শুধু নদী বাঁচানোই নয়। সেচ প্রকল্পের জন্যও আমাদের দরকার ন্যূনতম ৩ হাজার কিউসেক পানি। সুতরাং তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে আমাদের নিরাপত্তার সঙ্গে এটা সরাসরি সম্পৃক্ত। আমাদের নীতিনির্ধারকরা যদি বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখেন, তাহলে এ দেশ, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ একটি বড় ধরনের সংকটে পড়বে। খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে থাকবে। এমনকি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এতে করে বাড়বে। মনে রাখতে হবে, তিস্তায় পানি প্রাপ্তি আমাদের ন্যায্য অধিকার। আন্তর্জাতিক আইন আমাদের পক্ষে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব আমাদের অধিকারকে নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে মমতা ব্যানার্জির আপত্তি বা সমর্থন এটা আমাদের বিষয় নয়। আমরা এটা বিবেচনায় নিতে চাই না। আমাদের অধিকার, যা আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত, তা নিশ্চিত করবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এখানে বলা ভালো, সিকিম হয়ে ভারতের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ারের সমভূমি দিয়ে চিলাহাটি হয়ে ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার পূর্বে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার উত্তর খড়িবাড়ির কাছে ডিমলা উপজেলার ছাতনাই দিয়ে প্রবেশ করেছে তিস্তা নদী। ছাতনাই থেকে এ নদী নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা, লালমনিরহাটের সদর, পাটগ্রাম, হাতিবান্দা, কালীগঞ্জ, রংপুরের কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর হয়ে চিলমারীতে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। ডিমলা থেকে চিলমারীÑ এ নদীর বাংলাদেশ অংশের মোট ব্যাচমেন্ট এরিয়া প্রায় ১ হাজার ৭১৯ বর্গকিলোমিটার। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী কমিশন গঠনের পর তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালের জুলাইয়ে দুই দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের এক বৈঠকে তিস্তার পানিবণ্টনে শতকরা ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ ও ৩৯ ভাগ ভারত এবং ২৫ ভাগ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু কোনো চুক্তি হয়নি। পরবর্তী সময়ে ২০০৭ সালের ২৫, ২৬ ও ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ ভাগ দুই দেশের মধ্যে বণ্টন করে বাকি ২০ ভাগ নদীর জন্য রেখে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। ভারত সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এরপর যুক্ত হয়েছিল মমতার আপত্তি। বাংলাদেশের কোনো প্রস্তাবের ব্যাপারেই অতীতে মমতার সম্মতি পাওয়া যায়নি। এখানে আরও একটা বিষয় বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। তিস্তার পানিবণ্টনে সিকিমকে জড়িত করারও প্রয়োজনীয়তা পড়েছে। কেননা সিকিম নিজে উজানে পানি প্রত্যাহার করে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। ফলে তিস্তায় পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে দিন দিন। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে কৃষকের কাছে তিস্তার পানির চাহিদা বেশি। সেচ কাজের জন্য তাদের প্রচুর পানি দরকার। এটা বরাবরই মমতার জন্য একটি ‘রাজনৈতিক ইস্যু’। সুতরাং মমতা তিস্তা চুক্তি করে বাংলাদেশের পানি প্রাপ্তি নিশ্চিত করবেনÑ এটা আমার কখনোই বিশ্বাস হয়নি। তাই মমতায় আস্থা রাখা যায় না। এক্ষেত্রে আমাদের যা করণীয় তা হচ্ছে, তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে ভারতের ওপর ‘চাপ’ অব্যাহত রাখা। আমরা ভারতের অনেক ‘দাবি’ পূরণ করেছি। মোদির আমলে সীমানা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে দুই দেশের সীমানা এখন চিহ্নিত। দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা একটা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। এক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতির পরও মমতা যদি তার ওপর রাখা আস্থার প্রতিদান না দেন, তাহলে তা যে দুই দেশের সম্পর্কের মাঝে একটা অবিশ্বাসের জন্ম দেবে, এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই মমতা ব্যানার্জি পশ্চিমবঙ্গে রুদ্র কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নিতে পারেন, যেখানে পশ্চিমবঙ্গের এ পানি বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশকে শতকরা ৫০ ভাগ পানি দেয়া সম্ভব বলে সুপারিশ করেছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রণব কুমার রায়ও এ সুপারিশ সমর্থন করেছিলেন। এর ভিত্তিতেই মমতা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তবে মমতাকে আস্থায় নেয়া সত্যিকার অর্থেই কঠিন। ঢাকায় আসার আগে আত্রাই প্রসঙ্গটি তুলে তিনি একটি ‘জট’ লাগিয়ে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ আত্রাইয়ের সঙ্গে তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি এক করে দেখেছেন। এটি একটি ভিন্ন বিষয়। আত্রাই নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু তিস্তায় পানি প্রাপ্তি আমাদের অগ্রাধিকার। এর সঙ্গে অন্য কোনো ইস্যুকে তুলনা করা যাবে না। বাংলাদেশ সরকারকে দ্রুত তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টিকে সামনে রেখে ভারতের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে। সমুদ্রসীমাও নির্ধারিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক আসরে। দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়নি। আজ প্রয়োজনে তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক আসরে তুলে ধরতে হবে। মমতা ব্যানার্জির ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর আমাদের দেশের কোটি কোটি মানুষের বেঁচে থাকার বিষয়টি ঝুলে থাকতে পারে না। লাখ লাখ মানুষের জীবনজীবিকা তিস্তার পানির ওপর নির্ভরশীল। মমতা ব্যানার্জির দয়াদাক্ষিণ্যের ওপর বিষয়টি নির্ভর করে না। ভাটির দেশ হিসেবে তিস্তার পানির ন্যায্য অধিকার আমাদের রয়েছে। মমতা ব্যানার্জি এককভাবে পানি প্রত্যাহার করে নিতে পারেন না। যদি তিনি তা করেন, তাহলে তা হবে আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এক্ষেত্রে মমতাকে নয়, বরং ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর আমাদের চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। তবে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, মমতা বারবার রঙ বদলাচ্ছেন। একবার বলেছিলেন, তিনি ‘কাঠবিড়ালি’ হবেন। আর এবার বললেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা দেবেন। স্পষ্টই এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে তিনি অন্যদিকে দৃষ্টি সরাতে চান।
তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ এককভাবে পানি প্রত্যাহার করতে পারে না। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র, অভিন্ন নদীগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেবে। এখন পশ্চিমবঙ্গের পানি প্রত্যাহার বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেয়নি। হেলসিংকি নীতিমালার ১৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রত্যেকটি তীরবর্তী রাষ্ট্র তার সীমানায় আন্তর্জাতিক পানিসম্পদের ব্যবহারের অধিকার ভোগ করবে যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিতে। কিন্তু এ ‘যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তি’টি উপেক্ষিত থাকে যখন পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার ২ নং নীতিতে বলা হয়েছে, পানি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনায় অবশ্যই সবার অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। তিস্তার পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটা হয়নি। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ‘জলপ্রবাহ কনভেনশন’ নামে একটি নীতিমালা গ্রহণ করে। এ নীতিমালার ৬ নং অনুচ্ছেদে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ‘যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার’ কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ব্যবহার অর্থাৎ এককভাবে তিস্তার পানির ব্যবহার এ ‘যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতা’র ধারণাকে সমর্থন করে না। আমরা আরও আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারব, যেখানে বাংলাদেশের অধিকারকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে, পরিবেশসংক্রান্ত জীববৈচিত্র্য কনভেনশনে ১৪ নং অনুচ্ছেদ, জলাভূমিবিষয়ক রামসার কনভেনশনের ৫ নং অনুচ্ছেদÑ প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবেশের প্রভাব এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীগুলোর সংরক্ষণের যে কথা বলা হয়েছে, তা রক্ষিত হচ্ছে না। এখানে সমস্যাটা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের। ভারতের ফেডারেল কাঠামোয় রাজ্য কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। কিন্তু কোনো রাজ্য (এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ) এমন কিছু করতে পারে না, যা আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে। সমস্যাটা ভারতের। পশ্চিমবঙ্গকে আশ্বস্ত করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। আমরা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীই আমাদের পানির হিস্যা নিশ্চিত করতে চাই।
তিস্তায় পানির প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ এখন বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকির মাঝে রয়েছে। আমরা চাই, এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বারবার ভারতীয় নেতাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, তিস্তা চুক্তি আমাদের অগ্রাধিকার। আমরা আমাদের ন্যায্য হিস্যা চাই। বর্তমান সরকারের সময় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। ৪০ বছর ছিটমহল সমস্যা দুই দেশের মাঝে আস্থার সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় জটিলতা সৃষ্টি করেছিল। এখন তা অতীত। ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়েছে। বাংলাদেশ ভারতকে ‘ট্রানজিট’ দিয়েছে। ভারত থেকে আমরা বিদ্যুৎ পাচ্ছি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় (২৭ মে ২০১৫) একটি চার দেশীয় উপআঞ্চলিক সহযোগিতা (বিবিআইএন) চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এখন শুধু তিস্তা চুক্তির কারণে এ সম্পর্ককে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যাবে না এটা হতে পারে না। সুতরাং আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় বাংলাদেশ তিস্তা চুক্তির প্রসঙ্গটি উত্থাপন করবে। এ ব্যাপারে ভারতে একটি জনমত সৃষ্টি করাও জরুরি।
Daily Alokito Bangladesh
08.01.2017
0 comments:
Post a Comment