রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

নতুন বিমানবন্দর প্রয়োজন তবেঃ

প্রস্তাবিত আড়িয়ল বিলে একটি বিমানবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা বাতিল করা হয়েছে। সে খবর অনেক পুরনো। এ নিয়ে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে, যা হওয়া কোনমতেই উচিত ছিল না। তবে একটি বিমানবন্দরের প্রয়োজন রয়েছে। কোথায় হবে, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। একুশ শতকে এ প্রয়োজনটাকে আমি অস্বীকার করতে পারি না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পদ্মার ওপারে নতুন বিমানবন্দরটি নির্মাণ করা হবে। কোথায় হবে, সে সম্পর্কে তিনি সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলেননি। আমি বিশ্বাস করি, তিনি একটি বিশেষজ্ঞ কমিটিকে এ দায়িত্বটি দেবেন। তারা যাচাই-বাছাই করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি রিপোর্ট দেবেন। তবে মনে রাখতে হবে
বিমানবন্দরটি যেখানেই নির্মাণ করা হোক না কেন, তার সঙ্গে রাজধানী ঢাকার যোগাযোগ যেন হয় সহজ এবং কোন যানজটের কারণে মানুষকে যেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় থাকতে না হয়। আমাদের বাণিজ্যিক কেন্দ্রও বলতে হয় ঢাকা। ঢাকাকে কেন্দ্র করেই সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। সুতরাং ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগটা হতে হবে স্বচ্ছন্দ। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় বিদেশী নাগরিক তথা ভিআইপিরা ঢাকাতেই আসবেন। প্রস্তাবিত বিমানবন্দর থেকে তাদের ঢাকায় আসতে দীর্ঘ সময় যাতে না লাগে, সে বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমিও একমত- পদ্মার ওপারে নতুন বিমানবন্দর নির্মিত হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে কতগুলো বিষয় বিবেচনায় নেয়ার অনুরোধ করছি। যুক্তি হিসেবে একটি নতুন বিমানবন্দরের পক্ষে আমি।

কেননা বাংলাদেশকে এখন চিন্তা করতে হবে ২০২৫ অথবা ২০৩০ সাল সামনে রেখে। শাহজালাল বিমানবন্দর হয়তো পুরোটা ব্যবহার হচ্ছে না। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বিমানবন্দরের (শাহজালাল) আশপাশে প্রচুর বাড়িঘর হয়ে গেছে। উত্তরা বা নিকুঞ্জ এখন ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। প্রচুর লোক এখানে বসবাস করে। উপরন্তু এখানে প্রচুর ছয় ও সাততলা ভবন রয়েছে। এটা নিয়ে বিমান কোম্পানিগুলোর বিরোধিতা ও আপত্তি অনেক দিনের। এখন ২০১১ সালেই শাহজালাল বিমানবন্দরের আশপাশের এলাকা ঘনবসতিপূর্ণ। ২০২০ কিংবা ২০২৫ সালের পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে, তা সহজেই অনুমেয়। এখন তেজগাঁও বিমানবন্দর যেমন অব্যবহৃত, ঠিক তেমনি আগামী ১০ বছরের মধ্যে শাহজালাল বিমানবন্দরও পরিত্যক্ত হবে। তখন? এখন থেকে যদি পরিকল্পনা করা না হয়, তাহলে তো পরবর্তী সময়ে একটি বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হবে বাংলাদেশকে। দ্বিতীয় আরেকটি জিনিস আমাদের মনে রাখতে হবে, পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণাঞ্চলের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যাবে। বিদেশে কর্মীর চাহিদা থাকবেই। এখনই পরিসংখ্যান বলে, বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশীরা যে টাকা পাঠায়, তা অন্যান্য খাত থেকে উপার্জিত অর্থের চেয়ে বেশি। এক্ষেত্রে পদ্মার ওপারে নতুন বিমানবন্দর হলে তা দক্ষিণাঞ্চলের তরুণ প্রজন্মের জন্য একটি সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে। এ অঞ্চলের মানুষ তখন খুব সহজেই বিদেশে যেতে পারবে। অনেকে যশোর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নত করার প্রস্তাব করেছেন। এটা সম্ভব নয় এ কারণেই যে, যশোর হচ্ছে সীমান্ত শহর। সাধারণত সীমান্তে কোন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ করা হয় না।

এখন পদ্মার ওপারে কোথায় বিমানবন্দরটি হবে, আমি ঠিক জানি না। আমি এর জন্য যোগ্য ব্যক্তিও নই। তবে একজন সমাজ বিশেষজ্ঞ হিসেবে কতগুলো কথা বলতে পারি। এক. বিমানবন্দর যেখানেই নির্মাণ করা হোক না কেন, তাতে যেন কৃষি জমির কোন ক্ষতি না হয়। দেশে মানুষ বাড়ছে। কিন্তু দিনের পর দিন কৃষি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। একটি আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর নির্মাণ করতে ন্যূনতম ২০ থেকে ২৫ হাজার একর জমি প্রয়োজন। এই জমি আমরা কোথায় পাব? এমনিতেই লোকসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় কৃষি জমির পরিমাণ অনেক কমে গেছে। এতে করে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। প্রায় ৪০ বছর আগে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বিজ্ঞানী পল এরলিচ একটি বই লিখেছিলেন- ‘পপুলেশন বোম্ব’। বিশ্বে জনবিস্ফোরণের ভয়াবহতার কথা তিনি উল্লেখ করেছিলেন। বাংলাদেশের পরিস্থিতি অনেকটা তেমনি। একটি ছোট্ট দেশ, কিন্তু জনসংখ্যা প্রচুর। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্যের চাহিদা মেটানো সহজ কাজ নয়।

বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসের (বিবিএস) ২০০৬ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ৮ দশমিক ৪৪ মিলিয়ন হেক্টর। আর নিট আবাদি জমি হচ্ছে ৭ দশমিক ৮০৯ মিলিয়ন হেক্টর। অথচ জনসংখ্যা বাড়ছে। ফলে আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যায় প্রতি বছর নতুন করে যোগ হচ্ছে ৩০ লাখ মানুষ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এক দশমিক পাঁচ ভাগ। বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন ১৬ কোটির উপরে। গবেষকরা বলছেন, বর্তমান ধারা চলতে থাকলে ২০৫১ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা দাঁড়াবে ২৮ কোটির ওপরে। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্যের জোগান দেয়া চাট্টিখানি কথা নয়। এর ওপর যদি চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যায়, তাহলে তা খাদ্য সংকটকে আরও জটিল করবে। এক হিসাবে জানা গেছে, অপরিকল্পিতভাবে শিল্প-কারখানা ও রাস্তাঘাট নির্মাণের কারণে প্রতি বছর ৮২ হাজার হেক্টর আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। গড়ে বছরে কমছে মোট আবাদি জমির ১ শতাংশ। বিপরীতে মানুষের খাদ্য চাহিদা বাড়ছে ১ দশমিক ৪ শতাংশ হারে। ২০২০ সালের দিকে এদেশের লোকসংখ্যা যখন ২০ কোটি ছুঁইছুঁই করবে, তখন খাদ্য চাহিদা প্রায় ২৫ ভাগ বাড়বে। কিন্তু জমি বাড়বে না। এ অবস্থায় আবাদি জমি কমতে থাকলে বাংলাদেশকে প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্যের জোগান দিতে কঠিন এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। গেল বছর ১৫ কোটি জনগোষ্ঠীকে বিবেচনায় নিয়ে একটি খাদ্য চাহিদার হিসাব করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ১৫ কোটি লোকসংখ্যার জন্য খাদ্য চাহিদা প্রায় আড়াই কোটি মেট্রিক টন। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ২০২৫ সালে খাদ্যের চাহিদা হবে প্রায় সোয়া ৩ কোটি মেট্রিক টন। তখন আবাদি জমি কমে গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় ৬৯ লাখ হেক্টর। খাদ্য চাহিদা মেটাতে হেক্টরপ্রতি বছরে গড়ে ফসল ফলাতে হবে ৪.৬ মেট্রিক টন। কাজটি খুব সহজ নয়। এমনি এক পরিস্থিতিতে ২০ থেকে ২৫ হাজার একর জমি যদি নষ্ট হয়ে যায় (বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য), তাহলে তা তো খাদ্য উৎপাদনের ওপর কিছুটা ‘চাপ’ সৃষ্টি করবেই। নতুন বিমানবন্দর নির্মাণের সময় বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। একদিকে নতুন একটি বিমানবন্দর যেমন প্রয়োজন, ঠিক তেমনি কৃষি জমি যাতে নষ্ট না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখাও জরুরি।

দ্বিতীয়ত, প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার মেগা প্রজেক্টে সরকার একা কেন খরচ বহন করবে? সরকার বিদেশী পার্টনার খুঁজতে পারে। বর্তমান সময়ে এটা সম্ভব। এতে করে সরকারের ওপর থেকে ‘চাপ’ কিছুটা কমবে। ফলে সরকার কর্মসংস্থানে এই টাকা বিনিয়োগ করতে পারবে। মনে রাখতে হবে, আগামী দিনে কর্মসংস্থান একটি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেবে। তরুণদের জন্য যদি কাজের ক্ষেত্র সৃষ্টি করা না যায়, তাহলে নানা সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।

তৃতীয়ত, এই মুহূর্তে সরকারের এটা প্রায়োরিটি কিনা, তা বিবেচনায় নিতে হবে। সরকারের কাছে এখনও আরও প্রায় ৩ বছর সময় রয়েছে। যেসব ওয়াদা আওয়ামী লীগ করেছিল, সাধারণ মানুষ চাইবে সরকার সেসব ওয়াদা পূরণ করুক। বিদ্যুৎ একটা বড় সমস্যা। গ্রীষ্ম শুরু হতে না হতেই লোডশেডিং শুরু হয়েছে। চলতি গ্রীষ্মে লোডশেডিং গিয়ে দাঁড়াবে ২ হাজার মেগাওয়াটে।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে (২০০৮) বলা হয়েছিল, ২০১১ সালে ৫ হাজার মেগাওয়াট, ২০১৩ সালের মধ্যে ৭ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০২১ সালে ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে উৎপাদন বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। এটা হচ্ছে সরকারের প্রথম অগ্রাধিকার। বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের জন্য দরকার প্রচুর অর্থের। সরকারের দ্বিতীয় অগ্রাধিকার হওয়া উচিত কর্মসংস্থান। প্রতি বছর দেশে সর্বোচ্চ ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব। অথচ দেশে বর্তমান ২ কোটি ৭০ লাখ লোক বেকার। প্রতি বছর ২০ লাখ মানুষ যুক্ত হচ্ছে কর্মবাজারে। ফলে বেকার বাড়ছে। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য যদি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা না যায়, তাহলে তা সরকারের জন্য কোন শুভ সংবাদ বয়ে আনবে না। তাই অগ্রাধিকার দিতে হবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি। বিদেশে কর্মী প্রেরণের ব্যাপারে খুব বড় ধরনের অগ্রগতি হয়েছে, তা বলা যাবে না। মধ্যপ্রাচ্যে মানবসম্পদ রফতানির ক্ষেত্রেও কিছু জটিলতা রয়ে গেছে। সৌদি আরবে বাজার এখনও উন্মুক্ত নয়। পররাষ্ট্রনীতিতে এ দিকটির দিকে গুরুত্ব দিতে হবে বেশি। বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। জাতিসংঘ এমনটাই আশংকা করছে। বাংলাদেশ খাদ্য সংকটের ঝুঁকিতে আছে। খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। এজন্য কৃষকদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। এজন্যও অর্থের প্রয়োজন। প্রতিশ্রুত বৈদেশিক সহায়তা আসেনি। তারপরও বাড়ছে প্রকল্পের সংখ্যা। কৃচ্ছ্রসাধন জরুরি। অপ্রয়োজনীয় খাতে বরাদ্দ কমানোও প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জনবল বৃদ্ধি পেয়েছে আশংকাজনকভাবে। জনবল বৃদ্ধি শিক্ষার মানোন্নয়নে সহায়ক নয়।

আড়িয়ল বিলের মতো মেগা প্রকল্প বাতিল করে সরকারপ্রধান তার সদিচ্ছা প্রমাণ করলেন। জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন। শুধু বলব, প্রকল্প নেয়া হোক; কিন্তু তা যেন নেয়া হয় জনস্বার্থে এবং তাতে করে সাধারণ মানুষের কোন ক্ষতি হবে না- এটা যেন বিবেচনায় রাখা হয়।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

0 comments:

Post a Comment