গত ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকার অনলাইন ভার্সনের খবর ‘বেড়ানো আর শপিংয়েই ব্যস্ত তারা’। সংবাদটি পাঠিয়েছেন ওই পত্রিকার নিউইয়র্ক সংবাদদাতা। মূল বিষয় হচ্ছে একটিই জাতিসংঘের ৬৮তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হওয়া ১৪০ সদস্যের অনেকেই এখন নিউইয়র্কে ব্যস্ত শপিং আর কেনাকাটায়। যেখানে অধিবেশনে যোগ দেয়ার সুযোগ পেয়েছেন মাত্র কয়েকজন, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী ১৪০ জন কেন? এ প্রশ্নের জবাব জানার কোনো সুযোগ আমার নেই। কিন্তু আমি জানি এ দেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় এদের টিকিট কাটা হয়েছে! তবে ২৬ জনের মতো ব্যবসায়ীও এসেছেন, যারা নিজেরা টিকিট কেটেছেন। সরকারপ্রধানের সফরসঙ্গী হয়ে কেনাকাটা আর বেড়ানোর জন্য নিউইয়র্কে আসার কোনো মানে হয় না। রাষ্ট্র এভাবে কাউকে, কোনো সরকারকে এ ধরনের অপচয়ের সুযোগ দিতে পারে না। পত্রিকার খবরে জানলাম ওই ১৪০ জনের মাঝে আমলাপত্নী, মন্ত্রীপত্নীও আছেন। আমি জানি না সংবাদের সত্যতা কতটুকু। যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক আমলাপত্নী বা মন্ত্রীপত্নীর কাজটা নিউইয়র্কে কী? সবার খরচ (ব্যবসায়ীরা বাদে) সরকারের। টিকিট থেকে শুরু করে টার্মিনাল ট্যাক্স, হোটেল ভাড়া, যাতায়াত সব খরচই জোগাবে রাষ্ট্র। অন্য কোনো দেশের রাষ্ট্র কিংবা সরকারপ্রধান কি এভাবে এত বিপুলসংখ্যক প্রতিনিধি দল নিয়ে নিউইয়র্কে এসেছেন? না, আসেননি। ব্যবসায়ীরাও এসেছেন নিজস্ব খরচে। প্রশ্ন থেকে যায় এটা তো প্রধানমন্ত্রীর কোনো রাষ্ট্রীয় সফর নয়, কোনো দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হওয়ারও সম্ভাবনা নেই। তাহলে ব্যবসায়ীরা এলেন কোন প্রয়োজনে? নিউইয়র্কে বাজার করা ছাড়া তাদের আর কী কাজ থাকতে পারে? অনলাইনে ফেসবুকে দেখলাম একজন উৎসাহী জনপ্রতি খরচের একটা হিসাব দিয়েছেন। এই হিসাবের পরিমাণ ৯ লাখ ৫২ হাজার টাকা! এটা হয়তো সঠিক হিসাব নয়। কিন্তু কাছাকাছি একটা হিসাব। তাহলে কত টাকা রাষ্ট্রের গেল? আমাদের দেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সে অর্থে বিকশিত হয়নি। হলে দেখা যেত কত টাকা খরচ হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর বিলাস নিয়ে এর আগে একটি সংবাদপত্র রিপোর্ট করেছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। কোনো দেশ এত বিপুলসংখ্যক প্রতিনিধি দল নিয়ে নিউইয়র্কে আসেনি। ইরানের প্রেসিডেন্টের এই সফর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭৯ সালের পর এই প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে কথাবার্তা হয়েছে। তবে ওবামা-রুহানি বৈঠক হয়নি। তারপরও প্রেসিডেন্ট রুহানির সঙ্গে ছিলেন অর্থমন্ত্রী ও পেট্রোলিয়াম দফতরের মন্ত্রী। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের সংখ্যা ২৬ জন। ভারত বড় দেশ। বিশ্ব অর্থনীতিতে জাপানের ওপরে অবস্থান এখন ভারতের। নব্য অর্থনৈতিক শক্তি ‘ব্রিক’-এর সদস্য ভারত। তারপরও সীমিত একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে এসেছেন মনমোহন সিং। বেশ কয়েক বছর আগে ব্যক্তিগত খরচে এ ধরনের জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। আমার মনে আছে কিউবার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ত্রো কোনো পাঁচতারা হোটেলে ওঠেননি। ছিলেন রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে। আমার মনে আছে কোনো কোনো আফ্রিকান দেশের প্রতিনিধিরা সম্মেলন কক্ষে এসেছিলেন সাবওয়েতে করে, লিমুজিন কারে নয়। আমাদের সরকারি প্রতিনিধিদের কাছ থেকে কি তেমনটি প্রত্যাশা করা যায়? ১৪০ জনের এই বিশাল বহর বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করবে না। প্রতিনিধি দলে তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু কিংবা রাশেদ খান মেননের অন্তর্ভুক্তি দেখে আমি অবাক হয়েছি। মাত্র কিছুদিন আগে মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে অস্বীকার করেছিলেন তোফায়েল আর মেনন। প্রধানমন্ত্রী তাদের সিদ্ধান্তে নাখোশ হয়েছিলেন। তোফায়েল আহমেদ এখন আর আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী ফোরামে নেই। হতাশাগ্রস্ত তোফায়েল তখন তার মনোকষ্ট প্রকাশ করতেও দ্বিধাবোধ করেননি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না এমন খবর পত্র-পত্রিকায়ও ছাপা হয়েছিল। রাশেদ খান মেননও যে সরকারের কর্মকাণ্ডে খুশি, তা নয়। প্রধানমন্ত্রী এদের দু’জনকে নিউইয়র্কে নিয়ে এসে তাদের ‘খুশি’ করতে চাইলে তারা খুশি হবেন, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। তাহলে কি তোফায়েল, আমু, মেনন সাহেবরা ২৫ অক্টোবরের পর ছোট পরিসরে যে মন্ত্রিসভা গঠিত হবে তাতে যোগ দিতে যাচ্ছেন? সরকারের নীতি-নির্ধারকরা তো বলেন ছোট্ট পরিসরে একটি মন্ত্রিসভা থাকবে ২৫ অক্টোবরের পর। কারা থাকছেন সেখানে?
আসলে টেকসই গণতন্ত্রের সংজ্ঞা কী? যেখানে মহাজোট সরকারের অন্যতম মিত্র জাতীয় পার্টি বলছে তারা একদলীয় নির্বাচনে অংশ নেবে না, সেখানে প্রধানমন্ত্রী টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন কীভাবে? দেয়ালের লিখন থেকে আমরা কিছু শিখি না। প্রধানমন্ত্রী সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের জন্য। দেশে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনিই জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৯৫-৯৬ সালে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। সেদিনের ‘মিত্র’ আজকের শত্রু! আজ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নেই। তবে একটি সুযোগ ছিল আরো দুই টার্ম রাখার, কিন্তু তিনি তা রাখেননি। আজ তিনি যখন টেকসই গণতন্ত্রের কথা বলেন, তখন প্রশ্ন তো উঠবেই যে শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেখে যে গণতন্ত্র, তাকে আমরা টেকসই গণতন্ত্র বলব কি-না? দ্বিতীয়ত, তার উপদেষ্টারা, মন্ত্রীরা, দলের নীতি-নির্ধারকরা যে ভাষায় কথা বলেন, বিরোধী দলকে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখেন তা টেকসই গণতন্ত্রের নমুনা কি? বনমন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, বেগম জিয়া তালেবানের নেতা। তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে এ ধরনের বক্তব্য রাখা কতটুকু গণতান্ত্রিক কিংবা বনমন্ত্রীর সৌজন্যবোধ কতটুকু, এসব প্রশ্ন করাই যায়। শুধু বনমন্ত্রী কেন বলি? মোহাম্মদ নাসিমের একটি বক্তব্য ছাপা হয়েছে অনলাইনে। তার বক্তব্য ছাপা হয়েছে এভাবে ‘খালেদা জিয়ার বুলেট তাড়া করে বেড়াচ্ছে শেখ হাসিনাকে’ (আরটিএন, ২৪ সেপ্টেম্বর)। এই দুটি বক্তব্য প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যে, রাজনৈতিক শিষ্টাচার বলতে যা বোঝায় তা দেশের অনেক রাজনীতিকই জানেন না। রাজনীতিতে শিষ্টাচার একেবারেই উঠে গেছে। অপর পক্ষকে শ্রদ্ধাভরে কথা বলার (কিংবা রাজনৈতিকভাবে আক্রমণ করা) যে রেওয়াজ একসময় ছিল তা আর নেই। তরুণ প্রজন্ম কী শিখছে? বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদ কিংবা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিম তরুণ প্রজšে§র রাজনীতিকদের কী শেখাচ্ছেন? তৃতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী টেকসই গণতন্ত্রের যে কথা বলছেন, তাতে প্রধান বিরোধী দলের কোনো অংশগ্রহণ নেই অথচ প্রধান বিরোধী দল এবং জোট মোট ভোটারদের ৩৮ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে। এখন ৩৮ ভাগ লোকের প্রতিনিধিত্ব যেখানে নেই, সেই গণতন্ত্র টেকসই হলো কীভাবে? বিরোধী দলের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপনের অপর নামই গণতন্ত্র। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে তা অনুপস্থিত। বিরোধী দলকে বাইরে রেখে যে নির্বাচন তা কি বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র উপহার দেবে? নির্বাচনের প্রশ্নে একটা সমাধান প্রয়োজন। নির্বাচনকালীন একটি সরকার দরকার, যাতে প্রধান বিরোধী দলের আস্থা থাকবে। প্রধানমন্ত্রী সংবিধানের দোহাই দেন বটে, কিন্তু সংবিধানের আওতায়ও একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু আন্তরিকতার আর ‘বিচার মানি, কিন্তু তালগাছটা আমার’ এই মানসিকতা পরিবর্তন।
রাষ্ট্রীয় খরচে নিউইয়র্ক দর্শনের মাঝে বড় কিছু পাওয়ার নেই। প্রধানমন্ত্রী এবারো তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এসেছেন। এর কি কোনো প্রয়োজন ছিল? প্রধানমন্ত্রী তো পারতেন একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে। সরকারের শেষ সময়ে এসে সরকারি অর্থের এই অপচয় প্রধানমন্ত্রীর সম্মানকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাবে না। একটি প্রথম শ্রেণীর দৈনিকে (২৭ সেপ্টেম্বর) প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের নিউইয়র্ক শহর ঘুরে বেড়ানোর যে সংবাদ ছাপা হয় তা আমাদের একটা ধান্ধায় ফেলে দেয়। সরকারি অর্থের অপচয়ের এই ‘মড়ক’ কি আমরা বারবার দেখতেই থাকব? এর কি কোনো পরিবর্তন হবে না? প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের নিউইয়র্কে ঘুরে বেড়ানোর সংবাদ যেদিন ছাপা হয়েছে, ঠিক একই দিন অপর একটি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে অপর একটি সংবাদ উত্তরাঞ্চলে মানুষের কাজ নেই। তারা বেঁচে থাকার জন্য কাজ চান। কেউ কেউ আগাম শ্রম বিক্রি করে দিয়েছেন। কেউবা আবার এক হাজার টাকা কর্জ করেছেন ২০০ টাকা সুদের বিনিময়ে! কাবিখা, কাবিটা কিংবা টিআরের বিনিময়ে যে সাহায্য, তা পাচ্ছে গুটিকয় মানুষ, যারা স্থানীয় চেয়ারম্যানের আশীর্বাদপুষ্ট। যেখানে মানুষের ন্যূনতম অধিকার, যা সংবিধান প্রদত্ত তা রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে পারছে না, সেখানে রাষ্ট্রের টাকায় কিছু লোকের নিউইয়র্ক দর্শন যুক্তিহীন ও অগ্রহণযোগ্য। একবার বিশ্বসভায় যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী এক কবিকে নিউইয়র্ক নিয়ে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে কবি নিউইয়র্ক কিংবা বিশ্বসভা নিয়ে কোনো কবিতা লিখেছিলেন কি-না বলতে পারব না। তবে জাতির যে এতে কোনো উপকার হয়নি তা দিব্যি দিয়েই বলতে পারি।
বিশ্বসভা একটি বিশ্বরাজনীতির জায়গা। প্রধানমন্ত্রী এসেছেন। কয়েকটি সভায় বক্তব্য রেখেছেন এটা ঠিক আছে। কিন্তু তার সঙ্গে তার মিডিয়া উইংয়ের উপদেষ্টা প্রধান তথ্য কর্মকর্তাসহ যে বিশাল টিম এসেছে, তার কি কোনো প্রয়োজন ছিল? বিশাল এক প্রেস টিম তার সঙ্গে এসেছে, তার বক্তব্য জাতিকে জানানোর জন্য! সরকারি টাকার এই অপচয়ের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী যদি নিউইয়র্ক থেকে ফিরে এসে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে যান ভালো করবেন। অন্তত ‘রংপুরের মফিজদের’ জন্য প্রধানমন্ত্রী কিছু করার উদ্যোগ নিতে পারেন। সেখানে সাধারণ মানুষের কর্মের সংস্থানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকও উদ্যোগ নিতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক উদ্যোগ নিলে বেসরকারি ব্যাংকও এগিয়ে আসবে। ওদের কাজ দেয়া দরকার। প্রধানমন্ত্রীর কাছের জনরা তাকে এই উপদেশটি দেবেন কি-না জানি না, কিন্তু আমি বিশ্বাস রাখতে চাই প্রধানমন্ত্রী উত্তরাঞ্চলের মানুষের সমস্যা সম্পর্কে জ্ঞাত। তিনি উদ্যোগী হলে জাতি তাকে স্মরণে রাখবে।
দৈনিক মানবকন্ঠ, ১ অক্টোবর।
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক - See more at: http://www.manobkantha.com/2013/10/01/141029.html#sthash.b6Xca5Sn.dpuf
আসলে টেকসই গণতন্ত্রের সংজ্ঞা কী? যেখানে মহাজোট সরকারের অন্যতম মিত্র জাতীয় পার্টি বলছে তারা একদলীয় নির্বাচনে অংশ নেবে না, সেখানে প্রধানমন্ত্রী টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন কীভাবে? দেয়ালের লিখন থেকে আমরা কিছু শিখি না। প্রধানমন্ত্রী সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের জন্য। দেশে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনিই জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৯৫-৯৬ সালে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। সেদিনের ‘মিত্র’ আজকের শত্রু! আজ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নেই। তবে একটি সুযোগ ছিল আরো দুই টার্ম রাখার, কিন্তু তিনি তা রাখেননি। আজ তিনি যখন টেকসই গণতন্ত্রের কথা বলেন, তখন প্রশ্ন তো উঠবেই যে শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেখে যে গণতন্ত্র, তাকে আমরা টেকসই গণতন্ত্র বলব কি-না? দ্বিতীয়ত, তার উপদেষ্টারা, মন্ত্রীরা, দলের নীতি-নির্ধারকরা যে ভাষায় কথা বলেন, বিরোধী দলকে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখেন তা টেকসই গণতন্ত্রের নমুনা কি? বনমন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, বেগম জিয়া তালেবানের নেতা। তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে এ ধরনের বক্তব্য রাখা কতটুকু গণতান্ত্রিক কিংবা বনমন্ত্রীর সৌজন্যবোধ কতটুকু, এসব প্রশ্ন করাই যায়। শুধু বনমন্ত্রী কেন বলি? মোহাম্মদ নাসিমের একটি বক্তব্য ছাপা হয়েছে অনলাইনে। তার বক্তব্য ছাপা হয়েছে এভাবে ‘খালেদা জিয়ার বুলেট তাড়া করে বেড়াচ্ছে শেখ হাসিনাকে’ (আরটিএন, ২৪ সেপ্টেম্বর)। এই দুটি বক্তব্য প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যে, রাজনৈতিক শিষ্টাচার বলতে যা বোঝায় তা দেশের অনেক রাজনীতিকই জানেন না। রাজনীতিতে শিষ্টাচার একেবারেই উঠে গেছে। অপর পক্ষকে শ্রদ্ধাভরে কথা বলার (কিংবা রাজনৈতিকভাবে আক্রমণ করা) যে রেওয়াজ একসময় ছিল তা আর নেই। তরুণ প্রজন্ম কী শিখছে? বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদ কিংবা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিম তরুণ প্রজšে§র রাজনীতিকদের কী শেখাচ্ছেন? তৃতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী টেকসই গণতন্ত্রের যে কথা বলছেন, তাতে প্রধান বিরোধী দলের কোনো অংশগ্রহণ নেই অথচ প্রধান বিরোধী দল এবং জোট মোট ভোটারদের ৩৮ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে। এখন ৩৮ ভাগ লোকের প্রতিনিধিত্ব যেখানে নেই, সেই গণতন্ত্র টেকসই হলো কীভাবে? বিরোধী দলের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপনের অপর নামই গণতন্ত্র। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে তা অনুপস্থিত। বিরোধী দলকে বাইরে রেখে যে নির্বাচন তা কি বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র উপহার দেবে? নির্বাচনের প্রশ্নে একটা সমাধান প্রয়োজন। নির্বাচনকালীন একটি সরকার দরকার, যাতে প্রধান বিরোধী দলের আস্থা থাকবে। প্রধানমন্ত্রী সংবিধানের দোহাই দেন বটে, কিন্তু সংবিধানের আওতায়ও একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু আন্তরিকতার আর ‘বিচার মানি, কিন্তু তালগাছটা আমার’ এই মানসিকতা পরিবর্তন।
রাষ্ট্রীয় খরচে নিউইয়র্ক দর্শনের মাঝে বড় কিছু পাওয়ার নেই। প্রধানমন্ত্রী এবারো তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এসেছেন। এর কি কোনো প্রয়োজন ছিল? প্রধানমন্ত্রী তো পারতেন একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে। সরকারের শেষ সময়ে এসে সরকারি অর্থের এই অপচয় প্রধানমন্ত্রীর সম্মানকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাবে না। একটি প্রথম শ্রেণীর দৈনিকে (২৭ সেপ্টেম্বর) প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের নিউইয়র্ক শহর ঘুরে বেড়ানোর যে সংবাদ ছাপা হয় তা আমাদের একটা ধান্ধায় ফেলে দেয়। সরকারি অর্থের অপচয়ের এই ‘মড়ক’ কি আমরা বারবার দেখতেই থাকব? এর কি কোনো পরিবর্তন হবে না? প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের নিউইয়র্কে ঘুরে বেড়ানোর সংবাদ যেদিন ছাপা হয়েছে, ঠিক একই দিন অপর একটি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে অপর একটি সংবাদ উত্তরাঞ্চলে মানুষের কাজ নেই। তারা বেঁচে থাকার জন্য কাজ চান। কেউ কেউ আগাম শ্রম বিক্রি করে দিয়েছেন। কেউবা আবার এক হাজার টাকা কর্জ করেছেন ২০০ টাকা সুদের বিনিময়ে! কাবিখা, কাবিটা কিংবা টিআরের বিনিময়ে যে সাহায্য, তা পাচ্ছে গুটিকয় মানুষ, যারা স্থানীয় চেয়ারম্যানের আশীর্বাদপুষ্ট। যেখানে মানুষের ন্যূনতম অধিকার, যা সংবিধান প্রদত্ত তা রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে পারছে না, সেখানে রাষ্ট্রের টাকায় কিছু লোকের নিউইয়র্ক দর্শন যুক্তিহীন ও অগ্রহণযোগ্য। একবার বিশ্বসভায় যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী এক কবিকে নিউইয়র্ক নিয়ে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে কবি নিউইয়র্ক কিংবা বিশ্বসভা নিয়ে কোনো কবিতা লিখেছিলেন কি-না বলতে পারব না। তবে জাতির যে এতে কোনো উপকার হয়নি তা দিব্যি দিয়েই বলতে পারি।
বিশ্বসভা একটি বিশ্বরাজনীতির জায়গা। প্রধানমন্ত্রী এসেছেন। কয়েকটি সভায় বক্তব্য রেখেছেন এটা ঠিক আছে। কিন্তু তার সঙ্গে তার মিডিয়া উইংয়ের উপদেষ্টা প্রধান তথ্য কর্মকর্তাসহ যে বিশাল টিম এসেছে, তার কি কোনো প্রয়োজন ছিল? বিশাল এক প্রেস টিম তার সঙ্গে এসেছে, তার বক্তব্য জাতিকে জানানোর জন্য! সরকারি টাকার এই অপচয়ের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী যদি নিউইয়র্ক থেকে ফিরে এসে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে যান ভালো করবেন। অন্তত ‘রংপুরের মফিজদের’ জন্য প্রধানমন্ত্রী কিছু করার উদ্যোগ নিতে পারেন। সেখানে সাধারণ মানুষের কর্মের সংস্থানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকও উদ্যোগ নিতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক উদ্যোগ নিলে বেসরকারি ব্যাংকও এগিয়ে আসবে। ওদের কাজ দেয়া দরকার। প্রধানমন্ত্রীর কাছের জনরা তাকে এই উপদেশটি দেবেন কি-না জানি না, কিন্তু আমি বিশ্বাস রাখতে চাই প্রধানমন্ত্রী উত্তরাঞ্চলের মানুষের সমস্যা সম্পর্কে জ্ঞাত। তিনি উদ্যোগী হলে জাতি তাকে স্মরণে রাখবে।
দৈনিক মানবকন্ঠ, ১ অক্টোবর।
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক - See more at: http://www.manobkantha.com/2013/10/01/141029.html#sthash.b6Xca5Sn.dpuf
0 comments:
Post a Comment