রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর, অনেক অমীমাংসিত ইস্যু

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে যাচ্ছেন সম্ভবত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। এ সফর চূড়ান্ত করতেই ঢাকায় এসেছিলেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব নিরুপমা রাও। ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার আগে রাও প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে কথাও বলেছেন। সংবাদপত্রগুলো আমাদের জানাচ্ছে যে, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় নিরাপত্তা বিষয়ে তিনটি চুক্তি সই হবে। যে চুক্তির কথা বলা হচ্ছে তা হচ্ছে_ সাজাপ্রাপ্ত আসামি বিনিময় চুক্তি, অপরাধ দমনে পারস্পরিক আইনগত সহযোগিতা চুক্তি এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস দমন, সংঘবদ্ধ অপরাধ দমন ও অবৈধ মাদক পাচার প্রতিরোধ চুক্তি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী গেল সেপ্টেম্বরে যখন নয়াদিলি্ল যান তখনই এ ধরনের একটি আভাস আমরা পেয়েছিলাম যে, এ ধরনের চুক্তি হবে এবং দু'দেশের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে তা চূড়ান্ত করা হবে। সাজাপ্রাপ্ত আসামি বিনিময় সংক্রান্ত কোনো চুক্তি দু'দেশের মধ্যে নেই। তাই চুক্তিটি প্রয়োজন।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রীর এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে বেশ কিছু অমীমাংসিত বিষয় রয়েছে, যার সমাধান বাঞ্ছনীয়। অতীতে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধানে ভারত আমাদের আশ্বাস দিলেও সেসব সমস্যা যা ছিল, তা-ই রয়ে গেছে_ সমাধান হয়নি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি এবং নেপাল ও ভুটানে যেতে ট্রানজিটের বিষয়টি বাংলাদেশের অগ্রাধিকারের তালিকায় রয়েছে। এই ট্রানজিটের ব্যাপারে ভারত ইতিবাচক মনোভাব দেখালেও তিস্তার পানি বণ্টন আলোচনার ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয়নি। বলা ভালো, ৪ বছর ধরে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক হচ্ছে না
এবং ভারতের অনীহার কারণে তারিখ ঠিক করেও এ পর্যন্ত বাংলাদেশকে ৪০টি বৈঠক বাতিল করতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় স্থল ট্রানজিটের একটি চুক্তিও হবে। এর আওতায় ভারত আশুগঞ্জ বন্দর ব্যবহার করে ত্রিপুরার পালাটোনা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ভারি সরঞ্জাম পরিবহনের সুবিধা পাবে। ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে আগামীতে বাংলাদেশ আড়াইশ' মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাবে বলেও পররাষ্ট্র সচিব আমাদের জানিয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় আশুগঞ্জ বন্দর ব্যবহারের বিষয়ে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে রাজি হয়েছিল। এখন শুধু অনুমোদন দেওয়ার পালা। ভারত নৌ-ট্রানজিট ও এয়ার ট্রানজিটের সুবিধা পায়। এবার পেতে যাচ্ছে স্থল ট্রানজিট। যদিও পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, শুধু একবারের জন্য ভারত এই সুবিধা পাবে। এখন দেখার বিষয়, স্থল ট্রানজিটের বিষয়টি শুধু 'একবারের' জন্য সীমাবদ্ধ থাকে কি-না। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে কোনো সমঝোতা হয়নি। কোনো চুক্তিও হবে না। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, বরাক নদীর উজানে বাঁধ নির্মিত হলে সুরমা-কুশিয়ারায় পানি থাকবে না। ফলে পলিমাটিতে নদী, হাওর-বাঁওড় ভরে যাবে। মৎস্যসম্পদ ধ্বংস হবে। মরুকরণ হবে বিস্তৃত অঞ্চলে। এটি শুধু সিলেটবাসীর জন্য নয়, এটি গোটা বাংলাদেশেরই আতঙ্ক। ভয় হচ্ছে, আমরা আগামী ৩ থেকে ৪ বছরের মধ্যে আরেকটি ফারাক্কা প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছি কি-না। এই যখন পরিস্থিতি তখন ভারতের দেওয়া প্রতিশ্রুতির কতটুকু রক্ষিত হয়, সেটিই দেখার বিষয় এখন।

নিউইয়র্কভিত্তিক এশিয়াটিক সোসাইটি এশিয়ার পানি সংকট নিয়ে একটি ভয়াবহ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তাতে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, পানি সংকটের যদি সমাধান না হয়, তাহলে এ অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো বড় ধরনের সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সংকট রয়েছে। রাষ্ট্রপতি সম্প্রতি ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির কথা বলেছেন। এ ক্ষেত্রে ভারতের সহযোগিতা প্রয়োজন। কেননা ভুটানের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ভারত পরিচালনা করে। ভারতের বিনিয়োগও সেখানে বেশি। ভুটানে বিদ্যুৎ 'সারপ্লাস' রয়েছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে এখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী কি কোনো উদ্যোগ নেবেন? আরও একটি কথা। নানা অশুল্ক বাধার কারণে ভারতীয় আমদানিকারকরা বাংলাদেশি পণ্যের ব্যাপারে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। ভারত যদি তার আমদানির পরিমাণ বাড়ায়, তাহলে খুব সহজেই বাণিজ্য ঘাটতি কমানো সম্ভব। অথচ তা 'না করে...' ভারত এখন প্রকাশ্যে স্থল ট্রানজিট দাবি করছে। স্থল ট্রানজিটের মাধ্যমে ভারত তার পণ্য বাংলাদেশের ওপর দিয়ে 'সাতবোন' রাজ্যগুলোতে নিয়ে যেতে চায়। যেহেতু স্থল ট্রানজিটের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের একটি নেতিবাচক ধারণা রয়েছে এবং নিরাপত্তা ঝুঁকিও রয়েছে। সেক্ষেত্রে ভারত নৌ-ট্রানজিটকে ব্যবহার করতে পারে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তে একটি ইপিজেড প্রতিষ্ঠা করে উৎপাদিত পণ্য শুল্কমুক্তভাবে (জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো) 'সাতবোন' রাজ্যগুলোতে নিয়ে যেতে পারে। এতে করে বাংলাদেশের রাস্তাঘাট ব্যবহার করার প্রয়োজন হবে না। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের যে রাস্তাঘাট তা ভারতীয় হেভি ট্রাকের জন্য উপযুক্ত নয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী কি বিষয়টি নিয়ে ভাববেন? ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে একটি সমস্যা রয়েছে। ভারতীয় ব্লক ২২ ও ২৩ বাংলাদেশি এলাকার মধ্যে পড়েছে। ভারত তার এই দাবি নিয়ে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে জাতিসংঘে গেছে। বাংলাদেশের নিজস্ব সমুদ্রসীমায় এ দুটি ব্লকে গ্যাসপ্রাপ্তির সম্ভাবনা রয়েছে। ভারত 'বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ' এ দুটি ব্লকের ওপর থেকে তার দাবি প্রত্যাহার করে নিতে পারত। একই সঙ্গে ৬.৫ কিলোমিটার সীমান্ত এখনও চিহ্নিত হয়নি। সীমান্ত সমস্যা রয়েছে মুহুরীর চর (ফেনী), লাঠিটিলা (মৌলভীবাজার) ও দইখাদা (কুড়িগ্রাম) নিয়ে। এ ব্যাপারে ভারতের ইতিবাচক উদ্যোগ প্রয়োজন। এছাড়া ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল রয়েছে। এরও কোনো সমাধান হয়নি। উপরন্তু গত প্রায় ৩০ বছরেও তালপট্টি দ্বীপ নিয়ে যে বিবাদ, তার সমাধান হয়নি। এটি বাংলাদেশি এলাকা, কিন্তু ১৯৮১ সালে সেখানে ভারতীয় সৈন্য অবতরণ করে। এক্ষেত্রে আমরা চাই ভারতের উদার মনোভাব। ভারত অনেক বড় দেশ। শিল্পজাত দ্রব্যের উৎপাদনের দিক থেকে ভারতের অবস্থান বিশ্বে দশম। ভারতের পুঁজি আজ আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ক্যারিবীয় অঞ্চল থেকে মধ্যপ্রাচ্য_ সর্বত্র বিনিয়োগ হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে বাংলাদেশের উন্নয়নে ভারত ইচ্ছা করলে একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। দু'দেশের বাণিজ্য ঘাটতি একটি বড় সমস্যা। এ ঘাটতি ভারতের অনুকূলে। গড়ে গত ৫ বছরে এ ঘাটতির পরিমাণ ১ হাজার ৭৫৪ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে আমরা ভারতে রফতানি করেছি ৩৫৮ মিলিয়ন ডলারের পণ্য অথচ আমদানি করেছি ৩ হাজার ৩৯৩ মিলিয়ন ডলারের ভারতীয় পণ্য। শুধু এক বছরেই ঘাটতি ৩ হাজার ৩৫ মিলিয়ন ডলার।

নিরুপমা রাওয়ের সফরের সময় এসব অনেক বিষয়ই আলোচিত হয়নি। তবে আমি আস্থা রাখি, শেখ হাসিনা-মনমোহন সিং আলোচনায় প্রতিটি বিষয় আলোচিত হবে এবং শেখ হাসিনা বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরবেন। ভারত আন্তরিক হলে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব। আমরা ভারতের কাছ থেকে সে আন্তরিকতাই প্রত্যাশা করি।
-ড. তারেক শামসুর রেহমান : আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষক ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (সুত্র, সমকাল, ২৫/১১/২০০৯)

0 comments:

Post a Comment