রানা প্লাজা ও তাজরীন গার্মেন্টে শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা জিএসপি সুবিধা বাতিলের পেছনে অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিল। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি ১৬ দফা কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। ওই কর্মপরিকল্পনা পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়েছে, এটা বলা যাবে না। অসংখ্য নারী শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এর প্রভাব পড়ে জিএসপি সুবিধা বাতিলের ক্ষেত্রে। যদিও এটা সত্য, শুধু তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে জিএসপি সুবিধা পাওয়ার ব্যাপারে আমাদের আগ্রহ বেশি। তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে আমরা ১৫ দশমিক ৬২ ভাগ শুল্ক পরিশোধ করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের অবস্থান ধরে রেখেছি। এখন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে ভিয়েতনাম। আর এ ভিয়েতনামের সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্র গেল বছর টিপিপি বা ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ চুক্তি করেছিল। এ চুক্তির আওতায় ভিয়েতনাম শুল্কমুক্তভাবে তার তৈরি পোশাক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করতে পারত। ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক যে যুক্তরাষ্ট্রে একটি ঝুঁকির মুখে থাকত, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বলা ভালো, চীনের পরই ভিয়েতনাম হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাকের দ্বিতীয় বড় রফতানিকারক দেশ। অর্থাৎ চীন বেশি রফতানি করে। তারপর ভিয়েতনাম। পরিসংখ্যান বলছে, তৈরি পোশাকে ভিয়েতনামের রফতানি বাড়ছে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ হারে। এখন টিপিপির ফলে এটা আরও বাড়ত। ২০১৫ সালেই ভিয়েতনাম পোশাক রফতানি খাতে ২৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। ভিয়েতনাম ২০২০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে সামগ্রিক রফতানি ৫০ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চায়।
ওবামা প্রশাসনের আমলে টিপিপি চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলেও যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস তা অনুমোদন করেনি। ফলে তা আইনে পরিণত হয়নি। তবে আমাদের জন্য একটা সুখের খবর হলো, ট্রাম্প বলছেন, তিনি এ টিপিপি চুক্তি অনুমোদন করবেন না। তিনি মনে করেন, এ চুক্তির ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বেকার সমস্যা বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক শিল্প নষ্ট হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাকের যে বিশাল বাজার, তা পূরণ হয় ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ ও চীনে তৈরি আরএমজি থেকে। অর্থাৎ এসব দেশ এ চাহিদা মেটায়। যদিও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমাদের আরএমজি সেক্টরের চাহিদা যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ছে। বাংলাদেশ তার রফতানি বাড়াতে চায়। উল্লেখ্য, তৈরি পোশাকে ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হওয়া ৮ হাজার ১৭৮ কোটি ডলারের মধ্যে চীনের একার ২ হাজার ৯৭১ কোটি ডলার। তার পরের অবস্থানই ভিয়েতনামের ৯২৬ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়া রয়েছে যৌথভাবে তৃতীয় অবস্থানে। চতুর্থ ও পঞ্চম যথাক্রমে মেক্সিকো ও ভারত। দেশ দুইটির রফতানি যথাক্রমে ৩৭৩ ও ৩৪০ কোটি ডলার। বিজিএমইএ’র দেয়া তথ্যমতে, ২০১৪ সালে (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৪৮৩ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি করে। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের রফতানি প্রবৃদ্ধি (যুক্তরাষ্ট্রে) কমেছে ৪ দশমিক ৮৯ শতাংশ। আমাদের শঙ্কার কারণটা এখানেই। এমনিতেই যখন জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল হলো না, তখন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের সঙ্গে টিপিপি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। এক্ষেত্রে টিপিপির ফলে আমাদের তৈরি পোশাক খাত ঝুঁকির মুখে ছিল। এ ধরনের সংকট ভবিষ্যতে কীভাবে কাটিয়ে উঠতে পারব, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন।
জিএসপি সুবিধা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৫ সালে হংকংয়ে অনুষ্ঠিত বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার শীর্ষ সম্মেলনে ধনী দেশগুলো ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়ার শর্ত কার্যকর করতে রাজি হয়েছিল। এতে করে একটা ধারণার জন্ম হয়েছিল যে, অনুন্নত বিশ্ব পশ্চিমা উন্নত দেশে তাদের পণ্যের আওতা বাড়াতে পারবে। তবে একটা প্রশ্ন ছিল পণ্যের মান ও উৎস নির্ধারণ নিয়ে। এ দুইটি বিষয় নির্ধারণের ক্ষমতা ছিল আমদানিকারক দেশগুলোর হাতে। হংকং সম্মেলনের ৮ বছর পর ২০১৩ সালের ৩ থেকে ৭ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ার বালিতে সর্বশেষ বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় (মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক)। বালি সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে বটে; কিন্তু বালি ঘোষণায় কোন পক্ষ কী পেল, কিংবা বাণিজ্যবৈষম্যের শিকার অনুন্নত দেশগুলোর জন্য বিশেষ সুবিধাগুলো বাস্তবায়ন হবে কিনা, সে প্রশ্ন থেকে গিয়েছিল। বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেল, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের প্রশ্নে এ প্রশ্নগুলোই আবারও উত্থাপিত হয়েছে। আমাদের জিএসপি সুবিধা পাওয়ার কথা; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তৈরি পোশাকে কোনো জিএসপি সুবিধা দিচ্ছে না। তারপরও অন্যান্য পণ্যে যতটুকু সুবিধা পেত বাংলাদেশ, তাও গেল জুন (২০১৩) থেকে স্থগিত রাখা হয়েছে। জিএসপি সুবিধা স্থগিত করার পেছনে যুক্তরাষ্ট্র মূলত প্রথমে তিনটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল। এক. শ্রমমান, দুই. শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যাকা-ের পূর্ণ তদন্ত ও বিচার এবং তিন. ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার। ঢাকার টিকফার প্রথম বৈঠকেও যুক্তরাষ্ট্র আকার-ইঙ্গিতে এ প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল।
শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ ‘রুলস অব অরিজিন’ এর কঠিন শর্তে আটকে আছে। ধনী দেশগুলো এটা তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে বাংলাদেশের মোট রফতানির ৬১.৩ ভাগ জিএসপি সুবিধার আওতায়। তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে মোট রফতানির প্রায় ৬০ ভাগ সুবিধা ব্যবহার করতে পারছে বাংলাদেশ। বলা ভালো, বাংলাদেশের মোট রফতানির ৭৮ ভাগ হচ্ছে তৈরি পোশাক। এ তৈরি পোশাকের ৬০ ভাগ যায় ইউরোপে, আর ২৫ ভাগ যায় যুক্তরাষ্ট্রে। তৈরি পোশাক আমাদের আয়ের অন্যতম উৎস হলেও এ খাতের সঙ্গে জড়িত নানা ‘প্রশ্ন’ এর ব্যাপারে সঠিক ব্যাখ্যা ও বক্তব্য বাংলাদেশ উপস্থাপন করতে পারেনি। দরকষাকষিতে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল। আমলানির্ভর আমাদের মন্ত্রণালয়ের আমলারা ‘বিদেশ সফর’, ‘সম্মেলনে অংশগ্রহণ’ ইত্যাদিকেই প্রাধান্য দেন বেশি। এখানে দক্ষ জনশক্তির বড় অভাব। বিজিএমইএও দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারেনি। তাদের গবেষণা ‘সেল’ও শক্তিশালী নয়। শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধার সঙ্গে ‘রুলস অব অরিজিন’, ‘এন্টি ডাম্পিং’ ও ‘কাউন্টারভেইলিং ব্যবস্থা’, ‘প্রেফারেন্স ইরোসন’, শ্রমমান ইত্যাদি নানা টেকনিক্যাল প্রশ্ন জড়িত। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনায়ও আমরা এসব প্রশ্নে শক্ত অবস্থানে যেতে পারিনি।
আমাদের সমস্যা এখানেই। জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত ইস্যুগুলোর ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আসরে আমরা আমাদের অবস্থান জোরালোভাবে উপস্থাপন করতে পারিনি। প্রতিপক্ষ এ থেকে সুবিধা নিয়েছে। তৈরি পোশাকের ব্যাপারে আমাদের আরও সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন ছিল। এখানে এক ধরনের শৈথিল্য কাজ করেছিল প্রথম থেকেই। যুক্তরাষ্ট্র যে ১৬ দফা কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপন করেছিল, তার সবগুলো বাস্তবায়ন হয়েছে, এটা বলা যাবে না। তবে এটা সত্য, এ ১৬ দফার বেশ ক’টি আমরা এরই মধ্যে বাস্তবায়ন করেছি। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যে কথাটা বলা হয়েছে তা হচ্ছে, তারা ১৬ দফার পূর্ণ বাস্তবায়ন চায়। আংশিক বাস্তবায়ন তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। সেই সঙ্গে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জঙ্গিবাদের প্রশ্নটি। যুক্তরাষ্ট্র এখন চাচ্ছে, বাংলাদেশ স্বীকার করুক এ দেশে আইএস ও আল কায়দা আছে। কিছুদিন আগে তথ্যমন্ত্রী স্বীকার করেছিলেন, বাংলাদেশে ৮ হাজার আল কায়দা জঙ্গি আছে। কোন যুক্তিতে, কোন তথ্যমতে তথ্যমন্ত্রী ভারতীয় পত্রিকা ‘দি হিন্দু’কে তথ্যটি দিয়েছিলেন, আমি জানি না। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর এ ধরনের সংগঠনের বাংলাদেশে উপস্থিতির কথা অস্বীকার করে আসছেন।
সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরা যদি জঙ্গি প্রশ্নে পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা বলেন, তা শুধু বিভ্রান্তিই বাড়ায় না, বরং এতে যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তি এ থেকে সুবিধা নেবে, এটাই স্বাভাবিক। জিএসপি নিয়ে সমস্যা আছে। তার সমাধান হয়নি। পূর্বে জঙ্গিবাদ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ‘চাপ’ আরও বাড়ে। এ ‘চাপ’ কি বাংলাদেশ উপেক্ষা করতে পারবে? সচেতন পাঠক জানেন, যুক্তরাষ্ট্র অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশের সঙ্গে ‘আকসা’ এবং ‘সোফা’ নামে দুইটি চুক্তি করতে চাচ্ছে। এর বাইরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সন্ত্রাসবিরোধী যে জোটটি গঠিত হয়েছে, তাতে অংশগ্রহণের প্রশ্নটি। তবে আমাদের কাছে বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয় যে, ট্রাম্প প্রশাসন ‘আকসা’ ‘সোফা’ বা সন্ত্রাসবিরোধী জোট নিয়ে এগিয়ে যাবে কিনা। সুতরাং এসব ক্ষেত্রে ওবামা প্রশাসনের যে ‘অবস্থা’ ছিল, ট্রাম্প তাতে পরিবর্তন আনতে পারেন। তবে একটা কথা বলা যায়, তিনি জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল করবেন না। এর অর্থ হচ্ছে, শুল্ক পরিশোধ করেই তৈরি পোশাকের বাজারটি ধরে রাখতে হবে। ধারণা করছি, শিগগিরই ট্রাম্প একটি নীতিনির্ধারণী ভাষণ দেবেন। একটি ব্যাপক পরিবর্তন আশা করছেন অনেকে। এখন দেখার পালা, এ ‘পরিবর্তন’, বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ওপর কতটুকু প্রভাব ফেলে।
Daily Alokito Bangladesh
22.01.2017
0 comments:
Post a Comment