গত
২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি একটি সার্চ কমিটি গঠন করেছেন। ৬ সদস্য বিশিষ্ট এই
কমিশন আগামী ১০ কর্ম দিবসের মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন
কশিনারদের নাম প্রস্তাব করবেন। প্রস্তাবিত নামগুলোর মধ্যে থেকে রাষ্ট্রপতি
একজন সিইসি ও চারজন কমিশনারকে নিয়োগ দেবেন। বর্তমানে যে কমিশন আছে, তাদের
মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে ৯ ফেব্রুয়ারি। নয়া সিইসি ও কমিশনাররা দায়িত্ব নেবেন
এরপর। কিন্তু সার্চ কমিটি নিয়েও প্রশ্ন তুলল বিএনপি। বিএনপির মহাসচিব
জানিয়েছেন, সার্চ কমিটি গঠনে তার দল ‘হতাশ এবং ক্ষুব্ধ।’ এই বক্তব্য একটা
ভিন্ন মেসেজ এখন পৌছে দিতে পারে। এখন এই কমিটি যাদের নাম প্রস্তাব করবে,
তারাও বিতর্কিত হয়ে যেতে পারে। এক কঠিন সময়ে নয়া কমিশন দায়িত্ব নিতে
যাচ্ছে। কেননা তারাই ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় একাদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজন করবে।
ফলে নতুন নির্বাচন কমিশনকে বিএনপিকে আস্থায় নিতে হবে। আস্থায় নিতে না পারলে
আগামী নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে নিবন্ধিত দলগুলোর আলোচনায় যে ধরনের প্রস্তাব পাওয়া গিয়েছিল তার ভিত্তি ধরেই এই সার্চ কমিটি গঠিত হলো। তবে সরকার এখন একটি আইন করতে যাচ্ছে যেখানে সিইসি তথা কমিশনারদের নিয়োগ প্রক্রিয়া উল্লেখ থাকবে। তবে এবার এটি হলো না। আগামী কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে এই আইনটি কার্যকর হবে। বিএনপি মহাসচিব তার দলের হতাশার কথা বললেও তিনি স্পষ্ট করে বলেননি কেন তার দল হতাশ। ৬ জন সদস্যের মধ্যে দু’জন আছেন শিক্ষাবিদ। তারা আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে যিনি পিএসসির চেয়ারম্যান তিনি এর আগে নির্বাচন কমিশনের সচিব ছিলেন। ৫ জানুয়ারি (২০১৪) নির্বাচন তিনিই ‘সম্পন্ন’ করেছেন। ওই নির্বাচন একটি বড় বিতর্কের জš§ দিয়েছিল বাংলাদেশে। ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হয়েছিলেন, যা সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ওই নির্বাচন আয়োজন ও সম্পন্ন করার ব্যাপারে যিনি জড়িত ছিলেন তিনি যখন সার্চ কমিটির সদস্য নিযুক্ত হন তখন বিতর্ক বাড়ে বৈকি! যিনি সার্চ কমিটির প্রধান নিযুক্ত হয়েছেন, তিনি এর আগেও সার্চ কমিটির প্রধান ছিলেন। তাকে নিয়ে অথবা অপর বিচারপতিকে নিয়েও প্রশ্ন তোলা যাবে না। মহাহিসাব নিরীক্ষক বিতর্কের বাইরে।
রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যখন আলোচনা করছিলেন, তখনই সার্চ কমিটির প্রস্তাব আসে। সেই সঙ্গে একটি আইন প্রণয়ন করারও দাবি ওঠে যা গত ৪৪ বছরে হয়নি। একজন নারীকে অন্তর্ভুক্ত করারও দাবি উঠেছিল যা এবার রাখা হয়েছে। সুতরাং রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা বা উপস্থাপন করা যাবে না। রাষ্ট্রপতি শুধুমাত্র সাংবিধানিক ধারা অনুসরণ করেছেন। অর্থাৎ তিনি সংবিধানের ১১৮নং ধারা ও ৪৮নং ধারা অনুসরণ করেছেন। ৪৮ (৩)নং ধারায় বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন পুনঃগঠনের ব্যাপারে তিনি যাই করুন না কেন, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ করেই তিনি তা করবেন। তিনি তা করেছেনও। অর্থাৎ সার্চ কমিটির নামের তালিকা প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার পরই তার সম্মতি নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়। আওয়ামী লীগ বারবার বলে আসছিল সার্চ কমিটি গঠিত হবে সংবিধানের আলোকেই। বিএনপি তো এটা জানতই যে সার্চ কমিটি গঠনেও প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির প্রয়োজন আছে। এখন কমিটি ১০ দিনের মাঝে তাদের নামের তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেবে। তবে এটা স্পষ্ট নয় সার্চ কমিটি সিইসি পদে একাধিক ব্যক্তি এবং ৪ জন কমিশনারের বিপরীতে ৮ জন ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করবে কি না? রাষ্ট্রপতিকে সুযোগ দিতে হবে এবং সে কারণে একাধিক ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করা উত্তম। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এই দলগত দ্বন্দ্ব, একদল কর্তৃক অন্য দলকে সহ্য না করার মানসিকতা এমন পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হয়েছে যে কোনো একটি ক্ষেত্রেও কোনেন ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। রাষ্ট্রপতি একটি সার্চ কমিটি গঠন করলেন। তাও ‘বিতর্কিত’ হয়ে গেল এবং আমি দিব্যি দিয়ে বলতে পারি যারা নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন এবং দায়িত্ব নেবেন তাদেরকও বিতর্কিত করা হবে। এই ‘বিতর্কের’ ভয়ে অনেক শুভবুদ্ধির মানুষ নির্বাচন কমিশনে দায়িত্ব নিতে আগ্রহী হবেন না। সম্মানের ভয়ে কেউই আসতে চাইবেন না। ফলে একটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে বটে কিন্তু এই কমিশন একাদশ সংসদ নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারবে তা নিয়েও একটা শঙ্কা রয়ে গেল।
একটি ‘গ্রহণযোগ্য ও সব দলের অংশগ্রহণে’ নির্বাচন প্রয়োজন। ৫ জানুয়ারি (২০১৪) একটি নির্বাচন হয়েছিল বটে কিন্তু ওই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। এরপর থেকে দাতাগোষ্ঠী বারবার বলে আসছে ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ একটি নির্বাচনের কথা। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্যও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে যেখানে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রী কোনো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন চান না।’ জানি না প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের সভায় কথাটা এভাবেই বলেছিলেন কিনা। বাস্তবতা হচ্ছে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটা ভালো ছিল না। এর জন্য যে বক্তব্যই দেয়া হোক না কেন, ৫ জানুয়ারি নির্বাচন এ দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমরা নিশ্চয়ই আগামী নির্বাচনটাও এমন দেখতে চাই না। একটি নির্বাচন হবে এবং তাতে সব দল অংশ নেবে, এটাই কাম্য। সেজন্যই নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বটি অনেক বেশি। সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে অনেক স্বাধীনতা দিয়েছে। সমস্যা হচ্ছে স্বাধীনতার ব্যবহার নিয়ে। রকিব কমিশন স্বাধীনভাবে নির্বাচন কমিশন পরিচালনা করতে পারেননি। সুতরাং যারা আসবেন তাদের নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাবে। এখন দেখার পালা সার্চ কমিটি কাদের নাম প্রস্তাব করে।
সংলাপের এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন বড় দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য কমিয়ে আনার। এটাই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বড় সমস্যা। প্রতিটি ইস্যুতে মতপার্থক্য খুব বেশি। সার্চ কমিটি গঠনের প্রশ্নেও এই মতপার্থক্য দেখা গেল। তবুও আশা করব সার্চ কমিটি যাদের নাম রাষ্ট্রপতির বিবেচনার জন্য প্রেরণ করবে, তাদের নিয়ে বিতর্ক হবে না। কিংবা রাজনৈতিকভাবে যারা পরিচিত, তাদের নাম প্রস্তাব করবে না। সাবেক কোন আমলাকে সিইসি পদে প্রস্তাব না করাই মঙ্গল। সেক্ষেত্রে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নাম প্রস্তাব করা যেতে পারে। কমিশনার হিসেবে শিক্ষাবিদরা অথবা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও আসতে পারেন। সাবেক জেলা জজ কিংবা সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র অফিসাররাও যে বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে পারেন না রকিব কমিশন এর বড় প্রমাণ। তাই সার্চ কমিটির দায়িত্ব অনেক বেশি। ১০ দিন সময়টা খুব বেশি নয়। ইতোমধ্যে খবর বেরিয়েছে সার্চ কমিটি সবার কাছে নাম চাইতে পারে। অর্থাৎ দলগুলো নাম জমা দেবে। এটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। ১০ দিনের মধ্যে এটা কতটুকু করা সম্ভব হবে আমি নিশ্চিত নই। তবে সার্চ কমিটি গঠনের ব্যাপারে বিএনপি যে প্রস্তাব দিয়েছিল ওই প্রস্তাবগুলোকে সামনে রেখে সার্চ কমিটি একটি তালিকা তৈরি করতে পারে। এমনকি বিএনপি কোনো ব্যক্তির নাম না দিয়ে একটি কাঠামোর ধারণা দিতে পারে। প্রস্তাব করতে পারে, যা সার্চ কমিটি বিবেচনায় নিতে পারে। যেমন সিইসির ক্ষেত্রে একজন সাবেক বিচারপতি, একজন সাবেক আমলা অথবা সেনাবাহিনীর একজন সাবেক মেজর জেনারেলের অন্তর্ভুক্তির কাঠামো প্রস্তাব করতে পারে। সার্চ কমিটি সেখান থেকে কয়েকটি নাম বিবেচনায় নিতে পারে। এমনকি নামগুলো নিয়ে বিএনপির সঙ্গে পরোক্ষ আলোচনায়ও হতে পারে। সেই সঙ্গে ৪ জন কমিশনারের একটি ‘কাঠামোও’ দিতে পারে, যেখান থেকে কমিশনারদের নাম প্রস্তাব করা হবে। সেক্ষেত্রে একজন দলনিরপেক্ষ শিক্ষাবিদ, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা হলে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত হবে।
যে ৬ জনকে নিয়ে সার্চ কমিটি হয়েছে তার মাঝে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি তার বক্তব্যে নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীকে তিনি অনেকটা ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন সার্চ কমিটিতে অন্তুর্ভুক্ত হওয়ার জন্য। তার বক্তব্য পত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। এতে করে কি তার নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয় না? অধ্যাক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম গুণী ব্যক্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতিতে তিনি একটি পক্ষের মানুষ। যদিও সিরিয়াসলি তিনি কখনো শিক্ষক রাজনীতি করেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার সমর্থিত নীল দলের সমর্থক তিনি। তার ইন্টিগ্রিটি বা গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও প্রেসিডেন্টের এই মনোনয়ন তাকে বিতর্কিত করতে পারে। ড. সাদিকের অতীত ইতিহাস খুব উজ্জ্বল নয়। ৫ জানুয়ারি (২০১৪) নির্বাচনের সময় তিনি ছিলেন নির্বাচন কমিশনের সচিব। ফলে তাকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলে, তা একেবারে ফেলে দেয়া যাবে না। দুজন বিচারপতির বাইরে সরকারের মহাহিসাব নিরীক্ষক একজন সরকারি আমলা ড. সাদিকের মতো। যদিও তিনি শপথ নিয়েছেন এবং সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত। কিন্তু তারপরও সরকারের প্রভাবের বাইরে তিন কতটুকু যেতে পারবেন, সে প্রশ্ন কেউ তুলতেই পারেন। তারপরও সার্চ কমিটিকে একটি সুযোগ দেয়া উচিত। দেখা যাক সার্চ কমিটি কাদের নাম সুপারিশ করে। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা এটাই যে, সার্চ কমিটি কোনো বিতর্কিত ব্যক্তিকে সুপারিশ করবে না। যদিও ২০১২ সালে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে দিয়েই প্রথম সার্চ কমিটি গঠিত হয়েছিল এবং তারা রকিব উদ্দিনকে সিইসি পদে সুপারিশ করেছিলেন। তাদের অভিমত খুব সুখের হয়নি। সমসাময়িককালে রকিব কমিশন বিতর্কিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ফলে সাধারণ মানুষ চাইবে না দ্বিতীয় আরেকটি ‘রকিব কমিশন’ গঠিত হোক। সার্চ কমিটির কাছে তাই প্রত্যাশা অনেক বেশি।
আমরা চাই এ দেশে সুস্থ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হোক। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠুক। এই আস্থার সম্পর্ক গড়ে না উঠলে বারবার সংকটের জš§ হবে। সরকারের যে কোনো সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করবে প্রধান বিরোধী দল। আমরা গণতন্ত্র চাই বটে কিন্তু ভুলে যাই পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর আস্থা স্থাপনের নামই গণতন্ত্র। সেই গণতন্ত্র এখন বাংলাদেশে মুখ থুবড়ে পড়েছে। সার্চ কমিটি নিয়ে যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল তা ভেস্তে গেল। ফলে ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় একাদশ সংসদ নির্বাচনও থাকল একটি প্রশ্নের মুখে। ইতোমধ্যে দাতাগোষ্ঠী আবার সক্রিয় হয়েছে। দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বলতে চান। আগামী নির্বাচন নিয়েই তারা কথা বলতে চান। প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচনের বিষয়টি একান্তভাবেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশের সংবিধানে এ ব্যাপারে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা আছে। সুতরাং বাইরের কোনো ‘শক্তির’ এ ব্যাপারে কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ‘আস্থার সম্পর্কে’ ঘাটতি থাকায় সুযোগ নিচ্ছে দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনে যদি কোনো বিতর্কিত ব্যক্তি থাকেন এবং বিএনপি যদি তাদের প্রত্যাখ্যান করে তাহলে জটিলতা বাড়বে এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও একটা অশ্চিয়তার মধ্যে থাকবে। তাই সার্চ কমিটির দিকে তাকিয়ে আছে সারা জাতি। বিএনপিকে আস্থায় নিয়েই তারা সিইসি তথা কমিশনারদের নাম প্রস্তাব করবে এটিই সবার প্রত্যাশা। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করে সিইসি হিসেবে কারো নাম প্রস্তাব না করে দশজনের নামের একটি তালিকা তারা জমা দিতে পারে। রাষ্ট্রপতি সেখান থেকে একজন সিইসি ও চারজন কমিশনার নিয়োগ দিতে পারেন। চলতি ২০১৭ সালটি শুরু হলো একটি অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে। এখন দেখার পালা সামনের দিনগুলো কেমন যায়। Daily Manobkontho 30.01.2017
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে নিবন্ধিত দলগুলোর আলোচনায় যে ধরনের প্রস্তাব পাওয়া গিয়েছিল তার ভিত্তি ধরেই এই সার্চ কমিটি গঠিত হলো। তবে সরকার এখন একটি আইন করতে যাচ্ছে যেখানে সিইসি তথা কমিশনারদের নিয়োগ প্রক্রিয়া উল্লেখ থাকবে। তবে এবার এটি হলো না। আগামী কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে এই আইনটি কার্যকর হবে। বিএনপি মহাসচিব তার দলের হতাশার কথা বললেও তিনি স্পষ্ট করে বলেননি কেন তার দল হতাশ। ৬ জন সদস্যের মধ্যে দু’জন আছেন শিক্ষাবিদ। তারা আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে যিনি পিএসসির চেয়ারম্যান তিনি এর আগে নির্বাচন কমিশনের সচিব ছিলেন। ৫ জানুয়ারি (২০১৪) নির্বাচন তিনিই ‘সম্পন্ন’ করেছেন। ওই নির্বাচন একটি বড় বিতর্কের জš§ দিয়েছিল বাংলাদেশে। ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হয়েছিলেন, যা সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ওই নির্বাচন আয়োজন ও সম্পন্ন করার ব্যাপারে যিনি জড়িত ছিলেন তিনি যখন সার্চ কমিটির সদস্য নিযুক্ত হন তখন বিতর্ক বাড়ে বৈকি! যিনি সার্চ কমিটির প্রধান নিযুক্ত হয়েছেন, তিনি এর আগেও সার্চ কমিটির প্রধান ছিলেন। তাকে নিয়ে অথবা অপর বিচারপতিকে নিয়েও প্রশ্ন তোলা যাবে না। মহাহিসাব নিরীক্ষক বিতর্কের বাইরে।
রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যখন আলোচনা করছিলেন, তখনই সার্চ কমিটির প্রস্তাব আসে। সেই সঙ্গে একটি আইন প্রণয়ন করারও দাবি ওঠে যা গত ৪৪ বছরে হয়নি। একজন নারীকে অন্তর্ভুক্ত করারও দাবি উঠেছিল যা এবার রাখা হয়েছে। সুতরাং রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা বা উপস্থাপন করা যাবে না। রাষ্ট্রপতি শুধুমাত্র সাংবিধানিক ধারা অনুসরণ করেছেন। অর্থাৎ তিনি সংবিধানের ১১৮নং ধারা ও ৪৮নং ধারা অনুসরণ করেছেন। ৪৮ (৩)নং ধারায় বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন পুনঃগঠনের ব্যাপারে তিনি যাই করুন না কেন, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ করেই তিনি তা করবেন। তিনি তা করেছেনও। অর্থাৎ সার্চ কমিটির নামের তালিকা প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার পরই তার সম্মতি নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়। আওয়ামী লীগ বারবার বলে আসছিল সার্চ কমিটি গঠিত হবে সংবিধানের আলোকেই। বিএনপি তো এটা জানতই যে সার্চ কমিটি গঠনেও প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির প্রয়োজন আছে। এখন কমিটি ১০ দিনের মাঝে তাদের নামের তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেবে। তবে এটা স্পষ্ট নয় সার্চ কমিটি সিইসি পদে একাধিক ব্যক্তি এবং ৪ জন কমিশনারের বিপরীতে ৮ জন ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করবে কি না? রাষ্ট্রপতিকে সুযোগ দিতে হবে এবং সে কারণে একাধিক ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করা উত্তম। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এই দলগত দ্বন্দ্ব, একদল কর্তৃক অন্য দলকে সহ্য না করার মানসিকতা এমন পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হয়েছে যে কোনো একটি ক্ষেত্রেও কোনেন ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। রাষ্ট্রপতি একটি সার্চ কমিটি গঠন করলেন। তাও ‘বিতর্কিত’ হয়ে গেল এবং আমি দিব্যি দিয়ে বলতে পারি যারা নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন এবং দায়িত্ব নেবেন তাদেরকও বিতর্কিত করা হবে। এই ‘বিতর্কের’ ভয়ে অনেক শুভবুদ্ধির মানুষ নির্বাচন কমিশনে দায়িত্ব নিতে আগ্রহী হবেন না। সম্মানের ভয়ে কেউই আসতে চাইবেন না। ফলে একটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে বটে কিন্তু এই কমিশন একাদশ সংসদ নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারবে তা নিয়েও একটা শঙ্কা রয়ে গেল।
একটি ‘গ্রহণযোগ্য ও সব দলের অংশগ্রহণে’ নির্বাচন প্রয়োজন। ৫ জানুয়ারি (২০১৪) একটি নির্বাচন হয়েছিল বটে কিন্তু ওই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। এরপর থেকে দাতাগোষ্ঠী বারবার বলে আসছে ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ একটি নির্বাচনের কথা। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্যও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে যেখানে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রী কোনো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন চান না।’ জানি না প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের সভায় কথাটা এভাবেই বলেছিলেন কিনা। বাস্তবতা হচ্ছে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটা ভালো ছিল না। এর জন্য যে বক্তব্যই দেয়া হোক না কেন, ৫ জানুয়ারি নির্বাচন এ দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমরা নিশ্চয়ই আগামী নির্বাচনটাও এমন দেখতে চাই না। একটি নির্বাচন হবে এবং তাতে সব দল অংশ নেবে, এটাই কাম্য। সেজন্যই নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বটি অনেক বেশি। সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে অনেক স্বাধীনতা দিয়েছে। সমস্যা হচ্ছে স্বাধীনতার ব্যবহার নিয়ে। রকিব কমিশন স্বাধীনভাবে নির্বাচন কমিশন পরিচালনা করতে পারেননি। সুতরাং যারা আসবেন তাদের নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাবে। এখন দেখার পালা সার্চ কমিটি কাদের নাম প্রস্তাব করে।
সংলাপের এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন বড় দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য কমিয়ে আনার। এটাই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বড় সমস্যা। প্রতিটি ইস্যুতে মতপার্থক্য খুব বেশি। সার্চ কমিটি গঠনের প্রশ্নেও এই মতপার্থক্য দেখা গেল। তবুও আশা করব সার্চ কমিটি যাদের নাম রাষ্ট্রপতির বিবেচনার জন্য প্রেরণ করবে, তাদের নিয়ে বিতর্ক হবে না। কিংবা রাজনৈতিকভাবে যারা পরিচিত, তাদের নাম প্রস্তাব করবে না। সাবেক কোন আমলাকে সিইসি পদে প্রস্তাব না করাই মঙ্গল। সেক্ষেত্রে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নাম প্রস্তাব করা যেতে পারে। কমিশনার হিসেবে শিক্ষাবিদরা অথবা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও আসতে পারেন। সাবেক জেলা জজ কিংবা সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র অফিসাররাও যে বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে পারেন না রকিব কমিশন এর বড় প্রমাণ। তাই সার্চ কমিটির দায়িত্ব অনেক বেশি। ১০ দিন সময়টা খুব বেশি নয়। ইতোমধ্যে খবর বেরিয়েছে সার্চ কমিটি সবার কাছে নাম চাইতে পারে। অর্থাৎ দলগুলো নাম জমা দেবে। এটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। ১০ দিনের মধ্যে এটা কতটুকু করা সম্ভব হবে আমি নিশ্চিত নই। তবে সার্চ কমিটি গঠনের ব্যাপারে বিএনপি যে প্রস্তাব দিয়েছিল ওই প্রস্তাবগুলোকে সামনে রেখে সার্চ কমিটি একটি তালিকা তৈরি করতে পারে। এমনকি বিএনপি কোনো ব্যক্তির নাম না দিয়ে একটি কাঠামোর ধারণা দিতে পারে। প্রস্তাব করতে পারে, যা সার্চ কমিটি বিবেচনায় নিতে পারে। যেমন সিইসির ক্ষেত্রে একজন সাবেক বিচারপতি, একজন সাবেক আমলা অথবা সেনাবাহিনীর একজন সাবেক মেজর জেনারেলের অন্তর্ভুক্তির কাঠামো প্রস্তাব করতে পারে। সার্চ কমিটি সেখান থেকে কয়েকটি নাম বিবেচনায় নিতে পারে। এমনকি নামগুলো নিয়ে বিএনপির সঙ্গে পরোক্ষ আলোচনায়ও হতে পারে। সেই সঙ্গে ৪ জন কমিশনারের একটি ‘কাঠামোও’ দিতে পারে, যেখান থেকে কমিশনারদের নাম প্রস্তাব করা হবে। সেক্ষেত্রে একজন দলনিরপেক্ষ শিক্ষাবিদ, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা হলে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত হবে।
যে ৬ জনকে নিয়ে সার্চ কমিটি হয়েছে তার মাঝে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি তার বক্তব্যে নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীকে তিনি অনেকটা ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন সার্চ কমিটিতে অন্তুর্ভুক্ত হওয়ার জন্য। তার বক্তব্য পত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। এতে করে কি তার নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয় না? অধ্যাক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম গুণী ব্যক্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতিতে তিনি একটি পক্ষের মানুষ। যদিও সিরিয়াসলি তিনি কখনো শিক্ষক রাজনীতি করেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার সমর্থিত নীল দলের সমর্থক তিনি। তার ইন্টিগ্রিটি বা গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও প্রেসিডেন্টের এই মনোনয়ন তাকে বিতর্কিত করতে পারে। ড. সাদিকের অতীত ইতিহাস খুব উজ্জ্বল নয়। ৫ জানুয়ারি (২০১৪) নির্বাচনের সময় তিনি ছিলেন নির্বাচন কমিশনের সচিব। ফলে তাকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলে, তা একেবারে ফেলে দেয়া যাবে না। দুজন বিচারপতির বাইরে সরকারের মহাহিসাব নিরীক্ষক একজন সরকারি আমলা ড. সাদিকের মতো। যদিও তিনি শপথ নিয়েছেন এবং সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত। কিন্তু তারপরও সরকারের প্রভাবের বাইরে তিন কতটুকু যেতে পারবেন, সে প্রশ্ন কেউ তুলতেই পারেন। তারপরও সার্চ কমিটিকে একটি সুযোগ দেয়া উচিত। দেখা যাক সার্চ কমিটি কাদের নাম সুপারিশ করে। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা এটাই যে, সার্চ কমিটি কোনো বিতর্কিত ব্যক্তিকে সুপারিশ করবে না। যদিও ২০১২ সালে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে দিয়েই প্রথম সার্চ কমিটি গঠিত হয়েছিল এবং তারা রকিব উদ্দিনকে সিইসি পদে সুপারিশ করেছিলেন। তাদের অভিমত খুব সুখের হয়নি। সমসাময়িককালে রকিব কমিশন বিতর্কিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ফলে সাধারণ মানুষ চাইবে না দ্বিতীয় আরেকটি ‘রকিব কমিশন’ গঠিত হোক। সার্চ কমিটির কাছে তাই প্রত্যাশা অনেক বেশি।
আমরা চাই এ দেশে সুস্থ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হোক। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠুক। এই আস্থার সম্পর্ক গড়ে না উঠলে বারবার সংকটের জš§ হবে। সরকারের যে কোনো সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করবে প্রধান বিরোধী দল। আমরা গণতন্ত্র চাই বটে কিন্তু ভুলে যাই পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর আস্থা স্থাপনের নামই গণতন্ত্র। সেই গণতন্ত্র এখন বাংলাদেশে মুখ থুবড়ে পড়েছে। সার্চ কমিটি নিয়ে যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল তা ভেস্তে গেল। ফলে ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় একাদশ সংসদ নির্বাচনও থাকল একটি প্রশ্নের মুখে। ইতোমধ্যে দাতাগোষ্ঠী আবার সক্রিয় হয়েছে। দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বলতে চান। আগামী নির্বাচন নিয়েই তারা কথা বলতে চান। প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচনের বিষয়টি একান্তভাবেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশের সংবিধানে এ ব্যাপারে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা আছে। সুতরাং বাইরের কোনো ‘শক্তির’ এ ব্যাপারে কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ‘আস্থার সম্পর্কে’ ঘাটতি থাকায় সুযোগ নিচ্ছে দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনে যদি কোনো বিতর্কিত ব্যক্তি থাকেন এবং বিএনপি যদি তাদের প্রত্যাখ্যান করে তাহলে জটিলতা বাড়বে এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও একটা অশ্চিয়তার মধ্যে থাকবে। তাই সার্চ কমিটির দিকে তাকিয়ে আছে সারা জাতি। বিএনপিকে আস্থায় নিয়েই তারা সিইসি তথা কমিশনারদের নাম প্রস্তাব করবে এটিই সবার প্রত্যাশা। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করে সিইসি হিসেবে কারো নাম প্রস্তাব না করে দশজনের নামের একটি তালিকা তারা জমা দিতে পারে। রাষ্ট্রপতি সেখান থেকে একজন সিইসি ও চারজন কমিশনার নিয়োগ দিতে পারেন। চলতি ২০১৭ সালটি শুরু হলো একটি অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে। এখন দেখার পালা সামনের দিনগুলো কেমন যায়। Daily Manobkontho 30.01.2017
0 comments:
Post a Comment