রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

বিশ্ব নেতৃত্বের যোগ্যতা হারিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র

ওয়াশিংটনে শেষ পর্যন্ত শাটডাউন পরিস্থিতির অবস্থান ঘটলেও ১৬ দিনের এই সংকট বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতাকে বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। ঋণসীমা বৃদ্ধির প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত পাস হওয়ায় ফেডারেল কর্মচারীরা কাজে ফিরে আসবেন বটে; কিন্তু আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে নতুন করে আবার সংকট দেখা দিতে পারে। বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র। বড় দেশ, বড় অর্থনীতি। জিডিপির পরিমাণ ১৫.৬৮ ট্রিলিয়ন ডলার। অথচ এই যুক্তরাষ্ট্রই কিনা ফেডারেল সরকারের কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছিল না। ৮ লাখ সরকারি কর্মচারীকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছিল। ভবিষ্যতে এদের কতজন কর্মস্থলে ফিরে আসতে পারবেন কিংবা ফিরে এলেও পুরনো বেতন পাবেন কিনা, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে Special supplemental Nutrition Program for women, infants and children. এর আওতায় মা ও শিশুরা ফেডারেল সরকারের কাছ থেকে যে সাহায্য পেতেন, তা বন্ধ হয়ে গেছে। ফেডারেল সরকারের হাতে কোনো টাকা ছিল না। তারা কোনো বিলই পরিশোধ করতে পারছিল না। শাটডাউনের কারণে সৃষ্টি হয়েছিল অচলাবস্থা। নতুন অর্থবছরে বাজেট বরাদ্দ এবং সেই সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা সংস্কার (ওবামা কেয়ার) নিয়ে রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেসের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ওবামার বিরোধের জের ধরে ওই সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল। ওবামার সঙ্গে রিপাবলিকানদের আলোচনাও ব্যর্থ হয়েছিল। ফলে যে অর্থনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল, তা কেন্দ্রীয় সরকারের গ্রহণযোগ্যতাকে একটা প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণ কীভাবে পাওয়া যাবে বলা মুশকিল। তবে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ফেডারেল সরকারের হাতে টাকা ছিল না। অথচ এর চেয়ে বেশি টাকা আছে ৯টি বড় বড় কোম্পানির। যেখানে ফেডারেল সরকারের রাজস্ব বিভাগের পরিচালনা ব্যয় ৩২ বিলিয়ন ডলার, সেখানে কয়েকটি কোম্পানির আর্থিক ভিত্তি ফেডারেল সরকারের চেয়ে বেশি। যেমন জেনারেল ইলেকট্রিক ৮৮.৮৬ বিলিয়ন ডলার, মাইক্রোসফট ৭৭.০২ বিলিয়ন, গুগল ৫৪.৪৩ বিলিয়ন, সিসকো ৫০.৬১ বিলিয়ন, অ্যাপেল ৪২.৬১ বিলিয়ন, ওরাকল ৩৯.১০ বিলিয়ন, ফোর্ড ৩৬.৩১ বিলিয়ন ডলার। এ থেকেই বোঝা যায়, ফেডারেল সরকারের আর্থিক ভিত্তি কত দুর্বল।

ফেডারেল সরকারের শাটডাউনের ফলে যুক্তরাষ্ট্র যে 'ইমেজ' সংকটের মুখে পড়েছে, তার একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া থেকে যাবে বলেই মনে হচ্ছে। একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আমেরিকান প্রগ্রেস ৭টি সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার কথা বলেছে। তারা বলছে, এর ফলে মেইন স্টেটের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার শীতকালে ঘরবাড়ি গরম রাখার যে সরকারি সাহায্য পেত, তা পাবে না। বেকার ভাতা বন্ধ হয়ে যাবে। শিশুদের জন্য আর্থিক সাহায্য বন্ধ হয়ে যাবে। 'ফুড স্টাম্প' কর্মসূচিও আর থাকবে না। বিশেষায়িত সেবা (অটিজম, পঙ্গুদের জন্য) ও স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ হয়ে যাবে। সর্বোপরি বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা মারাত্মকভাবে হ্রাস পাবে। শুধু তাই নয়, এই সংকট যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাকেও হুমকির মুখে ঠেলে দেবে। বিখ্যাত ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে রিচার্ড এন হাস এ সংক্রান্ত একটি প্রবন্ধ লিখেছেন গত ১১ অক্টোবর (The real threat to USA's National Security) । আসলে বড় অর্থনীতির দেশ হলেও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আর্থিক ভিত্তি শক্তিশালী নয়। ঋণ গ্রহণ করে (চীন থেকে) সরকার চালাতে হয়। মানুষের মাঝে যে বৈষম্য তা-ও কমাতে পারেনি সরকার।

মার্কিন পুঁজিবাদী সমাজে এক শ্রেণীর মানুষের কাছে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে দিনের পর দিন। অন্যদিকে বাড়ছিল দেশটির দরিদ্রতা। এই অসমতাই তরুণ সমাজকে ২০১১ সালে নিউইয়র্কের রাস্তায় টেনে নিয়ে গিয়েছিল। জুকোটি পার্ক বেছে নেওয়ার কারণও একটি_ জুকোটি পার্কের পাশেই ওয়ালস্ট্রিট, যেখানে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্টক একচেঞ্জ। আর তাই ওই স্টক একচেঞ্জকে গণ্য করা হয় পুঁজিবাদের প্রতীক হিসেবে। ওয়ালস্ট্রিটের আশপাশের ভবনে রয়েছে বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠনের সদর দফতর। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এখানে অবস্থিত। মার্কিন সমাজে অসমতা কীভাবে তৈরি হয়েছিল, তার একটা পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। যুক্তরাষ্ট্রে পুঁজিবাদী সমাজে ১৯৭০ সালে ধনিক শ্রেণী হিসেবে পরিচিতদের হাতে দেশের মোট আয়ের ৮ থেকে ৯ ভাগ অর্থ সঞ্চিত হতো। ২০১১ সালে তারা ভোগ করতেন মোট সম্পদের ২৩ দশমিক ৫ ভাগ। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (ব্রাকলে) অধ্যাপক ইমানুয়েল সাজের মতে, ১০ ভাগ আমেরিকান দেশটির মোট বেতনের ৪৯ দশমিক ৭ ভাগ গ্রহণ করে। অধ্যাপক ডেভিড গ্রে অপর এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, আমেরিকান ধনীদের মোট সম্পদের পরিমাণ ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রে গরিব জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের মোট সম্পদের চেয়েও বেশি। তার মতে, শীর্ষে থাকা এক ভাগ ধনী যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ৭০ ভাগের মালিক। আর নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিসের মতে, শীর্ষে থাকা ওই এক ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তরাষ্ট্রের মোট সম্পদের ৪০ ভাগ। অথচ ২৫ বছর আগে ধনীরা নিয়ন্ত্রণ করতেন মাত্র ১২ ভাগ সম্পদ। এই যে অসমতা ও সম্পদ কিছু ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়া ও সম্পদের সমতা রক্ষা করার জন্যই জন্ম হয়েছিল 'অকুপাই মুভমেন্টে'র। সেটা ছিল অনেকটা স্বাভাবিক একটা ব্যাপার_ একটা প্রতিবাদ। যুগে যুগে তরুণ সমাজ এভাবেই প্রতিবাদী হয়েছে। ষাটের দশকে ইউরোপে, বিশেষ করে জার্মানিতে তরুণ সমাজও এভাবে যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়েছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মতো সমাজেও যে অসমতা ও দরিদ্রতা রয়েছে তা ছিল অকল্পনীয়। খোদ নিউইয়র্ক শহরেও অনেক মানুষ রয়েছে, যাদের কোনো ঘরবাড়ি নেই। চাকরি নেই। ফুড স্ট্যাম্পে তাদের দিন চলে। এই নিউইয়র্ক শহরে ম্যানহাটন এলাকায় আমি অনেক যুদ্ধাহত আমেরিকানকে দেখেছি ভিক্ষা করে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র (ইরাক ও আফগানিস্তানে) যুদ্ধের পেছনে খরচ করেছে ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার, সেখানে একজন যুদ্ধাহত নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি রাষ্ট্রটি! অনেকের কাছেই এই বৈষম্য বিশ্বাস করা কঠিন! তাই হঠাৎ করেই 'অকুপাই ওয়ালস্ট্রিটে'র জন্ম হয়নি। ধীরে ধীরে তরুণ সমাজের ক্ষোভ বাড়ছিল আর তার বিস্ফোরণ ঘটেছিল নিউইয়র্কে ২০১১ সালে। কিন্তু তা কি আদৌ কোনো পরিবর্তন আনতে পেরেছে মার্কিন সমাজে? আমরা যখন 'ওয়াশিংটনে শাটডাউন পরিস্থিতি' নিয়ে আলোচনা করছি, ঠিক তখনই ওয়াশিংটনে প্রতিনিধি পরিষদে 'ফুড স্টাম্পে' অর্থ বরাদ্দ ৪০ মিলিয়ন ডলার কমানো হয়েছে। এই 'ফুড স্টাম্প' কর্মসূচি হচ্ছে ফেডারেল সরকারের একটি অনুদান, যার মাধ্যমে নিম্ন আয়ের গরিব পরিবারকে খাদ্য সহায়তা করা হয়। এই ফুড স্টাম্পের বিনিময়ে নিম্ন আয়ের মানুষরা খাদ্য কিনে থাকেন ফেডারেল সরকারের আর্থিক সহায়তায়। এখন রিপাবলিকানরা এটা বন্ধ করে দিতে চাচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, আগামী বছর ৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন মানুষ এই সহায়তা পাবে না। শুধু তাই নয়, এই কর্মসূচির আওতায় কয়েক লাখ শিশু দুপুরে স্কুলে কোনো 'ফ্রি লাঞ্চ' পাবে না। এর ফলে মানুষে মানুষে অসমতা ও দরিদ্রতা আরও বাড়বে। সাম্প্রতিক সময়ের অসমতার আরেকটি চিত্র তুলে ধরেছে 'সেন্টার ফর আমেরিকান প্রসেস' নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তারা দেখিয়েছে (১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৩), যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ৫টি শিশুর মাঝে একটি শিশু দরিদ্র। তাদের মতে, ২০১২ সালে ১৪ দশমিক ৫ ভাগ মানুষ (৪৯ মিলিয়ন) ক্ষুধার জন্য লড়াই করেছিল। আফ্রো-আমেরিকানদের এই সংখ্যা ২৫ ভাগ, হিসপানিক ২৩ ভাগ। ফুড স্টাম্পের কারণে (The Supplement Nutrition Assistance Program) ২০১১ সালে ২ দশমিক ১ মিলিয়ন শিশু দরিদ্রতার চক্র থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে। শুধু তাই নয়, ২ দশমিক ৬ মিলিয়ন সিনিয়র সিটিজেনও দরিদ্রতা দূর করতে পেরেছে।

এখনও শাটডাউন পরিস্থিতির স্থায়ী সমাধান হয়নি। আপাতত ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ফেডারেল সরকার ঋণ গ্রহণ করে সরকার চালাতে পারবে। কিন্তু তারপর? শাটডাউনের অবসান ঘটলেও মার্কিন অর্থনীতি নিয়ে অনেক প্রশ্নের জন্ম হয়েছে।
দৈনিক সমকাল, ২৬ অক্টোবর, ২০১৩।
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট

অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়্র

tsrahmanbd@yahoo.com

তত্ত্বাবধায়ক বনাম সর্বদলীয় সরকার

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে সর্বদলীয় সরকারের যে প্রস্তাব করেছেন, খালেদা জিয়া এক সংবাদ সম্মেলনে তার প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী যেখানে একটি সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব করেছেন, সেখানে খালেদা জিয়া একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রস্তাব করেছেন। খালেদা জিয়ার প্রস্তাবে রয়েছে বিগত ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পাঁচজন করে সদস্য দিয়ে মোট ১০ জনের সমন¦য়ে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এতে পাঁচজনের নাম প্রস্তাব করবে আওয়ামী লীগ, আর পাঁচজনের নাম প্রস্তাব করবে বিএনপি। সর্বোপরি এই সরকারের প্রধান যিনি হবেন, তার ব্যাপারে আলোচনা হতে পারে। স্পষ্টই খালেদা জিয়ার এই বক্তব্য প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের ঠিক উল্টো। খালেদা জিয়া যে সরকারের প্রস্তাব করেছেন, তা সংবিধানে নেই। এটা করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। যেহেতু সংসদের কার্যক্রম এখনও চলছে, সেহেতু তত্ত্বগতভাবে সংবিধান সংশোধন সম্ভব।

কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা আছে বলে সরকার ও সরকারি দল মনে করে না। তাহলে সঙ্কট কি অনিবার্য? সমঝোতা কি আদৌ সম্ভব নয়? আওয়ামী লীগ খালেদা জিয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় সঙ্কটের গভীরতা আরও বাড়ল। প্রধানমন্ত্রীর সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাবেরও কোনো জট খোলেনি। এরই মধ্যে শেখ হাসিনা-এরশাদ বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠক নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে ধূম্রজাল। সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন। যেখানে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, নির্বাচনে বিএনপি না এলে জাতীয় পার্টি বিরোধী দলে যাবে; সেখানে এরশাদ স্বয়ং জানিয়ে দিলেন, সব দল নির্বাচনে না গেলে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে যাবে না। জাতীয় পার্টি মহাজোটে থাকবে না, একথা এরশাদের মুখ থেকে অনেকবার উচ্চারিত হয়েছে। এখনও এটা স্পষ্ট নয় যে, তিনি সত্যি সত্যিই মহাজোট ছাড়বেন কিনা?

এখন স্পষ্টতই জাতি বিভক্ত হয়ে আছে। শুধু বিভক্ত নয়, বরং একটি বড় ধরনের সঙ্কটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। একদিকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, অন্যদিকে বাস্তবতা। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে নির্বাচন হতে হবে। অন্যদিকে বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলে, ওই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। দেশের এক চরম সঙ্কটকালে প্রধানমন্ত্রী এ ভাষণ দিলেন। কিন্তু এই ভাষণের মধ্যে দিয়ে দেশের চলমান সঙ্কটের সমাধান হবে, সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। কেননা, মূল যে সমস্যাটিকে কেন্দ্র কের বর্তমান সঙ্কটের জন্ম, অর্থাৎ একটি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠনের যে দাবি, সে দাবির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী এতটুকুও ছাড় দেননি। বিকল্প হিসেবে তিনি সর্বদলীয় সরকার গঠনের একটি প্রস্তাব করেছেন। এই প্রস্তাব নিয়েও আছে নানা কথা। কেননা, একটি সর্বদলীয় সরকার গঠনের কোনো কথা সংবিধানে নেই। প্রধানমন্ত্রী কোন ধারাবলে এই সরকার গঠন করবেন? এটা যদি তিনি করেন, তাহলে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠতে পারে। সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা বলা হয়েছে। সংবিধানে বর্ণিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আর প্রধানমন্ত্রীর সর্বদলীয় সরকার পরস্পর সাংঘর্ষিক। একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি দায়িত্ব নেয়ার পরপরই যদি একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করতেন, তাহলে কোনো প্রশ্ন উঠত না। এটা প্রধানমন্ত্রীর অধিকার। এখন নির্বাচনের তিন মাস আগে শুধু নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি সর্বদলীয় সরকার, যা সংবিধানে লিপিবদ্ধ নেই, এটা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। উপরন্তু সর্বদলীয় সরকারের প্রধান কে হবেন, সে ব্যাপারে তিনি স্পষ্ট কোনো ধারণা দেননি। সরকারের নীতিনির্ধারকদের বক্তব্য থেকে এটা বোঝা যায় যে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই এই সরকারের প্রধান হবেন। এক্ষেত্রে একজন দলীয় প্রধান হিসেবে তিনি যদি সরকার প্রধান থাকেন, তাহলে নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে কিনাÑ এ ধরনের প্রশ্ন উঠতে পারে। প্রধানমন্ত্রী সর্বদলীয় বলতে কোন কোন দলের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে একটি মন্ত্রিসভা গঠন করবেন, এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। তার নেতৃত্বে একটি মহাজোট সরকার ক্ষমতায়। ওই মহাজোটে জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ বেশ কিছু ছোট দল রয়েছে। মন্ত্রিসভায় ওয়ার্কার্স পার্টির কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। এক্ষেত্রে বিএনপির দু’জন থেকে তিনজন মন্ত্রী দিয়ে তো মন্ত্রিসভায় ব্যালেন্স হবে না। এখন সর্বদলীয় সরকারের নামে মহাজোট সরকারের প্রতিনিধিত্বই থেকে যাবে। তাতে জট খুলবে না। প্রশ্ন হচ্ছে, সর্বদলীয় সরকারে কী জামায়াত থাকবে? জামায়াতের সংসদে প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। ধারণা করছি, জামায়াত সেখানে থাকবে না। কেননা সরকারের ‘বন্ধুরা’ বিশেষ করে বাম সংগঠনগুলো এটা চাইবে না। যুদ্ধাপরাধী মামলায় জামায়াতের নেতারা অভিযুক্ত ও শাস্তিপ্রাপ্ত। তাদের ব্যাপারে আপত্তি থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু জামায়াতকে বাদ দিলে (?) কী সর্বদলীয় চরিত্র পাবে ওই মন্ত্রিসভা?

প্রধানমন্ত্রী কবে নির্বাচন হবে, তার একটি ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি ২৫ অক্টোবরের পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে চান। সংবিধানে এভাবেই লেখা আছে। এটা সংবিধানসম্মত। তবে মনে রাখতে হবে, একটি নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে যদি সমঝোতায় উপনীত হওয়া না যায়, তাহলে ৯০ দিনের মাঝে নির্বাচন করা যাবে বটে। কিন্তু প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ তাতে না থাকলে তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। আসলে মূল প্রশ্ন যা তা হচ্ছে, বিরোধী দল বিএনপিকে আস্থায় নেয়া। এ কাজটি করতে হবে সরকারকেই। সংসদে বিএনপির কম আসন রয়েছেÑ এটা সত্য কথা। কিন্তু এই কম আসন দিয়ে বিএনপিকে বিচার করা হলে বিএনপির প্রতি অবিচার করা হবে। বিগত নির্বাচনেও বিএনপি ৩০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। চারদলীয় জোটের প্রাপ্ত ভোটের হার শতকরা প্রায় ৩৮ ভাগ। এখন বিএনপি বলছে, সর্বদলীয় সরকারে তারা যোগ দেবে না। বরং তারা নির্বাচন প্রতিহত করার কথা বলছে। তাহলে ক্ষমতাসীন মহাজোটকে এককভাবে নির্বাচন করতে হবে। সাংবিধানিকভাবে সেটা ঠিক আছে। কিন্তু অনেক সময় সংবিধানের বাইরে গিয়েও জাতির বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে ঐক্য গড়ে তুলতে হয়। সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতিতে কেনিয়া ও জিম্বাবুয়ের দৃষ্টান্ত আমরা দিতে পারি। আমাদের কাছে পাকিস্তান, নেপাল কিংবা গ্রিস ও বুলগেরিয়ার ইতিহাসও আছে। আর মালদ্বীপের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট নাশিদও বলেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা।

সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে জনমত জরিপের ফল প্রকাশিত হয়েছে। জনমত জরিপে দেখা গেছে, এ মুহূর্তে যদি ভোট হয়, তাহলে শতকরা ৫০ দশমিক ৩ ভাগ ভোট পড়বে বিএনপির ঘরে। আর জামায়াতকে নিয়ে এই হার ৫৩ দশমিক ২০ ভাগ। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভোটের হার ৩৬ দশমিক ৫০। বিদেশে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পশ্চিম ইউরোপে এই জনমত জরিপ নির্বাচনে একটা বড় ভূমিকা রাখে। প্রেসিডেন্ট ওবামা যখন দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন তখন জনমত জরিপই জানিয়ে দিয়েছিল, তিনি প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন। নির্বাচনের ফলাফলে তাই জনমত জরিপের প্রতিফলন ঘটেছিল। বাংলাদেশে এই জনমত জরিপ নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। সত্যিকার অর্থেই এই জনমতে সাধারণ মানুষের মতামত কতটুকু প্রতিফলিত হয়, এ নিয়ে সন্দেহ রয়েছে অনেকের। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে এ জনমত জরিপ কিছুটা হলেও একটা আবেদন তুলবে। তবে বলতে দ্বিধা নেই, এ জনমত জরিপ দিয়ে বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতিকে বোঝা যাবে না।

পরিস্থিতি যা, তাতে করে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হতে বাধ্য। নির্বাচনকালীন একটি সরকার গঠনের সম্ভাবনা আদৌ নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেখে সরকার নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিএনপির নেতারা বলছেন, কোনো অবস্থাতেই নির্বাচন করতে দেয়া হবে না। এই যে পরস্পরবিরোধী মনোভাব, তা কি বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র বিনির্মাণে আদৌ সাহায্য করবে? একজন সাধারণ মানুষকে এ প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করলে তিনিও না বলবেন। আমরা বারবার বলেছি, আস্থার সম্পর্ক স্থাপন না করলে টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। দেশ আজ এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী কি আবার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন? প্রধানমন্ত্রীর আগের ভাষণে নতুন কিছু ছিল না। সেই পুরনো কথা। উন্নয়নের কথা। বিরোধী দলের তথাকথিত অপতৎপরতার কথা! প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যেও জট খোলার কোনো সম্ভাবনা নেই। যারা সরকারে থাকেন, তারা অভিভাবক। উদ্যোগ তাদেরই নিতে হয়। এক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগই ছিল প্রধান। কিন্তু চলমান সঙ্কটের সমাধানে সরকারের কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। ফলে সঙ্কটের গভীরতা আরও বাড়ছে। খালেদা জিয়া চীনা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাতে দুই মহাসচিব পর্যায়ে আলোচনার প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু সরকার তাতে আগ্রহ দেখায়নি। জাতিসংঘের মহাসচিবের দূতের বাংলাদেশ সফরের সময় বিরোধী দলকে একটি চিঠি লেখার কথা ছিল সরকারের। সেই চিঠি আর লেখা হয়নি। তবে এখন লেখা হয়েছে ও হচ্ছে বলে জানা গেছে। আলাপ হয়েছে ফোনে ফোনেও।

রাজনীতিতে ‘রিয়েল পলিটিক্স’ বা বাস্তববাদী যে নীতির কথা আমরা বলি, তা এখন আর দৃশ্যমান নয়। জাতির সামনে কোনো অভিভাবকের দেখাও মিলছে না, যিনি জাতিকে পথ দেখাবেন। সরকার নির্বাচন করতেই পারে। কিন্তু ওই নির্বাচন দিয়ে বাংলাদেশে বিকাশমান গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেয়া যাবে না। চাই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব। চাই সমঝোতা। চাই সংলাপ। খালেদা জিয়া এরই মধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন তার কথা। মানুষ আতঙ্কে ভুগছে। লাগাতার হরতাল আর অবরোধের কথা বলা হচ্ছে। কোন পথে এখন বাংলাদেশ?

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ, ২৫ অক্টোবর ২০১৩
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য ও কলাম লেখক

tsrahimoubd@yahoo.com - See more at: http://alokitobangladesh.com/editorial/2013/10/26/30254#sthash.lgrTAFge.6oURipUr.dpuf

সমাধান কোন পথে

আগামী ২৫ অক্টোবরের পর দা-কুড়াল নিয়ে তৈরি থাকতে নির্দেশ দিয়েছিলেন ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা। এরপর থেকে তিনি উধাও। পুলিশ তাকে খুঁজছে। একটি অনলাইন সংবাদপত্রে পুলিশের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, তিনি সম্ভবত দা-কুড়াল বানাচ্ছেন। এ কথাটার পেছনে সত্যতা হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু এটা তো সত্য যে, রাজনীতিতে ‘লগি-বৈঠার’ পর ‘দা-কুড়াল’ এসে গেছে। বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার ৪২ বছরে পা দিয়েছে। আমাদের দুর্ভাগ্য এখানেই যে, সাধারণ মানুষের প্রতি আস্থা না রেখেই আমাদের রাজনীতিকরা লগি-বৈঠা আর দা-কুড়ালে গণতন্ত্র খুঁজছেন! জনাব খোকা বিএনপির শীর্ষ নেতাদের একজন নন। স্থায়ী পরিষদের তিনি সদস্য নন। তবে ঢাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। খোকা ছাড়া ঢাকায় জনসভা করা চিন্তাও করা যায় না এবং তিনি বেগম জিয়ার আস্থাভাজন-এ কথাটা বিএনপি সার্কেলে সবাই জানেন। তাই তিনি যখন দা-কুড়াল নিয়ে প্রস্তুত থাকার কথা বলেন, তখন আমি আতঙ্কিত না হয়ে পারি না। স্মরণ করিয়ে দেয় ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের কথা, যখন প্রকাশ্যে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়েছিল। বাংলাদেশের মতো দেশে প্রকাশ্যে দিনের আলোকে মানুষ পিটিয়ে মারার বিষয়টি ছিল অকল্পনীয়। রাজনীতিবিদদের উস্কানিমূলক বক্তব্যে মানুষ কত সহিংস হয়ে উঠতে পারে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের ঘটনা ছিল এর বড় প্রমাণ। তারপর অনেক সময় পার হয়েছে। দোষীদের চিহ্নিত করে বিচার করা সম্ভব হয়নি। ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে। জনগণ ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে বিপুল সংখ্যক ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় পাঠিয়েছে। আজ সাত বছর পর দা-কুড়ালের কথা শুনলাম। এই নিউইয়র্ক শহরে বসেও দেশের রাজনীতির উত্তাপ খুঁজে পাই। দুঃখ লাগে আমরা এত বছর পরও মানবিক হতে পারিনি। ক্ষমতার জন্য কখনো বলছি ‘লগি-বৈঠার’ কথা, কখনো বলছি ‘দা-কুড়ালের’ কথা! সাধারণ মানুষের প্রতি আস্থা রাখতে পারছি না। অথচ এই সাধারণ মানুষের ভোটেই ক্ষমতার পালা-বদল ঘটে। আজ এই দা-কুড়ালের কথা শুনলাম এমন একসময় যখন জাতি প্রস্তুত হচ্ছে নতুন একটি সংসদ গঠন করার জন্য। কিন্তু সেখানেও নানা প্রশ্ন, নানা জিজ্ঞাসা। একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য যা প্রয়োজন, তা এখানে অনুপস্থিত।
ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে তার ভাষণে নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তা নাকচ করে দলটির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলন করে বিকল্প প্রস্তাব দেন। তিনি বলেছেন, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সদস্যদের নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করুন। যদিও তার প্রস্তাবে সাবেক উপদেষ্টাদের অনেকেই সরাসরি না বলেছেন, যা পত্র-পত্রিকায় এসেছে। তাছাড়া সেই দু-সরকারের কেউ কেউ ইতোমধ্যে প্রয়াতও হয়েছেন। কারো কারো শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। আওয়ামী লীগ ও তাদের জোটের কোনো কোনো শরিক দল বেগম খালেদা জিয়ার প্রস্তাব নাকচ করে দেয় সঙ্গে সঙ্গে। এর মধ্যে সৈয়দ আশরাফকে মির্জা ফখরুল একটি চিঠি দিয়েছেন এবং সৈয়দ আশরাফ এর পরিপ্রেক্ষিতে মির্জা ফখরুলকে ফোনও করেছেন। বলা যায়, এই নতুন চিত্র কিছুটা হলেও জনমনে স্বস্তির রেখাপাত করেছে এবং সংলাপের অন্তত একটি সরু রাস্তা হলেও তৈরি হয়েছে। আশরাফ-ফখরুলের ফোনালাপ বিদ্যমান জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে অবশ্যই একটি ইতিবাচক দিক বলা যায়। এই প্রক্রিয়া এগিয়ে গেলেই মঙ্গল। অন্যদিকে বিদেশি কূটনীতিকরা সংকট নিরসনে তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। সম্প্রতি রাজনীতিতে অনেক কিছুই ঘটছে যা আগে থেকে আঁচ করা যাচ্ছে না। সংসদের চলতি অধিবেশনেও বিএনপি যোগ দিচ্ছে এমন সংবাদ ২২ অক্টোবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সংকট থেকে বড় দু’দলই যে বেরিয়ে আসতে চাইছে এর একটা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, এটি খুব আশার কথা বলা যায়।
অতি সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে জনমত জরিপের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। জনমত জরিপে দেখা গেছে, এই মুহূর্তে যদি ভোট হয়, তাহলে শতকরা ৫০ দশমিক ৩ ভাগ ভোট পড়বে বিএনপির ঘরে। আর জামায়াতকে নিয়ে এই হার ৫৩ দশমিক ২০ ভাগ। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভোটের হার ৩৬ দশমিক ৫০। বিদেশে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পশ্চিম ইউরোপে এই জনমত জরিপ নির্বাচনে একটা বড় ভূমিকা রাখে। প্রেসিডেন্ট ওবামা যখন দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন তখন জনমত জরিপই জানিয়ে দিয়েছিল তিনি প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন। নির্বাচনের ফলাফলে তাই জনমত জরিপের প্রতিফলন ঘটেছিল। বাংলাদেশে এই জনমত জরিপ নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। সত্যিকার অর্থেই এই জনমতে সাধারণ মানুষের মতামত কতটুকু প্রতিফলিত হয়েছে বা হয়, এ নিয়ে সন্দেহ রয়েছে অনেকের। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে এই জনমত জরিপ কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলবে। তবে এই জনমত জরিপ দিয়ে বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতিকে বোঝা যাবে না। বাংলাদেশে এখন ২৫ অক্টোবরকে ঘিরে একটা শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ওই দিন বিএনপি ও আওয়ামী লীগ ঢাকায় জনসভা আহ্বান করেছে। যদিও বিএনপি জনসভার অনুমতি পায়নি। বিএনপি জনসভা করতে পারবে বলেও মনে হয় না। তাহলে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে? বিএনপিকে জনসভা করতে না দিলে বিএনপির কর্মীরা কী আরো সহিংস হয়ে উঠবে না? পরিস্থিতি যা তাতে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের সম্ভাবনা আদৌ নেই এমনটিই মনে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেখে সরকার নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিএনপির নেতারা বলেছেন এমন কোনো অবস্থাতেই নির্বাচন করতে দেয়া হবে না। এই যে পরস্পরবিরোধী মনোভাব, তা কি বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র বিনির্মাণে আদৌ সাহায্য করবে? একজন সাধারণ মানুষকে এ প্রশ্নটা করলে তিনিও না বলবেন। আমরা বারবার বলছি আস্থার সম্পর্ক স্থাপন না করলে টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। দেশ আজ এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী ১৮ অক্টোবর জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছেন সেখানে নতুন কিছু নেই। সেই পুরনো কথা। উন্নয়নের কথা। বিরোধী দলের তথাকথিত অপ-তৎপরতার কথা! যারা সরকারে থাকেন, তারা অভিভাবক। উদ্যোগ তাদের নিতে হয়। এক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগটাই প্রধান। কিন্তু চলমান সংকটের সমাধানে সরকারের কোনো আন্তরিক উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। ফলে সংকটের গভীরতা আরো বাড়ছে। বেগম জিয়া চীনা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাতে দুই মহাসচিব পর্যায় আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার তাতে আগ্রহ দেখায়নি। জাতিসংঘের মহাসচিবের দূতের বাংলাদেশ সফরের সময় বিরোধী দলকে একটি চিঠি লেখার কথা ছিল সরকারের। সেই চিঠি আর লেখা হয়নি।
নিউইয়র্কে প্রধানমন্ত্রী টেকসই গণতন্ত্রের যে কথা বলেছেন, তাতে প্রধান বিরোধী দলের কোনো অংশগ্রহণ নেই। অথচ প্রধান বিরোধী দল এবং জোট মোট ভোটারদের ৩৮ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে। যখন ৩৮ ভাগ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব এখানে নেই, সেই গণতন্ত্র টেকসই হবে কীভাবে? বিরোধী দলের প্রতি জিজ্ঞাসা ও আস্থা স্থাপনের অপর নামই গণতন্ত্র। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সেটা অনুপস্থিত। বিরোধী দলকে বাইরে রেখে যে নির্বাচন, তা বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র উপহার দেবে না। নির্বাচনের প্রশ্নে একটা সমাধান প্রয়োজন। নির্বাচনকালীন একটি সরকার দরকার, যাতে প্রধান বিরোধী দলের আস্থা থাকবে। সংবিধানের আওতায়ও একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু আন্তরিকতার। সেই সঙ্গে বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করা, জনসভা করতে না দেয়া, এই মানসিকতার পরিবর্তন করাও জরুরি।
প্রধানমন্ত্রীর জন্য একটি সুযোগ তৈরি হয়েছিল। তিনি ইতিহাসে স্থান করে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি সম্ভবত বেছে নিয়েছেন এক দলীয় নির্বাচন। বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে নির্বাচনে অংশ নেয়ার লোকের অভাব নেই। রাজনৈতিক দলেরও অভাব নেই। নির্বাচন হতেই পারে। কিন্তু গ্রহণযোগ্যতা? ১৯৮৬ সালে দেশে নির্বাচন হয়েছিল। তাতে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত অংশ নিয়েছিল। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশ না নেয়ায় সেই নির্বাচন কোনো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তাই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন হওয়ার জন্য ওই সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা হয়েছিল। তাতে আওয়ামী লীগ অংশ নেয়নি। ফলে সংসদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। ওই সময় সংসদ টিকে ছিল মাত্র ১৩ দিন। যারা ওই সময় সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাদের নিয়েও বিতর্ক কম হয়নি। বিতর্কের মুখে সংসদ ভেঙে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই সংসদের গুরুত্ব আছে একটি কারণে-আর তা হচ্ছে ওই সংসদেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস হয়েছিল। তারপরের ইতিহাস সবার জানা। বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাস একটি দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় সপ্তম (১৯৯৬), অষ্টম (২০০১) ও নবম (২০০৮) জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছিল এবং ওই তিনটি নির্বাচন ব্যাপক গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দু’দুবার বিজয়ী হয়ে (১৯৯৬, ২০০৮) সরকার গঠন করেছেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার এখন ইতিহাস। ওই সরকার ভালো ছিল, কী মন্দ ছিল, তা নিয়ে একসময় গবেষণা হবে। যে প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল ঘোষিত হয়েছে, তা বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। আদালতের রায়ে ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল ঘোষিত হয়েছে, কিন্তু উচ্চ আদালতের সুপারিশ গ্রহণ করা হয়নি। অনেকেই বলার চেষ্টা করেন অনির্বাচিত একটি সরকার গণতন্ত্রের পরিপন্থী। এর পেছনে ‘সত্যতা’ যতটুকু আছে, তার চাইতেও বেশি ‘সত্য’ হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে এ ধরনের একটি সরকারের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। আমরা টেকসই গণতন্ত্র চাই বটে কিন্তু একজন দলীয় প্রধানকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেখে এবং তাকে সব সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যে নির্বাচন, সেই নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে দেশে টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। সরকার ২৫ অক্টোবর থেকে ২৪ জানুয়ারির (২০১৪) মধ্যে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন করবে। সরকার অপেক্ষা করছে বিএনপির সিদ্ধান্তের জন্য। নিঃসন্দেহে বিএনপি তথা ১৮ দলীয় জোটের জন্য এটা একটা কঠিন সময়। নির্বাচনকালীন সরকারের দাবিকে উহ্য রেখে বিএনপি যদি নির্বাচনে যায়(?), তাহলে সরকারের অবস্থান শক্তিশালী হবে। সরকারের লেজিটেমেসি তাতে আরো বাড়বে। আর বিএনপি যদি নির্বাচনে না যায়(?), তাহলেও সরকার সংবিধানের দোহাই দিয়ে নির্বাচন করবে ও পুনরায় সরকার গঠন করবে। এক্ষেত্রে একটি ‘সরকার সমর্থক’ বিরোধী দলের জন্ম হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। হয়তো সেই সরকার ন্যূনতম দু’বছর ক্ষমতায় থাকবে এবং রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে। ততদিনে বিএনপি তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারবে কিনা, সেটাই প্রশ্ন হয়ে থাকবে অনেকের কাছে। নিঃসন্দেহে প্রধানমন্ত্রী একটি ঝুঁকি নেবেন যদি তিনি এককভাবে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এতে অস্থিরতা আরো বাড়বে। এই অস্থিরিতা বাংলাদেশের বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্য কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। টেকসই গণতন্ত্রের জন্য তা হবে ছুরিকাঘাতের শামিল। সর্বশেষ জার্মান সংসদ নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে দুটি প্রধান দলের মাঝে একটি সংসদীয় ঐক্য হতে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন সিডিইউ এবং প্রধান বিরোধী দল এসপিডি একটি কোয়ালিশন সরকারে যোগ দিতে যাচ্ছে। ওটা আমাদের জন্য একটা দৃষ্টান্ত যে সরকার ও বিরোধী দলের মাঝেও ঐক্য সম্ভব ও সরকার গঠন করা সম্ভব। আমাদের জাতীয় নেতারা কি বিষয়টি উপলব্ধি করেন? কোনো বিদেশি দাতাগোষ্ঠী নয়, জাতিসংঘও নয়; বরং আমাদের সমস্যা আমাদেরই সমাধান করতে হবে। বাইরে থেকে কেউ এসে আমাদের সমস্যার সমাধান করে দেবে না।
এখনো মনে করি একটা সমাধান খুঁজে বের করা সম্ভব। যেহেতু সংবিধান হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনার চাবিকাঠি এমন অবস্থায়। সংবিধানের বর্তমান কাঠামো অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলেও, বাস্তবতা হচ্ছে আমরা সংবিধানকে অস্বীকার করতে পারব না। সংবিধানের আলোকেও একটি সমাধান বের করা সম্ভব। এক্ষেত্রে শেখ হাসিনা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান থাকতে পারেন। তবে স্বরাষ্ট্র ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব তুলে দিতে হবে বিরোধী দল মনোনীত প্রার্থীদের কাছে। বেগম জিয়া নিজে অথবা সংসদের একজন বিএনপির প্রার্থীর কাছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বটি থাকতে হবে। ১০ জন সদস্য নিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা গঠিত হবে। দুটি বড় দলের প্রস্তাবিত নাম নিয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। এভাবেই একটা সমাধান বের করা সম্ভব, সেখানে দরকার শুধু আন্তরিকতার। ইতিহাসের এক কঠিন সময় আমরা পার করছি। রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতা, আমাদের ‘রাজনীতির ব্ল্যাকহোলে’ ঠেলে
দিতে পারে। ‘খাদের কিনারে’ দাঁড়িয়ে রয়েছে
দেশের রাজনীতি। এই সংকটকালে আমাদের রাজনীতিবিদরা ভুল করবেন না, এটাই শুধু আমাদের প্রত্যাশা।
দৈনিক মানবকন্ঠ, ২৪ অক্টোবর ২০১৩
লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
 

জনমত জরিপ ও টেকসই গণতন্ত্রের স্বরূপ

একটি জাতীয় দৈনিকে জনমত জরিপের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। জরিপে দেখা গেছে, এ মুহূর্তে যদি ভোট হয়, তাহলে শতকরা ৫০ দশমিক ৩ ভাগ ভোট পড়বে বিএনপির ঘরে। আর জামায়াতকে নিয়ে এই হার ৫৩ দশমিক ২০ ভাগ। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভোটের হার ৩৬ দশমিক ৫০। বিদেশে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পশ্চিম ইউরোপে এ ধরনের জনমত জরিপ নির্বাচনে একটা বড় ভূমিকা রাখে। বারাক ওবামা যখন দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তখন জনমত জরিপই জানিয়ে দিয়েছিল তিনি প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন। নির্বাচনের ফলাফলে সেই জনমত জরিপের প্রতিফলন ঘটেছিল। বাংলাদেশে এ ধরনের জনমত জরিপ নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। সত্যিকার অর্থেই এ জনমতে সাধারণ মানুষের মতামত কতটুকু প্রতিফলিত হয়, এ নিয়ে সন্দেহ রয়েছে অনেকের। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে এ জনমত জরিপ কিছুটা হলেও একটা আবেদন তুলবে। তবে বলতে দ্বিধা নেই, এ জরিপ দিয়ে দেশের চলমান পরিস্থিতি বোঝা যাবে না।
বাংলাদেশে এখন ২৫ অক্টোবরকে ঘিরে একটা শংকা তৈরি হয়েছে। আরও একটা শংকা তৈরি হয়েছে ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। খোকা ‘দা-কুড়াল’ নিয়ে তৈরি থাকার জন্য বিএনপির কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সঙ্গত কারণেই যে প্রশ্নটি আসে তা হচ্ছে, এই ‘দা-কুড়ালের’ আহ্বান বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কোনো অবদান রাখাবে কিনা? আমরা ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের ‘লগি-বৈঠা’ নিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম করার খবরও জানি। দুঃখজনক হলেও সত্য, সেই একই স্টাইলে আমরা প্রত্যক্ষ করছি ‘দা-কুড়ালের’ আহ্বান। এর পেছনে হয়তো অনেকে যুক্তি দেবেন যে, ২০০৬ সালের ‘লগি-বৈঠার’ আহ্বানে যদি কোনো দোষ না হয়ে থাকে, তাহলে আজকের ‘দা-কুড়ালের’ আহ্বানেও কোনো দোষ নেই! এ নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। যে কেউ এ ধরনের কর্মসূচির পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে পারেন। এ ধরনের আহ্বান কোনো মতেই গণতন্ত্রের ভাষা হতে পারে না। গণতন্ত্র যে সহনশীলতার কথা বলে, এ ধরনের আহ্বানে সেই সহনশীলতা প্রকাশ পায় না। টেকসই গণতন্ত্র বিনির্মাণে এটা একটা বড় সমস্যা। এ ধরনের আহ্বান দেশে সহিংসতার জন্ম দিতে পারে। সরকার এটাকে তার স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে। এবং সরকার তা-ই করেছে। বিএনপি কার্যালয় কোরবানির পর থেকেই অবরুদ্ধ হয়ে আছে। বিএনপিকে ২৫ অক্টোবরের জনসভা করার অনুমতি দেয়া হয়নি। জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ সংকট নিরসনের আশা জাগালেও রাজধানীতে সব ধরনের মিছিল-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে সরকারের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
আসলে টেকসই গণতন্ত্রের সংজ্ঞা কী? যেখানে মহাজোট সরকারের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টিও বলছে, তারা একদলীয় নির্বাচনে অংশ নেবে না, সেখানে প্রধানমন্ত্রী টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন কীভাবে? দেয়ালের লিখন থেকে আমরা কেউ কিছু শিখি না। প্রধানমন্ত্রী অতীতে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের জন্য। দেশে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনিই জামায়াতের সঙ্গে একাÍ হয়ে ১৯৯৫-৯৬ সালে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। সেদিনের ‘মিত্র’ আজকের শত্র“! আজ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নেই। তবে একটি সুযোগ ছিল আরও দুই টার্ম রাখার। কিন্তু তিনি তা রাখেননি। আজ তিনি যখন টেকসই গণতন্ত্রের কথা বলেন, তখন প্রশ্ন তো উঠবেই- শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেখে যে গণতন্ত্র, তাকে আমরা টেকসই গণতন্ত্র বলব কিনা? তার উপদেষ্টারা, মন্ত্রীরা, দলের নীতিনির্ধারকরা যে ভাষায় কথা বলেন, বিরোধী দলকে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখেন, তা টেকসই গণতন্ত্রের নমুনা কি? বনমন্ত্রীর একটি বক্তব্য- বেগম জিয়া তালেবানদের নেতা! তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে এ ধরনের বক্তব্য রাখা কতটুকু গণতান্ত্রিক কিংবা বনমন্ত্রীর সৌজন্যবোধ কতটুকু, সে প্রশ্ন করাই যায়। শুধু বনমন্ত্রী কেন, মোহাম্মদ নাসিমের একটি বক্তব্য ছাপা হয়েছে অনলাইনে। তার বক্তব্য ছাপা হয়েছে এভাবে, ‘খালেদা জিয়ার বুলেট তাড়া করে বেড়াচ্ছে শেখ হাসিনাকে’ (আরটিএন, ২৪ সেপ্টেম্বর)। এ দুটি বক্তব্য এটা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যে, রাজনৈতিক শিষ্টাচার বলতে যা বোঝায়, তা আওয়ামী লীগের নেতারা জানেন না। বিগত নির্বাচনে নাসিম সাহেব অযোগ্য ঘোষিত হয়েছিলেন। এখন আবার লাইম লাইটে আসতে চান। আবারও মন্ত্রী হতে চান! প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করার জন্যই এসব কথা বলা। প্রথমবারের মতো সংসদে আসা বনমন্ত্রীর বেগম জিয়া সম্পর্কে মন্তব্য করা ঠিক হয়নি। রাজনীতিতে শিষ্টাচার একেবারেই উঠে গেছে। অপর পক্ষকে শ্রদ্ধাভরে কথা বলার (কিংবা রাজনৈতিকভাবে আক্রমণ করা) যে রেওয়াজ এক সময় ছিল, তা আর নেই। তরুণ প্রজন্ম কী শিখছে? বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদ কিংবা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিম তরুণ প্রজন্মের রাজনীতিকদের কী শেখাচ্ছেন?
নিউইয়র্কে প্রধানমন্ত্রী টেকসই গণতন্ত্রের যে কথা বলেছেন, তাতে প্রধান বিরোধী দলের কোনো অংশগ্রহণ নেই। অথচ প্রধান বিরোধী দল ও জোট মোট ভোটারদের ৩৮ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে। এখন ৩৮ ভাগ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব যেখানে নেই, সেই গণতন্ত্র টেকসই হল কীভাবে? বিরোধী দলের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপনের অপর নামই গণতন্ত্র। বাংলাদেশে এ মুহূর্তে সেটা অনুপস্থিত। বিরোধী দলকে বাইরে রেখে যে নির্বাচন, তা কি বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র উপহার দেবে? নির্বাচনের প্রশ্নে একটা সমাধান প্রয়োজন। নির্বাচনকালীন একটি সরকার দরকার, যার ওপর প্রধান বিরোধী দলের আস্থা থাকবে। প্রধানমন্ত্রী সংবিধানের দোহাই দেন বটে, কিন্তু সংবিধানের আওতায়ও একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু আন্তরিকতার। সেই সঙ্গে ‘বিচার মানি, কিন্তু তালগাছটা আমার’- এ মানসিকতা পরিবর্তন করাও জরুরি।
প্রধানমন্ত্রীর জন্য একটি সুযোগ তৈরি হয়েছিল। তিনি ইতিহাসে স্থান করে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি সম্ভবত বেছে নিয়েছেন একদলীয় নির্বাচন। বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে নির্বাচনে অংশ নেয়ার লোকের অভাব নেই। রাজনৈতিক দলেরও অভাব নেই। নির্বাচন হতেই পারে। কিন্তু গ্রহণযোগ্যতা? ১৯৮৬ সালে দেশে নির্বাচন হয়েছিল। তাতে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত অংশ নিয়েছিল। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশ না নেয়ায় সেই নির্বাচন কোনো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করার জন্য ওই সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা হয়েছিল। তাতে আওয়ামী লীগ অংশ নেয়নি। ফলে সংসদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। সে সময় সংসদ টিকে ছিল মাত্র ১৩ দিন। যারা ওই সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাদের নিয়েও বিতর্ক কম হয়নি। বিতর্কের মুখে সংসদ ভেঙে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই সংসদের গুরুত্ব আছে একটি কারণে আর তা হচ্ছে, ওই সংসদেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস হয়েছিল। এর পরের ইতিহাস সবার জানা। বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে একটি দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় সপ্তম (১৯৯৬), অষ্টম (২০০১) ও নবম (২০০৮) জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছিল এবং ওই তিনটি নির্বাচন ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দু’দুবার বিজয়ী হয়ে (১৯৯৬, ২০০৮) সরকার গঠন করেছেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার এখন ইতিহাস। এ সরকার ভালো কী মন্দ ছিল, তা নিয়ে একসময় গবেষণা হবে। যে প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল ঘোষিত হয়েছে তাও বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। আদালতের রায়ে ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু উচ্চ আদালতের সুপারিশ গ্রহণ করা হয়নি। অনেকেই বলার চেষ্টা করেন, অনির্বাচিত একটি সরকার গণতন্ত্রের পরিপন্থী। এর পেছনে ‘সত্যতা’ যতটুকু আছে, তার চেয়েও বেশি ‘সত্য’ হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে এ ধরনের একটি সরকারের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। আমরা টেকসই গণতন্ত্র চাই বটে, কিন্তু একজন দলীয় প্রধানকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হেসেবে রেখে এবং তাকে সব সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যে নির্বাচন, সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। সরকার ২৫ অক্টোবর থেকে ২৪ জানুয়ারির (২০১৪) মধ্যে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন করবে। অপেক্ষা করছে বিএনপির সিদ্ধান্তের জন্য। নিঃসন্দেহে বিএনপি তথা ১৮ দলীয় জোটের জন্য এটা একটা কঠিন সময়। নির্বাচনকালীন সরকারের দাবিকে উহ্য রেখে বিএনপি যদি নির্বাচনে যায় (?), তাহলে সরকারের অবস্থান শক্তিশালী হবে। বিএনপি এ নির্বাচনে অংশ নেবে না বলেই জানিয়েছে।
এখন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু সে সংসদ কোনো সমাধান বের করতে পারবে না। ওই সংসদ তার টার্ম শেষ করতে না পারলেও তা টিকে থাকবে কিছুদিন। আমরা ১৯৮৬ সালের তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা চিন্তা করতে পারি। অনেকটা অংকের যোগফলের মতো বলে দেয়া যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়েই একটা ‘সমাধান’ বের হবে এবং আমরা নির্বাচনকালীন একটা সরকারের রূপরেখা পাব। তবে এ মুহূর্তে বলা কঠিন, সেই সরকারের রূপরেখা কী হবে। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে যে সম্ভাবনার জন্ম হয়েছিল, তার ‘মৃত্যু’ ঘটেছে শুধু নির্বাচন কমিশনারদের অতিকথনের কারণে। অতীতেও নির্বাচন কমিশন তাদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারেনি। তাদের সবার যেন একটা টার্গেট ছিল মিডিয়ায় পরিচিতি পাওয়া। টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় যে মানসিকতা দরকার, তা কারও মধ্যেই নেই। ক্ষমতা ধরে রাখা কিংবা ফের ক্ষমতায় যাওয়ার যে ফন্দি, তা বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনার ‘মৃত্যু’ ঘটিয়েছে। আমি তাই আশাবাদী হতে পারছি না। প্রধানমন্ত্রী বিশ্বসভায় টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন বটে, কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে সে রকম কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তাই বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল।
দৈনিক যুগান্তর, ২১ অক্টোবর।
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com - See more at: http://www.jugantor.com/sub-editorial/2013/10/22/36183#sthash.cfeCqegP.dpuf

আরো দুই বছর ক্ষমতায় থাকার দুই বিকল্প নিয়ে আগাচ্ছে আ’লীগ

আজকাল-এর সাথে পর্যবেক্ষণ শেয়ার করলেন রাজনীতি-বিশ্লেষক তারেক শামসুর রেহমান:
আবু দারদা যোবায়ের ঃ বাংলাদেশের বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান সাপ্তাহিক আজকালকে বলেছেন, রাজনৈতিক সংকটের টান টান উত্তেজনার মধ্যে ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার মনে হয় এখন দুটি বিকল্পের একটি বেছে নিতে চিন্তা-ভাবনা করছে। বিকল্প দুটি হচ্ছে, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পাওয়া সাংবিধানিক ক্ষমতার বলে আওয়ামী লীগ এককভাবে নির্বাচন করবে, বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও। কিংবা বিএনপি-জামায়াত জোটের আন্দোলনকে সহিংসতা বলে প্রতীয়মান করে দেশে জরুরী অবস্থা জারির মাধ্যমে আগামী দুই বছর ক্ষমতায় থাকা। দুটি বিকল্পেরই লক্ষ্য এক, আওয়ামী লীগের কমপক্ষে আরো দুই বছর ক্ষমতায় থাকা। কোনটি বেছে নেবে, শিগগির দেখতে পাওয়া যাবে।

তিনি বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে অনেক ক্ষমতা দিয়েছে। মহাজোট সরকার সাংবিধানিক ক্ষমতার বলে আগামী ২৪ জানুয়ারীর আগে দেশে সংসদ নির্বাচন করবে। তবে ২৪ অক্টোবর সরকারের ক্ষমতা শেষ এটা ঠিক নয়, ২৫ অক্টোবরের পরেও সংসদ চলতে পারে এবং সেটা সংবিধান-সম্মতভাবেই চলবে। আগামী জানুয়ারী মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করবে। নভেম্বর মাসে নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণা হতে পারে।

তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন আস্থা অর্জন করতে পারেনি। কেননা প্রধান নির্বাচন কমিশনার সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকে কখন কি করতে হবে। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর থেকে শতকরা ৩৩ থেকে ৩৮ ভাগ ভোট পেয়ে ক্ষমতায় এসেছে। বিশাল জনসমর্থনের দল বিএনপিকে বাইরে রেখে কিংবা বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশ না নেয় তবে সে নির্বাচন দেশে বিদেশে গ্রহণযোগ্য হবে না। এমনকি দাতা সংস্থাগুলির কাছেও নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়াও চীন, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ ইতিমধ্যে বিরোধী দলের অংশ গ্রহণে একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ওপর জোর দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর উচিত ভাল কাজ করে থাকলে সকল দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন করা । জনগণ যাকে ভোট দিবে তারাই ক্ষমতায় আসবে। কেননা জনগণ কখনোই ভুল করে না। আগামী নির্বাচন সষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হলে দেশে গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে, প্রবৃদ্ধি বাড়বে। কিন্তু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে গণতন্ত্র হুমকির সম্মুখিন হবে।

তারেক শামসুর রেহমান বলেন, তবে বর্তমান বাস্তবতায় সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেত্বত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে সেডো কেবিনেটের মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনা করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে পাঁচজন পাঁচজন করে দশজন নিয়ে মন্ত্রীসভা গঠন করে সেই মন্ত্রী সভায় খালেদা জিয়ার মনোনীত প্রতিনিধিদের স্বরাষ্ট্র ও তথ্য মন্ত্রণালয়য়ের দায়িত্ব দিয়ে নির্বাচন করা যেতে পারে। এটার উদ্দেশ্যই হলো বিরোধী দলকে আস্থায় নিয়ে আসা এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইচ্ছা করলে এটা করতে পারেন। আর তা না হলে সংবিধান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে যে ক্ষমতা দিয়েছে তা চালু রাখতে হলে অবশ্যই নির্বাচন করতে হবে। এ অবস্থায় বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের জোট দেশব্যাপি হরতাল , অবরোধ , জ্বালাও পোড়াও এর কর্মসূচি দিলে নানা সহিংসতা হতে পারে। আর সেই সহিংসতার অজুহাতে - বিকল্প হিসেবে শেখ হাসিনার সরকার দেশে জরুরী অবস্থা জারি করে আওয়ামী লীগ দুই বছর ক্ষমতায় থাকতে পারে, ভারতে ইন্ধিরা গান্ধী ৭৪ সালে যে ভাবে জরুরী অবস্থা জারি করে ক্ষমতায় ছিলেন।

তিনি বলেন, সেনা বাহিনীর ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনা খুবই কম। বর্তমান বাস্তবতায় সেনাবাহিনী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের পরিবর্তে সিভিল প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে বেশ আগ্রহী। সেনাবাহিনীতে ইতিমধ্যে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়েছে, জাতিসংঘ শান্তি মিশনে সেনাবাহিনীর সদস্যরা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছেন। পাশাপাশি তারা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। তাই সেনাবাহিনী বর্তমান সরকারের প্রতি আস্থাশীল বলেই মনে হ্েচ্ছ। বিএনপি একটি বিশাল রাজনৈতিক দল । এ দলের মূল নেতৃত্বকে নির্বাচনের বাইরে রেখে বিএনপি ভেঙ্গে আলাদা বিএনপি গঠন করে নির্বাচন অংশগ্রহণ দেখানো হলে তাও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।ত বে একটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, যেহেতু পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে তাই আগামীতে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা কি হবে সে ব্যাপারে অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি সমঝোতায় আসতে হবে। দশম সংসদে হয়তো এর সমাধান হবে না, কিন্তু এগাদশ সংসদে অবশ্যই নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছাতে হবে এবং তখন তা করাও সম্ভব হবে।

প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ ও কিছু মৌলিক প্রশ্ন

প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন গত শুক্রবার। দেশের এক চরম সংকটকালে প্রধানমন্ত্রী এ ভাষণ দিলেন। কেননা মূল যে সমস্যাটিকে কেন্দ্র করে বর্তমান সংকটের জন্ম, অর্থাৎ একটি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠনের যে দাবি, সে দাবির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী এতটুকুও ছাড় দেননি। বিকল্প হিসেবে তিনি সর্বদলীয় সরকার গঠনের একটি প্রস্তাব করেছেন। এই প্রস্তাব নিয়েও আছে নানা কথা। প্রথমত, একটি সর্বদলীয় সরকার গঠনের কোনো কথা সংবিধানে নেই। প্রধানমন্ত্রী কোন ধারা বলে এই সরকার গঠন করবেন? এটা যদি তিনি করেন, তাহলে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠতে পারে। সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা বলা হয়েছে। সংবিধানে বর্ণিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আর প্রধানমন্ত্রীর সর্বদলীয় সরকার পরস্পর সাংঘর্ষিক। একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই যদি একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করতেন, তাহলে কোনো প্রশ্ন উঠত না। এটা প্রধানমন্ত্রীর অধিকার। এখন নির্বাচনের তিন মাস আগে শুধু নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি সর্বদলীয় সরকার, যা সংবিধানে লিপিবদ্ধ নেই- এটা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। দ্বিতীয়ত, সর্বদলীয় সরকারের প্রধান কে হবেন, সে ব্যাপারে তিনি স্পষ্ট কোনো ধারণা দেননি। সরকারের নীতিনির্ধারকদের বক্তব্য থেকে এটা বোঝা যায় যে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই এই সরকারের প্রধান হবেন। এ ক্ষেত্রে একজন দলীয় প্রধান হিসেবে তিনি যদি সরকারপ্রধান থাকেন, তাহলে নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে না- এ ধরনের প্রশ্ন উঠতে পারে। তৃতীয়ত, সর্বদলীয় বলতে তিনি কোন কোন দলের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে একটি মন্ত্রিসভা গঠন করবেন, এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে তিনি কিছু বলেননি। তাঁর নেতৃত্বে একটি মহাজোট সরকার ক্ষমতায়। ওই মহাজোটে জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ বেশ কিছু ছোট দল রয়েছে। মন্ত্রিসভায় অবশ্য ওয়ার্কার্স পার্টির কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। এ ক্ষেত্রে বিএনপির দুই থেকে তিনজন মন্ত্রী নিয়ে তো মন্ত্রিসভায় ব্যালেন্স হবে না। এখন সর্বদলীয় সরকারের নামে মহাজোট সরকারের প্রতিনিধিত্বই থেকে যাবে, তাতে জট খুলবে না। চতুর্থত, সর্বদলীয় সরকারে কি জামায়াত থাকবে? জামায়াতের সংসদে প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। ধারণা করছি, জামায়াত সেখানে থাকবে না। কেননা সরকারের 'বন্ধুরা', বিশেষ করে বাম সংগঠনগুলো এটা চাইবে না। যুদ্ধাপরাধের মামলায় জামায়াতের নেতারা শাস্তিপ্রাপ্ত। তাঁদের ব্যাপারে আপত্তি থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু জামায়াতকে বাদ দিলে(?) কি সর্বদলীয় চরিত্র পাবে ওই মন্ত্রিসভা?
প্রধানমন্ত্রী কবে নির্বাচন হবে, তার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি ২৫ অক্টোবরের পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে চান। সংবিধানে এভাবেই লেখা আছে। এটা সংবিধানসম্মত। তবে মনে রাখতে হবে, একটি নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে যদি সমাঝোতায় উপনীত হওয়া না যায়, তাহলে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করা যাবে বটে; কিন্তু প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ তাতে না থাকলে তার গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। আসলে মূল প্রশ্ন যা, তা হচ্ছে বিরোধী দল বিএনপিকে আস্থায় নেওয়া। এ কাজটি করতে হবে সরকারকেই। সংসদে বিএনপির কম আসন রয়েছে- এটা সত্য। কিন্তু ওই কম আসন দিয়ে বিএনপিকে বিচার করা হলে তাদের প্রতি অবিচার করা হবে। বিগত নির্বাচনেও বিএনপি ৩০ শতাংশ ভোট পেয়েছে। চারদলীয় জোটের প্রাপ্ত ভোটের হার প্রায় ৩৮ শতাংশ। এখন বিএনপি যদি সর্বদলীয় সরকারে যোগ না দেয় এবং যার সম্ভাবনাই বেশি, তাহলে ক্ষমতাসীন মহাজোটকে এককভাবে নির্বাচন করতে হবে। সাংবিধানিকভাবে সেটা ঠিক আছে। কিন্তু অনেক সময় সংবিধানের বাইরে গিয়েও জাতির বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে ঐক্য গড়ে তুলতে হয়। সমসাময়িক বিশ্বরাজনীতিতে কেনিয়া ও জিম্বাবুয়ের দৃষ্টান্ত আমরা দিতে পারি। আমাদের কাছে পাকিস্তান, নেপাল কিংবা গ্রিস ও বুলগেরিয়ার ইতিহাসও আছে। নিঃসন্দেহে সংবিধান প্রধানমন্ত্রীর অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সংবিধান বাইবেল নয়। এ ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধন করেই যে নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে, তেমনটি নয়। বরং সংসদে গৃহীত একটি সিদ্ধান্তের আলোকেই এ ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। মনে রাখতে হবে, সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। আগামী ২৫ অক্টোবরকে ঘিরে জনমনে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। শঙ্কাও বাড়ছে মানুষের মধ্যে। প্রধানমন্ত্রী একটি ঝুঁকি নেবেন, যদি তিনি এককভাবে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এতে অস্থিরতা আরো বাড়বে। এই অস্থিরতা বাংলাদেশের বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্য কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। টেকসই গণতন্ত্রের জন্য তা হবে ছুরিকাঘাতের শামিল! সর্বশেষ জার্মানিতে সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দুটি প্রধান দলের মধ্যে সংসদীয় ঐক্য হতে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন সিডিইউ ও প্রধান বিরোধী দল এসপিডি একটি কোয়ালিশন সরকারে যোগ দিতে যাচ্ছে। এটা আমাদের জন্য একটি দৃষ্টান্ত যে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যেও ঐক্য ও যৌথভাবে সরকার গঠন সম্ভব। আমাদের জাতীয় নেতারা কি বিষয়টি উপলব্ধি করেন? কোনো বিদেশি দাতাগোষ্ঠী নয়, জাতিসংঘও নয়; বরং আমাদের সমস্যা আমাদেরই সমাধান করতে হবে। বাইরে থেকে কেউ এসে আমাদের সমস্যার সমাধান করে দেবে না।
আমি এখনো মনে করি, একটা সমাধান খুঁজে বের করা সম্ভব। যেহেতু সংবিধান হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনার চাবিকাঠি, সংবিধানের বর্তমান কাঠামো অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলেও বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা সংবিধানকে অস্বীকার করতে পারব না। তাই সংবিধানের আলোকেও একটি সমাধান বের করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান থাকতে পারেন। তবে স্বরাষ্ট্র ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব তুলে দিতে হবে বিরোধী দল মনোনীত প্রার্থীদের কাছে। বেগম জিয়া নিজে অথবা সংসদের একজন বিএনপির প্রার্থীর কাছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বটি থাকতে হবে। ১০ জন সদস্য নিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা গঠিত হবে। দুটি বড় দলের প্রস্তাবিত নাম নিয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। এভাবেই একটা সমাধান বের করা সম্ভব, যেখানে দরকার শুধু আন্তরিকতার। ইতিহাসের এক কঠিন সময় আমরা পার করছি। আমাদের রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতা আমাদের 'রাজনীতির ব্ল্যাকহোলে' ঠেলে দিতে পারে। 'খাদের কিনারে' দাঁড়িয়ে এখন চলমান রাজনীতি। আমাদের রাজনীতিবিদরা ভুল করবেন না- এটাই শুধু আমাদের প্রত্যাশা। প্রধানমন্ত্রী একটি উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু তাঁর ভাষণে অনেক অস্পষ্টতা আছে। এসব অস্পষ্টতা দূর করতে হবে। এখনো সম্ভাবনা আছে একটি সংলাপের। আমি আশা করব, বিএনপি একটি প্রস্তাব দেবে। নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে তাদের প্রস্তাব কী, তা-ও জাতিকে জানানো দরকার। তখন দুই প্রস্তাবকে সামনে রেখে একটি সংলাপ হতে পারে।
দৈনিক কালের কন্ঠ, ২০ অক্টোবর ২০১৩।
নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে

লেখক : অধ্যাপক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে অশনি সংকেত

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে শাট ডাউনের ঘটনা দ্বিতীয় সপ্তাহে গড়াল। নতুন অর্থবছরে বাজেট বরাদ্দ ও স্বাস্থ্যসেবা সংস্কার (ওবামা কেয়ার) নিয়ে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে বিরোধী দল রিপাবলিকান পার্টি নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেসের কোনো সমঝোতা না হওয়ায় ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব নেতৃত্ব প্রদানের যোগ্যতা নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ওয়াশিংটনের এই শাট ডাউনের ঘটনা বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে বলে অর্থনীতিবিদরা আশংকা করেছেন। চীনের ডেপুটি অর্থনীতি সংক্রান্ত মন্ত্রী এই শাট ডাউনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। যুক্তরাষ্ট্রে চীনের বিশাল বিনিয়োগের ব্যাপারে নিশ্চয়তা চেয়েছেন। ১০ অক্টোবর হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভের স্পিকার ও রিপাবলিকান দলীয় নেতা বয়েইনারের নেতৃত্বাধীন ২০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল প্রেসিডেন্ট ওবামার সঙ্গে দেখা করলেও তাতে জট খোলেনি। প্রতিনিধি দলটি মধ্য নভেম্বর পর্যন্ত একটা ‘শর্ট-টার্ম’ সমাধানের প্রস্তাব দিলেও প্রেসিডেন্ট ওবামা তাতে রাজি হননি। ওবামা চাচ্ছেন আরও ঋণ গ্রহণ করে সরকারের ব্যয়ভার মেটাতে। রিপাবলিকানদের তাতে আপত্তি। এই ঋণের পরিমাণ এখন প্রায় ১৬ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার (এক হাজার বিলিয়নে এক ট্রিলিয়ন)।
ফেডারেল সরকার ঋণ গ্রহণ করতে না পারায় ওয়াশিংটনে ফেডারেল সরকারের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। বেতন দিতে না পারায় ৮ লাখ কর্মচারীকে, যারা ফেডারেল সরকারের বেতনভুক্ত, তাদের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। ওবামা স্বাস্থ্যসেবায় যে সংস্কার আনতে চান, তাতেও আপত্তি রিপাবলিকানদের। তারা স্বাস্থ্যসেবায় ফেডারেল সরকারের বরাদ্দে আরও কাটছাঁট করতে চান। ইতিমধ্যে অনেক স্বাস্থ্যসেবা সংকুচিত করা হয়েছে। অনেক বাংলাদেশীও এখন আর স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন না। ফেডারেল সরকার ঋণ গ্রহণ করতে না পারায় রাষ্ট্রের তহবিল শূন্য হতে চলেছে। সরকারের প্রতিদিনের খরচ ৬ হাজার কোটি ডলার। ১৭ অক্টোবরের পর সরকারের হাতে থাকবে মাত্র ৩ হাজার কোটি ডলার। অথচ ১ নভেম্বর রাজস্ব বিভাগকে স্বাস্থ্য খাতের কর্মচারী ও অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের ৬ হাজার কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। রাজস্ব খাতে সে পরিমাণ টাকা আসছে না। বিনিয়োগকারীদের সুদের অর্থও পরিশোধ করতে পারছে না। বলা ভালো, যুক্তরাষ্ট্র চীনের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিল ১ দশমিক ২৭ ট্রিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে যত বিনিয়োগ হয়েছে তার ২৩ ভাগ এককভাবে চীনের।
যুক্তরাষ্ট্রের এই অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দেশটির অর্থনীতিতে মন্দাবস্থাই প্রমাণ করে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি প্রাপ্তবয়স্ক ৭ জন নাগরিকের মধ্যে একজন ‘ফুড স্টাম্প’ গ্রহণ করে থাকেন। অর্থাৎ ফেডারেল সরকারের কাছ থেকে খাদ্য সাহায্য পেয়ে থাকেন। ১৭ দশমিক ৬ মিলিয়ন পরিবার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। ৪৯ মিলিয়ন মানুষ জানেন না পরের বেলার খাদ্য তারা কোত্থেকে জোগাড় করবেন। ফেডারেল সরকার প্রতি বছর ৭৮ বিলিয়ন ডলার এই ফুড স্টাম্পের পেছনে ব্যয় করে। অর্থাৎ গরিব জনগোষ্ঠী খাদ্য সহায়তা পায়। এখন যদি অর্থ পাওয়া না যায় তাহলে নির্দ্বিধায় এই খাদ্য সহায়তা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। এর ফলে গরিব মানুষের সংখ্যা আরও বাড়বে। শুধু খাদ্য সহায়তা নয়, বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা ব্যাহত হবে। পরিসংখ্যান বলে, যুক্তরাষ্ট্রে কর্মজীবী জনশক্তির শতকরা ৭ ভাগ এখন বেকার। আফ্রো-আমেরিকানদের মাঝে এই হার ১৩ ভাগ। প্রায় ২ কোটি মানুষের কোনো কাজ নেই। এখন যদি যুক্তরাষ্ট্র আবার যুদ্ধে জড়িয়ে যায়, তাহলে উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ আর বাড়বে না। স্মরণ থাকার কথা, আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধে প্রায় ৮ হাজার মার্কিন সৈন্য প্রাণ হারিয়েছিল। আর সাধারণ মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা ১০০-রও বেশি। একমাত্র ইরাকে ৪ থেকে ৯ লাখ মানুষ হয় মারা গেছে, নতুবা স্থানচ্যুত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরু করে আফগানিস্তান ও ইরাকে যে যুদ্ধ শুরু করেছিল, তাতে ব্যয় হয়েছিল ৩ থেকে ৪ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার। এখন সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু হলে ওবামাকে অর্থ বরাদ্দ করতে হবে এবং এর পরিমাণ কোথায় গিয়ে ঠেকবে কেউ বলতে পারে না।
যুক্তরাষ্ট্র তিন তিনটি দেশে (আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া) যুদ্ধ শুরু করলেও সেখানে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারেনি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা তো স্বপ্নই থেকে গেছে। আফগানিস্তান এখন বাহ্যত তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে। ২০১৪ সালে সেখান থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহার করা হলে কারজাইকেও দেশ ত্যাগ করতে হবে। আর টাইমস ম্যাগাজিনের খবর অনুযায়ী (৯ সেপ্টেম্বর ২০১৩) গত কয়েক মাসে ইরাকে ৩ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ইরাকে আত্মঘাতী বোমাবাজির প্রবণতা বেড়েছে। ইরাক এখন সিয়া, সুন্নি ও কুর্দি- এই তিন সম্প্রদায়ের মাঝে বিভক্ত হয়ে আছে। লিবিয়াতে কোনো স্থিতিশীল সরকার নেই। অস্ত্রবাজরা আজ রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। এদের হাতেই প্রাণ হারিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত। সিরিয়ার ক্ষেত্রেও এমনটি হতে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধে আল কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো শক্তিশালী হয়েছে। ইরাক ও লিবিয়াতে এরা শক্তিশালী হয়েছে। সিরিয়ায় আল কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আল-নুসরা ফ্রন্ট ও ইরাকের ইসলামিক স্টেট অব ইরাক সিরিয়া-ইরাক সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করে। যুদ্ধে আল-কায়দা উৎখাত হয়নি, বরং আল-কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো শক্তিশালী হয়েছে। এই ‘যুদ্ধ’ একটি আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিণত হতে পারে। সিরিয়ার পার্শ্ববর্তী দেশ ইরান, লেবানন ও ইসরাইল এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে এবং সেই সঙ্গে বিশ্ব নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করতে পারে। এর সঙ্গে জড়িয়ে যাবে বিশাল অর্থের প্রশ্নটি।
তবে শুধু অর্থনৈতিক সংকটের কারণেই যে ওবামা প্রশাসন সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু করেনি, তেমনটি নয়। সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু না করার কারণ অন্য। এখন অর্থনৈতিক সংকট ওবামার হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিতে পারে। ওবামা সামাজিক খাতে, বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাতের দিকে নজর দিলে এবং তাতে রিপাবলিকানদের সমর্থন না পাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে বৈষম্য বাড়বেই। অর্থাৎ ফুড স্টাম্প বন্ধ হয়ে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কৃষাঙ্গ জনগোষ্ঠী, যাদের একটা বড় অংশের কোনো চাকরি নেই, বাসস্থান নেই। এদের অনেকেই ফুড স্টাম্পের ওপর নির্ভরশীল। এখন টাকার অভাবে এই ফুড স্টাম্প বন্ধ হয়ে গেলে কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে দরিদ্রতা আরও বাড়বে। এটা সত্যিই দুঃখজনক যে, যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর এক নম্বর অর্থনৈতিক শক্তি হলেও সাধারণ মানুষের ন্যূনতম যে সামাজিক অধিকার, তার একশ’ ভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। চাকচিক্যময় এ দেশে দরিদ্রতা একটি বড় সমস্যা। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া, সম্পদ একশ্রেণীর মানুষের কাছে কেন্দ্রীভূত হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় গণতান্ত্রিক দেশের জন্য দুঃখজনক সংবাদ। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মাঝে দরিদ্রতা কমানো সম্ভব হয়নি। ১৯৬০ সালে মোট জনগোষ্ঠীর মাঝে কৃষ্ণাঙ্গরা যেখানে ছিল শতকরা ১১ ভাগ, এখন তা বেড়েছে ১৪ ভাগে। ১৯৬০ সালে প্রায় ১৫৫ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ ছিল ১৭ দশমিক ০৫ মিলিয়ন, এখন ২৪১ মিলিয়ন শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গ ৪৫ মিলিয়ন। তারা সবচেয়ে বড় এথনিক গ্র“প নয়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর বড় অংশ হচ্ছে ল্যাতিনো অথবা হিসপানিক, ৫৪ মিলিয়ন। শিক্ষাক্ষেত্রে দেখা গেছে ১৯৬৭ সালে স্কুল ত্যাগকারী কৃষ্ণাঙ্গের হার যেখানে ছিল শতকরা ২৯ ভাগ, ২০১১ সালে তা কমে এসে দাঁড়ায় ৭ ভাগে। অথচ একই সময় শ্বেতাঙ্গদের স্কুলত্যাগের হার ছিল ১৫ ভাগ (১৯৬৭)। আর এখন তা ৫ ভাগ। ১৯৬০ সালে কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে ব্যাচেলর ডিগ্রি গ্রহণকারীদের হার ছিল ৪ ভাগ (শ্বেতাঙ্গ ৮ ভাগ)। ২০১২ সালে কৃষ্ণাঙ্গদের বেড়েছে ২১ ভাগে, আর শ্বেতাঙ্গদের এ হার ৩৫ ভাগ। তবে কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে অপরাধ প্রবণতার হার বেশি। পরিসংখ্যান বলে, কারাগারে অবস্থানকারী কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর হার ৩৭ ভাগ। এর মধ্যে শতকরা ৪২ ভাগ আবার মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত। কিশোর অপরাধীর হার (কৃষ্ণাঙ্গ) শতকরা ৩২ ভাগ। পরিসংখ্যান বলে, কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে দরিদ্রতার হার কিছুটা কমেছে। ১৯৬০ সালের মাঝামাঝি কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে দরিদ্রতার হার যেখানে ছিল শতকরা ৪১ ভাগ, সেখানে বর্তমানে এই হার শতকরা ২১ ভাগ। অঙ্গরাজ্যগুলোর মাঝে মেইন-এ কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে বেকারদের হার বেশি, শতকরা ২১ ভাগ, আর দরিদ্রতার হারও বেশি, শতকরা ৪৬ ভাগ। মিসিসিপি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে দরিদ্র রাজ্য। অথচ এখানে শতকরা ৫৭ ভাগ কৃষ্ণাঙ্গের নিজস্ব বাড়ি রয়েছে। নিউইয়র্কে সবচেয়ে বেশি কৃষ্ণাঙ্গ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, এ সংখ্যা দুই লাখ চার হাজার ৩২। আয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গদের গড় আয় যেখানে বছরে ২১ হাজার ডলার, সেখানে শ্বেতাঙ্গদের আয় ২৭ হাজার ডলার। চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে কৃষ্ণাঙ্গরা এখনও পিছিয়ে আছে। ২০১৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী যেখানে শতকরা ৭ জন শ্বেতাঙ্গ বেকার, সেখানে কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে এই হার শতকরা ১৫ জন। এই পরিসংখ্যান শুধু পুরুষদের জন্য। কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাদের মাঝে বেকারত্বের হার শতকরা ১৩ ভাগ। ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে বেকারত্বের হার ২৩ ভাগ। আর ৬০ থেকে ৬৪ বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেকারত্বের হার মাত্র ৯ ভাগ। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, শতকরা মাত্র ৭ ভাগ ব্যবসা রয়েছে কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ন্ত্রণে (২০০৭ সালের হিসাব অনুযায়ী)। যদিও ১৯৬৭ সালের হিসাব অনুযায়ী এই সংখ্যা তিনগুণ বেশি ছিল। গত দুই সপ্তাহ ধরে চলা অর্থনৈতিক অব্যবস্থা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাতে পারে। শাট ডাউনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রিপাবলিকানদের জনপ্রিয়তায়ও ধস নেমেছে। এনবিসি ও ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, শতকরা ৫৩ ভাগ মানুষ মনে করে শাট ডাউনের ঘটনার জন্য রিপাবলিকানরা দায়ী। সত্যিকার অর্থেই যুক্তরাষ্ট্রের এই অর্থনৈতিক অব্যবস্থা বিশ্ব নেতৃত্ব দেয়ার সক্ষমতা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে। এই প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র অ্যাপেক সম্মেলনেও যোগ দিতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের আগামী দিনগুলো তাই সত্যিকার অর্থেই কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
দৈনিক যুগান্তর ১৫ অক্টোবর ২০১৩ (ঈদ-উল-আযহার আগের দিন)।
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com - See more at: http://www.jugantor.com/sub-editorial/2013/10/15/35155#sthash.omIj1al2.xtNGeRaH.dpuf

কী হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে??

কী হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে ২৪ অক্টোবরের পর? সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগে যদি নির্বাচন দিতে হয়, তাহলে ২৪ অক্টোবর সংসদ ভেঙে দিতে হবে। কিন্তু সরকার সেটি করছে না। বরং সংসদ নভেম্বর পর্যন্ত চলবে, তেমন একটি সংবাদ পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীও তা সুস্পষ্ট করেছেন।

প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে একটা সমঝোতার কথা খোদ জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হলেও, সেই সম্ভাবনার ‘মৃত্যু’ ঘটেছে বলেই মনে হচ্ছে। অথচ প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্কে বলে গিয়েছিলেন, তিনি বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। কিন্তু বিএনপিকে বাদ দিয়ে সেই টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এটি উপলব্ধি করছেন না। সমঝোতার সম্ভাবনা যেখানে অনিশ্চিত, সেখানে সাবেক ও বর্তমান মন্ত্রীরা অত্যন্ত কঠোর ভাষায় বিরোধী দলের সমালোচনা করছেন।

প্রধানমন্ত্রীকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেখে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করতে যাচ্ছে বর্তমান সরকার। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল, মহাজোট সরকারের শরিকরা এবং সুশীল সমাজের একটা বড় অংশ চাচ্ছে নির্বাচনকালীন একটি সরকার, যার মাধ্যমে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু বিষয়টির এখনও ফয়সালা হয়নি। দ্বিতীয়ত, মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, মন্ত্রীরা ক্ষমতায় থেকেই নির্বাচন করতে পারবেন। এতে করে কী মন্ত্রীরা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার করবেন না? একজন মন্ত্রী যখন ‘মন্ত্রী’ থাকবেন, তিনি প্রটোকল পাবেন যখন তিনি নির্বাচনী এলাকায় যাবেন। তখন স্থানীয় প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকবে কীভাবে? মন্ত্রিসভার এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশে গণতন্ত্রচর্চাকে ব্যাহত করবে। মন্ত্রীদের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আসার জন্যই মূলত এই সিদ্ধান্ত। তৃতীয়ত, এ ধরনের একটি সিদ্ধান্তের সমালোচনা হতে পারত নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে। কিন্তু কমিশনের সদস্যরা আশ্চর্যরকমভাবে এ বিষয়ে নীরব থেকেছেন। ফলে সঙ্গত কারণেই নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্নের জন্ম দেবে। এতে করে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক পরিচালিত নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। চতুর্থত, প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন। সংসদ ভেঙে দেয়ার পর, তিনি যখন অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থাকবেন, তখন পুরো ‘প্রটোকল’ তিনি পাবেন এবং নির্বাচনী প্রচারণা অব্যাহত রাখবেন। তাতে করে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত হবে না। পঞ্চমত, মোহাম্মদ নাসিম সরকারি কর্মকর্তাদের ‘ঠিক মতো কাজ না করলে’ বাড়ি পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছেন। এতে করেও কী নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ থেকে গেল না?

আসলে টেকসই গণতন্ত্রের সংজ্ঞা কী? যেখানে মহাজোট সরকারের অন্যতম মিত্র জাতীয় পার্টিও বলছে তারা একদলীয় নির্বাচনে অংশ নেবে না, সেখানে প্রধানমন্ত্রী টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন কীভাবে? দেয়ালের লিখন থেকে আমরা কেউই কিছু শিখি না। প্রধানমন্ত্রী সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের জন্য। দেশে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনিই জামায়াতের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ১৯৯৫-৯৬ সালে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। সেদিনের ‘মিত্র’ আজকের শত্রু! আজ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নেই। তবে একটি সুযোগ ছিল আরও দুই টার্ম রাখার। কিন্তু তিনি তা রাখেননি। আজ তিনি যখন টেকসই গণতন্ত্রের কথা বলেন, তখন প্রশ্ন তো উঠবেই শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেখে যে গণতন্ত্র, তাকে আমরা টেকসই গণতন্ত্র বলব কিনা? তার উপদেষ্টারা, মন্ত্রীরা, দলের নীতিনির্ধারকরা যে ভাষায় কথা বলেন, বিরোধী দলকে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখেন, তা কী টেকসই গণতন্ত্রের নমুনা? বনমন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, বেগম জিয়া তালেবানদের নেতা! তিন-তিনবারের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে এ ধরনের বক্তব্য রাখা কতটুকু গণতান্ত্রিক কিংবা বনমন্ত্রীর সৌজন্যবোধ কতটুকু, সে প্রশ্ন করাই যায়। শুধু বনমন্ত্রী কেন বলি? মোহাম্মদ নাসিমের একটি বক্তব্য ছাপা হয়েছে অনলাইনে। তার বক্তব্য ছাপা হয়েছে এভাবেÑ ‘খালেদা জিয়ার বুলেট তাড়া করে বেড়াচ্ছে শেখ হাসিনাকে’ (আরটিএন, ২৪ সেপ্টেম্বর)। এই দুটো বক্তব্য প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যে, রাজনৈতিক শিষ্টাচার বলতে যা বোঝায়, তা আওয়ামী লীগের নেতারা জানেন না। বিগত নির্বাচনে নাসিম সাহেব অযোগ্য ঘোষিত হয়েছিলেন। এখন আবার লাইমলাইটে আসতে চান। আবারও মন্ত্রী হতে চান! প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করার জন্যই এসব কথা বলা। কী যোগ্যতা আছে বনমন্ত্রীর বেগম জিয়া সম্পর্কে মন্তব্য করার? কে তাকে চেনে? কি তার পরিচয়? জাতীয় রাজনীতিতে তার অবদান কতটুকু?

রাজনীতিতে শিষ্টাচার একেবারেই উঠে গেছে। অপরপক্ষকে শ্রদ্ধাভরে কথা বলার (কিংবা রাজনৈতিকভাবে আক্রমণ করা) যে রেওয়াজ এক সময় ছিল, তা আর নেই। তরুণ প্রজন্ম কী শিখছে? বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদ কিংবা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম তরুণ প্রজন্মের রাজনীতিবিদদের কী শেখাচ্ছেন? প্রধানমন্ত্রী টেকসই গণতন্ত্রের যে কথা বলছেন, তাতে প্রধান বিরোধী দলের কোনো অংশগ্রহণ নেই। অথচ প্রধান বিরোধী দল এবং জোট মোট ভোটারদের ৩৮ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে। এখন ৩৮ ভাগ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব যেখানে নেই, সেই গণতন্ত্র টেকসই হলো কীভাবে? বিরোধী দলের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপনের অপর নামই গণতন্ত্র। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সেটা অনুপস্থিত। বিরোধী দলকে বাইরে রেখে যে নির্বাচন, তা কি বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র উপহার দেবে? নির্বাচনের প্রশ্নে একটা সমাধান প্রয়োজন। নির্বাচনকালীন একটি সরকার দরকার, যাতে প্রধান বিরোধী দলের আস্থা থাকবে। প্রধানমন্ত্রী সংবিধানের দোহাই দেন বটে; কিন্তু সংবিধানের আওতায়ও একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু আন্তরিকতার। সেই সঙ্গে ‘বিচার মানি কিন্তু তালগাছটা আমার’Ñ এই মানসিকতা পরিবর্তন করাও জরুরি।

প্রধানমন্ত্রীর জন্য একটি সুযোগ তৈরি হয়েছিল। তিনি ইতিহাসে স্থান করে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি সম্ভবত বেছে নিতে যাচ্ছেন একদলীয় নির্বাচন! বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে নির্বাচনে অংশ নেয়ার লোকের অভাব নেই। রাজনৈতিক দলেরও অভাব নেই। নির্বাচন হতেই পারে। কিন্তু গ্রহণযোগ্যতা? ১৯৮৬ সালে দেশে নির্বাচন হয়েছিল। তাতে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত অংশ নিয়েছিল। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশ না নেয়ায় সেই নির্বাচন কোনো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনেও। এর ফলাফলও সবাই জানেন।

আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে এরই মধ্যে কয়েকটি জাতীয় দৈনিক একটি জনমত জরিপ চালিয়েছে। জনপ্রিয়তার দিক থেকে বিএনপিকে ওইসব জরিপে এগিয়ে রাখা হয়েছে। অবশ্য এসব জরিপ নিয়ে প্রশ্ন আছে।

ঈদের পর বড় ধরনের আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। ‘সংগ্রাম কমিটি’ গঠনের ডাক দিয়েছে দলটি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে ‘সংগ্রাম কমিটি’ গঠনের আহ্বান একটি নতুন মাত্রা দিয়েছে। বেগম জিয়া হঠাৎ করেই সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন চিকিৎসার(!) জন্য। মানুষ এটা নিয়ে নানা কথা বলছে। তিনি কী সিঙ্গাপুর থেকে শেষ মেসেজ (?) নিয়ে এসেছেন। ২৫ অক্টোবরের আর খুব বেশি দিন বাকি নেই। পাল্টাপাল্টি জনসভাও আহ্বান করা হয়েছে ওইদিন। মানুষের মাঝে আতঙ্ক বাড়ছে। সারা যুক্তরাষ্ট্রে যেখানেই আমি গেছি, সেখানেই মানুষের মাঝে নানা প্রশ্ন, নানা জিজ্ঞাসা। এখন কোন পথে যাচ্ছে বাংলাদেশ? একটি জাতীয় দৈনিক মন্তব্য করেছে, জরুরি অবস্থা ঘোষণা হতে পারে(?)। সহযোগী অন্য একটি দৈনিক বলছে, বেগম জিয়া গ্রেফতার হতে পারেন(?)। এ ধরনের সংবাদ টেকসই গণতন্ত্রের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। ২৪ অক্টোবরের পরের দিনগুলো নিয়ে তাই আশঙ্কা, উদ্বেগ আর আতঙ্ক রয়েই গেল।
দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ, ১৫ অক্টোবর ২০১৩
পেনসেলভেনিয়া, যুক্তরাষ্ট্র থেকে

ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও কলাম লেখক

দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে মার্কিন সমাজ

বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। জিডিপির পরিমাণ হচ্ছে ১৫ দশমিক ৬৮ ট্রিলিয়ন ডলার (এক ট্রিলিয়ন এক হাজার মিলিয়নের সমান)। কিন্তু এখানেও দারিদ্র্য আছে। আছে বেকারত্ব। অবাক করার একটি বিষয়, গত ৪ সেপ্টেম্বর অনলাইনভিত্তিক সংবাদপত্র Meclatchy-তে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। তাতে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি প্রাপ্তবয়স্ক সাতজনের মধ্যে একজন নাগরিক 'ফুড স্টাম্প' গ্রহণ করে থাকেন। অর্থাৎ ফেডারেল সরকারের কাছ থেকে খাদ্য সাহায্য পেয়ে থাকেন। ১৭ দশমিক ৬ মিলিয়ন পরিবার খাদ্য নিরাপত্তায় ভোগে। ৪৯ মিলিয়ন মানুষ জানে না পরের বেলার খাদ্য তারা কোত্থেকে জোগাড় করবে। ফেডারেল সরকার প্রতিবছর ৭৮ বিলিয়ন ডলার এই ফুড স্টাম্পের পেছনে ব্যয় করে। অর্থাৎ গরিব জনগোষ্ঠী খাদ্য সহায়তা পায়। এখন যদি সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে সেখানে এই খাদ্য সহায়তা কার্যক্রম বন্ধ হবে। এর ফলে গরিব মানুষের সংখ্যা আরো বাড়বে। শুধু খাদ্য সহায়তা নয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা ব্যাহত হবে। পরিসংখ্যান বলে যুক্তরাষ্ট্রে কর্মজীবী জনশক্তির ৭ শতাংশ এখন বেকার। আফ্রো-আমেরিকানদের মধ্যে এই হার ১৩ শতাংশ। প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষের কোনো কাজ নেই। এখন যদি যুক্তরাষ্ট্র আবার যুদ্ধে জড়িয়ে যায়, তাহলে উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ আর বাড়বে না। স্মরণ থাকার কথা, আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধে প্রায় আট হাজার মার্কিন সেনা প্রাণ হারিয়েছিল। আর সাধারণ মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা ১০০ গুণ বেশি। একমাত্র ইরাকে চার থেকে ৯ লাখ মানুষ মারা গেছে, নতুবা স্থানচ্যুত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র Global war on terror শুরু করে আফগানিস্তান ও ইরাকে যে যুদ্ধ শুরু করেছিল, তাতে ব্যয় হয়েছিল ৩ থেকে ৪ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার (এক ট্রিলিয়ন = ১০০০ মিলিয়ন ডলার)। এখন সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু হলে ওবামাকে অর্থ বরাদ্দ করতে হবে এবং এর পরিমাণ কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা কেউ বলতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্র তিন-তিনটি দেশে (আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া) যুদ্ধ শুরু করলেও এই তিনটি দেশে আদৌ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। স্থিতিশীলতাও ফিরে আসেনি। এখন সিরিয়ায় চতুর্থ আরেকটি যুদ্ধের আশঙ্কা আপাতত স্তিমিত হলেও ভবিষ্যতে আদৌ 'যুদ্ধ' হবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ ও হিসপানিক নাগরিকরাই দারিদ্র্যের শিকার। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ও শান্তিবাদী নেতা মার্টিন লুথার কিং একসময় যুক্তরাষ্ট্রের গরিব মানুষ, বিশেষ করে আফ্রো-আমেরিকানদের জন্য লড়েছিলেন। সেটা ১৯৬৩ সালের কথা। তারপর অনেক সময় পার হয়েছে। লুথার কিংয়ের সেই স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেছে। মানুষের মধ্যে অসমতা ও দারিদ্র্য কমেনি। আফ্রো-আমেরিকানরা দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে আজও বের হয়ে আসতে পারেনি। নিউ ইয়র্কের হেরলেম আর ব্রোঞ্জ উপশহরে গেলে দেখা যায় আফ্রো-আমেরিকানরা কী অমানবিক জীবন যাপন করছেন।
মার্টিন লুথার কিং জীবদ্দশায় বৈষম্য কমিয়ে আনার সংগ্রাম করে জীবন দিলেও মার্কিন সমাজে বৈষম্য আদৌ কমেনি। ১৯৬৩ সালের আগস্টের বিখ্যাত March on Washington-এর পর ৫০ বছর পার হয়েছে (২৬ আগস্ট), কিছু বৈষম্য পুরোপুরি দূর হয়েছে- এটা বলা যাবে না। তবে নিঃসন্দেহে কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। ১৯৬০ সালে মোট জনগোষ্ঠীর মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গরা যেখানে ছিল ১১ শতাংশ, এখন তা বেড়ে হয়েছে ১৪ শতাংশ। ১৯৬০ সালে প্রায় ১৫৫ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ ছিল ১৭ দশমিক ০৫ মিলিয়ন। এখন ২৫১ মিলিয়ন শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গ ৪৫ মিলিয়ন। তারা সবচেয়ে বড় এথনিক গ্রুপ নয়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর বড় অংশ হচ্ছে ল্যাতিনো অথবা হিসপানিক, ৫৪ মিলিয়ন। শিক্ষা ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ১৯৬৭ সালে স্কুল ত্যাগকারী কৃষ্ণাঙ্গদের হার যেখানে ছিল ২৯ শতাংশ, ২০১১ সালে তা কমে এসে দাঁড়ায় ৭ শতাংশে। অথচ একই সময় শ্বেতাঙ্গদের স্কুল ত্যাগের হার ছিল ১৫ শতাংশ (১৯৬৭)। আর এখন ৫ শতাংশ। ১৯৬০ সালে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে ব্যাচেলর ডিগ্রি গ্রহণকারীর হার ছিল ৪ শতাংশ (শ্বেতাঙ্গ ৮ শতাংশ), ২০১২ সালে কৃষ্ণাঙ্গদের হার বেড়েছে ২১ শতাংশে, আর শ্বেতাঙ্গদের এ হার ৩৫ শতাংশ। তবে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতার হার বেশি। পরিসংখ্যান বলে, কারাগারে অবস্থানকারী কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর হার ৩৭ শতাংশ, এর মধ্যে ৪২ শতাংশ আবার মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত। কিশোর অপরাধীর হার (কৃষ্ণাঙ্গ) ৩২ শতাংশ। পরিসংখ্যান বলে, কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে দারিদ্র্যের হার কিছুটা কমেছে। ১৯৬০ সালের মাঝামাঝি কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে দারিদ্র্যের হার যেখানে ছিল ৪১ শতাংশ, সেখানে বর্তমানে এই হার ২১ শতাংশ। অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে মেইনে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে বেকারের হার বেশি, ২১ শতাংশ, আর দারিদ্র্যের হারও বেশি, ৪৬ শতাংশ। মিসিসিপি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে দরিদ্রতম রাষ্ট্র। আর এখানে ৫৭ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গের নিজস্ব বাড়ি রয়েছে। নিউ ইয়র্কে সবচেয়ে বেশি কৃষ্ণাঙ্গ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এ সংখ্যা ২০৪০৩২ জন। আয়ের মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে, কৃষ্ণাঙ্গদের গড় আয় যেখানে বছরে ২১ হাজার ডলার, সেখানে শ্বেতাঙ্গদের আয় ২৭ হাজার ডলার। চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে কৃষ্ণাঙ্গরা এখনো পিছিয়ে আছে। ২০১৩ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায় যেখানে ৭ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ বেকার, সেখানে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে এই হার ১৫ শতাংশ। এই পরিসংখ্যান শুধু পুরুষদের জন্য। কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১৩ শতাংশ। ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে বেকারত্বের হার ২৩ শতাংশ। আর ৬০ থেকে ৬৪ বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গ বেকারত্বের হার মাত্র ৯ শতাংশ। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দেখা গেছে মাত্র ৭ শতাংশ ব্যবসা রয়েছে কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ন্ত্রণে (২০০৭ সালের হিসাব অনুযায়ী)। যদিও ১৯৬৭ সালের হিসাব অনুযায়ী এই সংখ্যা তিন গুণ বেশি। তবে নিজস্ব বাড়ি নেই অনেক কৃষ্ণাঙ্গ-আমেরিকানের। এক অমানবিক জীবনযাপন কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের। নিউ ইয়র্ক শহরে যত বেশি কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান হোমলেস (যার বাড়ি নেই) কিংবা বাধ্য হয়ে সাবওয়েতে ভিক্ষাবৃত্তি(!) করে, অন্য কোনো শহরে আমি তা দেখিনি। গত তিন মাসে আমি যুক্তরাষ্ট্রের অনেক শহরে ঘুরেছি। নিউ ইয়র্ক, অস্টিন, ডালাস, ওয়াশিংটন- আমার কাছে দরিদ্র বেশি চোখে পড়েছে নিউ ইয়র্কে। এই অসমতার বিরুদ্ধে এই নিউ ইয়র্ক শহরেই জন্ম হয়েছিল 'অকুপাই মুভমেন্ট'-এর। সেটা ২০১১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরের কথা। ম্যানহাটনের জুকোট্টি পার্ক দখল করে নিয়েছিল তরুণরা। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে আমি সেই জুকোট্টি পার্কে গিয়েছি। পার্কটি তেমনি আছে। কোনো পরিবর্তন আসেনি। যারা হাউজিং ব্যবসায় ধস নামিয়েছিল, যাদের জন্য শত শত স্থানীয় ব্যাংক বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাদের একজনেরও বিচার হয়নি। এর মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক ক্রিমিনালদেরই উৎসাহিত করা হলো। আমেরিকার মতো বড় অর্থনীতির দেশে রাষ্ট্র গরিব মানুষদের পাশে এসে দাঁড়াবে না- এটা সত্যিই দুঃখজনক। নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
দৈনিক কালের কন্ঠ, ৯ নভেম্বর ২০১৩

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

অক্যুপাই মুভমেন্টের চেতনার কি মৃত্যু ঘটেছে?

২০১১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরের ঘটনা। শত শত তরুণ জমায়েত হয়েছিল নিউইয়র্কের লোয়ার ম্যানহাটনের একটি ছোট্ট পার্কে, যার নাম জুকোট্টি পার্ক। সেখানে জš§ হয়েছিল একটি আন্দোলনেরÑ ‘অক্যুপাই মুভমেন্ট’। দিনের পর দিন ছোট এই পার্কটি দখল করে রেখে তারা যে ইতিহাস রচনা করে, তা প্রতিবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে সৃষ্টি করে অনন্য এক নজির। তরুণরা প্রতিবাদ করে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের ‘অসমতা, দারিদ্র্য, শোষণ আর বঞ্চনার’। সারা দুনিয়ার মানুষকে তারা জানায়, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অন্যতম সম্পদশালী রাষ্ট্রে পরিণত হলেও এখানেও দারিদ্র্য আছে। কিছু মানুষের কাছে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে। দাবি ওঠে, স্লোগান ওঠে ‘আমরাই জনগোষ্ঠীর ৯৯ ভাগ’। দিনের পর দিন জুকোট্টি পার্কে তাঁবু খাঁটিয়ে অবস্থান করে অসমতা, শোষণ আর বঞ্চনার যে প্রতিবাদ তারা করেছিল, তা ছড়িয়ে গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের এক শহর থেকে আরেক শহরে। একসময় আটলান্টিক আর প্রশান্ত মহাসাগরের ওপারের দেশগুলোতেও তা ছড়িয়ে পড়ে। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী এই প্রতিবাদ ইতিহাসে স্থান করে নেয়। ইতিহাসে এভাবেই প্রতিবাদী আন্দোলন লিখিত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের পতনের পর (ডিসেম্বর ১৯৯১), চীনে সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি চালু হওয়ার পর মার্কিন তাত্ত্বিকরা (ফুকিয়ামা, হানটিংটন) একসময় বলতে শুরু করেছিলেন সমাজতন্ত্র ব্যর্থ। সমাজতন্ত্র মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। কিন্তু নিউইয়র্কের ‘অক্যুপাই মুভমেন্ট’ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল মার্কিন সমাজে অসমতা কত গভীরে। এখানেও দারিদ্র্য আছে। শোষণ ও বঞ্চনা এখানে অনেক বেশি।
জুকোট্টি পার্কের আন্দোলন শেষ হয়ে গিয়েছিল দু’বছর আগে। এ আন্দোলন, এর পরিণতি, মার্কিন সমাজের বৈষম্য নিয়ে আমার অনেক লেখা তখন ছাপা হয়েছিল। নিউইয়র্কে এসেই তাই আমি ছুটে গিয়েছিলাম জুকোট্টি পার্কে। সঙ্গে আমার ছাত্র নূর মিয়াজী কালাম। সরকার ও রাজনীতির ছাত্র কালামেরও আগ্রহ ছিল বিশ্বব্যাপী ওই পরিবর্তন নিয়ে। ক্লাসেও আমার সঙ্গে বিতর্ক জুড়ে দিত কালাম। সেই আন্দোলনের দু’বছর পর আমরা যখন জুকোট্টি পার্কে গেলাম, আমার বিশ্বাস হতে কষ্ট হচ্ছিল এখানেই ইতিহাস রচিত হয়েছিল মাত্র দু’বছর আগে। ছোট্ট একটি পার্ক, এ রকম পার্ক এই নিউইয়র্ক শহরে হাজারটা আছে। এত ছোট্ট যে, অনেক লোক একসঙ্গে জড়ো হওয়াও কঠিন! পেছনে বার্গার কিংয়ের দোকান। এর সামনে দিয়ে একটা রাস্তা চলে গেছে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার ধসে যাওয়া ভবনের দিকে। ডান পাশে পানিনি অ্যান্ড কোম্পানির ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। পাশে ওয়ান লিবার্টি প্লাজা। উল্টোদিকে একটা রাস্তা, তার মাথায় ওয়াল স্ট্রিট, হেঁটে যাওয়া যায়। এই জুকোট্টি পার্ক আমাকে টেনে নিয়ে গেল ২০১১ সালের ঘটনাবলীর দিকে।
যে প্রেক্ষাপটে ‘অক্যুপাই মুভমেন্টে’র জš§ হয়েছিল, তার একটা ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন। ২০০৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ইতিহাসে ঘটে গিয়েছিল সবচেয়ে বড় ধরনের কলংকের ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রের ৪র্থ বিনিয়োগে ব্যাংক লেহম্যান ব্রাদার্স নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে। এর প্রতিক্রিয়া শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই অনুভূত হয়নি, এর প্রভাব পড়ে বিশ্ব অর্থনীতিতেও। যুক্তরাষ্ট্রের হাউজিং ব্যবসায় বড় ধরনের ধস নামে। বাড়ির দাম কমে যায়। শত শত মানুষ ব্যাংকের দেনা শোধ করতে না পেরে বাড়ি হারিয়ে ফেলেন। স্থানীয়ভাবে অনেক ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যায়। লেহম্যান ব্রাদার্স দেউলিয়া হয়ে যাওয়ায় অর্থনীতিতে ক্ষতির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ১৪ ট্রিলিয়ন ডলার (১ ট্রিলিয়ন সমান এক হাজার বিলিয়ন)। পরিবারপ্রতি ক্ষতির পরিমাণ হিসাব করা হয় ১ লাখ ২০ হাজার ডলার। অর্থনীতির এই দেউলিয়াত্বের কারণে চাপ পড়ে সামাজিক খাতের ওপর। দারিদ্র্য বেড়ে যায়। স্বাস্থ্যসেবা খাতে অর্থ বরাদ্দ কমে যায়। শত শত তরুণ তাদের গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার জন্য যে আর্থিক অনুদান পেত, তা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে জš§ হয় ‘অক্যুপাই মুভমেন্টে’র।
মার্কিন পুঁজিবাদী সমাজে একশ্রেণীর মানুষের কাছে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে দিনের পর দিন। অন্যদিকে বাড়ছিল দারিদ্র্য। এই অসমতাই তরুণ সমাজকে নিউইয়র্কের রাস্তায় টেনে নিয়ে গিয়েছিল। জুকোট্টি পার্ককে বেছে নেয়ার কারণ, এ পার্কের পাশেই ওয়াল স্ট্রিট, যেখানে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্টক এক্সচেঞ্জ। ওই স্টক এক্সচেঞ্জকে গণ্য করা হয় পুঁজিবাদের প্রতীক হিসেবে। ওয়াল স্ট্রিটের আশপাশের ভবনে রয়েছে বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সদর দফতর। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এখানে অবস্থিত। মার্কিন সমাজে অসমতা কীভাবে তৈরি হয়েছিল, তার একটা পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদী সমাজে ১৯৭০ সালে ধনিক শ্রেণী হিসেবে পরিচিতদের হাতে দেশের মোট আয়ের ৮ থেকে ৯ ভাগ অর্থ সঞ্চিত হতো। ২০১১ সালে তারা ভোগ করতেন মোট সম্পদের ২৩ দশমিক ৫ ভাগ। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (ব্রাকলে) অধ্যাপক ইমানুয়েল সাজের মতে, ১০ ভাগ আমেরিকান দেশটির মোট বেতনের ৪৯ দশমিক ৭ ভাগ গ্রহণ করে। অধ্যাপক ডেভিড গ্রে অপর এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, আমেরিকান ধনীদের মোট সম্পদের পরিমাণ ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের গরিব জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের মোট সম্পদের চেয়েও বেশি। তার মতে, শীর্ষে থাকা এক ভাগ ধনী যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ৭০ ভাগের মালিক। আর নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিসের মতে, শীর্ষে থাকা ওই এক ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তরাষ্ট্রের মোট সম্পদের ৪০ ভাগ। অথচ ২৫ বছর আগে ধনীরা নিয়ন্ত্রণ করত মাত্র ১২ ভাগ সম্পদ।
এই যে অসমতা ও সম্পদ কিছু ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়া- এ সম্পদের সমতা রক্ষা করার জন্যই জš§ হয়েছিল ‘অক্যুপাই মুভমেন্টে’র। সেটা ছিল অনেকটা স্বাভাবিক একটা ব্যাপারÑ একটা প্রতিবাদ। যুগে যুগে তরুণ সমাজ এভাবেই প্রতিবাদী হয়েছে। ষাটের দশকে ইউরোপে, বিশেষ করে জার্মানিতে তরুণ সমাজও এভাবে যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়েছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মতো সমাজেও যে অসমতা ও দারিদ্র্য রয়েছে, তা ছিল অকল্পনীয়। খোদ নিউইয়র্ক শহরেও অনেক মানুষ রয়েছে, যাদের কোনো ঘর-বাড়ি নেই। চাকরি নেই। ফুড স্টাম্পেই তাদের দিন চলে। এই নিউইয়র্ক শহরে ম্যানহাটন এলাকায় আমি অনেক যুদ্ধাহত আমেরিকানকে দেখেছি ভিক্ষা করতে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র (ইরাক ও আফগানিস্তানে) যুদ্ধের পেছনে খরচ করেছে ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার, সেখানে একজন যুদ্ধাহত নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি রাষ্ট্রটি! অনেকের কাছেই এই বৈষম্য বিশ্বাস করা কঠিন! তাই হঠাৎ করেই অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রিটের জš§ হয়নি। ধীরে ধীরে তরুণ সমাজের ক্ষোভ বাড়ছিল, আর তার বিস্ফোরণ ঘটেছিল নিউইয়র্কে ২০১১ সালে। কিন্তু তা কি আদৌ কোনো পরিবর্তন আনতে পেরেছে মার্কিন সমাজে? আমরা যখন ‘অক্যুপাই মুভমেন্টে’র বর্ষপূর্তি নিয়ে আলোচনা করছি, ঠিক তখনই ওয়াশিংটনে প্রতিনিধি পরিষদে ‘ফুড স্টাম্পে’ অর্থ বরাদ্দ ৪০ মিলিয়ন ডলার কমানো হয়েছে। এই ‘ফুড স্টাম্প’ কর্মসূচি হচ্ছে ফেডারেল সরকারের একটি অনুদান, যার মাধ্যমে নিু আয়ের গরিব পরিবারকে খাদ্য সহায়তা করা হয়। এই ‘ফুড স্টাম্পে’র বিনিময়ে নিু আয়ের মানুষরা খাদ্য কিনে থাকেন ফেডারেল সরকারের আর্থিক সহায়তায়। এখন রিপাবলিকানরা এটা বন্ধ করে দিতে চাচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, আগামী বছর ৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন মানুষ এই সহায়তা পাবে না। শুধু তাই নয়, এই কর্মসূচির আওতায় কয়েক লাখ শিশু দুপুরে স্কুলে কোনো ‘ফ্রি লাঞ্চ’ পাবে না। এর ফলে মানুষে মানুষে অসমতা ও দারিদ্র্য আরও বাড়বে।
সাম্প্রতিক সময়ের অসমতার আরেকটি চিত্র তুলে ধরেছে সেন্টার ফর আমেরিকান প্রগ্রেস নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তারা দেখিয়েছে (১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৩), যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ৫টি শিশুর মাঝে ১টি দরিদ্র। তাদের মতে, ২০১২ সালে ১৪ দশমিক ৫ ভাগ মানুষ (৪৯ মিলিয়ন) ক্ষুধার জন্য লড়াই করেছিল। আফ্রো-আমেরিকানদের ক্ষেত্রে এই হার ২৫ ভাগ, হিসপানিক ২৩ ভাগ। ‘ফুড স্টাম্পে’র কারণে ২০১১ সালে ২ দশমিক ১ মিলিয়ন শিশু দারিদ্র্যের চক্র থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে। শুধু তাই নয়, ২ দশমিক ৬ মিলিয়ন সিনিয়র সিটিজেনও দারিদ্র্য দূর করতে পেরেছে। এখন এই কর্মসূচি বন্ধ হতে যাচ্ছে। তাহলে ‘অক্যুপাই মুভমেন্ট’ করে লাভ কী হল? হাজার হাজার মানুষ একত্রিত হয়ে যে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, তার কি কোনো প্রভাব থাকবে না এই মার্কিন সমাজে। আমি জুকোট্টির পাশে দাঁড়িয়ে থেকে কালামকে এ প্রশ্নটিই করেছিলাম। কালাম এখন আমেরিকার নাগরিক। ওর স্ত্রী সাবিনাও আমার ছাত্রী ছিল। সাবিনাও আমেরিকান। ওর মেয়ে চেলসি, সেও আমেরিকান। ‘আমরাই ৯৯ ভাগ’-এর মাঝে কালাম-সাবিনার মতো নয়া আমেরিকানরাও রয়েছে। কিন্তু এ সমাজে পরিবর্তন আনাটা কঠিন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। সমাজতন্ত্রের সেখানে পতন হয়েছে। সমাজতন্ত্র এখন ইতিহাসের অংশ। চীনের ‘মাও ড্রেস’ও এখন ইতিহাস। চীনের মানুষ এখন অর্থ আর বিত্তের পেছনে ঘুরছে, সমাজতন্ত্র তাদের টানে না। মস্কোতে একবার এক রুশ তরুণী আমার কাছে ডলার চেয়েছিল। সেটা সমাজতন্ত্র ভেঙে পড়ার আগের কথা। ‘ডলার সাম্রাজ্যের’ বিরুদ্ধে আজ প্রতিবাদী হচ্ছে মার্কিন নাগরিকরা। এখানে দারিদ্র্য বাড়ছে। বাড়ছে বৈষম্য। একটা প্রতিবাদ উঠেছিল ‘অক্যুপাই মুভমেন্টে’র মধ্য দিয়ে। এই আন্দোলন থেমে থাকবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর ‘অক্যুপাই মুভমেন্ট’ তার দু’বছর পার করল। মানুষ এখানে স্মরণ করেছে এই দিনটিকে। কিন্তু প্রধান প্রধান মিডিয়ায় এ দিনটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে কম। বিকল্প মিডিয়ায় বিষয়টি উঠে এসেছে। বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র। পৃথিবীর এক নম্বর অর্থনীতির দেশ এই আমেরিকা। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির পরিমাণ ১৫ দশমিক ৬৮ ট্রিলিয়ন ডলার এবং মাথাপিছু আয়ের (গড়) পরিমাণ ৪৯ হাজার ৯২২ ডলার, সেখানে যদি জনগোষ্ঠীর শতকরা ১৫ ভাগ মানুষ গরিব থাকে (যুক্তরাষ্ট্রের সেন্সাস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী), তা কোনো আশার কথা বলে না। ‘অক্যুপাই মুভমেন্টে’র স্পিরিট যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা গ্রহণ করে নিতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। জুকোট্টি পার্কে দাঁড়িয়ে আমার সে কথাটাই মনে হয়েছিল বারবার।
দৈনিক যুগান্তর, ৩ অক্টোবর ২০১৩,
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 

সিরিয়ার অর্থনীতি কি আগের অবস্থায় ফিরে আসবে?

সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে প্রায় ২৯ মাস ধরে। বাসারবিরোধী একটি রাজনৈতিক মোর্চা তথা প্রবাসী সরকার গঠন, বিদ্রোহী সেনাবাহিনী গঠন ও তাদের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছে যুক্তরাষ্ট্র স্বয়ং। এটা কোনো রাখ-ঢাকের বিষয় ছিল না। কিন্তু এ যুদ্ধ সিরিয়ার অর্থনীতিকে পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে। যে সিরিয়া ছিল খাদ্যে ও উত্পাদিত পণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটা দেশ, সেই দেশ এখন খাদ্য ও পণ্য আমদানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। বেকার সমস্যা যেখানে যুদ্ধের আগে তেমন একটা ছিল না, এখন তা প্রকট আকার ধারণ করেছে। যেখানে যুদ্ধের আগে তেল উত্পাদন হতো দৈনিক ৩ লাখ ৮০ হাজার ব্যারেল, এখন হয় মাত্র ২০ হাজার ব্যারেল। শুধু তেল উত্পাদনে বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ ১৩ বিলিয়ন ডলার। সিরিয়ার মুদ্রার (পাউন্ড) ব্যাপক দরপতন হয়েছে। আগে ডলারে পাওয়া যেত ৪৭ পাউন্ড, এখন ২৫০ পাউন্ডে পাওয়া যায় ১ ডলার। জনসংখ্যার বড় অংশ গরিব হয়ে গেছে যুদ্ধের কারণে। অথচ যুদ্ধের আগে গরিব জনগোষ্ঠীর সংখ্যা এক শতাংশেরও কম ছিল। স্বাস্থ্যসেবা পরিপূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছে। দেশের ৭৫টি হাসপাতালের মধ্যে এখন চলছে মাত্র ৩০টি। একসময় সরকার জ্বালানি তেল ও খাদ্যে ভতুর্কি দিত, যার পরিমাণ ছিল বছরে ৬ বিলিয়ন ইউরো; এখন তা শূন্যের কোটায়। যুদ্ধের আগে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১৮ বিলিয়ন ডলার, এখন তা এক রকম শূন্য (ইকোনমিস্ট, ১০ এপ্রিল, ২০১৩)। ‘তাই যুদ্ধ’ না হলে, এখানে মার্কিন কনট্রাকটররা আসবেন না, তেল উত্পাদন বাড়ানো যাবে না। ‘আরেকটি ইরাক’ও তৈরি হবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি বহুজাতিক বাহিনী ইরাকি সরকারকে উত্খাত করেছিল। তারপরের ইতিহাস সবার জানা। ইরাক এখন ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। সেখানে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড বেড়েছে। ইরাক অতিরিক্ত তেল উত্পাদন করে ‘বাধ্যতামূলকভাবে’ ‘যুদ্ধ খরচ’ মিটিয়েছিল। একই কথা প্রযোজ্য লিবিয়ার ক্ষেত্রে। লিবিয়ার তেল আর গ্যাসের ওপর পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল পশ্চিম ইউরোপ। লিবিয়া এখন ধ্বংসের মুখে। সেখানেও বেড়েছে সন্ত্রাসবাদ। এখন ধারণা করা হচ্ছে, সিরিয়াও সেই পথে যাচ্ছে। সিরিয়ায়ও ‘তেল’ রয়েছে। সে তেলের ব্যাপারেও আগ্রহ রয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের। তবে সিরিয়ার স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব পশ্চিমা সরকারগুলোর কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। আসাদ সরকারের পতন হলে ইরানের ওপর পরোক্ষ চাপ বাড়বে। এতে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে ইসরায়েল, দুর্বল হবে ইরান ও লেবানন সরকার। লেবাননের হিজবুল্লাহ গেরিলারা সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে থাকবে। ইসরায়েলের ভয় একদিকে যেমনি ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প অন্যদিকে তেমনি হিজবুল্লাহর গেরিলারা, যারা ইসরায়েলের ভূখণ্ডের ওপর দীর্ঘদিন ধরে হামলা চালিয়ে আসছে। তাই সারা বিশ্বের দৃষ্টি এখন সিরিয়ার দিকে। প্রেসিডেন্ট ওবামা হামলার ব্যাপারে কিছুটা পিছিয়ে এসেছেন বটে। কিন্তু রুশ-মার্কিন ফর্মুলা যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে সিরিয়ায় হামলার ব্যাপারে তিনি পিছপা হবেন না। এটা জানাতেও তিনি ভোলেননি। সুতরাং রুশ-মার্কিন সম্পর্কটাই যে সিরিয়া সংকটের সমাধান বয়ে আনবে, তা মনে করার কারণ নেই। আমি গত ক’দিন মার্কিন টিভিতে রুশ-মার্কিন সমঝোতা নিয়ে মার্কিন নীতিনির্ধারক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষকদের বক্তব্য শুনে আসছি। তাতে একটা বিষয় আমার কাছে মনে হয়েছে— আর তা হচ্ছে, এ সমঝোতার ভবিষ্যত্ নিয়ে সবাই সন্দিহান। অনেকেই বলছেন, এ সমঝোতা আদৌ কাজ করবে না। এখানে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। এক. সমঝোতা অনুযায়ী সিরিয়াকে পরিপূর্ণভাবে নিরস্ত্রীকরণের কাজ শেষ হবে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি। প্রশ্ন হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র এত দিন অপেক্ষা করবে কী না? বড় প্রশ্ন হলো, বাশার আল আসাদকে স্বীকার করে নেয়া! যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা এটা করবেন কী না? দুই. এ অঞ্চলের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে স্ট্র্যাটেজি, তাতে দেখা যায় ক্ষমতায় একনায়কতান্ত্রিক সরকারগুলোকে রেখে কোনো সমঝোতার জট খোলেনি। ইরাকে সাদ্দাম হোসেন ও লিবিয়ায় গাদ্দাফির ক্ষেত্রে কোনো জট খোলেনি। ফলে চূড়ান্ত বিচারে এদের উত্খাতের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের। এরা সাদ্দাম হোসেন, গাদ্দাফি আর বাশারকে এক কাতারেই দেখে। কোনো পার্থক্য করে না। তাই যুক্তরাষ্ট্র কি বাশারকে আরো প্রায় এক বছর ক্ষমতায় রাখবে?
তিন. সমঝোতায় সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্রের হিসাব, অবস্থান, মজুদ, অস্ত্রের ধরন, গবেষণা ইত্যাদির কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। নভেম্বরের মধ্যে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়ার কথা। এখন যদি সিরিয়া সরকার জাতিসংঘের সশস্ত্র পরিদর্শকদের সঙ্গে সহযোগিতা না করে, তখন কী হবে? চার. রাসায়নিক অস্ত্র নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের অনেকেই জানিয়েছেন সিরিয়াকে পুরোপুরিভাবে রাসায়নিক অস্ত্রমুক্ত করার কাজটি অত সহজ নয়। কেননা ধারণা করা হয় সিরিয়ায় মোট ৪০টি রাসায়নিক কারখানা অথবা এলাকা রয়েছে, যেখানে এসব অস্ত্র উত্পাদন করা হয় অথবা তা সংরক্ষণ করা হয়। প্রায় ১ হাজার মেট্রিক টন গ্যাস (সারিন ও মাস্টার্ড গ্যাস) সিরিয়া সংরক্ষণ করেছে। এসব গ্যাস ধ্বংস করা কঠিন। একজন গবেষক লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ২৮ বছর ধরেই তাদের কাছে রক্ষিত রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংস করে আসছে। কিন্তু পুরোপুরি ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি। এখানে সিরিয়া নিয়ে যে বড় সমস্যা হবে তা হচ্ছে, এসব অস্ত্র একটি নির্দিষ্ট প্লান্টে বা স্থানে ধ্বংস করতে হবে। সিরিয়ায় তা করা যাবে না। সিরিয়া থেকে সরিয়ে নিয়ে অন্য কোনো দেশে এগুলো ধ্বংস করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের ১৩টি প্লান্টের মধ্যে ৯টি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ইউরোপে পরিবেশবাদীরা অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা যেকোনো পরিবহন ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা গড়ে তুলবে। স্থানীয় আইন ও আন্তর্জাতিক আইনও পরিবহন ব্যবস্থার বিপক্ষে। সুতরাং একটা সমস্যা থেকেই গেল। এক্ষেত্রে রাশিয়া একটা সমাধান হতে পারে। কিন্তু সিরিয়ার আসাদ সরকারকে রাশিয়ার সমর্থন এবং রুশ-মার্কিন সম্পর্কের টানাপড়েন ইত্যাদি কারণে সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংসে আগামীতে জটিলতা তৈরি হতে পারে। পাঁচ. সিরিয়ায় অস্ত্র পরিদর্শক হিসেবে কারা কারা থাকবেন, সেটা নিয়েও একটা জটিলতা তৈরি হতে পারে। এক্ষেত্রে একটি সংস্থা রয়েছে— Organization for the prohibition of chemical weapons (OPCW)। এ সংস্থাটি মূলত নিয়ন্ত্রণ করে আমেরিকানরা। এক্ষেত্রে পরিদর্শক টিমে যদি আমেরিকানদের সংখ্যা বেশি থাকে, তা সিরিয়ার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। ছয়. এ সমঝোতার ব্যাপারে সিরীয় বিদ্রোহীরা তাদের আপত্তির কথা জানিয়েছে। বাশার সরকার বিদ্রোহীদের নিরস্ত্রীকরণের দাবি জানিয়ে আসছিল। কিন্তু সে দাবি গ্রহণযোগ্য হয়নি। এখন বিদ্রোহীরা যদি তাদের আক্রমণ অব্যাহত রাখে, তাতে করে এ পরিদর্শন কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে। ভেঙে যেতে পারে সমঝোতা। সাত. এ সমঝোতার পেছনে মূল অ্যাক্টর দুই শক্তি— যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। অথচ সিরিয়া সরকার ও বিদ্রোহী পক্ষের কোনো অংশগ্রহণ নেই এখানে। ফলে অনেকটা ‘চাপিয়ে দেয়া’র মতো হয়ে গেল বিষয়টা। আন্তর্জাতিক যেকোনো ইস্যু নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মাঝে যদি বিরোধ দেখা দেয়, তাহলে তা এ সমঝোতার ওপর প্রভাব ফেলবে। এরই মধ্যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে American Exceptionalism হিসেবে আখ্যায়িত করে তার অসন্তুষ্টির কথা প্রকাশ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে আলাদা ভাবে। তাদের আলাদা বৈশিষ্ট্য, যারা রক্ষণশীলবাদ, একসময় মার্কসিস্টরা এভাবেই যুক্তরাষ্ট্রকে চিহ্নিত করত, এখন পুতিনের বক্তব্যে তা ফিরে এসেছে। এর ব্যাখ্যা একটাই— বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের ‘মাতুব্বরি’ করা রাশিয়ানরা সহ্য করবে না!
রুশ-মার্কিন সমঝোতার মধ্য দিয়ে ‘কূটনীতি’ জয়যুক্ত হয়েছে। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। গত ১৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের অস্ত্র পরিদর্শকরা তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন যে, তারা সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের প্রমাণ পেয়েছেন। ফলে সঙ্গত কারণেই সিরিয়ার ওপর ‘চাপ’ এখন আরো বাড়বে। তাই সিরিয়া নিয়ে শেষ কথাটা বলার সময় এখনো আসেনি।
হিউস্টন, যুক্তরাষ্ট্র
দৈনিক বণিক বার্তা, ২ অক্টোবর ২০১৩।
লেখক: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahman09@gmail.com - See more at: http://www.bonikbarta.com/sub-editorial/2013/10/02/17870#sthash.E6646Ius.VEdtYsmG.dpuf

রাষ্ট্রীয় খরচে অর্থহীন বিদেশ সফর

গত ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকার অনলাইন ভার্সনের খবর ‘বেড়ানো আর শপিংয়েই ব্যস্ত তারা’। সংবাদটি পাঠিয়েছেন ওই পত্রিকার নিউইয়র্ক সংবাদদাতা। মূল বিষয় হচ্ছে একটিই জাতিসংঘের ৬৮তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হওয়া ১৪০ সদস্যের অনেকেই এখন নিউইয়র্কে ব্যস্ত শপিং আর কেনাকাটায়। যেখানে অধিবেশনে যোগ দেয়ার সুযোগ পেয়েছেন মাত্র কয়েকজন, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী ১৪০ জন কেন? এ প্রশ্নের জবাব জানার কোনো সুযোগ আমার নেই। কিন্তু আমি জানি এ দেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় এদের টিকিট কাটা হয়েছে! তবে ২৬ জনের মতো ব্যবসায়ীও এসেছেন, যারা নিজেরা টিকিট কেটেছেন। সরকারপ্রধানের সফরসঙ্গী হয়ে কেনাকাটা আর বেড়ানোর জন্য নিউইয়র্কে আসার কোনো মানে হয় না। রাষ্ট্র এভাবে কাউকে, কোনো সরকারকে এ ধরনের অপচয়ের সুযোগ দিতে পারে না। পত্রিকার খবরে জানলাম ওই ১৪০ জনের মাঝে আমলাপত্নী, মন্ত্রীপত্নীও আছেন। আমি জানি না সংবাদের সত্যতা কতটুকু। যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক আমলাপত্নী বা মন্ত্রীপত্নীর কাজটা নিউইয়র্কে কী? সবার খরচ (ব্যবসায়ীরা বাদে) সরকারের। টিকিট থেকে শুরু করে টার্মিনাল ট্যাক্স, হোটেল ভাড়া, যাতায়াত সব খরচই জোগাবে রাষ্ট্র। অন্য কোনো দেশের রাষ্ট্র কিংবা সরকারপ্রধান কি এভাবে এত বিপুলসংখ্যক প্রতিনিধি দল নিয়ে নিউইয়র্কে এসেছেন? না, আসেননি। ব্যবসায়ীরাও এসেছেন নিজস্ব খরচে। প্রশ্ন থেকে যায় এটা তো প্রধানমন্ত্রীর কোনো রাষ্ট্রীয় সফর নয়, কোনো দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হওয়ারও সম্ভাবনা নেই। তাহলে ব্যবসায়ীরা এলেন কোন প্রয়োজনে? নিউইয়র্কে বাজার করা ছাড়া তাদের আর কী কাজ থাকতে পারে? অনলাইনে ফেসবুকে দেখলাম একজন উৎসাহী জনপ্রতি খরচের একটা হিসাব দিয়েছেন। এই হিসাবের পরিমাণ ৯ লাখ ৫২ হাজার টাকা! এটা হয়তো সঠিক হিসাব নয়। কিন্তু কাছাকাছি একটা হিসাব। তাহলে কত টাকা রাষ্ট্রের গেল? আমাদের দেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সে অর্থে বিকশিত হয়নি। হলে দেখা যেত কত টাকা খরচ হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর বিলাস নিয়ে এর আগে একটি সংবাদপত্র রিপোর্ট করেছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। কোনো দেশ এত বিপুলসংখ্যক প্রতিনিধি দল নিয়ে নিউইয়র্কে আসেনি। ইরানের প্রেসিডেন্টের এই সফর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭৯ সালের পর এই প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে কথাবার্তা হয়েছে। তবে ওবামা-রুহানি বৈঠক হয়নি। তারপরও প্রেসিডেন্ট রুহানির সঙ্গে ছিলেন অর্থমন্ত্রী ও পেট্রোলিয়াম দফতরের মন্ত্রী। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের সংখ্যা ২৬ জন। ভারত বড় দেশ। বিশ্ব অর্থনীতিতে জাপানের ওপরে অবস্থান এখন ভারতের। নব্য অর্থনৈতিক শক্তি ‘ব্রিক’-এর সদস্য ভারত। তারপরও সীমিত একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে এসেছেন মনমোহন সিং। বেশ কয়েক বছর আগে ব্যক্তিগত খরচে এ ধরনের জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। আমার মনে আছে কিউবার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ত্রো কোনো পাঁচতারা হোটেলে ওঠেননি। ছিলেন রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে। আমার মনে আছে কোনো কোনো আফ্রিকান দেশের প্রতিনিধিরা সম্মেলন কক্ষে এসেছিলেন সাবওয়েতে করে, লিমুজিন কারে নয়। আমাদের সরকারি প্রতিনিধিদের কাছ থেকে কি তেমনটি প্রত্যাশা করা যায়? ১৪০ জনের এই বিশাল বহর বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করবে না। প্রতিনিধি দলে তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু কিংবা রাশেদ খান মেননের অন্তর্ভুক্তি দেখে আমি অবাক হয়েছি। মাত্র কিছুদিন আগে মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে অস্বীকার করেছিলেন তোফায়েল আর মেনন। প্রধানমন্ত্রী তাদের সিদ্ধান্তে নাখোশ হয়েছিলেন। তোফায়েল আহমেদ এখন আর আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী ফোরামে নেই। হতাশাগ্রস্ত তোফায়েল তখন তার মনোকষ্ট প্রকাশ করতেও দ্বিধাবোধ করেননি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না এমন খবর পত্র-পত্রিকায়ও ছাপা হয়েছিল। রাশেদ খান মেননও যে সরকারের কর্মকাণ্ডে খুশি, তা নয়। প্রধানমন্ত্রী এদের দু’জনকে নিউইয়র্কে নিয়ে এসে তাদের ‘খুশি’ করতে চাইলে তারা খুশি হবেন, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। তাহলে কি তোফায়েল, আমু, মেনন সাহেবরা ২৫ অক্টোবরের পর ছোট পরিসরে যে মন্ত্রিসভা গঠিত হবে তাতে যোগ দিতে যাচ্ছেন? সরকারের নীতি-নির্ধারকরা তো বলেন ছোট্ট পরিসরে একটি মন্ত্রিসভা থাকবে ২৫ অক্টোবরের পর। কারা থাকছেন সেখানে?
আসলে টেকসই গণতন্ত্রের সংজ্ঞা কী? যেখানে মহাজোট সরকারের অন্যতম মিত্র জাতীয় পার্টি বলছে তারা একদলীয় নির্বাচনে অংশ নেবে না, সেখানে প্রধানমন্ত্রী টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন কীভাবে? দেয়ালের লিখন থেকে আমরা কিছু শিখি না। প্রধানমন্ত্রী সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের জন্য। দেশে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনিই জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৯৫-৯৬ সালে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। সেদিনের ‘মিত্র’ আজকের শত্রু! আজ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নেই। তবে একটি সুযোগ ছিল আরো দুই টার্ম রাখার, কিন্তু তিনি তা রাখেননি। আজ তিনি যখন টেকসই গণতন্ত্রের কথা বলেন, তখন প্রশ্ন তো উঠবেই যে শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেখে যে গণতন্ত্র, তাকে আমরা টেকসই গণতন্ত্র বলব কি-না? দ্বিতীয়ত, তার উপদেষ্টারা, মন্ত্রীরা, দলের নীতি-নির্ধারকরা যে ভাষায় কথা বলেন, বিরোধী দলকে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখেন তা টেকসই গণতন্ত্রের নমুনা কি? বনমন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, বেগম জিয়া তালেবানের নেতা। তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে এ ধরনের বক্তব্য রাখা কতটুকু গণতান্ত্রিক কিংবা বনমন্ত্রীর সৌজন্যবোধ কতটুকু, এসব প্রশ্ন করাই যায়। শুধু বনমন্ত্রী কেন বলি? মোহাম্মদ নাসিমের একটি বক্তব্য ছাপা হয়েছে অনলাইনে। তার বক্তব্য ছাপা হয়েছে এভাবে ‘খালেদা জিয়ার বুলেট তাড়া করে বেড়াচ্ছে শেখ হাসিনাকে’ (আরটিএন, ২৪ সেপ্টেম্বর)। এই দুটি বক্তব্য প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যে, রাজনৈতিক শিষ্টাচার বলতে যা বোঝায় তা দেশের অনেক রাজনীতিকই জানেন না। রাজনীতিতে শিষ্টাচার একেবারেই উঠে গেছে। অপর পক্ষকে শ্রদ্ধাভরে কথা বলার (কিংবা রাজনৈতিকভাবে আক্রমণ করা) যে রেওয়াজ একসময় ছিল তা আর নেই। তরুণ প্রজন্ম কী শিখছে? বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদ কিংবা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিম তরুণ প্রজšে§র রাজনীতিকদের কী শেখাচ্ছেন? তৃতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী টেকসই গণতন্ত্রের যে কথা বলছেন, তাতে প্রধান বিরোধী দলের কোনো অংশগ্রহণ নেই অথচ প্রধান বিরোধী দল এবং জোট মোট ভোটারদের ৩৮ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে। এখন ৩৮ ভাগ লোকের প্রতিনিধিত্ব যেখানে নেই, সেই গণতন্ত্র টেকসই হলো কীভাবে? বিরোধী দলের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপনের অপর নামই গণতন্ত্র। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে তা অনুপস্থিত। বিরোধী দলকে বাইরে রেখে যে নির্বাচন তা কি বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র উপহার দেবে? নির্বাচনের প্রশ্নে একটা সমাধান প্রয়োজন। নির্বাচনকালীন একটি সরকার দরকার, যাতে প্রধান বিরোধী দলের আস্থা থাকবে। প্রধানমন্ত্রী সংবিধানের দোহাই দেন বটে, কিন্তু সংবিধানের আওতায়ও একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু আন্তরিকতার আর ‘বিচার মানি, কিন্তু তালগাছটা আমার’ এই মানসিকতা পরিবর্তন।
রাষ্ট্রীয় খরচে নিউইয়র্ক দর্শনের মাঝে বড় কিছু পাওয়ার নেই। প্রধানমন্ত্রী এবারো তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এসেছেন। এর কি কোনো প্রয়োজন ছিল? প্রধানমন্ত্রী তো পারতেন একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে। সরকারের শেষ সময়ে এসে সরকারি অর্থের এই অপচয় প্রধানমন্ত্রীর সম্মানকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাবে না। একটি প্রথম শ্রেণীর দৈনিকে (২৭ সেপ্টেম্বর) প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের নিউইয়র্ক শহর ঘুরে বেড়ানোর যে সংবাদ ছাপা হয় তা আমাদের একটা ধান্ধায় ফেলে দেয়। সরকারি অর্থের অপচয়ের এই ‘মড়ক’ কি আমরা বারবার দেখতেই থাকব? এর কি কোনো পরিবর্তন হবে না? প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের নিউইয়র্কে ঘুরে বেড়ানোর সংবাদ যেদিন ছাপা হয়েছে, ঠিক একই দিন অপর একটি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে অপর একটি সংবাদ উত্তরাঞ্চলে মানুষের কাজ নেই। তারা বেঁচে থাকার জন্য কাজ চান। কেউ কেউ আগাম শ্রম বিক্রি করে দিয়েছেন। কেউবা আবার এক হাজার টাকা কর্জ করেছেন ২০০ টাকা সুদের বিনিময়ে! কাবিখা, কাবিটা কিংবা টিআরের বিনিময়ে যে সাহায্য, তা পাচ্ছে গুটিকয় মানুষ, যারা স্থানীয় চেয়ারম্যানের আশীর্বাদপুষ্ট। যেখানে মানুষের ন্যূনতম অধিকার, যা সংবিধান প্রদত্ত তা রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে পারছে না, সেখানে রাষ্ট্রের টাকায় কিছু লোকের নিউইয়র্ক দর্শন যুক্তিহীন ও অগ্রহণযোগ্য। একবার বিশ্বসভায় যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী এক কবিকে নিউইয়র্ক নিয়ে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে কবি নিউইয়র্ক কিংবা বিশ্বসভা নিয়ে কোনো কবিতা লিখেছিলেন কি-না বলতে পারব না। তবে জাতির যে এতে কোনো উপকার হয়নি তা দিব্যি দিয়েই বলতে পারি।
বিশ্বসভা একটি বিশ্বরাজনীতির জায়গা। প্রধানমন্ত্রী এসেছেন। কয়েকটি সভায় বক্তব্য রেখেছেন এটা ঠিক আছে। কিন্তু তার সঙ্গে তার মিডিয়া উইংয়ের উপদেষ্টা প্রধান তথ্য কর্মকর্তাসহ যে বিশাল টিম এসেছে, তার কি কোনো প্রয়োজন ছিল? বিশাল এক প্রেস টিম তার সঙ্গে এসেছে, তার বক্তব্য জাতিকে জানানোর জন্য! সরকারি টাকার এই অপচয়ের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী যদি নিউইয়র্ক থেকে ফিরে এসে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে যান ভালো করবেন। অন্তত ‘রংপুরের মফিজদের’ জন্য প্রধানমন্ত্রী কিছু করার উদ্যোগ নিতে পারেন। সেখানে সাধারণ মানুষের কর্মের সংস্থানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকও উদ্যোগ নিতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক উদ্যোগ নিলে বেসরকারি ব্যাংকও এগিয়ে আসবে। ওদের কাজ দেয়া দরকার। প্রধানমন্ত্রীর কাছের জনরা তাকে এই উপদেশটি দেবেন কি-না জানি না, কিন্তু আমি বিশ্বাস রাখতে চাই প্রধানমন্ত্রী উত্তরাঞ্চলের মানুষের সমস্যা সম্পর্কে জ্ঞাত। তিনি উদ্যোগী হলে জাতি তাকে স্মরণে রাখবে।
দৈনিক মানবকন্ঠ, ১ অক্টোবর। 
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক - See more at: http://www.manobkantha.com/2013/10/01/141029.html#sthash.b6Xca5Sn.dpuf

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও প্রবাসীদের ভাবনা

সাংবিধানিকভাবে দেশে একটি নির্বাচন হতে যাচ্ছে। ২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারি বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হবে। সংবিধান অনুযায়ী এর তিন মাস আগে যে কোনো এক সময় এই নির্বাচন হবে। এর আগে অবশ্য প্রধানমন্ত্রী একবার বলেছিলেন, বর্তমান সংসদের মেয়াদের শেষ দিন পর্যন্ত বর্তমান সংসদ বহাল থাকবে। তার ওই বক্তব্য সমালোচিত হয়েছিল। কেননা ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত সংসদ থাকলে, সংসদ সদস্যরা তাদের পদে থেকেই নির্বাচন করবেন। ফলে নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রভাবান্বিত হয়ে যেতে পারে।

এখন ২৪ অক্টোবরের একটি তারিখকে ঘিরে নানা প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। ওই তারিখের পর সংসদ ভেঙে যেতে পারে, এমন গুজব বাতাসে ভাসছে। বিরোধী দল ২৪ অক্টোবরের পর কঠোর কর্মসূচির কথা বলছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ যত বেশি উৎকণ্ঠিত, তত বেশি উৎকণ্ঠিত প্রবাসী বাংলাদেশীরাও। গত তিন মাস আমি সারা যুক্তরাষ্ট্র চষে বেড়িয়েছি। নিউইয়র্ক থেকে শুরু করে ওয়াশিংটন ডিসি, ডালাস, অস্টিন, হিউস্টনÑ সবার মনেই একটা প্রশ্নÑ নির্বাচন কী হবে? দেশে কী হতে যাচ্ছে? অনেকেরই নভেম্বর-ডিসেম্বরে দেশে যাওয়ার কথা। এখন যাচ্ছেন নাÑ সবার ধারণা, একটা অস্থিরতার মধ্যে দেশ পড়তে যাচ্ছে অক্টোবরের পর! এর আলামত এরই মধ্যে ফুটে উঠতে শুরু করেছে। গার্মেন্ট সেক্টর হঠাৎ করেই অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী এসেছেন নিউইয়র্কে। এখানেও তিনি বললেন, সংবিধানের আওতায়ই নির্বাচন হবে। আর ঢাকায় আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকদের একজন মোহাম্মদ নাসিম আমাদের জানিয়ে দিলেন, আর কোনো সংলাপ নয়। হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন হবে (আরটিএন, ২৪ সেপ্টেম্বর)।

অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যেটা এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে তা হচ্ছে, শেখ হাসিনাই তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থাকবেন। এ ক্ষেত্রে একটা ছোট মন্ত্রিসভা থাকতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো বক্তব্য সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। এ প্রশ্নে সংলাপ হবে না। সংলাপ হতে পারে নির্বাচনের তারিখ ও আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে। সংলাপে সংসদ ভেঙে যাওয়া নিয়েও আলোচনা হতে পারে। এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী কি জেনে-শুনেই এই ঝুঁকিটি নিতে যাচ্ছেন? তিনি কি মনে করছেন, ২৪ অক্টোবরের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি তিনি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন? তিনি নিজে এবং তার উপদেষ্টা ও দলের নীতি-নির্ধারকদের কথায় তো তাই মনে হয়। অতীত ইতিহাস প্রধানমন্ত্রী জানেন।

১৯৮৬, ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালে একটি করে বড় দল (বিএনপি, আওয়ামী লীগ) নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় তৃতীয়, চতুর্থ ও ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি এবং টিকে থাকতে পারেনি। শেখ হাসিনা কী ও রকম একটি নির্বাচনের দিকে যাচ্ছেন? বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করে আসছে বারবার। বিএনপি সংসদে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা উপস্থাপন করতে পারত। কিন্তু তারা তা করেনি। তবে নির্বাচনকালীন একটা সরকার নিয়ে এখনও আলোচনা সম্ভব। বেগম জিয়া বিকল্প বেশ কিছু প্রস্তাব দিতে পারেন। একটা প্রস্তাব হবে, তিন মাসের জন্য একটি সরকার, যে সরকার নীতি-নির্ধারণ সংক্রান্ত কোনো ‘কাজ’ করবে না। তাদের দায়িত্ব হবে শুধু নির্বাচন পরিচালনা করা। তবে প্রধানমন্ত্রীকে ‘অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে রেখেও এই সরকার গঠন করা যায়! এ ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বটি দিতে হবে বিরোধী দলের প্রধান অথবা তাদের দলীয় একজন এমপিকে। প্রধানমন্ত্রী কোনো নির্বাহী দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। তিনি কোনো প্রটোকল পাবেন না। দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারবেন না। টিভি, বেতার, সরকারি মিডিয়া তিনি ব্যবহার করতে পারবেন না। তিনি দলীয় প্রধান হিসেবে যদি কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে চান, তাহলে তিনি ‘অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রীর’ দায়িত্বে থাকতে পারবেন না। বিকল্প হিসেবে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতাকে নিয়ে একটি যৌথ সরকার গঠন করা যায়, যেখানে বিরোধীদলীয় নেতার হাতে থাকবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সংবিধান এ ক্ষেত্রে বড় বাধা। তবে বিরোধী দলের হাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থাকলে সমস্যা কম। নির্বাচন-পূর্ববর্তী তিন মাস পুরো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। দু’দলের পক্ষ থেকে ৫ জন করে ১০ জন সহকর্মী থাকবেন, যারা অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় পরিচালনা করবেন। তবে কথা থাকে, এই ১০ জন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।

একটি ‘সাহাবুদ্দিন ফর্মুলা’ও ব্যবহৃত হতে পারে। অর্থাৎ প্রধান বিচারপতি (সাবেক) সাহাবুদ্দিন আহমদকে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে নব্বই-এর আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে সব দল নীতিগতভাবে রাজি হয়েছিল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বর্তমান প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন এ দায়িত্বটি পালন করতে পারেন। তবে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের মতো তাকেও তিন মাস পর তার স্বপদে ফিরে আসার সুযোগ দিতে হবে। এক্ষেত্রে তিনি যদি দায়িত্ব নেন, তাহলে প্রশাসনিক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পরিবর্তনের দায়িত্বটি তাকে দিতে হবে।

গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থেই একটি নয়া নির্বাচন কমিশন দরকার। বর্তমান সিইসি ও কমিশনাররা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবেন এবং নয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান একটি সার্চ কমিটির মাধ্যমে নয়া সিইসি ও কমিশনারদের নিয়োগ দেবেন। সার্চ কমিটির সদস্যদের কোনো ধরনের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারবে না। নয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধানকে এককভাবে সার্চ কমিটির সদস্যদের নিয়োগের এখতিয়ার দিতে হবে। তার সিদ্ধান্তে কোনো আপত্তি চলবে না। একটি নির্বাচনকালীন ‘কোড অব কনডাক্ট’ প্রণয়ন করাও জরুরি। নির্বাচনকালীন সময়ে সহিংসতা এড়ানোর জন্য কোনো দলকে জনসভা করতে দেয়ার অনুমতি দেয়া হবে না। টিভি ও বেতারে তারা কর্মসূচি উপস্থাপন করবেন। কোনো নেতা-নেত্রী সম্পর্কে কটূক্তি করা যাবে না।

সাংবিধানিকভাবে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত সংসদ বৈধ। তবে এর ৯০ দিন আগে প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভেঙে দেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করবেন। সংসদ ভেঙে যাওয়ার তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন হবে। এই সময়ে দুই নেত্রী সমান প্রটোকল পাবেন। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, সংসদ রেখেই দেশে নির্বাচন হবে। ‘সংসদ রেখে নির্বাচন’-এর বক্তব্য সংবিধানসম্মত নয়। প্রধানমন্ত্রী প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করার কথা বলেন। সংবিধানের প্রতিটি ধারা, উপধারা তিনি ভালো বোঝেন, এটা আমার বিশ্বাস। কিন্তু ‘সংসদ রেখে নির্বাচন’ কোন ধারায় আছে, আমি তা খুঁজে পাইনি কোথাও। বরং সংবিধানের ১২৩ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, সংসদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যেই নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীকে রেখে যে নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে, তা বাস্তবায়ন করতে হলে বিএনপির সম্মতি যেমনি প্রয়োজন, ঠিক তেমনি প্রয়োজন ২৪ অক্টোবরের পর সংসদ ভেঙে দেয়া। ওই তিন মাস প্রধানমন্ত্রী থাকবেন, তবে সংসদ থাকবে না। সংসদ থাকলে কী ধরনের জটিলতা তৈরি হবে, তা এরই মধ্যে আমরা একাধিকবার আলোচনা করেছি।

এখন যে বিষয়টি গুরুত্ব পেতে পারে, তা হচ্ছে, সংবিধানের আওতায় কীভাবে একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যায়। টিভি টক-শো আর সরকারি বুদ্ধিজীবীদের যুক্তিহীন বক্তব্যে এর সমাধান হবে না। ২৪ অক্টোবরের আগেই সরকার আর বিরোধী দলের সংবিধান বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সংলাপ করতে হবে। এখানে মহাসচিব পর্যায়ে বৈঠকের কোনো প্রয়োজন নেই। স্পিকারের সভাপতিত্বে দু’দলের সংবিধান বিশেষজ্ঞরা সংলাপ করতে পারেন। ওই সংলাপে একটা সমাধান বের হয়ে আসতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর কথাবার্তায় এটা স্পষ্টÑ প্রধানমন্ত্রী নিজে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে যেতে চান এবং নির্বাচন পরিচালনা করতে চান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যা বুঝতে পারছেন না তা হচ্ছে, তিনি যদি অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও থেকে যান, তাহলে সুবিধাভোগীরা তাকে দিয়ে ক্ষমতা না ছাড়ার নানা ষড়যন্ত্র (?) করতে পারে। তার আমলে প্রশাসনে নিয়োগপ্রাপ্তদের দিয়ে তিনি নির্বাচনে প্রভাব খাটাতে পারেন। নির্বাচন কমিশনাররা (সিইসি বাদে) তার আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত। নির্বাচন কমিশনাররা ‘অবৈধ কর্মকা-ে’ জড়িয়ে পড়তে পারেন। নির্বাচনের সময় সেনা মোতায়েন না হলে স্থানীয় পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এসবই আশঙ্কার কথা। বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে এ ধরনের সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দেয়া যায় না।

এখন যদি সরকার সত্যিকার অর্থেই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন এবং সংবিধানকে সমুন্নত রাখতে চান, তাহলে বিরোধী দলের আস্থা সরকারকে অর্জন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীকে তার উপদেষ্টারা কিংবা নীতি-নির্ধারকরা তাকে সঠিক উপদেশটি দিচ্ছেন বলে মনে হয় না। প্রধানমন্ত্রীকে এটা উপলব্ধি করতে হবে যে, বাংলাদেশের ৪১ বছরের সংবিধানের ইতিহাসে এবারের মতো এত বড় সঙ্কট অতীতে কখনও সৃষ্টি হয়নি। এরশাদ জমানার শেষের দিকে কীভাবে এরশাদ ক্ষমতা সংবিধানের আওতায় হস্তান্তর করবেন এ প্রশ্ন উঠলেও, বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান করে একটা সমাধান বের করা সম্ভব হয়েছিল। কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছিল সাংবিধানিক সঙ্কট। বর্তমানে পরিস্থিতি দিনে দিনে জটিল হচ্ছে। দাতা দেশগুলোর প্রতিনিধিরা জানিয়ে দিয়েছেন যে, তারা চান সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন। সেটা এখনও সম্ভব। এমনকি সাংবিধানিকভাবে কীভাবে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়, সেটা নিয়েও আলোচনা শুরু হতে পারে। স্পিকার স্বয়ং উদ্যোগ নিতে পারেন। সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। নিউইয়র্কে থেকেও আমি ঢাকার উত্তাপ বেশ অনুভব করছি। হাজারটা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় আমাকে। একদলীয় নির্বাচন, তথাকথিত তৃতীয় শক্তির উত্থান, উত্তরপাড়া, ড. ইউনূসের ভূমিকা নিয়ে নানা কথা বাতাসে ভাসছে এই নিউইয়র্ক শহরে। প্রধানমন্ত্রী ঘুরে গেলেন। এখান থেকে তিনি কী মেসেজ নিয়ে গেলেন, জানি না। কিন্তু জানি, সব দলের অংশগ্রহণ যদি নিশ্চিত করা না হয়, তাহলে প্রবাসী বাংলাদেশীরা থাকবেন হতাশায়। বাংলাদেশ তাদের জন্য এক সময় অচেনা হয়ে যাবে।
দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ, ২ অক্টোবর ২০১৩
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও কলাম লেখক