২০১১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরের ঘটনা। শত শত তরুণ জমায়েত হয়েছিল নিউইয়র্কের লোয়ার ম্যানহাটনের একটি ছোট্ট পার্কে, যার নাম জুকোট্টি পার্ক। সেখানে জš§ হয়েছিল একটি আন্দোলনেরÑ ‘অক্যুপাই মুভমেন্ট’। দিনের পর দিন ছোট এই পার্কটি দখল করে রেখে তারা যে ইতিহাস রচনা করে, তা প্রতিবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে সৃষ্টি করে অনন্য এক নজির। তরুণরা প্রতিবাদ করে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের ‘অসমতা, দারিদ্র্য, শোষণ আর বঞ্চনার’। সারা দুনিয়ার মানুষকে তারা জানায়, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অন্যতম সম্পদশালী রাষ্ট্রে পরিণত হলেও এখানেও দারিদ্র্য আছে। কিছু মানুষের কাছে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে। দাবি ওঠে, স্লোগান ওঠে ‘আমরাই জনগোষ্ঠীর ৯৯ ভাগ’। দিনের পর দিন জুকোট্টি পার্কে তাঁবু খাঁটিয়ে অবস্থান করে অসমতা, শোষণ আর বঞ্চনার যে প্রতিবাদ তারা করেছিল, তা ছড়িয়ে গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের এক শহর থেকে আরেক শহরে। একসময় আটলান্টিক আর প্রশান্ত মহাসাগরের ওপারের দেশগুলোতেও তা ছড়িয়ে পড়ে। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী এই প্রতিবাদ ইতিহাসে স্থান করে নেয়। ইতিহাসে এভাবেই প্রতিবাদী আন্দোলন লিখিত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের পতনের পর (ডিসেম্বর ১৯৯১), চীনে সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি চালু হওয়ার পর মার্কিন তাত্ত্বিকরা (ফুকিয়ামা, হানটিংটন) একসময় বলতে শুরু করেছিলেন সমাজতন্ত্র ব্যর্থ। সমাজতন্ত্র মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। কিন্তু নিউইয়র্কের ‘অক্যুপাই মুভমেন্ট’ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল মার্কিন সমাজে অসমতা কত গভীরে। এখানেও দারিদ্র্য আছে। শোষণ ও বঞ্চনা এখানে অনেক বেশি।
জুকোট্টি পার্কের আন্দোলন শেষ হয়ে গিয়েছিল দু’বছর আগে। এ আন্দোলন, এর পরিণতি, মার্কিন সমাজের বৈষম্য নিয়ে আমার অনেক লেখা তখন ছাপা হয়েছিল। নিউইয়র্কে এসেই তাই আমি ছুটে গিয়েছিলাম জুকোট্টি পার্কে। সঙ্গে আমার ছাত্র নূর মিয়াজী কালাম। সরকার ও রাজনীতির ছাত্র কালামেরও আগ্রহ ছিল বিশ্বব্যাপী ওই পরিবর্তন নিয়ে। ক্লাসেও আমার সঙ্গে বিতর্ক জুড়ে দিত কালাম। সেই আন্দোলনের দু’বছর পর আমরা যখন জুকোট্টি পার্কে গেলাম, আমার বিশ্বাস হতে কষ্ট হচ্ছিল এখানেই ইতিহাস রচিত হয়েছিল মাত্র দু’বছর আগে। ছোট্ট একটি পার্ক, এ রকম পার্ক এই নিউইয়র্ক শহরে হাজারটা আছে। এত ছোট্ট যে, অনেক লোক একসঙ্গে জড়ো হওয়াও কঠিন! পেছনে বার্গার কিংয়ের দোকান। এর সামনে দিয়ে একটা রাস্তা চলে গেছে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার ধসে যাওয়া ভবনের দিকে। ডান পাশে পানিনি অ্যান্ড কোম্পানির ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। পাশে ওয়ান লিবার্টি প্লাজা। উল্টোদিকে একটা রাস্তা, তার মাথায় ওয়াল স্ট্রিট, হেঁটে যাওয়া যায়। এই জুকোট্টি পার্ক আমাকে টেনে নিয়ে গেল ২০১১ সালের ঘটনাবলীর দিকে।
যে প্রেক্ষাপটে ‘অক্যুপাই মুভমেন্টে’র জš§ হয়েছিল, তার একটা ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন। ২০০৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ইতিহাসে ঘটে গিয়েছিল সবচেয়ে বড় ধরনের কলংকের ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রের ৪র্থ বিনিয়োগে ব্যাংক লেহম্যান ব্রাদার্স নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে। এর প্রতিক্রিয়া শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই অনুভূত হয়নি, এর প্রভাব পড়ে বিশ্ব অর্থনীতিতেও। যুক্তরাষ্ট্রের হাউজিং ব্যবসায় বড় ধরনের ধস নামে। বাড়ির দাম কমে যায়। শত শত মানুষ ব্যাংকের দেনা শোধ করতে না পেরে বাড়ি হারিয়ে ফেলেন। স্থানীয়ভাবে অনেক ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যায়। লেহম্যান ব্রাদার্স দেউলিয়া হয়ে যাওয়ায় অর্থনীতিতে ক্ষতির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ১৪ ট্রিলিয়ন ডলার (১ ট্রিলিয়ন সমান এক হাজার বিলিয়ন)। পরিবারপ্রতি ক্ষতির পরিমাণ হিসাব করা হয় ১ লাখ ২০ হাজার ডলার। অর্থনীতির এই দেউলিয়াত্বের কারণে চাপ পড়ে সামাজিক খাতের ওপর। দারিদ্র্য বেড়ে যায়। স্বাস্থ্যসেবা খাতে অর্থ বরাদ্দ কমে যায়। শত শত তরুণ তাদের গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার জন্য যে আর্থিক অনুদান পেত, তা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে জš§ হয় ‘অক্যুপাই মুভমেন্টে’র।
মার্কিন পুঁজিবাদী সমাজে একশ্রেণীর মানুষের কাছে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে দিনের পর দিন। অন্যদিকে বাড়ছিল দারিদ্র্য। এই অসমতাই তরুণ সমাজকে নিউইয়র্কের রাস্তায় টেনে নিয়ে গিয়েছিল। জুকোট্টি পার্ককে বেছে নেয়ার কারণ, এ পার্কের পাশেই ওয়াল স্ট্রিট, যেখানে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্টক এক্সচেঞ্জ। ওই স্টক এক্সচেঞ্জকে গণ্য করা হয় পুঁজিবাদের প্রতীক হিসেবে। ওয়াল স্ট্রিটের আশপাশের ভবনে রয়েছে বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সদর দফতর। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এখানে অবস্থিত। মার্কিন সমাজে অসমতা কীভাবে তৈরি হয়েছিল, তার একটা পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদী সমাজে ১৯৭০ সালে ধনিক শ্রেণী হিসেবে পরিচিতদের হাতে দেশের মোট আয়ের ৮ থেকে ৯ ভাগ অর্থ সঞ্চিত হতো। ২০১১ সালে তারা ভোগ করতেন মোট সম্পদের ২৩ দশমিক ৫ ভাগ। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (ব্রাকলে) অধ্যাপক ইমানুয়েল সাজের মতে, ১০ ভাগ আমেরিকান দেশটির মোট বেতনের ৪৯ দশমিক ৭ ভাগ গ্রহণ করে। অধ্যাপক ডেভিড গ্রে অপর এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, আমেরিকান ধনীদের মোট সম্পদের পরিমাণ ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের গরিব জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের মোট সম্পদের চেয়েও বেশি। তার মতে, শীর্ষে থাকা এক ভাগ ধনী যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ৭০ ভাগের মালিক। আর নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিসের মতে, শীর্ষে থাকা ওই এক ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তরাষ্ট্রের মোট সম্পদের ৪০ ভাগ। অথচ ২৫ বছর আগে ধনীরা নিয়ন্ত্রণ করত মাত্র ১২ ভাগ সম্পদ।
এই যে অসমতা ও সম্পদ কিছু ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়া- এ সম্পদের সমতা রক্ষা করার জন্যই জš§ হয়েছিল ‘অক্যুপাই মুভমেন্টে’র। সেটা ছিল অনেকটা স্বাভাবিক একটা ব্যাপারÑ একটা প্রতিবাদ। যুগে যুগে তরুণ সমাজ এভাবেই প্রতিবাদী হয়েছে। ষাটের দশকে ইউরোপে, বিশেষ করে জার্মানিতে তরুণ সমাজও এভাবে যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়েছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মতো সমাজেও যে অসমতা ও দারিদ্র্য রয়েছে, তা ছিল অকল্পনীয়। খোদ নিউইয়র্ক শহরেও অনেক মানুষ রয়েছে, যাদের কোনো ঘর-বাড়ি নেই। চাকরি নেই। ফুড স্টাম্পেই তাদের দিন চলে। এই নিউইয়র্ক শহরে ম্যানহাটন এলাকায় আমি অনেক যুদ্ধাহত আমেরিকানকে দেখেছি ভিক্ষা করতে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র (ইরাক ও আফগানিস্তানে) যুদ্ধের পেছনে খরচ করেছে ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার, সেখানে একজন যুদ্ধাহত নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি রাষ্ট্রটি! অনেকের কাছেই এই বৈষম্য বিশ্বাস করা কঠিন! তাই হঠাৎ করেই অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রিটের জš§ হয়নি। ধীরে ধীরে তরুণ সমাজের ক্ষোভ বাড়ছিল, আর তার বিস্ফোরণ ঘটেছিল নিউইয়র্কে ২০১১ সালে। কিন্তু তা কি আদৌ কোনো পরিবর্তন আনতে পেরেছে মার্কিন সমাজে? আমরা যখন ‘অক্যুপাই মুভমেন্টে’র বর্ষপূর্তি নিয়ে আলোচনা করছি, ঠিক তখনই ওয়াশিংটনে প্রতিনিধি পরিষদে ‘ফুড স্টাম্পে’ অর্থ বরাদ্দ ৪০ মিলিয়ন ডলার কমানো হয়েছে। এই ‘ফুড স্টাম্প’ কর্মসূচি হচ্ছে ফেডারেল সরকারের একটি অনুদান, যার মাধ্যমে নিু আয়ের গরিব পরিবারকে খাদ্য সহায়তা করা হয়। এই ‘ফুড স্টাম্পে’র বিনিময়ে নিু আয়ের মানুষরা খাদ্য কিনে থাকেন ফেডারেল সরকারের আর্থিক সহায়তায়। এখন রিপাবলিকানরা এটা বন্ধ করে দিতে চাচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, আগামী বছর ৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন মানুষ এই সহায়তা পাবে না। শুধু তাই নয়, এই কর্মসূচির আওতায় কয়েক লাখ শিশু দুপুরে স্কুলে কোনো ‘ফ্রি লাঞ্চ’ পাবে না। এর ফলে মানুষে মানুষে অসমতা ও দারিদ্র্য আরও বাড়বে।
সাম্প্রতিক সময়ের অসমতার আরেকটি চিত্র তুলে ধরেছে সেন্টার ফর আমেরিকান প্রগ্রেস নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তারা দেখিয়েছে (১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৩), যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ৫টি শিশুর মাঝে ১টি দরিদ্র। তাদের মতে, ২০১২ সালে ১৪ দশমিক ৫ ভাগ মানুষ (৪৯ মিলিয়ন) ক্ষুধার জন্য লড়াই করেছিল। আফ্রো-আমেরিকানদের ক্ষেত্রে এই হার ২৫ ভাগ, হিসপানিক ২৩ ভাগ। ‘ফুড স্টাম্পে’র কারণে ২০১১ সালে ২ দশমিক ১ মিলিয়ন শিশু দারিদ্র্যের চক্র থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে। শুধু তাই নয়, ২ দশমিক ৬ মিলিয়ন সিনিয়র সিটিজেনও দারিদ্র্য দূর করতে পেরেছে। এখন এই কর্মসূচি বন্ধ হতে যাচ্ছে। তাহলে ‘অক্যুপাই মুভমেন্ট’ করে লাভ কী হল? হাজার হাজার মানুষ একত্রিত হয়ে যে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, তার কি কোনো প্রভাব থাকবে না এই মার্কিন সমাজে। আমি জুকোট্টির পাশে দাঁড়িয়ে থেকে কালামকে এ প্রশ্নটিই করেছিলাম। কালাম এখন আমেরিকার নাগরিক। ওর স্ত্রী সাবিনাও আমার ছাত্রী ছিল। সাবিনাও আমেরিকান। ওর মেয়ে চেলসি, সেও আমেরিকান। ‘আমরাই ৯৯ ভাগ’-এর মাঝে কালাম-সাবিনার মতো নয়া আমেরিকানরাও রয়েছে। কিন্তু এ সমাজে পরিবর্তন আনাটা কঠিন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। সমাজতন্ত্রের সেখানে পতন হয়েছে। সমাজতন্ত্র এখন ইতিহাসের অংশ। চীনের ‘মাও ড্রেস’ও এখন ইতিহাস। চীনের মানুষ এখন অর্থ আর বিত্তের পেছনে ঘুরছে, সমাজতন্ত্র তাদের টানে না। মস্কোতে একবার এক রুশ তরুণী আমার কাছে ডলার চেয়েছিল। সেটা সমাজতন্ত্র ভেঙে পড়ার আগের কথা। ‘ডলার সাম্রাজ্যের’ বিরুদ্ধে আজ প্রতিবাদী হচ্ছে মার্কিন নাগরিকরা। এখানে দারিদ্র্য বাড়ছে। বাড়ছে বৈষম্য। একটা প্রতিবাদ উঠেছিল ‘অক্যুপাই মুভমেন্টে’র মধ্য দিয়ে। এই আন্দোলন থেমে থাকবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর ‘অক্যুপাই মুভমেন্ট’ তার দু’বছর পার করল। মানুষ এখানে স্মরণ করেছে এই দিনটিকে। কিন্তু প্রধান প্রধান মিডিয়ায় এ দিনটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে কম। বিকল্প মিডিয়ায় বিষয়টি উঠে এসেছে। বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র। পৃথিবীর এক নম্বর অর্থনীতির দেশ এই আমেরিকা। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির পরিমাণ ১৫ দশমিক ৬৮ ট্রিলিয়ন ডলার এবং মাথাপিছু আয়ের (গড়) পরিমাণ ৪৯ হাজার ৯২২ ডলার, সেখানে যদি জনগোষ্ঠীর শতকরা ১৫ ভাগ মানুষ গরিব থাকে (যুক্তরাষ্ট্রের সেন্সাস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী), তা কোনো আশার কথা বলে না। ‘অক্যুপাই মুভমেন্টে’র স্পিরিট যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা গ্রহণ করে নিতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। জুকোট্টি পার্কে দাঁড়িয়ে আমার সে কথাটাই মনে হয়েছিল বারবার।
জুকোট্টি পার্কের আন্দোলন শেষ হয়ে গিয়েছিল দু’বছর আগে। এ আন্দোলন, এর পরিণতি, মার্কিন সমাজের বৈষম্য নিয়ে আমার অনেক লেখা তখন ছাপা হয়েছিল। নিউইয়র্কে এসেই তাই আমি ছুটে গিয়েছিলাম জুকোট্টি পার্কে। সঙ্গে আমার ছাত্র নূর মিয়াজী কালাম। সরকার ও রাজনীতির ছাত্র কালামেরও আগ্রহ ছিল বিশ্বব্যাপী ওই পরিবর্তন নিয়ে। ক্লাসেও আমার সঙ্গে বিতর্ক জুড়ে দিত কালাম। সেই আন্দোলনের দু’বছর পর আমরা যখন জুকোট্টি পার্কে গেলাম, আমার বিশ্বাস হতে কষ্ট হচ্ছিল এখানেই ইতিহাস রচিত হয়েছিল মাত্র দু’বছর আগে। ছোট্ট একটি পার্ক, এ রকম পার্ক এই নিউইয়র্ক শহরে হাজারটা আছে। এত ছোট্ট যে, অনেক লোক একসঙ্গে জড়ো হওয়াও কঠিন! পেছনে বার্গার কিংয়ের দোকান। এর সামনে দিয়ে একটা রাস্তা চলে গেছে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার ধসে যাওয়া ভবনের দিকে। ডান পাশে পানিনি অ্যান্ড কোম্পানির ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। পাশে ওয়ান লিবার্টি প্লাজা। উল্টোদিকে একটা রাস্তা, তার মাথায় ওয়াল স্ট্রিট, হেঁটে যাওয়া যায়। এই জুকোট্টি পার্ক আমাকে টেনে নিয়ে গেল ২০১১ সালের ঘটনাবলীর দিকে।
যে প্রেক্ষাপটে ‘অক্যুপাই মুভমেন্টে’র জš§ হয়েছিল, তার একটা ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন। ২০০৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ইতিহাসে ঘটে গিয়েছিল সবচেয়ে বড় ধরনের কলংকের ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রের ৪র্থ বিনিয়োগে ব্যাংক লেহম্যান ব্রাদার্স নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে। এর প্রতিক্রিয়া শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই অনুভূত হয়নি, এর প্রভাব পড়ে বিশ্ব অর্থনীতিতেও। যুক্তরাষ্ট্রের হাউজিং ব্যবসায় বড় ধরনের ধস নামে। বাড়ির দাম কমে যায়। শত শত মানুষ ব্যাংকের দেনা শোধ করতে না পেরে বাড়ি হারিয়ে ফেলেন। স্থানীয়ভাবে অনেক ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যায়। লেহম্যান ব্রাদার্স দেউলিয়া হয়ে যাওয়ায় অর্থনীতিতে ক্ষতির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ১৪ ট্রিলিয়ন ডলার (১ ট্রিলিয়ন সমান এক হাজার বিলিয়ন)। পরিবারপ্রতি ক্ষতির পরিমাণ হিসাব করা হয় ১ লাখ ২০ হাজার ডলার। অর্থনীতির এই দেউলিয়াত্বের কারণে চাপ পড়ে সামাজিক খাতের ওপর। দারিদ্র্য বেড়ে যায়। স্বাস্থ্যসেবা খাতে অর্থ বরাদ্দ কমে যায়। শত শত তরুণ তাদের গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার জন্য যে আর্থিক অনুদান পেত, তা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে জš§ হয় ‘অক্যুপাই মুভমেন্টে’র।
মার্কিন পুঁজিবাদী সমাজে একশ্রেণীর মানুষের কাছে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে দিনের পর দিন। অন্যদিকে বাড়ছিল দারিদ্র্য। এই অসমতাই তরুণ সমাজকে নিউইয়র্কের রাস্তায় টেনে নিয়ে গিয়েছিল। জুকোট্টি পার্ককে বেছে নেয়ার কারণ, এ পার্কের পাশেই ওয়াল স্ট্রিট, যেখানে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্টক এক্সচেঞ্জ। ওই স্টক এক্সচেঞ্জকে গণ্য করা হয় পুঁজিবাদের প্রতীক হিসেবে। ওয়াল স্ট্রিটের আশপাশের ভবনে রয়েছে বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সদর দফতর। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এখানে অবস্থিত। মার্কিন সমাজে অসমতা কীভাবে তৈরি হয়েছিল, তার একটা পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদী সমাজে ১৯৭০ সালে ধনিক শ্রেণী হিসেবে পরিচিতদের হাতে দেশের মোট আয়ের ৮ থেকে ৯ ভাগ অর্থ সঞ্চিত হতো। ২০১১ সালে তারা ভোগ করতেন মোট সম্পদের ২৩ দশমিক ৫ ভাগ। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (ব্রাকলে) অধ্যাপক ইমানুয়েল সাজের মতে, ১০ ভাগ আমেরিকান দেশটির মোট বেতনের ৪৯ দশমিক ৭ ভাগ গ্রহণ করে। অধ্যাপক ডেভিড গ্রে অপর এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, আমেরিকান ধনীদের মোট সম্পদের পরিমাণ ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের গরিব জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের মোট সম্পদের চেয়েও বেশি। তার মতে, শীর্ষে থাকা এক ভাগ ধনী যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ৭০ ভাগের মালিক। আর নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিসের মতে, শীর্ষে থাকা ওই এক ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তরাষ্ট্রের মোট সম্পদের ৪০ ভাগ। অথচ ২৫ বছর আগে ধনীরা নিয়ন্ত্রণ করত মাত্র ১২ ভাগ সম্পদ।
এই যে অসমতা ও সম্পদ কিছু ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়া- এ সম্পদের সমতা রক্ষা করার জন্যই জš§ হয়েছিল ‘অক্যুপাই মুভমেন্টে’র। সেটা ছিল অনেকটা স্বাভাবিক একটা ব্যাপারÑ একটা প্রতিবাদ। যুগে যুগে তরুণ সমাজ এভাবেই প্রতিবাদী হয়েছে। ষাটের দশকে ইউরোপে, বিশেষ করে জার্মানিতে তরুণ সমাজও এভাবে যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়েছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মতো সমাজেও যে অসমতা ও দারিদ্র্য রয়েছে, তা ছিল অকল্পনীয়। খোদ নিউইয়র্ক শহরেও অনেক মানুষ রয়েছে, যাদের কোনো ঘর-বাড়ি নেই। চাকরি নেই। ফুড স্টাম্পেই তাদের দিন চলে। এই নিউইয়র্ক শহরে ম্যানহাটন এলাকায় আমি অনেক যুদ্ধাহত আমেরিকানকে দেখেছি ভিক্ষা করতে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র (ইরাক ও আফগানিস্তানে) যুদ্ধের পেছনে খরচ করেছে ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার, সেখানে একজন যুদ্ধাহত নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি রাষ্ট্রটি! অনেকের কাছেই এই বৈষম্য বিশ্বাস করা কঠিন! তাই হঠাৎ করেই অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রিটের জš§ হয়নি। ধীরে ধীরে তরুণ সমাজের ক্ষোভ বাড়ছিল, আর তার বিস্ফোরণ ঘটেছিল নিউইয়র্কে ২০১১ সালে। কিন্তু তা কি আদৌ কোনো পরিবর্তন আনতে পেরেছে মার্কিন সমাজে? আমরা যখন ‘অক্যুপাই মুভমেন্টে’র বর্ষপূর্তি নিয়ে আলোচনা করছি, ঠিক তখনই ওয়াশিংটনে প্রতিনিধি পরিষদে ‘ফুড স্টাম্পে’ অর্থ বরাদ্দ ৪০ মিলিয়ন ডলার কমানো হয়েছে। এই ‘ফুড স্টাম্প’ কর্মসূচি হচ্ছে ফেডারেল সরকারের একটি অনুদান, যার মাধ্যমে নিু আয়ের গরিব পরিবারকে খাদ্য সহায়তা করা হয়। এই ‘ফুড স্টাম্পে’র বিনিময়ে নিু আয়ের মানুষরা খাদ্য কিনে থাকেন ফেডারেল সরকারের আর্থিক সহায়তায়। এখন রিপাবলিকানরা এটা বন্ধ করে দিতে চাচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, আগামী বছর ৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন মানুষ এই সহায়তা পাবে না। শুধু তাই নয়, এই কর্মসূচির আওতায় কয়েক লাখ শিশু দুপুরে স্কুলে কোনো ‘ফ্রি লাঞ্চ’ পাবে না। এর ফলে মানুষে মানুষে অসমতা ও দারিদ্র্য আরও বাড়বে।
সাম্প্রতিক সময়ের অসমতার আরেকটি চিত্র তুলে ধরেছে সেন্টার ফর আমেরিকান প্রগ্রেস নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তারা দেখিয়েছে (১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৩), যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ৫টি শিশুর মাঝে ১টি দরিদ্র। তাদের মতে, ২০১২ সালে ১৪ দশমিক ৫ ভাগ মানুষ (৪৯ মিলিয়ন) ক্ষুধার জন্য লড়াই করেছিল। আফ্রো-আমেরিকানদের ক্ষেত্রে এই হার ২৫ ভাগ, হিসপানিক ২৩ ভাগ। ‘ফুড স্টাম্পে’র কারণে ২০১১ সালে ২ দশমিক ১ মিলিয়ন শিশু দারিদ্র্যের চক্র থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে। শুধু তাই নয়, ২ দশমিক ৬ মিলিয়ন সিনিয়র সিটিজেনও দারিদ্র্য দূর করতে পেরেছে। এখন এই কর্মসূচি বন্ধ হতে যাচ্ছে। তাহলে ‘অক্যুপাই মুভমেন্ট’ করে লাভ কী হল? হাজার হাজার মানুষ একত্রিত হয়ে যে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, তার কি কোনো প্রভাব থাকবে না এই মার্কিন সমাজে। আমি জুকোট্টির পাশে দাঁড়িয়ে থেকে কালামকে এ প্রশ্নটিই করেছিলাম। কালাম এখন আমেরিকার নাগরিক। ওর স্ত্রী সাবিনাও আমার ছাত্রী ছিল। সাবিনাও আমেরিকান। ওর মেয়ে চেলসি, সেও আমেরিকান। ‘আমরাই ৯৯ ভাগ’-এর মাঝে কালাম-সাবিনার মতো নয়া আমেরিকানরাও রয়েছে। কিন্তু এ সমাজে পরিবর্তন আনাটা কঠিন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। সমাজতন্ত্রের সেখানে পতন হয়েছে। সমাজতন্ত্র এখন ইতিহাসের অংশ। চীনের ‘মাও ড্রেস’ও এখন ইতিহাস। চীনের মানুষ এখন অর্থ আর বিত্তের পেছনে ঘুরছে, সমাজতন্ত্র তাদের টানে না। মস্কোতে একবার এক রুশ তরুণী আমার কাছে ডলার চেয়েছিল। সেটা সমাজতন্ত্র ভেঙে পড়ার আগের কথা। ‘ডলার সাম্রাজ্যের’ বিরুদ্ধে আজ প্রতিবাদী হচ্ছে মার্কিন নাগরিকরা। এখানে দারিদ্র্য বাড়ছে। বাড়ছে বৈষম্য। একটা প্রতিবাদ উঠেছিল ‘অক্যুপাই মুভমেন্টে’র মধ্য দিয়ে। এই আন্দোলন থেমে থাকবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর ‘অক্যুপাই মুভমেন্ট’ তার দু’বছর পার করল। মানুষ এখানে স্মরণ করেছে এই দিনটিকে। কিন্তু প্রধান প্রধান মিডিয়ায় এ দিনটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে কম। বিকল্প মিডিয়ায় বিষয়টি উঠে এসেছে। বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র। পৃথিবীর এক নম্বর অর্থনীতির দেশ এই আমেরিকা। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির পরিমাণ ১৫ দশমিক ৬৮ ট্রিলিয়ন ডলার এবং মাথাপিছু আয়ের (গড়) পরিমাণ ৪৯ হাজার ৯২২ ডলার, সেখানে যদি জনগোষ্ঠীর শতকরা ১৫ ভাগ মানুষ গরিব থাকে (যুক্তরাষ্ট্রের সেন্সাস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী), তা কোনো আশার কথা বলে না। ‘অক্যুপাই মুভমেন্টে’র স্পিরিট যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা গ্রহণ করে নিতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। জুকোট্টি পার্কে দাঁড়িয়ে আমার সে কথাটাই মনে হয়েছিল বারবার।
দৈনিক যুগান্তর, ৩ অক্টোবর ২০১৩,
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
তারেক শামসুর রেহমান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
0 comments:
Post a Comment