রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক তেমন একটা নেই। শিক্ষকতা জীবনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব একটা যাইনি, দু’বার কিংবা তিনবার গিয়েছি। কিন্তু ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বেশ কিছু প্রিয় শিক্ষক সহকর্মী রয়েছেন। বেশ ক’জন তরুণ শিক্ষক রয়েছেন, যারা আমাকে ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য মহোদয়কে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য থাকাকালীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল, আমি ওই তদন্ত কমিটির সদস্য ছিলাম। একপর্যায়ে তদন্ত কমিটিতে আমি না থাকতে ইচ্ছা পোষণ করি। সেদিন অধ্যাপক এম আবদুস সোবহান ইউজিসির চেয়ারম্যানকে চিঠি লিখে আমার প্রতি তার আস্থার কথা জানিয়েছিলেন। আমার প্রতি তার আস্থা আমাকে অবাক করেছিল। তার প্রতি আমার বিশ্বাস ও ভালোবাসা বেড়ে গিয়েছিল। অধ্যাপক সোবহান ওই সময় শিক্ষকদের একটা অংশের নেতা। ‘প্রগতিশীল, বামপন্থী ও আওয়ামী পন্থী’ শিক্ষকদের নেতা হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন। তার ‘আন্দোলন’ ছিল বিএনপির আমলে নিয়োগ পাওয়া ভিসিদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ ছিল ‘অতিরিক্ত শিক্ষক ও কর্মকর্তা’ নিয়োগের। এই অভিযোগ তুলে তিনি সেখানে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তার সেই ‘আন্দোলন’-এর পরিপ্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ইউজিসি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল।
‘অতিরিক্ত শিক্ষক তথা কর্মচারী’ নিয়োগের অভিযোগে(?) অধ্যাপক সোবহান যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, সেদিন একটা ‘যুক্তি’ ছিল বটে, কিন্তু মহাজোট সরকারের আমলে তিনি যখন নিজে ভিসি হলেন, তখন তিনি নিজেই অতিরিক্ত শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ দেবেন, সেটা নিশ্চয়ই কেউ প্রত্যাশা করেনি। তিনি নিজেই এখন অভিযুক্ত হলেন অতিরিক্ত শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগের ব্যাপারে। এখন তার বিচার কে করবে? ইউজিসি কি একটা তদন্ত কমিটি করে অভিযোগগুলো তদন্ত করে দেখবে? গত ২ এপ্রিল দৈনিক আমার দেশ-এ প্রকাশিত সংবাদটি পাঠ করে আমার মনে হয়েছে, শুধু দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগের জন্যই উপাচার্য মহোদয়দের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অধ্যাপক সোবহান নিজে আন্দোলন করলেন যে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে, সেই একই অভিযোগে আজ তিনি অভিযুক্ত। শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয় আইনও তিনি ভঙ্গ করেছেন একাধিকবার। প্রথম দৃষ্টান্ত—এগ্রোনমি অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন বিভাগের সভাপতি নিয়োগ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৭৩ অনুযায়ী নির্দিষ্ট করে বলা আছে কে বিভাগের পরবর্তী সভাপতি হবেন। এখানে উপাচার্য মহোদয়ের চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। ‘শিক্ষক নেতা’ হিসেবে সোবহান সাহেবের এটা অজানা নয়। বিশ্ববিদ্যালয় কোনো ব্যক্তির ‘নিজস্ব সম্পত্তি’ নয় যে, তিনি যা ইচ্ছে তাই করবেন। সোবহান সাহেব তাই করলেন। সিনিয়রকে বাদ দিয়ে জুনিয়রকে সভাপতি করলেন। এটা নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধ। এই অপরাধে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় অযোগ্য বিবেচিত হতে পারেন। দৃষ্টান্ত দুই—নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগের সভাপতি নিয়োগ। যাকে সভাপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, তিনি তো ওই বিভাগের শিক্ষক নন। অধ্যাপক মলয় কুমার ভৌমিক একজন নাট্যকার বটে, কিন্তু তিনি তো ওই বিভাগের শিক্ষক নন। তিনি তো ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক। ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক কী করে ও কোন আইন বলে নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগের সভাপতি হন? অধ্যাপক ভৌমিক আওয়ামী ঘরানার শিক্ষক। নাটক লেখেন বটে, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তার নেই। দলবাজির রাজনীতিতে ভিসি মহোদয় তাকে চাইতে পারেন। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করলেন কোন বিবেচনায়? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কি আমরা প্রাথমিক বিদ্যালয় বানিয়ে ফেললাম? যিনি অংক শেখান, তিনি বাংলাও পড়ান! বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেও তাই আমরা দেখব? এটা কি শিক্ষার মানোন্নয়নের কথা বলে? অধ্যাপক ভৌমিক শেষ পর্যন্ত ৪টি শর্ত সাপেক্ষে পদত্যাগ করেছেন। তিনি ওই বিভাগের শিক্ষক নন। বিভাগের ১৯ জন শিক্ষকের মাঝে ১৩ জন শিক্ষক যখন তার বিরুদ্ধে অনাস্থা আনেন, তখন তো অনেক আগেই পদত্যাগ করে তার নিজ বিভাগে চলে যাওয়া উচিত ছিল। তিনি তা করলে বড় ধরনের সঙ্কট বিশ্ববিদ্যালয় এড়াতে পারত। তবে বিভাগীয় সভাপতির কক্ষে তালা লাগানোটা ঠিক হয়নি। এটা নিঃসন্দেহে এক ধরনের প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদ অন্যভাবেও করা যেত। দৃষ্টান্ত তিন— নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন যিনি, তিনি সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও ডিন। এর অর্থ কী? নৃ-বিজ্ঞান বিভাগে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করার মত কোনো সিনিয়র শিক্ষক ওই বিভাগে নেই? যদি থেকে থাকে তাহলে অন্য বিভাগের শিক্ষককে এনে (সমাজ বিজ্ঞান) নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি বানানো হলো কেন?
এই তিনটি ‘কেন’র জবাব আমার কাছে আছে। সোবহান সাহেব হয়তো এটা স্বীকার করতে চাইবেন না। কিন্তু এটাই বাস্তব। বিভাগের শিক্ষক নিয়োগে বিভাগীয় সভাপতিরা একটি ভূমিকা পালন করেন। দলীয় লোকদের নিয়োগ দিতে চাইলে বিভাগের সভাপতির সম্মতি প্রয়োজন। তাই উপাচার্য মহোদয়রা ঠিক একাজটিই করেন। আইন ভঙ্গ করে অন্য ডিসিপ্লিনের শিক্ষক এনে বিভাগীয় সভাপতি বানান, যাতে করে দলীয় লোকদের নিয়োগ দিতে সহজ হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অনেক পুরনো এবং ঐতিহ্যমণ্ডিত। এরই মধ্যে ৩০টি বিভাগে বিজ্ঞাপিত ১১০টি পদের বিপরীতে ১৯৩ জন শিক্ষককে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রায় ৪০০ শিক্ষক নিয়োগের ‘এক মহাপরিকল্পনা’ নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয় এগিয়ে যাচ্ছেন বলে পত্রিকাগুলো আমাদের জানাচ্ছে। এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে কোনো কোনো বিভাগে যে অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে, সে ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রাক অনুমতি নেয়া হয়েছিল কীনা! মঞ্জুরি কমিশনের আইন অনুযায়ী অনুমতি নিতে বিশ্ববিদ্যালয় বাধ্য। যদি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অনুমতি না নিয়ে থাকেন, তাহলে তিনি আইন ভঙ্গ করেছেন। এ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি অবৈধ হয়ে যাবে। মঞ্জুরি কমিশনকে আরও শক্ত হওয়ার আমি আহ্বান জানাই। মঞ্জুরি কমিশন শুধু টাকা বরাদ্দ করবে, তা তো হতে পারে না। অতীতে মঞ্জুরি কমিশন চিঠি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে। এবার তার ব্যত্যয় ঘটলো কেন? নাকি সর্ষের মধ্যেই ভূত আছে! আরও একটি ঘটনায় আমি লজ্জিত ও দুঃখিত। মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক আতফুল হাই শিবলী শিক্ষক হিসেবে অবসরগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার চাকরির মেয়াদ এক বছর বৃদ্ধি করেছে। এটা তো অবৈধ। অধ্যাপক শিবলী এতে সম্মতি দেন কীভাবে? নাকি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের অপকর্ম ঢাকতে অধ্যাপক শিবলীকে ব্যবহার করছেন! বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর এবং এর তদন্ত হওয়া উচিত।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি এখন সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর। তার প্রশাসনের পক্ষে এতগুলো পাবলিক ও সেই সঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেখভাল করা সম্ভব নয়। সেই জনবলও নেই। এ ক্ষেত্রে সংবাদপত্রগুলো ‘সহযোগী শক্তি’ হিসেবে কাজ করতে পারে। সংবাদপত্রগুলোকে ‘বন্ধু’ ভেবে প্রকাশিত সংবাদগুলোকে বিবেচনায় নেয়া উচিত। মহামান্য রাষ্ট্রপতি বারবার শিক্ষার মানোন্নয়নের কথা বলছেন এবং তা পত্র-পত্রিকায় ছাপাও হচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্রপতির এ ধরনের বক্তব্য শুধু কাগজে-কলমে থাকবে কেন? কেন দলীয়ভাবে শিক্ষক নিয়োগ হবে? কেন অন্য বিভাগের শিক্ষক এনে বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হবে? কেন ইউজিসির এক সদস্য ‘তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে’ চাকরির মেয়াদ আরও এক বছর বাড়িয়ে নেবেন? এসব ‘কেন’র জবাব থাকা প্রয়োজন। আমরা একটা মেধাশূন্য জাতিতে পরিণত হতে যাচ্ছি। তরুণ শিক্ষকরা, যারা পরবর্তী প্রজন্মের নেতৃত্ব দেবেন, তাদের মধ্যে শিক্ষকসুলভ মানসিকতা নেই, সিনিয়রদের শ্রদ্ধা করার মানসিকতা নেই। যাদের নামে থানায় মামলা হয়েছে, জিডি হয়েছে, তাদের আমরা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছি, মায় তাদের স্থায়ী পর্যন্ত করেছি। উচ্চ শিক্ষাকে আমরা প্রশ্নবিদ্ধ করেছি। দলীয়ভাবে শিক্ষক নিয়োগ আর যাই হোক, শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য সহায়ক নয়। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে উপাচার্য মহোদয়রা এই কাজটি করছেন। যেখানে হাজার হাজার বাংলাদেশী কর্মী বিদেশ থেকে দেশে ফিরে আসছেন, তাদের জন্য স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা জরুরি। জরুরি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা, বিদ্যুতের ঘাটতি মেটান। এ জন্য দরকার বিনিয়োগ, দরকার সরকারি অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি করা। তা না করে আমরা অতিরিক্ত শিক্ষক তথা কর্মচারী নিয়োগ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পরিণত করেছি কর্মসংস্থানের একটা জায়গা হিসেবে। এক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই বাজেট ঘাটতি ২১ কোটি টাকা। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা একই। অতিরিক্ত শিক্ষক আর কর্মচারীর ভারে আজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভেঙে পড়ার উপক্রম। তাই মাননীয় চ্যান্সেলর মহোদয়ের একটি বড় ভূমিকা আমি আশা করছি। গত দু’বছরে যেসব শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ হয়েছে, তা রিভিউ হওয়া বাঞ্ছনীয়। মাননীয় চ্যান্সেলর নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে একটি রিভিউ কমিটি গঠন করতে পারেন। মঞ্জুরি কমিশনকে দিয়ে এই কাজটি হবে না। কেননা সেখানে দলীয়ভাবে নিয়োগপ্রাপ্তরা কখনোই দলীয়ভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ভাইস চ্যান্সেলরদের বিরুদ্ধে যাবেন না। মাহামান্য রাষ্ট্রপতি এই কাজটি করলে আরও প্রশংসিত হবেন। অতীতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত তার একটি সিদ্ধান্ত প্রশংসিত হয়েছিল। ইদানীং রাজশাহী, রংপুর, জাহাঙ্গীরনগর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে যেসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তা উচ্চ শিক্ষার জন্য কোনো আশার কথা বলে না। তাই অতি দ্রুত যদি এই প্রবণতা বন্ধ করা না যায়, তাহলে আমরা এক মেধাশূন্য জাতিতে পরিণত হব। সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এখনই।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
‘অতিরিক্ত শিক্ষক তথা কর্মচারী’ নিয়োগের অভিযোগে(?) অধ্যাপক সোবহান যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, সেদিন একটা ‘যুক্তি’ ছিল বটে, কিন্তু মহাজোট সরকারের আমলে তিনি যখন নিজে ভিসি হলেন, তখন তিনি নিজেই অতিরিক্ত শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ দেবেন, সেটা নিশ্চয়ই কেউ প্রত্যাশা করেনি। তিনি নিজেই এখন অভিযুক্ত হলেন অতিরিক্ত শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগের ব্যাপারে। এখন তার বিচার কে করবে? ইউজিসি কি একটা তদন্ত কমিটি করে অভিযোগগুলো তদন্ত করে দেখবে? গত ২ এপ্রিল দৈনিক আমার দেশ-এ প্রকাশিত সংবাদটি পাঠ করে আমার মনে হয়েছে, শুধু দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগের জন্যই উপাচার্য মহোদয়দের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অধ্যাপক সোবহান নিজে আন্দোলন করলেন যে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে, সেই একই অভিযোগে আজ তিনি অভিযুক্ত। শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয় আইনও তিনি ভঙ্গ করেছেন একাধিকবার। প্রথম দৃষ্টান্ত—এগ্রোনমি অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন বিভাগের সভাপতি নিয়োগ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৭৩ অনুযায়ী নির্দিষ্ট করে বলা আছে কে বিভাগের পরবর্তী সভাপতি হবেন। এখানে উপাচার্য মহোদয়ের চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। ‘শিক্ষক নেতা’ হিসেবে সোবহান সাহেবের এটা অজানা নয়। বিশ্ববিদ্যালয় কোনো ব্যক্তির ‘নিজস্ব সম্পত্তি’ নয় যে, তিনি যা ইচ্ছে তাই করবেন। সোবহান সাহেব তাই করলেন। সিনিয়রকে বাদ দিয়ে জুনিয়রকে সভাপতি করলেন। এটা নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধ। এই অপরাধে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় অযোগ্য বিবেচিত হতে পারেন। দৃষ্টান্ত দুই—নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগের সভাপতি নিয়োগ। যাকে সভাপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, তিনি তো ওই বিভাগের শিক্ষক নন। অধ্যাপক মলয় কুমার ভৌমিক একজন নাট্যকার বটে, কিন্তু তিনি তো ওই বিভাগের শিক্ষক নন। তিনি তো ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক। ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক কী করে ও কোন আইন বলে নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগের সভাপতি হন? অধ্যাপক ভৌমিক আওয়ামী ঘরানার শিক্ষক। নাটক লেখেন বটে, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তার নেই। দলবাজির রাজনীতিতে ভিসি মহোদয় তাকে চাইতে পারেন। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করলেন কোন বিবেচনায়? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কি আমরা প্রাথমিক বিদ্যালয় বানিয়ে ফেললাম? যিনি অংক শেখান, তিনি বাংলাও পড়ান! বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেও তাই আমরা দেখব? এটা কি শিক্ষার মানোন্নয়নের কথা বলে? অধ্যাপক ভৌমিক শেষ পর্যন্ত ৪টি শর্ত সাপেক্ষে পদত্যাগ করেছেন। তিনি ওই বিভাগের শিক্ষক নন। বিভাগের ১৯ জন শিক্ষকের মাঝে ১৩ জন শিক্ষক যখন তার বিরুদ্ধে অনাস্থা আনেন, তখন তো অনেক আগেই পদত্যাগ করে তার নিজ বিভাগে চলে যাওয়া উচিত ছিল। তিনি তা করলে বড় ধরনের সঙ্কট বিশ্ববিদ্যালয় এড়াতে পারত। তবে বিভাগীয় সভাপতির কক্ষে তালা লাগানোটা ঠিক হয়নি। এটা নিঃসন্দেহে এক ধরনের প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদ অন্যভাবেও করা যেত। দৃষ্টান্ত তিন— নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন যিনি, তিনি সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও ডিন। এর অর্থ কী? নৃ-বিজ্ঞান বিভাগে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করার মত কোনো সিনিয়র শিক্ষক ওই বিভাগে নেই? যদি থেকে থাকে তাহলে অন্য বিভাগের শিক্ষককে এনে (সমাজ বিজ্ঞান) নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি বানানো হলো কেন?
এই তিনটি ‘কেন’র জবাব আমার কাছে আছে। সোবহান সাহেব হয়তো এটা স্বীকার করতে চাইবেন না। কিন্তু এটাই বাস্তব। বিভাগের শিক্ষক নিয়োগে বিভাগীয় সভাপতিরা একটি ভূমিকা পালন করেন। দলীয় লোকদের নিয়োগ দিতে চাইলে বিভাগের সভাপতির সম্মতি প্রয়োজন। তাই উপাচার্য মহোদয়রা ঠিক একাজটিই করেন। আইন ভঙ্গ করে অন্য ডিসিপ্লিনের শিক্ষক এনে বিভাগীয় সভাপতি বানান, যাতে করে দলীয় লোকদের নিয়োগ দিতে সহজ হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অনেক পুরনো এবং ঐতিহ্যমণ্ডিত। এরই মধ্যে ৩০টি বিভাগে বিজ্ঞাপিত ১১০টি পদের বিপরীতে ১৯৩ জন শিক্ষককে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রায় ৪০০ শিক্ষক নিয়োগের ‘এক মহাপরিকল্পনা’ নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয় এগিয়ে যাচ্ছেন বলে পত্রিকাগুলো আমাদের জানাচ্ছে। এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে কোনো কোনো বিভাগে যে অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে, সে ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রাক অনুমতি নেয়া হয়েছিল কীনা! মঞ্জুরি কমিশনের আইন অনুযায়ী অনুমতি নিতে বিশ্ববিদ্যালয় বাধ্য। যদি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অনুমতি না নিয়ে থাকেন, তাহলে তিনি আইন ভঙ্গ করেছেন। এ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি অবৈধ হয়ে যাবে। মঞ্জুরি কমিশনকে আরও শক্ত হওয়ার আমি আহ্বান জানাই। মঞ্জুরি কমিশন শুধু টাকা বরাদ্দ করবে, তা তো হতে পারে না। অতীতে মঞ্জুরি কমিশন চিঠি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে। এবার তার ব্যত্যয় ঘটলো কেন? নাকি সর্ষের মধ্যেই ভূত আছে! আরও একটি ঘটনায় আমি লজ্জিত ও দুঃখিত। মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক আতফুল হাই শিবলী শিক্ষক হিসেবে অবসরগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার চাকরির মেয়াদ এক বছর বৃদ্ধি করেছে। এটা তো অবৈধ। অধ্যাপক শিবলী এতে সম্মতি দেন কীভাবে? নাকি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের অপকর্ম ঢাকতে অধ্যাপক শিবলীকে ব্যবহার করছেন! বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর এবং এর তদন্ত হওয়া উচিত।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি এখন সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর। তার প্রশাসনের পক্ষে এতগুলো পাবলিক ও সেই সঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেখভাল করা সম্ভব নয়। সেই জনবলও নেই। এ ক্ষেত্রে সংবাদপত্রগুলো ‘সহযোগী শক্তি’ হিসেবে কাজ করতে পারে। সংবাদপত্রগুলোকে ‘বন্ধু’ ভেবে প্রকাশিত সংবাদগুলোকে বিবেচনায় নেয়া উচিত। মহামান্য রাষ্ট্রপতি বারবার শিক্ষার মানোন্নয়নের কথা বলছেন এবং তা পত্র-পত্রিকায় ছাপাও হচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্রপতির এ ধরনের বক্তব্য শুধু কাগজে-কলমে থাকবে কেন? কেন দলীয়ভাবে শিক্ষক নিয়োগ হবে? কেন অন্য বিভাগের শিক্ষক এনে বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হবে? কেন ইউজিসির এক সদস্য ‘তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে’ চাকরির মেয়াদ আরও এক বছর বাড়িয়ে নেবেন? এসব ‘কেন’র জবাব থাকা প্রয়োজন। আমরা একটা মেধাশূন্য জাতিতে পরিণত হতে যাচ্ছি। তরুণ শিক্ষকরা, যারা পরবর্তী প্রজন্মের নেতৃত্ব দেবেন, তাদের মধ্যে শিক্ষকসুলভ মানসিকতা নেই, সিনিয়রদের শ্রদ্ধা করার মানসিকতা নেই। যাদের নামে থানায় মামলা হয়েছে, জিডি হয়েছে, তাদের আমরা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছি, মায় তাদের স্থায়ী পর্যন্ত করেছি। উচ্চ শিক্ষাকে আমরা প্রশ্নবিদ্ধ করেছি। দলীয়ভাবে শিক্ষক নিয়োগ আর যাই হোক, শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য সহায়ক নয়। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে উপাচার্য মহোদয়রা এই কাজটি করছেন। যেখানে হাজার হাজার বাংলাদেশী কর্মী বিদেশ থেকে দেশে ফিরে আসছেন, তাদের জন্য স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা জরুরি। জরুরি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা, বিদ্যুতের ঘাটতি মেটান। এ জন্য দরকার বিনিয়োগ, দরকার সরকারি অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি করা। তা না করে আমরা অতিরিক্ত শিক্ষক তথা কর্মচারী নিয়োগ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পরিণত করেছি কর্মসংস্থানের একটা জায়গা হিসেবে। এক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই বাজেট ঘাটতি ২১ কোটি টাকা। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা একই। অতিরিক্ত শিক্ষক আর কর্মচারীর ভারে আজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভেঙে পড়ার উপক্রম। তাই মাননীয় চ্যান্সেলর মহোদয়ের একটি বড় ভূমিকা আমি আশা করছি। গত দু’বছরে যেসব শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ হয়েছে, তা রিভিউ হওয়া বাঞ্ছনীয়। মাননীয় চ্যান্সেলর নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে একটি রিভিউ কমিটি গঠন করতে পারেন। মঞ্জুরি কমিশনকে দিয়ে এই কাজটি হবে না। কেননা সেখানে দলীয়ভাবে নিয়োগপ্রাপ্তরা কখনোই দলীয়ভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ভাইস চ্যান্সেলরদের বিরুদ্ধে যাবেন না। মাহামান্য রাষ্ট্রপতি এই কাজটি করলে আরও প্রশংসিত হবেন। অতীতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত তার একটি সিদ্ধান্ত প্রশংসিত হয়েছিল। ইদানীং রাজশাহী, রংপুর, জাহাঙ্গীরনগর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে যেসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তা উচ্চ শিক্ষার জন্য কোনো আশার কথা বলে না। তাই অতি দ্রুত যদি এই প্রবণতা বন্ধ করা না যায়, তাহলে আমরা এক মেধাশূন্য জাতিতে পরিণত হব। সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এখনই।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
0 comments:
Post a Comment