রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বিদ্যুৎ সংকট কয়লা উত্তোলনের প্রয়োজনীয়তা

গত ২৯ মার্চ সারা দিনে যখন একাধিকবার লোডশেডিংয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত, ঠিক তখনই বিদ্যুতের মূল্য আরেক দফা বাড়ানো হলো। বিদ্যুতের এই বেহাল অবস্থায় মূল্য বাড়িয়ে বিদ্যুৎ খাতের আর্থিক শৃঙ্খলা কতটুকু কমিয়ে আনা সম্ভব হবে, তা এক ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু যে বিষয়টিকে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া উচিত ছিল, তা হচ্ছে এই মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ জনগণের ওপর এক বাড়তি বোঝা। এমনিতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সরকারের ওপর সাধারণ মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে। সরকার ও বিরোধী দল ক্রমেই একটি বড় ধরনের সংঘাতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এমনি এক পরিস্থিতিতে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের হতাশা তাদের সরকারবিরোধী অবস্থানে ঠেলে দেবে। ইতিমধ্যে সংসদে সরকারি দলের নেতারাই বিদ্যুৎ পরিস্থিতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বিদ্যুৎ উপদেষ্টা অযোগ্য- এমন অভিযোগও করেছেন সরকারি দলের সিনিয়র নেতারা। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর অপসারণও দাবি করেছেন কেউ কেউ।
যেখানে সংবিধানের ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা আছে, রাষ্ট্র জনগণের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করবে, সেখানে বিদ্যুতের চাহিদা নিশ্চিত না করে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। মূলত রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কেনার কারণেই বিদ্যুতের এই দাম বাড়ানো হলো। কুইক রেন্টালের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করতে যাওয়ার সিদ্ধান্তটি ছিল একটি আত্মঘাতী। বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেছে, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল থেকে বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে কম, কিন্তু ব্যয় হয়েছে বেশি।
এখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে এর প্রভাব সরাসরি জনগণের ওপর পড়বে। এর ফলে মূল্যস্ফীতি আরেক দফা বাড়বে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় পণ্যমূল্য ধরে রাখা সম্ভব হবে না, যা কি না নিম্ন-আয়ের মানুষের জন্য হবে আরেক যন্ত্রণার কারণ। এতে করে জীবনযাত্রার খরচও অনেক বৃদ্ধি পাবে। বিদ্যুৎ নিয়ে এমনিতেই সংকট আছে। এখন এই সংকট আরো বাড়ল। এমনিতেই এই ঢাকা শহরে হাজার হাজার ফ্ল্যাট তৈরি হয়েছে। এসব ফ্ল্যাটে আদৌ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। যদি না হয়, তাহলে যাঁরা লাখ লাখ টাকা খরচ করে নির্মিতব্য এই ফ্ল্যাটগুলো ক্রয় করেছেন, তাঁরা এখন কী করবেন? আবাসন শিল্পের সঙ্গে জড়িত কয়েক লাখ মানুষ। তাদের আয়-রোজগারের কী হবে? ডেভেলপাররা যদি ক্রেতাদের ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিতে না পারে, তাহলে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার কর্মী বেকার হয়ে যাবে। সরকারের জন্য আদৌ তা কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না।
বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় প্রাকৃতিক গ্যাস দিয়ে। এই গ্যাস এখন ফুরিয়ে আসছে। চলমান গ্যাস সংকট মোকাবিলায় সরকার ২০০৯ সালে 'ফাস্ট ট্র্যাক প্রোগ্রাম' নামের একটি প্রকল্প হাতে নেয়। এর অধীনে অতি দ্রুত নতুন গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বাপেক্সের হাতে থাকা ৩, ৬, ৮ ও ১১ নম্বর ব্লকের মোট ৩১০০ লাইন কিলোমিটার দ্বিমাত্রিক (টু-ডি) সিসমিক জরিপের কাজ তিন বছরের মধ্যে সম্পন্ন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। অভিযোগ উঠেছে যে স্থলভাগের ২৩টি ও অগভীর সমুদ্রের আটটি ব্লককে পিএসসির আওতায় বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে কনোকো-ফিলিপস একটির দায়িত্ব পেয়েছে। একই সঙ্গে রাশিয়ার তেল-গ্যাস উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রম এবং অস্ট্রেলিয়ার কম্পানি স্যান্ডোজও শিগগিরই কাজ পাচ্ছে। এমন অভিযোগও উঠেছে যে স্থলভাগে সুনেত্রার মতো বিশাল মজুদ বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া হতে পারে। কনোকো-ফিলিপস যে দায়িত্বটি পেয়েছে, সেটা নিয়ে বাংলাদেশে বড় ধরনের বিতর্ক হচ্ছে। তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতারা এই চুক্তির বিরোধিতা করে দেশব্যাপী প্রচুর গণসংযোগ করেছেন। তাঁদের যুক্তি একটাই, কোনো অবস্থায়ই বাংলাদেশের গ্যাস রপ্তানি করা যাবে না। গভীর সমুদ্রে গ্যাস পাওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে। কেননা মিয়ানমার এবং ভারত গভীর সমুদ্রে গ্যাস পেয়েছে। মিয়ানমারের গভীর সমুদ্রে প্রাপ্ত গ্যাস আগামী বছর যাবে থাইল্যান্ডে। চীনও এই গ্যাস কিনছে। এ ক্ষেত্রে যদি গ্যাস পাওয়াও যায়, তা উত্তোলন ও জাতীয় গ্রিডে তা দিতে নূ্যনতম আরো পাঁচ থেকে ছয় বছর সময় প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সরকারের কাছে বিকল্প কী, এটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। যদিও একটা কথা ইদানীং শোনা যাচ্ছে যে সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনায় বাপেঙ্ যে ৪ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (সম্ভাব্য মজুদ) গ্যাস আবিষ্কার করেছে, তা যদি উত্তোলনের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে বিদ্যুৎ সংকটের একটা সমাধান সম্ভব। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে- এই মজুদও বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া হতে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত সরকার বিষয়টি খোলাসা করেনি।
যেহেতু গ্যাসের একটি সংকট আছে, তাহলে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান আমরা কিভাবে করব? গ্যাসের বিকল্প হতে পারে কয়লা। এ পর্যন্ত দেশে পাঁচটি কয়লাখনি আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত মজুদের পরিমাণ দুই হাজার ৫০০ মিলিয়ন টন। এ কয়লা সম্পদ ৭৩ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য। তবে উত্তোলনযোগ্য কয়লার পরিমাণ ২০ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য ধরা যেতে পারে, যা ৩০ থেকে ৪০ বছরের জ্বালানি-নিরাপত্তা দিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু কয়লা উত্তোলন নিয়েও বাংলাদেশে একটি বড় বিতর্ক রয়েছে। কয়লা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তোলা হবে, নাকি আন্ডারগ্রাউন্ড পদ্ধতিতে তোলা হবে- এটা নিয়ে বিতর্ক বাড়ছে। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনন করলে ছয় হাজার হেক্টর কৃষিজমি নষ্ট হবে এবং তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করতে হবে। তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার বিপক্ষে। অথচ উন্মুক্ত পদ্ধতিতে একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, এই পদ্ধতিতে ৯০ শতাংশ কয়লা তোলা যাবে। অন্যদিকে আন্ডারগ্রাউন্ড পদ্ধতিতে তুললে তোলা যাবে মাত্র ১০ শতাংশ কয়লা। বড়পুকুরিয়া কয়লাক্ষেত্রের বেলায় দেখা যাচ্ছে, ১০ শতাংশ কয়লাও তোলা সম্ভব হচ্ছে না। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ অভিমত দিয়েছেন যে বড়পুকুরিয়া থেকে ১০০ মিলিয়ন টনের বেশি কয়লা তোলা সম্ভব হবে না। পক্ষান্তরে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ৬০০ থেকে ৭০০ মিলিয়ন টন কয়লা তোলা সম্ভব, যা বাংলাদেশের ৪০ থেকে ৫০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তা দেবে।
জ্বালানি খাতে কয়লা একটা সম্ভাবনার সৃষ্টি করলেও তাতে এখন সমস্যা দেখা দেবে। যেখানে বিশ্বের ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় কয়লা থেকে, সেখানে এই সেক্টরের উন্নয়নের ব্যাপারে আমরা তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছি না। আমাদের প্রচুর কয়লা মজুদ থাকা সত্ত্বেও আমরা খুলনা ও চট্টগ্রামে দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছি ভারত থেকে আমদানীকৃত কয়লার ওপর নির্ভর করে। এই সেক্টরটিও আমরা ভারতের হাতে তুলে দিয়েছি। বিদ্যুৎ নিয়ে অতীতে এবং এখনো বিগত চারদলীয় জোট সরকারকে দোষারোপ করলেও বর্তমান সরকার যদি বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করতে না পারে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের ওপর থেকে জনগণ আস্থা হারিয়ে ফেলবে। এ সত্যটি সরকার যত দ্রুত উপলব্ধি করতে পারবে, ততই মঙ্গল।
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tareque.rahman@aol.com

0 comments:

Post a Comment