প্
রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে একটি ভাষণ দিয়েছেন গত ১২ জানুয়ারি। দ্বিতীয় মেয়াদে তার সরকারের তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে তিনি জাতির উদ্দেশে এই ভাষণটি দিলেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ‘বিতর্কিত’ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিনি সরকার গঠন করেছিলেন। এ নিয়ে টানা আট বছর তিনি ক্ষমতায় আছেন। এবারে জাতির উদ্দেশে তিনি ভাষণ দিলেন এমন একটা সময় যখন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করছেন। বিএনপি নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ফিরে আসার একটি আভাস দিয়েছিল। ফলে রাজনীতি আগের মতো এত উত্তপ্ত ও অসহিষ্ণু নয় এখন। ধীরে ধীরে একটি ‘আস্থার সম্পর্ক’ তৈরি হচ্ছে। ঠিক তখনই প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। তিনি গত তিন বছরে তার সাফল্যের কথা বলবেন, এটা স্বাভাবিক। তবে ‘সমঝোতার রাজনীতির’ ব্যাপারে কি বক্তব্য রাখেন সে ব্যাপারে আগ্রহ ছিল অনেকের। কেননা এর মধ্য দিয়ে তিনি একটি ‘মেসেজ’ দিলেন যা চলমান রাজনীতির জন্য ইতিবাচক হতে পারে। এর আগে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে তিনি যে মন্তব্য করেছেন, তাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভবিষ্যতে কোনো বিতর্কিত নির্বাচন চান না বলে সংলাপে রাষ্ট্রপতিকে জানিয়েছেন। রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব জয়নাল আবেদিন সাংবাদিকদের এই তথ্যটি দিয়েছেন। এ থেকে ধরে নেয়া স্বাভাবিক যে প্রধানমন্ত্রী চান ‘সব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক।’ তাতে নির্বাচনটি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে। জনগণের অংশগ্রহণ বাড়বে এবং যে কোনো ধরনের বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকবে নির্বাচন কমিশন। ঠিক তেমনি জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রীর এই ‘স্পিরিটটি’ প্রতিফলিত হয়েছে। ভাষণে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন সব রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রপতির উদ্যোগে গঠিত নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা রাখবে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনে অংশ নেবে এবং দেশে গণতান্ত্রিক ধারাকে সমুন্নত রাখতে সহায়তা করবে। নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলেও তিনি জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণে নীতি নির্ধারণী কোনো বক্তব্য নেই। তিনি গত তিন বছরে কি কি করেছেন, কোন কোন ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন তার একটা পরিসংখ্যান দেন। এটা খুবই স্বাভাবিক। আগেও তিনি এ ধরনের বক্তব্য রেখেছেন। তবে এক্ষেত্রে একটি ‘আস্থার সম্পর্ক’ কি করে প্রতিষ্ঠা করা যায় তার কোনো দিক নির্দেশনা আমরা পাইনি। তার ভাষণ সম্পর্কে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। এমনকি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে আওয়ামী লীগ যে ৪টি প্রস্তাব দিয়েছে, তার একটি ই-ভোটিং এর ব্যাপারেও কোনো কোনো রাজনৈতিক দল তাদের মতামত দিয়েছে। জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের ওই প্রস্তাবটি দেখছেন ইতিবাচক হিসেবে। সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন এটা ‘খুবই গৌণ বিষয়।’তিনি ওই প্রস্তাবকে আখ্যায়িত করেছেন ‘মৌলিক বিষয় আড়াল করার একটা প্রয়াস’ হিসেবে। আর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন বাংলাদেশে ইভিএম গ্রহণযোগ্য নয়। বলা ভালো আওয়ামী লীগের দেয়া প্রস্তাবের মাঝে আরো রয়েছে ১. সিইসি ও কমিশনার নিয়োগে একটি আইন প্রণয়ন করা এবং ২. রাষ্ট্রপতি ইসি নিয়োগ প্রক্রিয়ার ব্যাপারে যে প্রক্রিয়া উপযুক্ত মনে করবেন তাই তিনি করবেন। অন্যদিকে বিএনপির প্রস্তাবের মাঝে রয়েছে ঐকমত্যের ভিত্তিতে ইসি গঠন, ৫ সদস্য বিশিষ্ট বাছাই কমিটি, একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে বাছাই কমিটি, বাছাই কমিটিতে একজন জ্যেষ্ঠ নারী কিংবা শিক্ষাবিদসহ আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের অন্তর্ভুক্ত করা ইত্যাদি। জাতীয় পার্টিও একটি সার্চ কমিটির প্রস্তাব করেছে। একই সঙ্গে ইসি নিয়োগে একটি আইন ও ইসি সচিবালয় প্রতিষ্ঠার দাবিও তাদের। সুতরাং দেখা যাচ্ছে তিনটি বড় দলের মাঝে তাদের স্ব স্ব প্রস্তাবের ব্যাপারে খুব যে একটা মিল আছে, তা বলা যাবে না। একটি আইন প্রণয়ন করার ব্যাপারে কিছুটা মিল আছে। নীতিগতভাবে বিএনপিও এটা সমর্থন করে। তবে এক্ষেত্রে প্রশ্ন আছে অনেক। ৯ ফেব্রুয়ারিতে এই কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। সুতরাং এত অল্প সময়ের ব্যবধানে আইন করে সিইসি ও কমিশনারদের নিয়োগ দেয়া সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের পদগুলো ‘সীমিত সময়ের’ জন্য খালি রাখা যায় কি না? তাহলে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সংসদে আইনটি পাস করানো সম্ভব। সাংবিধানিক পদগুলো খালি রাখা যায় কি যায় না, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের একটি ‘রেফারেন্স’ চাওয়া যেতে পারে। তবে আইনটি প্রণয়ন করার সময় সব রাজনৈতিক দলের মতামত নেয়া হবে কি? সিভিল সোসাইটির মতামত নেয়াও প্রয়োজন। সিইসি তথা কমিশনারদের একটা ‘নিরপেক্ষতার’ কথা বলেছেন সবাই। কিন্তু এই নিরপেক্ষতার সংজ্ঞা কি কিংবা এই ‘নিরপেক্ষতা’ নিশ্চিত হবে কিভাবে? কাজী রকিবউদ্দিনের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল না। ‘জনতার মঞ্চে’ তিনি গিয়েছিলেন, এমন তথ্যও আমাদের জানা নেই। তাহলে তিনি বিতর্কিত হলেন কেন? আসলে একজন ‘আমলাকে’ বেছে নেয়ার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। আমলাদের যে মানসিকতা, তা তারা ছাড়তে পারেন না। দীর্ঘ চাকরি জীবনে সরকারের প্রতি যে ‘দায়বদ্ধতা’ থাকে, কিংবা চাকরি জীবনে তিনি যা ধারণ করেন তা নতুন করে যখন পরবর্তী জীবনে নতুন করে চাকরিতে প্রবেশ করেন ওই মানসিকতা থেকে তিনি বের হয়ে আসতে পারেন না। উপরন্তু সরকারও যে নির্বাচন কমিশনকে প্রভাব খাটাতে চেষ্টা করে না, তা নয়। সংবিধানের ১১৮(৪) এর অধীনে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই ধারাটি সিইসি কিংবা কমিশনাররা প্রয়োগ করেন না। একজন দৃঢ়চেতা সিইসিকে আমরা কখনো পাইনি। ভারতের নির্বাচন কমিশনের দৃষ্টান্ত আমরা প্রায়সই দেই। সেখানে মাত্র তিনজন কমিশনার নিয়ে ভারতের মতো দেশের পুরো নির্বাচনী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। আমরা এখানে আইন করে ৫ জনের কমিশন করলাম। তাতে ফলটা কি হয়েছে? বর্তমান কমিশন নিয়ে আমাদের সুখকর কোনো অভিজ্ঞতা নেই। আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রস্তাবিত ৪ দফার মধ্যে ৩ নং দফায় যে আইন প্রণয়ন করার কথা বলা হয়েছে, এটাই হচ্ছে মুখ্য। এটা জরুরি। কিন্তু আইন প্রণয়ন করার সময় সরকার যাতে বিতর্কিত না হয়ে যায় সেদিকে লক্ষ রাখা জরুরি। সরকারের পক্ষে যায় অথবা সরকার ভবিষ্যতে নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ডে প্রভাব বিস্তার করতে পারে, এমন কোনো ধারা বা বিধান যদি আইনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহলে মূল উদ্দেশ্যটি ব্যাহত হবে-অর্থাৎ একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন আমরা পাব না। দ্বন্দ্ব, বিভেদ, বিতৃষ্ণা থেকে যাবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় অনুষ্ঠিত বেশ ক’টি নির্বাচন ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেলেও ওই সময় আমরা ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’র অভিযোগ শুনেছি। নির্বাচনে হেরে গেলে ওই নির্বাচনের রায়কে মেনে নেয়ার মানসিকতা আমাদের তৈরি হয়নি। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটাই বড় সমস্যা। আসলে মূল কথা একটিই- আস্থার সম্পর্ক গড়ে না উঠলে সার্চ কমিটি গঠন করেও কোনো লাভ হবে না। সংবিধানের ৪৮(৩) ধারা মতে রাষ্ট্রপতি ‘সম্ভাব্য সার্চ কমিটি গঠন’ কিংবা ‘কমিশনারসহ সিইসিকে নিয়োগ’ দানের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিতে বাধ্য। এখানেই রয়েছে তার সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা। সুতরাং এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীই হচ্ছেন মুখ্য ব্যক্তি। যদিও প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন রাষ্ট্রপতি এ ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত দেবেন, তা তারা মেনে নেবেন। রাষ্ট্রপতির কাছে অনেক বিকল্প আছে। তিনি সার্চ কমিটির ব্যাপারে নাম চাইতে পারেন দলগুলোর কাছে। এককভাবে তিনি সার্চ কমিটি গঠন করতে পারেন। অথবা সরাসরি সিইসিসহ ৫ জনকে নিয়োগ দিতে পারেন। এটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। তাই একটা সংলাপ হচ্ছে। ভালো হোক, মন্দ হোক এই সংলাপ একটা আস্থার সম্পর্ক তৈরি করতে পারে কিনা সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। প্রধানমন্ত্রীর দুটি বক্তব্যকে আমি গুরুত্ব দিতে চাই। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘তিনি কোনো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন চান না।’ তাকে সাধুবাদ জানাই। আওয়ামী লীগ আজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছে। আওয়ামী কেন এমন একটি নির্বাচনের আয়োজন করবে, যে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। দ্বিতীয়, তিনি এমন একটি নির্বাচন চান, যে নির্বাচনে সব দল অংশ নেবে। এটাই হচ্ছে গণতন্ত্রের কথা। আমরা সবাই জানি কোন পরিস্থিতিতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একটি নির্বাচনের আয়োজন করা হয়েছিল। যে নির্বাচনে ১৫৪ জন সংসদ সদস্য বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হন, সেই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থাকবে-এটাই স্বাভাবিক। আমরা ৫ জানুয়ারির ওই নির্বাচনকে ভুলে যেতে চাই। তাকাতে চাই সামনের দিকে। একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০১৮ সালের শেষে অথবা ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে। সংবিধানে পরবর্তী নির্বাচনের কথা এভাবেই বলা হয়েছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কয়েকটি বড় দল অংশগ্রহণ করেনি। কেন করেনি, কি জন্য করেনি, এটা নিয়ে আমরা বিতর্ক যত কম করব, ততই আমাদের জন্য ভালো। ওই নির্বাচন থেকে ‘শিক্ষা’ নিয়ে একাদশ সংসদ নির্বাচনে সব দল যাতে অংশ নেয়, সে চেষ্টাই আমাদের করা উচিত। এ কারণেই নির্বাচন কমিশন গঠন এবং নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা রাখাটা জরুরি। একটি শক্তিশালী বিরোধী দল সরকারের জন্যও মঙ্গল। সরকারের ভুল ত্রুটিগুলো তুলে ধরে সরকারকে সঠিক নীতি গ্রহণ করতে সাহায্য করতে পারে বিরোধী দল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও সত্য, দশম জাতীয় সংসদে সেই ‘বিরোধী দল’ আমরা পাইনি। গত তিন বছর জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় নিয়ে সংসদে বিতর্ক হয়নি। ফলে সংসদ হয়ে পড়েছে একদলীয়। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে উন্নয়নের অনেক কথা বলেছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন অনেক বেশি, সন্দেহ নেই তাতে। এখন এই অর্জনকে ধরে রাখতে এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে আমাদের দরকার শক্তিশালী একটি বিরোধী দল। এখন প্রত্যাশা এটাই বিএনপি ‘মূল ধারার রাজনীতিতে’ নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখবে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করবে এবং আমরা আগামীতে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল পাব সংসদে। এই প্রত্যাশা আমাদের কতটুকু পূরণ হবে, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে। Daily Manobkontho 16.01.2017
রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে একটি ভাষণ দিয়েছেন গত ১২ জানুয়ারি। দ্বিতীয় মেয়াদে তার সরকারের তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে তিনি জাতির উদ্দেশে এই ভাষণটি দিলেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ‘বিতর্কিত’ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিনি সরকার গঠন করেছিলেন। এ নিয়ে টানা আট বছর তিনি ক্ষমতায় আছেন। এবারে জাতির উদ্দেশে তিনি ভাষণ দিলেন এমন একটা সময় যখন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করছেন। বিএনপি নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ফিরে আসার একটি আভাস দিয়েছিল। ফলে রাজনীতি আগের মতো এত উত্তপ্ত ও অসহিষ্ণু নয় এখন। ধীরে ধীরে একটি ‘আস্থার সম্পর্ক’ তৈরি হচ্ছে। ঠিক তখনই প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। তিনি গত তিন বছরে তার সাফল্যের কথা বলবেন, এটা স্বাভাবিক। তবে ‘সমঝোতার রাজনীতির’ ব্যাপারে কি বক্তব্য রাখেন সে ব্যাপারে আগ্রহ ছিল অনেকের। কেননা এর মধ্য দিয়ে তিনি একটি ‘মেসেজ’ দিলেন যা চলমান রাজনীতির জন্য ইতিবাচক হতে পারে। এর আগে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে তিনি যে মন্তব্য করেছেন, তাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভবিষ্যতে কোনো বিতর্কিত নির্বাচন চান না বলে সংলাপে রাষ্ট্রপতিকে জানিয়েছেন। রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব জয়নাল আবেদিন সাংবাদিকদের এই তথ্যটি দিয়েছেন। এ থেকে ধরে নেয়া স্বাভাবিক যে প্রধানমন্ত্রী চান ‘সব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক।’ তাতে নির্বাচনটি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে। জনগণের অংশগ্রহণ বাড়বে এবং যে কোনো ধরনের বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকবে নির্বাচন কমিশন। ঠিক তেমনি জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রীর এই ‘স্পিরিটটি’ প্রতিফলিত হয়েছে। ভাষণে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন সব রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রপতির উদ্যোগে গঠিত নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা রাখবে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনে অংশ নেবে এবং দেশে গণতান্ত্রিক ধারাকে সমুন্নত রাখতে সহায়তা করবে। নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলেও তিনি জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণে নীতি নির্ধারণী কোনো বক্তব্য নেই। তিনি গত তিন বছরে কি কি করেছেন, কোন কোন ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন তার একটা পরিসংখ্যান দেন। এটা খুবই স্বাভাবিক। আগেও তিনি এ ধরনের বক্তব্য রেখেছেন। তবে এক্ষেত্রে একটি ‘আস্থার সম্পর্ক’ কি করে প্রতিষ্ঠা করা যায় তার কোনো দিক নির্দেশনা আমরা পাইনি। তার ভাষণ সম্পর্কে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। এমনকি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে আওয়ামী লীগ যে ৪টি প্রস্তাব দিয়েছে, তার একটি ই-ভোটিং এর ব্যাপারেও কোনো কোনো রাজনৈতিক দল তাদের মতামত দিয়েছে। জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের ওই প্রস্তাবটি দেখছেন ইতিবাচক হিসেবে। সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন এটা ‘খুবই গৌণ বিষয়।’তিনি ওই প্রস্তাবকে আখ্যায়িত করেছেন ‘মৌলিক বিষয় আড়াল করার একটা প্রয়াস’ হিসেবে। আর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন বাংলাদেশে ইভিএম গ্রহণযোগ্য নয়। বলা ভালো আওয়ামী লীগের দেয়া প্রস্তাবের মাঝে আরো রয়েছে ১. সিইসি ও কমিশনার নিয়োগে একটি আইন প্রণয়ন করা এবং ২. রাষ্ট্রপতি ইসি নিয়োগ প্রক্রিয়ার ব্যাপারে যে প্রক্রিয়া উপযুক্ত মনে করবেন তাই তিনি করবেন। অন্যদিকে বিএনপির প্রস্তাবের মাঝে রয়েছে ঐকমত্যের ভিত্তিতে ইসি গঠন, ৫ সদস্য বিশিষ্ট বাছাই কমিটি, একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে বাছাই কমিটি, বাছাই কমিটিতে একজন জ্যেষ্ঠ নারী কিংবা শিক্ষাবিদসহ আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের অন্তর্ভুক্ত করা ইত্যাদি। জাতীয় পার্টিও একটি সার্চ কমিটির প্রস্তাব করেছে। একই সঙ্গে ইসি নিয়োগে একটি আইন ও ইসি সচিবালয় প্রতিষ্ঠার দাবিও তাদের। সুতরাং দেখা যাচ্ছে তিনটি বড় দলের মাঝে তাদের স্ব স্ব প্রস্তাবের ব্যাপারে খুব যে একটা মিল আছে, তা বলা যাবে না। একটি আইন প্রণয়ন করার ব্যাপারে কিছুটা মিল আছে। নীতিগতভাবে বিএনপিও এটা সমর্থন করে। তবে এক্ষেত্রে প্রশ্ন আছে অনেক। ৯ ফেব্রুয়ারিতে এই কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। সুতরাং এত অল্প সময়ের ব্যবধানে আইন করে সিইসি ও কমিশনারদের নিয়োগ দেয়া সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের পদগুলো ‘সীমিত সময়ের’ জন্য খালি রাখা যায় কি না? তাহলে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সংসদে আইনটি পাস করানো সম্ভব। সাংবিধানিক পদগুলো খালি রাখা যায় কি যায় না, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের একটি ‘রেফারেন্স’ চাওয়া যেতে পারে। তবে আইনটি প্রণয়ন করার সময় সব রাজনৈতিক দলের মতামত নেয়া হবে কি? সিভিল সোসাইটির মতামত নেয়াও প্রয়োজন। সিইসি তথা কমিশনারদের একটা ‘নিরপেক্ষতার’ কথা বলেছেন সবাই। কিন্তু এই নিরপেক্ষতার সংজ্ঞা কি কিংবা এই ‘নিরপেক্ষতা’ নিশ্চিত হবে কিভাবে? কাজী রকিবউদ্দিনের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল না। ‘জনতার মঞ্চে’ তিনি গিয়েছিলেন, এমন তথ্যও আমাদের জানা নেই। তাহলে তিনি বিতর্কিত হলেন কেন? আসলে একজন ‘আমলাকে’ বেছে নেয়ার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। আমলাদের যে মানসিকতা, তা তারা ছাড়তে পারেন না। দীর্ঘ চাকরি জীবনে সরকারের প্রতি যে ‘দায়বদ্ধতা’ থাকে, কিংবা চাকরি জীবনে তিনি যা ধারণ করেন তা নতুন করে যখন পরবর্তী জীবনে নতুন করে চাকরিতে প্রবেশ করেন ওই মানসিকতা থেকে তিনি বের হয়ে আসতে পারেন না। উপরন্তু সরকারও যে নির্বাচন কমিশনকে প্রভাব খাটাতে চেষ্টা করে না, তা নয়। সংবিধানের ১১৮(৪) এর অধীনে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই ধারাটি সিইসি কিংবা কমিশনাররা প্রয়োগ করেন না। একজন দৃঢ়চেতা সিইসিকে আমরা কখনো পাইনি। ভারতের নির্বাচন কমিশনের দৃষ্টান্ত আমরা প্রায়সই দেই। সেখানে মাত্র তিনজন কমিশনার নিয়ে ভারতের মতো দেশের পুরো নির্বাচনী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। আমরা এখানে আইন করে ৫ জনের কমিশন করলাম। তাতে ফলটা কি হয়েছে? বর্তমান কমিশন নিয়ে আমাদের সুখকর কোনো অভিজ্ঞতা নেই। আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রস্তাবিত ৪ দফার মধ্যে ৩ নং দফায় যে আইন প্রণয়ন করার কথা বলা হয়েছে, এটাই হচ্ছে মুখ্য। এটা জরুরি। কিন্তু আইন প্রণয়ন করার সময় সরকার যাতে বিতর্কিত না হয়ে যায় সেদিকে লক্ষ রাখা জরুরি। সরকারের পক্ষে যায় অথবা সরকার ভবিষ্যতে নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ডে প্রভাব বিস্তার করতে পারে, এমন কোনো ধারা বা বিধান যদি আইনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহলে মূল উদ্দেশ্যটি ব্যাহত হবে-অর্থাৎ একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন আমরা পাব না। দ্বন্দ্ব, বিভেদ, বিতৃষ্ণা থেকে যাবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় অনুষ্ঠিত বেশ ক’টি নির্বাচন ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেলেও ওই সময় আমরা ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’র অভিযোগ শুনেছি। নির্বাচনে হেরে গেলে ওই নির্বাচনের রায়কে মেনে নেয়ার মানসিকতা আমাদের তৈরি হয়নি। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটাই বড় সমস্যা। আসলে মূল কথা একটিই- আস্থার সম্পর্ক গড়ে না উঠলে সার্চ কমিটি গঠন করেও কোনো লাভ হবে না। সংবিধানের ৪৮(৩) ধারা মতে রাষ্ট্রপতি ‘সম্ভাব্য সার্চ কমিটি গঠন’ কিংবা ‘কমিশনারসহ সিইসিকে নিয়োগ’ দানের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিতে বাধ্য। এখানেই রয়েছে তার সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা। সুতরাং এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীই হচ্ছেন মুখ্য ব্যক্তি। যদিও প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন রাষ্ট্রপতি এ ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত দেবেন, তা তারা মেনে নেবেন। রাষ্ট্রপতির কাছে অনেক বিকল্প আছে। তিনি সার্চ কমিটির ব্যাপারে নাম চাইতে পারেন দলগুলোর কাছে। এককভাবে তিনি সার্চ কমিটি গঠন করতে পারেন। অথবা সরাসরি সিইসিসহ ৫ জনকে নিয়োগ দিতে পারেন। এটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। তাই একটা সংলাপ হচ্ছে। ভালো হোক, মন্দ হোক এই সংলাপ একটা আস্থার সম্পর্ক তৈরি করতে পারে কিনা সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। প্রধানমন্ত্রীর দুটি বক্তব্যকে আমি গুরুত্ব দিতে চাই। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘তিনি কোনো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন চান না।’ তাকে সাধুবাদ জানাই। আওয়ামী লীগ আজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছে। আওয়ামী কেন এমন একটি নির্বাচনের আয়োজন করবে, যে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। দ্বিতীয়, তিনি এমন একটি নির্বাচন চান, যে নির্বাচনে সব দল অংশ নেবে। এটাই হচ্ছে গণতন্ত্রের কথা। আমরা সবাই জানি কোন পরিস্থিতিতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একটি নির্বাচনের আয়োজন করা হয়েছিল। যে নির্বাচনে ১৫৪ জন সংসদ সদস্য বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হন, সেই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থাকবে-এটাই স্বাভাবিক। আমরা ৫ জানুয়ারির ওই নির্বাচনকে ভুলে যেতে চাই। তাকাতে চাই সামনের দিকে। একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০১৮ সালের শেষে অথবা ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে। সংবিধানে পরবর্তী নির্বাচনের কথা এভাবেই বলা হয়েছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কয়েকটি বড় দল অংশগ্রহণ করেনি। কেন করেনি, কি জন্য করেনি, এটা নিয়ে আমরা বিতর্ক যত কম করব, ততই আমাদের জন্য ভালো। ওই নির্বাচন থেকে ‘শিক্ষা’ নিয়ে একাদশ সংসদ নির্বাচনে সব দল যাতে অংশ নেয়, সে চেষ্টাই আমাদের করা উচিত। এ কারণেই নির্বাচন কমিশন গঠন এবং নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা রাখাটা জরুরি। একটি শক্তিশালী বিরোধী দল সরকারের জন্যও মঙ্গল। সরকারের ভুল ত্রুটিগুলো তুলে ধরে সরকারকে সঠিক নীতি গ্রহণ করতে সাহায্য করতে পারে বিরোধী দল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও সত্য, দশম জাতীয় সংসদে সেই ‘বিরোধী দল’ আমরা পাইনি। গত তিন বছর জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় নিয়ে সংসদে বিতর্ক হয়নি। ফলে সংসদ হয়ে পড়েছে একদলীয়। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে উন্নয়নের অনেক কথা বলেছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন অনেক বেশি, সন্দেহ নেই তাতে। এখন এই অর্জনকে ধরে রাখতে এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে আমাদের দরকার শক্তিশালী একটি বিরোধী দল। এখন প্রত্যাশা এটাই বিএনপি ‘মূল ধারার রাজনীতিতে’ নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখবে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করবে এবং আমরা আগামীতে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল পাব সংসদে। এই প্রত্যাশা আমাদের কতটুকু পূরণ হবে, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে। Daily Manobkontho 16.01.2017
0 comments:
Post a Comment