রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

একটি অভিযোগ ও প্রাসঙ্গিক কিছু বক্তব্য

একটি গুরুতর অভিযোগ এনেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ১৪ মার্চ ১৪ দল আয়োজিত সমাবেশে খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে তিনি বলেছেন, 'পাকিস্তানে চলে যান।' কালের কণ্ঠ পত্রিকায় এ সংবাদটা এভাবেই ছাপা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেছেন যে সম্প্রতি পাকিস্তানের আদালতে আইএসআইয়ের প্রধান বলেছেন, ১৯৯১ সালের নির্বাচনের সময় তারা বিএনপিকে অর্থ দিয়েছিল। এ জন্যই তিনি খালেদা জিয়াকে পাকিস্তানে চলে যেতে বলেছেন। নিঃসন্দেহে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য। একজন প্রধানমন্ত্রী যখন এ ধরনের কথা বলেন, তখন এর গুরুত্ব থাকে বৈকি! এটা কোনো কথার কথা নয়। আমার ধারণা, এ দেশের লাখ লাখ মানুষ প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যে আহত হয়েছেন। কেননা একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী যদি সত্যিই সত্যিই বিদেশি একটি রাষ্ট্রের কাছ থেকে টাকা নিয়ে থাকেন, এর চেয়ে আর দুঃখজনক কিছু থাকতে পারে না! প্রধানমন্ত্রী যখন এ ধরনের গুরুতর একটি অভিযোগ আনেন, আমি বিশ্বাস করতে চাই গোয়েন্দাদের কাছ থেকে সঠিক তথ্যটি পেয়েই তিনি প্রকাশ্যে এ দাবিটি করেছিলেন। কেননা তিনি ভালো করে জানেন, একজন প্রধানমন্ত্রী যখন এ ধরনের অভিযোগ আনেন, তা আর শুধু সীমিত কিছু লোকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং রাষ্ট্রের বাইরেও গণমাধ্যমের কারণে তা প্রচারিত হয়ে যায় এবং তা হয়ে গেছেও ইতিমধ্যে। কিন্তু এখন জানা গেল, সংবাদটির পেছনে আদৌ কোনো সত্যতা নেই। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অভিযোগটি সত্য নয়।
প্রধানমন্ত্রী যে তথ্যটি বিশাল সমাবেশে উপস্থাপন করেছিলেন, তার সূত্র হচ্ছে 'প্রথম আলো'য় প্রকাশিত একটি সংবাদ। সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল গত ৪ মার্চ। সংবাদটি পাঠিয়েছিলেন তাদের নয়াদিল্লির সংবাদদাতা দীপাঞ্জন রায়। এর আগে সংবাদটি খালিজ টাইমস, ডেইলি মেইলের ভারত সংস্করণ ও বাসস সংবাদটি পরিবেশন করে। প্রতিটি সংবাদের বক্তব্য একটিই- পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সাবেক প্রধান লে. জেনারেল আসাদ দুররানি (অব.) পাকিস্তানের উচ্চ আদালতে বলেছেন, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপিকে পাঁচ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল। খালিজ টাইমস বা ডেইলি মেইল যে সংবাদটি ছাপে, তারও সূত্র ওই একই ব্যক্তি- দীপাঞ্জন রায়। এ ক্ষেত্রে 'প্রথম আলো' যখন এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর ছাপে, তখন স্বাভাবিকভাবেই একজন পাঠক হিসেবে আমি ধরে নেব, সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি সংবাদটির সত্যতা যাচাই করেই সংবাদটি ছাপার ব্যবস্থা করেছিলেন। এ ধরনের সংবাদে কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে, এটা একজন সিনিয়র সাংবাদিক হিসেবে তাঁর না জানার কথা নয়। এর দায়দায়িত্ব তাঁকে বহন করতেই হবে। আজ যখন অন্য একটি সংবাদপত্র আইএসআইয়ের সাবেক প্রধানের একটি সাক্ষাৎকার ছাপে (নয়া দিগন্ত, ২২ মার্চ) কিংবা পাকিস্তানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা ছাপা হয়, তখন আমার কাছে যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দেয়, তা হচ্ছে- এ সাক্ষাৎকারটি তো প্রথম আলোও ছাপতে পারত? প্রথম আলো তো সত্যতা যাচাই করার স্বার্থেই জেনারেল দুররানির সঙ্গে কথা বলতে পারত? এটাই তো সৎ সাংবাদিকতা? তাহলে প্রশ্ন এসে যায়, প্রথম আলো এ কাজটি করল না কেন? এখন যখন দুররানি নিজেই বলেছেন, তিনি আদালতে এ ধরনের কোনো কথা বলেননি এবং 'খবর'টি সম্পূর্ণ কাল্পনিক ও বানোয়াট, তখন প্রথম আলো কি তাদের এই 'ভুল'টি স্বীকার করবে? 'পাবলিক ফিগার'দের নিয়ে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর সংবাদ পরিবেশনা কাম্য নয়। তাঁরা জনগণের প্রতিনিধি। লাখ লাখ মানুষ তাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাঁদের রাজনীতিতে 'ভুল' থাকতেই পারে। আর ভুল আছে বলেই জনগণের সমর্থন না পেয়ে তাঁদের কেউ কেউ ক্ষমতা হারান। আবার একসময় ক্ষমতায় ফিরেও আসেন। আর এ 'ক্ষমতা হারানো' কিংবা 'ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার' মধ্য দিয়ে তাঁরা কতটুকু কী শিখতে পারেন, সে প্রশ্ন ভিন্ন। কিন্তু আমরা তো চাই তাঁরা 'দেয়ালের লিখন' থেকে শিখবেন। না 'শিখলে' তাঁদের পরিণতি কী হতে পারে, তা তাঁরা ভালো করেই জানেন। কিন্তু তাই বলে একটা সংবাদপত্র তো মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করতে পারে না? একটা সংবাদপত্র তো বিভ্রান্তিকর সংবাদ পরিবেশন করতে পারে না? সংবাদপত্রের কোনো নীতিমালাই এ ধরনের বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন সমর্থন করে না। আমি হাজারটা তথ্য দিতে পারব, যেখানে মিথ্যা সংবাদ পরিবেশনের জন্য সম্পাদক পদত্যাগ করেছেন। নিদেনপক্ষে ওই সাংবাদিক তথা সংশ্লিষ্ট সম্পাদককে বরখাস্ত করা হয়েছে। এখন প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ কী এই নীতি অনুসরণ করবে? তবে প্রথম আলো যদি ভুল স্বীকার করে, আমার ধারণা তাতে কিছুটা হলেও 'সম্মান' রক্ষা হবে।
তবে সংবাদপত্রের ওপর আমি আস্থাটা রাখতে চাই। কেননা সংবাদপত্র আমাকে শেখায়। আমার মূল্যায়নে সাহায্য করে। আমার গবেষণায় এবং গ্রন্থে আমি সংবাদপত্র থেকে প্রচুর উদ্ধৃতি দিই। আমার মতো অনেক গবেষকও এ কাজটি করেন। তাই সংগত কারণেই সংবাদপত্রের ওপর আস্থাটা আমার বেশি। কিন্তু ভুল সংবাদ কেন? এটা কী উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কোনো সংবাদ ছিল? আমি জানি না, প্রথম আলো এর কী জবাব দেবে। তবে প্রথম আলো সম্পর্কে বাজারে নানা কথা চালু রয়েছে। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এ সংবাদপত্রটির ভূমিকা নানা কারণে বিতর্কিত ছিল। বিশেষ করে ওই পত্রিকার সম্পাদকের তথাকথিত 'মাইনাস টু ফর্মুলা' একাধিকবার সমালোচিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও সমালোচনা করেছেন। এমনি একটি পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়াকে নিয়ে যখন আরেকটি 'মিথ্যা' সংবাদ পরিবেশিত হয়, তখন সংবাদপত্রটি আবারও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে এলো।
বাংলাদেশ এখন একটি বড় ধরনের রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সরকার ও বিরোধী দল এখন পরস্পরবিরোধী একটি অবস্থান বহন করছে। প্রধান বিরোধী দল সরকারকে আগামী জুনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। বিএনপি ও চার দল সংসদে ফিরে গেছে। এটি একটি পজিটিভ দিক। বিরোধী দলের সংসদে উপস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হবে- এটাই প্রত্যাশিত। এমনি একটি সময়ে প্রথম আলোর মতো একটি সংবাদপত্র বিরোধী দল ও তার প্রধানকে নিয়ে একটি মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করে কি প্রকারান্তরে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে নতুন করে বৈরিতা সৃষ্টি করল না? তাদের এ উদ্দেশ্যটি সৎ নয়। নিন্দুকরা বলতে পারে, এর পেছনে কোনো মতলব কাজ করছে। আজ দেশের পরিস্থিতি সামনে রেখে এ দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজের প্রায় সবাই বলছেন, একটা সমঝোতা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সরকারকেও কিছু ছাড় দিতে হবে আবার বিএনপিকেও কিছু ছাড় দিতে হবে। বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অগণতান্ত্রিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকার নিন্দা করেন আজ সবাই। একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকবে পাঁচ বছর, এটা সবাই চায়। এর মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র আরো শক্তিশালী হবে। এরপর নির্বাচনে জনগণই বিচার করবে ক্ষমতাসীন সরকারের পারফরম্যান্স। এমনই একসময় প্রধান বিরোধী দলের নেতাকে নিয়ে একটি বিভ্রান্তিকর তথ্য কাম্য নয়। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যও সঠিক ছিল না। প্রয়োজনে সরকার পাকিস্তানের আদালতে আইএসআইয়ের সাবেক প্রধানের বক্তব্য সংগ্রহ করে তা জনসম্মুখে প্রকাশ করতে পারে। বিএনপি আদালতে যাওয়ার কথা বলেছে। রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আদালতে না যাওয়াই মঙ্গল। তবে সরকারি দলের নেতারা যদি বারবার এ ধরনের কথা বলতে থাকেন, তাতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হবে। তাতে কোনো সমাধান পাওয়া যাবে না। বরং বিএনপি তথা চার দল সংসদে ফিরে গেছে। এটাকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের উদ্যোগ নিতে পারে সরকার। একটি নির্দলীয় ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামো নিয়েও আলোচনা হতে পারে। তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক পক্ষ, যারা সরকার ও বিরোধী দলেরও বন্ধু, তাদের মাধ্যমেও এ বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত করা যায়। প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদের ওপর ভিত্তি করেই প্রধানমন্ত্রী একটি অভিযোগ করেছেন। এখন আইএসআইয়ের সাবেক প্রধানের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হওয়ার পর এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অস্বীকৃতির পর এ বিষয়ে সব বিভ্রান্তির অবসান ঘটবে বলেই আমার বিশ্বাস। ব্যক্তি আক্রমণ থেকে আমরা যদি নিজেদের দূরে রাখতে পারি, আমার বিশ্বাস, আমরা দেশে সুস্থ রাজনীতি চর্চার পথ সুগম করতে পারব।
তারেক শামসুর রেহমান অধ্যাপক,
 রাজনৈতিক বিশ্লেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,
 tsrahmanbd@yahoo.com

0 comments:

Post a Comment