রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও প্রবাসীদের ভাবনা

সাংবিধানিকভাবে দেশে একটি নির্বাচন হতে যাচ্ছে। ২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারি বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হবে। সংবিধান অনুযায়ী এর তিন মাস আগে যে কোনো এক সময় এই নির্বাচন হবে। এর আগে অবশ্য প্রধানমন্ত্রী একবার বলেছিলেন, বর্তমান সংসদের মেয়াদের শেষ দিন পর্যন্ত বর্তমান সংসদ বহাল থাকবে। তার ওই বক্তব্য সমালোচিত হয়েছিল। কেননা ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত সংসদ থাকলে, সংসদ সদস্যরা তাদের পদে থেকেই নির্বাচন করবেন। ফলে নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রভাবান্বিত হয়ে যেতে পারে।

এখন ২৪ অক্টোবরের একটি তারিখকে ঘিরে নানা প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। ওই তারিখের পর সংসদ ভেঙে যেতে পারে, এমন গুজব বাতাসে ভাসছে। বিরোধী দল ২৪ অক্টোবরের পর কঠোর কর্মসূচির কথা বলছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ যত বেশি উৎকণ্ঠিত, তত বেশি উৎকণ্ঠিত প্রবাসী বাংলাদেশীরাও। গত তিন মাস আমি সারা যুক্তরাষ্ট্র চষে বেড়িয়েছি। নিউইয়র্ক থেকে শুরু করে ওয়াশিংটন ডিসি, ডালাস, অস্টিন, হিউস্টনÑ সবার মনেই একটা প্রশ্নÑ নির্বাচন কী হবে? দেশে কী হতে যাচ্ছে? অনেকেরই নভেম্বর-ডিসেম্বরে দেশে যাওয়ার কথা। এখন যাচ্ছেন নাÑ সবার ধারণা, একটা অস্থিরতার মধ্যে দেশ পড়তে যাচ্ছে অক্টোবরের পর! এর আলামত এরই মধ্যে ফুটে উঠতে শুরু করেছে। গার্মেন্ট সেক্টর হঠাৎ করেই অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী এসেছেন নিউইয়র্কে। এখানেও তিনি বললেন, সংবিধানের আওতায়ই নির্বাচন হবে। আর ঢাকায় আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকদের একজন মোহাম্মদ নাসিম আমাদের জানিয়ে দিলেন, আর কোনো সংলাপ নয়। হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন হবে (আরটিএন, ২৪ সেপ্টেম্বর)।

অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যেটা এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে তা হচ্ছে, শেখ হাসিনাই তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থাকবেন। এ ক্ষেত্রে একটা ছোট মন্ত্রিসভা থাকতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো বক্তব্য সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। এ প্রশ্নে সংলাপ হবে না। সংলাপ হতে পারে নির্বাচনের তারিখ ও আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে। সংলাপে সংসদ ভেঙে যাওয়া নিয়েও আলোচনা হতে পারে। এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী কি জেনে-শুনেই এই ঝুঁকিটি নিতে যাচ্ছেন? তিনি কি মনে করছেন, ২৪ অক্টোবরের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি তিনি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন? তিনি নিজে এবং তার উপদেষ্টা ও দলের নীতি-নির্ধারকদের কথায় তো তাই মনে হয়। অতীত ইতিহাস প্রধানমন্ত্রী জানেন।

১৯৮৬, ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালে একটি করে বড় দল (বিএনপি, আওয়ামী লীগ) নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় তৃতীয়, চতুর্থ ও ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি এবং টিকে থাকতে পারেনি। শেখ হাসিনা কী ও রকম একটি নির্বাচনের দিকে যাচ্ছেন? বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করে আসছে বারবার। বিএনপি সংসদে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা উপস্থাপন করতে পারত। কিন্তু তারা তা করেনি। তবে নির্বাচনকালীন একটা সরকার নিয়ে এখনও আলোচনা সম্ভব। বেগম জিয়া বিকল্প বেশ কিছু প্রস্তাব দিতে পারেন। একটা প্রস্তাব হবে, তিন মাসের জন্য একটি সরকার, যে সরকার নীতি-নির্ধারণ সংক্রান্ত কোনো ‘কাজ’ করবে না। তাদের দায়িত্ব হবে শুধু নির্বাচন পরিচালনা করা। তবে প্রধানমন্ত্রীকে ‘অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে রেখেও এই সরকার গঠন করা যায়! এ ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বটি দিতে হবে বিরোধী দলের প্রধান অথবা তাদের দলীয় একজন এমপিকে। প্রধানমন্ত্রী কোনো নির্বাহী দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। তিনি কোনো প্রটোকল পাবেন না। দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারবেন না। টিভি, বেতার, সরকারি মিডিয়া তিনি ব্যবহার করতে পারবেন না। তিনি দলীয় প্রধান হিসেবে যদি কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে চান, তাহলে তিনি ‘অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রীর’ দায়িত্বে থাকতে পারবেন না। বিকল্প হিসেবে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতাকে নিয়ে একটি যৌথ সরকার গঠন করা যায়, যেখানে বিরোধীদলীয় নেতার হাতে থাকবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সংবিধান এ ক্ষেত্রে বড় বাধা। তবে বিরোধী দলের হাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থাকলে সমস্যা কম। নির্বাচন-পূর্ববর্তী তিন মাস পুরো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। দু’দলের পক্ষ থেকে ৫ জন করে ১০ জন সহকর্মী থাকবেন, যারা অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় পরিচালনা করবেন। তবে কথা থাকে, এই ১০ জন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।

একটি ‘সাহাবুদ্দিন ফর্মুলা’ও ব্যবহৃত হতে পারে। অর্থাৎ প্রধান বিচারপতি (সাবেক) সাহাবুদ্দিন আহমদকে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে নব্বই-এর আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে সব দল নীতিগতভাবে রাজি হয়েছিল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বর্তমান প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন এ দায়িত্বটি পালন করতে পারেন। তবে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের মতো তাকেও তিন মাস পর তার স্বপদে ফিরে আসার সুযোগ দিতে হবে। এক্ষেত্রে তিনি যদি দায়িত্ব নেন, তাহলে প্রশাসনিক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পরিবর্তনের দায়িত্বটি তাকে দিতে হবে।

গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থেই একটি নয়া নির্বাচন কমিশন দরকার। বর্তমান সিইসি ও কমিশনাররা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবেন এবং নয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান একটি সার্চ কমিটির মাধ্যমে নয়া সিইসি ও কমিশনারদের নিয়োগ দেবেন। সার্চ কমিটির সদস্যদের কোনো ধরনের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারবে না। নয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধানকে এককভাবে সার্চ কমিটির সদস্যদের নিয়োগের এখতিয়ার দিতে হবে। তার সিদ্ধান্তে কোনো আপত্তি চলবে না। একটি নির্বাচনকালীন ‘কোড অব কনডাক্ট’ প্রণয়ন করাও জরুরি। নির্বাচনকালীন সময়ে সহিংসতা এড়ানোর জন্য কোনো দলকে জনসভা করতে দেয়ার অনুমতি দেয়া হবে না। টিভি ও বেতারে তারা কর্মসূচি উপস্থাপন করবেন। কোনো নেতা-নেত্রী সম্পর্কে কটূক্তি করা যাবে না।

সাংবিধানিকভাবে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত সংসদ বৈধ। তবে এর ৯০ দিন আগে প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভেঙে দেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করবেন। সংসদ ভেঙে যাওয়ার তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন হবে। এই সময়ে দুই নেত্রী সমান প্রটোকল পাবেন। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, সংসদ রেখেই দেশে নির্বাচন হবে। ‘সংসদ রেখে নির্বাচন’-এর বক্তব্য সংবিধানসম্মত নয়। প্রধানমন্ত্রী প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করার কথা বলেন। সংবিধানের প্রতিটি ধারা, উপধারা তিনি ভালো বোঝেন, এটা আমার বিশ্বাস। কিন্তু ‘সংসদ রেখে নির্বাচন’ কোন ধারায় আছে, আমি তা খুঁজে পাইনি কোথাও। বরং সংবিধানের ১২৩ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, সংসদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যেই নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীকে রেখে যে নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে, তা বাস্তবায়ন করতে হলে বিএনপির সম্মতি যেমনি প্রয়োজন, ঠিক তেমনি প্রয়োজন ২৪ অক্টোবরের পর সংসদ ভেঙে দেয়া। ওই তিন মাস প্রধানমন্ত্রী থাকবেন, তবে সংসদ থাকবে না। সংসদ থাকলে কী ধরনের জটিলতা তৈরি হবে, তা এরই মধ্যে আমরা একাধিকবার আলোচনা করেছি।

এখন যে বিষয়টি গুরুত্ব পেতে পারে, তা হচ্ছে, সংবিধানের আওতায় কীভাবে একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যায়। টিভি টক-শো আর সরকারি বুদ্ধিজীবীদের যুক্তিহীন বক্তব্যে এর সমাধান হবে না। ২৪ অক্টোবরের আগেই সরকার আর বিরোধী দলের সংবিধান বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সংলাপ করতে হবে। এখানে মহাসচিব পর্যায়ে বৈঠকের কোনো প্রয়োজন নেই। স্পিকারের সভাপতিত্বে দু’দলের সংবিধান বিশেষজ্ঞরা সংলাপ করতে পারেন। ওই সংলাপে একটা সমাধান বের হয়ে আসতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর কথাবার্তায় এটা স্পষ্টÑ প্রধানমন্ত্রী নিজে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে যেতে চান এবং নির্বাচন পরিচালনা করতে চান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যা বুঝতে পারছেন না তা হচ্ছে, তিনি যদি অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও থেকে যান, তাহলে সুবিধাভোগীরা তাকে দিয়ে ক্ষমতা না ছাড়ার নানা ষড়যন্ত্র (?) করতে পারে। তার আমলে প্রশাসনে নিয়োগপ্রাপ্তদের দিয়ে তিনি নির্বাচনে প্রভাব খাটাতে পারেন। নির্বাচন কমিশনাররা (সিইসি বাদে) তার আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত। নির্বাচন কমিশনাররা ‘অবৈধ কর্মকা-ে’ জড়িয়ে পড়তে পারেন। নির্বাচনের সময় সেনা মোতায়েন না হলে স্থানীয় পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এসবই আশঙ্কার কথা। বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে এ ধরনের সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দেয়া যায় না।

এখন যদি সরকার সত্যিকার অর্থেই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন এবং সংবিধানকে সমুন্নত রাখতে চান, তাহলে বিরোধী দলের আস্থা সরকারকে অর্জন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীকে তার উপদেষ্টারা কিংবা নীতি-নির্ধারকরা তাকে সঠিক উপদেশটি দিচ্ছেন বলে মনে হয় না। প্রধানমন্ত্রীকে এটা উপলব্ধি করতে হবে যে, বাংলাদেশের ৪১ বছরের সংবিধানের ইতিহাসে এবারের মতো এত বড় সঙ্কট অতীতে কখনও সৃষ্টি হয়নি। এরশাদ জমানার শেষের দিকে কীভাবে এরশাদ ক্ষমতা সংবিধানের আওতায় হস্তান্তর করবেন এ প্রশ্ন উঠলেও, বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান করে একটা সমাধান বের করা সম্ভব হয়েছিল। কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছিল সাংবিধানিক সঙ্কট। বর্তমানে পরিস্থিতি দিনে দিনে জটিল হচ্ছে। দাতা দেশগুলোর প্রতিনিধিরা জানিয়ে দিয়েছেন যে, তারা চান সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন। সেটা এখনও সম্ভব। এমনকি সাংবিধানিকভাবে কীভাবে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়, সেটা নিয়েও আলোচনা শুরু হতে পারে। স্পিকার স্বয়ং উদ্যোগ নিতে পারেন। সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। নিউইয়র্কে থেকেও আমি ঢাকার উত্তাপ বেশ অনুভব করছি। হাজারটা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় আমাকে। একদলীয় নির্বাচন, তথাকথিত তৃতীয় শক্তির উত্থান, উত্তরপাড়া, ড. ইউনূসের ভূমিকা নিয়ে নানা কথা বাতাসে ভাসছে এই নিউইয়র্ক শহরে। প্রধানমন্ত্রী ঘুরে গেলেন। এখান থেকে তিনি কী মেসেজ নিয়ে গেলেন, জানি না। কিন্তু জানি, সব দলের অংশগ্রহণ যদি নিশ্চিত করা না হয়, তাহলে প্রবাসী বাংলাদেশীরা থাকবেন হতাশায়। বাংলাদেশ তাদের জন্য এক সময় অচেনা হয়ে যাবে।
দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ, ২ অক্টোবর ২০১৩
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও কলাম লেখক

0 comments:

Post a Comment