রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

অথঃ বিদ্যুৎ সমাচার



বিদ্যুৎ নিয়ে সংকট আছে। চাহিদা বাড়ছে অস্বাভাবিকভাবে। কিন্তু সেভাবে উৎপাদন হচ্ছে না। হাজার হাজার ফ্ল্যাট এই ঢাকা শহরেই তৈরি হচ্ছে। এসব ফ্ল্যাটে কী আদৌ পূর্ণ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে? যদি না হয়, তাহলে যারা লাখ লাখ টাকা খরচ করে নির্মিতব্য এই ফ্ল্যাটগুলো ক্রয় করেছেন, তারা এখন কী করবেন? আবাসন শিল্পের সঙ্গে জড়িত কয়েক লাখ মানুষ। তাদের আয়-রোজগারের কী হবে? ডেভেলপার যদি ক্রেতাদের ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিতে না পারে, তাহলে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার কর্মী বেকার হয়ে যাবেন। সরকারের জন্য আদৌ তা কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না।
বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় প্রাকৃতিক গ্যাস দিয়ে। এই গ্যাস এখন ফুরিয়ে আসছে। চলমান গ্যাস সংকট মোকাবিলায় সরকার ২০০৯ সালে 'ফাস্ট ট্রাক প্রোগ্রাম' নামের একটি প্রকল্প হাতে নেয়। এর অধীন অতি দ্রুত নতুন গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বাপেক্সের হাতে থাকা ৩, ৬, ৮ ও ১১ নম্বর বস্নকের মোট ৩১০০ লাইন কিলোমিটার (টু-ডি) সিসমিক জরিপের কাজ ৩ বছরের মধ্যে সম্পন্ন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। অভিযোগ উঠেছে, স্থলভাগের ২৩টি ও অগভীর সমুদ্রের ৮টি বস্নককে পিএসসির আওতায় বিদেশিদের হাতে তুলে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে কনোকো ফিলিপস একটির দায়িত্ব পেয়েছে। একই সঙ্গে রাশিয়ার তেল-গ্যাস উত্তোলনকারী একটি প্রতিষ্ঠান এবং অস্ট্রেলিয়ার এক কোম্পানি শিগগির কাজ পাচ্ছে। এমন অভিযোগও উঠেছে, স্থলভাগের বিশাল সম্পদ বিদেশিদের হাতে তুলে দেয়া হতে পারে। কনোকো ফিলিপস যে দায়িত্বটি পেয়েছে, সেটা নিয়ে বাংলাদেশে বড় ধরনের বিতর্ক হচ্ছে। তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতারা এই চুক্তির বিরোধিতা করে দেশব্যাপী প্রচুর গণসংযোগ করেছেন। তাদের যুক্তি একটাই_ কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশের গ্যাস রফতানি করা যাবে না। গভীর সমুদ্রে গ্যাস পাওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে। কেননা মিয়ানমার এবং ভারত গভীর সমুদ্রে গ্যাস পেয়েছে। মিয়ানমারের গভীর সমুদ্রে প্রাপ্ত গ্যাস আগামী বছর যাবে থাইল্যান্ডে। চীনও এই গ্যাস কিনছে। এ ক্ষেত্রে যদি গ্যাস পাওয়াও যায়, তা উত্তোলন ও জাতীয় গ্রিডে তা দিতে নূ্যনতম আরো ৫ থেকে ৬ বছর সময় প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সরকারের কাছে বিকল্প কী, এটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। যদিও একটা কথা ইদানীং শোনা যাচ্ছে, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনায় বাপেক্স যে ৪.৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (সম্ভাব্য মজুদ) গ্যাস আবিষ্কার করেছে, তা যদি উত্তোলনের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে বিদ্যুৎ সংকটের একটা সমাধান সম্ভব। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, এই মওজুদও বিদেশিদের হাতে তুলে দেয়া হতে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত সরকার বিষয়টি খোলাসা করেনি।
যেহেতু গ্যাসের একটা সংকট আছে, তাহলে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান আমরা কীভাবে করব? গ্যাসের বিকল্প হতে পারে কয়লা। এ পর্যন্ত দেশে পাঁচটি কয়লা খনি আবিষ্কৃৃত হয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত মজুদের পরিমাণ ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন টন। এ কয়লা সম্পদ ৭৩ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য। তবে উত্তোলনযোগ্য কয়লার পরিমাণ ২০ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য ধরা যেতে পারে, যা ৩০ থেকে ৪০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তা দিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু কয়লা উত্তোলন নিয়েও বাংলাদেশে একটি বড় বিতর্ক রয়েছে। কয়লা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তোলা হবে, নাকি আন্ডারগ্রাউন্ড পদ্ধতিতে তোলা হবে, এটা নিয়ে বিতর্ক বাড়ছে। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনন করলে ৬ হাজার হেক্টর কৃষি জমি নষ্ট হবে এবং অনেককে তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করতে হবে। তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার বিপক্ষে। অথচ উন্মুক্ত পদ্ধতির একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে ওই পদ্ধতিতে ৯০ শতাংশ কয়লা তোলা যাবে। অন্যদিকে আন্ডারগ্রাউন্ড পদ্ধতিতে তুললে তোলা যাবে মাত্র ১০ শতাংশ কয়লা। বড়পুকুরিয়া কয়লা ক্ষেত্রের বেলায় দেখা যাচ্ছে, শতকরা ১০ ভাগ কয়লাও তোলা সম্ভব হচ্ছে না। কোন কোন বিশেষজ্ঞ অভিমত দিয়েছেন, বড়পুকুরিয়া থেকে ১০০ মিলিয়ন টনের বেশি কয়লা তোলা সম্ভব হবে না। পক্ষান্তরে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ৬০০ থেকে ৭০০ মিলিয়ন টন কয়লা তোলা সম্ভব, যা বাংলাদেশের ৪০ থেকে ৫০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তা দেবে।
জ্বালানি খাতে কয়লা একটা সম্ভাবনার সৃষ্টি করলেও, তাতে এখন রাজনীতি ঢুকে গেছে। ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট ফুলবাড়ীর কয়লা খনি উত্তোলনের বিরোধিতাকারী স্থানীয় জনগণের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সংঘর্ষ হয়। তাতে মারা যান ৬ জন মানুষ। এরা উন্মক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনে বিরোধিতা করেছিল। সেই থেকে ফুলবাড়ী কয়লা উত্তোলনের বিষয়টি শুনে আসছি। এ ব্যাপারে সরকার এখন পর্যন্ত কোনো কয়লানীতিও গ্রহণ করতে পারেনি। যদিও ২০০৭ সালের ১১ জুন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার বুয়েটের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মোমিন পাটোয়ারীকে আহ্বাক করে একটি কমিটি গঠন করেছিল। ওই কমিটি ২০০৮ সালের ৮ জানুয়ারি সরকারের কাছে তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছিল। তাতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন, রফতানির সুযোগ না রাখা, দেশের চাহিদা পূরণের জন্য ৫০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, খনির মুখে একটি বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করার বিধান রাখা হয়েছিল। কিন্তু ওই রিপোর্ট গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি বর্তমান সরকার কোনো কয়লানীতিও গ্রহণ করেনি। ফলে একটি সম্ভাবনাময় সেক্টর আমাদের কোনো কাজে আসছে না। এখানে বলা ভালো, বিশ্বের ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় কয়লা থেকে। বিশ্বের কয়েকটি দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া ৭৯ শতাংশ, চীন ৭৮, জার্মানি ৪৯, ভারত ৬৯, দক্ষিণ আফ্রিকা ৯২, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৫০ শতাংশ। এখানে আরো একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন আর তা হচ্ছে, বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ কয়লা মজুদ থাকা সত্ত্বেও সরকার খুলনা ও চট্টগ্রামে দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে আমদানিকৃত (ভারত) কয়লার ওপর নির্ভর করে। এই সেক্টরটিও আমরা ভারতের হাতে তুলে দিয়েছি।
বিদ্যুৎ নিয়ে কম কথা হয়নি অতীতে। অভিযোগ ছিল, সাবেক ৪ দলীয় জোট বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা নেয়নি। ওই অভিযোগের পেছনে সত্যতা থাকুক আর না থাকুক বাস্তবতা হচ্ছে, বর্তমান সরকার বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তারা ওয়াদা করেছে। তারা ব্যর্থ হলে জনগণ খুব স্বাভাবিকভাবেই তাদের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলবে। এমনিতেই রাজনীতি উত্তপ্ত হচ্ছে। এমনি একটি ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ ঘাটতি নতুন একটি সংকট তৈরি করতে পারে। গত ৮ মার্চ সংসদ সদস্যরা আকারে-ইঙ্গিতে সে কথাটাই বলেছেন। সরকারের একজন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী আছেন। প্রধানমন্ত্রীর একজন বিদ্যুৎ উপদেষ্টাও আছেন। জানি না, তারা সরকারকে কী উপদেশ দেন। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই বিদ্যুৎ সংকটের যদি সমাধান করা না যায়, তাহলে তা সরকারের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। 


ড. তারেক শামসুর রেহমান 
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ঃধৎবয়ঁৎধযসধহ@ুধযড়ড়.পড়স

0 comments:

Post a Comment