নতুন বছরের বিশ্ব রাজনীতির কয়েকটি
অগ্রাধিকার চিহ্নিত করা যায়। ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্তি,
ইউরোপের রাজনীতিতে পরিবর্তন, সন্ত্রাসবাদী কর্মকা- দমন এবং সেই সঙ্গে বৃহৎ
রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক হবে চলতি বছরের বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম আলোচিত
বিষয়। কিন্তু ফোরিডার বিমানবন্দরে সন্ত্রাসী কর্মকা-ে ৫ জন নিহত, তুরস্কে
সন্ত্রাসী কর্মকা-, সিরিয়া থেকে রুশ সৈন্য প্রত্যাহার ইত্যাদি ঘটনা জানান
দিচ্ছে, চলতি বছরের বিশ্ব রাজনীতিতেও উত্তেজনা থাকবে। তবে ট্রাম্পকে ঘিরে
আবর্তিত হবে নানা আলোচনা। ২০ জানুয়ারি তিনি দায়িত্ব নেবেন। বিতর্কিত নানা
বক্তব্যের জন্য তিনি সমালোচিত। তিনি তার ইসলামবিরোধী এবং অভিবাসনবিরোধী
নীতি কতটুকু বাস্তবায়ন করেন, সে ব্যাপারে আগ্রহ থাকবে অনেকের। বলা ভালো,
নির্বাচনের আগে (৯ নভেম্বর ২০১৬) ট্রাম্পের কঠোর অভিবাসন ও ইসলামবিরোধী
মনোভাব ইউরোপের রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলেছিল। গেল বছর এ প্রশ্নে ব্রিটেনে
গণভোট হয়েছিল। ওই গণভোটে ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার
সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল, যা কিনা ব্রেক্সিট নামে এখন অভিহিত হচ্ছে।
ট্রাম্পের বিজয়ের ফলে সমগ্র ইউরোপে যে উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির উত্থান
ঘটেছে, তার প্রভাব পড়বে চলতি বছর অনুষ্ঠিত তিনটি দেশের নির্বাচনে।
হল্যান্ডে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ১৫ মার্চ। এই নির্বাচনে কট্টরপন্থি
নেতা গ্রেট উইলডার্সের বিজয়ের আশঙ্কা করছেন অনেকে। উইলডার্স রাজনৈতিক দল
‘পার্টি ফর ফ্রিডম’ বা পিভিভির নেতা। ট্রাম্পের মতোই তিনি ইসলাম ও
অভিবাসনবিরোধী। ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু তাকে
শাস্তি দেওয়া হয়নি। তিনি হল্যান্ডে ইসলামের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরিফ
নিষিদ্ধ করা, যারা হিজাব পরিধান করবেন, তাদের ওপর ট্যাস্ক আরোপ করা ও কোনো
মসজিদ তৈরিতে অনুমোদন না দেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। উগ্র মনোভাবের
কারণেই তার পক্ষে একটা জনমত গড়ে উঠেছে সেখানে এবং বলা হচ্ছে, ব্রিটেনের
অনুসরণে হল্যান্ডও ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যেতে পারে, যেটাকে তারা বলছে
‘ব্রেক্সিট’। ইউরোপে ব্যাপক সিরীয় অভিবাসীর আগমনের কারণে ব্যক্তিগতভাবে
ক্ষতি হয়েছে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ওঁলাদের। তার জনপ্রিয়তা এখন মাত্র ৪
ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। ২৩ এপ্রিল সেখানে প্রথম দফা ও ৭ মে দ্বিতীয় দফা
প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সোস্যালিস্ট পার্টি এখন আর ওঁলাদকে
তাদের প্রার্থী করবে না। জনমত জরিপে এগিয়ে আছেন কট্টর দক্ষিণপন্থি নেতা
মারিয়ানে লি পেন। তিনি উগ্রপন্থি ন্যাশনাল ফ্রন্টের নেতা। তবে তুলনামূলক
বিচারে আবার দক্ষিণপন্থি নেতা ও ‘লেস রিপাবলিকানস পার্টির’ প্রার্থী
ফ্রাসোইস ফিলোনের অবস্থান ভালো। তিনি হচ্ছেন ফ্রান্সের ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প’।
পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে তাতে করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দ্বিতীয় রাউন্ডে
গড়াবে। এখানে বলা ভালো, ওঁলাদের শাসনামলে তিনি সিরীয় অভিবাসীদের জন্য
ফ্রান্সের দরজা খুলে দিয়েছিলেন, যা কিনা কট্টরপন্থিদের উসকে দিয়েছিল এবং
স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে এই বিষয়টা পুঁজি করে ন্যাশনাল ফ্রন্ট তাদের
অবস্থান শক্তিশালী করেছে। নির্বাচনে মারিয়ানে লি পেন বিজয়ী না হলেও তিনি যে
ফ্রান্সের জাতীয় রাজনীতিতে অন্যতম শক্তিতে পরিণত হয়েছেন, তা বলার আর
অপেক্ষা রাখে না। নির্বাচন হবে জার্মানিতেও। ২২ অক্টোবর সেখানে নির্বাচন।
চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মেরকেল চতুর্থবারের জন্য চ্যান্সেলর প্রার্থী
হয়েছেন। তার দল সিডিইউ তাকে মনোনয়ন দিয়েছে। এক সময়ের বিরোধী দল এসপিডিকে
নিয়ে তিনি জার্মানিতে একটি গ্রেটার কোয়ালিশন গড়ে তুলেছেন। নির্বাচনের পর এই
কোয়ালিশন থাকবে কিনা সেটা একটা প্রশ্ন। তার জনপ্রিয়তা ৩৪ ভাগ থেকে কমে এসে
দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৪ ভাগে। তবে ভয়টা হচ্ছে নব্য নাজি পার্টি ‘অলটারনেটিভ ফর
জার্মানির পার্টি’কে নিয়ে। এরা প্রচ- রকমের ইসলাম ও অভিবাসনবিরোধী।
জার্মান সংসদে এরা নেই। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে এরা ভালো করেছে।
ধারণা করা হচ্ছে, এবার সংসদ নির্বাচনে ৫ ভাগ ভোট নিশ্চিত করে এরা সংসদে
যাবে। তাই যদি হয়, তাহলে তা জার্মানির গণতন্ত্রের জন্য হবে এক ধরনের কলঙ্ক।
বলতে দ্বিধা নেই, যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের বিজয় এবং তার কিছু কিছু
বক্তব্যে ইউরোপের দক্ষিণপন্থিরা উৎসাহিত হয়েছেন। ব্রিটেনের জনমতে ইউরোপ
থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও ব্রিটেন দুবছর সময় পাবে। এ জন্য
চলতি বছর প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে লিসবন চুক্তির আর্টিকেল ৫০ (ইউরোপীয়
ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার আইনগত ভিত্তি) কার্যকর করতে পারেন।
বদলে যাচ্ছে ইউরোপ। সনাতন রাজনীতির দিন শেষ হয়ে আসছে। গণতন্ত্র এখানে এখন ঝুঁকির মুখে। ভিন্ন ফর্মে উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ফিরে আসছে। দুটো সম্ভাবনা এখন প্রবল। এক. ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদী দলের উত্থান ও বিজয় শোষণ চুক্তিকে এখন অকার্যকর করে ফেলতে পারে। শোষণ চুক্তি, অর্থাৎ অবাধ চলাচলের (ইউরোপীয় ইউনিয়নে) যে অধিকার, তাতে এখন বিধিনিষেধ আসতে পারে। দুই. এই মুহূর্তে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভেঙে না গেলেও ইউরো জোনে পরিবর্তন আসবে। সর্বশেষ ইতালির প্রধানমন্ত্রী মোটিও রেনজি গণভোটে (সংস্কারের পক্ষে) হেরে যাওয়ায় পদত্যাগ করেন। তার এই পদত্যাগ ফাইভ স্টার মুভমেন্টকে জাতীয় পর্যায়ে পরিচিত করেছে এবং তারা জাতীয় রাজনীতিতে অন্যতম শক্তিতে পরিণত হয়েছে। এই ফাইভ স্টার মুভমেন্ট ইউরোপ জোনবিরোধী। চলতি বছর ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ২৭ দেশের (১৫টি দেশ ইউরো জোনে অন্তর্ভুক্ত) মধ্যে কিছু পরিবর্তন আসবে এবং ইউরো জোন থেকে অনেক দেশ বেরিয়ে যাবে। মোদ্দা কথা ইউরোপের ঐক্যে ফাটল দেখা দিয়েছে এবং আগামীতে তা আরও ‘বড়’ হবে। অর্থাৎ ইউরো জোনভুক্ত কিছু দেশ আলাদা অবস্থান নেবে।
চলতি বছর একদিকে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক, অন্যদিকে রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক অনেকের কাছেই আলোচনার অন্যতম বিষয় হয়ে থাকবে। ক্ষমতা নেওয়ার আগেই ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের সনাতন ‘ওয়ান চায়না পলিসি’কে একটি প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। ২ ডিসেম্বর (২০১৬) তিনি তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েনের (ঞংধর ষহম-বিহ) একটি ফোনকল রিসিভ করেন। ১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। সেই থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাইওয়ানের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক সম্পর্ক রাখে না যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র ‘এক চীন’ নীতি অনুসরণ করে আসছে। তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টকে যুক্তরাষ্ট্রের হবু প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দিয়ে ট্রাম্প শুধু চীনের নেতৃবৃন্দেরই আক্রমণের শিকারে পরিণত হলেন না, বরং চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে একটি প্রশ্নের মাঝে ফেলে দিয়েছেন। চীন এর সমালোচনা করেছে। এর আগে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের কর্তৃত্ব নিয়েও ট্রাম্প প্রশ্ন তুলেছেন। নির্বাচনের আগে তিনি বলেছিলেন, তিনি চীনা পণ্যের ওপর শতকরা ৩৫ ভাগ শুল্ক আরোপ করবেন। ফলে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কটি একটি প্রশ্নের মুখে থাকল। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া সম্পর্ক নিয়েও নতুন করে আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় হিলারি কিনটনের ই-মেইল হ্যাক, ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক, রাশিয়ায় ট্রাম্পের ব্যবসায়িক স্বার্থ এবং রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক ট্রাম্পকে ক্ষমতায় বসানোর উদ্যোগ ইত্যাদি নানা কারণে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভিন্ন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পরই বোঝা যাবে এই সম্পর্ককে কোন পর্যায়ে নিয়ে যান। ইউক্রেন সংকট এবং ক্রিমিয়ার রাশিয়ার অন্তর্ভুক্তি নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল। জি-৮ থেকে রাশিয়াকে বহিষ্কার করা হয় এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হয়। এখন ট্রাম্প বিষয়গুলোকে কীভাবে নেবেন, সেটা দেখার বিষয়। তবে ন্যাটো সম্প্রসারণের ব্যাপারে ট্রাম্পের অনাগ্রহ পুতিনকে খুশি করে থাকবে। পুতিনের প্লাস পয়েন্ট এটাই। এ ক্ষেত্রে পেন্টাগন বিষয়টিকে আগামীতে কীভাবে দেখবে, সেদিকে লক্ষ থাকবে অনেকের।
ট্রাম্পের দায়িত্ব নেওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আসবে না। যুক্তরাষ্ট্র-ইরাক পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তিকে অস্বীকার করেছেন ট্রাম্প। তিনি জানিয়েছেন, তিনি এটা অনুমোদন করবেন না। তিনি যদি সত্যিই সত্যিই এটি করেন, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে উত্তেজনা বাড়বে। ইরান মধ্যপ্রাচ্যে একটি ‘ফ্রন্ট ওপেন’ করবে এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। ইরান সমঝোতা এ অঞ্চলে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়াকে শুধু এগিয়ে নিয়ে যাবে না, বরং এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে। ওবামা প্রশাসনের আমলে আইএসের উত্থান মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির দৃশ্যপটকে পরিপূর্ণভাবে বদলে দেয়। ইরাক ও সিরিয়ার একটা অংশ নিয়ে ইতোমধ্যে আইএসের উদ্যোগে একটি জিহাদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তারা ইসলামিক দেশগুলোকে নিয়ে খেলাফত প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেছে। দক্ষিণ তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তারা দূরবর্তী খেলাফত প্রতিষ্ঠার কথাও বলেছে। বাস্তবতা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার অব্যাহত বিমান হামলার পরও আইএসকে উৎখাত করা সম্ভব হয়নি। রাশিয়ার বিমান হামলা (এমনকি চীনেরও সমর্থনসহ) সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদকে নতুন একটি জীবন দিয়েছে। ইরাকে সাদ্দাম হোসেন আর লিবিয়ায় গাদ্দাফির উৎখাতের পর টার্গেট ছিলেন আসাদ। এখন মনে হচ্ছে, আসাদ টিকে গেলেন। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, ট্রাম্প-পুতিন সমঝোতা সিরিয়ায় কি প্রভাব ফেলবে? ধারণা করা স্বাভাবিক, যুক্তরাষ্ট্র-সিরিয়া প্রশ্নে তাদের ‘ইনভলভমেন্ট’ কমিয়ে ফেলবে। আরও একটি বিষয় বেশ গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে ন্যাটোর বাহিনী মোতায়েন, বিশ্বের সর্বত্র ‘যুদ্ধে’ জড়িয়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র যে বিপুল অর্থ ব্যয় করে, তা ট্রাম্প এখন কমিয়ে আনতে চাইবেন। এতে করে ওই অর্থ খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগের পরিস্থিতির উন্নতি করতে পারে। তবে তা ইউরোপের দেশগুলোকে আবারও এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। কেননা রাশিয়াকে নিয়ে ইউরোপের ভয়টা বাড়ছে। পুতিন ওয়ারশ সামরিক চুক্তির আদলে ‘কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি’ গঠন করতে যাচ্ছেন, যেখানে তিনি মধ্য এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোকে এক সামরিক বলয়ে আনতে চান। ফলে ট্রাম্পের চার বছরের জমানায় বিশ্ব এক নতুন পৃথিবীকে দেখবে। ওবামা প্রশাসনের আমলে এই বিশ্ব স্থিতিশীল ছিল না। ওবামা নিজে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েও (২০০৮) লিবিয়ায় বিমান হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। চলতি বছর ভারতেও বেশ কয়েকটি বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সব মিলিয়ে ২০১৭ সালটি সন্ত্রাসমুক্ত থাকবে কিনা, একটি স্থিতিশীল বিশ্ব আমরা দেখব কিনা এ প্রশ্ন থাকলই।
Daily Amader Somoy
11.01.2017
বদলে যাচ্ছে ইউরোপ। সনাতন রাজনীতির দিন শেষ হয়ে আসছে। গণতন্ত্র এখানে এখন ঝুঁকির মুখে। ভিন্ন ফর্মে উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ফিরে আসছে। দুটো সম্ভাবনা এখন প্রবল। এক. ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদী দলের উত্থান ও বিজয় শোষণ চুক্তিকে এখন অকার্যকর করে ফেলতে পারে। শোষণ চুক্তি, অর্থাৎ অবাধ চলাচলের (ইউরোপীয় ইউনিয়নে) যে অধিকার, তাতে এখন বিধিনিষেধ আসতে পারে। দুই. এই মুহূর্তে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভেঙে না গেলেও ইউরো জোনে পরিবর্তন আসবে। সর্বশেষ ইতালির প্রধানমন্ত্রী মোটিও রেনজি গণভোটে (সংস্কারের পক্ষে) হেরে যাওয়ায় পদত্যাগ করেন। তার এই পদত্যাগ ফাইভ স্টার মুভমেন্টকে জাতীয় পর্যায়ে পরিচিত করেছে এবং তারা জাতীয় রাজনীতিতে অন্যতম শক্তিতে পরিণত হয়েছে। এই ফাইভ স্টার মুভমেন্ট ইউরোপ জোনবিরোধী। চলতি বছর ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ২৭ দেশের (১৫টি দেশ ইউরো জোনে অন্তর্ভুক্ত) মধ্যে কিছু পরিবর্তন আসবে এবং ইউরো জোন থেকে অনেক দেশ বেরিয়ে যাবে। মোদ্দা কথা ইউরোপের ঐক্যে ফাটল দেখা দিয়েছে এবং আগামীতে তা আরও ‘বড়’ হবে। অর্থাৎ ইউরো জোনভুক্ত কিছু দেশ আলাদা অবস্থান নেবে।
চলতি বছর একদিকে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক, অন্যদিকে রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক অনেকের কাছেই আলোচনার অন্যতম বিষয় হয়ে থাকবে। ক্ষমতা নেওয়ার আগেই ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের সনাতন ‘ওয়ান চায়না পলিসি’কে একটি প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। ২ ডিসেম্বর (২০১৬) তিনি তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েনের (ঞংধর ষহম-বিহ) একটি ফোনকল রিসিভ করেন। ১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। সেই থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাইওয়ানের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক সম্পর্ক রাখে না যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র ‘এক চীন’ নীতি অনুসরণ করে আসছে। তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টকে যুক্তরাষ্ট্রের হবু প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দিয়ে ট্রাম্প শুধু চীনের নেতৃবৃন্দেরই আক্রমণের শিকারে পরিণত হলেন না, বরং চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে একটি প্রশ্নের মাঝে ফেলে দিয়েছেন। চীন এর সমালোচনা করেছে। এর আগে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের কর্তৃত্ব নিয়েও ট্রাম্প প্রশ্ন তুলেছেন। নির্বাচনের আগে তিনি বলেছিলেন, তিনি চীনা পণ্যের ওপর শতকরা ৩৫ ভাগ শুল্ক আরোপ করবেন। ফলে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কটি একটি প্রশ্নের মুখে থাকল। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া সম্পর্ক নিয়েও নতুন করে আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় হিলারি কিনটনের ই-মেইল হ্যাক, ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক, রাশিয়ায় ট্রাম্পের ব্যবসায়িক স্বার্থ এবং রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক ট্রাম্পকে ক্ষমতায় বসানোর উদ্যোগ ইত্যাদি নানা কারণে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভিন্ন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পরই বোঝা যাবে এই সম্পর্ককে কোন পর্যায়ে নিয়ে যান। ইউক্রেন সংকট এবং ক্রিমিয়ার রাশিয়ার অন্তর্ভুক্তি নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল। জি-৮ থেকে রাশিয়াকে বহিষ্কার করা হয় এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হয়। এখন ট্রাম্প বিষয়গুলোকে কীভাবে নেবেন, সেটা দেখার বিষয়। তবে ন্যাটো সম্প্রসারণের ব্যাপারে ট্রাম্পের অনাগ্রহ পুতিনকে খুশি করে থাকবে। পুতিনের প্লাস পয়েন্ট এটাই। এ ক্ষেত্রে পেন্টাগন বিষয়টিকে আগামীতে কীভাবে দেখবে, সেদিকে লক্ষ থাকবে অনেকের।
ট্রাম্পের দায়িত্ব নেওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আসবে না। যুক্তরাষ্ট্র-ইরাক পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তিকে অস্বীকার করেছেন ট্রাম্প। তিনি জানিয়েছেন, তিনি এটা অনুমোদন করবেন না। তিনি যদি সত্যিই সত্যিই এটি করেন, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে উত্তেজনা বাড়বে। ইরান মধ্যপ্রাচ্যে একটি ‘ফ্রন্ট ওপেন’ করবে এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। ইরান সমঝোতা এ অঞ্চলে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়াকে শুধু এগিয়ে নিয়ে যাবে না, বরং এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে। ওবামা প্রশাসনের আমলে আইএসের উত্থান মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির দৃশ্যপটকে পরিপূর্ণভাবে বদলে দেয়। ইরাক ও সিরিয়ার একটা অংশ নিয়ে ইতোমধ্যে আইএসের উদ্যোগে একটি জিহাদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তারা ইসলামিক দেশগুলোকে নিয়ে খেলাফত প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেছে। দক্ষিণ তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তারা দূরবর্তী খেলাফত প্রতিষ্ঠার কথাও বলেছে। বাস্তবতা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার অব্যাহত বিমান হামলার পরও আইএসকে উৎখাত করা সম্ভব হয়নি। রাশিয়ার বিমান হামলা (এমনকি চীনেরও সমর্থনসহ) সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদকে নতুন একটি জীবন দিয়েছে। ইরাকে সাদ্দাম হোসেন আর লিবিয়ায় গাদ্দাফির উৎখাতের পর টার্গেট ছিলেন আসাদ। এখন মনে হচ্ছে, আসাদ টিকে গেলেন। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, ট্রাম্প-পুতিন সমঝোতা সিরিয়ায় কি প্রভাব ফেলবে? ধারণা করা স্বাভাবিক, যুক্তরাষ্ট্র-সিরিয়া প্রশ্নে তাদের ‘ইনভলভমেন্ট’ কমিয়ে ফেলবে। আরও একটি বিষয় বেশ গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে ন্যাটোর বাহিনী মোতায়েন, বিশ্বের সর্বত্র ‘যুদ্ধে’ জড়িয়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র যে বিপুল অর্থ ব্যয় করে, তা ট্রাম্প এখন কমিয়ে আনতে চাইবেন। এতে করে ওই অর্থ খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগের পরিস্থিতির উন্নতি করতে পারে। তবে তা ইউরোপের দেশগুলোকে আবারও এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। কেননা রাশিয়াকে নিয়ে ইউরোপের ভয়টা বাড়ছে। পুতিন ওয়ারশ সামরিক চুক্তির আদলে ‘কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি’ গঠন করতে যাচ্ছেন, যেখানে তিনি মধ্য এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোকে এক সামরিক বলয়ে আনতে চান। ফলে ট্রাম্পের চার বছরের জমানায় বিশ্ব এক নতুন পৃথিবীকে দেখবে। ওবামা প্রশাসনের আমলে এই বিশ্ব স্থিতিশীল ছিল না। ওবামা নিজে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েও (২০০৮) লিবিয়ায় বিমান হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। চলতি বছর ভারতেও বেশ কয়েকটি বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সব মিলিয়ে ২০১৭ সালটি সন্ত্রাসমুক্ত থাকবে কিনা, একটি স্থিতিশীল বিশ্ব আমরা দেখব কিনা এ প্রশ্ন থাকলই।
Daily Amader Somoy
11.01.2017
0 comments:
Post a Comment