রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ট্রাম্পের আমল এ অঞ্চলে কী প্রভাব ফেলবে



মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প আজ অভিষিক্ত হচ্ছেন। অনেক বিতর্ক আর এক ধরনের শংকার মধ্যে দায়িত্ব নিলেন তিনি। এখন প্রশ্ন, বিশ্ব রাজনীতিতে তিনি কি কোনো পরিবর্তন আনবেন? বিশেষ করে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন নীতিতে কি আদৌ কোনো পরিবর্তন আসবে? যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির আওতায় বাংলাদেশ। সুতরাং এ অঞ্চলে যে কোনো পরিবর্তন বাংলাদেশকেও স্পর্শ করবে। বৈদেশিক নীতিতে ট্রাম্পের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। কেননা অতীতে তিনি কোনোদিন আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন না। তিনি কোনো রাজ্যের গভর্নরও ছিলেন না। বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে আনকোরা একজন মানুষ এমন এক সময় যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি বড় রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিলেন, যখন বিশ্বে নতুন করে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হয়েছে, যাকে অভিহিত করা হয়েছে স্নায়ুযুদ্ধ-২ হিসেবে। তার যে কোনো সিদ্ধান্ত বিশ্বে একদিকে যেমন উত্তেজনা বাড়াতে পারে, অন্যদিকে তেমনি বিশ্বব্যবস্থায় একটি ‘আস্থার সম্পর্ক’ গড়ে তুলতে পারে। নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্টের জন্য আগামীতে যে ক’টি বিষয় বেশি গুরুত্ব পাবে, তার অন্যতম হচ্ছে দক্ষিণ চীন সাগর। দক্ষিণ চীন সাগরের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব অনেক। যুক্তরাষ্ট্রের নৌ স্ট্র্যাটেজিস্টরা দক্ষিণ চীন সাগরে তাদের কর্তৃত্ব ও প্রভাব বজায় রাখতে চাইবে। এবং এতে করে চীনের সঙ্গে যে কোনো ‘সংঘর্ষে’ জড়িয়ে পড়তে পারে যুক্তরাষ্ট্র।

বেশ কিছু কারণে এ অঞ্চলের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ রয়েছে। শুধু স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্বই নয়, বরং দক্ষিণ চীন সাগরে রয়েছে বিপুল জ্বালানি সম্পদ, যে সম্পদের ব্যাপারে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আগ্রহ রয়েছে। এক্সন মোবিলের সাবেক প্রধান রেক্স টিলারসন হতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। একটি বহুজাতিক তেল কোম্পানির প্রধানকে কেন ট্রাম্প তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিলেন, তা বুঝতে কারও বাকি থাকার কথা নয়। পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এখন ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি প্রাধান্য পাবে। দক্ষিণ চীন সাগরে তেল ও গ্যাসের যে বিপুল রিজার্ভ রয়েছে, তার হিসাব অনেকটা এরকম : তেল ১১ বিলিয়ন ব্যারেল, গ্যাস ১৯০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট। এখন ব্যবসায়ী ও সাবেক এক্সন মোবিল প্রধান এ ব্যাপারে তার ‘আগ্রহ’ অস্বীকার করবেন কীভাবে? ওবামা প্রশাসন এটা অনুধাবন করেই ভিয়েতনামের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছিলেন। তিনি ভিয়েতনামের সঙ্গে টিপিপি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন, যা ট্রাম্প বাতিল করবেন বলে জানিয়েছেন। এই তেল ও গ্যাস উত্তোলনের সঙ্গে ভারতও জড়িত। গেল বছর ভারতের চারটি যুদ্ধজাহাজ এ অঞ্চলে মোতায়েন করা হয়েছিল। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের যে স্ট্র্যাটেজি, তার অংশীদার ভারতও। অর্থাৎ এ অঞ্চলজুড়ে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র ঐক্য গড়ে উঠছে।

ওবামা প্রশাসন ২০০৭ সালে ভিয়েতনামকে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সদস্যপদ পেতে সমর্থন দিয়েছিল। ওবামা নিজে গেল বছরের জুনে ভিয়েতনাম সফর করেছিলেন। চীনের বিরুদ্ধে একটি বলয় তৈরিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন রয়েছে ভিয়েতনামের। ভিয়েতনাম হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের মার্কিন নীতির কেন্দ্রবিন্দু। ফলে ওবামার ভিয়েতনাম সফর শুধু সাধারণ একটি সফর ছিল না। চীনের বিরুদ্ধে সামরিক ও অর্থনৈতিক বলয় সৃষ্টি করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করছে। আর এই মহাপরিকল্পনায় একাধিক দেশকে জড়িত করছে যুক্তরাষ্ট্র। এখানে বলা ভালো, চীনের বিরুদ্ধে একটি সামরিক বলয় তৈরি করার অংশ হিসেবেই গেল বছর দক্ষিণ চীন সাগরে ফিলিপাইনসহ একাধিক দেশের সঙ্গে সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রকে পাঁচটি সামরিক ঘাঁটি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিল ফিলিপাইন। ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে ভারত দক্ষিণ চীন সাগরে তাদের নৌ ইস্টার্ন কমান্ডের চারটি গাইডেড মিসাইল সজ্জিত যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছিল। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ওই জাহাজগুলো দক্ষিণ চীন সাগর এবং উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে মোতায়েন করা হয়েছিল। এর অর্থ পরিষ্কার, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের চীনবিরোধী যে নীতি, তাতে ভারতকেও পাশে চায় যুক্তরাষ্ট্র। ভারত এ অঞ্চলে অন্যতম নৌশক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এর অংশ হিসেবেই দেশটি প্রথমবারের মতো তার ইস্টার্ন কমান্ডের চার যুদ্ধজাহাজকে এ অঞ্চলে মোতায়েন করেছিল। যদিও দক্ষিণ চীন সাগরে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে ভারতের স্বার্থ রয়েছে। ভারত ভিয়েতনামের সঙ্গে চুক্তি করে এ অঞ্চলে তেল ও গ্যাসের অনুসন্ধান চালাচ্ছে।

২০১৬ সালে ভিয়েতনামের ওপর থেকে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা এবং ৩২০ কোটি ডলারের ছয়টি ইলেকট্রিক সাবমেরিন বিক্রির যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে উসকে দেবে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ায় থাড ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যদিও বলা হচ্ছে, উত্তর কোরিয়ার ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখে দক্ষিণ কোরিয়াই এ সিদ্ধান্তটি নিয়েছে, তবে চীনে আধা ঘণ্টারও কম সময়ে আঘাত হানতে সক্ষম এমন হাইপারসনিক গ্লিড ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাও মোতায়েন করা হয় সেখানে। চীন বিষয়গুলোকে খুব সহজভাবে দেখছে না। এতে করে এ অঞ্চলে উত্তেজনা আরও বাড়বে। সর্বশেষ ট্রাম্পের এক চীন নীতি পরিত্যাগের হুমকি এ উত্তেজনায় নতুন মাত্রা এনে দেবে।

এখানে দক্ষিণ চীন সাগরের স্ট্র্যাটেজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন। আগামী দিনে এ অঞ্চলের রাজনীতির উত্থান-পতন বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। প্রায় ৩৫ লাখ বর্গকিলোমিটারজুড়ে রয়েছে চীন সাগরের বিস্তৃতি। এ অঞ্চলটি চীনের মূল ভূখণ্ডের দক্ষিণে, ফিলিপাইনের পশ্চিমে, মালয়েশিয়ার উত্তরে, ব্র“নাইয়ের উত্তর-পশ্চিমে, ইন্দোনেশিয়ার উত্তরে এবং ভিয়েতনামের পূর্বে অবস্থিত। এ অঞ্চলের গুরুত্ব বেড়েছে এ কারণে যে, দক্ষিণ চীন সাগরে প্রায় ১১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল রয়েছে। এবং গ্যাস রয়েছে ১৯০ দশমিক ২০ ট্রিলিয়ন ঘনমিটার। এই হিসাব আমরা পেয়েছি যুক্তরাষ্ট্র থেকে। চীনের প্রচুর ‘জ্বালানি ক্ষুধা’ রয়েছে। চীনের অর্থনীতিকে সঠিক পথে চালাতে প্রচুর জ্বালানি দরকার। সেক্ষেত্রে এ অঞ্চলে যদি চীনের কর্তৃত্ব থাকে, তাহলে দেশটি তার জ্বালানি চাহিদা এখান থেকে মেটাতে পারবে। এ সমুদ্রপথটি পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ত সমুদ্রপথ। এ কারণে এর গুরুত্ব আরও বেড়েছে। পৃথিবীর সব সমুদ্রপথে যত বাণিজ্য হয়, তার এক-তৃতীয়াংশ হয় এই পথে। চীন, জাপান, কোরিয়া, দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত স্প্রার্টলি, প্যারাসেল ও টনকিন উপসাগরে অবস্থিত কয়েকটি ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে আশপাশের দেশ, বিশেষ করে ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, তাইওয়ান ও মালয়েশিয়ার সঙ্গেই চীনের বিরোধ। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এ অঞ্চলের অর্থাৎ দক্ষিণ চীন সাগরের গুরুত্ব বেড়েছে একাধিক কারণে। চীনকে ‘ঘিরে ফেলা’ কিংবা চীনের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের দেশগুলোকে নিয়ে একটি ‘ঐক্য’ করার পাশাপাশি জাপানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক হুমকি মোকাবেলা করা এবং এ সাগর দিয়ে মার্কিন যুদ্ধজাহাজের প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করার ব্যাপারে মার্কিন স্বার্থ রয়েছে। এর উপরে রয়েছে এ এলাকার তেল ও গ্যাস সম্পদের ওপর মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানির লোলুপ দৃষ্টি। ফলে এ অঞ্চলটি যে আগামী দিনের প্রভাব বলয় বিস্তারের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা পালন করবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এ অঞ্চলে নিজেদের কর্তৃত্ব ও প্রভাব বলয় বৃদ্ধি করতে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, তাইওয়ান, জাপান, এমনকি ভারতও তৎপর। যুক্তরাষ্ট্র এ দেশগুলোকে পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করছে। এটি বিশ্বের বড় সমুদ্র-বাণিজ্য রুটগুলোর একটি। বিশ্ব বাণিজ্যের ৩২ ভাগ এ পথ দিয়ে প্রবাহিত হয়। চীনের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে এটি সংযুক্ত নয়। মূল ভূখণ্ড থেকে ১ হাজার নটিক্যাল দূরে এই দ্বীপপুঞ্জগুলো অবস্থিত। জাপান এই রুটকে ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল আমদানি করে এবং ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্যিক রুট হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। জাপান এই দ্বীপগুলোর নাম দিয়েছে সেনকাকু, যা চীনের কাছে পরিচিত দিয়াওইউ নামে। ঐতিহাসিকভাবে চীনের শি ও হান রাজবংশের কর্তৃত্ব অনুযায়ী চীন এ অঞ্চলের মালিকানা দাবি করে এলেও এ অঞ্চলের আশপাশের দেশগুলো তা মানতে নারাজ। জাপানের নিজস্ব কোনো তেল ও গ্যাস নেই। মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর দেশটি পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল। জাপান দৈনিক ১০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল এই সমুদ্রপথ ব্যবহার করে আমদানি করে থাকে।

স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব থাকায় চীন এ অঞ্চলে নতুন করে একটি কৃত্রিম দ্বীপ বানিয়েছে। সেখানে যুদ্ধবিমান মোতায়েনের জন্য বড় বড় রানওয়ে তৈরি করছে। মিসাইল ব্যাটারি স্থাপন করেছে। এমনকি আগামীতে এখানে যাতে পারমাণবিক সাবমেরিন ‘ডক’ করতে পারে, সে ব্যবস্থাও পাকাপাকি করেছে চীন। ফলে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে একটি আতংক ছড়িয়ে গেছে। আর যুক্তরাষ্ট্র এই আতংককে ব্যবহার করছে তার স্বার্থে। বলা ভালো, দক্ষিণ চীন সাগরের এই বিরোধ জাতিসংঘের সামুদ্রিক বিবাদ নিষ্পত্তি সংক্রান্ত ট্রাইব্যুনালে উত্থাপিত হয়েছিল। ফিলিপাইন ছিল এর উদ্যোক্তা। তবে চীন এই শুনানিতে অংশ নেয়নি। কিন্তু আদালত চীনের বিরুদ্ধে রায় দিলেও চীন কূটনীতিতে বড় সাফল্য পেয়েছে। নবনির্বাচিত ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট দুতার্তেকে চীন রাষ্ট্রীয় সফরে আমন্ত্রণ জানিয়ে ফিলিপাইনের সঙ্গে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলছে। দুতার্তের আমলে ফিলিপাইনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের যথেষ্ট অবনতি ঘটেছে। দুতার্তে ওবামাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছিলেন। দুতার্তের স্ট্র্যাটেজি থেকে বোঝা যায়, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর থেকে সব নির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে চান। ফিলিপাইনে মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে এবং মার্কিন সেনারা চুক্তিবলে একাধিক ফিলিপাইনের সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করে। এখন ট্রাম্পের শাসনামলে এই সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেটাও দেখার বিষয়।

ট্রাম্প প্রশাসনে একাধিক সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল রয়েছেন। তারা সবাই যুদ্ধবাজ এবং বহির্বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক ‘প্রভাব’ দেখতে চান। এখন ট্রাম্প যতই বলুন না কেন, তিনি আর ন্যাটোর খরচ বহন করবেন না, পেন্টাগন কি তা মানবে? পেন্টাগনের সামরিক স্ট্র্যাটেজিস্টরা চাইবেন এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের যে স্বার্থ, তা বজায় থাকুক। এর ফলে দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন নজরদারি থাকবে। ফলে চীনের সঙ্গে সম্ভাব্য দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়তে পারে ট্রাম্প প্রশাসন। এতদিন যুক্তরাষ্ট্র যে ‘এক চীন নীতি’ অনুসরণ করে আসছিল, তাতেও এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয়ের পর তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার ফোনে আলাপ হয়েছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ‘এক চীন নীতি’ পরিত্যাগ করতে পারেন এমন আশংকাও তৈরি হয়েছে। চীনে এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। চীন বলছে, এটি একটি মীমাংসিত বিষয়। এটা নিয়ে দরকষাকষি কিংবা আলাপ-আলোচনার কিছু নেই। ট্রাম্প তাইওয়ান প্রশ্নে নতুন করে আলোচনার কথা বলেছিলেন। চীন হুমকি দিয়ে সম্প্রতি বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র ‘এক চীন নীতি’ থেকে সরে দাঁড়ালে চীন যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুদের অস্ত্র সরবরাহ করবে। স্পষ্টতই এটা একটা হুমকি। ফলে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকল। যুক্তরাষ্ট্র এখানে জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকেও জড়িত করছে। আর এই নয়া স্ট্র্যাটেজিক অ্যালায়েন্সে ভারত পালন করতে যাচ্ছে একটি বড় ভূমিকা। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের পরমাণু সরবরাহকারী গোষ্ঠী বা এনএসজিতে ভারতের অন্তর্ভুক্তির (৪৮টি দেশ এর সদস্য। চীনের আপত্তি আছে ভারতের ব্যাপারে) প্রতি সম্মতি দিয়েছে। মিসাইল টেকনোলজি কনট্রোল রেজিম বা এমটিসিএ’তেও ভারত ঢুকতে চায়। নীতিগতভাবে তাতে সমর্থন রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। এতে করে অত্যাধুনিক মিসাইল টেকনোলজি পাবে ভারত। ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিনতে চায় এফ-১৬, ও এফ-১৮ জঙ্গি বিমান।

এটা স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক এখন অনেক উষ্ণ। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের যে স্ট্র্যাটেজি তাতে স্পষ্টতই ভারত পালন করতে যাচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। চীনের বিরুদ্ধে একটি বৃহত্তর অ্যালায়েন্স গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন ওবামা। তার Pivot to Asia-এর মূল দর্শনই হল চীনের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের দেশগুলোকে নিয়ে ঐক্য। এখন ট্রাম্প প্রশাসন এই নীতি নিয়ে এগিয়ে যাবে কিনা, সেটাই দেখার বিষয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইউরোপে প্রভাব বলয় বিস্তারের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে স্নায়ুযুুদ্ধের জন্ম হয়েছিল। এখন দৃশ্যপট বদলে যাচ্ছে। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল হয়ে উঠছে গুরুত্বপূর্ণ। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার দ্বন্দ্ব একটি বড় উত্তেজনার কারণ হতে পারে। এ ব্যাপারে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর লক্ষ্য থাকবে অনেকের।
Daily Jugantor
20.01.2017

0 comments:

Post a Comment