৮ বছর ক্ষমতায় থেকে বিদায় নিচ্ছেন বারাক ওবামা। ২০ জানুয়ারি তিনি ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে। ১১ জানুয়ারি শিকাগোতে ১৮ হাজার মানুষের সম্মুখে ওবামা বিদায় ভাষণ দিলেন। এই শিকাগো থেকেই ওবামা তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন। একজন আইনজীবী, একজন সিনেটর, অতঃপর একজন প্রেসিডেন্ট। আবেগে আপ্লুত তার ‘বিদায়ী ভাষণে’ তিনি দায়িত্ব পালনে তার স্ত্রী ও কন্যাদের অবদানের কথা যেমনি স্মরণ করেছেন, তেমনি তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীদের অবদানের কথাও। বারাক ওবামা এক অভিবাসী শ্বেতাঙ্গ বাবার সন্তান, যিনি যুক্তরাষ্ট্রে কখনও থাকেননি, সন্তানকে স্ত্রীর কাছে রেখে ফিরে গিয়েছিলেন ‘নিজ বাসভূমি’ কেনিয়ায়। বারাক ওবামার স্ত্রী মিশেলের পূর্বপুরুষ ছিলেন ক্রীতদাস, এসেছিলেন আফ্রিকা থেকে। অভিবাসীর রক্ত স্বামী ও স্ত্রী দুইজনের রক্তেই আছে। আবেগাপ্লুত বারাক ওবামা যখন তার ৮ বছরের শাসনামলে অনেক অর্জনের কথা বলেছিলেন, তখন তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু। তিনি আবেগ সংযত করতে পারেননি। তিনি আমেরিকার দরজা সবসময় সবার জন্য খোলা রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে সবাইকে বিভাজনের বদলে আইনের প্রতি অবিচল থাকার আহ্বান জানান। মুসলমান অভিবাসীদের বিভাজনের দিকে ঠেলে দেয়ার বিরোধিতা করে তিনি বলছিলেন, তারা অন্য সব আমেরিকানের মতোই দেশপ্রেমিক, তারা আমাদের মতোই এ দেশকে ভালোবাসে। ৮ বছর আগে এই শিকাগো শহরে এমনি এক জনসভায় তিনি বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ আমরাই পারব।’ আর ৮ বছর পর তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ আমরা পেরেছি।’
ওবামা কতটুকু কী পেরেছেন, তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু তিনি এমন একসময় হোয়াইট হাউস ছেড়ে যাচ্ছেন, যখন এ অভিবাসন, বিশেষ করে মুসলমান অভিবাসীদের নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ। এ বিভক্তিকে সামনে নিয়ে এসেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। গেল বছরের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি বিজয়ী হয়েছেন। কিন্তু এর আগে টানা কয়েক মাস তিনি মুসলমানবিদ্বেষী বক্তব্য রেখে সেখানে একটা মুসলমানবিরোধী জনমত গড়ে তুলেছিলেন। সেটা কাজে দিয়েছিল। জনমতকে তার পক্ষে সংগঠিত করতে পেরেছিলেন তিনি। এখন ২০ জানুয়ারি তিনি দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন। কিন্তু তার আগেই একাধিক কারণে বিতর্কিত হয়েছেন তিনি। যাদের তিনি মন্ত্রিপরিষদে নিয়োগ দিয়েছেন, তারা সবাই প্রায় বিতর্কিত। সবাই উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রবক্তা। ফলে ট্রাম্পের শাসনামলে ইসলামবিদ্বেষ, অভিবাসনবিরোধী নীতি যে প্রাধান্য পাবে, তা স্পষ্ট। ওবামার নীতির সঙ্গে পার্থক্য এখানেই। ওবামা যেখানে তার বিদায়ী ভাষণে মুসলমান সম্প্রদায়কে ‘দেশপ্রেমিক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, সেখানে ট্রাম্প একটি বিদ্বেষ সৃষ্টি করেছেন। শুধু তাই নয়, ট্রাম্প তার বড় মেয়ে ইভাস্কা ট্রাম্পের স্বামী জেরার্ড কুশনারকে হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিশেষ উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। এটা নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। আইনগতভাবে তিনি এটি পারেন না। ভবিষ্যতে কংগ্রেসের শুনানির মুখোমুখিও হতে পারেন কুশনার। আরও একটি খারাপ খবর আছে ট্রাম্পের জন্য। নির্বাচন প্রচার অভিযানে রাশিয়ান গোয়েন্দা সংস্থা পরাজিত প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের নির্বাচনী শিবিরের ই-মেইল হ্যাক করেই ক্ষান্ত থাকেনি, বরং এখন শোনা যাচ্ছে, ট্রাম্পের ব্যাপারেও স্পর্শকাতর তথ্য রয়েছে রাশিয়ানদের কাছে। ফলে ট্রাম্পের শুরুটা বিতর্কের মধ্য দিয়েই হচ্ছে।
চলতি বছর একদিকে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক, অন্যদিকে রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক অনেকের কাছেই আলোচনার অন্যতম বিষয় হয়ে থাকবে। ক্ষমতা নেয়ার আগেই ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের সনাতন ‘ওয়ান চায়না’ পলিসিকে একটি প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছেন। গেল বছরের ২ ডিসেম্বর তিনি তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইঙ ওয়েন (ঞংধর ওহম-ডবহ) এর একটি ফোন কল রিসিভ করেন। ১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। সেই থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাইওয়ানের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক সম্পর্ক রাখেনি যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র ‘এক চীন’ নীতি অনুসরণ করে আসছে। এখন তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টকে যুক্তরাষ্ট্রের হবু প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দিয়ে ট্রাম্প শুধু চীনের নেতাদেরই আক্রমণের শিকারে পরিণত হলেন না, বরং চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে একটি প্রশ্নের মাঝে ফেলে দিয়েছেন। চীন এর সমালোচনা করেছে। এর আগে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের কর্তৃত্ব নিয়েও ট্রাম্প প্রশ্ন তুলেছেন। নির্বাচনের আগে তিনি বলেছিলেন, তিনি চীনা পণ্যের ওপর শতকরা ৩৫ ভাগ শুল্ক আরোপ করবেন। ফলে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কটি একটি প্রশ্নের মুখে থাকল। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া সম্পর্ক নিয়েও নতুন করে আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় হিলারি ক্লিনটনের ই-মেইল হ্যাক, ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক, রাশিয়ায় ট্রাম্পের ব্যবসায়িক স্বার্থ এবং রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক ট্রাম্পকে ক্ষমতায় বসানোর উদ্যোগ ইত্যাদি নানা কারণে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভিন্ন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ট্রাম্প দায়িত্ব নেয়ার পরই বোঝা যাবে এ সম্পর্ককে তিনি কোন পর্যায়ে নিয়ে যান। সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক খুব ভালো যাচ্ছে না। ইউক্রেন সংকট এবং ক্রিমিয়ার রাশিয়ার অন্তর্ভুক্তি নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল। জি-৮ থেকে রাশিয়াকে বহিষ্কার করা হয় এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হয়। এখন ট্রাম্প বিষয়গুলোকে কীভাবে নেবেন, সেটা দেখার বিষয়। তবে ন্যাটোর সম্প্রসারণের ব্যাপারে ট্রাম্পের অনাগ্রহ পুতিনকে খুশি করে থাকবে। পুতিনের প্লাস পয়েন্ট এটাই। এক্ষেত্রে পেন্টাগন বিষয়টিকে আগামীতে কীভাবে দেখবে, সেদিকে লক্ষ থাকবে অনেকের।
ট্রাম্পের দায়িত্ব নেয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আসবে না। যুক্তরাষ্ট্র-ইরান পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তিকে অস্বীকার করেছেন ট্রাম্প। তিনি জানিয়েছেন, তিনি এটা অনুমোদন করবেন না। তিনি যদি সত্যি সত্যিই এটি করেন, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে উত্তেজনা বাড়বে। ইরান মধ্যপ্রাচ্যে একটি ‘ফ্রন্ট ওপেন’ করবে এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। ইরান সমঝোতা এ অঞ্চলে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়াকে শুধু এগিয়ে নিয়ে যাবে না, বরং এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে। ওবামা প্রশাসনের আমলে আইএসের উত্থান মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির দৃশ্যপটকে পরিপূর্ণভাবে বদলে দেয়। ইরাক ও সিরিয়ার একটা অংশ নিয়ে এরই মধ্যে আইএসের উদ্যোগে একটি ‘জিহাদি রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তারা ইসলামিক দেশগুলোকে নিয়ে ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেছে। দক্ষিণ তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তারা ‘দূরবর্তী খেলাফত’ প্রতিষ্ঠার কথাও বলছে। বাস্তবতা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার অব্যাহত বিমান হামলার পরও আইএসকে উৎখাত করা সম্ভব হয়নি। রাশিয়ার বিমান হামলা (এমনকি চীনেরও সমর্থনসহ) সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদকে নতুন একটি জীবন দিয়েছে। ইরাকে সাদ্দাম হোসেন আর লিবিয়ায় গাদ্দাফির উৎখাতের পর টার্গেট ছিলেন আসাদ। এখন মনে হচ্ছে, আসাদ টিকে গেলেন। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, ট্রাম্প-পুতিন সমঝোতা সিরিয়ায় কী প্রভাব ফেলবে? ধারণা করা স্বাভাবিক, যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়া প্রশ্নে তাদের ‘ইনভলভমেন্ট’ কমিয়ে ফেলবে। আরও একটি বিষয় বেশ গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, ন্যাটোর বাহিনী মোতায়েনে এবং বিশ্বের সর্বত্র ‘যুদ্ধে’ জড়িয়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র যে বিপুল অর্থ ব্যয় করে, তা ট্রাম্প এখন কমিয়ে আনতে চাইবেন। এতে ওই অর্থ খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগের পরিস্থিতির উন্নতি করতে পারে। তবে তা ইউরোপের দেশগুলোকে আবারও এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। কেননা রাশিয়াকে নিয়ে ইউরোপের ভয়টা বাড়ছে। পুতিন ওয়ারশ সামরিক চুক্তির আদলে ‘কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি’ গঠন করতে যাচ্ছেন, যেখানে তিনি মধ্য এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোকে এক সামরিক বলয়ে আনতে চান। ফলে ট্রাম্পের ৪ বছরের জমানায় বিশ্ব এক নতুন পৃথিবীকে দেখবে। ওবামা প্রশাসনের আমলে এ বিশ্ব স্থিতিশীল ছিল না। ওবামা নিজে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেলেও (২০০৮) সিরিয়ায় বিমান হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর আগে লিবিয়ায় বোমা হামলার নির্দেশ দিয়ে তিনি গাদ্দাফিকে উৎখাত করেছিলেন। লিবিয়া এখন একটি অকার্যকর রাষ্ট্র। অস্ত্রবাজদের হাতে এখন দেশটি চলে গেছে। একসময় যে দেশটি উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি ‘মডেল’ ছিল, তা এখন কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। কোনো কোনো এলাকা আইএসের নিয়ন্ত্রণেও চলে গেছে।
বিশ্ববাসীর জন্য আরও একটি দুঃখজনক সংবাদ হচ্ছে, ট্রাম্প বলছেন, তিনি প্যারিসে (২০১৫) স্বাক্ষরিত কপ-২১ সমঝোতা স্মারক চুক্তিটি মানবেন না। জলবায়ু পরিবর্তনরোধে এ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল। পরে গেল বছর নিউইয়র্কে এর ধারাবাহিকতায় একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে এটি আইনে পরিণত হলো। প্যারিস ও নিউইয়র্কে যুক্তরাষ্ট্র সমঝোতা স্মারক এবং চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। এখন যদি ট্রাম্প এ চুক্তি অনুযায়ী তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ না নেন, তা একটি ভিন্ন মেসেজ পৌঁছে দেবে। যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা একটা প্রশ্নের মুখে থাকবে। ফলে ২০ জানুয়ারির পর সারা বিশ্ব তাকিয়ে থাকবে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে।
বারাক ওবামা তার বিদায়ী ভাষণে নির্বাচনের আগে বিভক্ত হয়ে পড়া জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এখন ট্রাম্পের জমানায় জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকে কিনা, সেটাই বড় প্রশ্ন।
Daily Alokito Bangladesh
15.01.2017
0 comments:
Post a Comment