রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

আরো ব্যাংক আরো প্রশ্ন

আরও নয়টি ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মাঝে তিনটি এনআরবি অর্থাৎ বিদেশী উদ্যোক্তাদের, বাকিগুলো দেশীয় উদ্যোক্তাদের। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে ব্যাংকের মোট সংখ্যা দাঁড়াল ৫৬তে, যার মাঝে ৪টি হচ্ছে সরকারি ব্যাংক। তবে নতুন ব্যাংকগুলো নিয়ে নানা প্রশ্ন এখন বাজারে। নতুন নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা অর্থনীতির সফলতা নির্দেশ করে কিনা, আমি বলতে পারব না। যারা অর্থনীতি নিয়ে কাজ করেন তারা ভালো বলতে পারবেন। আমার ভাবনাটা অন্য জায়গায়। একজন শিক্ষাবিদ কিংবা একজন সাবেক আমলা যদি সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে ব্যবহার করে এভাবে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন, তাহলে আগামীতেও এর পুনরাবৃত্তি ঘটবে। এভাবে শিক্ষকরা যদি শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে টাকা উপার্জনের জন্য ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেন, তাহলে তা জাতির জন্য আদৌ কোন মঙ্গল বয়ে আনবে না। যে শিক্ষাবিদের নামটি একজন উদ্যোক্তা হিসেবে ছাপা হয়েছে, তিনি ইতিমধ্যে একটি বিশ্ববিদ্যালয় ‘প্রতিষ্ঠা’ করে তার ‘ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড’ শুরু করেছেন। এখন ব্যাংকিং সেক্টরে তার ‘ব্যবসা’ সম্প্রসারণ করলেন। ভালোই।

আসলে প্রশ্ন সেটি নয়। যদি সত্যি সত্যিই ‘প্রয়োজন’ থাকে, তাহলে নতুন নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা যেতেই পারে। কিন্তু সেই প্রয়োজনটি আছে কি? আদৌ কি বাংলাদেশ ব্যাংক কোন ‘স্টাডি’ করেছে নতুন ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা? যদি আদৌ কোন ‘স্টাডি’ না হয়ে থাকে তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংককে সব ধরনের দায়ভার বহন করতেই হবে। অতীতে এমনটি কখনও হয়েছে বলে আমার জানা নেই। তেল, পেঁয়াজ আর রসুনের মতো ব্যাংকিং সেক্টর ব্যবসার জায়গা নয়। নতুন নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ফলে এখানে আমানত সংগ্রহের জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেতে পারে, যা কিনা ব্যাংকিং সেক্টরে বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এই বিষয়টি সরকারের নীতিনির্ধারকরা কতটুকু ভেবে দেখেছেন, আমি বলতে পারব না।

নতুন ব্যাংকগুলোকে নিয়ে এখন অনেক প্রশ্ন, অনেক জিজ্ঞাসা। এক. বলা হয়েছে নতুন ব্যাংকের জন্য পরিশোধিত মূলধন ৪০০ কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, উদ্যোক্তারা যে ৪০০ কোটি টাকা একেকটি ব্যাংকের জন্য জমা দেবেন বা দিয়েছেন, তাদের অর্জিত ওই ‘সম্পদ’ কি বৈধ? ট্যাক্স রিটার্নে কি তা দেখানো হয়েছে? যদি সম্পদের হিসাব ট্যাক্স রিটার্নে থাকে, তাহলে কোন সমস্যা নেই। বিনিয়োগের উৎস কী, এটা জানা জরুরি। যে শিক্ষাবিদ, আমলা কিংবা ব্যাংকারের নাম উদ্যোক্তা হিসেবে ছাপা হয়েছে, তারা কি সারা জীবনে বৈধ পথে (কোন ব্যবসা না করে, কোন পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান না থেকে) এত টাকা উপার্জন করতে পারেন? একজন শিক্ষক হিসেবে আমি তো জানি আমার সারা জীবনের সঞ্চয় কত। একজন আমলা অবসর নিয়ে রাজনীতি করে কত টাকাই বা বৈধ পথে আয় করতে পারেন? দুই. অনেকদিন ধরেই ব্যাংকিং সেক্টরে তারল্য সংকট চলছে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা কি এটা ভেবে দেখেছেন যে, নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ফলে এই তারল্য সংকট আদৌ বাড়বে কিনা? তিন. ব্যাংকিং সেক্টরে যারা কাজ করেন, তারা জানেন ব্যাসেল-২ বলে একটা কথা আছে। এখানে কিছু শর্ত থাকে, যা ব্যাংকগুলোকে পালন করতে হয়। এমনিতেই ব্যাংকগুলো ব্যাসেল-২ এর শর্ত পূরণ করতে পারছে না। এখন নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়ায় পরিস্থিতি কি আরও জটিল হল না?

চার. কিছুদিন আগে পর্যন্ত বেসরকারি ব্যাংকগুলো বাজার থেকে আমানত সংগ্রহের জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। কোন কোন ব্যাংক আমানতকারীদের সাড়ে ১৪ ভাগ সুদ পর্যন্ত দিতে শুরু করেছিল। এর ফলে যারা ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করতেন, তাদের অতিরিক্ত সুদ দিতে হতো, কোন কোন ক্ষেত্রে যা ২০ ভাগের ওপরে। একপর্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে হস্তক্ষেপ করে আমানতের সুদের হার নির্দিষ্ট করে দিতে হয়েছিল। এখন নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ফলে এই ‘অসুস্থ প্রতিযোগিতা’ আবার শুরু হবে। নতুন ব্যাংকগুলো ‘আগ্রাসী ব্যাংকিং’ করবে এবং আমানতকারীদের অতিরিক্ত সুদের প্রলোভন দেখাবে। এতে করে একদিকে অন্য ব্যাংকগুলোও এই প্রতিযোগিতায় নামবে এবং এর ফলে সরকারের যে সঞ্চয় প্রকল্পগুলো চালু রয়েছে (পারিবারিক সঞ্চয়পত্র, পেনশনার সঞ্চয়পত্র ইত্যাদি), তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সরকার এসব প্রকল্প থেকে যে টাকা সংগ্রহ করে, তা ব্যাহত হবে। পাঁচ. বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা নতুন ব্যাংকগুলোকে ঢাকার বাইরে ব্যাংক স্থাপনের জন্য উৎসাহিত করবে। প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন ব্যাংকগুলো তা কি করবে? যেখানে ব্যাংক স্থাপনের পেছনে শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি কাজ করছে, সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘উপদেশ’ তারা গ্রহণ করবেন, এই বিশ্বাসটা রাখতে পারছি না। ‘ব্যবসা’ করার জন্যই তারা এখানে পুঁজি বিনিয়োগ করেছেন, কোন সমাজসেবা করার জন্য নয়। সুতরাং ঢাকা আর চট্টগ্রামে যে প্রথমেই শাখা খোলা হবে, তা দিব্যি ধরে নিতে পারি। ছয়. বাংলাদেশ ব্যাংক যে নীতিমালা প্রণয়ন করেছে, তা কি নতুন ব্যাংকগুলো অনুসরণ করবে? যেমন বলা হয়েছে, উদ্যোক্তার সংখ্যা ১৩ সদস্যের বেশি হতে পারবে না এবং উদ্যোক্তারা ১০ শতাংশ শেয়ারের অধিকারী হবেন। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? কোন কোন ব্যাংকের উদ্যোক্তার সংখ্যা ৪০-এর কাছাকাছি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের করণীয় কী?


এসব প্রশ্নের একটা জবাব বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আছে, আমরা তা জানি। সদ্য পদোন্নতি পাওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর সুর চৌধুরী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় কোন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়নি। তিনি এও জানিয়েছেন যে, আবেদনগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই করেই ব্যাংকগুলোকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। কিন্তু অতি উৎসাহী সুর বাবু ভুলে গেছেন যে, স্বয়ং অর্থমন্ত্রী একবার স্বীকার করেছিলেন, ‘রাজনৈতিক বিবেচনাতেই ব্যাংকগুলোর অনুমোদন দেয়া হবে। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের করার কিছুই নেই।’ অথচ সুর বাবু আরেকটু এগিয়ে গিয়েই বললেন, রাজনৈতিক বিবেচনা বিবেচ্য বিষয় ছিল না। সুর সাহেব কি গত ৯ এপ্রিলের পত্রিকাগুলো দেখেছেন? ব্যাংক উদ্যোক্তা হিসেবে যেসব নাম ও ছবি ছাপা হয়েছে, আপনার কি মনে হয় ওই ব্যক্তিদের সঙ্গে রাজনৈতিক কোন সংশ্লিষ্টতা নেই? এতদিন জানতাম বাংলাদেশ ব্যাংকে যারা ক্যারিয়ার গঠন করেন, তারা রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ। আমার অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু বাংলাদেশ ব্যাংকের উচ্চপদে আছেন (ডেপুটি গভর্নর) বা ছিলেন। তারা কেউই রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। কিন্তু সুর বাবুর বক্তব্যে ‘রাজনীতির’ গন্ধ পাচ্ছি। যা হোক, সুর বাবুদের কথায় কিছু যায় আসে না। সংবাদগুলোই আমাদের বলে দিচ্ছে রাজনৈতিক বিবেচনাতেই ব্যাংকগুলোর অনুমোদন দেয়া হয়েছে।

তারপরও কথা থেকে যায়। ব্যাংকগুলো যদি সনাতন ব্যাংকিং খাতে পরিবর্তন আনতে পারে, নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে গ্রাহকদের কাছে যেতে পারে, আমার বিশ্বাস, তারা সাধারণ মানুষের মাঝে একটা আস্থা অর্জন করতে পারবে। ফারমার্স ব্যাংক কিংবা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক নামে দুটো ব্যাংক অনুমোদন পেয়েছে। এখন ফারমার্স ব্যাংক যদি ঢাকায় অফিস খুলে বসে, তা যেমন দেখতে বেমানান হবে, ঠিক তেমনি তার কর্মপরিধির সঙ্গে তা খাপ খাবে না। ফারমার্স ব্যাংক গ্রামে যাক। দশ টাকায় কৃষকদের জন্য ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলুক। অথবা প্রয়োজনে বিনে পয়সায় অ্যাকাউন্ট খুলতে কৃষকদের সাহায্য করুক। কৃষকদের বিনা জামানতে ঋণ দিক। ক্ষুদ্রঋণ চালু করুক। একই কথা প্রযোজ্য এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের ক্ষেত্রেও। এত গ্রাম। এত কৃষক। ব্যাংকগুলো কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের নিয়েও একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পারে। সেখান থেকেও ব্যবসা করা সম্ভব। বেসরকারি ব্যাংক মানেই ঢাকায় অফিস, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিস কক্ষ, এমডির মাসিক বেতন দশ লাখ টাকা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর এই যে মানসিকতা, এই মানসিকতা বদলাতে হবে।

কৃষকরা এসি রুমে যেতে পারেন না। ‘স্যুটেড বুটেড’ বিবিএ পাস তরুণ ব্যাংককর্মীর কাছে সে অপরিচিত। অথচ কৃষকরাই এই দেশটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সরকারি ব্যাংকগুলো তাদের কাছে যায়নি। যায়নি কৃষি ব্যাংকও। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলো তো শুধু শহরকেন্দ্রিক। এখন নয়া ব্যাংকগুলো যদি এই বৃত্ত ভাঙতে পারে, তাহলে তারা ব্যাংকিং খাতে শুধু একটি বড় পরিবর্তনই আনবে না, বরং ব্যাংকিং ব্যবস্থার পুরো চেহারাটাই বদলে দিতে পারে। সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদেরও নাম এসেছে একটি ব্যাংকের অন্যতম উদ্যোক্তা হিসেবে। এখানে ব্যক্তি এরশাদ যদি অনুমোদন নিয়ে থাকেন, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে যদি অনুমোদন নিয়ে থাকেন, তাহলে এর একটি পজিটিভ দিক রয়েছে। পশ্চিম ইউরোপে অনেক রাজনৈতিক দলের নিজস্ব ব্যাংক রয়েছে (যেমন জার্মানি)। ব্যাংক পরিচালনা থেকে যে আয় হয়, সেই অর্থ দিয়ে দলটির কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। রাজনৈতিক দলগুলো শুধু ব্যাংকিং সেক্টরেই নয়, বরং সংবাদপত্র ও রিয়েল এস্টেটেও অর্থ বিনিয়োগ করে থাকে। বাংলাদেশে এরকমটি নেই। কোন রাজনৈতিক দলেরই আর্থিক কোন ভিত্তি নেই। বলা হয় দল চলে চাঁদায়। এটি সত্য নয়। দল চলে বড় বড় ব্যবসায়ীর অর্থে। যারা দল ক্ষমতায় গেলে সুবিধা উঠিয়ে নেয়। এক্ষেত্রে জাতীয় পার্টি যদি একটি ব্যাংকের অনুমোদন নেয়, সেটা হবে বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য নতুন একটি দিগন্ত। জাতীয় পার্টি সে ক্ষেত্রে নতুন একটি রাজনীতির ধারা সূচনা করতে পারে।

নতুন ৯টি ব্যাংক অর্থনীতিতে আদৌ কোন অবদান রাখতে পারবে কিনা, তা শুধু ভবিষ্যৎই বলতে পারে। তবে ব্যাংকগুলোর শুরুটা ভালো হল না। ‘রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া’র অভিযোগটি ব্যাংকগুলোর ভবিষ্যৎকে একটি প্রশ্নের মাঝে ফেলে দিতে পারে। তবে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপকরা এই অভিযোগটি কাটিয়ে উঠতে পারবেন যদি তারা নতুন এপ্রোচে ব্যাংকগুলো পরিচালনা করেন। এক্ষেত্রে সুযোগ রয়েছে। সম্ভাবনাও রয়েছে। এখন দেখার বিষয় উদ্যোক্তারা কিভাবে ব্যাংকগুলো পরিচালনা করেন।

ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[সূত্র: যুগান্তর, ১৯/০৪/১২]

0 comments:

Post a Comment