯৬০ সালে সেনাবাহিনী জেনারেল সিমেল গুরসোলের নেতৃত্বে ক্ষমতা দখল করে গ্রান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির বিলোপ সাধন করে। মোস্তফা কামাল, যিনি আতাতুর্ক উপাদিতে ভূষিত হয়েছিলেন, তিনি তুরস্কে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি উপহার দিয়েছিলেন। তিনি আরবি হরফের পরিবর্তে রোমান হরফে তুর্কি ভাষা প্রচলন করেন। তুর্কি ভাষায় আজান প্রচার চালু করেন। ১৯২৪ সালে তিনি ধর্মীয় আদালতের বিলুপ্তি ঘটান। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ অনুচ্ছেদ সংযোজনের পাশাপাশি ১৯২৮ সালে তিনি ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার অবসান ঘটান। ১৯৩৪ সালে তুরস্কে মহিলাদের ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়। ১৯৩৮ সালে কামাল আতাতুর্ক মারা যান। তার মৃত্যুর এত বছর পরও তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। কামাল আতাতুর্ক তুরস্কের স্বাধীনতার জন্য ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেও তিনি তুরস্ককে একটি ইউরোপীয় রাষ্ট্র হিসেবেই দেখতে চেয়েছিলেন। আর আতাতুর্ক-পরবর্তী নেতৃত্ব এ পথ থেকে বিচ্যুত হয়নি। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়নে তুরস্কের যোগদান এখনও নিশ্চিত হয়নি।
তুরস্কের রাজনীতি এখন স্পষ্টতই দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। এক ভাগে রয়েছে ইসলামী দলগুলো, যারা ইসলামী ভাবধারায় দেশটিকে পরিচালিত করতে চায়; অন্যদিকে রয়েছে ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা, যারা দেশটিকে পশ্চিমা ভাবধারায় পশ্চিমা রাজনীতির অনুকরণে পরিচালিত করতে চায়। এরদোগানের নেতৃত্বাধীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ইসলামী ভাবধারায় বিশ্বাসী হলেও তারা কট্টরপন্থী নন। তারা মধ্যযুগীয় রাজনীতিতেও দেশটিকে নিয়ে যেতে চান না। বেশ-ভূষায় তারা আধুনিক। আধুনিক পশ্চিমা শিক্ষায় তারা শিক্ষিত। তারা ইসলামী আদর্শকে আধুনিক উপযোগী করে ব্যক্তি তথা রাষ্ট্রীয় জীবনে ব্যবহার করতে চান। মেয়েদের পর্দা প্রথা তারা সমর্থন করেন; কিন্তু তাই বলে মেয়েদের ঘরের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখতে চান না। মেয়েদের শিক্ষারও বিরোধী নয় দলটি। এখানেই তাদের সঙ্গে আল-কায়দা ও তালেবানদের পার্থক্য। এরদোগান নিজে ইসলামের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছেন একাধিকবার। তিনি তুরস্ককে একটি ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চান—এমন কথা তিনি বা তার দল কখনও বলেনি। তালেবানদের কর্মকাণ্ডেরও তারা সমালোচনা করেছেন। তবে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে সরকার বেশ বিব্রত। ইসরাইলের সঙ্গে দেশটির কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। এর ফলে মুসলিম বিশ্বে তুরস্কের ইমেজ কিছুটা হলেও ক্ষুণ্ন হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে এরদোগান ইসরাইলি কর্মকাণ্ডের সমর্থন না করলেও রাষ্ট্রীয় তথা আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার কারণে ইসরাইলের সঙ্গে তাকে সম্পর্ক রাখতে হচ্ছে।
গেল বছরের গণভোটের ফলাফলের পর এরদোগানের অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়েছে। জনগণ তাঁকে সংবিধান সংশোধনের সুযোগ দিয়েছে। সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রে তিনি কতটুকু পরিবর্তন আনবেন আগামীতে সেটাই দেখার বিষয়। এরই মধ্যে সেনাবাহিনী যাতে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে না পারে, সে ব্যাপারে কয়েকটি রক্ষাকবচ তিনি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। শীর্ষস্থানীয় জেনারেলদের তিনি সিভিল কোর্টে বিচারের ব্যবস্থা করেছেন। বর্তমান সংবিধানে যে কোনো ‘অপরাধ’ (রাষ্ট্র দখল) এর বিচার সিভিল কোর্টে করা যায় না। তাদের ‘ইমিউনিটি’ দেয়া হয়েছে। যে কারণে অতীতের সামরিক অভ্যুত্থানের জন্য (১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনবার) কোনো সেনাশাসককেই বিচার করা যায়নি। দ্বিতীয়ত, উচ্চ আদালতে বিচারপতিদের নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি এখন ইসলামী ভাবধারায় বিশ্বাসী বিচারকদের নিয়োগ দিতে পারেন। অতীতে উচ্চ আদালতের সমর্থন তিনি পাননি। তার দল নিষিদ্ধ হয়েছিল। তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন—এরদোগানের এসব ভোলার কথা নয়। তৃতীয়ত, দল হিসেবে স্বীকৃতির জন্য সংবিধানে একটা বাধ্যবাধকতা আছে। ন্যূনতম ১০ ভাগ ভোট না পেলে সেই দল পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। অতীতে কুর্দিরা পারেনি। এনজিওরা বেশ কিছুদিন ধরেই এই ধারার পরিবর্তন চাচ্ছে। এখন এরদোগান এতে পরিবর্তন আনতে পারেন ও কুর্দিদের সঙ্গে একটা সহাবস্থানে যেতে পারেন। এসব ক্ষেত্রে তিনি যদি পরিবর্তন আনেন, তা সেনাবাহিনীর স্বার্থে আঘাত করতে পারে। সেনাবাহিনী এই তিনটি ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন চাইবে না।
উল্লেখ্য, তুরস্কের গণভোটে সংবিধান সংশোধনের পক্ষে রায় পড়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন জানিয়েছিল। এরদোগান সংবিধান সংশোধনের পক্ষে একটি যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে সংবিধান সংশোধন করা না হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ পাওয়া যাবে না। তিনি দাবি করেছিলেন, গণভোটের এই রায় তুরস্কে আইনের শাসনের পথ প্রশস্ত করবে; কিন্তু এরদোগানের জন্য খারাপ খবর হচ্ছে শুধু সেনাবাহিনীই নয়, বরং বিরোধীদলগুলোও তখন এই সংবিধান সংশোধনের বিরোধিতা করেছিল। এমনি এক পরিস্থিতিতে এরদোগানের অবস্থান তুরস্কের রাজনীতিতে অত্যন্ত শক্তিশালী। জনসমর্থন তার রয়েছে। সেনাবাহিনী গণভোটের ফলাফলে খুশি না হলেও এ মুহূর্তে সরকারের সঙ্গে কোনো বিরোধিতায় জড়াবে না। সামরিক অভ্যুত্থানের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কেননা এ ধরনের কোনো সামরিক অভ্যুত্থানকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সমর্থন করে না। তাই নিঃসন্দেহে তুরস্কের রাজনীতিতে পরিবর্তন আসছে বলেই মনে হয়। তাই বলে দেশটি ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে না। মিসরের অবস্থানও ঠিক তেমনি। মুসলিম ব্রাদারহুড অত্যন্ত শক্তিশালী দল মিসরে। মিসরে ওশযধিহ গড়াবসবহঃ মূলত মুসলিম ব্রাদারহুডেরই সৃষ্টি। দলটি নিষিদ্ধ থাকায় তারা এ নামে কাজ করছে। এর নেতা সাইদ এল কাতাতনি তুরস্কের এরদোগান বা গুলের ভূমিকা পালন করতে পারেন মিসরে। তবে এখন দেখার বিষয় সেনাবাহিনী কতটুকু ‘কমিটেড’। আদৌ তারা ৬ মাসের মাথায় নির্বাচন দেবে—আমি পুরোপুরি তাতে বিশ্বাস রাখতে পারছি না। যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, তাহলে ওশযধিহ গড়াবসবহঃ-কে ঠেকানো যাবে না। মিসরের ঋধপবনড়ড়শ আন্দোলনেও Ikhwan Movement-এর তরুণ কর্মীরা সংগঠনের নির্দেশেই অংশ নিয়েছিল। এখন দেখার পালা মিসরে পরিবর্তনটা কীভাবে আসে।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
তুরস্কের সনাতন রাজনৈতিক দলগুলো যখন ব্যাপক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল, তখন সেখানে ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী ইসলামিক ওয়েলফেয়ার কমিটির আত্মপ্রকাশ ঘটে। দলটির ইসলামিক আদর্শ সাধারণ মানুষ সমর্থন করলেও সেনাবাহিনীর সমর্থন পায়নি দলটি। দলটির নেতা রিসেপ তাইয়েব এরদোগান ১৯৯৬ সালের জুনের নির্বাচনের পর সরকার গঠন করেছিলেন। তিনি ধর্মনিরপেক্ষ ট্রুপাথ পার্টির সঙ্গে তাকে কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন; কিন্তু সেনাবাহিনীর চাপের মুখে এরদোগানকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। তখন পতন ঘটে কোয়ালিশন সরকারের (জুন ১৯৯৭)। এরদোগানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে নষ্ট করে আনাচে-কানাচে অসংখ্য ধর্মীয় স্কুল, মাদ্রাসা ইত্যাদি গড়ে তুলেছেন, যা তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের প্রতি সরাসরি হুমকিস্বরূপ। সেনাবাহিনী ওই সময় ধর্মীয় স্কুলগুলো বন্ধ করে দেয়ার দাবি জানালে এরদোগান তা মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলেন; কিন্তু অত্যন্ত ক্ষমতাধর সেনাবাহিনীর চাপের মুখে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরদোগানের পদত্যাগের পর ওই সময় সরকার গঠন করেছিলেন মাদারল্যান্ড পার্টির নেতা মেসুত ইলমাজ; কিন্তু ইলমাজের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে ১৯৯৮ সালের শেষদিকে তিনি পদত্যাগ করেন। ওই সময় ইসলামিক ওয়েলফেয়ার পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। দলটি এতে করে ধ্বংস হয়ে যায়নি। তারা ভার্চু পার্টি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। ভার্চু পার্টিরই পরিবর্তিত নাম ইসলামিক জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি। মেসুত ইলমাজের পদত্যাগ ও প্রবীণ নেতা বুলন্দ এচিভিট সাময়িকভাবে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর তুরস্কে আবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের প্রাক্কালে এরদোগানকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। পরে উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি সংসদে আসেন। তার অবর্তমানে তার দল নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হয় ও সরকার গঠন করে। প্রথমদিকে মি. গুল সরকার প্রধানের দায়িত্ব নিলেও এরদোগান উপনির্বাচনে বিজয়ী হলে তিনিই সরকার প্রধান অর্থাত্ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। সেই থেকে এরদোগান তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী।
চলতি বছর সেখানে পরবর্তী নির্বাচনের কথা এবং এরদোগান সম্ভবত দেশটির প্রেসিডেন্ট হবেন।
এরদোগান প্রথম যখন সরকার গঠন করেন (১৯৯৬), তখন তার অনেক সিদ্ধান্ত তাকে বিতর্কিত করেছিল। এরদোগানের ১২ মাসের শাসনামলে মোট ১২ বার তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছিল। তিনি তার কোয়ালিশন পার্টনারের সঙ্গেও দ্বন্দ্বে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। দু’জন মন্ত্রী তখন পদত্যাগ করেছিলেন। এরদোগানের ইসলামীকরণ কর্মসূচি এবং ওই সময় তার ইরান, লিবিয়া ও সিরিয়া সফর বহির্বিশ্বে তুরস্কের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছিল। এই তিনটি দেশের সঙ্গে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভালো নয়। তুরস্কের সেনাবাহিনী ইসরাইলের সঙ্গে সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ এবং ইসরাইলের সঙ্গে ওই তিনটি দেশের সম্পর্কও ভালো নয়। ধারণা করা হয়, তুরস্কের সেনাবাহিনী এরদোগানের ওই সফরকে অনুমোদন করেনি। এরদোগানকে তাই পদত্যাগে বাধ্য করেছিল সেনাবাহিনী।
তুরস্কের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর এই ভূমিকা অনেকটা স্বীকৃত। রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর এই পরোক্ষ অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করেছিলেন সে দেশের অবিসংবাদিত নেতা কামাল আতাতুর্ক। কামাল আতাতুর্ককে আধুনিক তুরস্কের জনক বলা হয়। তার নেতৃত্বে তুরস্ক অটোমান সাম্রাজ্যের বিলোপ করে স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিল। ১৯২০ সালের এপ্রিলে আঙ্কারায় স্বাধীন তুরস্কের গ্রান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির প্রথম অধিবেশন হয়। ১৯২১ সালের ২০ জানুয়ারি অ্যাসেম্বলি নতুন সংবিধানের পক্ষে ভোট দেয়। নতুন সংবিধান অনুযায়ী জনগণের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেয়া হয়। রাষ্ট্রের মৌলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানে লিপিবদ্ধ হয়। ১৯২৩ সালের ২৯ অক্টোবর তুরস্ক প্রজাতন্ত্র জন্মলাভ করে। এর প্রায় ৩৭ বছর পর ১৯৬০ সালে সেনাবাহিনী জেনারেল সিমেল গুরসোলের নেতৃত্বে ক্ষমতা দখল করে গ্রান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির বিলোপ সাধন করে। মোস্তফা কামাল, যিনি আতাতুর্ক উপাদিতে ভূষিত হয়েছিলেন, তিনি তুরস্কে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি উপহার দিয়েছিলেন। তিনি আরবি হরফের পরিবর্তে রোমান হরফে তুর্কি ভাষা প্রচলন করেন। তুর্কি ভাষায় আজান প্রচার চালু করেন। ১৯২৪ সালে তিনি ধর্মীয় আদালতের বিলুপ্তি ঘটান। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ অনুচ্ছেদ সংযোজনের পাশাপাশি ১৯২৮ সালে তিনি ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার অবসান ঘটান। ১৯৩৪ সালে তুরস্কে মহিলাদের ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়। ১৯৩৮ সালে কামাল আতাতুর্ক মারা যান। তার মৃত্যুর এত বছর পরও তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। কামাল আতাতুর্ক তুরস্কের স্বাধীনতার জন্য ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেও তিনি তুরস্ককে একটি ইউরোপীয় রাষ্ট্র হিসেবেই দেখতে চেয়েছিলেন। আর আতাতুর্ক-পরবর্তী নেতৃত্ব এ পথ থেকে বিচ্যুত হয়নি। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়নে তুরস্কের যোগদান এখনও নিশ্চিত হয়নি।
তুরস্কের রাজনীতি এখন স্পষ্টতই দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। এক ভাগে রয়েছে ইসলামী দলগুলো, যারা ইসলামী ভাবধারায় দেশটিকে পরিচালিত করতে চায়; অন্যদিকে রয়েছে ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা, যারা দেশটিকে পশ্চিমা ভাবধারায় পশ্চিমা রাজনীতির অনুকরণে পরিচালিত করতে চায়। এরদোগানের নেতৃত্বাধীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ইসলামী ভাবধারায় বিশ্বাসী হলেও তারা কট্টরপন্থী নন। তারা মধ্যযুগীয় রাজনীতিতেও দেশটিকে নিয়ে যেতে চান না। বেশ-ভূষায় তারা আধুনিক। আধুনিক পশ্চিমা শিক্ষায় তারা শিক্ষিত। তারা ইসলামী আদর্শকে আধুনিক উপযোগী করে ব্যক্তি তথা রাষ্ট্রীয় জীবনে ব্যবহার করতে চান। মেয়েদের পর্দা প্রথা তারা সমর্থন করেন; কিন্তু তাই বলে মেয়েদের ঘরের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখতে চান না। মেয়েদের শিক্ষারও বিরোধী নয় দলটি। এখানেই তাদের সঙ্গে আল-কায়দা ও তালেবানদের পার্থক্য। এরদোগান নিজে ইসলামের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছেন একাধিকবার। তিনি তুরস্ককে একটি ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চান—এমন কথা তিনি বা তার দল কখনও বলেনি। তালেবানদের কর্মকাণ্ডেরও তারা সমালোচনা করেছেন। তবে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে সরকার বেশ বিব্রত। ইসরাইলের সঙ্গে দেশটির কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। এর ফলে মুসলিম বিশ্বে তুরস্কের ইমেজ কিছুটা হলেও ক্ষুণ্ন হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে এরদোগান ইসরাইলি কর্মকাণ্ডের সমর্থন না করলেও রাষ্ট্রীয় তথা আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার কারণে ইসরাইলের সঙ্গে তাকে সম্পর্ক রাখতে হচ্ছে।
গেল বছরের গণভোটের ফলাফলের পর এরদোগানের অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়েছে। জনগণ তাঁকে সংবিধান সংশোধনের সুযোগ দিয়েছে। সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রে তিনি কতটুকু পরিবর্তন আনবেন আগামীতে সেটাই দেখার বিষয়। এরই মধ্যে সেনাবাহিনী যাতে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে না পারে, সে ব্যাপারে কয়েকটি রক্ষাকবচ তিনি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। শীর্ষস্থানীয় জেনারেলদের তিনি সিভিল কোর্টে বিচারের ব্যবস্থা করেছেন। বর্তমান সংবিধানে যে কোনো ‘অপরাধ’ (রাষ্ট্র দখল) এর বিচার সিভিল কোর্টে করা যায় না। তাদের ‘ইমিউনিটি’ দেয়া হয়েছে। যে কারণে অতীতের সামরিক অভ্যুত্থানের জন্য (১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনবার) কোনো সেনাশাসককেই বিচার করা যায়নি। দ্বিতীয়ত, উচ্চ আদালতে বিচারপতিদের নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি এখন ইসলামী ভাবধারায় বিশ্বাসী বিচারকদের নিয়োগ দিতে পারেন। অতীতে উচ্চ আদালতের সমর্থন তিনি পাননি। তার দল নিষিদ্ধ হয়েছিল। তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন—এরদোগানের এসব ভোলার কথা নয়। তৃতীয়ত, দল হিসেবে স্বীকৃতির জন্য সংবিধানে একটা বাধ্যবাধকতা আছে। ন্যূনতম ১০ ভাগ ভোট না পেলে সেই দল পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। অতীতে কুর্দিরা পারেনি। এনজিওরা বেশ কিছুদিন ধরেই এই ধারার পরিবর্তন চাচ্ছে। এখন এরদোগান এতে পরিবর্তন আনতে পারেন ও কুর্দিদের সঙ্গে একটা সহাবস্থানে যেতে পারেন। এসব ক্ষেত্রে তিনি যদি পরিবর্তন আনেন, তা সেনাবাহিনীর স্বার্থে আঘাত করতে পারে। সেনাবাহিনী এই তিনটি ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন চাইবে না।
উল্লেখ্য, তুরস্কের গণভোটে সংবিধান সংশোধনের পক্ষে রায় পড়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন জানিয়েছিল। এরদোগান সংবিধান সংশোধনের পক্ষে একটি যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে সংবিধান সংশোধন করা না হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ পাওয়া যাবে না। তিনি দাবি করেছিলেন, গণভোটের এই রায় তুরস্কে আইনের শাসনের পথ প্রশস্ত করবে; কিন্তু এরদোগানের জন্য খারাপ খবর হচ্ছে শুধু সেনাবাহিনীই নয়, বরং বিরোধীদলগুলোও তখন এই সংবিধান সংশোধনের বিরোধিতা করেছিল। এমনি এক পরিস্থিতিতে এরদোগানের অবস্থান তুরস্কের রাজনীতিতে অত্যন্ত শক্তিশালী। জনসমর্থন তার রয়েছে। সেনাবাহিনী গণভোটের ফলাফলে খুশি না হলেও এ মুহূর্তে সরকারের সঙ্গে কোনো বিরোধিতায় জড়াবে না। সামরিক অভ্যুত্থানের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কেননা এ ধরনের কোনো সামরিক অভ্যুত্থানকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সমর্থন করে না। তাই নিঃসন্দেহে তুরস্কের রাজনীতিতে পরিবর্তন আসছে বলেই মনে হয়। তাই বলে দেশটি ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে না। মিসরের অবস্থানও ঠিক তেমনি। মুসলিম ব্রাদারহুড অত্যন্ত শক্তিশালী দল মিসরে। মিসরে ওশযধিহ গড়াবসবহঃ মূলত মুসলিম ব্রাদারহুডেরই সৃষ্টি। দলটি নিষিদ্ধ থাকায় তারা এ নামে কাজ করছে। এর নেতা সাইদ এল কাতাতনি তুরস্কের এরদোগান বা গুলের ভূমিকা পালন করতে পারেন মিসরে। তবে এখন দেখার বিষয় সেনাবাহিনী কতটুকু ‘কমিটেড’। আদৌ তারা ৬ মাসের মাথায় নির্বাচন দেবে—আমি পুরোপুরি তাতে বিশ্বাস রাখতে পারছি না। যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, তাহলে ওশযধিহ গড়াবসবহঃ-কে ঠেকানো যাবে না। মিসরের ঋধপবনড়ড়শ আন্দোলনেও Ikhwan Movement-এর তরুণ কর্মীরা সংগঠনের নির্দেশেই অংশ নিয়েছিল। এখন দেখার পালা মিসরে পরিবর্তনটা কীভাবে আসে।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
0 comments:
Post a Comment