সারা বিশ্ববাসীর দৃষ্টি এখন মিসরের দিকে। ঐতিহ্যমন্ডিত এই দেশটিতে গণবিস্ফোরণ ঘটেছে। অতীতে মিসরবাসী এ ধরনের গণবিস্ফোরণ কখনও প্রত্যক্ষ করেনি। এমনকি ১৯৭৯ সালে মিসরের প্রেসিডেন্ট প্রয়াত আনোয়ার সাদাত যখন সারা আরব জাহানের বিরোধিতার মুখে ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন, তখন ওই চুক্তি নিয়ে মিসরবাসীর বিরোধিতা থাকলেও তখন এ ধরনের গণবিস্ফোরণ ঘটেনি। কিন্তু আজ মানুষ দেখছে এক ভিন্ন চিত্র। দিনের পর দিন কায়রোর তাহরির স্কোয়ারে হাজার হাজার মানুষ কারফিউ উপেক্ষা করে অবস্থান করছেন। তাদের দাবি একটাই প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের পদত্যাগ। দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে হোসনি মোবারক ক্ষমতায়। তিনি বারে বারে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আসছেন। এখানে সংসদ আছে বটে, কিন্তু গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হয়নি। মিসরে রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমনই যে বারে বারে হোসনি মোবারক প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, আর তার দল ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি নির্বাচনে বিজয়ী হয়। ইসলামিক ব্রাদারহুড পার্টি সেখানে নিষিদ্ধ। সংসদে ২০ জন সদস্য রয়েছেন, যারা স্বতন্ত্র সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। তারা নিষিদ্ধ ঘোষিত ইসলামিক ব্রাদারহুড পার্টির সদস্য বলে ধরে নেয়া হয়।
দীর্ঘদিন ধরেই পশ্চিমা বিশ্বে মিসর একটি স্থিতিশীল দেশ হিসেবেই পরিচিত। আরব বিশ্বে বিশেষ করে উত্তর আফ্রিকায় আলজেরিয়ার মত দেশে যেখানে ইসলামিক কট্টরপন্থিরা শক্তি অর্জন করছে এবং আল-কায়দা এসব অঞ্চলে তৎপর সেখানে মিসরে আল-কায়দার তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় না। সেই মিসরে হঠাৎ করে গণবিস্ফোরণ কেন ঘটলো? কেন হোসনি মোবারক এই অসন্তোষকে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন? এটা স্বীকার করতেই হবে মিসরে অসন্তোষ ছিল। সাধারণ মানুষের মাঝে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও ঘৃণা জমেছিল। একদিনের অসন্তোষে এত বড় গণবিস্ফোরণের জন্ম হতে পারে না। কেন এই গণঅসন্তোষ? প্রথমত, তিউনেসিয়ার ঘটনাবলী থেকে মিসরবাসী অনুপ্রাণিত হয়েছেন। সেখান যে গণবিস্ফোরণ ঘটেছিল, তার পরিণতিতে দীর্ঘদিনের শাসক হইন আল আবেদিন বেন আলী দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন। বেন আলী ও তার পরিবার যেমনি বিপুল বিত্ত ও বৈভবের মালিক হয়েছিলেন যেখানে সাধারণ মানুষ ছিল দরিদ্র, মিসরের ঘটনাবলীও ঠিক একই সূত্রে গাঁথা। মিসরে সাম্প্রতিককালে ধনী ও গরীবের মাঝে একটি বড় ব্যবধান তৈরি করেছিল। মিসরে যত বেশী ভিক্ষুক দেখা যায়, অন্যকোন আরব বিশ্বে এত ভিক্ষুক নেই। ঠিক তেমনি মিসরে শত শত কোটিপতির জন্ম হয়েছে, যা উত্তর আফ্রিকার অন্যকোন দেশে নেই। ধনী ও দরিদ্রের এই ব্যবধান মিসরে গণবিস্ফোরকে সম্পন্ন করেছে। দ্বিতীয়ত, মিসরে তরুণ সমাজের একটি বড় অংশই বেকার। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী নিয়ে এরা চাকরি পায় না। সরকার এদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করতে পারেনি। ফলশ্রুতিতে এদের মাঝে যে হতাশার জন্ম হয়েছে, তা থেকে সৃষ্টি হয়েছে গণবিস্ফোরণর। তৃতীয়ত, সনাতন পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তনের কোন সুযোগ মিসরে নেই। একটি গোষ্ঠী বারে বারে জনগণের নাম করে রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিচালনা করছেন। সাধারণ মানুষের সমর্থন এদের প্রতি না থাকলেও, এরাই সকল সুবিধা নিচ্ছেন। এদেরকে দিয়েই গঠিত হচ্ছে সংসদ, মন্ত্রীসভা। সাধারণ মানুষ যে তিমিরে, সেই তিমিরেই থেকে যাচ্ছেন বছরের পর বছর। প্রযুক্তি বিদ্যার উন্নতিতে সারাবিশ্বের উন্নয়ন এখন তাদের সম্মুখে। সেই উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় তারা উৎসাহিত। গণবিস্ফোরণ এটাও একটা কারণ। চতুর্থত, প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক তার দীর্ঘ শাসনামলে নিজেকে একজন স্বৈরশাসক হিসেবেই প্রমাণ করেছেন, যেমনি প্রমাণ করেছিলেন তিউনেসিয়ায় বেন আলী। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের সাথে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে তরুণ সমাজের 'পালস' তিনি বুঝতে পারেননি। তরুণ সমাজ ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ ছিল। এই ক্ষুব্ধতাই তাদেরকে রাজপথে টেনে নিয়ে আসে। পঞ্চমত, মিসরে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ হয়েছিল ১৯৫২ সালে। সেদিন তরুণ অফিসাররা কর্নেল জামাল আব্দুল নাসেরের নেতৃত্বে সামরিক অভু্যত্থানের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল হোসনি মোবারক মিসরে এক ধরনের পরিবারতন্ত্র কায়েম করেছেন। তিনি ভেতরে ভেতরে তার সন্তান জামালকে তৈরি করেছিলেন ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্টের জন্য। মিসরে তথা সারাবিশ্বে এটা জানান হয়েছিল যে জামাল মোবারক বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে সেপ্টেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেপ্রাথর্ী হবেন। ৮২ বছর বয়সে এসে হোসনি মোবারক তার ছেলের কাছেই দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন এরকম আভাসই পাওয়া গিয়েছিল। এটা তো এক ধরনের 'রাজতন্ত্রই'! আর মিসরে ক্ষমতাসীনরা এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছেন, যেখানে হোসনি মোবারক যা চান, তাই হয়। বড় ধরনের এই গণবিস্ফোরণ না ঘটলে হয়ত মিসরবাসী জামাল মোবারককেই পরবতর্ী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে পেত। ষষ্ঠত, এক সময় মিসর জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছে। উন্নয়নশীল বিশ্বের নেতাও ছিল মিসর। নাসের ছিলেন 'ন্যাম' এর প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। 'প্যান ত্রারাবিজম' এর জন্ম দিয়ে আরব জাহানের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছিলেন নাসের। জামাল আব্দুল নাসেরের সেই মিসর শৌর্যে, উন্নতিতে এখন অনেক পেছনে। মিসর এখন আর আরব জাহানকে নেতৃত্ব দিতে পারে না। তরুণ সমাজের মাঝে এ থেকে হতাশা আসতেই পারে। এই হতাশাই তাদেরকে টেনে নিয়ে গেছে রাজপথে। সপ্তম, ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তির পর এতটা বছর পার হয়ে গেছে। ২০১০ সাল পার হওয়া স্বত্ত্বেয় শুধু ইসরাইলের একগুয়েমির কারণে ফিলিস্তিনী সমস্যার সমাধান হয়নি।আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিন আজো মিশর রাজনীতিতে আর্বিভূত হয় নি। ফলশ্রুতিতে হোসনি মুবারকের প্রতি সাধারণ মানুষের একটা বিতৃষ্ণা ও বিদ্বেষ জন্ম হতেই পারে। কেননা ফিলিস্তিনের জনগণের প্রতি সাধারণ মিসরবাসীর একটা সমর্থন সব সময়ই ছিল। এখনও আছে।
হোসনি মোবারক যদি সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশার প্রতি নজর দিতেন, যদি দারিদ্র্য কমানো তথা কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিতেন, সর্বোপরি তরুণ সমাজের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি দৃষ্টি দিতেন, তাহলে আজকের মত পরিস্থিতির সৃষ্টি হোত না। ক্ষমতার অন্ধে তিনি সবকিছু ভুলে গিয়েছিলেন। তিনি চালু করেছিলেন এক ধরনের পরিবারতন্ত্র। দ্রব্যমূল্যের ঊধর্্বগতি সারা বিশ্ব জুড়েই যখন একটি সমস্যা, তখন তিনি এদিকে নজর দেননি। ক্ষমতার মোহ তাকে সব ভুলিয়ে দিয়েছিল। সুতরাং আজকের যে পরিস্থিতি, এর দায়-দায়িত্ব তাঁকেই বহন করতে হবে। কিন্তু যে প্রশ্ন এখন বেশি করে আলোচিত হবে, তা হচ্ছে এরপর কি? কোন্দিকে যাচ্ছে এখন মিসর? মনে রাখতে হবে, মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে মিসরের গুরুত্ব অনেক বেশি। মিসর যদি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে, তাহলে তা মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়াকেই বিঘ্ন ঘটাবে না, বরং পুরো আরব বিশ্বেই এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। গত প্রায় দু'সপ্তাহ ধরে মিসরে যা ঘটে চলছে, তাকে কোনমতেই স্বাভাবিক বলা যাবে না। হোসনি মুবারকের পদত্যাগ ছাড়া কোন বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। সমস্যা হচ্ছে, হোসনি মুবারকের বিকল্প কে? একজন ভাইস প্রেসিডেন্টকে তিনি প্রথমবারের মত নিয়োগ করেছেন। তিনি সাবেক গোয়েন্দা সংস্থা প্রধান। পশ্চিমা বিশ্বে তিনি পরিচিত। কিন্তু বিক্ষোভকারীদের কাছে তিনি গ্রহণযোগ্য নন। সাংবিধানিকভাবে তিনি তার কাছেই ক্ষমতা ছাড়তে পারেন। অন্য কারো কাছে নয়। বিক্ষোভকারীদের কোন নেতা নেই। কোন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বেও এই আন্দোলন পরিচালিত হয়নি। সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা (আইএইও) এল বারাদি নিজেকে গণআন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। পশ্চিমা বিশ্বে তার একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে। কিন্তু তার দল নেই। ইসলামিক ব্রাদারহুড এর মত বড় ইসলামিক দল তাকে সমর্থন করবে, এটা মনে করা ঠিক হবে না। তিনি ইসলামিক জীবন-যাপনও করেন না। থাকেনও না মিসরে, থাকেন ভিয়েনাতে। ব্যক্তি এল বারাদি সর্বমহলে গ্রহণযোগ্যতা পাবেন বলেও মনে হয় না। এপ্রিল ৬ ইয়ুথ মু্যভমেন্ট এই গণবিক্ষোভকে সংগঠিত করেছে। এই সংগঠনটির নেত্রী আসমা মাহফুজও তেমন পরিচিত নন। সেনাবাহিনীর একটি ভূমিকা লক্ষ্য রাখার মত। সেনাবাহিনী স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছে তারা বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে গুলি ছুঁড়বে না। এর অর্থ সেনাবাহিনী একটি 'রাজনৈতিক সমাধানের' উপর গুরুত্ব দিচ্ছে। ইতিমধ্যে হোসনি মোবারক ঊধর্্বতন সেনা কমান্ডারদের সাথে বৈঠক করেছেন। এদের সমর্থন তিনি পুরোপুরিভাবে পেয়েছেন বলে মনে হয় না। উপরন্তু জনতার সাথে সাধারণ সৈনিকের করমর্দনের ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা সেনাবাহিনীর পক্ষেও সেস্নাগান দিয়েছে। এতে করে এটা ধারণা করা স্বাভাবিক যে, আগামীতে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা হবে মুখ্য। এক্ষেত্রে সেনাপ্রধান একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারেন। স্পষ্টতই মিসর এক পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে। সেখানে পরিবর্তন আসতেই হবে। হোসনি মোবারক যদি জোর করে ক্ষমতায় থাকতে চান, তাহলে সেখানে রক্ত ঝরবে। তবে মিসরে ব্যক্তি হোসনি মুবারকের ক্ষমতা ছেড়ে দেয়াই বড় কথা নয়। বড় কথা মিসরের রাজনৈতিক তথা অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার দরকার। কিছু ব্যক্তি তথা গোষ্ঠীর ক্ষমতা করায়াও করার প্রবণতাও বন্ধ করা জরুরী। সত্যিকার অর্থেই সেখানে একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু করা প্রয়োজন, যেখানে বহুদল ও বহুমত থাকবে। এবং সাধারণ মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করবেন। একটি গোষ্ঠী, একটি বিশেষ দলের প্রতি সমর্থন নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা যদি কমানো যায়, তাহলে মিসরে সত্যিকার অর্থেই গণতন্ত্র বিকশিত হবে। সেইসাথে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এনে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করাও জরুরী। ইতিহাস সাক্ষী দেয় শাসকের সাথে সাধারণ মানুষের ব্যবধান যদি তৈরী হয় তাহলে সেই শাসক ক্ষমতায় থাকতে পারেন না। ফরাসী বিপস্নবের প্রাক্কালে (১৭৮৯) রাজা ষোড়শ লুই থাকতে পারেননি। কেননা সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে কৃষকদের সাথে তার ব্যবধান তৈরী হয়েছিল। এই ব্যবধান তৈরী হয়েছিল ২০০৩ সালে জর্জিয়ায়, ২০০৪ সালে ইউক্রেনে, ২০০৫ সালে কিরঘিজস্তানে, আর অতিসম্প্রতি তিউনিসিয়ায়। ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। নেননি হোসনি মোবারকও। মিসরের স্থিতিশীলতার স্বার্থে হোসনি মোবারক যত তাড়াতাড়ি পদত্যাগ করবেন, ততই দেশটির জন্য মঙ্গল।
লেখক: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
দীর্ঘদিন ধরেই পশ্চিমা বিশ্বে মিসর একটি স্থিতিশীল দেশ হিসেবেই পরিচিত। আরব বিশ্বে বিশেষ করে উত্তর আফ্রিকায় আলজেরিয়ার মত দেশে যেখানে ইসলামিক কট্টরপন্থিরা শক্তি অর্জন করছে এবং আল-কায়দা এসব অঞ্চলে তৎপর সেখানে মিসরে আল-কায়দার তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় না। সেই মিসরে হঠাৎ করে গণবিস্ফোরণ কেন ঘটলো? কেন হোসনি মোবারক এই অসন্তোষকে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন? এটা স্বীকার করতেই হবে মিসরে অসন্তোষ ছিল। সাধারণ মানুষের মাঝে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও ঘৃণা জমেছিল। একদিনের অসন্তোষে এত বড় গণবিস্ফোরণের জন্ম হতে পারে না। কেন এই গণঅসন্তোষ? প্রথমত, তিউনেসিয়ার ঘটনাবলী থেকে মিসরবাসী অনুপ্রাণিত হয়েছেন। সেখান যে গণবিস্ফোরণ ঘটেছিল, তার পরিণতিতে দীর্ঘদিনের শাসক হইন আল আবেদিন বেন আলী দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন। বেন আলী ও তার পরিবার যেমনি বিপুল বিত্ত ও বৈভবের মালিক হয়েছিলেন যেখানে সাধারণ মানুষ ছিল দরিদ্র, মিসরের ঘটনাবলীও ঠিক একই সূত্রে গাঁথা। মিসরে সাম্প্রতিককালে ধনী ও গরীবের মাঝে একটি বড় ব্যবধান তৈরি করেছিল। মিসরে যত বেশী ভিক্ষুক দেখা যায়, অন্যকোন আরব বিশ্বে এত ভিক্ষুক নেই। ঠিক তেমনি মিসরে শত শত কোটিপতির জন্ম হয়েছে, যা উত্তর আফ্রিকার অন্যকোন দেশে নেই। ধনী ও দরিদ্রের এই ব্যবধান মিসরে গণবিস্ফোরকে সম্পন্ন করেছে। দ্বিতীয়ত, মিসরে তরুণ সমাজের একটি বড় অংশই বেকার। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী নিয়ে এরা চাকরি পায় না। সরকার এদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করতে পারেনি। ফলশ্রুতিতে এদের মাঝে যে হতাশার জন্ম হয়েছে, তা থেকে সৃষ্টি হয়েছে গণবিস্ফোরণর। তৃতীয়ত, সনাতন পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তনের কোন সুযোগ মিসরে নেই। একটি গোষ্ঠী বারে বারে জনগণের নাম করে রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিচালনা করছেন। সাধারণ মানুষের সমর্থন এদের প্রতি না থাকলেও, এরাই সকল সুবিধা নিচ্ছেন। এদেরকে দিয়েই গঠিত হচ্ছে সংসদ, মন্ত্রীসভা। সাধারণ মানুষ যে তিমিরে, সেই তিমিরেই থেকে যাচ্ছেন বছরের পর বছর। প্রযুক্তি বিদ্যার উন্নতিতে সারাবিশ্বের উন্নয়ন এখন তাদের সম্মুখে। সেই উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় তারা উৎসাহিত। গণবিস্ফোরণ এটাও একটা কারণ। চতুর্থত, প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক তার দীর্ঘ শাসনামলে নিজেকে একজন স্বৈরশাসক হিসেবেই প্রমাণ করেছেন, যেমনি প্রমাণ করেছিলেন তিউনেসিয়ায় বেন আলী। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের সাথে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে তরুণ সমাজের 'পালস' তিনি বুঝতে পারেননি। তরুণ সমাজ ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ ছিল। এই ক্ষুব্ধতাই তাদেরকে রাজপথে টেনে নিয়ে আসে। পঞ্চমত, মিসরে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ হয়েছিল ১৯৫২ সালে। সেদিন তরুণ অফিসাররা কর্নেল জামাল আব্দুল নাসেরের নেতৃত্বে সামরিক অভু্যত্থানের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল হোসনি মোবারক মিসরে এক ধরনের পরিবারতন্ত্র কায়েম করেছেন। তিনি ভেতরে ভেতরে তার সন্তান জামালকে তৈরি করেছিলেন ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্টের জন্য। মিসরে তথা সারাবিশ্বে এটা জানান হয়েছিল যে জামাল মোবারক বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে সেপ্টেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেপ্রাথর্ী হবেন। ৮২ বছর বয়সে এসে হোসনি মোবারক তার ছেলের কাছেই দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন এরকম আভাসই পাওয়া গিয়েছিল। এটা তো এক ধরনের 'রাজতন্ত্রই'! আর মিসরে ক্ষমতাসীনরা এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছেন, যেখানে হোসনি মোবারক যা চান, তাই হয়। বড় ধরনের এই গণবিস্ফোরণ না ঘটলে হয়ত মিসরবাসী জামাল মোবারককেই পরবতর্ী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে পেত। ষষ্ঠত, এক সময় মিসর জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছে। উন্নয়নশীল বিশ্বের নেতাও ছিল মিসর। নাসের ছিলেন 'ন্যাম' এর প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। 'প্যান ত্রারাবিজম' এর জন্ম দিয়ে আরব জাহানের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছিলেন নাসের। জামাল আব্দুল নাসেরের সেই মিসর শৌর্যে, উন্নতিতে এখন অনেক পেছনে। মিসর এখন আর আরব জাহানকে নেতৃত্ব দিতে পারে না। তরুণ সমাজের মাঝে এ থেকে হতাশা আসতেই পারে। এই হতাশাই তাদেরকে টেনে নিয়ে গেছে রাজপথে। সপ্তম, ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তির পর এতটা বছর পার হয়ে গেছে। ২০১০ সাল পার হওয়া স্বত্ত্বেয় শুধু ইসরাইলের একগুয়েমির কারণে ফিলিস্তিনী সমস্যার সমাধান হয়নি।আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিন আজো মিশর রাজনীতিতে আর্বিভূত হয় নি। ফলশ্রুতিতে হোসনি মুবারকের প্রতি সাধারণ মানুষের একটা বিতৃষ্ণা ও বিদ্বেষ জন্ম হতেই পারে। কেননা ফিলিস্তিনের জনগণের প্রতি সাধারণ মিসরবাসীর একটা সমর্থন সব সময়ই ছিল। এখনও আছে।
হোসনি মোবারক যদি সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশার প্রতি নজর দিতেন, যদি দারিদ্র্য কমানো তথা কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিতেন, সর্বোপরি তরুণ সমাজের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি দৃষ্টি দিতেন, তাহলে আজকের মত পরিস্থিতির সৃষ্টি হোত না। ক্ষমতার অন্ধে তিনি সবকিছু ভুলে গিয়েছিলেন। তিনি চালু করেছিলেন এক ধরনের পরিবারতন্ত্র। দ্রব্যমূল্যের ঊধর্্বগতি সারা বিশ্ব জুড়েই যখন একটি সমস্যা, তখন তিনি এদিকে নজর দেননি। ক্ষমতার মোহ তাকে সব ভুলিয়ে দিয়েছিল। সুতরাং আজকের যে পরিস্থিতি, এর দায়-দায়িত্ব তাঁকেই বহন করতে হবে। কিন্তু যে প্রশ্ন এখন বেশি করে আলোচিত হবে, তা হচ্ছে এরপর কি? কোন্দিকে যাচ্ছে এখন মিসর? মনে রাখতে হবে, মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে মিসরের গুরুত্ব অনেক বেশি। মিসর যদি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে, তাহলে তা মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়াকেই বিঘ্ন ঘটাবে না, বরং পুরো আরব বিশ্বেই এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। গত প্রায় দু'সপ্তাহ ধরে মিসরে যা ঘটে চলছে, তাকে কোনমতেই স্বাভাবিক বলা যাবে না। হোসনি মুবারকের পদত্যাগ ছাড়া কোন বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। সমস্যা হচ্ছে, হোসনি মুবারকের বিকল্প কে? একজন ভাইস প্রেসিডেন্টকে তিনি প্রথমবারের মত নিয়োগ করেছেন। তিনি সাবেক গোয়েন্দা সংস্থা প্রধান। পশ্চিমা বিশ্বে তিনি পরিচিত। কিন্তু বিক্ষোভকারীদের কাছে তিনি গ্রহণযোগ্য নন। সাংবিধানিকভাবে তিনি তার কাছেই ক্ষমতা ছাড়তে পারেন। অন্য কারো কাছে নয়। বিক্ষোভকারীদের কোন নেতা নেই। কোন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বেও এই আন্দোলন পরিচালিত হয়নি। সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা (আইএইও) এল বারাদি নিজেকে গণআন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। পশ্চিমা বিশ্বে তার একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে। কিন্তু তার দল নেই। ইসলামিক ব্রাদারহুড এর মত বড় ইসলামিক দল তাকে সমর্থন করবে, এটা মনে করা ঠিক হবে না। তিনি ইসলামিক জীবন-যাপনও করেন না। থাকেনও না মিসরে, থাকেন ভিয়েনাতে। ব্যক্তি এল বারাদি সর্বমহলে গ্রহণযোগ্যতা পাবেন বলেও মনে হয় না। এপ্রিল ৬ ইয়ুথ মু্যভমেন্ট এই গণবিক্ষোভকে সংগঠিত করেছে। এই সংগঠনটির নেত্রী আসমা মাহফুজও তেমন পরিচিত নন। সেনাবাহিনীর একটি ভূমিকা লক্ষ্য রাখার মত। সেনাবাহিনী স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছে তারা বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে গুলি ছুঁড়বে না। এর অর্থ সেনাবাহিনী একটি 'রাজনৈতিক সমাধানের' উপর গুরুত্ব দিচ্ছে। ইতিমধ্যে হোসনি মোবারক ঊধর্্বতন সেনা কমান্ডারদের সাথে বৈঠক করেছেন। এদের সমর্থন তিনি পুরোপুরিভাবে পেয়েছেন বলে মনে হয় না। উপরন্তু জনতার সাথে সাধারণ সৈনিকের করমর্দনের ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা সেনাবাহিনীর পক্ষেও সেস্নাগান দিয়েছে। এতে করে এটা ধারণা করা স্বাভাবিক যে, আগামীতে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা হবে মুখ্য। এক্ষেত্রে সেনাপ্রধান একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারেন। স্পষ্টতই মিসর এক পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে। সেখানে পরিবর্তন আসতেই হবে। হোসনি মোবারক যদি জোর করে ক্ষমতায় থাকতে চান, তাহলে সেখানে রক্ত ঝরবে। তবে মিসরে ব্যক্তি হোসনি মুবারকের ক্ষমতা ছেড়ে দেয়াই বড় কথা নয়। বড় কথা মিসরের রাজনৈতিক তথা অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার দরকার। কিছু ব্যক্তি তথা গোষ্ঠীর ক্ষমতা করায়াও করার প্রবণতাও বন্ধ করা জরুরী। সত্যিকার অর্থেই সেখানে একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু করা প্রয়োজন, যেখানে বহুদল ও বহুমত থাকবে। এবং সাধারণ মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করবেন। একটি গোষ্ঠী, একটি বিশেষ দলের প্রতি সমর্থন নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা যদি কমানো যায়, তাহলে মিসরে সত্যিকার অর্থেই গণতন্ত্র বিকশিত হবে। সেইসাথে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এনে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করাও জরুরী। ইতিহাস সাক্ষী দেয় শাসকের সাথে সাধারণ মানুষের ব্যবধান যদি তৈরী হয় তাহলে সেই শাসক ক্ষমতায় থাকতে পারেন না। ফরাসী বিপস্নবের প্রাক্কালে (১৭৮৯) রাজা ষোড়শ লুই থাকতে পারেননি। কেননা সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে কৃষকদের সাথে তার ব্যবধান তৈরী হয়েছিল। এই ব্যবধান তৈরী হয়েছিল ২০০৩ সালে জর্জিয়ায়, ২০০৪ সালে ইউক্রেনে, ২০০৫ সালে কিরঘিজস্তানে, আর অতিসম্প্রতি তিউনিসিয়ায়। ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। নেননি হোসনি মোবারকও। মিসরের স্থিতিশীলতার স্বার্থে হোসনি মোবারক যত তাড়াতাড়ি পদত্যাগ করবেন, ততই দেশটির জন্য মঙ্গল।
লেখক: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
0 comments:
Post a Comment